সোয়েটার

বেলা ছোট হয়ে আসছে, তাই বিকেলগুলোও দৈর্ঘে-প্রস্থে এঁটে ওঠে না। ক্যানভাসে যে বুড়ো কামরাঙা গাছ, তার ঝিলিমিলি পাতার ফাঁকে নরম নভেম্বরের আলোরেখা বাঁকা হয়ে পড়ছে। যেন লজেন্স না পাওয়া শিশুর ঠোঁটের দুকোণ। অভিমানে সামান্য বেঁকে গেছে। 

কসমোপলিটান কংক্রিটের শহরে এক চিলতে স্নিগ্ধ বাড়ি। সাদা পাতার ওপর একটি একলা আশ্চর্য চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে। দুই বাই দশ রূপলাল লেনের দোতলা বাড়ির বারান্দা। ঝুরো ঝুরো নারকেল আর চিনি দেয়া মুড়ির বাটি যার হাতে, তার ছায়া দীর্ঘতর হয়ে এগিয়েছে। টবের বেলী আর অ্যালমান্ডার ডালপাতায়। ছবির একেবারে ডান দিকে পাড়ার সরু গলিতে ক্রিকেট খেলছে বন্ধুরা। কোণাভাঙা ইটের ওপর ইট সাজিয়ে উইকেট।     

‘বাবুউউউ…’ একটি ব্যাকুল ডাক শুনে চমকে ওঠে ছেলেটি। প্রতিটি ডাকের পেছনে একটি কারণ থাকেই। বাবু সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ ভেবে নেয় মুহূর্তে। পেছনের দেয়ালে গাঁথা খোলা জানলা দিয়ে ভেতরে তাকায়। মলিন অন্ধকার। বাইরের মৃদু আলোয় ঘরের অন্ধকার সামান্য ফিকে। কাউকে দেখা যায় না। ‘হাউ’জ দ্যাট’ চিৎকারের সাথে কামরাঙার ডালে ফেরত আসে টিয়ের ঝাঁক আর কর্কশ ডাকাডাকিতে অ্যাপীল করে এল বি ডাব্লিও’র।          

খাবার ঘরে তিতলীর হাতে হ্যারিকেন। পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে নিচ্ছে কালির পরত। তিতলী বাবুর জেঠতুতো বোন, প্রায় আট বছরের বড়। তিতলীর খুব ন্যাওটা বাবু। হবে নাই বা কেন? জিভে শক লাগানো হজমী, বছরকার তুলে রাখা আমসত্ত্ব, রঙিন মার্বেল থেকে শুরু করে সমস্ত নিষিদ্ধ বস্তুর একমাত্র যোগানদার তিতলী। গোলাপি হাওয়াই মিঠাই, কুলফি মালাই আইসক্রিমও। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সে গাইতে পারে, আজ যেমন করে গাইছে আকাশ...। বাবু খুব খুশি, যেদিন তিতলী চে’র পোস্টার এনে দিল। ছবির পাশে লেখা— ‘আমার মৃত্যুর মানে এই নয় লড়াই থেমে গেছে’। এ কথার মানে সে বোঝে না। পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে চে’র পোস্টার। অঙ্কের ফরমুলার পাশে। স্কচ টেপ দিয়ে লাগিয়েছে। ঘরের যেদিক থেকেই তাকিয়ে দেখুক না কেন, বাবু লক্ষ্য করেছে, চে ওর দিকেই তাকিয়ে। সত্যিই খুব মজার ব্যাপার।         

দোতলায় থাকে বাবুরা। একতলায় একপাশে দুটো ঘর তিতলীদের। আরেকপাশে বসার ঘর। মাঝখান দিয়ে লাল সিমেন্টের সিঁড়ি চলে গেছে ছাদ পর্যন্ত। কামরাঙা গাছের ডাল ধরা যায় ছাদ থেকে। জেঠিমা নেই। হারিয়ে গেছে। কেমন করে সেটা বাবু জানে না। সন্ধ্যের পর জ্যাঠা এক গ্লাস মাল্টোভা আর বিস্কিট খেয়ে দাবার বোর্ড নিয়ে বসে। আনিস স্যার আসবেন ঘড়ি ধরে সাড়ে ছটায়। কামরাঙা গাছে হেলান দিয়ে তার সাইকেল দাঁড়িয়ে থাকবে রাত ন’টা অব্দি। তখন বাবু বীজগণিত করে বাবার কাছে আর প্যাসেজ রাইটিংও। বেঙ্গলি টু ইংলিশ। আজ বাবু উৎপাদকে বিশ্লেষণ করছে। বাবা বলে মিডল টার্ম ফ্যাক্টর। 

ইদানীং সন্ধ্যের বাতি না-জ্বলে উঠতেই বিদ্যুৎ চলে যায়। শহরের এদিকটায় হরহামেশা পাওয়ার কাটের হিড়িক। তিতলীর পাশের চেয়ারে মা। বাবুকে দেখে বলে—বাটি রেখে এদিকে আয়। তার হাতে উলের কাঁটা। দুটো কাঁটায় লটকে আছে ফিরোজা রঙের সোয়েটার। বাবু মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। দুহাতে বাবুকে ঘুরিয়ে ওর পিঠের ওপর অসমাপ্ত সোয়েটার মেলে ধরে মা। ওপর-নিচ, ডান-বাম দেখেটেখে বলে— হুম, ঠিক আছে, এবার যাও। মাপ নিতেই মা ডেকেছে তবে। বাবু ভেবেছে মা বলবে—এক্ষুনি গলায় মাফলার দাও। বাবুর ভীষণ ঠান্ডার ধাত। একটুতেই টনসিল ফুলে যায়। প্রায় সারা বছরই গায়ে সামান্য জ্বরের প্রলেপ। ঠান্ডা-গরমের পালা বদলে ছেলেটি সর্দি জ্বর বাধাবে। ও নিয়েই মা’র দুশ্চিন্তা। প্রতিদিন তুলসী পাতার রস, আদার রস আর মধু মিশিয়ে খাওয়াবে। পথ্য তখন নরম গলাভাত। টনসিল ফুলে গেলে গিলতে সহজ। তরতরিয়ে নেমে যায়। বাবু মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবারও।  

‘এই শোন্, জ্বর দেখি’, মা’র গলা শুনে ঘুরে দাঁড়ায় বাবু। দ্রুত উল বুনছে মা। বাবু বলে—তোমার হাত তো ব্যস্ত। মা হাসে—‘আমার গালে গাল লাগা। ওতেই বুঝব।’ বাবু লজ্জা পায়। মা যে কী! এখনো বাবুকে ছোট ভাবে। সে বড় হয়েছে না! তেরতে পা দিয়েছে। জানুয়ারি মাসে সে ক্লাস সেভেন এ উঠবে। মা কিন্তু কপালে-গালে হাত দিয়েই দেখল। ‘না জ্বর নেই। গলায় মাফলার পর আর জানলাটা খোলা থাকলে বন্ধ করে দিও।’ 

বাবু চলে যায়। মা সেদিকে আনমনা তাকিয়ে। ছেলেটা তার দেখতে এত সুন্দর! পৌরাণিক গ্রিক দেবতাদের মতো। আর মেধাবীও তেমন। তেমন আর পড়ে কই, তবু বরাবরই ফার্স্ট বয়।  
                  
উত্তরে হাওয়া জমিয়ে বসেছে মফস্বল শহরে। ঘন কুয়াশা চিরে মুখ দেখাতে আজকাল সূর্যের দেরি হয়ে যায়। বছরে একবারই আসা হয় এদিকে। তবে এবারেরটা অন্যরকম। মানে, বাবু আর কি। ফাইনাল  পরীক্ষা দিয়ে মামাবাড়ি এসেছে। মা-বাবাকে ছেড়ে প্রথম একলা কোথাও। তিতলীর বিয়ের কথা হচ্ছে। এ সময় বাড়িতে মায়ের থাকতেই হবে। সে তো মামা তাদের বাড়ি গিয়েছিল, তাই বাবু মামার সাথে চলে এসেছে। মা আসবে এক সপ্তাহ পর। 

পুরু লেপ গায়ে দিয়েও বাবুর শীত শীত করে। পাশ ফিরলে মনে হয় বিছানা ভেজা। একপাশ ফিরে শুয়ে ঠান্ডা ভেজা দীর্ঘ রাত কেটে যায়। ঝিঁঝিঁর ক্লান্তিহীন ডাকে বাবুর ভয় লাগে। মা-নেই-মা-নেই গন্ধ নিয়ে ভারী বাতাস জড়িয়ে ধরে। ঝিঁঝিঁ পোকা দেখতে কেমন বিদঘুটে আর বেশ বড়ও। কেন যেন বাবুর ধারণা ছিল, ঝিঁঝিঁ আর জোনাকির চেহারা প্রায় কাছাকাছি।                  

মামার কাছে সন্ধ্যের পর গল্প শোনে বাবু। মামার মুখেই চে’র নাম শুনেছিল। তিতলীকে বলেছিল সে কথা। স্টেশনারি দোকান থেকে পোস্টার কিনে এনেছিল তিতলী। বাবা প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিল। মা’কে বলেছিল- ‘তোমার ভাই, ছেলেটার এই বয়সেই মাথা নষ্ট করছে।’ মুক্তিযুদ্ধে মামাদের অপারেশানের গল্প শুনেছে বাবু। মামা বলে—অস্ত্র জমা দিয়েছি, বাবু, ট্রেনিং জমা দেই নাই। দরকার হলে দেশ গড়ার জন্য আবার যুদ্ধ করব। যাবি তুই আমার সাথে? শান্ত বাবুর ভেতরটায় যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়ায়। নিজেকে একাত্তরের গেরিলা মনে হয়। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে মামা। বাঁ পায়ে হাঁটুর নিচে গুলির দাগ আছে এখনও। সেলাইয়ের আঁকাবাঁকা, সাদা মাছের কাঁটার মতো দাগের ওপর বাবু হাত বুলিয়ে দেয়। তার হাত শিরশির করে।            

খেজুরের গুড় জ্বাল দেয় মামি মাটির উনোনে। তাই বাড়ি জুড়ে ম ম গন্ধ। দুটো মুড়ির মোয়া খেয়ে দিঘির পাড়ে চুপ করে বসে থাকে বাবু। ঠান্ডা হাওয়ায় হলুদ পাতা ঝরে জলের ওপর। মিষ্টি রোদ্দুর। তেমন জোর নেই তো! 

পাড় জুড়ে তাল আর খেজুর গাছ কয়েকটি। গাছে বাঁধা রসের ভাড়। কাঁটার ডালপাতা দেয়া ভাড়ের মুখে। তবুও ভাড়ে ঠোঁট ডুবিয়ে কী মোহনীয় ভঙিতে রস চুষছে পাখি। সময় নিয়ে। শান্ত, ধীর-স্থির। বাবুর গলাটা টনটন করছে এখন। নির্ঘাত জ্বর এসেছে। শীত লাগছে একটু। 

মুকুল আর পম্পা বাবুর খুব বন্ধু। স্কুলের বন্ধুদের কাছে সে মুকুলের কথা বলেছে। পম্পার কথা কেন বলেনি, সে জানে না। নিজেকে কলম্বাস ভাবতে ভালোবাসে বাবু। কখনও হাকলবেরি ফিন। কোনো এক সুন্দর সকালে সে বেরিয়ে পড়বে। ম্যাপ আর কম্পাস নিয়ে। রহস্যনগরী মাচুপিচি যাবে। পম্পা আর মুকুল সাথে থাকলে ভালো।        

পম্পাকে সে ডাকে আকাশিয়া আর মুকুলকে সিন্দবাদ। সেটা ওদের দুজনের কেউ জানে না। এ প্লাস বি হোল স্কয়ার দেখলে, ব্র্যাকেটের মধ্যে আকাশিয়া আর বাবু মনে হয়। কেন? এটাও ঠিক পরিষ্কার নয়। মুকুল বাবুকে ঝিঁঝিঁ পোকা চিনিয়েছে আর পম্পা জলপিপি। পম্পা পুকুরে ঝাঁপিয়ে সাঁতরায় আর মুকুল গাছের মগডাল থেকে পেড়ে আনে পাখির বাচ্চা। বাবু এসবের পারে না কিছুই। পারে শুধু ক্রিকেট খেলতে। এবার পাখির বাচ্চা ধরাটা ভালো লাগল না বাবুর। শুধু মা পাখিটার কথা মনে হতে লাগল।

কাল দুপুরে মুকুল আর পম্পার সাথে অনেকটুকু হেঁটে গিয়েছিল। একেবারে রেললাইনের ধারে। ডানে গেলে বাজার। বামে এই শীতেও রূপচিনি নদী তাথৈ। মান্তু পাগলের ভিটে ছাড়িয়ে যেতে যেতে রেললাইন। আশেপাশে ধান কেটে নেয়া জমি। খড়বিচালি উস্কোখুস্কো পড়ে আছে মন খারাপ করে। স্টেশান আরও দূরে। না, ট্রেন দেখতে পায়নি ওরা। পম্পা কিছু নুড়ি কুড়িয়েছিল, পাঁচ গুটি খেলার জন্য।        

বাবলা গাছের নিচে ঝোপ থেকে ‘টুউব’ করে ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ল দিঘিতে আর টোল পড়ল বাবুর গালে। অজান্তে হেসে ফেলেছে সে। জলপিপি দেখে অবাক বাবু! দূর থেকে মনে হয় জলের ওপর হাঁটছে। হাঁটছে আসলে কলমিলতা বা কচুরীপানার ওপর। কাছ থেকে দেখার জন্য এগিয়ে যায় বাবু। হ্যাঁ, জলপিপিই। ডাকছে কেমন পিপ-পিপ-পিপ। যেন বাবুকেই ডাকছে। বাবু কাছে যেতেই জলপিপি উধাও। 

আর বাবু? কলম্বাসের সাথে সবে পাল ওঠাবে তক্ষুনি ক্যাঁচ করে এসে বাইক থামাল চে। আরে বাহ! মামাও এসেছে মোটর সাইকেলে। ওরা যাচ্ছে কোথায় কিছুই বোঝে না বাবু। মামার কাঁধ চেপে ধরে। ক্যানভাসের সেই কামরাঙা গাছের নিচে দাঁড়াতেই, মেঘ সরে বেরিয়ে এলো মাচুপিচু! ওরা তবে অ্যান্ডিজে! এখানেই হবে কোথাও সূর্য দেবতার মন্দির। পথের ধুলোয় সোনার গুঁড়ো ছিল এখানেই। মুকুল আর পম্পার জন্য মন  খারাপ বাবুর। ওদের ভীষণ মিস করছে। 

অ্যান্ডিজের বরফ গলে পানি বাড়ছে। মা কোথায়? মাকে ডেকে ডেকে জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে বাবু নেমে আসে উপত্যকায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার জলে থৈ কূল পায় না। পানি বাড়ছেই আর ঢেউয়ের প্রবল গতি। পানি যত দ্রুত ছুটছে, ভয় বাড়ে ততটাই বেশি। চারদিকে শুধু পানি। মা-নেই-মা-নেই ভয়ের আরও অন্ধকার অতলে ডুবতে থাকে বাবু।   
  
ডুবতে বসেছে সূর্যও। তবু পাখির রস পানের শেষ নেই। ঘরে ফেরার তাড়া নেই। বেলা ছোট হয়ে আসছে তাই বিকেলগুলোরও তর সয় না। আকাশের ফিকে গোলাপি ক্রমশ গাঢ় লাল, তারপর কিছুটা ধোঁয়াশা নীলচে। মা জানে বাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না সকাল থেকে। বাবাও তা-ই জানে। ওই তো বাবু। পাতলা চাদর পেতে মেঝেয় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ফ্যাকাশে নীলাভ মুখ, বেশ ফুলে গেছে। মা’র সেদিকে খেয়াল নেই। 

‘বাবু, বাবুউউউ...’ আমরা জেনেছি প্রতিটি ডাকের পেছনে একটি কারণ থাকেই। সে ডাকের কার্যকারিতা থাকুক কিংবা না-থাকুক। কেউ হয়তো সাড়া দিল অথবা না-দিল। ডাকের তীব্রতায় বাবুর সমস্ত রক্ত কণিকা ছুটিছুটি শুরু করবে, ফুসফুসের তরলগুলো কবোষ্ণ বাতাস হয়ে হাসবে, এমন না-ও হতে পারে।   

পাগলের মতো ছেলের গা থেকে মা খুলতে থাকে ভেজা চুপচুপে সোয়েটার। ‘ইশ!’ — মা শিউরে ওঠে— ‘ছেলেটার বড় ঠান্ডার ধাত।’ কী ভীষণ ভারী সোয়েটার! শক্ত হয়ে সেঁটে আছে বাবুর ঠান্ডা গায়ে। এক ঘর মানুষ নিশ্চুপ কাঁদছে। সম্মিলিত নিশ্বাসের উষ্ণতাও তাপমাত্রা বাড়াতে পারে না। 


‘কেমন ভিজে গেছে, দেখেছ?’ কিছু শ্যাওলার ছোপছাপ তখনও লেগে সোয়েটারে। ‘ছেলেটা একদম শীত সইতে পারে না’ — মা কাঁদো কাঁদো কিন্তু কাঁদে না। জলশূন্য এ তীব্র ব্যাকুলতা কান্নার অধিক। পৃথিবী নয় অন্যভুবনে, অজানা কোনো গভীরতর উৎসে এর জন্ম। 

সোয়েটার যেন শুষে নিয়েছে সকল উষ্ণতা। খুলে নিলেই বড় বড় চোখ মেলে তাকাবে বাবু। মায়ের চিন্তায় শুধু ভেজা সোয়েটার, সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে একটি ফিরোজা সোয়েটার। আর কিচ্ছু নেই।    

অপার্থিব সে কান্না শুনে উঠোনের প্রান্তে থমকে দাঁড়িয়েছে শীত।


• ঢাকা  

menu
menu