রিফুজি

(মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।)
সীমান্ত পেরিয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছে একেক দল। নিরাশায় আন্ধাইর চউখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে দ্রুতলয়ে চলার চেষ্টা তাদের। একটু সামনে গেলেই ইন্ডিয়ার সীমান্ত আর ঠিক এইখানে এসে যেন চলার গতিটা ক্লান্তিতে, হতাশায় আর অনিশ্চয়তায় কমে আসতে চায়। নিজ দেশ তেয়াগি ভীনদেশে যেতে মন সায় দিতে চায় না তাদের। পাও চলে না যেন। তাও এই বিপদের সময় চলতে হয়; চারদিকে পাহাড়, দিনের বেলাও আন্ধাইর লাগে রাইতের মতন। কিন্তু এই পাহাড়-অরণ্য ডরের কিছু না এই মানুষগুলার কাছে। তারা পালাচ্ছে একদল হিংস্র মানুষের ভয়ে। কেউ কেউ বলেও উষ্মার লগে, ‘মুই(আমি) মুজিব-হেইয়া খান কুন্তা চাই না৷ মোর ঘর অইলেই চলে। আমার ঘর থনে আমারেই বাইর করি দিলো। মুই কিতা পুতুল আছলাম তারার হাতো? মাগির পুয়াইনতর কুন ক্ষতি করছলাম আমি? আমি লড়াই নায়, শান্তিতে বাঁচতাম চাই। বান্দির পুয়াইন্তর লাগি আইজ আমি ঘরছাড়া, দেশছাড়া।’ কেউ কেউ কান্দে, আল্লা-ভগবানরেও ডাকে, বিচার দেয়। তারা এইসব যুইদ্ধটুইদ্ধর কুন্তাই বুঝে না। না বুঝিয়াই বেগাফিল বিপদে পড়ছে। কুন হালায় লড়াইর ডাক দিছে এইটা তারা জানে না। লড়াই কেনে হয় তাও তারা জানে না। খালি দেখে মানুষ মরে, মানুষ ধর্ষিত হয়। তারার ইতা ভালা লাগে না। তারা লড়াই চায় না। কারোর সাতে-পাঁচে নেই তারা। তাদের মিলিটারিরা কেনে মারে? এই প্যাঁচের কোনো মীমাংসা তারা করতে পারে না। বরঞ্চ এখনো তারা চায় লড়াইর বদলা আরও দশ হাল বেশি জমিনে ধান ফলাইতে; বাইরষায় একটু বেশি জাল বাইয়া, বরশি বাইয়া মাছ ধরতে; শীতের সময় চান্দের আলোতে বইয়া বইয়া কিচ্ছা কইতে, পালাগান, জারিগান গাইতে; লেম জ্বালিয়ে পুঁথি পড়তে—হাতেম তাই, হালতুন্নবী, আমির হামজার পুঁথি। কিন্তু তারার চাওয়ার কিতা আর দাম আছে কোন? যারা বুঝে তারা বোধহয় চুপ থাকে। তারা হেইয়া খানরে গাইল দেয় না, জানে গাইলের ফলে হেইয়া খানর বাল-ও ছিঁড়তো না একছা। মুজিবরে মাথায় উঠিয়ে নাচে না তারা, নাচার ইচ্ছাও নেই তাদের। গতকালই তো মুজিব হেইয়া বন্ধু ছিল। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান লড়াই হলো, আজ পুবে-পইছমে লড়াই। কাইল? কাইল কার কার লড়াই অইবো? তাদের বেশিরভাগই নেতা বুঝে না, বুঝে না কূটনীতি। তারা বুঝে পাশের ঘরে আগুন লাগছে, পাশের গাউর যুবতী মাইয়ারে ঘর থেকে বে-আব্রু ধরে নিছে মিলিটারি। তাদের ঘরে বউ আছে, বইন আছে, যুবতী ফুরি আছে। তারা আর সাহস পাইছে না ঘরে থাকার। ঘরে জোয়ান ফুয়া আছে, মাঝবয়সী বেটামানুষ আছে। মিলিটারি তাদের লাইন ধরিয়ে গুলি করে মারে, মারার পরে তাদের ভাইয়ের, বইনের লাশ একলগে কয়বরে মাটিচাপা দিতে তাদেরই বাধ্য করে। তারা ইতা ভয় পায়, ঘেন্না করে। চায় না এই পরিস্থিতিতে থাকতে। সুতরাং তারা পালায়, মুসার আমলের বনি-ইসরাইল বংশের মতো তারাও পালায়। পালিয়ে গেলেও নতুন দেশ পায় না। তারা হয় রিফুজি। যে লড়াই তাদের রিফুজি বানায় তারা এই লড়াই চায় না। এই লড়াইর মুখে মুতে তারা। কিন্তু লড়াই থামে না। যেমন শুরু হয় হেইয়া খানের ইচ্ছায়, হেইয়া খানের ইচ্ছায় চলতে থাকে, থামে না। তাদের ইচ্ছায় এই দুনিয়ায় কিচ্ছু হয় না, তাদের ইচ্ছার কোনো দাম নেই বড়ো বড়ো মানুষদের কাছে। 
আকতা (হঠাৎ) তারা শুনছে সংগ্রাম শুরু হইছে। তখনো তারা সংগ্রাম বুঝে না। মাইনসরে জিগাইছে সংগ্রাম কিতা, তখন যারা বুঝে তারা বলেছে যুইদ্ধ লাগছে, ‘৬৫-র হিন্দুস্তান—পাকিস্তান লড়াইর লাখান। তারা জঙ্গনামা পড়ে, খাইবারের লড়াইর হজরত আলীরে মনে করে পয়লা পয়লা রোমাঞ্চিত হইছে। এইবার পুব-পাকিস্তান আর পচ্চিম-পাকিস্তানে লড়াই। দুলদুল না আইলো, ঘোড়া তো আইবো হাজার হাজার, তরবারি আর ঢাল হাতে হাজার হাজার সৈন্য আইবো। কিন্তু না আয় ঘোড়া, না হয় তরোয়াল যুদ্ধ। স্বপ্ন ভাঙে তারার দূরে আগুনের শিখা দেখে, মোহ কাটে বোমার শব্দয়, গুলির শব্দয়। দেখে শাঁ শাঁ করে ঘর জ্বলছে, বাড়ি জ্বলছে, জ্বলছে মানুষ, বনজঙ্গল, পশুপাখি।
একদিন তারা খবর পায় পুব-পচ্চিম সবাই মুসলমান। কিন্তু মুসলমানে মুসলমানে লড়াই তো খারাপ। তখন কেউ কেউ কয়—মুজিবে টুপি পিন্দে না, নামাজ পড়ে না। মুজিব কাফির। তখন  তারা মুজিবকে ঘিন্না করে।
কিন্তু একদিন আল্লা আল্লা করতে থাকা তাদের একজনর ঘরে মিলিটারি আসে। মিলিটারি তাদের এক যুবতী ফুরিকে ধরে নিয়ে যায়, বেইজ্জত করে। ক্যাম্পে আটকে রেখে রেখে বেইজ্জত করে। আরও অনেক যুবতীরে ধরে নেয়। তারা তখন ডরে ভাগতে থাকে। ভাগতে ভাগতে কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আপনজনের কাছ থেকে। তাও তারা দৌড়ায়, বউবাচ্চা লইয়া, মালসামান যা পারে মাথায়, কান্ধে করে দৌঁড়ায়। প্রথমে কিচ্ছু ভাবে না। খালি দৌঁড়ায়। পরে একটু ক্লান্ত হয়। থামে। থেমে তারা ভাবে, কই যাবে তারা! তখন বুঝে যে তাদের বাড়ি আর তাদের নেই। মিলিটারির হয়ে গেছে। তারা ডরায়, কেউ কেউ এন্ডিয়াত যাইবার কথা মনে করিয়ে দেয়। তারা কয়, এন্ডিয়াত জঙ্গ অইরো না? একজনে কয়, সারা দুনিয়াইত জঙ্গ অইরো। তখন তাদের আরেকজনে বলে, না, না। জঙ্গ খালি পুবে পচ্চিমে অইরো। মুজিব হেইয়া খানে অইরো। এন্ডিয়া আরেক দেশ৷ তখন তারা বুঝতে পারে, এন্ডিয়াত যাইতে অইবো। এন্ডিয়া তাদের বাড়ি না হউক, এন্ডিয়াত যুদ্ধ নাই। আরেকজন জিজ্ঞেস করে, যদি এন্ডিয়াত যুইদ্ধ লাগে? সবাই বলে, কিয়ামত অইবো তখন। 
সুতরাং একে একে তারা ঘরদোর আল্লাখোদাভগবানের হাতে সঁপে ঘর থনে বাইর হয়। দলে দলে, সকালে বিকালে, দিনে রাইতে। সবেই মিলিটারিরে ডরায় কারণ মিলিটারি মানে বন্দুক, খুন আর ধর্ষণ। যারা মিলিটারি দেখতে পারেনি, তারা জানে মিলিটারি আজরাইলের মতন আসে মিলিয়ে, যায়ও মিলিয়ে; কেউ কেউ যারা চাক্ষুষ মিলিটারি দেখছে তাদের জিজ্ঞেস করে, ’মিলিটারি দেখতে কিলাখান?’ তারা কয়, ’মিলিটারি মাইনসের মতনই দেখতে, কিন্তু কথা তারার আরেকলাখান, বুঝা যায় না। এরা মানুষ নায়, মিলিটারি।’ সুতরাং ঘরকে ঘর তারা বাইর হয় বাঁচার খাতিরে, উড়াতাড়া করে। আরও কেউ কেউ তখন মিলিটারিদের দেখে, তাদের মাতকথা শুনে। তারাও কয় মিলিটারি মানুষ নায়—আল্লা-ভগবানর গজব। তারা আল্লাভগবানের নাম জপি জপি হাঁটতে থাকে। 
এন্ডিয়া কই, সবে এইটা কইতে পারে না। তারা হাঁটে, তারা দৌঁড়ায়। তারা খাইতে পারে না, তারা কাচ্চাবাচ্চারে খাওয়াইতে পারে না। ফুলতলা বর্ডারের দিকে আগায়; চিপাচিপি করে একলগে দুইজন আগাইবার মতো রাস্তা, চাইরধারে পাহাড়, বাঘের ডরে মানুষ আগে এইদিকে যাইবার নাম নিতেও সাহস করতো না—এখন তারা এইদিকেই যায় কারণ বাঘের চাইতেও তারা মিলিটারিরে  ডরায়, ডরায় কারণ মিলিটারি মানুষও না, বাঘও না—এরা ভয়ংকরও না, এরা সবতার ঊর্ধ্বে কিছু  একটা, নাজেল হওয়া এক খোদায়ী গজবের নাম। বাঘের ডাক শুনলে তারা বুঝে যে বাঘ আসছে, সাপ কামড় দেওয়ার আগে ফোঁসফোঁস করে। তারা ফোঁসফোঁস শুনে সাবধান হয়, ধারেকাছে সাপ আছে; কিন্তু মিলিটারির ফোঁসফাস, ডাকাডাকি তারা শুনেনি, এরা আকতা এসে হাজির হয়েছে। কেনে তারা এসেছে, কেনে মানুষ মারছে, তাদের ওপর এদের এতো রাগ কেনে—কিচ্ছুই  তারা জানে না। এর জন্য জঙ্গনামা পুঁথি এখন ভয় করে তাদের। ঘর ছেড়ে পাগল হয়ে ছুটে। পুঁথি ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে। তারা ছেপ দিয়ে বাইর হয় ঘর থনে। ছেপ উড়তে উড়তে মুখখাইয়া আছড়ে পড়ে। কই পড়ে তা তারা ফিরিয়াও দেখে না।
তাদের একদল এন্ডিয়াতে পৌঁছে। অন্যদল রওনা হয়, অন্য আরেক দল রওনা হয়, আরও অনেক দল রওনা হয়। ধীরে ধীরে তারা এক ময়দান দেখে, অনেকগুলা তাঁবু দেখে, দেখে শুকনা শুকনা মানুষ৷ তারা বাড়িঘর ফেলে এখানে এসে দেখে তারা আর মানুষ না, তারা রিফুজি— একবেলা খায় আর তিনবেলা না খাইয়া থাকে, শুকায়; আবার একবেলা খায়, তিনবেলা না খাইয়া থাকে, আবার শুকায়। তাদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। এখানে মিলিটারি থাকে না, তাও তারা ডরায়। মিলিটারিরে না, তারা এইবার ডরায় পেটের খিদারে। এন্ডিয়ার পুলিশরে। তারা ঘর ছাড়ছে কারণ তারা ভয় পাইছে মিলিটারিদের, দেশও ছাড়ছে একই কারণে। এখন কেউ কেউ দুনিয়া ছাড়ে, মিলিটারির গুলি নয়, তাদের খুন করছে পেটের খিদা আর অসুখবিসুখ। এর লাগি কেউ কেউ রাগ করে। তাদের আসুক মিয়া, খটই মিয়া, আজির উদ্দিনেরা ডাকে মুক্তিতে যোগ দিতে। তারা জিজ্ঞেস করে, ’মুক্তি কিতা? ইতা কিতার লাগি?’ উত্তর পায়, ’মিলিটারিরে মারতে, নিজর ঘর ফিরিয়া পাইতে। যেরা এইগুলা করে, তারাই মুক্তি।’ জবাব শুনে তাদের কেউ কেউ মুক্তিতে নাম লেখায়, ট্রেনিং নেয়। এলাকায় ফিরে আসে। লড়াই করে। বাকিরা খাইয়া, না খাইয়া অপেক্ষায় থাকে—এই অপেক্ষা ঘরে ফেরার চাইতেও বেশি শান্তির লাগি, স্বাভাবিক জীবনের  লাগি। সংগ্রামের শেষ কোনো সময় তারা কেউ জানে না। যার সময় আসে, সে মরে-অসুখে, নয়তো এন্ডিয়ান পুলিশের গুলিতে অথবা ভারতীয়দের আক্রমণে। যারা বেঁচে থাকে তারার খাওয়ার কষ্ট, লগে অসুখবিসুখের কষ্ট। ফের মরে অনেকেই। কষ্টের কোনো শেষ নেই মউত ছাড়া। তখন তারা ভাবে এই কষ্টে বেঁচে থাকবার চেয়ে মরে যাওয়া ভালা। কিন্তু তারা সব একলগে মরে না, কেউ গলাতও দড়ি দেয় না। যুইদ্ধর মাঝখানে তখন আরেক যুদ্ধ শুরু হই যায়, বিভিন্ন জাতের মানুষ রিলিফ দিতে আসার পরে তারা লাইনে দাঁড়ায় সূর্য উঠার আগে। একজনরে ডিঙাইয়া কে কত এগিয়ে যেতে পারে তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি। মাইর লাগে তখন, তাদের মধ্যে যাদের শক্তি বেশি তারা তখন যাদের শক্তি কম তাদের রিলিফ পাইতে দেয় না। দুর্বলরা সবলের মাইর খায়, খাইয়া আরও দুর্বল হয়, তারা তখন গাইল দিতে থাকে। পুরা রিফুজি ক্যাম্প জুড়ে তখন চিৎকার, চেঁচামেচি আর কান্নাকাটি, গালিগালাজ, আর গমগম আওয়াজ।
খাবার দখলের যুইদ্ধের পরে তারা সবাই বইয়া বইয়া খাইতে খাইতে গপ করে, কান্দাকাটি করে, হাসাহাসি করে। তাদের একজন কয়, ’আমার বাড়িত আমার গাই ফরইছে। একটা ডেকি বাইচ্চা দিছে। বাইচ্চাটা যে দুর্বল, আমিই ধরি ধরি নিয়া ওলানো মুখ লাগাইয়া দিয়া দুধ খাওয়াইছি। এর লাগি একটু তাকত আইছে শরীরও। যেদিন আমি বাড়িত্তনে বাইর অইয়া এন্ডিয়াত রওনা অইছি, পিছনে চাইয়া দেখি ওই বাইচ্চাটা আমার লগে লগে আইতে আছে। ভাবছে আমি খাওয়াইমু! কতো বিশ্বাস আমারে করে। আর আমি তাইরে থইয়া, ভাগিয়া আইছি অনো। হেমানজানোয়ারর জীবনও এই জীবনর চাইতে ভালা। আল্লারে! আমার ঘর! আমার অতো মায়ার ডেকি বাইচ্চা! আর নি পারমু ফিরিয়া যাইতে!’ 
তারা তখন গাইর বাইচ্চাটার লাগি কান্দে, কষ্ট পায়। তারার কান্দাকাটির লগে তখন অসুস্থ-ভুখা মাইনসের কান্দাকাটি মিলে অভিন্ন একটা সুর ওঠে। সেই সুর আসমানের দিকে যাওয়ার পথে থমকে গিয়ে ফিরে আসে তাদের কানের দিকে, আর কারো কানে পৌঁছে না। তারা আবার কান্দে, আল্লার কাছে বিচার দেয়, মা কালীর কাছে বিচার দেয়। মাফি চায় পাপের, প্রত্যেকদিন। রিলিফ আইলে আবার লাইনে দাঁড়ায়। পরস্পর মারামারি, ঠেলাঠেলি করে, খামচাখামচি-কাড়াকাড়ি করে। খাবারের ব্যাগ নিয়ে হাসতে হাসতে নিজ নিজ তাঁবুতে যায়। যারা খাবার পায় না তারা নির্জীব হয়, হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে তাবুতে যাইতে যাইতে আল্লাখোদার নাম ধরে ডাকে, ভগবানের নাম ধরে ডাকে। কেউ কেউ গাইল দেয়, ’চুতমারানির পুয়ায় আমারে ঠেলিয়া আগে গেছে। রিলিফ পাইতে দিছে না। এই খানকির পুয়ার লাগি আমি খানি পাইছি না। তারে আমি খুন করমু আইজ রাইত।’ সত্যি সত্যি একজনের লাশ পড়ে থাকে পরদিন, কেউ পাত্থর দিয়ে মেরে মাথা থেঁতলে দিছে। 
তাদের আর একটা দল তখন এন্ডিয়া আর ঘরের মাঝামাঝি রাস্তায়, তারা এন্ডিয়াতে যাওয়ার মাঝপথে দেখে মাইনসে কাপড়চোপড়, ফলমূল, তরিতরকারি বেচতেছে। তারা মনে করে এন্ডিয়াতে পৌঁছে গেছে। হাতে যা টেকাকড়ি আছে তাই দিয়ে এইটা ওইটা কিনে। আরবার ঘর করার ইচ্ছা জাগে তাদের মনে। এক মহিলা কোলের বাচ্চার জন্য কলা কিনতে বলে জামাইকে। জামাই কলা কিনতে যায়। 
’ভাই, কলার দাম কত? সারাদিন ফুয়াটার মুখো কিচ্ছু দিতে পারছি না।’ 
’এক হালি এক টেকা, পুশাইলে নেইন। না নিলে ভাগইন।’ 
’শাউয়ার টেকাদি কিতা অইতো এই নেও আমার কাছে আশি টেকা আছে। দেও কলা। তুমার টেকা দরকার, নেও। থু!’ 
কলাবেচতে আসা লোকটা চুপচাপ টাকা গোনে লুঙ্গির ভাঁজে রেখে কলার সবক’টা কান্ধি দিয়া দেয়। সে জানে রিফুজিহকলের টেকার মায়া নাই। তার আছে। এজন্য টেকাগুলা নেয় সে। সে অভাবী, বড় হইতে পয়সা লাগে। 
জামাই-বউ কলাবেচতে আসা ওই লোকটারেই জিজ্ঞেস করে, ’এইটা কুন জাগাত আইছি আমরা?‘
সে কয়, ’এইটা সমাই।’ 
’এন্ডিয়া কতদূর?’ 
’আরও এক-দুই মাইল যাইতে অইবো।’ 
’বাইচ্চাটারে আর না খাওয়াইয়া রাখা যাইতো না। একটু কলা খাওয়াইতে অইবো। বুকুত দুধও নাই। মাইলে নেওরার লড়াইয়ে শান্তি দিলো না।’ 
’তারে আমার কাছে দে। দিয়া তুই কলা মাখা।’
রওনা হওয়ার পরে পয়লাবার বউয়ে বাচ্চারে কাঁধ থনে নামায়। 
’নেও, তোমার ফুয়া।’ বলে সে কাঁথায় জড়ানো বাচ্চা এগিয়ে দেয় জামাইর হাতে।
জামাই হাতে নিয়েই চিল্লাইয়া উঠে, ’এই চুতমারানির ফুরি, তুই বালিশ দেছ কেনে আমারে? আমার ফুয়া কই? তুই আমার ফুয়ারে জানে মারছত।’ 
’আমার পুয়া নাই? ইতা কিতা করলাম আমি! আমি মরলাম না কেনে! ভগবান, মিলিটারি আইরো শুনিয়া আমি তাইলে বেহুঁশিত বালিশ লইয়া দৌড় দিছি! হায় রাম! আমারে তুমি নিলায়গি না কেনে এই দুঃখর মাঝে ফালানির চাইতে!’
কলাবেপারি যখন দেখে জামাই বউ কাঁদছে তখন হাত থেকে টাকাগুলো ছুঁড়ে ফেলবে ভাবে, কষ্ট লাগে তার। ইচ্ছে করে সব টাকা এদের দিয়ে দিতে। কিন্তু তারও তো আটা কিনতে হবে। টাকা-পয়সা ছাড়া চলবে না তার। 
তাও বলে, ’আফনার টেকা নেইন গি। কলা আপনারা নিজেরা খাইলাইন যেনো। এন্ডিয়াত গেলেও টেকা তো লাগবো। আর যা অইবার অইগেছে। সবকিছু শান্ত অইলে একবার গিয়া আমিই নাওয় খুঁজ নিমু আইজ রাইত আফনার বাচ্চার। আমারে ঠিকানা দিয়া যাইন।’ আশি টাকার জায়গায় দুশো টাকা দিয়ে দেয় সে তাদের। বলে, ’ঘরও অভাব না থাকলে সব টেকাই দিয়া দিতাম আফনারারে। আমারে খালি ঠিকানা দিয়া যাইন। আমি আইজ রাইত যাইমু আফনার ফুয়ার খুঁজে।’ জামাই বলল, ’আমার বাড়ি ভবানীপুর। কিন্তু যদি আমার ফুয়ারে পাও তুমি আমরা জানমু কিলান?’ জবাবে লোকটি বলল, ’আমার বাড়িত থাকবা আফনারা?’ জামাই রাজি হয়ে যায়। এরপরেও বউর কান্না থামে না। এই কান্না শুধু বাচ্চার জন্যও না। শুধু ঘর ছাড়ার জন্যও না। এই কান্না সবকিছুর জন্য, একটুখানি আশার জন্যও। যদিও বেশিরভাগের চোখে এই সময়ে কান্না আসে না। কোন কষ্টই আর গতরে লাগে না। লড়াই শুরুর লগে লগে এইগুলা ধীরে ধীরে নাই হয়ে গেছে মন থেকে। মানুষের মন তখন মরুভূমির লাখান শুকনা, খশখশে। ঘর হারাইলেও, স্বামী হারাইলেও কান্দন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হাসিও ঠিক তাই। না হাসতে থাকা, না কান্দনরত, না খুশি, না বেজার ওই মানুষগুলা এখন জিন্দা লাশ। পৃথিবীর পথহীন এই পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে এই দম্পতি আস্তে আস্তে তাদের মূল দলের থেকে আলাদা হয়ে চলতে থাকে। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সেই লোক। তার মনে অদ্ভুত এক শান্তি কাজ করে। অনেক টাকা হাতে থাকা সত্ত্বেও তা ছিল না। সে আল্লার কাছে লোভের লাগি পানাহ চায়। বাকি লোকজন এন্ডিয়াত যাইতে থাকে। তাদের কাছ থেকে দেখলে আলাদা করা যায়, দূর থনে আর আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। বেটাবেটি, বুড়া-জুয়ান সব এক হয়ে যায়, তাদের পরিচয় রিফুজি। কলাবেপারি লোকটি আর ওই দম্পতি বেশ দূর থেকে আরেকদল রিফুজিরে যাইতে দেখে। এরারেও দূর থনে আলাদা করতে পারে না। বহুত ঘটনা-দুর্ঘটনা, দুঃখ-দুর্গতি নিয়ে এদের প্রত্যেকেই ধীর পদক্ষেপে হেঁটে হেঁটে চলে যায়। এরপরে আরেকদল। আরও একদল। আরও অনেকদল। এরা সব এন্ডিয়াত যায়।


• কথাসাহিত্যিক, এস্তোনিয়া।

menu
menu