শেষ প্রহরের প্রলাপ
একটি তাকের কোণে কাঠের টুলে বসে তখন বাঁ হাতের কনে আঙুলের নখ দিয়ে ডান হাতের সবগুলো নখের ভিতরের ময়লা পরিষ্কার করছিল সোহেল। সবটুক মনোযোগ এক একটা নখের ডগায় কেন্দ্রীভূত। কাজটিতে তার মনোযোগ সেকালের ঋষি-মুনিদের ধ্যানমগ্নতার কথা মনে না করিয়ে পারে না। ঊর্বশী-রম্ভারাই শুধু পারবে তার ধ্যান ভাঙাতে। তবে ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে ব্যস্ত বেগে ছুটে আসা ছেলেটা আপাতত ইন্দ্রপুরী থেকে এই ম্লেচ্ছপুরীর রাজধানীতে অপ্সরাদের রাউন্ড ট্রিপের সময় ও খরচটা বাঁচিয়ে দিল।
নিচতলার সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দটা শুরু হওয়া মাত্রই তিন তলায় বসে সেটা অবশ্য টের পায় সোহেল। অবিরাম চলতে থাকা সেকেন্ডের কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল ছেলেটি। তার ব্যস্তভঙ্গি হয়তো দৌড় প্রতিযোগিতায় ট্র্যাকে নামা কোন দৌড়বিদকে উপহাসের পাত্র বানিয়ে ছাড়বে। বারবার সে হাতের ঘড়িটির দিকে তাকায় এবং সেকেন্ডের কাঁটাটিকে বিন্দুমাত্র আপস করতে না দেখে উৎকণ্ঠায় তার ছোটার গতি আরও বেড়ে যায়। শেষমেশ ঘড়ির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছে সে যখন তিনতলার দোকানটায় ঢোকে, সেটা বন্ধ হতে তখন ষোল-সতের মিনিট বাকি।
নখের ময়লাটুকু সরিয়ে ফেলা মাত্র আঙুলটিকে দুই দাঁতের মাঝে চালান ছেলেটির দিকে তাকায় সোহেল। তার নিঃশ্বাসে শব্দ সোহেলের কানে না আসলেও বুকের ওঠা নামা দেখে।
ননীর পুতুল নাকি, দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়েই মুতে দিছে!
সোহেল ছেলেটার দিকে আগায়।
পুরানা কাস্টমার। মাসে দুই-তিনবার তো আসেই।
সবসময় কিনতে আসে না। ঘুরতেও আসে। কয়েকটা বই নাড়াচাড়া করে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই পাঁচশ-হাজার এমনকি দুই-আড়াই হাজার টাকার বই কিনে দোকান থেকে বের হয়।
আর প্রায় সময়েই সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। অধিকাংশ সময়েই, না প্রায় সব সময়েই সঙ্গে থাকে মেয়েরা। তাও আবার একটা না। চারটা-পাঁচটা। অবশ্যই সবাই একসঙ্গে না। একেক সময় একেকজন। তারমধ্যে আবার একটারে নিয়াই বেশি আসে। গার্লফ্রেন্ড নাকি ওইটা?
কে জানে?
সবগুলার সঙ্গেই তো মাখামাখি করে। এদের মধ্যে কোনটা গার্লফ্রেন্ড বোঝবার উপায় কি! অবশ্য আজকালকার ভার্সিটির পোলাপান আবার খুব ফ্রেন্ড ফুটায়। প্রেম না কইরাও ওরা যেরকম মাখামাখি করে... আগে তো প্রেমিক-প্রেমিকারাও এত মাখামাখি করত না।
তবে হইতেও পারে, যে মেয়েটারে বেশি নিয়ে আসে ওইটাই গার্লফ্রেন্ড। সেও মনে হয় জানে যে ছেলেটা অন্য মেয়েগুলার সঙ্গে মাখামাখি করে। হয়তো সে নিজেও অন্য ছেলেগো সঙ্গে ওমনি মাখামাখি করে।
ছেলেটা ও তার মেয়েবন্ধুদের ভাবনায় সোহেল এতটা ডুবে ছিল টের পায়নি কখন তার ভাবনার শান্ত পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে সুর কেটে দিয়ে ওর পাশের তাকটির বই নাড়াচাড়া শুরু করে দিয়েছে ছেলেটা।
সোহেল ছেলেটির পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
—ভাইয়া কোন বইটা লাগবে?
ছেলেটি ভদ্রতার হাসি হেসে বলে,
—আমিই দেখছি।
ছেলেটির কথায় কিংবা ভঙ্গিতে বিরক্ত হবার কোনো কারণ না থাকলেও কেন যেন বিরক্ত হয় সোহেল।
দেখেন! আপনেই দেখেন! আমরাতো কিছু বুঝি না। বইয়ের নাম বললে খুইজা দিতে পারমু না। দোকানে বইসা সারাদিন ঘাস কাটি।
কিছু করতে হবে না অথচ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে। এখন আবার টুলে বসলে মালিক ধরবে।
—কাস্টমার বই খুঁজতেছে আর তুমি নবাবের বাচ্চার মতো টুলে বসে আছো কেন?
তারে তো আর বোঝানো যাবে না যে এই কুতুব বলে দিছে তারে বই খুইজা দিতে হবে না।
সোহেলের এই বিরক্তিভাবের সঙ্গে অবশ্য ওই ছেলেটার ভদ্র হাসির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা শব্দ দুটোর খুব একটা সম্পর্ক নেই।
এই আধা ঘণ্টাও হয়নি মালিক একদফা কথা শুনিয়ে গেল। কাল মঙ্গলবার। মার্কেট বন্ধ। পরশু একদিন খোলা, তার পরদিন সরকারি ছুটির জন্য আবার বন্ধ। তো পরশু যদি একদিনের ছুটি পাওয়া যায়, সোহেল বাড়ি গিয়ে বন্ধুর বিয়েটা খেয়ে আসতে পারে। ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া, ফুটবল খেলা, নদীতে দাঁপানো, আম চুরি-ডাব চুরি, একই বিড়ির পাছায় প্রথম টান দেয়া, মিলনের দোকানের পিছনের ঘরে ঘণ্টা হিসাবে ভাড়ায় ভিসিডি প্লেয়ারে ওইসব দেখা—বন্ধুত্বের গাঢ়তা নির্ণায়ক এই সকল চিরায়ত কাজগুলো কোনটা তারা একসঙ্গে করেনি?
সেই বন্ধুর বিয়েতে যাওয়ার জন্য একদিনের ছুটি চাইতেই মালিকের মুখ ঝামটা,
—খুব রঙ পাইছো? বন্ধুর বিয়ায় যাবা? এদিকে তাইলে দোকান চালাবে কে? সরকারি ছুটির জন্য যে পরদিন আবার বন্ধ এটা খেয়াল আছে মাথায়?
মালিকের সেই কথার ঝাঁঝ দুহাতের মুঠির মধ্যে শক্ত করে চেপে সোহেল নিঃশব্দে সেটা ছুঁড়ে দেয় এই ছেলেটার দিকে।
শালা বইয়ের নাম না জাইনা বই কিনতে আসছো ক্যান?
বইয়ের নাম মুখস্থ কইরা চুপচাপ এসে নাম বলবা, আমি বাইর কইরা দিমু, তুমি এরপর টাকা দিবা, বইটা নিয়া চইলা যাবা। এত দেখা দেখির কি আছে? তার উপরে দোকান খোলা আছে আর দশ মিনিট। এত দেখলে তোমার আর আজকে বই কেনা লাগবে না। বই তো কিনতে পারবা না, হুদাই দশ মিনিট আমারে তোমার পাছার কাছে খাড়া করাই রাখবা।
স্পিকারে বাজতে থাকা রবীন্দ্র সঙ্গীতের ইন্সট্রুমেন্টালের তালে তালে সোহেলের শব্দহীন কথাগুলো যেন পৌঁছে যায় ছেলেটার কানে। চিকন একটা বই বের করে সোহেলকে দেখায় সে।
বইয়ের পেছনে তাকিয়ে দাম বলে সোহেল।
—সাড়ে এগার শ টাকা। ক্যাশে চলেন।
হে! এদের টাকা কি আসলেই গাছে ঝোলে? এইটুক চিকনা একটা বই সাড়ে এগার শ দিয়া কিনতেছে? একশটা পৃষ্ঠাও নাই বইটায়। ইংরেজি বই, ইন্ডিয়া থেইকা আনানো। এজন্যে এর দাম হবে সাড়ে এগার শ! বোঝা গেল বিদেশি বই, তাই দাম না হয় একটু বেশিই হইলো। কিন্তু মানুষ আবার এই চিকনা বই সাড়ে এগার শ টাকা দিয়া কেনে। টাকার দাম এতই কম!
সোহেল দেখে এরই মধ্যে ছেলেটা মালিকের সঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে।
—ভাইয়া নিয়মিত কাস্টমার আমি। তারপরেও যদি পঞ্চাশ টাকা কম রাখার জন্য প্রতিবার রিকোয়েস্ট করতে হয়... রূপির দাম তো এখন পড়ে গেছে। কম রাখতেই পারেন।
শালা! সাড়ে এগার শ টাকার বই পছন্দ করতে পারো, আর এখন পঞ্চাশ টাকার জন্য তোমার কইলজা পোড়ে। তোমাগো ভণ্ডামি দেখলে গা জ্বলে।
ভাইয়া! কয়টা টাকা কম রাখেন ভাইয়া!
সোহেলের ভ্যাঙানো কথাগুলো ওর মস্তিষ্ক থেকে মুখ পর্যন্ত পথটুকুতে ঘূর্ণি তুলে ওখানেই মিলিয়ে যায়। নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের হওয়া নিষ্পাপ বাতাসে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
আবার মালিকের ফাঁপর দেখো। এই ব্যাটা আরেক চিজ।
—না না ভাইয়া। এখানে আমার হাত পা বাঁধা। নিয়মিত কাস্টমার আপনারা। আপনাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আলাদা। আপনি আমার সাথে মার্কেজ নিয়ে কথা বলতে চান, আমি আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা সময় দেব আপনাকে। রুশদি, গুন্টার গ্রাস, মিশেল ফুকো। যেকোনো রাইটার নিয়ে, বই নিয়ে আপনার সাথে কথা বলব, সময় দেব। কিন্তু রেট ভাইয়া ফিক্সড করা। এখান থেকে আমি একচুল নড়তে পারব না।
ওর হাত থেকে নেয়া এক হাজার ও পাঁচশ টাকার নোট দুটায় যেন আঠা লাগানো। ক্যাশ ড্রয়ারে রাখার সময় হাত থেকে নামতেই চাইছিল না। অনেক কষ্টে নামানো গেলেও ফেরত দেয়ার টাকাগুল আর কোনোভাবেই সোহেলের হাত থেকে ছেলেটার হাতে যেতে চায় না। ড্রয়ারের ভিতরে কিছু একটায়, সোহেল জানেও না কি, চোখ আটকে যায়। ছেলেটা কাউন্টারে হাত রেখে আঙুল নাচায়। বাতাসে না হয়ে আঙুলগুলো পিয়ানোতে ঠাঁই পেলে মোৎজার্টের মতো কিছু একটা হয়ত করে ফেলত।
—ভাই চেঞ্জটা?
—ও! সরি ভাই।
ড্রয়ারটা ভালো করে দেখতেও দিল না ছেলেটা।
যাক। বাকিটা সময় টুলে বসেই পার করা যাবে।
কিন্তু টুলটার কাছে যাওয়া মাত্রই ডাক পড়ে।
—সোহেল। গুছগাছ শুরু কর। বন্ধ করার টাইম হইয়া গেল তো।
ফেরার এই সময়টা বেশ ঝামেলার। বাসে ঝোলাঝুলি—সে তো আর এই শহরে কোনো অভিযোগ হতে পারে না। বরং সিট পাওয়াটা বাড়িতে থাকতে রোজ রোজ নিরামিষ আর দুই-তিন দিন পর পর ঘেরের গু খাওয়া পাঙ্গাশের বদলে হঠাৎ একদিন গরুর মাংস দিয়ে পোলাও খাওয়ার মতোই। সমস্যাটা হলো বাসে করে একবারে যাওয়া যায় না। বাস থেকে নেমে লেগুনা ধরতে হয়। আর লেগুনায় সিট তো শুধু গরুর মাংস দিয়ে পোলাউও না, সঙ্গে খাসির রেজালা মুরগির রোস্ট দই- মিষ্টি মিলে একেবারে বিয়ে বাড়ির খানা। হেলপারের পা-দানিতেও তখন দুইজন একটা পা রেখে ঝুলতে থাকে। অধিকাংশ লেগুনা অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের ধাক্কাধাক্কির সুযোগ না দিয়েই শাঁই করে চলে যায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে হয়তো কোনো এক হেলপারের গলায় ঠোকর দিতে থাকা গন্তব্যের নামটি তালুতে টংকার তোলা জিহ্বার লাথি খেয়ে মুখ থেকে বের হয়ে অদ্ভুত সুরে যখন কানে পৌঁছায়। কোনোরকমে পাদানিতে পা রেখে শরীরটা উঠিয়ে দিতে পারলেই হলো। ভিতরে দু-একটা সিট ফাঁকা তো মাথাটা আগে বাড়িয়ে শরীরটা কোনোরকমে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়। এরপর সিটে বসা মোটা মোটা লোকদের অনিচ্ছুক পাছা ঠেলে গুতিয়ে ওর চিকন পাছাটাকে কোনোমতে রাখতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। নিশ্চিন্তে সিলিংয়ের রডটা ধরে সহযাত্রীদের ঘামমাখা গায়ের ওপর নিজের ওজনটা চাপিয়ে দিলেই হলো। বাকিটা পথ দুলতে দুলতে আর হুট করে ব্রেক কষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে একই সময়ে নানা রকমের গালি, যেগুলোতে বাবা-মা-ভাই-বোনদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি প্রকট, সেগুলো ড্রাইভারের দিকে ছুঁড়ে মারা ছাড়া আর কোনো ঝামেলা নেই।
এত কষ্ট করে যেখানে আসা, সে জায়গার কথা ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় সোহেলের। পুরনো আমলের ভাঙাচোরা বিল্ডিং। প্লাস্টার খসে পড়েছে, দেয়াল লোনায় ধরা, শ্যাওলার আস্তরণ। দেখলে মনে হয় গেরিলা যুদ্ধের জন্য ক্যামোফ্লজ সাজ। জায়গায় বেজায়গায় বের হয়ে আসা রডগুলো নর-কঙ্কালের হাড্ডি মনে করিয়ে দেয়। কোন ভৌতিক সিনেমার পটভূমি যেন। দেয়াল, সিঁড়ি, সিলিং ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কঙ্কালরূপী প্রেত। কেবল পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের পঞ্চমতলার সিলিং থেকে নয়, বৃষ্টির ভেজা ভেজা ফোঁটাগুলো অনবরত টুপটাপ করে পড়তে থাকে সব তলার সিলিংয়ের কোনা থেকে।
অবশ্য এরকম একটা বিল্ডিং-এ সোহেলের আগের দশ জন্মের মধ্যে কেউ থাকেনি। মাটির মেঝের উপর হোগলা পাতার বেড়া ও ছনের চালা থেকে টিন-কাঠের বেড়ার উপর ছনের চালা আসল কেবল ওর জন্মের পরে। এরকম একটা পাকা দালানে থাকতে পারলেও তো ওর মায়ের গলার জোর তার জা-দের গলার থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়ে যেতে পারে অনায়াসে।
কিন্তু সমস্যা বৃষ্টির টুপটাপ কিংবা দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা কঙ্কালে নয়।
নিচতলায় একটা হোটেল। আর সোহেল যে রুমে আরও দুইজনের সঙ্গে শেয়ারে থাকে, সেই রুমটার ঠিক নিচে হোটেলের রান্নাঘর। শীতের দিনে লেপ-কম্বল কেনার খরচটা বেঁচে যায় ঠিকই, কিন্তু গরমের দিনে রান্নাঘরের আঁচ ওদেরও বিশাল ডেকচিতে চড়ানো গরুর মাংসের মতো সিদ্ধ করে ফেলে।
দুইটা জানালার জং ধরা গ্রিল আর ওপাশের আরেকটা স্যাঁতস্যাঁতে বিল্ডিং-এর ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়ের উপস্থিতি জানান দিতে আসা আঠালো বাতাস ওদের গা জুড়াতে পারে না। বরং সারা শরীর জুড়ে চেপে থাকা অশান্তির সঙ্গে নাকের ভিতর ভিতর আরও একটু বেশি অস্বস্তি সুড়সুড়ি দিয়ে জুম্মাবারে খুতবার আগে হুজুরের ওয়াজে শোনা জাহান্নাম হুজুরের মুখ থেকে পালিয়ে আস্তানা গড়ে ওদের রুমটায়।
হুজুর যেমন সুরেলা গলায় ঘুম ধরানো মাদকতায় সবাইকে আচ্ছন্ন করে অনবরত বলতে থাকে,
—জাহান্নামে কি আছে? খালি আগুন আর আগুন! সেই আগুনে পুইরা সারা শরীরের চামড়া গইল্যা একাকার হইয়া যাবে। ওই গরমে পুইড়া অতিষ্ট হইয়া পিপাসায় কাতর হইয়া যখন পানি খাইতে চাইবেন, তখন কি পাইবেন জানেন? পুঁজ পুঁজ! দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ।
রুমে ঢুকে যখন লালচে হয়ে আসা কোকের বোতল থেকে গলার ভিতর গলগল করে পানি ঢালে সোহেল, তখন মুখের ভিতর স্যাঁতস্যাঁতে বাতাসের স্বাদ খানিকটা ঢুকে পড়লে সেই পানিকেও তার পুঁজ পুঁজ মনে হয়।
কথা বলার সময় এক বলকায় অনেকখানি বাতাস বেরিয়ে গেলে যখন ফুসফুসের ভিতর সমতা বিধানের জন্যে আবার অনেকখানি বাতাস টেনে নেয় মুখ দিয়ে সোহেল, তখন আলমের ধড় ও হাতের সংযোগস্থলে যে সমকোণ সৃষ্টি হয় সেখান থেকে ভুর ভুর করে গন্ধ ছুটে আসলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দুই দুইবার হুজুর বর্ণিত পুঁজের স্বাদ অনুভব করে ওর পেটে মোচড় দেয়।
উঠে দাঁড়িয়ে রুমমেটকে বলে সোহেল,
—খাইতে যাবেন না?
—যামুনা ক্যান? যামু যামু!
কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয় খুব আমুদে মেজাজে আছে আলম। একটু থেমে আবার শুরু করে,
—তোমাগো দোকানে তো অনেক সুন্দর সুন্দর মাইয়া আয়, আয় না? ভার্সিটির ইয়াং ইয়াং মাইয়া।
তার চোখ ও জিভ জ্বলজ্বল করে।
—আমাগো দোকানে আর কয়ডা আয়! আপনের দোকানে তো লাইগ্যাই থাহে মাইয়াগো লাইন। ব্রা-পেন্টি বেচেন! মজা তো আপনেরই!
—ধুর! ফুটপাতের দোকানে আর কয়জন কেনে! মার্কেটের ভিতরে একখান দোকান থাকলে যা হইতো না! সুন্দর সুন্দর মাইয়াগুলা ভিতরের দোকান থেইকা বেশি কেনে। চিকন বিকিনি, নেটের নাইটি। এইগুলা তো ফুটপাথ থেইকা কেউ কেনে না। এইগুলা না বেচতে পারলে কিসের শান্তি?
—দেহেন মার্কেটের ভিতরে জায়গা পান নাকি।
—এত সোজা!
কথাটা শেষ করে সে যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন মনে হয় মার্কেটের ভিতর জায়গা না পেয়ে সে যে মেয়েদের সূক্ষ্ম অন্তর্বাস বেচতে পারছে না, এজন্য আসলেই তার মন দুঃখ ভারাক্রান্ত।
কথা বলার বিষয়বস্তু রমরমে হলেও সোহেল পালাতে চায়।
—চলেন খাইয়া আসি।
—যাও তুমি। আমি আইতেয়াছি।
হোস্টেলের ডাইনিংয়ের দিকে যেতে যেতে খানিকটা স্বস্তি আসে ওর মনে। ভাতের প্লেটে নাক ডুবিয়ে থাকলে ময়লার ভাগাড় থেকে ভেসে আসা গন্ধ গরম ডালের ধোয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে না উঠে বেশ দূরে দূরে থাকে।
ডাইনিংএ ঢুকতেই পাশের রুমের পরিচিত এক লোক ডাক দেয় ওকে।
—ওই সোহেল ভাই! আসো। বসো এইহানে।
সোহেল বসে তার পাশে। ভদ্রতার খাতিরে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করে।
—কখন আইছেন?
—এইতো। তোমার না বাড়িত যাবার কথা আছিলো? ছুটি পাইছো?
—শালা খাচ্চরটা ছুটির কথা শুইন্যাই খ্যাচ কইরা উঠছে।
ছুটি! শালায় ছুটির কথা শুইন্যাই খ্যাচ কইরা উঠলো। শালা খচ্চর! এক্কেবারে ওর চাচার মতো হইছে।
মালিকের চাচাও তো সোহেলের বাপের সঙ্গে এমন আচরণ করে।
কে জানে চাচারই জাউড়া পোলা কিনা! নইলে একই রকম কইরা মুখ ঝামটা দেয় ক্যামনে?
সোহেলের বাড়ি আর ওর দোকানের মালিকের বাড়ি একই গ্রামে। সেই গ্রামে অবশ্য তাদের পরিবারের কেউ থাকে না। তাদের ভিটের পাশে সোহেলদের ভিটে। তাদের ভিটে পাহারা দেয়া শুরু করে জমি চাষ—সব করে সোহেলের বাপ-চাচারা। আর সেই চাষবাসের লেনদেন হয় গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে উপজেলা সদরে থাকা মালিকের চাচার সঙ্গে। সেই চাচাও কথায় কথায় সোহেলের বাপ-চাচাদের ওরকম মুখ ঝামটা দেয়।
খাওয়া হয়ে গেলে গলির মুখের চায়ের দোকানটার দিকে পা বাড়ায় সোহেল।
না! এই সময় আর চা খাবে না। দোকানে কাজ করার সময় দিনে পাঁচ-ছয়বার চা খাওয়া হয়। মালিকের এই স্বভাবটা খারাপ না। যখন চা আনায়, সবার জন্যেই আনায়। তো, দিনে পাঁচ-ছয়বার ফ্রি চা খাওয়ার পরে এখন পয়সা দিয়ে চা খাওয়ার মতো এত শখ নেই। উল্টা ঘুমের সমস্যা হবে। অবশ্য আজ দেরি করে ঘুমালে সমস্যা থাকার কথা ছিল না, পরদিন তো ছুটিই।
কিন্তু ছুটির রাতে অন্য ঝামেলা আছে। প্রায়ই ছুটি উপলক্ষে দুই রুমমেট বোতল নিয়ে আসে, মোবাইলে নতুন ভিডিও ভরে আনে—বেশ ফুরফুরে থাকে তারা। তখন জেগে থাকলে সমস্যা। ঘুমের মধ্যে যা হয় হোক, টের না পাওয়ার ভান করে থাকা যায়। কিন্তু জেগে থেকে বাঁধা দিয়ে দুজনের সঙ্গে পারা যাবে না। আর তখন ওর প্রতি তাদের দাবি, আবদার, জোর—সবকিছুই অনেক বেশি। ওসবে ভক্তি হয় না, সহ্যও করা যায় না।
জেগে থাকা যাবে না কোনোভাবেই।
সোহেল এমনিই যায় চায়ের দোকানের দিকে। বাইরে তবু গরমটা সহ্য করা যায়। হুটহাট বাতাসও আসে। সে বাতাসে গা জুড়ানোর জন্য নাকটা চেপে ধরতে হয়। তবু ঘরের গুমোটের চেয়ে তো ভালো।
দোকানের পাশে দাঁড়ানোর পরে কি জানি ভেবে একটা গোল্ডলিফ কেনে সোহেল। বিয়ে হতে যাওয়া ওই বন্ধুটির সঙ্গে জীবনের প্রথম বিড়ি ধরিয়েছিল। কিন্তু কখনো নেশা জন্মাতে দেয়নি। তারপরেও মাঝেমধ্যে টানতে খারাপ লাগে না।
প্রথমবার সিগারেট খাওয়ার কথা ওর যত না মনে পড়ে, তার চেয়ে বেশি পড়ে প্রথমবার ধরা খাওয়ার কথা। ক্লাস সিক্সে তখন। বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে সওদাপাতি কিনে ভাংতি টাকা ফেরত না দিয়ে লুঙ্গিটা পরেই চরের দিকে দৌড় লাগায়। এদিকে ভাংতির খোঁজে পকেটে হাত দিলে লম্বা গোল খসখসে কাগজের বস্তুটিতে হাত পড়া মাত্রই মা বুঝে ফেলে জিনিসটা কি। চরে সূর্য ডোবা পর্যন্ত ফুটবল খেলে, এরপর নদীতে ডুবিয়ে চোখ লাল করে সন্ধ্যার অনেক পরে ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই নারিকেলের শলার ঝুাড়ু শপাং শপাং শব্দে কালবৈশাখী ঝড় হয়ে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে ওর পিঠে।
ঝড়ের সঙ্গে ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে পড়ে মায়ের গালাগালি।
—শুয়ারের বাচ্চা পয়দা করছি একটা। মোচ গজায় নায় বাল গজায় নায় এহনি বিড়ি টানা শুরু করছে। এর মদ্যে মোস্তান হইয়া গ্যাছে কুত্তার বাচ্চাডায়। বাপের তো টাহার তালগাছ আছে তুই হেই তালগাছ বেইচ্যা সিকারেট কিন্যা খাবি!
গালিগালাজের বৃষ্টি আর ঝাড়ুর ঝড় চলতে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। পিঠের বেশ কয়েক জায়গায় কেটেকুটেও গিয়েছিল। এরপর থেকে মা প্রায় প্রতিদিনই সিগারেট নিয়ে শাসানি দিত। আর কথায় কথায় টেনে আনতো তার চাচাতো ভাইপোর কথা।
আইএ পাস করে একটা সরকারি অফিসে চাকরি পেয়েছে সে। এদিক-ওদিক চৌদ্দ গুষ্ঠীর মধ্যে আর কেউ নাই যে একটা সরকারি চাকরি করে। কত ভদ্র সেই ছেলে! জীবনে দল আড্ডা সিগারেট এগুলার ধারে কাছে যায় নায়। বাপের সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ছোট দোকানটায় কাজ করত আর পড়াশোনা করত। বাপটা অকালে না মরলে ঢাকায় যেয়ে বড় বড় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারত।
চিন্তার লাগামহীন প্রবাহের এই মুহূর্তে ইউনিভার্সিটির কথা মনে আসতেই ভেসে উঠল দোকানে আসা সেই ছেলেটার কথা।
কোন ভার্সিটিতে পড়ে কে জানে। প্রতি সপ্তাহেই তো আসে দোকানে। কতগুলা টাকা নষ্ট করে বইয়ের পিছনে!
শালা! ওগোই তো জীবন!
জীবনে কখনো ভাতের জন্য কষ্ট করা লাগে নাই।
ভার্সিটিতে তো ওরাই পড়বে।
পায়ের উপর পা তুইল্যা টিভি দেখছে আর মায় আইসা মুখের ভিতর লোকমার পর লোকমা ভাত হান্দাইয়া দিছে।
সোনামণি পড়ো! পড়ো! ভাত খাও! বিস্কুট খাও! কেক খাও! চলো চলো কোচিংএ চলো! ভাত খাও! পড়ো! টিফিন খাও!
এত পুতুপুতু করলে ওরা কলেজ ভার্সিটিতে পড়বে না কে পড়বে? মায়ের চাচতো ভাইপোর মতো খালি পেটে পরীক্ষা পাস করে কয়জন?
না। সেকালের মতো দশ মাইল মাটির রাস্তা হেঁটে বর্ষার সময় হাঁটু সমান প্যাচপ্যাচে কাঁদা ডিঙিয়ে, লুঙ্গিতে বেঁধে বইগুলো মাথায় নিয়ে সাঁকোহীন খাল-বিল পেরোতে হয় না। প্রাইমারি স্কুল আছে ওদের গ্রামেই। ছোট বিল্ডিংটার সামনে বড় একটা মাঠ। অদ্ভুতভাবে মাঠের মাঝখানে ঢ্যাং করে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড একটা নারিকেল গাছ। মাঠের ঠিক মাঝখানে ওটা আসল কীভাবে? হাইস্কুল ওদের গ্রামে না হলেও ইউনিয়নের মধ্যেই পড়ে। হেঁটে যেতে বেশি না, বড়জোর আধা ঘণ্টা লাগে।
ঠেলাগুতা খেয়ে প্রাইমারি স্কুলটা পাস করা গেল। হাইস্কুলে ভর্তিও হওয়া গেল। টেনেটুনে ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষাও পাস করা গেল। গ্রামের স্কুল, বিশ-পঁচিশকে তেত্রিশ বানাতে বেগ পেতে হয় না। নইলে আধাসরকারি স্কুলটাই তো উঠে যাবে।
ভালোই চলছিল, উড়ে বেড়ানো।
নিত্যই মায়ের মুখ ঝামটা অবশ্য ছিল। ছেলের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রতি বেলা একবার করে সেই চাচতো ভাইপোর পা ধোয়া পানি।
এলোমেলো বাতাসের ছন্দে এলোপাতারি উড়ে চলা আধাফোলা বেলুনটা হঠাৎ চুপসে গেলো।
বাপটা ঠ্যাং ভেঙে তিন মাস বিছনায়। আয় রোজগার কই? আগে দুইটা, পরে আরও দুইটা বোনের মাঝখানে পড়ে চ্যাপ্টা হওয়া একমাত্র ছেলে সন্তান হয়ে ঠেকেছে তো সেই। ওকে পাঠানো হলো সদরে একটা মুদির দোকানে কাজ করতে।
বই কিনতে আসা ওই শালার বাপের তো ঠ্যাং ভাঙে নাই। ভাঙলেও বা কি? অফিস থেইকা ছুটি নিছে, ছুটির মধ্যেও বেতন পাইছে। কত মানুষ ফল-ফলাদি, খাবার-দাবার নিয়া দেখতে আইছে। সেগুলা খাইছে আর বেডপ্যানে হাগছে। বাপের সঙ্গে ওই শালায়ও খাইছে। আরে ওইতো বেশি খাইছে। হাগছেও বেশি। কমোডে বইসা আরামসে। ওর তো আর মুদির দোকানে কাম করতে যাইতে হয় নাই।
বুড়ার ঠ্যাং আর আগের মতো শক্ত হয় নাই। কাজ কর্ম করতে পারে না বেশিক্ষণ। তাই স্কুলে আর ফেরা হয়নি সোহেলের। সেই চাচতো ভাইপোর মতো আইএ পাস করে সরকারি অফিসে একটা চাকরি পাবে—ওকে নিয়ে সেই স্বপ্ন দেখার পর্দা ততদিনে গুটিয়ে নিয়েছে ওর মা।
কয়েক বছর ধরে এই দোকান, এক-দেড়শ টাকা বেশি পেলে ওই দোকান, না হয় হোটেল— এভাবেই চলছিল।
প্যাটে ভাত নাই আবার লেখাপড়া!
দোকানে আসা ওই কুতুবটার মতো বাপ পাইলে কে না ভার্সিটিতে পড়তে পারে!
শুধু কি পড়া? চকচককে কাপড়চোপড়, কথায় কথায় ইংলিশ ফুটানো। তার চেয়ে বড় কথা এতগুলা মেয়ের সঙ্গে ঘুচুরঘাচুর করা। একেকদিন একেকটারে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া, ওদের সঙ্গে সবসময় ইংলিশ ফুটানো, ধানমন্ডির রেস্টুরেন্টগুলোয় খাইতে যাওয়া...
কি একেকখান রেস্টুরেন্ট! ওর ভিতরে একখান সুন্দরী মাইয়ারে জড়াইয়া ধইরা বইসা থাকতে পারলে আর কি লাগে! আর সাথে চাইনিজ, চিকেন ফ্রাই!
আহ! সব ক্যান শালার ওই হারামজাদাগুলা পায়?
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলে কখন যে ঠোঁট ফসকে গোল্ডলিফের ফিল্টার ঠোঁট ফসকে দাঁতের চাপা খেয়ে ছিঁড়ে যায়, টের পায়না সোহেল।
থু দিয়ে ছেঁড়া ফিল্টারটুকু ফেলে দিলে সেই থু-থুকে অনুসরণ করা একটি লোক পাশ দিয়ে বলে,
–কি ভাই ভাত খান নাই রাইতে? ফিল্টারডাও খাইয়া ফালাইতেছেন!
কোনো কথা না বলে বাকি থাকা ফিল্টারে ফস ফস করে দুটো টান দিয়ে সেটাও ফেলে দিয়ে দোকানদারকে সিগারেটের দাম দেয় সোহেল।
রুমে ফিরতে মন না চাইলেও রুমের পথে পা বাড়ায় ও। বোতল খোলা ও ভিডিও দেখা শুরু করার আগেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে। অনেকদিন ধরেই নতুন একটা মেস খোঁজার চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছে সোহেল। অনেককে বলেও রেখেছে। কোনোরকম একটা জায়গা পেলেই হতো।
রুমে ফিরে কাউকে না পেয়ে সুযোগ বুঝে ঘুমিয়ে যায় সোহেল।
কে জানে কতক্ষণ পরে, আধো ঘুম আধো জাগরণে মাথার ভিতরে এলোমেলো ছুটে চলা ভাবনা আর ঘন ঘন পট পরিবর্তন করা দৃশ্যগুলো স্বপ্ন নাকি সজ্ঞান চিন্তা সেটা বোঝার মতো হুঁশ এখন নেই সোহেলের।
ভুলতে চাওয়ার কিংবা সজ্ঞানে এড়িয়ে যেতে চাওয়ার ওই অধ্যায়টি অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়লেও ওই সময় ঘুম ভেঙে যায়। তবুও ঘুমের আবেশটি অক্ষুণ্ন রাখার এবং ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চলতে থাকে। প্রথমদিকে অবশ্য ব্যথার কারণে ঘুমের সঙ্গে আবেশটিও উধাও হয়ে যেত। এখন অবশ্য সেরকম ব্যথা লাগে না। যদিও সোহেলের ভাবতে এবং স্বীকার করতে খুব অস্বস্তি ও কুণ্ঠাবোধ হয়, ইদানীং বেশ ভালোও লাগে। তারপরেও নতুন মেস খোঁজার চেষ্টা তদবির চলছে।
তবে ঘুমের আবেশটা ওইসময় রেখে দিতে পারলে মাদকতাময় অনুভূতিতে ছেঁয়ে যায় সমগ্র চেতনা।
এখন আধো ঘুম আধো জাগরণের স্বপ্ন কিংবা সচেতন চিন্তার জালে ছটফট করতে থাকে অনেক ভাবনা। অনেক ছবি, অনেক দৃশ্য বারবার পট বদলায়। মালিকের ঠোঁটগুলো মুরগির চিকন বাঁকা ঠোঁটের আকার ধারণ করে সেখান থেকে বাঁকা বাঁকা কথা ছুঁড়তে থাকে। বন্ধুর শ্বশুরবাড়িতে রঙিন কাগজে মোড়ানো কলাপাতার গেট প্রথমবার খাওয়া সেই সিগারেটের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে আসে।
আর মাথায় ঘুরতে থাকে বন্ধুর বউয়ের মুখ। প্রথম সেই সিগারেটটার মতো বন্ধুরা প্রথম বউরে ভাগ দিতে পারে না? ঘোরগ্রস্ত সোহেলের ঠোঁটের কোণে বোধহয় একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে। নাহ! বউয়ের বেলায় আর বন্ধু ফুটায় না কেউ। ভাগাভাগি হয় মাগিগো বেলায়। দুই রুমমেট যেমন পার্কে-উদ্যানে যাইয়া দুইজন মিলা একজনকে ভাড়া করে। ওরেও তো ভাগাভাগি করে। ওরা দুইজন বিয়া করার পর? এতদিনের ভাগাভাগির অভ্যাসের তখন কি হইবো?
আসলে অভাব আছে দেইখা ওগো ভাগাভাগি করতে হয়।
যাগো অভাব নাই তাগো কি ভাগাভাগি করতে হয় নাকি?
আর বই কিনতে আসা ওই শালারে দেখো।
আধো ঘুম আধো জাগরণের স্বপ্নেও নিস্তার নাই ছেলেটির।
ওরে কারো লগে ভাগাভাগি করতে হয় না। উল্টা কতগুলা ওর ভাগে! এতগুলা মাইয়া লইয়া ঘুইরা বেড়ায়।
আচ্ছা, এতগুলার লগে ঘুইরা বেড়ায়, সবাই কি ওরে করতে দেয়? সবার সাথেই তো গলাগলি মাখামাখি। এইসব পোলাপান তো আবার খুব ফ্রেন্ড মারায়। সবার সাথে ধরাধরি মাখামাখি। যখন টিশার্ট পরা বুকে ওড়না না দেওয়া মাইয়াগুলার হাত ধরে, ফাইজলামি কইরা গলা ধরে তখন কি খাড়ায় না?
না! খাড়ায় না আবার!
আর করাডাও মনে হয় বাকি রইছে! করে করে! সবার লগে না করলেও দুই-তিনজনের লগে তো করেই। আবার মাইয়াগুলাও তো কত পোলাগো লগে ঢলাঢলি করে।
এইখানেও শালার পোড়া কপাল!
কেউ পায় না, কেউ ভাগাভাগি করে আর ওদের একেকটার ভাগে এত এত!
এইখানেও শালার ইনসাফ নাই।
সবকিছুই ওই শালাগো! সব ওরা খাইবো।
পড়বেও ওরা, খাইবেও ওরা, করবেও ওরা! একটা মুগুর দিয়া সবগুলার মাথা ছাতু কইরা দিতে পারতাম!
মায় খালি খালি মুখ ঝামটা দিত।
এত রাতেও কাছাকাছি কোথাও কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। হঠাৎ হঠাৎ মানুষের গলা শোনা যায়। আর শোনা যায় ড্রিল মেশিন কিংবা খোয়া-সিমেন্ট মিক্সারের ঘড় ঘড় শব্দ। সেই শব্দের তালে তালে মায়ের গলার বেসুরো সুর ওঠানামা করে,
—এত কই একটু পড়, একটু পড়। আইএ পাস কইরা এউক্কা চাকরি লইতে পারলে বাপের মতো দিন রাইত এত খাটাখাটনি করা লাগবে না। একটু পড় একটু পড়।
আরে ক্যামনে পড়মু!
দিলা তো দোকানে দোকানে কাম করতে পাঠাইয়া। স্কুলে থাকলে টাইন্যা টুইন্যা ঠিকই পাস করতাম। আর তোমরা খালি আমারে দোষ দেও?
তোমরা একটু পয়সায়ালা হইলে কি হইতো?
আমি তোমাগো ঘরে না জন্মাইয়া ওই পোলাডার ঘরে জন্মাইলাম না ক্যান? ওই ঘরে জন্মাইলে কি হইত?
কোনো কিছুর অভাব থাকত? তখন লেখাপড়া কারে কয় দেখাইয়া দিতাম।
ভার্সিটিতে পড়তাম। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাস্তি করার মতো টাকা! কি থাকত না?
আর থাকত গার্লফ্রেন্ড! জিন্স টিশার্ট পড়া গার্লফ্রেন্ড। নায়িকার মতো একেকজন। একেকদিন একেকজনরে নিয়া ঘুরতাম।
আহ!
আধো ঘুম আধো জাগরণের এই সময়টায় চেতনার সব স্তর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেবল ওই মেয়েগুলো।
এখন আর কোন কিছুর দরকার নেই। ভার্সিটিতে পড়া, ল্যাপটপ-কম্পিউটার এসব দিয়ে কি হবে?
সেই ছেলেটার সঙ্গে দোকানে আসা মেয়েগুলোর সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করে সোহেল। সঙ্গে যোগ করে নেয় বিভিন্ন সময় দোকানে আসা আরও অনেক মেয়েকে। কারো চেহারা যদিও মনে নেই।
কি দরকার চেহারা মনে করার?
শুধু নিজেকে ওই ছেলেটার জায়গায় বসালেই হয়।
মেয়েগুলোর মুখের জায়গায় কোনো নায়িকার মুখ বসিয়ে দিলেই হবে।
লেখাপড়া, টাকাপয়সা, বাড়ি গাড়ি—এখন কিছুরই দরকার নেই। আক্ষেপ নেই কিছুর জন্য। উপুর হয়ে শুয়ে তোশকে অনবরত ঘষাঘষি করতে থাকা দেহটার আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। ঘুম ঘুম আবেশের মাদকতায় এখন শুধু ওই মেয়েগুলোর অস্তিত্বই একমাত্র সত্য।
সবকিছুর পরিবর্তে মেয়েগুলোকে পাওয়ার বাসনার তীব্রতার সঙ্গে বাড়তে থাকে ঘর্ষণের তীব্রতা। তারপর হঠাৎ করেই থেমে থেমে কয়েকটা কাঁপুনির পড়ে নিথর হয়ে আসে দেহটি। তীব্র গরমের মাঝেও ঊরুসন্ধির কাছে ভেজা ভেজা ওই স্পর্শের কারণে অস্বস্তিবোধ হয় সোহেলের।
• কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, বাংলাদেশ।