ইশতেহার ও অলপ্পেয়ে

নিজের একটা নাম থাকা দরকার এই মতো একটা ধারণায় পৌঁছে যায় লোকটি। তখনই আরেকটা ঝামেলায় পড়ে। কোনো নামই মাথায় আসে না।নাম দুটো মাথায় এলো পাখি হয়ে—শালিক আর চড়ুই। এমনও হতে পারে দুটো নয় একটাই নাম। এ আর রহমান এর মতো শালিক আর চড়ুই। কেউ নাম জিজ্ঞেস করে না। তাই বলতে হয় না। কোথাও নাম লিখতে হয় না। তবু তার কেন যেন মনে হয় একটা নাম থাকলে তার বেশ ভালোই লাগবে। 
কোনো নাম ছিল কিনা কে জানে। কিন্তু এখন নেই। আম্মা খুব শালিক দেখতো এক সময়। এক শালিক দৃষ্টির কোণ ছুঁয়ে গেছে কী যায়নি, আম্মার চোখ তখন পেঁপে গাছের পাতার আড়াল পেরিয়ে, মডেল স্কুলের কার্নিশ ছুঁয়ে বহুদূর দূর আরেকটি শালিকের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ায়। প্রতিটা জানলার কার্নিশে কয়েক মুহূর্ত থেমে তারপর নেমে আসে ঘাসের বুকে, সদ্য ঢালাই করা রাস্তায়। যেন দুই শালিক পাখি আম্মাকে সমুদয় সুখের সিমসিম মন্ত্রঃপূত গুহার হদিশ দিয়ে যাবে। তেমনটা না হলেও অন্তত একটা অতিরিক্ত দুঃখভোগ থেকে মুক্তি দেবে। এমন ভাবনায় নিজেকে ঘিরে রাখত আম্মা। চিন্তিত গলায় বলত—আরেকটা শালিক আশেপাশেই থাকবে।
লোকটা কৈশোরে আম্মার মতোই শালিক খুঁজত। আসলে আম্মার জন্যই খুঁজত। শালিকের ভাবনাটা মাকড়শার পুরু জালের মতো সমস্ত অস্তিত্বে পেঁচিয়ে যেত। টেনে ছিঁড়ে কিছুতেই অন্ধকার ওই জালের একেকটি পরত থেকে বের হওয়া যেত না। নাক কান মুখ জুড়ে সুতার জাল এমনই সেঁটে থাকত, শ্বাস পর্যন্ত নেয়া যেত না। অনেক কষ্টে কিছুটা বাতাস ওর নাকের কাছে পৌছতে পারত। দুটো শালিক দেখলে তবে মাথা থেকে ওই অস্বস্তির জাল খসে পড়ত। তার দুটো চোখ দশদিক ভ্রমণ করে আসত আর দাঁতে নখ কাটতে কাটতে হাতের দশটি আঙুলের দিকে তাকিয়ে খুব অপ্রতুল মনে হতো। আরও কয়েকটি আঙুল বেশি থাকলে নখ কেটে দাঁতের শিনশিনানি কমানো যেত।     
হতে পারে কৈশোরের দুটো শালিকের খোঁজেই তিনি বেরিয়েছেন। অথচ জীবনটা তাঁর একেবারে মন্দ ছিল না। বেসরকারি চাকরি থেকে সদ্য অবসরে গিয়ে একটা সকাল তাঁকে আপ্লুত করেছিল। এলিফ্যান্ট রোডের পনের তলা এক দালানের দোতলার বারান্দায় ঢুকে যাওয়া নিম গাছের পাতা দেখার সেটা ছিল এক আশ্চর্য সুযোগ। রিটায়ার্ড অফিসার অফিসকে মিস করেননি এমন নয়। একটা নামকরা এমএনসি’র প্রোকিওরমেন্ট ম্যানেজার ছিলেন। যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল সহকর্মীদের সাথে। অফিসে শেষদিন বিষাদগস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে সহকর্মীদের জন্য নয়, দীর্ঘদিন ব্যবহার করা বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল আর চেয়ারের জন্য। এমন কি টেবিলের ওপর রাখা ফাইল, পেন হোল্ডার, পেপার ওয়েট, ডেস্ক ক্যালেন্ডার আর একটা কাগজের বুক মার্কারের জন্য। কীভাবে এই বুক মার্কার তাঁর টেবিল পর্যন্ত এলো কে জানে? কাউকে জিজ্ঞেসও করেননি। বুক মার্কারের উলটো দিকে লেখা ছিল দৃক গ্যালারী। সেই বুক মার্কারটা ডেস্ক ক্যালেন্ডারের সাথে জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখেছিলেন। জড়’র প্রতি এমন টান আগে তিনি কখনও অনুভব করেননি। চারপাশের ফাইল ক্যাবিনেট, অফহোয়াইট দেয়ালে ভ্যান গঘের স্টারি নাইটের রেপ্লিকা নিঃশব্দে তাঁকে যেন কিছু বলছিল। পাশের ছোট টেবিলে একটা তামার নেমপ্লেট বাঁকা হয়ে ছিল দু সারি ফাইলের চাপে। বাঁ দিক নিচু, ডান দিক উঁচু। তাই নামের ‘আফতাব’ অংশটিকে ধারণা করে নিতে হলেও ‘মাহমুদ’ অংশটি স্পষ্টই নিজেকে ঘোষণা করছিল।      
দীর্ঘদিনের কোলিগ সালমা চৌধুরী সামনের চেয়ারে বসে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে গিয়ে লোকটার, যার নাম আফতাব মাহমুদ, অদ্ভুত এক দৃশ্য মনে পড়ে। বহুদিন আগে টিভিতে দেখা ওভাকনের বিজ্ঞাপন চিত্র। এক নারী ঝকঝকে স্বচ্ছ লম্বা কাচের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জন্মনিরোধক ট্যাবলেট মুখে দিল। হতে পারে সেটা মায়া বড়ি। এতদিন পর সঠিক ব্র্যান্ড নেম তাঁর মনে পড়ে না। দৃশ্যটা তাঁকে এতোটাই বিচলিত করে যে, হাত থেকে গ্লাসটা  ফ্লোরে পড়ে চৌচির। টুকরোগুলো ছিটকে সশব্দে অনেক দূর চলে গেল, সাথে নিয়ে গেল স্টারি নাইটের নীলাভ নৈঃশব্দ্য। কলবেলের ব্যাটারি ডাউন দেখে ভ্রু দুটো কুঁচকে ওঠে আফতাবের। কপালের বলিরেখাগুলো সে মুহূর্তে চৈত্রের খরায় ফেটে যাওয়া জমিনের মতোই গভীর হয়ে উঠেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সালমা চৌধুরী আবেগ চাপা পড়ে যায়। ধাতস্থ হয়ে মাথায় চুল ডান কানের  পেছনে ঠেলে দেন। ‘ইশ! কী হলো এটা!’ বলে ক্লিনারকে ডাকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন সালমা।               
অবসরের প্রথম দিনটি আফতাব মাহমুদের ভারমুক্ত লেগেছিল। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন অনেকক্ষণ। গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে ছায়া আর রোদ্দুর তাঁর পাঞ্জাবিতে জ্যামিতিক নকশা ফুটিয়ে তুলছিল।  বাতাস নিমের ডালটাকে আরও দক্ষিণে চাপিয়ে দিলে, নিমপাতার ছাপচিত্র পড়েছিল পাঞ্জারির বুকে, বাহুতে।  বাতাস থেমে গেলে ক্ষণিকের সেই ছাপচিত্র মুছে যায়। সেই থেকে শরীরের ওপর ছায়ার আসা-যাওয়া খেলাটা দেখতে আফতাব মাহমুদের ভালো লাগত। আলু ফুলকপির তরকারি ভালো লাগত। শোল মাছ দিয়ে লাউ কিংবা গরম রুটি আর বুটের ডালও। নিজেই ঘুরে ঘুরে বাজার করে আনতেন সেসব। টাটকা সজীব আলু ফুলকপি লাউ কিংবা ঝিঙা। যে কচি ঝিঙার গায়ে হলুদ ফুলের পাপড়ি আর রেণু লেগে থাকে আর জালি লাউয়ের গায়ে কুয়াশার মতো মিহি শাল। সাকা চৌধুরীর ফাঁসি নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। চ্যানেল বদলে বদলে চোখ উসখুস করত টেলিভিশনের স্ক্রিনে। টক শো অনুষ্ঠানে আর নিউজে। 
তখন রান্না ঘরে প্রেশার কুকার সিটি বাজাচ্ছে আর দরজার ওপারে পিউ’র হাত থেকে পেপার বিল নিচ্ছে হকার। এক সময় সেই ফাঁসিও কার্যকর হয়ে যায়। স্মার্ট ফোনে তখনও আফতাব অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, ম্যাসেঞ্জারে-হোয়াটস অ্যাপে যতটা তাঁর স্ত্রী রেহানা। প্রায়ই দেখা যেত একমাত্র মেয়ে পিউকে ডেকে অনলাইনে কী সব জিনিসপাতি খুঁজে বের করে দেখান রেহানা। মাঝে মাঝে ব্যাংকার ছেলের বউ মিথিলাও ওদের সাথে অনলাইন শপিং প্রক্রিয়ায় জুড়ে যায়। এই তিন নারীর সহাবস্থান দেখেই তাদের হয়তো সমমনা বলা যায় না। কিন্তু একটা শান্তির আভা টের পেতেন আফতাব।         
হলো কী, একদিন সবুজ পানকে আফতাব মাহমুদ বললেন সোনালি ধান আর লাল গোলাপকে একটা পেকে হলদে হয়ে যাওয়া শশা। নামগুলো গুলিয়ে গেল আপনাতেই।   
বারান্দায় অমন ধারা বসে থাকাটা রেহানার অস্বাভাবিক লেগেছিল। তবু আফতাবের এসব ভাবালুতা রেহানা  শুরুতে তেমন পাত্তা দেননি। সদ্য রিটায়ার করলে যা হতে পারে। এতো দিনের চাকরি, ছকবাঁধা রুটিনজীবন বদলে গেলে মানুষ এক রকম থাকে না। এটা রেহেনা বোঝে। প্রায় সবই ভুলে যাচ্ছেন আফতাব। একদিন পিউ’র দিকে অচেনা ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন, আরেকদিন সারা বিকেল বিপিএল দেখে রাতে বললেন ক্রিকেট খেলাই দেখেননি। কখনও বাজার করে ব্যাগ বাজারেই রেখে এলেন। রেহানা অবাক হয়েছে। আফতাব খুব জাঁদরেল ধরনের মানুষ না হলেও, এতটা শেকি-ভালনারেবলও নয়। তিনি ভেবেই নিলেন আফতাব খুব আনমনা হয়ে পড়েছেন। এক ছুটির দিনে রুমন আর মিথিলা এসেছিল। ডোরবেল শুনে দরজা খুলে দিলেন আফতাব। তারপর দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন—আপনি কে? কার কাছে এসেছেন?        
তারপর যা হয়, রেহানা অবিরাম ডাক্তারের চেম্বারে ছুটোছুটি করে, নিজের প্রেশার বাড়িয়ে, অসংখ্যবার আলু ফুলকপির তরকারি পুড়িয়ে অবশেষে একদিন শান্ত হয়ে গেল। যেন তিরতির করে বয়ে চলা নদীতে একটা ঘূর্ণি এসে বিশাল জলস্তম্ভ নিয়ে সাত আসমান ফুঁড়ে দিল। আছড়ে পড়ে তছনছ করে দিল সাজানো  জীবনজমিন। নরম বালিশের ওম রেহানার চোখের জল শুষে নিলে, তাঁর মনে হলো ওই নিম গাছটাই নষ্টের  গোড়া। গাছের সাথে ভাব করতে গিয়েই আফতাবের এই দশা। পিউ বিরক্ত হয় মায়ের কথায়। ততদিনে মা-মেয়ে অনলাইন শপিং এ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে থাকে রেহানা। পিউ এসে মাকে প্রেশারের ওষুধ খাওয়ায়। বাবাকে ঘুমের ওষুধ। ফ্লোরে পড়ে থাকা একটা কাগজের ফালি তুলে নেয়। একটা বুক মার্কার। নিচের অংশে একজন কৃষাঙ্গের ছবি, ওপরের দিকটায় কিছু কথা লেখা— 

আমরা মনে করি
আমাদের দেশে
কোনো সংখ্যালঘু বা
কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ
থাকবে না,
থাকবে শুধু মানুষ।

স্টিভ বিকো
১৯৪৬-১৯৭৭
বর্ণবাদ বিরোধী নেতা, দক্ষিণ আফ্রিকা

শীতের নরম রোদ্দুরেও আফতাব মাহমুদের কপালে চুলের গোড়ায় ঘাম চিকচিক করে। অনেকটা রাস্তা হেঁটে হাঁফিয়ে উঠেছেন। তবু শালিক খুঁজে পান না। গাছগাছালি কমতে কমতে শহর প্রায় ন্যাড়া। শালিক থাকবেই বা কই? লোকালয়ে মানুষের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়। তবু তো দিনভর মাঠ ঘাট পেরিয়ে গাছেই রাত কাটাতে হয়। 
সেই যে এক শালিক দেখার পর, আম্মার জন্য দ্বিতীয় একটি শালিক খুঁজতে গিয়ে কত কিছুই জেনে  গিয়েছিলেন। শালিকের রঙ, শালিকের ডাক। তাঁর মনে হয়েছিল শালিক মন দিয়ে দেখার মতো। মাথা, ঘাড় আর লেজ কালচে। বাকি অংশ কালচে বাদামি। চোখ, ঠোঁট আর নখ হলদে। কিন্তু দেখে খুব মুগ্ধ হয়ে ছিলেন তা না। বরং রহস্য পত্রিকা পড়ে যখন জেনেছিলেন হিমালয়ের সেই কোনো উঁচুতেও নাকি শালিক বাসা বানায়, রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। প্রায়ই ভাবতেন আয়ুষ্কালে একদিন শালিক খুঁজতে খুঁজতে  হিমালয় পর্বতে চলে যাবেন। কতদিন তিনি জোড়া শালিক দেখেন না। খুঁজে বেড়ান। অথচ ঘরের ভেতর জোড়া শালিক পোষার ভাবনা কখনও মাথায় আসেনি, এটা ভারী আশ্চর্যজনক ব্যাপার মনে হয় তাঁর।   
শালিক বিষয়ক এসব চিন্তার মাঝখানে ফুটন্ত চায়ের ভাপ নাকে এসে সুড়সুড়ি দেয়। সামনে চায়ের টঙ দোকান। সেদিকেই এগিয়ে যান। শীতের হিম হিম আমেজে এক কাপ চায়ে গরম চুমুক দিতে ভালোই লাগবে বলে তাঁর মনে হয়। আসলে এই ভেষজ পাতার স্বাদ আর সুঘ্রাণ শীতে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। পাড়ার মালেক সরকারও চায়ের টঙে বসে আছেন। আফতাবের চেয়ে বয়সে কিছু ছোটই হবেন। তিনি মালেক সাহেবকে ঠিক চিনতে পেরেছেন এমন না। তবে মালেক সাহেবকে তাঁর কেমন চেনা চেনা লাগে।      
মালেক সাহেবই আগে কথা বলেন—আসেন, আসেন, খবর কী বলেন?   
খবর কী সেটা জানেন না আফতাব। তাকিয়ে দেখেন মালেক সাহেবের হাতে আধছেলা কমলা। মালেক সাহেব অর্ধেকটা কমলা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন—খান এইটা। মিষ্টি আছে। টক কিছু খাইতে পারি না। অ্যাসিডিটি হয়।  
চায়ের বদলে কমলার রসে আফতাবের মুখ ভরে যায়। পিচিক করে অফহোয়াইট রঙের দুটো বিচি মুখ থেকে ছুঁড়ে ফেলে বলেন—কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স কাপ জিতবে। কী বলেন?  
কমলার বিচি দুটো বেশি দূর যায় না। দু পায়ের সামনে পড়ে থাকে। একটা পিঁপড়া কমলার বিচির পাশ ঘেঁষে চলে যায়।  
—বিপিএল? জানি না ভাই। খেলা দেখনের টাইম পাই না।  
— ভিক্টোরিয়ান্স আর রংপুর রাইডার্সের মধ্যে ফাইনাল হবে। 
আফতাবের মনে পড়ে, যে বার বিপিএলের প্রথম আসর শুরু হয়, শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রুমন আর পিউকে নিয়ে গেছিলেন ফাইনাল খেলা দেখতে। ছেলে-মেয়ে দুটোরই বাবার মতো ক্রিকেটের নেশা। গ্যালারিতে ঢুকবেন, তখনই পা ফসকে পিউ আছাড় খেলো। টনটনে ব্যথা নিয়েই মেয়েটা পুরো খেলা দেখল। কোক খেলো, পপকর্ন খেলো।    
—স্যার, ফাইনাল হইয়া গেছে। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কাপ জিতছে। মালেক সাহেবের হাতে প্লাস্টিকের ওয়ান  টাইম চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে দাগধরা হলুদ দাঁত বের করে হাসে চাওয়ালা। 
— অ্যাঁ! কী কও!  
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া চ্যাম্পিয়ান হয়েছে জেনে ভারি আমোদ হয় আফতাবের। চাওয়ালার কাছ থেকে এক কাপ চা নেন। চাওয়ালা কয়েক প্যাকেট গোল্ডলিফ স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কৌটায় তুলে রাখে। লাল ঢাকনিটা শক্ত করে পেঁচিয়ে কৌটার মুখ লাগায়। 
মালেক সাহেবকে ফের প্রশ্ন করেন আফতাব—আপনার ছেলে তো ব্যাংকার তাই না?     
— হ্যাঁ, সকালে যায় রাতে ফিরে। এইটা কোনো জীবন হইল?  
— নিজেও তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিস করেছেন! প্রোকিওরমেন্টের ম্যানেজার ছিলেন, রিটায়ার না করলে অফিস টাইমে কমলা খেতে পারতেন?   
মালেক সাহেব হেসে ফেলেন সশব্দে—আপনে ভাই মজার মানুষ। আমি কিসের প্রোকিওরমেন্টে? শেয়ার ব্যবসা করি। আজকে শুক্রবার না? স্টক মার্কেট বন্ধ।  
আফতাব সাহেবও হেসে ফেলেন—তাই নাকি? খেয়াল নাই। আসি, ভাই। রেহানা ভাবী আর পিউরে নিয়া নিয়ে বাসায় আইসেন।
মালেক সাহেব এবার আর হাসেন না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন আফতাবের দিকে। অবাক হয়ে বলেন—হায় খোদা! রেহানা ভাবী তো আপনের বউ! পিউ আপনের মেয়ে! কী বলতেছেন এইসব?  
চা কিংবা কমলালেবুর পরস্পর বিপরীত স্বাদ আফতাবকে প্রবল দোটানায় ফেলে দিলে, মালেক সাহেবের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখেন, নীলাভ আকাশটা খুব শান্ত। যেন কেউ বুঝিয়েছে, অশান্ত হতে নেই। 
স্পষ্ট দেখলেন তিনি, সেই স্থিরতার মাঝেই নিখুঁতভাবে শালিকের ঝাঁক উড়ে গেল।    
— ওহ! আপনি তাহলে আফতাব মাহমুদ সাহেব না?     
—না। আমি মালেক। মালেক সরকার। আফতাব ভাই, আপনে বাসায় যান। দাঁড়ান, আমিই যাইতেছি আপনার সাথে। চলেন।   
একটা কিছু গোলমেলে ঠেকে আফতাবের কাছে—না, আমি যেতে পারব। আপনি চা খান।  
ভ্রু কুঁচকে যায় মালেক সাহেবের। পাগলের সাথে তর্কে যেতে চান না। চিন্তিত গলায় বলেন—যাইতে  পারবেন? বাসায় গিয়া ফোন দিয়েন। না থাক, আমিই ফোন দিব।   
কমলা হাতে হাঁটতে থাকেন আফতাব মাহমুদ। ডান হাতের মুঠো থেকে যতটুকু দেখা যায় কমলার ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আভা তাঁকে কী এক আচ্ছন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। হাঁটতেই থাকেন আফতাব। যেতে যেতে শহর নগর বন্দর পেরিয়ে যান। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যখন হামলা হলো শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে তিনি তখন আরও দূরে কোথাও। হাইড্রোলিক হর্নের শব্দ শুনতে শুনতে কখনও বাসে যান, কখনও জোয়ার ভাটা দেখতে দেখতে শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকায় যান। পুবে যান, পশ্চিমে যান। এরই মধ্যে সূর্যে গ্রহণ লাগে, বছর জুড়ে গুম হয়ে যায় ৮০ জন মানুষ। 
মসজিদের খোলা ওজুখানায় গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নেন আফতাব। পানির স্পর্শে  ধুলোবালি মুছে যায় মুহূর্তে। মাটিতে বুক ঘষে ঘষে ওজুর পানি এগিয়ে যায় নালার দিকে। আর আফতাব মাহমুদের মনে হয় নিখোঁজেরা কখনও ফিরে আসে কিংবা আর আসে না। যে আসে, সে হারিয়ে যাওয়ার আগের মানুষটি নয়। গুটিয়ে যাওয়া মানুষ। পুরনো স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে না পারা দলছুট, নিজের ভেতর ছুটে পালানো কষ্টের একজন। ততক্ষণে ওজুর পানি মিশে গেছে নালার বাদবাকি বিস্তীর্ণ প্রবাহের সাথে।            
আফতাব জানতেও পারেন না বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা। নালার চেয়েও বড়, সুবিশাল জলরাশি ঠেলে মানুষের ঢল নামে টেকনাফ সীমান্তে। নাফের পানিতে মরা রোহিঙ্গা ভেসে ওঠে মাছের মতো আর অং সান সুচি স্থানীয় গণমাধ্যমে বলে—মিয়ানমার সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। বাঁ কানের পেছন থেকে উঁকি দেয়া, খোঁপায় গোঁজা সাদা ফুলের গুচ্ছের দিকে যতবার তাকিয়েছেন আফতাব মুগ্ধ হয়েছেন। সেই ফুলের গুচ্ছ আর এই মানুষ হত্যার সমর্থন—এমন অসঙ্গতির মুখোমুখি হয়ে আফতাব বুঝতে  পারে না তাঁর কী করা উচিত। আসলে হয় কি, সকালের আকাশের রঙ বিকেলে অন্য রকম হয়ে যায় আর আফতাব জানতেই পারেন না। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য ভাইরাল হয়ে যায় ইউটিউব ও ফেসবুকে। এর আগেই মসজিদের বারান্দায় পাতা চাটাইয়ে ঘুম নামে। চোখের পাতা ঘুম-ঘুম তরলে ডুবে যায়।       
সেই কবে দুই শালিক খুঁজতে গিয়ে জোনাকি সিনামা হলের সামনে দাঁড়িয়ে বেদের মেয়ের পোস্টার দেখছিল এক কিশোর। অঞ্জু ঘোষ তখন ‘জোছনা’য় প্রতিস্থাপিত হয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে। ফলস আইল্যাশের ভেতর দিয়ে সাপের চোখের মতো বেদেনীর দুটো চোখ যেন কিশোরের ভেতরের সমস্তটুকু দেখে নিচ্ছে। ফর্সা গাল  দুটো লাল হয়ে যায় কিন্তু তবু সম্মোহিতের মতো সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। সারা বিকেল আম্মা হেমন্ত মুখার্জীর গান শোনেন। টুইনওয়ানে যখন ক্যাসেটের ফিতা আটকালো ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে একবার বারান্দায় আরেকবার ঘরের জানলার কাছে এসে দাঁড়ান। মাগরিবের নামাজের পর ছেলে ফিরে এলে তালের পাখার ডাঁট দিয়ে ডান বাহুতে দুটো বাড়ি মারেন। কিশোরের বড় বড় চোখের দীর্ঘ পল্লবে পানি আটকে টলটল করে। আম্মা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। হাত পাখা ছুঁড়ে ফেলে দেন আর সবুজাভ জামবাক ডলে দেন হাতের ফুলে ওঠা জায়গায়। জামবাকের গন্ধে চারপাশটা ভরে উঠলে সে মুখস্থ করতে থাকে ইংরেজি রচনা—এইম ইন লাইফ। আম্মা দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দেন।   
আসরের ওয়াক্ত শুরু হলে ইমাম সাহেব মমতাভরা ভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন ঘুমন্ত আফতাবের দিকে। মেহেদিলাল দাঁড়িতে হাত বুলান। ঝুঁকে দেখেন আফতাবকে। আল্লাহর বান্দার জন্য দোয়া করেন। আফতাব চোখে মেলেন। বেদের মেয়ে জোছনার চোখ, মায়ের চোখ, ইমাম সাহেবের চোখ নিয়ে বিভ্রান্ত হন। তারপর ঘুম ভেঙে গেলে অনন্ত সময় ধরে কেবল হাঁটতেই থাকেন। কখনও জিরিয়ে নেন ঘাসের গন্ধ বুকে নিয়ে। হাওয়া তখন কপালের বুকের বিন্দু বিন্দু ঘাম শুষে নেয় আর মেঘের দেশে ডুব সাঁতার দিয়ে চাঁদ জাগে। আফতাব মাহমুদ হাঁটতেই থাকেন। দক্ষিণে যান, উত্তরে যান। এ সময়ে পূর্ণিমা হয়, অমাবস্যা হয়। শালিক খুঁজতে খুঁজতে এক সময় টের পান সমস্তটা জুড়ে সকাল হচ্ছে।   
স্টেশানের লোক গমগম করে। দেখে ভারী আনন্দ হয় আফতাব মাহমুদের। ছেড়ে যাবার অপেক্ষায় ট্রেনের দাঁড়িয়ে থাকা আর চলে যাওয়া দেখতে ভালো লাগে। কোথায় কোথায় যে চলে যান ট্রেনের বগিতে চেপে।  লোয়ার বার্থে বসা টপ-জিন্স পরা মেয়েটা যখন চুল আঁচড়ায়, আফতাবের হৃদয় বিস্মিত হয়ে যায়। আত্মা  আলুথালু হয়ে যায়। তিনি উঠে গিয়ে বলেন—পিউ! অনলাইনে আজ কী কিনলি? ঘুমের ওষুধ এনেছিস?    
জিন্স পরা মেয়েটা কিছুই বলে না। কানে ইয়ারফোন গুঁজে জানলার দিকে চেপে বসে। আফতাবের বিষণ্ণতা সেই জানলা দিয়ে বেরিয়ে আকাশে ছড়িয়ে যায়। এমন বিষণ্ণ তিনি হয়েছিলেন আখ মাড়াইয়ের নাম করে যেদিন পুলিশ আর চিনিকলের কর্মচারীরা সাঁওতাল পল্লীতে হামলা করেছিলো। পথের লোকজন বলছিল—  আগুন নাগায় মানুষ পুড়ায় বাইর কর দিসে।    
ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আফতাব। কী যেন আলু ফুলকপি কিংবা শোল মাছ দিয়ে লাউ তরকারির কথা তাঁর মনে পড়ে। সাদাসিধে চেহারার এক লোক অনেক্ষণ ধরে দেখছিল আফতাবের রোগা, ক্ষয়াটে চেহারা। কাছে এসে বলে—কিছু খাবু?       
সঙ্কোচে আফতাব বলেন—আমি শ্যামল হেমব্রম। খিদে পেয়েছে, খাওয়াতে পারবেন? 
—ভিতরে আসো।     
‘আল্লার দান’ নাম ছিল ভাতের হোটেলের। চারদিকে সস্তার ছাপ। কলা আম আপেলের ছবি আঁকা টেবিল ক্লথ পাতা। মাছি উড়ছে টেবিলের উচ্ছিষ্ট ভাত ডালের ওপর। প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসে আফতাব। 
ওই লোক ফের জিজ্ঞেস করে—শ্যামলরে ক্যাঙ্কা করে চেনো? নাম কোটে শুনলা?   
অপরিষ্কার প্লাস্টিকের জগ থেকে পানি ঢেলে খায় আফতাব। শুনেছিল অভিযোগপত্রে মূল আসামীদের নাম বাদ পড়ে যায়। আক্রান্তরাই আসামী। তবুও তো ক্ষুধাবোধ জাগ্রত হয়। তৃষ্ণার্তরা গলা ভেজানোর জন্য সুপেয় পানি খোঁজে। তাই ডিমের তরকারি আর ডাল দিয়ে ভাত খায় আফতাব মাহমুদ আর নিষ্প্রাণ শ্যামল হেমব্রম, রমেশ টুডু, মঙ্গল মার্ডির পূর্ব পুরুষের ভিটা-মাটি ফিরে পাবার স্বপ্নমাখা চোখ তাকিয়ে দেখে অসম্ভব উঁচু ওই আকাশ।    
এই রকম যেতে যেতে কই যে চলে এলেন তিনি আর বুঝতে পারেন না। অজস্র পথ বেয়ে শুনেন ইয়ে কাঁহা আগেয়ে হাম... কথা আর সুর উড়ে আসে সিডির দোকান থেকে। বাজারের কিছু দূরে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আফতাব। বাতাসে চুল আর পাঞ্জাবি উড়ছে। রোদে পুড়ে ত্বকের পিগমেন্ট বিবর্তিত হয়েছে। রঙ ধরেছে ক্যারামেল সিরাপের মতো।  
এক উশকোখুশকো ভবঘুরে এসে দাঁড়ায় আফতাব মাহমুদের পাশে। চোখে তার প্রশ্নের ঢেউ উছলায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করে—ভাইজান, আপনের নাম কী? আমার নাম নজরুল। এলাকায় নতুন দেকতাছি। 
ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে যায়—ড. মুহম্মদ ইউনুস।   
— ইউনুস বাই। কার বাইত আইছেন? 
— গ্রামীণ ব্যাংকের কাজে এসেছি। মাইক্রো ক্রেডিট প্রজেক্ট।   
— আপনে নোবেল পুরুষ্কার পাইছেন? 
— হুম… কী যেন ভাবেন আফতাব… আনমনে কিছুটা যেন জিজ্ঞাসু হয়ে বলেন—সেটা তো ড. ইউনুসই  পেয়েছিল।   
হা হা করে হাসে নজরুল- মাথায় ডিস্টাব আছে। শালার নতুন পাগলের আমদানী।   
নজরুলের কথার গুরুত্ব দেন না আফতাব। জিজ্ঞেস করেন—আচ্ছা ভাই, বাসস্ট্যান্ড কত দূরে? এখান থেকে  এলিফ্যান্ট রোডের বাস পাওয়া যাবে?
— মানে? কুমিল্লায় এলিফ্যান রোডের বাস কই পাইবেন? 
— বাসায় যাব কিভাবে?   
— ঢাকায় যাইবেন? বাস ধরেন। ঠিকানা জানেন?   
মুখ ঘুরিয়ে নেন আফতাব। উত্তর না দিয়েই। যেন লোকটার দিকে না তাকালেই লোকটা নেই হয়ে যাবে। ব্রিজের রেলিং ধরে ঝুঁকে নিচটা দেখেন। অগাধ শুকনো মাটি আর বালু পড়ে আছে। চিরে দিলেই ভুরভুর করে বালু উঠবে। উড়বে শুষ্ক হাওয়ায়। ভরা বর্ষায় এই শুকনো ভূমিই কিউসেক কিউসেক পানি গিলে নরম হবে। হঠাৎ অদৃশ্য নদীটা দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। মিলিয়ে যাবার আগেই আফতাব মাহমুদ খুব মনযোগ দিয়ে নদী দেখার চেষ্টা করলে, একটু যেন ঢেউয়ের শব্দও শুনতে পান। চ্ছলাৎ চ্ছল শুনতে শুনতে এই নদীর নাম দেন এমএনআর। মাল্টি ন্যাশনাল রিভার। নদীর পর নিজের একটা নাম থাকা দরকার এই মতো একটা ধারণায় তিনি পৌঁছে যান। তখনই আরেকটা ঝামেলায় পড়েন। কোনো নামই মাথায় আসে না। 
ব্রিজ থেকে নেমে আফতাব হাঁটতে থাকেন। জোড়া শালিকের জন্য কত দূর যে যেতে হয়, কে তার খবর রাখে! হয়তো অনন্য উচ্চতায়, কোনো এক আবছা হিমালয়ে। আফতাব নিজেই জানেন না, এই অভীষ্টতম সত্য কিংবা বিভ্রান্তির খোঁজে, কি কুয়াশা কি ধূলা ছড়িয়ে, কত কাল গত হয়ে যায়। 
সমস্ত চেতনা ধূসরতায় ফুরিয়ে আফতাব হাঁটতেই থাকেন। আলোয় অন্ধকারে বহুদূরে। যতক্ষণ না অস্তিত্ব ঝাপসা হয়ে আসে।


ইশরাত তানিয়া, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক, ঢাকা

menu
menu