দেয়াল

‘বাবলুরে তুইলা নিয়া গেছে!’
কথাটা শোনার পরপরই পিছন থেকে মায়ের গলা শুনি, ‘শিপলু খাইতে আয়। আর দেখতো বাবলু ফিরল নাকি...’ বলতে বলতে মা আমার খোঁজে দরজার দিকে আসে। আমি দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে পাড়ার বড়ো ভাই শামুর দিকে তাকিয়ে তখন। সে যেন এসেই কী অদ্ভুত একটা কথা বলছিল, আমি বুঝতে পারিনি দেখে ভালোমতো বলতে চায়, ‘শিপলু, শুনছিস নাকি? বাবলুরে নাবিস্কোর মোড় থেইকা তুইলা নিছে।’
‘তুইলা নিছে মানে? কে তুলছে?’
‘মানে বুঝিস না? কে আবার?’ শামু ভাই আমার প্রশ্নে বিরক্ত কিংবা রাগ।   
আমি সত্যি বুঝি না। কিংবা বুঝতে চাই না। শামু ভাই যা বলে তা সত্যি হতে পারে নাকি! বাবলুর অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল, দিনভর ওই মোড়ে আড্ডা দিত, মাঝেমধ্যে টুকটাক ঝামেলায়ও জড়াত, কিন্তু তাই বলে তাকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে যাবে! আমার মাথায় ঢোকে না। কিন্তু যেন কীসের ভয়ে আমি তোতলাতে থাকি, ‘তু-তু-তুমি দেখছ নাকি শা-শামু ভাই? ওই... ওই বল্টু গ্যাং-এর কাজ নাকি?’ 
‘দেখি নাই, রে। আমি মোড়ে পৌছানির মিনিট পাঁচেক আগের কথা। গিয়াই শুনি সাদা একটা মাইক্রোবাস আইসা... তয় একটা কতা কী, যা শুনলাম তাতে এইটা বল্টু গ্যাং ক্যান, যেমনতেমন কোনো মাইনষেরই কাজ না।’
‘তাইলে কার কাজ, শামু ভাই? নিছে কই বাবলুরে?’ নির্দোষ প্রশ্নগুলো করতে করতে আমার হুঁশ হয়, এটাই বাস্তব যে আমার চার বছরের বড়ো ভাই, বাবলুকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আর হুঁশ হতেই আমার মনে হয় মাথা ঘুরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাব। বাবলু উধাও, বাবলু হাওয়া! সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে দরজার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরতে হয়। মা তখন ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ায়, ‘বাবলুরে নিয়া কী কতা কও তোমরা? বাবলু কই, আসে নাই এখনো?’
শামু ভাইয়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে মা দরজার বাইরে উঁকি দেয়। মাকে বলি, ‘দরজাটা একটু লাগায়ে দাও তো, আমি আসতেছি।’
‘এই এখন আবার কই যাস? ভাত বাড়লাম, ঠান্ডা ইইয়া যাবে না?’
মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে নিজেই বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিই। তারপর গলা নিচু করে বলি, ‘খুইলা বলো তো, শামু ভাই, হইছেটা কী? কে, কোথায় নিয়া গেছে বাবলুরে?’
‘নিছে তো মনে কয় পুলিশই। মানে পুলিশের বিগ ব্রাদার আর কী, ওই যে আছে না? তয় পোশাক কালা না, সাদাই আছিল। কিন্তু তুই হনহন কইরা কই যাস এখন?’
‘ক্যান, নাবিস্কোর মোড়ে?’
‘তুই কি পাগল হইলি নেকি? তারা এখনো ওইখানে বইসা আছে তর জন্য? কখন না নিয়া গেছে উঠাইয়া?’
‘তবু চলো, শামু ভাই, ওইখানে যদি কিছু... সে সেইখানে কী করতেছিল কও তো?’
‘কী আবার করবে, ওইখানেই তো খাড়ায়ে থাকি আমরা দিনরাত। রাস্তার ধারে খাড়ায়ে আইসক্রিম খাইতেছিল শুনলাম, যে গরম পড়ছে! তারপর মাইক্রোবাসটা আইসা... কিন্তু ওইখানে গিয়া এখন কী, ভাই, তুই বোঝার চেষ্টা কর, শোন...’
‘কিন্তু তাহলে আমি কোথায় যাব আর?’ আমার সমস্ত চিন্তা ওই নাবিস্কোর মোড়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। ছোটার পথ পায় না। কোথায় খুঁজব বাবলুকে? ফিরে গিয়ে কি মাকে বলব? শামু ভাইয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে আমি অন্ধকার গলিটাতে ড্রেনের পাশে বসে পড়ি। মাথা ঘুরেই পড়ে যাই নাকি কে জানে। একটা পা পিছলে ড্রেনের দিকে চলে যায়। অনেকদিন হয়েছে আমি ভাইয়ের কারণে কাঁদিনি। বহু বছর আগে আমার হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিলে মা বাবলুকে মারত। এমন মারত যে আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম আর কাঁদতাম। সেসব কবেই ভুলে গেছি। তখন হঠাৎ ড্রেনের পাশে পা ছড়িয়ে ‘বাবলু, বাবলু’ বলে চিৎকার করে উঠি।
শামু ভাই আমার হাত টেনে দাঁড় করাতে না পেরে নিজেও হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। অসহায়ের মতো শোনায় তার গলা, ‘আরে ওই, শিপলু? ভাই, তুই এইরাম করলে চলব? একটা ব্যবস্থা করতে হইব না? ওঠ দেখি, ওঠ।’
‘কই যাব? কার কাছে খুঁজব আমার ভাইরে?’
‘কই আর যাব, থানায় যাব। চল ওঠ। সাহস রাখ।’
আমি সাহসের উপরে ভর করে দাঁড়াই। নড়বড় করি। শামু ভাই আমাকে ধরে থাকে। থানা আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়, হেঁটে গেলে পনেরো মিনিট। নড়বড় করে হাঁটলে মিনিট বিশেক।
থানার গেট পার হলে বামদিকে বাগান। বাগানের দিকটা অন্ধকার তখন, আবছায়ায় দেখতে ঝোঁপঝাড়ের মতো। তার উলটোদিকে তীব্র আলো। বিভিন্ন কেসে ধরা খাওয়া বা তুলে আনা গাড়ির বহর সেদিকে। কোনোটা অক্ষত, কোনোটা সামনে বা পিছনে ভচকানো। দিনের পর দিন কেস ঝুলে ঝুলে দোমড়ানো মোচড়ানো গাড়িগুলোর উপরে ইঞ্চিদেড়েক ধূলার স্তর জমিয়ে ফেলেছে। রাস্তা থেকে থানার পাঁচিলের উপর দিয়ে দিনের বেলায় ওগুলোর দিকে চোখ গেলেও কুৎসিত লাগে। আমি সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বারান্দার দিকে তাকাই। দুজন কনস্টেবল দুই হাঁটুর মাঝখানে দাঁড় করানো লম্বাচওড়া বন্দুকের নলের উপরে জোড়া হাত রেখে জাবর কাটার ঢঙে পান চিবাচ্ছে। সেদিকে চোরা চোখে তাকাই। আমার বরাবর পুলিশ দেখলে ভয় লাগে। রাস্তায় হাঁটার সময়ে উলটো দিক থেকে পুলিশের গাড়ি আসতে দেখলে কেন যেন নিজের অজান্তে ভাবতে থাকি, আমি আবার কী করলাম! ভাবতে ভাবতে আগের কয়েকদিনের কৃতকর্মের তালিকা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মনে মনে ঝালিয়ে নিই... এর মধ্যে দোষ কি করেছিলাম কিছু? একসময় পুলিশের গাড়ি আমাকে পাশ কাটিয়ে যায়। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে হালকা হই কিন্তু সে যাই হোক, গাড়ির সামনে বা পিছনে ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ কথাটা লেখা দেখলেই আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
থানার বারান্দায় একজন কনস্টেবল জাবর কাটা থামিয়ে পিকভরা মুখে অস্পষ্ট উচ্চারণে বলেন, ‘কী বিষয়?’ আমার হুট করে পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সাহস নেই, তাই শামু ভাই বলেন, ‘ওর ভাইরে কারা যেন উঠায়ে নিয়া গেছে।’ শামু ভাই কনুই দিয়ে আমার গায়ে ছোট্ট ধাক্কা দেন। আমি যন্ত্রের মতো বলে উঠি, ‘ভাইকে খুঁজতে হবে। মানে, আমরা ভিতরে যাব।’ অন্য কনস্টেবল নাকের সামনে থেকে দুর্গন্ধ সরানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে আমাদেরকে ভিতরে যেতে বলেন। 
বড়ো ঘর। তিন দিকে দরজা। দেয়ালের ময়লামতো হলদেটে রঙ অল্প আলোর বাতিকে আলো ছড়াবার সুযোগ দেয় না। একজন গম্ভীর মুখে টেবিলে বসে আছেন, পাশে দাঁড়িয়ে ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছেন দুজন। টেবিলের উলটোদিকে একটা মেয়ে। মুখ দেখা না গেলেও দেখতে পাই তার সরু হাত দুটো টেবিলের ধারটা ধরে আছে। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সে দুবার বলে, ‘আমি কিন্তু সিএনজির নম্বরটা আপনাদের ফোর্সের একজনের হাতে দিয়েছিলাম। তার নাম শরীফ। শরীফ নাম, বুঝলেন? শার্টের উপরে নেমপ্লেট আর হাতে ওয়ারলেস ছিল। আপনি ফোন করে ভেরিফাই করতে পারেন। মানিক মিঞা অ্যাভিন্যুর শেষ মাথায়, সংসদ ভবনের কোণটাতে, কিন্তু তিনি...’
‘আহা বুঝলাম তো,’ গম্ভীর লোকটা বিরক্ত হয়তো।
‘না মানে, ছিনতাই করে নিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি উনাকে ট্যাক্সির নম্বরটা ঠিকঠাক দিয়েছি। এই দেখেন, এই যে আমার ফোনে লিখে রেখেছি ট্যাক্সির নম্বরটা। আপনি খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। আমি তাকে কতবার অনুরোধ করলাম আগারগাঁওয়ের পয়েন্টে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করানোর জন্য, ওয়ারলেসে যেন বলে দেন, কিন্তু তিনি...’
‘আরে আপা, আপনি কী শুরু করলেন? ওয়ারলেসে বলা হয়তো হয়েছিল। ছিনতাইকারী একবার পালালে কি ধরা অত সোজা?’
‘বলেননি। বলেননি তিনি। আমি অনেকবার রিকোয়েস্ট করেছি। তিনি আমাকে থানায় আসতে বলেছেন। চোখের সামনে সোজা রাস্তা দিয়ে ছিনতাইকারীর ট্যাক্সিটা আগারগাঁওয়ের দিকে চলে গেল, পরের পয়েন্টে ধরবে, এটা কঠিন কী হলো? উনি আসলে...’
‘আচ্ছা বুঝলাম। আপনার কমপ্লেইন উনার বিরুদ্ধে নাকি ছিনতাইকারীর?’
‘দুটোই। আপনারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা না নিলে কী করে ধরা পড়বে বলেন তো? আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে লাভ আছে? তবে ওই ছিনতাইকারীকে না ধরলে পুলিশের নির্ঘাত কিছু লাভ আছে, নাহলে তার হাতের ওয়ারলেসটার দিকে আঙুল তাক করে আমি কতবার অনুরোধ করলাম, প্লিজ সামনের মোড়ে যিনি আছেন তাকে ট্যাক্সির এই নম্বরটা বলে দিন, তিনি তা না করে ফোন করলেন থানায়, এর মানে কী?’
ফাইল ঠিকঠাক করতে থাকা লোকটি ইশারায় আমাদের যে বেঞ্চে বসতে বলে, সেখানে কোনো রকমে কোমর ঠেকিয়ে আমরা মেয়েটার কথা শুনি। পুলিশের সঙ্গে বুঝি এভাবে চিৎকার করে কথা বলা যায়! কুলকুল করা ঘামের মধ্যেই আমার শরীর হিম হয়ে আসে। 
‘দেখুন, একজন পুলিশ কাকে ফোন করবে না করবে তা আপনাকে বলতে হবে না। আপনি কি এখানে আমাদেরকে সেটাই শেখাতে এসেছেন?’ লোকটা আগের চেয়েও গম্ভীর। এবারে মেয়েটা কী বলবে তা ভেবে আমি কৌতূহল বোধ করি। দেখি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। সামনের লোকটা তার দিকে একভাবে তাকিয়ে। মেয়েটা মাথা নিচু করে নাক ঘষে নেয়। তারপর কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, ‘আমার হাতে যে চুড়িটা ছিল, ওটা আসলে আমার মায়ের শেষ চিহ্ন, মানে, ...থাক, বুঝবেন না আপনারা।’ 
মেয়েটা হিলের শব্দ তুলে চলে যেতেই গম্ভীর লোকটা আমাদের দিকে তাকায়। আমরা উঠে দাঁড়াই। শামু ভাই তাড়াতাড়ি গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে। আমিও পিছনে পিছনে গিয়ে পাশের চেয়ারে হাত রাখি। সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এরকম একটা ভাব নিয়ে শামু ভাই বলে, ‘আমার বন্ধু, বাবলুরে একটা সাদা মাইক্রোবাসে উঠাইয়া নিয়া গেছে।’ তারপর আমার ঘাড়ে আঙুল ঠেকিয়ে বলে, ‘এই যে অর ভাই, অর নাম, শিপলু।’
শামু ভাইয়ের কথা বলার গতিতে মনে হয় ওই মেয়েটার মতো তারও সময় নেই, ফোন দিলেই পরের পয়েন্টে মাইক্রোবাসটাকে দাঁড় করানো যাবে। তারপর তার ভিতর থেকে উদ্ধার হবে বাবলু। উলটোদিকের পুলিশ ঠিক তার উলটো, চেয়ারে হেলান দিয়ে ধীর গতিতে বলেন, ‘কখন? হইছিল কী আসলে?’
‘মানে, এই ধরেন এক ঘণ্টাও হয় নাই আর কী। ওই যে নাবিস্কোর মোড়ে, ওইখানে কোণার পান-বিড়ির দোকানটার সামনে, সবসময় যেইখানটায় ভীড় হইয়া থাকে, তো ওইখানে বাবলু খাড়ায়ে আছিল। দোকানের কাছেধারে বল্টু গ্যাং-এর লোকজনও ছিল আর কী। তো তারা কইল...’
‘ও গ্যাং-এর ব্যাপার? তা তরা কুন গ্যাং, বল্টু না ইস্পাত? আবার মারামারি লাগছে আজকে? আগেরবার ছাড়ছিলাম, এইবার ধরলে কিন্তু একটারেও ছাড়ব না।’
‘না না, মানে, গ্যাং না, স্যার। মানে, ওই যে সাদা পোশাকওলা লাম্বা লোকগুলা, ছোটো কইরা কাটা চুল আর একেকজন দেখতে ইয়া বড়ো... মানে, ওইখানে পানের দোকানে যারা আছিল তারা কইতেছে পু...।’
‘আচ্ছা, বুচ্ছি। তা ওই বাবলু ওইখানে করতেছিলটা কী, হুম?’
‘কিচ্ছু করে নাই, স্যার। ওর তো এতক্ষণে বাড়িতে গিয়া ভাত খাওনের কতা, কিন্তু ও শুনছি তখন ওইখানে খাড়াইয়া আইসক্রিম খাইতেছিল। তখন একটা সাদা মাইক্রোবাসে লোকগুলা আইসা...’
‘আচ্ছা, ঠিকাছে, ঠিকাছে। নাম-ঠিকানা লেইখা দিয়া যাও, দেখতেছি।’
‘নাম-ঠিকানা দিতেছি, স্যার? কিন্তু আপনেরা ওইখানে গিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না? রিপোর্ট লিখবেন না?’
‘আমরা কী করব সেইটা আমরা ঠিক করব। আর রিপোর্ট কীয়ের? আগে দেখতে হবে ঘটনা কী। রিপোর্ট কইলেই রিপোর্ট হইয়া যায় নাকি?’
শামু ভাই অসহায় গলায় বলে, ‘তাইলে কি আমরা মামলা করব না?’
‘ওই, আগে দ্যাখতে হইব না কেস হয় কি না? না দ্যাখতেই কীয়ের কেস? ক্যান উঠাইছে, কে উঠাইছে, দেখি আগে। ফোন নম্বর রাইখা যা, পরে জানামুনে।’
‘মানে, আপনেরা কি এখন বাবলুর খোঁজখবর করবেন না? কইতে চাইতেছি যে ওই জায়গাটা, ওই যে নাবিস্কোর মোড়, ওইখানেও কি যাওনের দরকার নাই, এই ধরেন, ক্রাইম সিন?’
‘হালায় দেখি সব জানে! কইলাম না ফোন নম্বর দিয়া যা? কাজ শিখাইতে আসবি না আমগো।’
‘না, মানে, একটা মানুষরে উঠাইয়া নেয়া হইল, তার একটা খোঁজখবর তো করা দরকার।’
‘মানুষরে? কও মাস্তানরে। কী রে, তর ভাই লেকপাড়ের এলাকার মাস্তান আছিল না? ওই ইস্পাত গ্যাং-এর লিডার, ঠিক কই নাই?’ ফাইল গোছাতে গোছাতে একজন পুলিশ আমার দিকে ইশারা করে বলেন। টেবিলের উলটোদিকের পুলিশের ভুরু কুঁচকে আসে। আমাদের দিকে এগিয়ে টেবিলে কনুই রেখে বলেন, ‘ও তাই কও। ওই যে ওই ছ্যারা?’
ফাইল গোছানো পুলিশ উপর-নিচে মাথা নাড়েন। টেবিলের পুলিশ বলেন, ‘তাইলে তো বল্টু গ্যাং-এরই কাজ? মাস্তানগো মৃত্যু মাস্তানগো হাতেই। তা কারে সন্দেহ হয়, হুম?’
‘মৃত্যু ক্যান হইব? আমার ভাইরে খালি তুইলা নিয়া গেছে। আপনারা স্যার একটু চেষ্টা করলেই আনতে পারবেন,’ আমার মুখ থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।
‘এত্ত সোজা!’ 
‘মানে, স্যার, সন্দেহ তো কাউরে হইতেছে না, আসলে ওইখানকার পানের দোকানদার কইল যে মাইক্রোবাসের লোকগুলা আসলে পু...’
‘আচ্ছা, হইছে। আমরা দেখতেছি। দেইখা নিই, তারপরে মামলা হয় কি না দেখা যাবে।’
দু’বার থুঁতনি উঁচু করে ইশারায় উনি আমাদেরকে বের হয়ে যেতে বলেন। পুলিশের সাহায্যে বাবলুকে উদ্ধারের পরিকল্পনার উপরে পানি পড়ে যাওয়ায় শামু ভাইয়ের মুখ কালো হয়ে যায়। টেবিলের পুলিশটা কেন যেন দরজা পেরিয়ে যাওয়া অব্দি তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। আমরা দ্রুত পা চালাই। বাইরে বেরোতেই ধুলোর স্তরের নিচে একটা গাড়ির কড়া লাল রঙ এক চিলতে উঁকি দেয়। বাবলুকেও কি এভাবে কোথাও ফেলে রাখবে? ওর গায়ের উপরে ধুলোর স্তর জমবে?
নাবিস্কোর মোড়ে দাঁড়ালে পানের দোকানদার এগিয়ে আসে, ‘আপনেরই তো ভাই আছিল। ধইরা নিতে অবশ্য আমি দেখি নাই তয় কাপ ধোয়াধুয়ির পিচ্চিটা দেখছে। গাড়ি খাড়াইছে আর তিন জন নাইমা আইসা তুলছে। এলেমদার পাবলিক, ভাই, মেশিনের মতো কাজ করছে, কেউ বুইঝা উঠার আগেই। তয় বুঝলেইবা কোন বালডা ছিঁড়ত!’
লোকটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে তার ইশারা করা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়াই। আমার ডান দিকে জোরে জোরে গাড়ি চলে। ধুলো উড়ে এসে আকাশটা ঘোলাটে হয়ে যায়। হলদে আলোর মধ্যে ছাইরঙা বাতাসে জায়গাটা তখন আমার চোখের দৃষ্টির মতোই ঝাপসা। আবছায়া রাস্তায় অস্পষ্ট চোখে আমি কী যেন খুঁজি। মাটিতে তাকিয়ে থাকি, কোনো গাড়ির চাকার দাগ খুঁজি হয়তো, যে গাড়িতে ওঠার আগে এই ঘোলা বাতাসে আমার ভাইয়ের এক-আধটা চিৎকার কি অবাক-বিস্ময়ের অর্থহীন শব্দ মিশে গেছে। ধুলোসমেত বড়ো নিশ্বাস টেনে আমি সেই চিৎকারের কণা খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, বাড়িতে গিয়ে আমি মাকে কী বলব! 
শামু ভাই বলে, ‘শিপলু, তুই বাড়ি যা, ভাই। দেখলি তো, লাভ নাই। অনেক সময় হুদাই জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিয়া যায়, বুঝলি? য্যামনে নিয়া গেল আবার ত্যামনেই এইখানে ছাইড়া দিয়া যাইতে পারে। মনে সাহস রাখিস।’
আমার সাহস নেই, শামু ভাই তা বোঝে নিশ্চয়। কিন্তু তাই বলে মায়ের সামনে পড়ার ভয়ে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে পারি না। বাড়িতে আমাকে ফিরতেই হয়। যখন ফিরি মনে হয় কী যেন ফেলে এসেছি। কী, তা কিছুতে মনে পড়ে না। মা চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছে, সামনে ভাত-তরকারি পড়ে আছে। মা দরজাও আটকে দেয়নি, হয়ত ভেবেছে এখনই বাবলু আসবে, খামোখা আর দরজায় ছিটকিনি ওঠানো কেন। আমিও তাই চুপচাপ বসে থাকি। যদি বাবলু ফেরা পর্যন্ত এভাবেই স্থির বসে থাকা যেত। আমি কিছুতেই মাকে বাবলুর হারানোর কথা বলতে চাই না। বরং দরজার দিকে আমার উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা থাকে, কে জানে বাবলু এসে ঢোকে কখন, শামু ভাই যেমন বলে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে নামিয়ে দেয়ার কথা। বাবলু হঠাৎ দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে ঢুকে বলতে পারে, হালারা খালি খালি এই কতা সেই কতা জিগানির লাইগা এতক্ষণ আটকাইয়া রাখল! আবার বলতে পারে, দ্যাখতো পিঠে দাগ পড়ছে নাকি, এরা দেখি কতা কইতে ধরলেই বাড়ি দেয়। বাবলু ফিরে এলে ওরকম দুচারটা লাঠির বাড়ির দাগ দেখলেও আমার খারাপ লাগত না। এমনকি বাবলু মার খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরলেও আমি কয়েকদিনে তাকে সারিয়ে তুলতাম। 
দরজার দিকে তাকিয়ে আমি এ-ও ভাবি যে পুলিশও তো আসতে পারে! হয়তো তুলে নেয়ার জায়গাটা এতক্ষণে দেখেছে, তাই বাড়িতে আসতে পারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তার আগেই আমার হয়তো মাকে জানানো দরকার। ছেলে হারানোর শোকের প্রথম চোট না হয় আমার উপর দিয়েই যাক। এটা ভাবতেই মা টেবিল থেকে মাথা ওঠান। আমাকে দেখে বিরক্ত হন, ‘দেখলি, সব ঠান্ডা হইয়া গেল। বাবলু কই?’
‘মা, বাবলুকে কে যেন ধইরা নিয়া গেছে,’ আমার মুখ থেকে হড়বড় করে বেরিয়ে আসে।
‘মানে? ওই লেকের পাড়ের পোলাগো লগে ফের মারামারি লাগছে?’
‘মারামারি লাগে নাই, মা।’
‘আমি যে ওরে এত কই যে ওরা লেকের উপরে ঘর তুলল না ক্লাব বানাইল তা দিয়া তর কী? সে আমার কথা শোনে না ক্যান?’
‘তাদের সঙ্গে কিছু হয় নাই। অন্য লোকে তারে গাড়িতে তুইলা নিয়া গেছে, মা। আমি পুলিশের কাছে গেছি, কাইল আরো খোঁজখবর করব, বুচ্ছ?’
‘মানে, তুই কইতে চাইতেছিস বাবলুরে আঁতকা তুইলা নিয়া গেছে?’ 
আমার আর বিস্তারিত বলতে হয় না। মা কাঁদতে কাঁদতে কোনোরকম বিছানা পর্যন্ত পৌঁছান। ওই বিছানায় বাবার শেষ নিশ্বাস পড়েছিল কোনোদিন। মা সেখানে মাথা রেখে বিড়বিড় করে কী সব বলতে থাকেন। কান্নার দমকে আর লালাভরা মুখের অস্পষ্ট উচ্চারণে তার কিছুই বোঝা যায় না। মাকে সান্ত্বনা দিতেও ইচ্ছা করে না আমার। তার দুর্বোধ্য কথাগুলো বোঝার জন্য কান পাততেও ইচ্ছা করে না। তার বদলে আমি আবারো খাবার টেবিলে ফেরত আসি। উদোম খাবারের উপরে দুটো মাছি দ্রুত হামাগুঁড়ি দিচ্ছে। মাছিদের আনন্দে বাগড়া বাজাতে আমার মোটেও সাধ হয় না। বাবলু যদি ফেরত না আসে সংসারে বেশ কিছু টাকা আসবে না, টাকা না এলে তেমন ভালো খাবারও... এই রান্না করা খাবারগুলো আমার খেয়ে ফেলা উচিত ছিল। পেটে ক্ষিদে নেই, বরং কেমন যেন বমি বমি ভাব লেগে আছে।
ওরকম অবস্থায় খাবার সামনে নিয়ে বসেও থাকতে ইচ্ছা করে না। নিজের বিছানার দিকে যাই, কয়েকদিন আগের একটা খবরের কাগজে চোখ পড়ে। ধুলোভরা টেবিলে গড়াগড়ি খাওয়া বলপেনটা হাতে তুলে নিই। বহুদিন পরে আমি খবরের কাগজের উপরে আঁকিবুঁকি আঁকি। ছোটোবেলায় কলম, পেনসিল বা ইটের টুকরো, কিছু একটা পেলেই যে কোনোকিছুর উপরে আঁকতে লেগে যেতাম। সেজন্য মা আর বাবলুর অনেক বকা খেতে হয়েছে। মায়ের শাড়িতে, বাবলুর খাতা-বইয়ে নিজের অজান্তে বিচিত্র ছবি এঁকে রাখতাম। আমার আঁকা ছবি ভালো কি মন্দ সে বিচারের প্রশ্ন ওঠেনি, তার আগে কলমের আঁচড় কেটে কাপড় আর বই খাতা নষ্ট করার জন্য আমাকে মা কিংবা বাবলু হাতের সুখ মিটিয়ে মেরেছে। কিন্তু আঁকা থামাতে পারিনি। কারণ লক্ষ করেছিলাম যে হতাশ হলে বা কষ্ট পেলে আমার আঁকতে ইচ্ছা করে। ওরা ওসবে আঁকলে রাগ করত বলে বেছে নিলাম দেয়াল, পাঁচিল, ফুটপাথ বা রাস্তা। দিনের পর দিন আঁকতাম। অনেকদিন বাদে জেনেছিলাম যে বড়ো বড়ো ছবিগুলো আমি বানাই তার নাম গ্র্যাফিতি। রাস্তায় যেতে যেতে কেউ একবার বলেছিল, ‘বাহ্ সুন্দর গ্র্যাফিতি তো!’ এসব ভাবতে ভাবতে খবরের কাগজ পেতে নিয়ে যা আঁকি তাই বাবলুর চেহারার মতো হয়ে যায়। কেউ দেখলে ভাববে বাবলুর মুখ অবিকল আঁকার জন্য চর্চা করে যাচ্ছি। একসময় খবরের সব হেডলাইন, সব কলাম বাবলুর মুখ হয়ে যায়। তখন মনে হয়, পুলিশের কাছে মামলা করতে পারলে কাল খবরের কাগজে এমন করেই বাবলু খবর হতো, গতকাল সন্ধ্যায় এক দল অপহরণকারী বাবলু রহমান নামের একজন তরুণকে নাবিস্কোর মোড় থেকে অতর্কিতে একটা সাদা মাইক্রোবাসে...
‘ভাইরে ধইরা নিয়া গেছে, কেমনে কই আছে খবর নাই, আর তুই বইসা ছবি আঁকস? তুই কি পাগল হইয়া গেলি নেকি, শিপলু?’
মা আমার চিন্তায় ছেদ ফেলে। প্রশ্নের পরই মায়ের কান্না গুনগুন শব্দ থেকে চিৎকারের দিকে ধেয়ে য়ায়। মনে পড়ে টাটকা খবরের কাগজের উপরে আঁকার জন্য মা অনেক বকেছে আগে। আজ অন্তত সেরকম কিছুর সম্ভাবনা নেই। 
‘ওই, তুই ওঠ। জোয়ান পোলা, ভাই হারাইছে, থানায় যা। আমি যে এখন কই যাই, কার কাছে সাহায্য চাই, এই ছ্যাড়ারে আমি কত বলছি ওই গ্যাংটার পিছে তুই লাগিস না।’
হাতের কাগজটা মুচড়ে গোল্লা করে আমি মায়ের সামনে থেকে উঠে পড়ি। দরজা খুলে সোজা বাইরে চলে যাই। তারপর হাঁটতে হাঁটতে নাবিস্কোর মোড়ের দিকে। চায়ের দোকানদার বলে, ‘কোনো সুরাহা হইল, ভাই? পুলিশ কী কইল?’ কথায় কথায় জানতে পারি সে-ও পুলিশকে ভয় পায়। ধীরে ধীরে চায়ের দোকান ফাঁকা হয়ে যায়। রাত নামে গভীর হয়ে। আমাদের ঢিমেতেতালা আলাপ চলতেই থাকে। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করি, মানুষ কেন পুলিশকে ভয় পায়? আমার মতো, চায়ের দোকানদারের মতো, আরও অনেকেই কি পুলিশকে ভয় পায়? চায়ের দোকানদার বলে সারাদিন সে আতঙ্কে ছিল এই বুঝি পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে, এই তুই কী দেখছিলি এইহানে? ওরে উডাইছে ক্যা? কুনো শয়তানি করছে নিশ্চয়, দেখিস নাই তুই? তুইও যোগসাজসে আছিলি নেকি? গাড়ির লোকগুলা কেমুন ছিল ক’ দিহি? ওরে মাইরা উডাইছে? দোকানদার ভাবে একই প্রশ্ন ধারাবাহিকভাবে ভিন্ন ভঙ্গিমায় আসতে পারত। সে অভিনয় করে দেখায়। কী প্রশ্ন এলে সে কী উত্তর দিত তা-ও বলে। আমি তার মুখের দিকে তাকাই, সে উত্তর বলতে গিয়ে আমতা আমতা করে, যদিও আমাদের সামনে কোনো পুলিশ নেই। একবার বলে, কথার মইদ্দে পুলিশ কইতে পারে, এই তুই মিছা কতা কইস না কিন্তু! মিছা কইলে এক্কেরে এই গাড়িত উডাইয়া তরেও নিয়া যাবো। এটা শুনলে সে নাকি বলবে, তাইলে কি বাবলু ভাইরেও আপনেরাই...
একনাগাড়ের কথা থামিয়ে দোকানদার উদাস হয়। তারপর বলে, ‘তা পুলিশ তো আইল না, ভাই। কিছুই তো জিগাইল না।’ 
আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে বিষণ্ণ চোখে বলে, ‘বাড়িত যান, ভাই। আমি ঝাঁপি নামাইয়া ঘুমাই। রাইত হইছে মেলা।’
গুমোট গরমে ঘামতে ঘামতে আমি বাড়ির দিকে হাঁটা দিই। কোত্থেকে যেন শামু ভাই আর ইস্পাত গ্যাং-এর জনাছয়েক ছেলে এসে জোটে। এমন ভাব দেখায় যে বাবলু নয়, তারা চিন্তিত আমাকে নিয়ে। বাড়িতে গিয়ে খুঁজে পায়নি দেখে দৌড়ে এখানে এসেছে। শামু ভাই বলে, ‘শোন, শিপলু, এইটা কিন্তু পরিষ্কার, বল্টু গ্যাং-এর কেউ অরে উঠায় নাই। আমি খুব ভিতর থেইকা জাসুস ফিট কইরা খবর নিছি। অরা জানে না ঠিকই তয় বাবলুরে উঠায়ে নিছে শুইনা বেজায় খুশি। পথের কাঁটা দূর হইছে। এখন লেকের উপরে বাঁশ দিয়া ঘর তুলতে আর কুনো বাধা নাই।’
ছেলেরা শামু ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়ে। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘শামু ভাই, তুমার কী মনে কয়? বাবলুরে পাওয়া যাইব নাকি যাইব না?’
‘যাইব, যাইব। মনে সাহস রাখিস। চল তরে বাড়ি দিয়া আসি। কাইল আবার পুলিশের কাছে যামুনে।’
অনেক রাত অব্দি আমাদের বাড়িতে বাতি জ্বলে। অথচ অন্য দিনের চেয়েও অন্ধকার লাগে। লোকে লোকারণ্য থাকে মাঝরাত পর্যন্ত। আশেপাশের লেকের ধারের মানুষেরা মাকে সান্ত্বনা দেয়। সান্ত্বনা দেয়ার ধরন হলো নিজেরাও কান্নাকাটি জুড়ে দেয়া। কান্নার রোল উঠলেও পাশের ঘরে আমাকে যেন অদ্ভুত কোনো স্তব্ধতা কুরে কুরে খায়। খবরের কাগজের উপরে বাবলুর ছবি আঁকতে আঁকতে আমি বলপেনটার কালি শেষ করে ফেলি। কলমটা কালিবিহীনভাবে বিচিত্র খবরগুলোর উপরে আঁচড় কাটে। সমবেত কান্নার শব্দের ফাঁকে ফাঁকে কলমের খসখস শব্দ আমাকে অদ্ভুতভাবে শান্ত রাখে। দুটোই মাত্র ঘর আমাদের বাড়িতে। আশেপাশের অনেকগুলো বাড়ি মিলে একটা পাঁচিল। পাঁচিলের ভিতরের মানুষেরা আমাদের দুর্দশায় রাত জাগে। কান্নার বিরতিতে, তাদের আলাপে আর আশ্বাসে মনে হয় তেমন কোনো চিন্তা নেই, আগামীকাল পুলিশের কাছে গেলেই হলো, বাবলুকে ফিরে পেতে আর দেরি নেই।
ভয়কে জয় করে আমি শামু ভাইয়ের হাত ধরে পরদিন সকাল সকাল আবারো থানায় যাই। রাতে হয়তো সামান্য দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে থাকবে। আটক করা গাড়িগুলোর উপরে কাদা কাদা হয়ে আছে। সেদিকটা আগের চেয়েও কুৎসিত। বারান্দায় একই পুলিশ। অবশ্য অন্য দুজনও হতে পারে। তাদের পোশাকের মতো মাঝে মধ্যে চেহারাও আমার কাছে একরকমের লাগে।
আগের দিনের ফাইল নাড়াচাড়া করা পুলিশ আজকে টেবিলে বসে আছে। আমাদের দুজনকে ঢুকতে দেখে যেন অবাক, ‘কী হইল, ফিরে নাই এখনো?’
‘জী না, স্যার,’ সহজে বলতে পারি। আমার যেন পুলিশের সঙ্গে কথা বলার ভয় খানিকটা কেটেছে। বলি, ‘আপনেরা কুনো খোঁজ পাইলেন?’
আমরা খোঁজ পাইলে তো বলতামই। কিন্তু অরে উঠাইল কে কও তো...’
‘স্যার, সাদা পোশাকে আসছে, স্যার। বুঝতেই তো পারতেছেন, আপনেগো কতরকমের লোকজন আছে। এই যেমন ধরেন, ডিবি কিংবা র‌্যা...’
‘চুপ! সাদা পোশাকে আসছে, তাইলে প্রমাণ কি যে তারা ডিবি কিংবা... যত্তসব ফালতু কথা। এইভাবে কইলে হয় নাকি? সাদা পোশাকে কেউ উঠাইয়া নিয়া গেলেই পুলিশরে দায় নিতে হবে?’
আমি ডানে-বামে মাথা নাড়ি। তারপর খড়কুটো খুঁজে পাওয়ার মতো করে বলি, ‘সাক্ষী আছে, স্যার! অনেক আছে।’ আমার কথা শুনে পুলিশ চমকে ওঠে। পাশ থেকে শামু ভাই কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে আমাকে, ‘কস কি তুই, ওই বল্টু গ্যাং-এর পোলাপান আমগো লাইগা সাক্ষী দিব? পাগল হইলি নেকি?’ আমিও হাল ছাড়ি না, বলি, ‘পিচ্চি আছে, স্যার। চায়ের দোকানে কাজ করে।’
‘হুম... আসামী তো বল্টু গ্যাং, নাকি?’
‘তারা ক্যান আসামি হবে, স্যার। বাবলুরে তো উঠাইছে পু...’
‘আবার! তরা কথা বুঝস না ক্যান? মামলা করবি নাকি করার ইচ্ছা নাই? বল্টু গ্যাং-এর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে কইরা যা, নাইলে ফোট।’
‘মানে, কথা হইল, স্যার, তারা আমগো শত্রু হইবার পারে কিন্তু বাবলুরে তো উঠাইছে পু...’
‘এক চটকোনা দিয়া কান ফাটাইয়া দিব তোর। সোজা কতা মাথায় ঢোকে না! বাইর হ এইখান থেইকা। আর যদি থানার আশেপাশে দেখি, ধইরা নিয়া শিকের পিছনে দিয়া দিব। কেউ তখন তোরেও খুঁইজা পাইব না, বুঝলি?’
কথা শুনে আমার সারা গায়ে কাঁপুনি ধরে যায়। এই জন্যেই কি আমি পুলিশকে ভয় পাই? আমার সঙ্গে চেয়ারটাও কাঁপে। শামু ভাইও কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘শিপলু, চল তাইলে আমরা যাই।’
টেবিলের পুলিশ গম্ভীর মুখে একজন কন্সস্টেবলকে ডেকে ইশারায় কিছু একটা চান। আমরা মুহূর্তেই তার চোখে অদৃশ্য হয়ে যাই। শুধু সে কেন, মনে হয় বাইরে বসা পুলিশ দুজনও আমাদেরকে দেখতে পায় না। আমরা চুপচাপ বেরিয়ে আসি। বহুদিন ধরে বল্টু গ্যাং-এর ছেলেদের কাছে দেখানো আমাদের দুঃসাহসের বেলুন কেন যেন নিঃশব্দে চুপসে যায়।  
শামু ভাই আমার ঘাড় জড়িয়ে ধরে রাখে। বলে, ‘কান্দিস না রে, ভাই।’  আমি আসলে কাঁদছিলাম না। শামু ভাইয়ের কথায় চোখে পানি চলে আসে।  বলি, ‘কী করব এখন, ভাই?’ শামু ভাইও কান্নাজড়ানো গলায় বলে, ‘বছর দশেকে তারা প্রায় ছয়শ’ লোকেরে উঠাইছে। কেস হইলেও ফিরছে কয়জন কে জানে। ফিরলেও জ্যান্ত লাশ, কথা কয় না।’
শামু ভাইয়ের কথা শুনে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি। চোখ মুছে দেখি রাস্তার কেউ তাকায় না। থানার সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি হয়ত স্বাভাবিক। মারামারি করতে দেখলে কি কেউ কৌতূহলী হতো? দুপুরের কড়া রোদে মানুষেরা যে যার কাজের উদ্দেশে ছোটে। যন্ত্রের মতো মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শহরটকে আমার নিষ্ঠুর লাগে। শামু ভাই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আমার খুব একা লাগে। কাঁদতে কাঁদতে বলি, ‘বোবা-কালা হইয়া ফির‌্যা আসুক বাবলু। তবু আসুক ভাই আমার।’ শামু ভাই আমার কথা শুনে চোখে মোছে। তারপর কেমন যেন কঠিন হয়ে যায় তার মুখ। শেষে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশরে ব্যবস্থা নিতে কইতেছি, আমরা কি পাগল নেকি রে?’ বলে নিয়ে শামু ভাই নিজে নিজেই হাসে। হাসির শব্দ বাড়ে, যেন অদৃশ্য কোনো হাত কাতুকুতু দিচ্ছে। আমি হাসি না তবে আমার চোখের পানি থমকে যায়। 
শামু ভাই প্রায় প্রতিদিন আসে। প্রতিবেশিরা আসে। তারা মায়ের সঙ্গে কথা বলে। আমার সঙ্গে কথা বলে। দিন যায়, মাস যায়। শামু ভাই সময় পেলে আসে। কোনোদিন হুট করে ক্ষেপে যায়, ‘চল তো আরেকবার থানায় যাই?’ আমি তার কথায় উৎসাহ পাই না। তবে মাঝেমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মনের ভুলেই থানার দিকে চলে যাই। বারান্দায় দুজন পুলিশ বসে থাকতে দেখি। ঢুকব কি ঢুকব না এই নিয়ে নিজের ভিতরে দীর্ঘ বিতর্ক শেষে বাড়ি ফিরে পুরোনো খবরের কাগজে বাবলুর ছবি আঁকি। একে একে সব খবর বাবলুর ছবিতে ঢেকে যায়। বাবলু নেই, আমার কাছে এর উপরে কোনো সত্য থাকে না। প্রতিবেশিরা কম আসে। কখনো মাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলে, ‘একটা কবর থাকলেও তো জিয়ারত করা যাইত! কিন্তু এইটা এমন এক অবস্থা...,’ মায়ের অশ্রু শুকিয়ে যাওয়া স্থির দৃষ্টিতে প্রতিবেশির কথা মাঝপথে থেমে যায়। কোনোদিন আবার মৌনতায় আশ্রয় নেয়া মা হুট করে উন্মাদ হয়ে ওঠে, ‘ওই তুই কি সারাজীবন বাবলুর ছবি আঁইকাই কাটায়া দিবি? ভাই হারাইছে তর, একটা কুনো ব্যবস্থা নিবি না? আকাইম্মা কুনহানকার। বাইর হ আমার বাড়ির থেইকা!’ মায়ের চিৎকার আর ধাক্কায় আমি সত্যি একদিন ছুটে বেরিয়ে যাই। হেঁটে বা দৌড়ে সোজা পৌঁছে যাই থানার বারান্দায়। দ্রুত ঢুকতে দেখে বারান্দার পুলিশেরা আমাকে আটকায়, দরজার খিলের মতো করে আড়াআড়ি বন্দুক ধরে। ভিতর থেকে ইশারা পেলে ছেড়েও দেয়। আমি হুড়মুড় করে টেবিলের পুলিশের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসি। যেন তাদের খবর নেয়ার কথা ছিল, এমন ভঙ্গিতে বলি, ‘কোনো খবর পাইলেন? ওই যে বাবলু, আমার ভাই?’ পুলিশ মনে হয় এক মুহূর্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে, আমাকে চিনবে নাকি চিনবে না... তারপর আকস্মিক কিছু মনে পড়ে যাওয়ার মতো করে বলে, ‘ও, ওই বাবলু! বাড়ি আসে নাই এখনো?’
‘স্যার, আপনেরা না খুঁজলে কেমনে আসবে? মামলা যে নিলেন না!’
‘নিই নাই মানে? তরে কই নাই বল্টু গ্যাং-এর বিরুদ্ধে মামলা কইরা যা? করলি কই?’
‘কিন্তু স্যার, আমি তো কইছিলাম যে বল্টু গ্যাং না, বাবলুরে উঠাইছে পু...’
‘এই তুই কিন্তু সীমা ছাড়ায়ে যাইতেছস! খালি এই পুলিশ সেই পুলিশ প্যাচাল পারস। আমাদের ওপরে অনেক চাপ আছে তা জানিস?’
‘স্বাধীন দেশের পুলিশের ওপরে কার চাপ, স্যার?’
আমার কথা শেষ হবার আগেই চেয়ার টেনে পুলিশ টেবিলের উলটোদিকে আসে, কত দ্রুত আসে তা জানি না কারণ ঠাস করে গালে চড় পড়ায় আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়। তাকিয়ে দেখি সামনের মুখটা থেকে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে আসবে করছে। সেদিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস জোটে না। চোখ নামিয়ে ফেলতেই চিৎকার শুনি, ‘ওই, তোর মুখে কথা ফুটছে, না? আগে না ডরে কাঁপতি? কুত্তার বাচ্চা, আর একবার এইরাম কইলে এইখানে ঢুকায়ে রাখব, আর কইবি?’ ইশারা করা দিকে লোহার শিক। দ্রুত ঢুকে আসার সময়ে লক্ষ করিনি পিছনের বেঞ্চে অপেক্ষারত কয়েকজন মানুষ। তারা পাথর দর্শক। একদিন ওই ঘরে একটা মেয়ে মায়ের শেষ চিহ্ন, হাতের চুড়ি হারিয়ে চিৎকার করার সময়ে আমি আর শামু ভাই ঠিক যেমন বধির দর্শক হয়ে ছিলাম।
চড়-থাপ্পড় খেয়ে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না। নাবিস্কোর মোড়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসি। এমনিতেও আমার মাঝে মাঝে দিনরাত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মনে হয় ঠিক ওইখানে হয়তো বাবলুকে কেউ মাইক্রোবাস থেকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেবে আর আমি কুড়িয়ে নিয়ে আসব। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কখনো এমন জিদ ওঠে যে মনে মনে চাই মাইক্রোবাসটা আবার আসুক আর আমাকেও তুলে নিয়ে যাক। অন্তত জানতে তো পারি বাবলু কোথায় আছে কিংবা তার কপালে কী ঘটেছে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস কোথাও নিশ্চয় থাকে! তারা যদি সেই একই জায়গায় আমাকেও নিয়ে যায়! দিনরাত কতবার ভেবেছি, বাবলু কি কারো মতো দেখতে যাকে তারা ধরতে চেয়েছিল? কিংবা বাবলু কি এমন কিছু করেছিল যা আমরা কেউ জানিনি? প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য কাউকে পাই না। চায়ের দোকানে ছাদ থেকে ঝোলানো ছোট্ট টেলিভিশন চলে। কী এক অনুষ্ঠানে হারিয়ে যাওয়া এক আদিবাসী ভাইকে খোঁজে তার বোন। নিজস্ব ভাষায় তার আকুলতা জানায় চাকমা বোনটা। পাশে দাঁড়িয়ে দোভাষী, বোনের কথার তরজমা করে যায় পরমুহূর্তে। কী যেন বলে বোনটা, দোভাষী কেঁদে ফেলে, দর্শক-শ্রোতার আর সেকথা জানা হয় না। আমার মন বলে, চাকমা ভাষা না জানলেও আমি জানি বোন কী বলে, আমি জানি বোন কী ভাবে।
বাড়ি ফিরি অনেক রাতে। মায়ের তখনো রাগ পড়েনি। ‘যে এট্টু পয়সা কামাইত, সেই চইলা গেছে গা। পইড়া রইছে আমড়া কাঠের ঢেঁকি,’ মা আমাকে দেখে গজগজ করেন, ‘গেছিলি থানায়? তরে দিয়া কি একটা মামলা করাও হইব না? কী এক পোলা দিছে আমারে আল্লায়।’ আমি মায়ের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। টেবিলে এলোমেলো জিনিসগুলোর মধ্যে বলপেন খুঁজি, কালি শেষ হবার পরে আর কিনেছিলাম কি? মনে পড়ে না। মা আবারো গর্জে ওঠেন, ‘তুই এখন আবার ছবি আঁকতে বইবি, না? কী জ্বালা! বাইর হ তুই, বাইর হ!’
মা খুব কাঁদেন। আমি তাকে তার ছেলে এনে দিতে পারি না। কিন্তু এত রাতে আমি কোথায় যাব? বাইরে এসে পাঁচিলে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসি। রাস্তার বাতির আলো মায়ের লাগানো পুঁইশাকের চকচকে পাতাকে আরো চকচকে করে তোলে। সেদিকে তাকিয়ে তাকতে থাকতে আমার আবারো ছবি আঁকতে ইচ্ছা করে। পায়ে ইটের টুকরোর ছোঁয়া পেলে হাতে তুলে নিই। তারপর পাঁচিলের গায়ে বাবলুর মুখ আঁকতে থাকি। বাবলুকে তুলে নিয়ে যাওয়ার যত গল্প শুনেছি, বিভিন্ন মানুষের বর্ণনার সেসব কথা মাথায় আনাগোনা করে। মাথার ভিতরে হুড়োহুড়ি করে একটা ঝড় তুলে দেয়। কেউ জানতে চায় না, অথচ মনে হয় সেসব বলে ফেলতে না পারলে আমি পাগল হয়ে যাব। কিংবা হয়ে যাব অথর্ব, আমাকে দিয়ে আর কখনো কিছু হবে না। রাস্তার বাতির আলোয় আমি পাঁচিলের গায়ে মানুষের মুখে শোনা সেইসমস্ত ছোটো ছোটো দৃশ্যের ছবি আঁকতে থাকি। বাবলু অন্যমনষ্কভাবে নাবিস্কোর মোড়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে, মগবাজারের দিক থেকে সাদা মাইক্রোবাস আসছে, বাবলুর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, তিন জন লম্বাচওড়া, ছোটো চুলওলা লোক গাড়ি থেকে নামছে, তারা বাবলুকে দুদিক থেকে ধরে পাঁজাকোলা করে গাড়ির খোলা দরজা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ভিতরের দিকে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে... একে একে আলাদা অনেকগুলো ছবি আঁকি আমি। পাঁচিলটাকে অনেকগুলো আয়তক্ষেত্রে ভাগ করে নিয়ে ক্রমাগত আঁকতে থাকি। রাত ভোর হয় প্রায়। যারা গ্র্যাফিতি আঁকে তারা রাতেই আঁকে যেন কেউ বিরক্ত না করে, যেন কেউ মানা করতে না পারে। আমি তাই করি। ভোর হলে অনেকগুলো ছবি আধাখেঁচড়াভাবে শেষ হয়। 
কিছু ঘুমিয়ে নিয়ে আবারো দুপুরে ছবিগুলোতে ভিন্ন রকমের ইট আর মাটির টুকরো দিয়ে রঙ করি। পুরো দেয়াল দুই-তিন দিনে বাবলুর জবরদস্তি অন্তর্ধানের প্রমাণ হয়ে ওঠে। যত আঁকি ততই আমার মন হালকা লাগে। আবার যত আঁকি ততই আঁকার নেশা চাগিয়ে ওঠে। আমি বুঁদ হয়ে আঁকি, কৌতূহলী মানুষ পিছনে জটলা করে দেখতে থাকে। বয়ষ্ক একজন বলে, ‘এইটা তো কান্তজির মন্দিরের মতো হইয়া যাইতেছে, পুরাই কাহিনি!’ প্রতিবেশি একজন বলে, ‘আঁক বাপ, আঁইকা শখ মিটা। আর তো কিছু করনের নাই তর।’ 
তিন দিনের মাথায় পাঁচিলের পাশে পুলিশের গাড়ি এসে থামে। বাবলু হারিয়ে যাওয়ার পরে এই প্রথম বাড়িতে খোঁজখবর করতে পুলিশ এসেছে ভেবে মা মাথার উপর থেকে অবাধ্য পুঁই শাকের ডাল সরিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসে। এক পুলিশ আরেক পুলিশকে লাঠির ডগা ঠেকিয়ে পাঁচিলের গায়ে আমার গ্র্যাফিতি দেখায়। নিজেদের মধ্যে কথা বলে, সামান্য হাসে, সামান্য রাগে। তারপর লাঠি দিয়ে ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকে। বলে, ‘শোন, তুই এইগুলা কী করতাছস? মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু কইতে চাইলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস মারে। হইয়া গেল কওয়া। তগো লাইগা ফেসবুক চালায়া রাখছে না? ওইহানে ক’না যত্ত খুশি। হালায় বাসাবাড়ির ওয়ালে লিখবার লাগছস ক্যা?’
আরেক পুলিশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘থানায় একটা চটকোনা খাইছ, হেইডাও এইহানে আঁকবার লাগব? মুইছা ফেল তাড়াতাড়ি। কাইল আইসা দেখব, নাইলে উপরে রঙ কইরা দিয়া যামু কইলাম।’
‘কইরেন রঙ। রঙের উপরে আবার আঁকব। যা খুশি আঁকব। এই যে আইলেন, এইডাও আঁকব। আপনেগো বাড়ির ওয়াল নেকি?’ দুই পা পিছিয়ে এসে বলি আমি। প্রতিবেশিরা পিছনে এসে দাঁড়ায়। কেউ ভাবে আমাকে গাড়িতে ওঠাবে। কেউ ভয় পায়, কেউ সুযোগে থাকে আমাকে বাঁচানোর। একজন পুলিশ অবাক হয়, আরেকজন মিটিমিটি হাসে। হেসে বলে, ‘আঁইকা যা তুই, দেহি কদ্দূর কী করবার পারস।’
তারা গাড়িতে উঠে চলে গেলে মানুষ স্বস্তি পায়। ফোন তাক করে ছবি তোলে—দেয়ালের ছবি, আমার ছবি। পরদিন কেউ কেউ এসে বলে খুব নাকি দেখছে মানুষ আমার আঁকা ছবি। অনেক রাগ, অনেক কান্না, মানুষেরা লিখে লিখে জানাচ্ছে। এইবার নাকি কিছু একটা হলেও হতে পারে। খবর নাকি ধীরে ধীরে উপরে পৌঁছবে। আমার অবশ্য সেসব তত জানতে ইচ্ছা করে না। তবে নিজের বাড়ি ছাড়িয়ে অন্যের বাড়িতেও ছবি আঁকতে ইচ্ছা করে। যত বাড়িতে আমার মতো কাউকে হারিয়ে কেউ হতভম্ব হয়ে বসে আছে, সেইসমস্ত বাড়ির দেয়ালে। মানুষের নৈঃশব্দ্যের ফেরে পড়ে যখন প্রতিটা বাড়িতে একজন করে আহত মানুষ বসে থাকবে, আমি তার স্বজন হারানোর কাহিনি শুনব। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনব। তার বাড়ির দেয়ালে আমি সেই ছবি আঁকব, কাহিনির মতো ছবি। জীবিত লাশে ভরপুর মৌন মানুষের শহরে জলজ্যান্ত মানুষ উবে যাওয়ার ছবিতে ছবিতে প্রত্যেকটা দেয়াল একদিন ঢেকে যাবে।


• কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ। 

menu
menu