মুক্তিপণ

এ গল্পটার কোনও মাথামুন্ডু নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ চরিত্রদের দোষ। বলা ভালো, চরিত্রদের চরিত্রদোষেই। চেতনা যে ট্যালা তা সে নিজেই খুব ভালো করে জানে। মানে, যেদিন থেকে একটু আধটু জ্ঞানগম্যি হয়েছে, সেদিন থেকেই সে জানে, অনেক কিছুই তার মাথায় ঢোকে না। বা, ঠিক সময়ে সে সব কিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। যখন তার মাথায় ঢোকে, তখন আসলে চোর পালিয়েছে।
ভেবেছিল, অনির্বাণটা সঙ্গে থাকলে সেই দোষ কেটে যাবে। অন্তত দোষ না কাটুক, তার খামতিটা পুষিয়ে যাবে। অনির্বাণ বেশ চালাক-চৌকশই বটে, তবে তার একটা বদভ্যেস হল, চেতনার মুখের উপর সে বিশেষ কথা বলে না। মোদ্দা কথা, প্রেমিকাটিকে বিশেষ চটাতে চায় না। ফলে দুই মক্কেলই মাঝেমধ্যে গাড্ডায় পড়ে। এখানে খানিকটা তর্কের অবকাশ অবশ্য থাকে। কারণ এই যে ট্যালা হিসেবে চেতনাকেই দেখানো হল, এ কি দীর্ঘকালীন প্যাট্রিয়ার্কিকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলেই নয়? উলটোটাও তো হতে পারত। অবশ্যই হতে পারত, তা নিয়ে কোনও সংশয়ই নেই। কিন্তু আপাতত এই কিউট কাপলকে আমরা একটা ইউনিট হিসেবে ধরি এবং মোদ্দা কথা হল, এরকম দোষ যাদের থাকে গল্প তাদের গেরোয় পড়া থেকে আটকাতে পারে না! এক্ষেত্রেও পারল না। ওরা গাড্ডায় পড়ল অবধারিতভাবেই।
ফলত এখন অনির্বাণের গায়ে একটা চিমটি কাটল চেতনা। চেতনার হাতের উপরেও অনির্বাণ চিমটি দিল। একে অন্যকে চিমটি কেটে তারা বোঝার চেষ্টা করল, এরকমটা আদৌ সত্যি ঘটছে কি না। মানে যা হচ্ছে সেটা কোনও ইয়ার্কি নয়। সত্যি যে এরকমটা ঘটতে পারে না, তার পিছনে একাধিক যুক্তি আছে। যেমন: 
১) শপিং মল ওরকম ঝাঁপ ফেলা দোকানের মতো নয় যে, রাত হল আর সব বন্ধ হয়ে গেল। আর তারা দুজন একটা ঝাঁপের পিছনে আটকে থাকল অথচ কেউ টেরটিও পেল না।
২) সিসিটিভি চেকিং চলছে অহরহ, কোথাও সন্দেহজনক কিছু দেখলে আগেভাগেই চেক করে নেওয়া হয়। সেখানে বাইরে থেকে কেনাকাটা করতে এসে দুই তরুণ-তরুণী এমন মশগুল হয়ে গেল যে দোকান বন্ধ হলেও তারা টের পেল না, এমনটা সম্ভব যদি ধরেও নিই, তবু কর্তৃপক্ষ তা কখনোই অ্যালাও করত না। তারা ঠিক মনিটরে তাদের দেখতে পেত এবং ঘেঁটি ধরে বের করে দিয়ে আসত।
৩) তা ছাড়া এইসব ধামসা প্রতিষ্ঠানে রাতেও সিকিওরিটি থাকে। ফলে, সেখানেও এরকম দোকানের ভিতর বন্ধ হয়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। আর যদি হয়ও, ধরে নিলাম কল্পনার খাতিরেই হয়, তবে ফোন করে বাইরে কাউকে খবর দিয়ে দিলেই হয়। ১০০ ডায়াল করা যেতে পারে। পুলিশ, দমকল… যাই হোক করে বাইরে জানানো নিয়ে কথা। ইন্টারনেট মানে ফেসবুকে জানিয়ে দিলে হইহই ব্যাপার হয়ে যাবে। কিন্তু এইসব একসঙ্গে কাজ করবে না, এটা জাস্ট অসম্ভব। মানে বি-গ্রেড হিন্দি ভূতের সিনেমাতেও এরকম উদ্ভট প্লট হবে না। 
চেতনার হাতে বোধ হয় একটু জোরেই চিমটি দিয়ে ফেলেছিল অনির্বাণ। সে কপট রাগে অনির্বাণের শক্ত পেশির উপর একটা নরম কিল বসিয়ে বলল, অসুর না কী রে বাবা! অন্য সময় হলে কথাটা নিয়ে তুলকালাম করত অনির্বাণ! সুরের উলটো অসুর— এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক ছক। ভ্রান্ত আর্যতত্ত্বের উপাদেয় নির্মাণ। ম্যাক্সমুলার সাহেবের গিলিয়ে দেওয়া বড়ি আর এক শ্রেণির বাবুদের আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর। তার দায় অসুর কেন বইবে? ‘পড়ো পড়ো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’ বলে স্বামী বিবেকানন্দ থেকে আচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায়— নানাজনের লেখা কোট করে একেবারে যাকে বলে পেড়ে ফেলত চেতনাকে। আর চেতনা শেষমেশ পরাজয় স্বীকার করে হয়তো বলত, হ্যাঁ, সবই না হয় মানলাম, কিন্তু অসুরের গায়ে জোর ছিল, এটা মানতে প্রবলেম কোথায়? কে লিখে গেছে যে, অসুর পেটরোগা বাঙালি ছিল! 
কিন্তু এই মুহূর্তে এই স্বাভাবিক তর্কটা হল না। কারণ দুজনেই বুঝতে পারছে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে। বুঝতে পেরেছে, তারা স্বপ্ন দেখছে না। দুজনে একসঙ্গে একই স্বপ্ন দেখা সম্ভব যদি হয়েও থাকে, কোনও দুরূহ তত্ত্ব যদি তাতে সমর্থনও জোগায়, এই মুহূর্তে সেসব কিছুই হচ্ছে না। চেতনার কিল বেশ অনুভব করতে পারছে অনির্বাণ। আর অনির্বাণের চিমটিতে চামড়া জ্বলছে চেতনার। অর্থাৎ তারা জেগেই আছে। এবং উপরে যা যা অবাস্তব কল্পনা করেছিল, তাই বাস্তবে হচ্ছে ভেবে বেশ শিউরেও উঠল।
এরকমটা সত্যি হতে পারে! তাদের মতো দুজন আদ্যন্তে শহুরে মানুষের সঙ্গে এরকমটা আদৌ হতে পারে, রিয়েলি! 

২.

অনির্বাণই পুরো বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করল। একটু আগে ঠিক কী হয়েছিল? সে আর চেতনা পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। যেন জন্মের ঘুম ঘুমিয়ে নিচ্ছিল তারা। সুষুপ্তির কোন স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল কে জানে! হঠাৎ মনে হল, মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে কারা যেন কথা বলছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, স্বপ্ন। তারপর মনে হল, না তো! দিব্যি তো কারা ঝুঁকে পড়ে দেখছে। যেমন রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষের মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করে অচেনা লোকেরা, অনেকটা সেরকমই। একটু একটু করে ঘুমটা খানিকটা ভাঙে তাদের। আর দ্যাখে, সামনে সত্যিই অনেকগুলো মুখ অপেক্ষা করছে।
অনির্বাণ জানতে চায়, আমরা কোথায়?
মুখেরা বলে, শপিং মলের ভিতর। জামাকাপড় দেখতে দেখতে তোমরা বুঁদ হয়ে গিয়েছিল। আমরা তখন তোমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
অনির্বাণ আর চেতনার ঘুম তখনও পুরোপুরি কাটেনি। অনির্বাণই আবার বলল, ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলে, সে আবার কী? তোমরা কারা?
মুখেরা বলল, আমরা ম্যানিকিন। এই শপিং মলেই থাকি। তোমাদের দুটিকে আমাদের খুব ভালো লেগেছে। তাই ঘুম পাড়িয়ে রেখে দিয়েছিলাম। 
“তা কী করে হবে? ম্যানিকিনের আবার কোনও ক্ষমতা আছে নাকি? তার কি প্রাণ আছে যে মানুষের মতো কাজ করবে?”
ম্যানিকিনরা বলল, হবে নাই বা কেন! রাবার স্ট্যাম্পের কি প্রাণ আছে? কিন্তু ওই স্ট্যাম্প না থাকলে কোনও কিছু সত্যি বলে মনে হয় নাকি? ওটি ছাড়া কোনও অফিশিয়াল কাজ হবে? 
মাথা নাড়ে অনির্বাণ-চেতনা। ওরা বলে, তাহলে বুঝলে তো জড়বস্তুরও কেমন ক্ষমতা থাকে!
এবার ধড়মড়িয়ে উঠে বসে অনির্বাণ। চেতনাও। বেশ কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল তারা। প্রাথমিক ধাক্কা কাটলে বুঝতে পারে, আশ্চর্য হলেও সত্যি, তারা একটা শপিং মলের মধ্যে আটকে আছে। একে অপরকে চিমটি কেটে দ্যাখে, সত্যিই কোনও স্বপ্ন দেখছে না। এ একেবারে ঘোর বাস্তব। ট্যালা চেতনারই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলেছিল। মোবাইল বের করে ফোন করার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলেই কিছু নেই। এক মুহূর্ত মনে হল, আদৌ তারা কলকাতাতেই আছে তো! থাকলে মোবাইলের কানেকশন থাকবে না, এটা হতে পারে!
“পারে, যদি আমরা বন্ধ করে রাখি।”
এবার যেন অন্ধকারের ভিতর একটু চোখ সয়ে যাওয়া আলোয় কয়েকটা মুখ দেখতে পেল ওরা। ম্যানিকিন। রাতের বেলা ওদের গাদাগাদি করে একটা পাশে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা নিজেদের পরপর সাজিয়ে গুছিয়ে চেতনাদের থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই দাঁড়িয়ে বলা ভুল, কারণ সবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত নেই। বিশেষত মেয়েদের। তাদের বুক পর্যন্ত দ্রষ্টব্য, ফলত ওটুকুই আছে। কিন্তু ওই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে আছে। 
এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল অনির্বাণ। চেতনা শক্ত করে তার পিঠের জামা খামচে ধরে আছে। অনির্বাণের মস্তিষ্ক শুধু বলল, কী করে কী হয়েছে, তা ভেবে এখন আর লাভ নেই। আসলে তারা এখন হস্টেজ। যেমন করে হোক, এদের সঙ্গে রফা করে তাদের বেরোতে হবে। 

৩.

“তোমরা আমাদের ঘুম পাড়ালে, আর এই শপে যারা কাজ করে তারা কেউ দেখতে পেল না? আস্ত দুজন মানুষ পড়ে থাকতে দেখেও ওরা দোকানপাট বন্ধ করে চলে গেল!”
“তোমরা মানুষ ছিলে না তো তখন।”
“মানে?”
“তোমরা যখন বুঁদ হয়ে পোশাক দেখছিলে, আমরা তোমাদের ম্যানিকিন বানিয়ে নিয়েছিলাম।”
এক পুরুষ ম্যানিকিন নিজেকে দেখিয়ে বলল, আমার মতো হয়ে তুমি ওখানটায় দাঁড়িয়েছিলে। আর একটা আবক্ষ মহিলা মূর্তিকে দেখিয়ে বলল, ওর মতো হয়ে ওদিকটায় ছিল ম্যাডাম। 
চেতনা ওই ম্যানিকিনের মতো স্রেফ অন্তর্বাস পরে কাচের পাল্লার পাশে ছিল! ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে উঠল তার, ইস কত লোকই না দেখে গেছে তবে তাকে। ম্যানিকিনগুলো বোধ হয় মন পড়তে পারে! আর এক আবক্ষ মহিলা মূর্তিটি বলল, তাহলে ভাবুন ম্যাডাম, আমাদের রোজ রোজ কীরকম লাগে! 
চেতনা বিরক্ত হয়ে বলল, বাজে বোকো না তো! তোমরা তো জড়বস্তু। তোমাদের লজ্জা, ঘেন্নার বালাই নেই। 
“সে তো আপনাদের প্রতিমাও জড়বস্তু। তাই বলে কি আপনি তাকে জড় ভাবেন?”
“কীসে আর কীসে তুলনা! প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা বলে তো একটা ব্যাপার থাকে, নাকি? এখানে কোথায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা?”
“কী যে বলেন?” বলে সে টানা বলতে শুরু করল, “আপনারাই তো প্রতিনিয়ত আমাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করছেন। এই ধরুন, কেউ যদি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে, আপনি উলটো দিকে তাকিয়ে থাকলেও তা টের পান তো! ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে টের পান। একজনের কামনা আপনার ওই না-থাকা ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে। এবার আমাদের দিকে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ ওই একই কামনা নিয়ে তাকায়, আমাদেরও কি ওই না-থাকা ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয় না? আসলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আপনাদের ভোগবাসনা সমস্ত ভিতরে জেগে ওঠে। সেই আগুনে আমরাও জেগে উঠি। কিন্তু আমরা মুখে বলতে পারি না, এই যা। ভাবুন তো কী অস্বস্তি! দিনভর একটা ব্রা কি আন্ডারওয়ার পরে দাঁড়িয়ে থাকা। আর লক্ষ লক্ষ মানুষ কামনাতুর চোখে আপনাকে চেটে চলে যাচ্ছে। আপনি থাপ্পড় লাগাতে চাইছেন অথচ স্রেফ ম্যানিকিন বলে কিছু করতে পারছেন না।” 
চেতনা খুব অস্ফুটে বলল, উফ মা গো! এত আস্তে কথাটা বলল যে শুধু অনির্বাণই তা শুনতে পেল। সে বুঝল, এখন এ তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। ম্যানিকিনদের পৃথিবী আছে নাকি নেই, সেখানে কী ক্ষোভ-দুঃখ আছে, সে পরের কথা। আগে এখান থেকে বেরোতে হবে। 
সে বলল, সবই বুঝলাম। কিন্তু আমরা তো প্রথমত মানুষ, আপনাদের মতো ম্যানিকিন নয়। ফলত, আমাদের এখানে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। মানে, এভাবে থাকলে আমরা হয় মরে যাব, নয় সিকিওরিটি জানতে পারলে আমাদের ধরে জেলে পুরে দেবে। আমাদের জন্য প্লিজ কিছু একটা করুন।
“সিকিওরিটি জানবে কী করে?”
“কেন, সিসিটিভি ফুটেজ?”
“ধুর! কত রেপ কিংবা মার্ডার কেসে দেখেন তো, ঠিক ওই সময়ের সিসিটিভি ফুটেজই থাকে না। কী করে থাকে না? চাইলে সব করা যায়। এই মনে করুন সিসিটিভি চলছে না, আবার ধরুন চলছেও। এই যে লেখা থাকে, ইউ আর আন্ডার সিসিস্টিভি সারভালেন্স, কখনও ভেবে দেখেছেন, সিসিটিভিটা আদৌ চলে কি না। জীবনেও দেখেননি। আসলে আপনাদের ভিতর একটা চোর লকলক করে বলে এই সাবধানবাণী দেখেই আপনারা সিঁটিয়ে যান।”
অন্য সময় হলে অনির্বাণ এ নিয়েও তর্ক করত। কিন্তু এবারও সামলে নিল। বলল, “মানলাম আপনাদের যুক্তি। কিন্তু আমাদের বেরোনোর কী হল?”
“একটা শর্তে।”
“কী?” দুজনেই সমস্বরে জানতে চাইল।
“একটা দিন আমাদের হয়ে আপনাদের প্রক্সি দিতে হবে।”
চেতনা জোরে বলল, না। কিন্তু আশ্চর্য, সে নিজেই বুঝল তার গলার জোর তেমন নেই। এমন একটা আওয়াজ বেরোল যা শুধু ওরাই শুনতে পায়। আর হস্টেজ হয়ে জোর খাটিয়ে বলার মতোও এখানে কিছু নেই। অনির্বাণ আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা ফচকে ম্যানিকিন, যার আঙুলটা নেতাদের মতো করে তোলা, বলল, যা বলছে তাই করুন। নইলে মুক্তি নেই। আবার ভেবে বসবেন না যেন যে, ম্যানিকিনদের দুনিয়ায় মৌলবাদ নেই। 
বলে ওরা নিজেদের মতো করে হাসতে লাগল। অনির্বাণের কাঁধে মাথা রেখে তখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে চেতনা। কিন্তু কিছু করার নেই। বাহারি পোশাক, ঠান্ডা দোকান তাদের এমন বুঁদ করে রেখেছিল যে, এখন এই মাশুল দিতেই হবে।       

৪.

“আমরা কি পরীক্ষায় পাশ করেছি? এবার কি আমরা মুক্তি পেতে পারি?”
একটা আস্ত দিন কেটে গেছে। অনির্বাণ আর চেতনা ম্যানিকিন হয়ে গোটা একটা দিন কাটিয়ে ফেলেছে। বাড়িতে এতক্ষণে নিশ্চিত পুলিশে ডায়রি করে দিয়েছে। যাকগে। ভালোয় ভালোয় ফিরে সব না হয় বুঝিয়ে বলা যাবে। অবশ্য কেউ বিশ্বাস করলে হয়! ভাবছিল অনির্বাণ। এমন সময় তার প্রশ্নের উত্তরে এক ম্যানিকিন জানতে চাইল, “তোমাদের কেমন লাগল?”
সবথেকে রাগ হচ্ছিল চেতনার। সে সজোরে রাগতভাবে বলল, “জঘন্য।” একটা এইটুকুন স্কার্ট পরিয়ে দিনভর তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। অনির্বাণের অবশ্য কপাল ভালো বলতে হবে। সে নর্মাল জিনস পেয়েছিল। উপরে গেঞ্জি। এতদিনে ওরা দুজন বুঝল কী জঘন্য মানুষের এই ব্যবস্থা! কারও বুক, পেট, কোমর, পেশি দেখানোর জন্য এরকম একটা করে মূর্তি বানিয়ে বসিয়ে রাখা আদতে একধরনের নিষ্ঠুরতা। পণ্যসভ্যতার অদ্ভুত স্বার্থপরতা। অথবা উল্লাস। যতটুকু তার দরকার ততটুকুই সে নিজের জন্য সাজিয়ে রাখে। এইজন্যই কি মানুষ প্রতিমার কাঠামোর পিছনে মাটি দেয় না? একই স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুর উল্লাস কাজ করে সেখানেও? এই বন্দি অবস্থাতেও অনির্বাণের মাথায় এসব এল। একটু রাগই হল তার। নিজের উপর নাকি মানুষের উপর নাকি এই ম্যানিকিনদের উপর, ভালো বুঝল না। কিন্তু এখন রাগারাগির সময় নয়। চেতনাও যেন বেফাঁস কিছু বলে না ফ্যালে! অনির্বাণ আলতো করে চেতনার গা টেপে। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করে, তা আপনারা সারাদিন কী করলেন?
যেন বন্ধ কলের মুখ খুলল। তাদের বিনিময়ে যে দুজন ছুটি পেয়েছিল আজ, তারা হইহই করে বলতে শুরু করল, একজন খাবারের জায়গায় সারাদিন কাটিয়েছে। আর একজন পারফিউম সেকশন ঘুরেছে, তারপর সিনেমার ওখানে… ইত্যাদি ইত্যাদি। 
অনির্বাণ হাসে। বলে, বাহ। পুরো হলিডে মুড। আমরা তো আপনাদের ডিউটি তাহলে ভালোভাবেই করে দিয়েছি। এবার আমাদের ছেড়ে দিন প্লিজ। 
ম্যানিকিনরা বলে, হ্যাঁ। এই যে দিই। কিন্তু তার আগে একটা কথা। 
অনির্বাণ-চেতনা যেন বুকে বল পেল। আবার একটু বিরক্তও হল। তবে মুখে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।
“যাবার আগে উপহার হিসেবে আমাদের একটা কিছু দিয়ে যান।”
“বলুন না, কী চান?”
“যাই হোক কিছু একটা। এই যে কালকে আমাদের প্রাণের বিষয়ে আপনারা সংশয় প্রকাশ করছিলেন, তাহলে খোলসা করে বলি। আমরা যে এতটা পোলিশড হয়েছি, তার কারণ বিভিন্ন সময়ে আপনাদের মতো লোকেরা কিছু না কিছু আমাদের দিয়ে গেছে। ঘেন্না, ভালোবাসা, লজ্জা, ভয়… কিন্তু সব কিছু কেউ এক আধারে পাই না। তাই আমরা পুরোপুরি মানুষ হতে পারি না। তা আপনারা কী দেবেন বলুন? প্রেম?”
চেতনা ফের আঁকড়ে ধরে অনির্বাণকে। প্রেম দিয়ে দিলে একে অপরকে হারাবে তারা। সেটি হচ্ছে না। 
“বেশ তাহলে অন্য কিছু? পড়াশোনা, মানে বিদ্যেবুদ্ধি?”
তাই বা কী করে হয়! চাকরিবাকরি থাকবে তাহলে? আর জীবনে চাকরি, অর্থ যদি না থাকে, তাহলে এরকম জীবন পেয়ে কী লাভ! যেখানে বেঁচে থাকাই দায়। 
কী দেওয়া যায় এদের! অনির্বাণের মনে পড়ল বাড়ির প্রিয়জন কেউ মারা গেলে তার নামে একটা ফল ছেড়ে দিতে হয়। মানে সেই ফল আর খাওয়া যায় না। সকলেই দেন। তাই বলে কি কেউ আম স্যাক্রিফাইস করেন! যেটা তেমন পছন্দ নয়, এরকম একটা কিছু দিয়ে দেন। ধরা যাক, বেদানা। অনির্বাণের অপছন্দের ফল, সুতরাং সেটা না খেলেও চলে। বা কাঁঠাল। 
অনির্বাণ ভাবতে বসল, এরকম একটা কী দেওয়া যায়, যাতে তাদের কিছু যায় আসে না। গায়ের শক্তি! না, তাহলে ডিজেবল হয়ে থাকতে হবে? মগজ হাতড়ে দেখল সেরকম কিছুই প্রায় নেই। লজ্জা, ঘেন্না, ভয়, প্রেম— এমন কিছুই চিরতরে দিয়ে দেওয়া যায় না। যা দেবে ভাবে, তাতেই নিজেকে বিকলাঙ্গ মনে হয়। অসম্পূর্ণ ঠেকে। মহা ফাঁপরে পড়া গেছে। তীরে এসে তরী না ডোবে!
“কী হল? কিছু ভেবে বের করতে পারলেন?”
অনির্বাণ এতক্ষণ অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিল। আচমকা যেন মগজে বিদ্যুৎ খেলল। চকিতে স্মার্টনেস দেখিয়ে অনির্বাণ বলল, হ্যাঁ, একটা জিনিস দিয়ে দিচ্ছি। 
চেতনাও তখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার দু-চোখে ভয়। না জানি কী না কী চিরতরে দিয়ে দিতে চলেছে অনির্বাণ! অনির্বাণ অবশ্য তার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিল, ডোন্ট ওরি, আই উইল ম্যানেজ।
“কই বলছেন না যে?”
“হ্যাঁ, এই যে বলি।” বলে অনির্বাণ বলল, “দেখুন, আমরা দুজনে কেউই অ্যাকটিভ পলিটিক্স করি না। তাই ঠিক করলাম, যদি আমাদের পলিটিক্যাল চিন্তাভাবনাগুলো, মানে কনসেন্সটা দিয়ে দিই, তবে আপনাদেরও কিছু একটা বেটার পাওনা হয়, আমাদেরও তেমন কোনও ক্ষতি হয় না। আশা করি, এরকম উপহার আপনাদের কেউ দিয়ে যায়নি।”
“আর এ উপহার দিলে, আপনাদের কোথাও কোনও জবাবদিহিও করতে হবে না, তাই তো!”
চুপ করে যায় অনির্বাণ। 
ম্যানিকিনদের মধ্যে এবার একটা হালকা হাসির হররা ছোটে। তারপর তারা ক্রমে নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে থাকে। তাদের প্রতি কোনোরকম ভ্রূক্ষেপ না করে এক এক করে সরছে সকলে। অনির্বাণ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। চেতনা আরও জোরে তার পিঠের জামা খামচে ধরেছে তখন। অনির্বাণ মরিয়া হয়ে চেঁচায়, আপনারা চলে যাচ্ছেন কেন? চাইলে অন্য কিছুও দিতে পারি কিন্তু। প্লিজ আমাদের মুক্তি দিন।  
বন্ধ শপের এক কোনায় সরে যেতে যেতে এতক্ষণ চুপ করে থাকা এক ম্যানিকিন এবার তার কথার উত্তর দিল। অনির্বাণ আর চেতনার দিকে একটু ঝুঁকে ভয়ানক সিরিয়াস হয়ে বলল, “কী জানেন অনির্বাণবাবু, এখানে আমাদের অনেকেই আসলে অনেক ভাবনাচিন্তা করে শেষমেশ এই উপহারটাই দিতে চেয়েছিলাম। দেখছেন না, সেই কারণে এখানে ম্যানিকিনের সংখ্যা দিন দিন কেমন বেড়ে যাচ্ছে। এরা তো এখন আর হিসেবও মেলায় না। আমাদের আসা আছে, ফেরা নেই।” 
বলতে বলতে সরে গেল সেই সিরিয়াস ম্যানিকিন। ভ্যাবলার মতো এই অন্ধকারে এখন বসে আছে অনির্বাণ-চেতনা। যদিও এরপর থেকে তাদের কেউ আর এই নামে চিনবে না।  


• পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

menu
menu