ঈশম
প্রখর গ্রীষ্মের দুপুর। ধানবাদ শহরের বাঙালি অধ্যুষিত একটি পাড়ার দোতলার বড় ঘরে পুরনো দিনের পাখাটা ঘুরে চলেছে। আশেপাশের ধানবাদ-ঝরিয়া কয়লাখনি অঞ্চলে এই ভরদুপুরে বাইরের তাপমাত্রা ৫০°/৫১° ছুঁয়ে ফেলতেও দ্বিধা করে না। ঘরের বাইরে যে দাবদাহ, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরের ভেতরেও যেন লু বইছে—ওই পাখাটা গোটা ঘরময় গরম বাতাস খেলিয়ে চলেছে বিরামহীন। ঘরের সব জানলা বন্ধ। দরজাটাও ভেজানো রয়েছে। নিচে মেঝেতে বাপ-বেটা শুয়ে আছে মাথায় ভিজে গামছা জড়িয়ে। এই তীব্র গরম ঝালাস থেকে পরিত্রাণ পেতে ওই ভিজে গামছাই ভরসা। ওরা আজ বেলা বারোটা নাগাদ এসে পৌঁছেছে। সেই কোন্ ভোর থাকতে গাঁ থেকে বেরিয়ে বোলপুর এসে দুর্গাপুরের বাস ধরে দুর্গাপুর স্টেশনে এসে নেমেছিল সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। বছর ১৪/১৫-র ছেলেটার খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করছিল। সেটা বুঝেই ওর বাপ একটা চায়ের দোকানে গিয়ে ওকে দুখানা কেক আর চা দিতে বলল। ‘নে রে ব্যাটা, তাড়াতাড়ি চাটো খেঁয়ে লে। এখুনি আবার গাড়ি ধরতে হবে।’ এই বলে নিজে এক কাপ চা আর একখানা বিস্কুট কোনোরকমে খেয়েই প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা দিতে দিতে বলল, ‘তু আয় ঈশম। আমি টিকিটটো কেটে লিয়ে যেছি।’
তারিয়ে তারিয়ে আর খাওয়া হল না কেকদুটো। কোনোরকমে চা কেক শেষ করে ছেলেটা ছুটল বাপের পিছনে। টিকিটের লম্বা লাইন। কিন্তু আব্বা গিয়ে একটা নীল শার্ট পরা লম্বা, ফর্সা মতো ছেলেকে কি সব বলে কোঁচড় থেকে টাকা দিল। ওমা, আর দুজনার পরই তো ওই নীল শার্ট লাইনে ছিল। টিকিটটা কেটে আব্বার হাতে দিয়ে সে ছেলেটা যে কোনদিকে চলে গেল। ওভারব্রিজ পেরিয়ে বাপ-বেটা তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে এল। ওদিকের প্ল্যাটফর্মে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ঈশম চলতে চলতে দেখছে গাড়িটা কি লম্বা! কতগুলো বাড়ি যেন পর পর লাগানো। কত জানলা। আর প্রতিটা বাড়িতে তিনটে করে দরজা। ভোঁ দিচ্ছে। কত লোক চাপছে। ‘আব্বা, গাড়ি ছেড়ে দিবে, চাপবা না?’
‘ধুর বোকা, উটো আমাদের গাড়ি লয়। আমরা অন্য গাড়িতে যাব। মাইকে বলবে শুনবি ক্যানে। ইদিকে আয়।’
‘ই তো দেখছি মেলাই লোক আব্বা। চাপতে পারা যাবে তো?’
‘এই ছেল্যেটোকে লিয়ে মহা মুশকিল ব্যাটে। আরে গাড়িটো ডাঁড়াবে যি। কত লোক নামবে কত উঠবে, দেখবি ক্যানে।’
অনতিকাল পরেই আপ ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকল গুম গুম শব্দ তুলে। উত্তেজনায় ছোট ছেলেটার বুকটা ধকধক করছিল। এই গাড়িতেই ওরা উঠবে! আব্বা টিকিট কেটে নিয়েছে। ঈশম এই প্রথম ট্রেনে চাপবে! প্রতিবার ধানবাদ যাবার সময় ও ঝোঁক করত বাপের সঙ্গে যাবে বলে। মা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলত, ‘বাপধন, তোর আব্বা জমির ধান বেচার হিসাব বুঝাইতে চলল মুনিবদিগে। অদের জমি, তা অরা ধানটো লিছে না। কিন্তু সর্ষে, তিল, গুড় খানিক খানিক পৌঁছে তো দিতে হবে।’ এবারে মা রাজি হয়েছে ঈশমকে ছাড়তে।
চূড়ান্ত গতিটা ক্রমে কমতে কমতে অবশেষে ট্রেনটা এসে থামল। হুড়মুড় করে লোক নামছে। নামলে কী হবে, তার ডবল লোক দাঁড়িয়ে আছে উঠবে বলে। আব্বার হাতটা ধরে নিল ঈশম। ভয় লাগছে। আর কেমন গায়ের লোম ঠারো হয়ে যাচ্ছে। ভালোও লাগছে। পিছন থেকে লোকেরা এমন ঠ্যালা মারল যে গুঁতো খেয়েই ওরা বাপ-ব্যাটা ট্রেনে চড়ে পড়ল। আব্বার হাতে এই বড় একটা মুখ বাঁধা থলি। তাতে আছে সর্ষে, খানিক আতপ চাল, ছোলা আর গুড়। শুধু মুখে এই ঢেলাগুড় খেতে খুব ভালোবাসে ঈশম।
ওরা আজ এবাড়িতে পৌঁছল বেলা বারোটা নাগাদ। ন’কাকিমা লেবুর শরবত আর সাদা চায়ের প্লেটে মণ্ডা দিল। দুই বাপ-ব্যাটায় জল মিষ্টি খেয়ে খানিক জুড়িয়ে তারপর কলতলায় চান করে নিল। হ্যাঁচকা কল টিপে জল উঠে আসে নীচের পাথর কেটে। কি ঠান্ডা! শরীরে জাড় লেগে কাঁপুনি ধরে ঈশমের।
‘হ্যাঁরে কালো, তোর ব্যাটা দেখতে তো বেশ হয়েছে রে। সঙ্গে করে আনলি, ভালো করলি। তোর বয়স হচ্ছে। এরপর ওকেই তো আসতে হবে এই সব সামাল দিতে। তাছাড়া দায় দৈবে তো আসবেই’ বলেই এক মাথা পাকা চুলে এই মোটা করে সিঁদুর পরা লম্বা রোগা বড়মা ঈশমের থুতনিটা দিলেন একটু নেড়ে। ঈশমের খুব লজ্জা লাগছে। ও কি আর ছোট আছে নাকি? এ বাড়ির সব বৌ মানুষদের মাথার মাঝে সিঁথিতে লাল সিঁদুর, কপালে লাল টিপ আর হাতে ওই লাল আর সাদা দুগাছি চুড়ি, সঙ্গে দুচার গাছি সোনার চুড়ি। ঈশমের মনে পড়ল মাকে। ওর মায়ের মাথার কাপড়টা কানের দুপাশে আটকানো আর দুহাতে চেপে বসা একগোছা করে জলভরা আসমানি রঙ কাঁচের চুড়ি।
ঈশমের বাবা কালো এ বাড়ির কিষান তো বটেই, মাহিন্দারও বলা যায়। কর্তাদের গাঁয়ের জমিতে চাষ করে। সেই কোন্ ছেলেবেলা থেকে। আর এই বাড়ির যা জমিজমা, গোটা তিনেক পুকুর আছে গাঁয়ে, তা দেখাশুনো করে। বদলে এই বাড়ির কর্তারাও এদের বিপদে আপদে খোঁজ নেয়, পাশে দাঁড়ায় বৈকি। এই পুকুরগুলোয় অল্প-সল্প মাছ আছে। গাঁ ঘরে তাতেই সংসারে অনেক সাশ্রয় হয়। কালোর ছেলেমেয়েরা ভাতের পাতে এক-আধদিন মাছ খেতে পায়। কাতলা ইলিশ কি আর? সিলভার কার্প, মৃগেল কি বড়জোর রুইয়ের চারাপোনা।
বড়মা খুব যত্ন করে খেতে দিল ওদের রান্নাঘরের সামনের বারান্দায়। ঈশম আজ খুব আরাম করে ভাত খেয়েছে। ঘন ডাল, তিনটে তরকারি আবার মাছের ঝাল। শেষপাতে আমের টক। খেয়ে দেয়ে কলতলায় মুখ ধুয়ে আসতে বড়মাই বলল, ‘যা, তোরা উপর ঘরে শো’গে যা। জ্যাঠা-কাকারা বিকেলে বাড়ি আসুক, তখন নাহয় টাকাপয়সার কথা বলে নিস।’ ঈশম বুঝল আব্বা চাষের জন্য টাকা নিতে এসেছে। খরার বোরো ধান তো উঠল, এবার আবার আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিতে মাঠে আউশের চাষ দিতে হবে যে!
আব্বার নাক ডাকছে। কিন্তু ঈশমের চোখে ঘুম নেই। চোখ ঘুরছে ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িতে, ননী চুরি করে খাওয়া গোপালের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডারে, ওদিকে বড় খাটের ফুলকাটা চাদরে, এদিক সেদিক। আর বারবার চোখ চলে যাচ্ছে মাথার উপর বন বন করে ঘুরতে থাকা পাখাটার দিকে। কেমন সমানে হাওয়া করছে! গাঁয়ের ঘরে ওদের বাড়িতে অনেক কটা পাখা। তালপাতার। হাত ঘুরিয়ে পাখা ঘোরালে তবে গায়ে বাতাস লাগবে। আর এই ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বড় পাখাটা নিজেই ঘুরছে! তাজ্জব লেগে যাচ্ছে ঈশমের।
টুক করে লোডশেডিং। ঘুরন্ত পাখাটা কেমন লাট খেতে খেতে থেমে আসছে। পাশে আব্বার ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। উসখুশ করছে। আর ওমনি ঈশম ভারি মজা পেয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাই গো, পাখাটো ইবার আলামারা খেঁয়ে গেলছে! আর ঘুরতে লাড়ছে।’
রাত একটার কম হবে না। রাস্তায় বড় বড় লরি যাচ্ছে এপার ওপার। ঘাড়ের গামছাটা মাথায় পাকিয়ে বেঁধে ঈশম গরুগুলোকে রাস্তার একধার করল। পিছনের বাগালটাকে ডেকে একবার গুনে নিতে বলল। বড় ছেলেটাকেই সঙ্গে করে আনতে চেয়েছিল ঈশম। আজকাল আর পারে না ও। একা পুরোটা সামলাতে কষ্ট হয়। বয়সটা কি আর বসে আছে? ছেলেটা এলে এই বাগালের টাকা কটা ঘরেই ফিরত। এতগুলো গরু পিছু কটা টাকাই বা মহাজন দেয়? তা ছেলেটার দুদিন ধরে জ্বরই ছাড়ল না। এমন দুর্বল হয়েছে যে ওই অত বড় ছেলে খাড়া হয়ে দাঁড়াতেই পারছে না। এখন এই বাগালকেও তো টাকা লাগবে। তাছাড়া পথের খোরাকি। গরুর পাইকারিতে খাটুনি খুব কিন্তু নাফা কম। অনেকক্ষণ হাঁটিয়ে এনেছে ওরা গরুগুলোকে সেই দুমকা থেকে। তার আগে ঝাড়খণ্ডের বিহারি পাইকার একটা লরিতে সবকটাকে চাপিয়ে পাঠিয়েছিল। আর বলেছিল ঝাড়খণ্ড থেকে এই রাজ্যে মানে বেঙ্গলে ঢোকার বর্ডারে খানিক বেশি টাকা লাগবে। চায়, পানি, নাস্তা। ঈশম সেইমত পাইকারের কাছ থেকে পাওয়া বরাদ্দ টাকার খানিকটা আলাদা করেই রেখেছিল ঘুনসিতে বেঁধে। আচমকা চোখে তীব্র আলো এসে পড়ায় প্রথমটা খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল ঈশম। চেকপোস্ট থেকেই টর্চ মারছে। গরুপাচারের কেস দিয়ে জেলে ভরে দেবে একটা টাকাও কম হলে। কি খাঁই। পেট ভরেই না এই পুলিশগুলোর। ঘুনসি থেকে টাকাটা বের করতে করতে ঈশম এগোয়। ঈশমরা জানে, শুধু হাতের টাকাটা নয়, গালটাও পেতে দিতে হয় এদের সামনে। এরা এদের যৎসামান্য যেটুকু বিবেক অবশিষ্ট, তার ভর্ৎসনার হাত থেকে রেহাই পেতে প্রথমেই ঈশমদের সঙ্গে একচোট বচসা শুরু করবে। এই রাত্রে কে কোথায় কার অনুমতিতে কার গরু কার কাছে কিনে নিয়ে যাচ্ছে কোন্ হাটে, এই অমূলক প্রসঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফটাফট গালে থাপ্পড়, যথেচ্ছ কিল চড় ঘুঁষি মেরে সম্ভবত নিজেদের বিবেক দংশনটুকুর মোকাবিলা করবে। তারপর এই সব পাইকারদের কাছ থেকে কমিশন বা কাটমানিটা গুণে গুণে আদায় করে এদের ছেড়ে দেবে।
গালদুটো কী জ্বালা করছে উফ্! ঈশম জানে মুখে রা কাড়লে হবে না। মার আরও দ্বিগুণ হয়ে পড়বে। টাকাটা সে ইউনিফর্ম পরা পুলিশটার হাতে গুণে দিয়ে বাকি টাকাটা আবার ঘুনসিতে বেঁধে রাখল। পিছনের বাগালটাকে হাতের ঈশারায় চলে আসতে বলে ঈশম গেল রাস্তার পাশে একটা ডোবায় মুখে চোখে গালে খানিক ঠান্ডা জল দিতে। নইলে হাঁটতে পারবে না। এখনো অনেক পথ। তাতে ছোট বড় মিলিয়ে আরও তিনটে চেকপোস্ট। তাঁতীপাড়া, জয়দেব, ইলামবাজার। তার মানে আরও তিনবার ঘুনসি খোলা। আর গাল পিঠ পেতে দেওয়া। ঈশমের এইটা ভারি অবাক লাগে। হাসিও পায়। আরে, টাকা না দিয়ে তেজে রুখে দাঁড়ালে না হয় মারত। টাকাও নেয় আবার পিটায়—কেন রে বাপু? শুধু পকেট গরম করলে বোধহয় ইজ্জত থাকে না পুলিশবাবুদের। তাই মেরে হাত গরম করে নেয়। ডবল সুখ।
হাঁটতে হাঁটতে ঈশম গরুগুলোর দিকে তাকায়। জোড়ায় জোড়ায় বাঁধা। ঝাড়খণ্ডের উত্তরপশ্চিমে সেই ডেহরি-অন-সোন, সোন নদীর ধারে গরুদের যে হাট, সেখানে বিস্তর গরু কেনাবেচা হয়। এগুলোও ওখান থেকেই এতটা পথ এসেছে পাইকারদের হাত বদল হয়ে। এদের বেশিরভাগেরই গায়ে হিসেবের গোল গোল লাল চাকা দাগ। ওই অবস্থাতেই পেচ্ছাপ-পায়খানা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে। খাওয়াও তাই। আল্লার বান্দা তো ওরাও। এত যে কষ্ট, এত যে পীড়ন, এত যে অকারণ শাস্তি, তা মুখে তো কারুর একটি রা নাই। পায়ে পা জড়িয়ে যাচ্ছে। তবু চুপ করে ওরা হেঁটে যাচ্ছে। হেঁটেই যাচ্ছে। চোখে জল আসে ঈশমের।
‘আমার গুনাহ’র শাস্তি আল্লাপাক আমারে আলবৎ দিবেন। তোরা আমারে ক্ষমা করিস। বাবা মরে গেল চারদিনের জ্বরে। আমাদের তো কিছুই নাই। আমিই ওই জ্যাঠাদের সব জমিজমা দেখতাম। চাষ হচ্ছিল। ঘরের আমাদের চালের অভাব হতো না। ভালোই ছিলাম। বিয়ে-শাদি হলো। ছোট বিটিটা কোলের থাকতে ধানবাদের সে জ্যাঠা-কাকা-বড়মা-কাকিরা সব একে একে মরে গেল। বয়সও হয়েছিল। দেশে ধানের বাজারদর এত পড়ে গেল যে গাঁয়ের জমিজায়গা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে তিন বিঘে মতন রেখে বাকি জমি দাদারা সব বিচে দিলে। উহারা শিক্ষিত বটে। ভালো বুঝল। তাতে সব বছর ভালো ধান হচ্ছে না। মেঘের জলের আর কোনো গ্যারান্টি নাই। শ্যালোর যা খরচ আর বাজারে ধানের যা দাম, তাতে আর চলছে না। ইবার আমরা কোথা যাই। ঘরে মা, বিবি, দুটো ব্যাটা, একটো বিটি, আমি নিজে, খাবার মুখ কি কম? প্যাটের জ্বালায় এই গরুপাইকারির কাম ধরতে হল রে, আমি তোদের গুনাগার হয়ে গেলাম।’
মনে মনে গরুগুলোর সঙ্গেই কত কথা বলে যাচ্ছিল ঈশম। আর পথ হাঁটছিল। হঠাৎ দেখে রাত পুইয়ে ভোর হচ্ছে আর সেই আলোয় জয়দেবের মন্দিরের চূড়াটা দেখা যাচ্ছে। ভোরের ঠান্ডা বাতাসে শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ লেগে আসছে। রমজান চলছে। ঈশম রোজা রাখেনি। ঘরের মানুষজন সবাই রাখছে। শুধু ছোট বিটিটাকে রেয়াত করেছে ওর মা, ঈশমের বিবি। আকাশের রঙ দেখে ঈশমের মনে হল এইবার ওর বিবিজান ফজরের নমাজ পড়তে বসল।
মহাজন ফোন করেছিল। জয়দেব থেকেই আর এক পাইকার গরুগুলো চাপিয়ে নেবে লরিতে। ঈশমদের আর ইলামবাজার অব্দি যেতে হবে না। তাহলে ইলামবাজারের চা-নাস্তাটা বেঁচে গেল। আর গালের ফটাস ফটাস থাপ্পড়টাও! কথাটা মনে আসতেই ঈশম হা হা করে জোরে হেসে উঠল। বাগালটা পাশেই ছিল। অবাক হয়ে তাকাতে ঈশম বলল, ‘ডাঁড়ায়ে দেখছিস কি? হাঁট্ ব্যাটা, আর খানিকটুকু। আমাদের ছুটি হয়ে গেলছে। জয়দেবে নাস্তা-পানি খেয়ে ঘরকে যাব।’
মাঘমাসের শীত বলে কথা। সারা গা হিম হয়ে ঘুমটা ভাঙতে ঈশম দেখে ঘরের আলোটা জ্বলছে আর গা থেকে লেপটা সরে গেছে। পাশের খাটে মেজকাকা নেই। নিজে উঠেছে বেশ করেছে, তা চোখের উপর আলোটা কটকট করে জ্বলছে সে খেয়াল নেই। নিঝুম রাত। ঈশম ঠাওর করে শুনতে পেল মেজকাকা রান্নাঘরে কী খুটখাট করছে। ভাবল যাগ্গে মরুগ্গে। যা করে করুক। লেপটা টেনে মুড়ি দিয়ে শুতে গেল। কিন্তু পেচ্ছাপ পেয়েছে। সেরে না আসলে ঘুম আসবে না। উঠে লুঙ্গিটা গুছিয়ে ঈশম দেখে মাঝের ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ভোর চারটে বাজছে। এত ভোরবেলা থেকে উঠে মেজকাকা কী করছে? উঠোন দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পেচ্ছাপ করে এসে ঈশম দেখল মেজকাকা রান্নাঘরের সামনের বড় টেবিলটায় একটা কাঁচের গেলাসে চা ছাঁকছে।
‘এত রেতে উঠলা কেনে? কোথাও যাবা নাকি?’ ঈশম শুধাল।
‘রাত আবার কোথায়? এই তো দিব্যি ভোর হবে। চা খেয়ে নিই। নিয়ে গোয়ালের গরুগুলোকে জাবনা দেব। তারপর বাইরে মাঠে বেঁধে দেব। কালো থাকলে আমাকে এসব কিছুই দেখতে হয় না। তোর দ্বারা একটা কাজ যদি হয়। দিনরাত শুধু চুলের টেরি আর বেলবটমের ঘের বাগানো। ফুটুনি খুব শিখেছিস! যা যা তুই শো’গে যা।’ মেজকাকা খ্যাঁচখ্যাঁচ করে বলল।
ঈশম এ বাড়িতে কোনোদিন থাকেনি। গ্রাম থেকে এসেছে আব্বার সঙ্গে কিন্তু ফিরে গেছে। গতকাল বাড়িতে গিয়ে ওর আব্বা মাকে বলছিল, ‘মুনিবদের ওবাড়ি থেকে সবাই দুর্গাপুজোর জন্য ধানবাদ গেছে। মেজগিন্নিও ব্যাটা-বিটিদের লিয়ে ওদের সঙ্গে চলে গেছে। তাই মেজমুনিব বলল যে কালো, তোর বড় ছেলেটাকে এ কটা দিন বিকেল করে পাঠিয়ে দিস। এত বড় বাড়িতে রাতে একা থাকলে ভালো করে পাহারা হবে না। শুনছ বিবি, ঈশমকে কাল থেকে বিকেলে সাইকেল নিয়ে ওবাড়ি যেতে বলবা। রাতে থেকে সকালেই চলে আসবে।’
ঈশম চলে এসেছে সন্ধের মুখে। ভাত, ডাল, শুশুনীর শাক আর আলুভাতে মাখা। পেঁয়াজ-লঙ্কাভাজা দিয়ে আলুভাতে যা মাখে না মেজকাকা! পেটভরে তাই খেল ঈশম। মেজকাকা রুটি খায় রাতে। আর কানের কাছে একটা ছোট রেডিও নিয়ে থাকে সবসময়। শীতের রাত। তাতে পেটে ভাত পড়তেই ঈশমের দুচোখ টেনে এসেছিল। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশম। আর ভোরবেলা উঠে দেখে এই।
মেজকাকা একটু কেমন মতন। এই ভালো মানুষ তো এই কেমন খেঁকিয়ে ওঠে। হাঁপানির কষ্ট পায় খুব এই শীতকালে। একবার ঈশম মেজকাকাকে সাইকেলে চাপিয়ে গাঁয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ বালিতে চাকা ফেঁসে টাল সামলাতে না পেরে কাকা ভাইপো দুজনেই রাস্তায়। আর উঠে মেজকাকা ঈশমকে কী মার যে মেরেছিল! মনে আছে দু তিন বছর আগে একদিন একটু বেলায় ওরা বাপ-ব্যাটায় এ বাড়িতে এসেছে। দেখে কি মেজকাকি খুব বকাঝকা করছে কাকাকে। খুব দরকারি কিছু একটা কিনতে নাকি টাকা দিয়েছিল। আর মেজকাকা বাজারে গিয়ে সব টাকা ভেঙে একটা এই বড় গাছ কাটার কাঁচি কিনে নিয়ে চলে এসেছে। মেজকাকি যত দাবড়ায় কাকা তত গুম হয়ে বসেছিল। ঈশমের কী হাসি পাচ্ছিল। ধান উঠবার পর ভাগ হবার সময় ঈশমরা দেখত আব্বা বাড়তি এক টিন ধান মেজকাকির জন্য আলাদা করে তুলে রাখে। ভাগের বাইরে।
সাইকেলে করে গাঁয়ে ফিরবার পথে আজ এসব কত পুরনো কথা যে মনে পড়ছিল ঈশমের। মেজকাকার তো সেই কবে ইন্তেকাল হয়েছে। তারপর মেজদা ছোড়দার বিয়ে হলো। ছেলেমেয়ে হলো। কাকি এখন ছোটছেলের কাছে দিল্লিতে থাকে। আর এই মেজদাদাটা খানিক ওর বাবার মতোই বটে। ইস্কুল মাস্টারির চাকরিটো ছেড়ে দিলে পার্টি করবে বলে। একটু আলাভোলা। মেজদার দাড়িগুলো সব পেকে গেছে। ঈশমেরও কি আর সে যৌবন বয়স আছে? শরীরে আর সে জোয়ার নাই। মেয়েটার ক’বছর হলো বিয়ে দিয়েছে। মেয়ের ঘরের একটা নাতি। আর বড় ছেলের এই হালে বিয়ে দিল। তবে হ্যাঁ, ঈশমের শরীরে এখনো সাহস আছে। আর সাহস থাকলেই তাকত আসে। আজ তো আল্লা রসুল সে পরীক্ষাই নিলেন!
ও আজ একটা কাজে বিকেল চারটে নাগাদ এই মেজদার বাড়ি এসেছিল। ভাগ্যিস এসেছিল! নইলে আজ যে কী হতো ঈশম আর ভাবতে পারছে না। খোলা গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখে মেজদা হতচকিত হয়ে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
‘কি হল কি তুমার? অমন খাড়ায়ে রয়েছ ক্যানে?’ ঈশম গ্যারেজে সাইকেল ঢোকাতে ঢোকাতে শুধাল।
‘বুঝলি, ঝামেলা হয়েছে একটা। ওই নিচের শোবার ঘরটায় একটা সাপ ঢুকেছে। তোর বৌদিরা তো নেই। ভাইঝিকে মুম্বই পৌঁছতে গেছে। ওই ঘরের সব জানলা বন্ধ।আমি ওঘরে গেছি চিরুনি নিয়ে চুলটা আঁচড়াতে। একটা খড়খড় শব্দ পেলাম। আওয়াজটা লক্ষ করে ওদিকের জানলার পর্দাটা সরাতেই দেখি লিকলিকে কালো একটা সাপ এই ফণা তুলে ফোঁস করছে! আমি ভয়ে পর্দাটা ছেড়ে দিতেই ও ওই জানলা আর খাটটার ফাঁকে ঢুকে পড়ল। কী করি এখন বল তো ঈশম?’
‘কী আবার করবে। উকে বার করে মারতে হবে। কই দাও, একটো টর্চ দাও।’
অতঃপর টর্চও না পেয়ে—
‘কী রকম কারবার তুমাদের গো, ঘরে একটো টর্চও নাই! বেশ, আমি আমার মোবাইল করে দেখে লিছি।’
‘পেলি নাকি রে দেখতে সাপটা? আছে, না?’
‘হ্যাঁ। থাকবে না? ইবার দাও একটো মোটা পারা লাঠি, আছে না তাও নাই?’ লাঠিটা পেয়ে সে ঘোষণা দিল, ‘শুনো মেজদা, তুমি বাইরে থেকে এই ঘরের দরজাটো লাগিং দাও। নয়তো উ ই ঘর থেকে বেরিং গেলে অখে ধরা যাবে না। এইবার অখে আমি কাবু করব।’
ঘরের সিংহভাগ দখল করা একটা বিরাট খাট, একটা বড় স্টিলের আলমারি আর একটা চওড়া বেঁটে প্লাইউডের আলমারি—এই আসবাব ভর্তি দশ ফুট বাই বারো ফুটের ঘরের ভিতর একটা জাত কালকেউটে। আর একজন জাত সাহসী, বীর, মরদ। ঘরের তিনটে জানলা বন্ধ ছিল। এবার দরজাটাও হলো। শুরু হল এনকাউন্টার।
পাক্কা চল্লিশ মিনিট লেগেছিল ঈশমের সেই সাড়ে তিনফুট লম্বা ভয়ঙ্কর বিষধর কালকেউটেটাকে বড় মোটা একটা লাঠির বাড়িতে নিকেশ করতে। হ্যাঁ, ও মেয়ে-সাপ ছিল। প্রচণ্ড গরমে ও বন্ধ কাচের জানলার ফাঁক গলে সেদিন ওই ঘরে ঢুকেছিল সম্ভবত মাতৃত্বের তাড়নায়, ডিম পাড়তে। সেগুলিকে তা দিয়ে তার নিজের উত্তরসূরিদের পৃথিবীতে হেঁটে বেড়ানো সুনিশ্চিত করতে।
প্রায় তিন থেকে চারবার সেই কালকেউটের ছোবল থেকে বিদ্যুৎগতিতে ক্ষিপ্র তৎপরতায় ও দুরন্ত শারীরিক ফুর্তিতে ঈশম নিজেকে বাঁচায় সেদিন। একাই অমানুষিক শক্তিতে ঘরের আসবাবগুলো ওকে সরা-নড়া করতে হয় আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা চালিয়ে যেতে। তারপর সেই ডিম পাড়তে আসা শ্রীমতী কালকেউটেকে ও একটা কোণায় ঠেলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নাটকের শেষ দৃশ্যে চেক অ্যান্ড চেকমেট। তার রক্তচিহ্ন এখনো বেঁটে আলমারির পিছনের দেওয়ালে। ঈশম দ্য হিরো তারপর ঘেমে নেয়ে রক্তমাখা লাঠিটা গেটের বাইরে দূরের ঝোঁপে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আর মেজদাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সামনের গাবায় সাপটাকে পোড়ায় দুজনে।
এই দুর্ধর্ষ জয়ের অনতি পরই আমি একটা ফোন পাই ঈশমের। ওর মেজদার ফোন থেকে। গলায় স্বাভাবিক উত্তেজনাটুকু ছিল। এতটা শারীরিক যুদ্ধ, ফলে একটু হাঁপাচ্ছিল। কিন্তু কোনো আস্ফালন ছিল না ওর গলার স্বরে। আর ছিল না কোনো এক্সপেকটেশন। একবারের জন্যেও ঈশম বলল না আমাকে এর জন্য তোমরা কী পুরস্কার দেবে। কী নিরাসক্ত ছিল ও কোনওরকম চাহিদার প্রতি! বাড়িতে টর্চ কেন নেই বলে আমায় বকাবকি করছিল। বললাম,’ তুই কি বুঝতে পারলি সাপটা মেয়ে না ছেলে?’ হাহা করে হেসে বলল, ‘কী যে বলো তুমরা, তা বুঝতে পারব না? উ মেয়েছেলে ব্যাটে, তাই অর এত ত্যাজ। অ্যাই ফ্যানা (ফণা) তুলে একবারে ডাঁড়িং যেছে। উ ডিম পাড়তে আইছিল। আমি না এলে আজ সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে যেত গো বৌদি।’
বললাম, ‘তা তুই যে ঘরে ওর সঙ্গে থেকে গেলি দরজাটা বন্ধ করতে বলে, যদি ফস্কে যেত? তোর ভয় করেনি?’
সহজ হেসে বলল, ‘কিসের ভয়? এসপার নয় ওসপার তো করতিই হবে। নয়তো মেজদা রেতে থাকত কী করে? ভয় খেলে হব্যা? হয় অখে আমি মারব নয় উ আমাকে ছুবল দিবে। বাস্। ওই ভয়ডর নাই যে আমাদের শরীলে। আর কুনো ব্যাপারে জানের মায়া করি না। কী হবে? মরতে এত ভয় ক্যানে বলো তো?’
এত সহজে ও এত কঠিন প্রশ্নটা করল আমায় যে আমি নিরুত্তর ছিলাম। বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আমরা মরা মানুষ ঈশম। আমরা মরেই থাকি। তোদের মতন এমন জান কবুল করে বাঁচতেও জানি না, লড়তেও জানি না।’
বলাবাহুল্য ঈশম কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। উপরোক্ত ঘটনাগুলিও ঠিক কাল্পনিক নয়। কল্পনা করার প্রয়োজনই পড়েনি কেননা এই ঈশমদের সঙ্গে ওই মেজমুনিবদের জীবন এমনই ভাতের পাতে ডালের, রক্তমাংসের স্বাভাবিকতায় বিদ্যমান ছিল এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত। ইতিহাসের নিরিখে তো বটেই, এই মানুষগুলো তাদের স্মৃতিতে তিনপুরুষের এই সহজ সহাবস্থান দেখেছে ও সেইভাবেই বেঁচেছে। কোথাও কিছু কম পড়েনি। ধর্মীয় ভেদ-বিভেদের সুর জীবনের মূল সুরটির কণ্ঠরোধ করে এমন করে বেজে ওঠেনি। ও সেদিন মরে গেলেও ওর নামে গার্ড অফ অনার হতো না। ও যে এত বড় এক যোদ্ধা, বীর, একশো শতাংশ নির্লোভ, নিরাসক্ত, উদাসীন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা না জেনেও শুধুমাত্র মানুষের ধর্মে এমন একটা নিদর্শন রাখল, সেসব স্রেফ না জেনেই দিব্যি সাপ মেরে মোটরসাইকেলে চেপে গাঁয়ে ফিরে গেল। সেটাও কেউ জানবে না, কোথাও ওর ফেলিসিটেশন হবে না। আর তাতে ওর কিছুই যায় আসে না। ওরা এসবের তোয়াক্কাই করে না। এই সব মানুষগুলোর বাঁচার, জীবনযুদ্ধের সংজ্ঞাই আলাদা।
ওর নাম নুরুল, রফিকুল, আসিফ, সাদেক, ইকবাল, বশির—যা খুশি হতে পারে। এই মুহূর্তে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ঈশমের নিরাপত্তার জন্যই ওর আসল পরিচয় দেব না। তাই খানিকটা গল্পের আদল দিতে হলো এই লেখার। ঈশমরা দেশ কাল জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এভাবেই মানুষের পাশে থাকে, শুধু পাশে থাকার শর্তেই এমন অমূল্য জীবনটা কবুল করতে কসুর করে না, দুবারও ভাবে না।
আর হ্যাঁ, ওকে আমি ঈশম বলে ডেকেছি তার কারণ—আমি ওর মুখে ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’র ঈশমের ছায়া দেখেছি।
• কথাসাহিত্যিক, ভারত।