ট্রমা পরবর্তী ভাইবোন

(কাজী মোহাম্মদ আলমগীর নব্বইয়ের দশকের গল্পকার। প্রচারবিমুখ এই লেখক মফস্বলে বসবাস করলেও বিশ্বসাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। বহুরৈখিকতা মধু তাঁর গল্পের অন্তরে বাহিরে। বিষও আছে। ট্রমা পরবর্তী ভাইবোন তাঁর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। লেখকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ প্রকাশের ১৩ বছর পর অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২১ স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে প্রকাশিতব্য। সমঝদার পাঠক তাঁর গল্পে খুঁজে পাবেন অন্য এক ভুবনের সন্ধান। তাঁর পাণ্ডুলিপির একটি গল্প থাকছে ঘুংঘুর-এর পাঠকের জন্য।)

বালকের সিনেমা দেখা

বালক সিনেমা দেখতে  গিয়েছিলো কিন্তু ফিরে এসেছে মোটা গোঁপওয়ালা এক লোকের মুখ নিয়ে; সেই মুখ এখনো তার মগজের ভেতর ঝুলে আছে। সাতভাই চম্পার সামনে; পর্দার সম্মুখভাগে, বিশালমুখ। কোনভাবে সরাতে পারছে না । চেষ্টা করলে আরো তীব্রভাবে ধেয়ে আসে। চলন্ত বাসের বাইরে চোখ রাখলে কাচের শরীরে সেই মুখ ভেঙে ভেঙে জোড়া লাগে। বালক জামার আস্তিনে নিজের মুখ লুকালে দম বন্ধ হয়ে আসে। তার ইসমাইল চাচাকে ডাকতে ইচ্ছে হয়। চাচাও যেনো তাকে ডাকে, ঠিক ডাকে না, জোর দিয়ে বলার মতো করে বলে, দেহিচ কিন্তু একা একা সিনেমা দেখতে যাইচ না। সমস্যায় পড়বি।
একা গেলে কী হয় ?
কিছু হয় না। হতে পারে। দিক ভুল হতে পারে। টাকা হারিয়ে যেতে পারে। কেউ পা মারিয়ে দিতে পারে। কেউ সাথে নেই তাই ভেতরটায় কেমন অসহায় মনে হতে পারে। এসব তো ইসমাইল চাচার ভেতরের কথা। অথবা বাহিরের কথা। বললে যেমন, না বললেও তেমন। 
আশির দশক, গ্রাম থেকে কোন ছেলে  সিনেমা দেখতে শহরে এলে এমন বাধার সম্মুখীন হওয়া ছিলো স্বাভাবিক। বালকের মগজের ভেতর ঝুলে থাকা বিশাল গোঁপওয়ালা মুখের  সাক্ষাৎ আমারও পেয়ে যাবো।
অথচ বালক সিনেমা দেখে বাড়িতে গিয়ে সিনেমার কাহিনী বলে  অহিদ মিয়ার লাড্ডু দোকান থেকে লাড্ডু খেতো, বন্ধুরা জিজ্ঞেস করতো—তারপর, তারপর কী হলো। বালক এখন কী হয়েছে বলতে পারবে না। আবার ছুবল নেয়া সাপরমত ধেয়ে আসে সেই মুখ। বালক ভাবে, জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়, ...এই মিয়া সিনেমাটা কি আপনার বাবার। বাতাসের শরীরে  এ প্রশ্ন জন্ম নেয়ার আগে জবাবের উৎসে চলে যায়। বালকের মনের বয়স কদুকাণ্ডের মতো লকলকিয়ে বাড়ে। এসবের সঙ্গে যোগ থাকতে পারে চাচা ইসমাইলের গুরু বিদ্যা।
বাপরে, উত্তর দিতে লোকটা যেনো আগেভাগে তৈরি ছিলো, ...বাবার সিনেমা হল থাকলে কেউ বেলেক করে। আমাদেরকে মাঝে মাঝে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়, সেই খবর কি তুমি জানো ?
পুলিশে নিলে আবার ব্লেক করতে আসেন কেন?
পুলিশে নিলেও আমাদের সাজা হয় না। সিনেমা হলের টিকেট বেলেক করলে মাত্র ৫০ টাকা জরিমানা। আইনটা অনেক পুরাতন, একবারে সোজা। তোমার মতো। 
আপনিও (পাঠক) ভাবতে পারেন, পৃথিবীর প্রান্তে জন্ম নেয়া  এমন সরল ছেলেরা মাঠে মাঠে ঘুরে ঘুরে বড় হয়, তারা বাঁকা হতে পারে না, কেবল সোজা থাকে। কেবলি সোজা। 
বাসটা শহরের দিকে বিভিন্ন জ্যামিতিতে ছুটে চলার সময় ভাবতে শুরু করেছিলো বালক, সমস্যায় পরলে কি করবে, চাচা তো বলেছিলো, দেহিচ একা সিনেমা দেখতে যাইচ না। সমস্যায় পড়বি। 
শেষ পর্যন্ত চাচার কথা সত্য হলো।
বাস থেকে নেমে চলমান মানুষের মুখ থেকে একটা মুখ বেছে নিতে সময় লাগলো বালকের। শহরের প্রতিটা বোকা মানুষও উদবিড়ালের মতো চতুর।  শহরে কি শুধু চালাক লোকই বাস করে। আবার মনে হয়েছিলো শহরের মানুষগুলো চালাক বা বোকা বড় কথা নয়, সে যে গ্রাম থেকে এসেছে এটা যেন কোথাও লিখা আছে, ভেসে আছে, অথবা হাঁটার গতিতে, মুখের হাসির রেখায় ফুটে আছে। গালে থাকা তিলের মতো যা কখনো মুছা যায় না। অবশেষে একজনকে তার মনে ধরে, তার কাছে জানতে চায়, মধুনিতা সিনেমা হলটা কোনদিকে। লোকটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলো, একবারে স্বাভাবিক হাসি, কিন্তু তার মনে হয়েছে, কুটিল হাসি, শহুরে হাসি। লোকটি বলেছিলো, মধুনিতা নয়, মধুরিতা। শুরুতে ধাক্কা। বালক লজ্জা পায়। এমন সামান্য পার্থক্য কেউ কথার আঁকশি দিয়ে আকরে ধরে! শহরের মানুষ যেন শাসন করতে মুখিয়ে থাকে। সব যেন শিক্ষক। তারপরও বালক বলেছিল, জী;  ঐ সিনেমা হল কোন দিকে আমি ঠিক জানি না। লোকটির অফুরাণ সময়। বলবে, একটু ভালোভাবে বলবে, আকাশে ডানা ছড়ানো ঈগলের মত ভাসতে ভাসতে বলবে। থাকে ,শহরে এমন লোকও কদাচিৎ থাকে। 
তুমি, সাত ভাই চম্পা দেখতে এসেছো। বালক গোয়ালে বাঁধা গরুর মতো মাথা দুলিয়ে বলে, জী, সাত ভাই চম্পা দেখতে এসেছি। লোকটি  চলো বলে তাকে নিয়ে আরো এগিয়ে যায়। কথা না বললে দুজনের মাঝে নীরবতা ঘুনপোকা হয়ে উঠতে পারে, সময় কেটে বের হয়ে অন্য দিকে চলে যাবে। পথের পরিচয় এমনি। লোকটি বলে, ছবিটা প্রথমে সাধা কালো ছিলো, নতুন করে রঙিন করা হয়েছে, তাই ছবির নাম রঙিন সাত ভাই চম্পা। সাতটি ভাই হলো শক্তির চিহ্ন। চম্পা হলো বিপদের চিহ্ন। এখন তুমি হলে চম্পা।  তুমি একা ছবি দেখতে এসেছো, আর কেউ আসে নি? প্রশ্ন শুনে আবার তার চাচার কথা মনে পরল। শহরের মানুষের টের পাওয়ার ক্ষমতাও যেন বেশি। চাচা যেন এ কথাগুল বলতে বাকি রেখে ছিল। লোকটি বলে, চলো তোমাকে হল পর্যন্ত এগিয়ে দেই; আমি ঐ দিকে যাবো, চলো। বালক ভার মুক্ত হয়। মেলায় হারিয়ে গিয়ে প্রতিবেশির খুঁজ পেয়ে  শক্ত করে আঙ্গুলে ধরার মত। লোকটা যেন তার ইসমাইল চাচা। লোকটা তাকে সিনেমা হলে পৌঁছে দিতে দায়িত্ব নিয়েছে। যেতে যেতে লোকটি তাকে আরো প্রশ্ন করে। বালক প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেয়। বালকের কাছে টাকা থাকলে বল তো, আপনি আমার সঙ্গে ছবিটা দেখতে পারেন। কিন্তু টাকা বেশি থাকলে তো সে ইসমাইল চাচাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে আসত। লোকটি বালককে জ্ঞান দিতে লাগল, আমরা পশ্চিম দিকে হাঁটছি। সিনেমা হলটা হাতের বাম দিকে। সামনে সামান্য দোকানপাট আছে, লোকে বলে মধুরিতা মার্কেট, প্রথমে ছিল গান রেকর্ডিং আর ছবি তোলার স্টুডিও, সংখ্যায় অনেক, পরে বদলাতে শুরু করল, ক্রোকারিজ দোকান, ভূমি কেনা বেচার অফিস, কতো কিছু হল। সিনেমা হলটাকে চেনার জন্য চিহ্ন হিসাবে মনে রাখতে পারো, উল্টো দিকে একটা মসজিদ রয়েছে। শহরের বড় মসজিদগুলোর একটি। এখানে ছাতি দোকানের চেয়ে স্বর্ণদোকান বেশি। লোকটির কথা শুনতে শুনতে বালকের ভয় ভীতি দূর হয়ে মনটা একবারে ঝর ঝরে হয়ে গেল। 
সিনেমা হলের সামনে এসে লোকটি তার চলার গতি শ্লথ করে, তারপর আঙুল উঁচিয়ে বলে, ঐ যে তোমার মধুরিতা সিনেমা হল, যাও, কোন অসুবিধা নেই। ঐ দেখো রঙিন সাত ভাই চম্পা।
লোকটি বালককে ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বালকের মনে হল সে যেন টলে যাবে, এক্ষুনি পড়ে যাবে। ইস্! লোকটি যদি তাকে টিকেট কেটে সিনেমা হলে বসিয়ে দিয়ে হলের লোকদেরকে বলে দিত, ওর দিকে লক্ষ্য রাখবেন। ওর যেন কোন অসুবিধা না হয়। অসুবিধা হলে ভাল হবে না। আমার দোকান ঐ যে হলের পাশে। মনে থাকে যেন, ও আমার ভাগিনা।
কিন্তু পথে দেখা মানুষেরা কে কার ভাগিনা! 
বালক ধীরে ধীরে সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উল্টো (উত্তর) দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সিনেমা হল। সকালের আলো সিনেমা হলের ছাদের উপর আটকে থাকে রোদে দেয়া ভেজা চাদরের মতো। দুপুরেও সামনের অংশে আলো পড়ে না। সামনের অংশে কেমন শীত শীত, বালক সামান্য কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়, দুই পকেটে দুই হাত, তার নড়তে ইচ্ছে হয় না। টিকেট কাউন্টারে ভিড়। ব্ল্যাক করে এমন সাত আটজন লোক মুখে খৈ ফুটাচ্ছে, ...এই ফাস ক্লাস... ওই সেকেন ক্লাস ...ওই অপেরা ডিসি...। বালক সিদ্বান্ত নেয় ফার্স্ট্র ক্লাসের টিকেট নিবে। কালো বাজারে কিনতে হবে। কাউন্টারে ঠেলাঠেলি করে বাইং মাছের মতো পিছলে পুছলে ভেতরে ঢুকে টিকেট নিতে পারবে না। তাহলে কার থেকে কেনা যায়। কোন একজনের চোখাচোখি হলে পরে কথা। বালক নীরবভাবে বরান্দায় ঝুলানো স্থির বিজ্ঞাপন চিত্রে চোখ বুলায়, চোখ রাখে। এসবকে বলা হয় বারেন্দা সু। গ্রাম থেকে আসা দর্শকদের বারেন্দা—সু দেখার সময় কম। এ পর্যন্ত যতবার বালক সিনেমা দেখেছে ততবার ইসমাইল চাচার সঙ্গে দেখেছে। মধুরিতাতে একবারও দেখেনি,এ পথে কখন আসেনি; এবারেই প্রথম। বারেন্দায় ঝুলিয়ে রাখা ছবি থেকে চোখ সরালে বালকের দৃষ্টি কেড়ে নেয় এক ব্ল্যাককার, কালো বাজারি, ...তুমি ছবি দেখবা মিয়া? বালক মাথা নেড়ে সায় দেয়। লোকটি জানতে চায় কোন ক্লাসে দেখবে । 
প্রথম শ্রেণিতে।
তাহলে টেকা দেও।   
কত ? 
এভাবে দুজনের মধ্যে কথা চালাচালি চলে। বালক পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়। কালো বাজারি লোকটি বলে আমার নাম রাফিজ, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি তোমাকে টিকেট দেমু, এই তো, এখুনি দেমু। তারপর রাফিজ তার টিকেট বিক্রির গদবাঁধা বিজ্ঞাপন চালিয়ে যেতে থাকে। রাফিজ বালককে কেন পরে টিকেট দেবে! রাফিজের প্রস্তাবে বালকের শরীরমন কেমন করে উঠে। ...লোকটি কি টের পেয়ে গেছে আমি গ্রাম থেকে এসেছি, বাসে করে এসেছি, এসে একজনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে অপরিচিত এ হলটি চেনার পর অসহায় হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।  
বালক এতোটা ভাবতে না পারলেও যতোটা পারে তা হয়তো আরো জটিল আরো করুণ আরো দমবন্ধ করা।
মুহুর্তের মধ্যে বালক রাফিজ নামটি হারিয়ে ফেলে। 
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাফিজের নাম সে ভুলে গেছে, এখন রাফিজকে তার ডাক দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কি বলে ডাক দিবে। সে ডাকতে থাকে, এই যে ভাই; এই যে ভাই। এই ভাই, এই ভাই...। রাফিজ; বালকের কোন জনমের ভাই? কিন্তু এখানকার মানুষ অপর মানুষকে ভাই বলে ডাকে। যে কোন অপ্রত্যাশিত ঝগড়ার আগেও ভাই সম্বোধন করে। বালকের বুকের ভেতরে বেদনায় জেগে উঠা ডাক—ভাই, ও ভাই...। রাফিজ কী মনে করে যেন বালকের দিকে তাকায়, বালক  বলে উঠে; এই ভাই...। রাফিজ একবারে ষাঁড়, তেড়ে ফুঁড়ে এলে বালক বুঝতে পারে সে গ্রাম থেকে এসেছে এ কথা রাফিজের আর বুঝার বাকি নেই। ...আমি কি মিয়া তোমার টেকা নিয়া পালাইয়া গেছি, তুমি গরুর মতো ব্যামরাইতাছো।  বালক  কি বলবে? তার আর কি বলার আছে, সে কি বলবে আমার বোনের বাড়ি ছাতি পট্টি-কাপড়িয়া পট্টি-কাশারি পট্টি-তেরি পট্টি, আরে বাপরে এ শহরে কত পট্টি। জানেন, আমি দুই বছর  অমুক বিদ্যালয়ে পড়ে ছিলাম। আমারে গরু মনে করেন ? আমার কিন্তু এ বছর এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। আমার বোঙা খালুরে বললে আপনার হাড্ডি গুড়া করে দিবে।
কিন্তু এসব কথা বালক বলতে পারে না। বালক শাপের মুখের ব্যাঙ। সে রাফিজের দিকে তাকিয়ে থাকে, যে রাফিজকে কোন দিন কোন টাকা দেই নাই! রাফিজ যদি তাকে টিকেট না দেয় এবং টাকাও ফেরত না দেয় তার বলার কিছু নেই, সবটা  ব্লটিং পেপার। গোঁপওয়ালা রাফিজের মুখ বালকের অসহায় চোখর তারায় ...।
রাফিজ আরো সামনে এগিয়ে গেলে বালকের মাথার ভেতর ঘূর্ণন ওঠে। একটা ভূমিকম্প তাকে এবং সিনেমা হলের সমস্ত কিছু নিয়ে ঘুরে উঠে। এ টাকা পয়সা সে অনেক কষ্ট করে জমিয়ে তবে সিনেমা দেখতে এসেছে। তার ইচ্ছে  রাফিজের কালো শার্টের কলার চেপে ধরতে কিন্তু তার পা যেন সিনেমা হলের বারান্দায় আটকে আছে। তার পা উঠে না, অদৃশ্য কাদায় আটকে আছে। এবার সে রাফিজকে হারিয়ে ফেলে। রাফিজ আরো সামনে এগিয়ে বলতে থাকে, টিকেট... ওই টিকেট... ফাস কেলাস  ফাস কেলাস। রাফিজের কণ্ঠ বালকের মগজে বাজে, তুমি গরুর মতো ব্যামরাইতাছো। 
না, রাফিজ পালিয়ে যায়নি। তার হাতের টিকেট বিক্রি না করা পর্যন্ত সে  যাবে না। 
পাশের একজন ব্ল্যাককারকে বালক জিজ্ঞেস করে , আচ্ছা ভাই—কালো শার্ট পরা ওই লোকটার নাম কি?
কোন লোক?
ওইযে মোটা মুছওয়ালা লোকটা।
টিকেট বেচে যে , কালো জামার, তুমি রাফিজের কথা জিগাও কেন! তারে তুমি টিকেটের জন্য টেকা দিছো ?
জী।
তোমারে টিকেট না দিলে টিকেট লইয়া তারপরে কথা কও।
এবার বালকের বুকের ভেতর এবং শ্বাসনালী  এক লহমায় শুকিয়ে যায়।  বালক চিৎকার করে ডাকে, ওই রাফিজ ভাই... রাফিজ ভাই..।
রাফিজ এবার মত্ত হস্তি, তেড়ে আসে।...ওই বেটা তুই আমার নাম ধইরা ডাক্তাছস ? তোর থাইক্কা আমি কোন টেকা নিছি ? কেউ স্বাক্ষি আছে ? বলতে পারবে ?
বালকের মাথা ঘুরে ভুতলে পতিত হবার উপক্রম। ধান টানতে টানতে একবার মাথা ঘুরে পরেছিল, পেটে ভাত ছিল না,তরকারি পছন্দ হয়নি বলে ভাত গিলেনি, বাপ বলেছিলে, নারাঙ্গি মারাচ, উঠ্, উঠ্ শালা, ফাইজালামী করার জায়গা পাচ না, সারাদিন হাম্বু হাম্বু করচ তখন মাথা ঘুরায় না। 
কতো বছর আগের সেই ভয় আবার কোত্থেকে  হামাগুরি দিয়ে তাকে মুখ দেখায়।
রাফিজ আরো উত্তেজিত হয়, এই বেটা চল, আয় ভেতরে আয়। সিনেমা দেখতে টিকেট লাগে কে কইছে। আয় তোরে হলে নেই। 
খাঁচায় বন্দি বালক। রাফিজ বালককে এক প্রকার টেনেটুনে সিনেমা হলের ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দেয়। বালক প্রায় কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে, আমার টিকেট! রাফিজ বলে, আমিই টিকেট ,আমার নাম রাফিজ। আমি তোর টিকেট। কেউ টিকেট খুঁজলে আমার নাম কইবি, কইবি রাফিজে বইয়ে গেছে। হলের গেটকিপার রাফিজের সঙ্গে সঙ্গে আসে আর বলতে থাকে; ওস্তাদ; কি হয়েছে ওস্তাদ...। রাফিজ গেটকিপারের কাঁধের উপর দিয়ে হাতগলিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিসিয়ে কি বলে বালক বা অন্য কেউ বিন্দু পরিমাণ বুঝতে পারে না। তবে গেটকিপারের মুখ সামান্য উজ্জ্বল হলে তা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়। যদিও বালকের দৃষ্টি তখন সম্পূর্ণ ঝাপসা। 
সিনেমা হলের ভেতরে সে পাটল রঙে নিমজ্জিত। 
সামনের পর্দাটায় বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন চলছে। কিন্তু বালক দেখছে রাফিজের মুখ। ইয়া গোঁফওয়ালা কালো রঙের রাফিজের মুখ দানাদার উঁচু নিচু গর্ত। কখন বালক এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাফিজের মুখ দেখেছে বলতে পারবে না। সেই মুখকে ধরতে গিয়ে বালক সিনেমার পর্দার ভেতর ঢুকে গেলে তার চাচার সাক্ষাৎ পায়। অভিমানে চাচা তার সাথে কথা বলে না। বালক ডাকে; চাচা... চাচা...। তার চাচা বলে, এহন চিৎকার করচস কেন! তুই রাফিজেরে চিনচ ? জানচ সে কে? সে মালিকের লোক। কিছুক্ষণ পর তোর গায়ের জামা খুলবে; পায়ের জুতা খুলবে। একথা বলে চাচা চলে গেলে বালক তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে এ জুতা তার চাচার। দুজনে সমান বয়সি , দুজনের পায়ের মাপ একেই রকম, বালক চাচার জুতা পরে চলে এসেছে। ময়লা জুতা। দেখতে সুন্দর না। বালক তার পায়ের জুতা জোড়া খুলে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারলে তৃতীয় শ্রেণিতে প্রথমে গণ্ডগোল শুরু হয় তারপর তা দ্বিতীয় শ্রেণিতেও শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে গণ্ডগোল ছড়তে থাকে। ছবি শুরু হওয়ার  চিহ্ন হিসাবে জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠলে বালক উঠে দাঁড়ানোর কথা বে-মালুম হয়ে যায়। পেছন থেকে কেউ একজন তার মাথার পেছনে কষে ঠুকনা মারলে বালক তড়িৎ উঠে দাঁড়ায়। গান শেষ হওয়ার পরেও ঠুকনা মারা লোকটা লক্ষ্য করে বালক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি বলে, আরে ভাই কি হলো, বসেন, মন কোথায়? ভালো না লাগলে বাড়ি চলে যান। বাড়ি চলে যান—এ কথা বালকের মর্মমূলে লাগে। হায় বাড়ি, বাড়িতো তার মায়ের উদোর, কিভাবে যাবে। টাকার পোড়ানি। সে বাড়িতে চলে যাওয়ার ইচ্ছা এবং সিনেমা দেখার ইচ্চা দুটোকে সমান ভাবে লালন করতে থাকলে  সিনেমার কিছুই বুঝেতে পারে না। তার চোখের সামনে রাফিজের গর্তভরা মুখ, গোঁফের পাক, রঙিন সাত ভাই চম্পার পর্দা জোড়ে । বালক ছবিতে মন দিতে বার বার ব্যর্থ হয় । বন্ধুদের নিয়ে অহিদ মিয়ার চা দোকানের লাড্ডু খাওয়ার দৃশ্যে সে পলাতক। মনে হয় কেউ একজন টিকেট চেক করার জন্য টর্চ লাইট হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। বালক  কী বলবে ভাবতে থাকে। রাফিজের নাম বললে টিকেট চেকার যদি বলে, রাফিজ তোর কি হয়। বলবে, রাফিজ আমার খালু, আপন খালু। তখন তার মনে সামান্য সাহস আসে। এবার সে ভাবে ছবি না হয় দেখা হলো না। বাড়িতে না হয় চলে যাবো, এভাবে ভাবলেই তো হয়। কিন্তু বালক দেখে এভাবে সে ভাবতে পারে না; ভাবলেও বাস্তবে তার অবস্থা বিপরীত। টাকার জন্য তার অন্তর জ্বলতে  থাকে। কষ্টের টাকা। বাবার দেয়া মায়ের দেয়া জমানো টাকা। বালক আবার বিমর্ষ হয়। তৃতীয় শ্রেণির দিক থেকে জুতা আসা শুরু হয়  দ্বিতীয় শ্রেণির দিকে। কেন জুতা আসছে কেউ বুঝতে পারে না। জুতা আসা যাওয়া ক্রমশ বৃদ্ধি পেলে পাশের সিটে বসে থাকা লোকটা বালককে বলে, মিয়া তুমি তো শুরু করেছো। তুমি কী কারণে জুতা মারলা ?
বালক বোকা হয়ে যায়। কখন সে জুতা মেরেছে। কিন্তু পায়ের দিকে চেয়ে দেখে তার পায়ে সত্যি জুতা নেই। বালক সত্যি ভয় পায়। জুতা উড়া উড়ির ভেতর জুতা কাহিনি ছড়তে থাকে। টর্চওয়ালা টিকেট চেকার, গেটকিপার একত্রে বালক পর্যন্ত এলে কয়েকজনে বলে, এই ছেলে শুরু করেছে। 
কি শুরু করেছে?
জুতা মারা।
গেটকিপার বলে, আরে দুত্তরি, এছেলে এ কাজ করতে পারবে না। 
কয়েকজন বলে, দেখেন তার পায়ে জুতা নেই।
টর্চের আলো ফেলে টিকেট চেকার দেখে সত্যি বালকের পায়ে জুতা নেই। বালককে ধরে সিনেমা হলের বাইরে নিলে তাদের সঙ্গে রাফিজের দেখা হয়। 
রাফিজ বলে, আরে সর্বনাশ হয়ে গেছে সামনের দুই শ্রেনিতে নাকি দর্শকরা জুতা মারামারি করছে। ছবি তো বন্ধ করার হুকুম আসছে। ঝামেলা যদি অপেরা— ডি সি পর্যন্ত আসে...!
টিকেট চেকার টর্চওয়ালা বলে, এই ছেলে প্রথম জুতা মারছে। এই হলো মূল আসামী ।
রাফিজ বলে, দেখি, ওমা! ও তো আমার আত্মীয়। ওতো সিনেমা হলে এসেছে জুতা ছাড়া। ছাড়ো তাকে।
টর্চওয়ালা বালককে ছেড়ে দিলে রাফিজ বালককে নিয়ে দ্রুত  হলের গণ্ডির বাইরে চলে আসে। একেবারে ত্রিসীমানা পার হয়ে প্রায় বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি।
তুমি জুতা ছুইড়া মারছো সত্য কইরা কইবা।
বালক মাথা নাড়ে। সম্মতি সূচক মাথা নাড়া।
তুমি জানো লোকজন তোমারে মাইরা ফেল তো।
বালক নিশ্চুপ।
রাফিজ এবার জানতে চায় তার কাছে টাকা অছে কি না। বালক বাড়ি ফেরার বাস ভাড়াটা রাফিজের হাতে তুলে দিলে রাফিজ তা সুড়ুৎ করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে, বলে, চলে যাও; ওই দেখো সিনেমা হলের গণ্ডগোল এদিকেও আসছে।
বালক  ধীরে ধীরে হেঁটে বাসে এসে বসে। তার পকেট শূন্য।  বাস কন্ডাকটারকে সে কি বলবে ভাবতে থাকলে তার বুক ফেটে কান্না আসে। তার পাশের সিটে বসা লোকটি জিজ্ঞেস করে, তুমি কানছো কেন মিয়া ?
বালক ডান হাতের আস্তিনের নিচে মুখ লুকায়। 


 কাজী মোহাম্মদ আলমগীর, কথাশিল্পী, কুমিল্লা

menu
menu