তাহলে মাছদের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো

বংশ পরম্পরায় ভুঁড়িওয়ালা বড়শিওয়ালার মাছ ধরার নেশা। সুযোগ পেলেই সে বড়শি নিয়ে ছোটে। আজ খুব সকাল সকাল কন্যাদিঘির দখিন পাড়ে পুঁতে রাখা লাটিতে ছাতা বেঁধে তার নিচে আসন পাতে। খৈল, হালকা আঁচে ভাজা সুজি, ছাতু, পাউরুটি ইত্যাদি সাত রকমের খাবার দিয়ে তৈরি করা চার ফেলে সন্তর্পণে। কেঁচো আর নালসো পিঁপড়ের ডিম দিয়ে আধার লাগায়। বৃদ্ধা আর তর্জনির সাহায্যে কায়দা করে বড়শি ফেলে। শাঁ করে বাতাস কেটে দলা পাকিয়ে বড়শি ছোটে। টুপ করে পড়ে জলের ভেতর। তরুণ মাছ, তরুণী মাছ, প্রৌঢ়-বৃদ্ধ মাছ, ছোট ছোট মলা-ডেলা-পুঁটিরাও ভিড় করে বড়শি ঘিরে। খিদের জ্বালায় ছুটে আসে নানা রকম মাছ। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, ঈশান-নৈঋত সবদিক থেকে নিজ নিজ আবাস ছেড়ে মাছেরা আসে। তাগড়া বোয়াল আধার গিলে। ফতার মাথা কাঁপতে থাকলে ছিপে ঢিল দেয় বড়শিওয়ালা। বোয়াল হাসে। দাঁতের ওপর বড়শি রাখে। টান মারলে উঠে আসে খালি বড়শি । 
ধুর শালা! বড়শিওয়ালা গাল দেয় কপালকে। 
কপালের কী দোষ! সব ওই তাগড়া বোয়ালের কারসাজি। বুঝে উঠতে পারে না ভুঁড়িওয়ালা বড়শিওয়ালা। আশায় আশায় বড়শি ফেলে। দাদাজানের কথা মনে পড়ে তার। রাজা মিয়া চৌধুরী বেঁচে থাকতে প্রতিযোগিতা করে মাছ শিকার হতো। গাঁয়ের জমিদার বলে কথা। গঞ্জ থেকে বড় বড় অফিসার আসত। বড় মাছটি যার বড়শিতে উঠত তাকে জমিদার সাহেব দিতেন রাজকীয় সব উপঢৌকন। রুপার বাটি, সুরমাদানি, মুনফ্লাস্ক এসব মিলত উপহারস্বরূপ। দিনভর চলত নানাপদের খাবার দাবার। রাতে চলত গান-কীর্তন, বাইজি নাচ। এখন জমি নেই, জমিদারিও নেই। আছে এই একখানা দিঘি। রটনা আছে, পরদাদা আলী মিয়া চৌধুরী নিজ হাতে ষোড়শী কন্যা মতিজান বেগমকে খুন করে ভাসিয়ে দিয়েছিল এই দিঘির জলে। সেই থেকে লোকেরা নাম দিয়েছে কন্যাদিঘি। এসব মনে আসতেই এখন বিষম নেশায় পেয়ে বসে তাকে। ঘোরের মধ্যে বুঝতে পারে টান পড়েছে বড়শিতে। এবারও লাগে না। সে ভাবে, বোধ হয় বড় কাতাল আধারটা কাবু করে দিয়েছে। 
এদিকে একটি ধবধবে সরপুঁটিকে ঘিরে তরুণ মাছেরা জটলা পাকায়। বৃদ্ধরা, প্রৌঢ়রা কী হয়েছে, কী সমাচার বলে ছুটে আসে। আধার খেতে আসা বড় কাতালের মনোযোগও সেদিকে।  
সরপুঁটি সমবেতদের অনুমতি নিয়ে কথা বলা শুরু করে। দেখুন, আমরা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছি। গত চারদিনেই আমার জানামতে মাছুম ও তরুণ-তরুণী মিলে রুই দশ, মৃগাল বার, টেংরা বিশ, আমার পিতামহসহ পুঁটি বিশ এবং অন্যান্য চল্লিশ সব মিলিয়ে শতাধিক মাছ নিখোঁজ হয়েছে। এসব ঘটছে ঠিক আমাদের চোখের সামনেই। এই যে আমার পাশে ঝুলে আছে একখান খাবার। আমি নিশ্চিত এটি কোনো খাবার নয়। মরণফাঁদ, টোপ। সুক্ষ্ম মাথায় চিন্তা করে দেখেছি আমি, ডাঙার সঙ্গে এর রয়েছে প্রত্যক্ষ সংযোগ। আমাদের স্বজনদের সেখানে তুলে নেয়া হচ্ছে কোনো কারণে। যে কারণেই নেয়া হোক না কেন, তারা আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এটাই নির্মম সত্য। এভাবে হারিয়ে যেতে থাকলে আমরা যে সমূলে বিনাশ হয়ে যাব সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 
এমন সময় পেছন থেকে আওয়াজ এল গেল, গেল। সবাই পেছন ফিরে তাকায়। চারদিক থেকে প্রশ্ন আসে কে গেল? কোথায় গেল?
সরপুঁটি দীর্ঘ করে শ্বাস নেয়। বুঝতে পারছি নিখোঁজ তালিকায় নতুন কারো নাম সংযোজন হতে যাচ্ছে। ঈশান কোণের গালকাটা তরুণী রুইটি বলে, আমি জানি সে কে। কিছুক্ষণ আগেও তাকে আমি দেখেছি এখন আর দেখতে পাচ্ছি না। 
উৎসুক দৃষ্টিতে সকলে তাকায় তরুণী রুইটির দিকে। সরপুঁটি তাকে অনুরোধ করে নামটি সর্বসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য। ধীর তালে এগিয়ে আসে তরুণী রুই। তার অবসন্ন ব্যথিত চোখ জরিপ করে চারদিক। নিজের কষ্টকে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেই কিনা সে দম নেয়। আমি তার নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে একটি কাহিনিও বলছি। কেউ আমাকে উঠকো প্রশ্ন করবেন না দয়া করে।
ব্যথিত হৃদয়ে বলতে শুরু করে সে। ও আর কেউ নয়। আমার ঘনিষ্ট বান্ধবী নিতিয়া। অনেকে চেনবেন তাকে। আমাদের পাশেই থাকত, ঈশান কোণে। গেলবার শুকনো মৌসুমে ওর বাবা মা দুজনই আটকা পড়েছিল শিকারীদের জালে। অনেকেই মৃগেল কন্যা নিতিয়াকে চিনতে পারে। চিনতে পেরে শোকে বিহ্বল হয় কেউ কেউ। সমবেদনা প্রকাশ করে অনেকে। তরণী রুইটি একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে। 
সেই ছোট বেলা থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি আমরা। আমি আর নিতিয়া। দুজনেই বর্ষার কানায় কানায় পুকুরে খেলতে যেতাম। পাড়ের কলমি লতা, গুল্ম আর সোঁদা গন্ধের জীবগুলোর আশায় আশায় কখনো কখনো বিপজ্জনকভাবে চলে যেতাম কাপকূলে। মা বাবা এজন্য কম গালমন্দ দেয়নি আমাদের। গেলবার বড় বর্ষা উৎসবে আমাদের দেখা হয় এফোনের সঙ্গে। এফোন, যে মঞ্চে গান গেয়ে মাত করে দিয়েছিল সেবার। বুঝতেই পারছেন, সময়টা কতোটা অন্য রকমের ছিল। বর্ষার বাড়ন্ত সময়গুলো। কত কিছু যে মনের মধ্যে খেলে যেত তখন। তো এমনি সময়ে ওদের দুজনের মধ্যে কথা হয়। নিতিয়া তার দুঃখের কথা শুনায় এফোনকে। এফোন তার মাতৃহারানোর গল্প বলে নিতিয়াকে। এভাবে দুজনের মধ্যে ভাব হয়। পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে তারা।
বৃদ্ধরা মুখের ভেতর তওবা তওবা বলে। প্রৌঢ়রা নড়েচড়ে ওঠে। তরুণ তরুণী মাছেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে পরস্পর।  
তরুণী রুইটি আবার বলা শুরু করে। তাদের সে ভালোবাসা ছিল খুবই নির্মল আর শোভিত । আমি সেটা ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারব না। এটুকুই বলব শুধু, সেসব দেখে আমার যথেষ্ট হিংসে হতো। তবু সে ছিল আমার ঘনিষ্ট বান্ধবী। একান্ত সুখে দুঃখের সাথী। তার জন্য অনুভবও আমার কম ছিল না। একবার এফোনের অসুখ করলে নিতিয়ার ব্যতিব্যস্ততা, আহার খোঁজা, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে এফোনকে আশ্বস্ত করার ভেতর দিয়েই আমি তাদের ভালোবাসার স্বরূপ বুঝেছিলাম। সে সময় নিতিয়া সারাক্ষণই থাকত এফোনের কাছাকাছি। আর এসব ঘটেছিল আমার সম্মুখেই। 
আবারও প্রৌঢ়রা-বৃদ্ধরা মুখের ভেতর জাবর কাটে। তরুণ তরুণীরা অধিক কিছু শুনার জন্য কান খাড়া করে দেয়। আর তরুণী রুইটি যেন রূপকথার গল্প বলতে শুরু করে। গত পরশু হঠাৎ নিতিয়ার পেটব্যথা ওঠে। দেখি সে ছটফট করছে। এফোনকে ডেকে আনি আমি। এফোন ভেঙে পড়ার নয়; তবু সে ভেঙে পড়ে কিছুটা। দূর থেকে আনা কী একটা নিতিয়ার মুখে পুরে দেয়। নিতিয়া আমাকে কাছে ডাকে। বলে, সই তুই ওকে বোঝা। আমি ঠিক ভালো হয়ে যাব। অযথা ছুটোছুটি করছে ও। সারাদিন তার কোন বিশ্রাম নেই। এফোন বসে থাকে না তবু। ঘুরাঘুরি করে। ওষুধ যোগায়। পথ্য যোগায়। বিকেলের দিকে খানিকক্ষণের জন্য নিতিয়ার কাছে থাকে। নিতিয়াকে গান শোনায়। সেসব মরমী গানের মর্ম নিতিয়া আমাকে পরে খুলে বলেছিল সব। তারপর সে এক সময় আহার খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। যাবারকালে নিতিয়াকে বলে, তোমার অসুখ খেয়েছে আমাকে। এ বর্ষায় ঘর বাধতে হবে।
সে যাওয়া ছিল তার শেষ যাওয়া। অগস্ত্য যাত্রা। ফিরে আসেনি আর। সন্ধ্যায় নিতিয়া একটু সুস্থ হলে আমরা দুজনেই তাকে খুঁজতে বেরোই। কোথাও তার এতটুকু খোঁজ পাইনি। পরে বুঝতে পারি, নিতিয়ার জন্যে খাবার খুঁজতে গিয়ে সে দিগ্বিদিক হয়ে টোপ গিলে ফেলেছে। বুড়ো কাতাল আধার গিলতে দেখেছে তাকে। এরপর নিতিয়া কেবল একটি কথাই বারবার বলেছিল আমাকে, আমি ওকে মেরে ফেলেছি। ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। সেও তো বলেছিল, আমার অসুখ তাকে খেয়েছে। তুই আমাকে মেরে ফেল সই। এ জীবন রাখতে চাই না আমি। না হয় আমি তার পথ ধরে তার মতো করে উধাও হয়ে যাব একদিন। আমি তাকে চোখেচোখে রাখতে চেয়েছি, পারিনি। আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন।
এমন সময়ে আরও দুজনের নিখোঁজ খবর নিয়ে আসে ছোট টেংরা। ধবধবে সরপুঁটি বলে এটি বৃহৎ ট্র্যাজেডির খণ্ডিত অংশমাত্র। এরচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। 
মৃগাল তরুণ নিশিম জিজ্ঞেস করে এখন আমাদের করণীয় কী। কী করলে পরিত্রাণ পাবো আমরা।
সরপুঁটির গলা বেশ দৃঢ় শোনায়। কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে আমাদের, করা তো উচিত। আপনাদের কী বক্তব্য?
তরুণদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, আমরা ডাঙায় যাব। স্বজনদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে আসব। চারদিক থেকে তখন দালানভাঙা আওয়াজ ওঠে আমরা সবাই ডাঙায় যাব, ভ্রাতৃ হত্যার বদলা নেব।
বড়সড় বৃদ্ধ কাতাল যে এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, মুখ খোলে। ডাঙায় যাওয়া ধর্মে বারণ আছে। ডাঙায় যাওন যাইব না। 
দু’চারজন প্রতিবাদী হবার চেষ্টা করে। তর্ক জুড়ে দিতে চায়। বয়োবৃদ্ধদের, বোয়াল-রুই-কাতালদের চোখরাঙানিতে পারে না, চুপসে যায় তারা। মাথা ঝিম ধরে সরপুঁটির। এমতাবস্থায় নীরব থাকাটাই শ্রেয় মনে করে সে।  নিশিমসহ কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে যায় আড়ালে। তারা শলাপরামর্শ করে। রণকৌশল ঠিক করে নেয়।
নিশিম এবার জমায়েতের সামনে এসে দাঁড়ায়। শুনুন আপনারা, এটা আত্মকলহের সময় নয়। এটা হলো অস্তিত্বের প্রশ্ন। মাথা ঠান্ডা রেখে এগোতে হবে আমাদের। নিতে হবে বিহিত ব্যবস্থা। অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা, ছোট ছোট নানা প্রজাতির মাছেরা নিশিমের কথায় সায় দেয়, মাথা নাড়ে। এগিয়ে আসে ধবধবে সরপুঁটি। নিশিম তুমি সাহসী দেখে টেংরা, শিং, মাগুর ও অন্যান্যদের মধ্য থেকে গোটা বিশজনকে টোপের চারদিকে পাহারা বসাও। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত টোপের ফাঁদে যেন কেউ পা না ফেলতে পারে। কথা মতো নিশিম দায়িত্ব পালনে উম্মুখ হয়। কিন্তু বাধ সাধে বড়রা, বৃদ্ধরা, বোয়াল-রুই-কাতালরা।
আমরা কি তাহলে সাধের ওই খাবারটি খাব না? অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বৃদ্ধ কাতাল। 
না। তবে আমরা না খেয়েও মরব না। আমাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সরপুঁটি প্রত্যুত্তর করে। 
জমায়েতের হাবভাব বুঝে নিজেকে সংযত করে বৃদ্ধ কাতাল। মুখে মুচকি হাসির ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে। স্বর নিচু করে। শোন বাবারা, বয়স আমার কম হয়নি। তোমরা যারা এখানে কথার খৈ ফুটাচ্ছ, গল্পরসে কথা বানাচ্ছ তোমাদের বাপ-দাদাদের হতে দেখেছি আমি। তোমরা যে অরাজকতার কথা বলছ তা হতে দিতে পারি না আমি। আমাদের ধর্মমতে এসব হতে পারে না। বাপ-দাদারা এ আহার খেয়ে গেছে, আমরাও খেয়ে যাব।
বৃদ্ধ কাতাল ধর্মবাণী উদ্ধৃত করে ‘তোমাদের মধ্যে যে পূণ্য কাজ করবে সে এ আহার খেয়ে পরিতৃপ্তি পাবে। আর যে পাপ কাজ করবে সে তার ধ্বংস ডেকে আনবে। মনে রেখ, অবাধ্যদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’
বৃদ্ধরা বলে—আমিন, আমিন। আমরাও এটি হতে দিতে পারি না। বাপ-দাদাদের রুসম, ধর্মরক্ষা আমাদের ওপর অবশ্যকর্তব্য। সায় দেয় বড় বৃদ্ধ, মাঝারি বৃদ্ধ আর ছোট বৃদ্ধরাও। তরুণদের মধ্যেও দু চারজন তাদের সঙ্গে জোট পাকায়।  
তরুণ তরুণীরা তেড়ে আসে, ক্রুদ্ধ হতে চায়। সরপুঁটি তাদের প্রশমিত করে। সে ফতোয়াবাজ বৃদ্ধ কাতালের দিকে তাকায়। ঠিক আছে, আপনিই বলেন এখন আমাদের কী করণীয়? 
সে আমি আগেই বলেছি। সবকিছু চলবে পুরাতন নিয়মে। এতদিন যেভাবে চলছিল সেভাবে। একথা বলতে বলতে টোপের কাছে যেতে উদ্যত হয় বৃদ্ধ কাতাল। নিশিম সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে বাধা দিতে আসে। এবারও সরপুঁটির হস্তক্ষেপ আসে নিশিমদের ওপর।
বুড়ো কাতাল টোপের আধার গিলে। ফতা উপরনিচ করছে। সুঁতোতে টান পড়তেই ভুঁড়িওয়ালা বড়শিওয়ালার চেতন আসে। হারামি, এখন তোর খোট দেয়ার সময় হয়েছে! ধ্যানভঙ্গ ঘটে তার। লোকটি ধ্যানমগ্ন ছিল এতক্ষণ। পানি নিতে আসা যুবতীটিই ছিল তার ধ্যানের কারণ। অসময়ে কাতাল বড়শিতে খোঁট দিয়ে তাকে বঞ্চিত করে। চিন্তার পূর্ণতায় ছেদ ঘটায়। মাথায় তার রক্ত ওঠে। ভুঁড়িওয়ালা বড়শিওয়ালা আশায় আশায় ছিপে টান দেয়। না, এবারও লাগে না। 
বালিকাটি কলসি নিয়ে পাড়ে ওঠে। তার পুরুষ্ট গাল, ভারিক্কি পাছা আর সটান বুকের দিকে নজর পড়ায় ইচ্ছেরা দুমড়ে মুচড়ে উঠতে চায়। ইচ্ছে করে, ডেকে দুকথা বলতে। কিন্তু পাছে সালেহাকে ভয়। সেবার সালেহার খালাত বোন রুবা তাদের বাড়ি বেড়াতে এলে তার গাট্টাগোট্টা শরীর, ডাগর ডাগর চোখ তাকে ঠিক থাকতে দেয় না। ঠাট্টাচ্ছলে তার গায়ে হাত দেয়। গাল ধরে, ঠোঁট টানে। এসব দেখে সালেহা তাকে শাসিয়ে দেয়, কড়া কথা কয়। সেই থেকে বৌয়ের ভয়টা পিছু ছাড়ে না তার। 
এখন বালিকাটি চোখের আড়াল হলে সে আধার পুরে ঠেসে ঠেসে। শক্তি দিয়ে যতদূর যায় ছুঁড়ে দেয় বড়শিটাকে। সালেহাকে সে কথা দিয়েছে, আজ একটি বড় রুই সে লাগাবেই। সালেহার পেটের লাহান ধবধবে পেটিওয়ালা একখানা রুই তাকে নেশাগ্রস্থ করে তোলে।  
এফাঁকে সরপুঁটি আর নিশিমরা ঐকমত্যে পৌঁছায়। প্রথমে ঘরের শত্রু ঠেকাতে হবে। তারপর বাইরের শত্রু। তারা ঠিক করে, টোপ গিলা বন্ধ করতে হবে সর্বপ্রথম। প্রয়োজনে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করা হবে। 
টোপের দিকে বোয়াল এগোয়। মাঝপথে নিশিম তার পথ আটকায়। আপনারা আমাদের মুরুব্বি, গুরুজন। আমাদের অস্তিত্বরক্ষা তথা ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আপনাদের। আপনারা তা তো দেখছেনই না, উল্টো প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেখাচ্ছেন মরণফাঁদ। ধর্মের দোহাই দিয়ে বৈধ করেছেন টোপ গিলা। আমরা জানি, এ টোপে আপনাদের কিছুই হবে না। মারবেন আমাদের ছোটদের, আপনাদের সন্তানদের, পুঁটি-কৈ-মাগুর-শিং-টেংরাদের। এ আপনাদের ভারি অন্যায়। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। আমরা আপনাকে যেতে দেব না। গলা ধরে আসে নিশিমের।
বোয়াল এসব কানে নেয় না। সে তেড়ে আসে ওদের দিকে। তেড়ে আসে রাক্ষুসে মুখ হা করে। নিরীহদের জাপটা দেয়। দু’চারজনকে গিলে ফেলে। 
আর অমনিই পূর্বসিদ্ধান্ত মতে বোয়ালের ওপর চড়াও হয় হাজারো মাছ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ, তরুণ মাছ, তরুণী মাছ, ছোট ছোট রুই-মৃগেল-ল্যাটা-পুঁটি-টেংরা মাছ। পাছে দু’চারজন বৃদ্ধ মাথা তুললে তাদের ওপরও চলে একইরকম আক্রমণ। শিং, মাগুর, টেংরা কাঁটা দিয়ে হুল ফোটায়। ল্যাটা গুতা মারে। কৈ বোয়ালের চোখ তুলে খায়। অন্যরাও কম যায় না। 
এসব দেখে অন্যান্য ভীত, শঙ্কিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তরুণদের সঙ্গে একমত পোষণ করতে থাকে। সম্মিলিত আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয় বোয়ালরা, বৃদ্ধরা। 
তরুণদের পক্ষেও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নগণ্য নয়। এ আক্রমণে তারা হারিয়েছে অনেক জ্ঞাতিকে, সহযোদ্ধাকে। প্রতিশোধ তবু তাদের নিস্তব্ধ করতে পারে না। কয়েকজন বেরিয়ে যায় বৃদ্ধ কাতালকে খুঁজতে। তাকে এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। যদিও সবাই জানে সবকিছু ঘটেছে তারই অঙ্গুলিহেলনে। 
নিশ্চয় সে আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। বলে, একজন বীরযোদ্ধা। 
একটা টিলা মতো জায়গা বরাবর অবস্থান নেয় সরপুঁটি।
ভাইয়েরা আপনারা ক্লান্ত, অবসন্ন। আপনাদের ঐক্য আর মিলিত প্রচেষ্টায় আজ অস্তিত্বের সংগ্রামে জয় পেয়েছি আমরা। তবে আমাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। আপনারা জানেন, আমাদের বাইরের শত্রু এখনো বহাল তবিয়তে। আমাদের ভেতরেও দু’চারজন মোনাফিক শত্রু থেকে যেতে পারে। আমরা ফতোয়াবাজ কাতালকে ধরে আনার জন্য নিশিমদের পাঠিয়েছি। আপনাদের আদালতেই তার বিচার হবে। 
শ্লোগানে মুখরিত হয় চারদিক। ফতোয়াবাজ কাতাল ধর, জবাই কর কেটেকুটে আহার কর। ফতোয়াবাজ কাতাল ধর, জবাই কর কেটেকুটে আহার কর।
শত সহস্র শ্লোগানের ভেতর সরপুঁটির বক্তব্য হারিয়ে যায়। শ্লোগান চলতে থাকে অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণের মতো। ফতোয়াবাজ কাতালকে নিয়ে আসে নিশিমরা। সরপুঁটির করজোড় আবেদনে শ্লোগান বন্ধ হয়। 
প্রিয় ভাইয়েরা আমার, সে বলতে থাকে—যার জন্য আমরা এতক্ষণ অপেক্ষা করছি সে এসে গেছে। আপনাদের নিকট আমার আকুল আবেদন কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। 
তবু যে কেউ কেউ আইন হাতে তুলে নেয় না তা নয়। দু’একজন জোশে, ক্রোধে পেছন থেকে ভেংচি কাটে, হুল ফুটিয়ে দেয় কাতালকে।
ফতোয়াবাজ কাতাল সরপুঁটির পাশে এসে অবস্থান নেয়। কৃতকর্মের জন্য সে অনুতপ্ত কিনা বুঝা যায় না। তাকে সুযোগ দেয় সরপুঁটি। সমবেতদের উদ্দেশ্য করে কাতাল লেজ নাড়ে। শোন বাছারা, আমি যা করেছি ধর্মের জন্য করেছি। বাপ-দাদার রুসম রক্ষার জন্য করেছি। তোমাদের ছোটদের মুতে আছাড় খেয়ে বেদআতে শরিক হইনি। এটা যদি আমার অপরাধ...। 
তার কথা শেষ হয় না, চারদিক থেকে ফের শ্লোগান ওঠে। কাতাল তোমার ক্ষমা নাই, তোমার কোনো রক্ষা নাই। বৃদ্ধ কাতালের মৃত্যু চাই, দিতে হবে দিতে হবে।
সরপুঁটি আর নিশিমদের করার কিছুই থাকে না। ওরা চেয়েছিল প্রাণাধিকারের দাবি তুলে বৃদ্ধ কাতালকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু এতসবের রায়, জনমতকে কিভাবে উপেক্ষা করে তারা। হাজারো মাছের রায়ে কাতালের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়।  
এবার বাইরের শত্রু নিধন পালা। 
এখন নিশিমসহ কয়েকজন বড়শির সুতো বেয়ে বেয়ে উপরে ওঠে। ভুঁড়িওয়ালা বড়শিওয়ালাকে দেখতে পায় তারা। ডাঙার কারসাজি বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের। সিদ্ধান্ত হয়, লোকটি যখন পুনঃ টোপ ফেলবে তখন একজন বড় শক্তিমান কাতাল টোপ গিলবে। সম্পূর্ণভাবেই সেটা গিলে ফেলবে সে। অন্যরা তার আশেপাশে থাকবে। যখন বড়শিওয়ালা সূতা টানবে সবাই মিলে তখন কাতালকে চেপে ধরবে। তাহলেই সে লোভ সামলাতে না পেরে নামবে পানিতে। আর তখনই বোয়াল চূড়ান্ত আঘাত হানবে।  
এফোন, নিতিয়া ও নাম না জানা শত শত নিখোঁজদের স্মরণে সমবেত হয় মাছেরা। সিদ্ধান্তমাফিক টোপ গিলে নির্দিষ্ট কাতাল। ভুঁড়িওয়ালা বড়শিওয়ালা চেঁচামেচি শুরু করে। ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস দেখে যা আমার বড়শিতে বড় মাছ লাগছে, ভীষণ বড় মাছ। বলছিলাম না সালেহা আমি একটা বড় মাছ লাগাবোই, তোমার পেটের লাহান ধবধবে পেটিওয়ালা মাছ। সে বিড়বিড় করে। 
কোথাও কেউ নেই। কেউ তাকে শুনতে পায় না। হাজার মণ ওজন হয়ে থাকে বড়শিটি। টেনে তুলতেও পারে না, আবার একা দুপুরে পানিতে নামতেও সাহস হয় না তার। কিছু একটা জানা হয়ে যায় যেন। লোভ সামলাতে পারে না। বুক পানিতে নেমে পড়ে। ধীর পায়ে বড়শির মাথায় যায়। মাছের গায়ে হাত লাগে। খুশিতে তার মন ভরে ওঠে। সালেহার  কথা মনে পড়ে তার। তাকে সে কথা দিয়েছিল...। দাদাজানের কথা মনে পড়ে তার। জমিদারি আমলের মাছ শিকারের ছবি চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
খেলিয়ে খেলিয়ে মাছটাকে পাড়ে তুলতে হবে ভাবে ভুঁড়িওয়ালা বড়শিওয়ালা। কিন্তু একি! কে যেন তার পায়ের লোমগুলো টেনে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। লুঙ্গির ভেতর খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। দৈত্যের মতো কিছু একটা পা ধরে টানছে যেন। গা হিম হয়ে আসে তার। ইউনুস নবীকে মাছে গিলে খাবার কথা মনে পড়ে। লুঙ্গির নিচে হাত দিতে সাহস হয় না। শক্ত হয়ে জমে যেতে থাকে সে। চিৎকার মেরে পাড়ে উঠতে চেয়ে উঠতে পারে না। বোয়াল তার বিশেষ অঙ্গ কামড়ে নিয়েছে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে। দেখতে পায়, চোখের সামনের পানিগুলো ক্রমশ লাল হয়ে যাচ্ছে।


• কথাসাহিত্যিক, বাংলাদেশ।  

menu
menu