এপ্রিলের রাইফেল—২০১৪

আমার একটা মোটা নোট খাতা ছিল। চামড়ার খয়েরি প্রচ্ছদে আঁটসাঁট বাধাই করা। গোটা গোটা ইংরেজি হরফে আমি সেটায় আমার পেশেন্টদের যাবতীয় বিত্তান্ত লিখে রাখতাম। তখন সবে মাত্র পিএইচডি শেষ করে আমি দেশে ফিরেছি। অনেকের নিষেধ উপদেশ সত্ত্বেও সাহস করে ইস্কাটনে দুই কামরার একটা চেম্বার নিয়ে প্রেকটিস শুরু করি। ঢাকায় তখন যেকোনো মনরোগ বিশেষজ্ঞের জন্য বাজার ছিল প্রায় ক্লোজড ডোর। সারা মাসে আমি পেশেন্ট পেতাম মাত্র আট থেকে দশ জন। কোনো কোনো মাসে তারও কম। অধিকাংশ পেশেন্টই আমার বন্ধু পরিচিতজন আর আত্মীয়-স্বজনদের কল্যাণে।

প্রত্যেক পেশেন্টের নাম বয়স পেশা এবং রোগের বিত্তান্তসহ খুঁটিনাটি এমন অনেক কিছুই খাতাটায় লিখতাম যা হয়তো একজন ফিকশনিস্টের লেখার কথা। লেখার ভাষা ছিল সাইকো এনালাইসিজ এর ছকবাঁধা থিওরিকে যদ্দূর সম্ভব পাশ কাটিয়ে অনেকটা সহজ-বোদ্ধ কৌতূহল উদ্দীপক সরস গল্পের ধাঁচে। আমি চেয়েছি ডাক্তারি প্রয়োজনের বাইরেও সে লেখার যেন একটা আলাদা আবেদন থাকে।

আমার ছিল তখন একটা কল্পনাপ্রবণ তরুণ মন। এবং বিস্তর অবসর। নোট খাতাটা লিখে শেষ করে সেটা দিয়ে একটা বই করারও গোপন ইচ্ছে ছিল। অনেক ভেবে চিন্তে জবরদস্ত একটা নাম পর্যন্ত ঠিক করে রাখি-দ্য ব্ল্যাক ডে’স এন্ড হোয়াইট নাইটস। প্রত্যেকটা সমস্যার গল্প লেখার পর আমি সেটা বারবার পড়তাম। সে সমস্যাটির ভেতর দিয়ে নিজের সময়, মানুষ, মানুষের বাহির আর ভেতরকার দৈর্ঘ্যপ্রস্থের পরিণতিকে নিজের মতো করে সেলাই করতাম একটার সঙ্গে অন্যটার। কখনো একদিক থেকে কখনো একসঙ্গে চতুর্দিক থেকে। নিজেকে আমার তখন বেশ জয়েস জয়েস মনে হতো।

সে সময়কার পেশেন্টেদের সমস্যাগুলো অতটা বিচিত্র কিংবা জটিল ছিল না। কারও হয়তো স্বাস্থ্য খারাপ বলে তিনি লোকজনের সামনে হীনমন্যতায় ভোগেন। কারও বাবার মৃত্যুর স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। কারও বা রাতে ঘুম হয় না; হলেও দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে যান ইত্যাদি। জটিল পেশেন্ট পেতাম কালেভদ্রে। অবশ্য সোজসাপ্টা ছোটখাট সম্যাগুলোও আমি চেষ্টা করতাম অতি যত্নের সঙ্গে চিকিৎসা করার।

হলো না, অনেক সুতোকাটা স্বপ্নের মতন নোট খাতাটাও শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রয়ে গেল। দিনে দিনে আমার নাম, বয়স, অভিজ্ঞতা এবং ব্যস্ততা বাড়ল। বাড়ল চেম্বারের ভাড়া, বাজারের খরচ, পরিবারের সদস্য। রোগীদেরও বাড়ল সমস্যার জটিলতা আর মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে ধর্না দেওয়ার দরকার। লাফিয়ে লাফিয়ে আমার ফি কয়েক দফায় বেড়ে ভালো একটা অঙ্কে গিয়ে ঠেকল। অবসর কমে যেতে যেতে প্রায় হয়ে গেল শূন্য। অনেকবার অনেক রকমের চেষ্টা করেও নোট খাতাটার সঙ্গে আর মন বসানো গেল না।

অনেক পরে এসে বুঝতে শিখেছি—হয় না, এক জীবনে এমন অনেক ঝাঁ-চকচকে আবেগ আর রঙ উপচানো স্বপ্ন থাকে-যা, দীর্ঘপথ ব্যাপী সঙ্গী হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত নানান অজুহাতে হয়ে ওঠে না। মাঝ পথে আশ্চর্যজনকভাবে খোয়া যায়। মায়াবী-মধুর জাঁকালো ডালপালাগুলো নির্মমভাবে ছেটে না ফেললে মূল কা-টি যে সুষ্ঠু-সুন্দর মতন বেড়ে ওঠে না তা বুঝতে কী আর জগদীশ বসু হতে হয়?

সম্প্রতি আমার পেশেন্টরা একেকজন এমন একেকটা অদ্ভুত আর জটিল সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছেন যা আমার মতন ব্যস্ত পেশাদারকেও মাঝে মধ্যে কি না কি সব ভাবাতে নিয়ে যায়। ভাবতে অবশ্য আমি এখনো একদম অরাজি নই। তবে ঠিক ততটুকু, যতটুকু সমস্যাগুলোর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে বাঁধা। মাদক মথিত তারুণ্য, উৎকণ্ঠার মধ্যবয়স, অতলান্ত বার্ধক্য, দাম্পত্যের নিস্পৃহা, নিগ্রহের বেকারত্ব, পারিবারিক ভাঙন-উপদ্রুত শৈশব, ভয়, বিচ্ছিন্নতা, পরাজয়, স্বপ্নহীনতা, আত্ম-হনন, অনাস্থা, একাকিত্ব ইত্যাদি আরও কত কত রকমের অসহায়ত্বের ভাড়াটে কান্ডারির ভূমিকায় আমাকে রোজ রোজ অভিনয় করতে হয়। এরপর যদি আবার ভাবতেও বসি তাহলেই সেরেছে।

সমস্যাগুলোর সারগল্প নিয়ে মাঝে মধ্যে মনে হয় দারুণ কিছু সিনেমা বানানো যেতে পারে। কল্পনাপ্রবণ আমার সে তরুণ মনটি এখনো বেঁচে থাকলে হয়তো আমিই নেমে পড়তাম। তা অবশ্য বলে কাজ নেই। সে মনটিও যেমন নেই সময়ও নেই। সময় আমার এখন মিনিট-ঘণ্টা-দিন-মাস-বছর ধরে ধরে পা ফেলে; ক্রমবর্ধনশীল আয় আর ব্যয়ের পায়ে পা দিয়ে। আমি আছি এখন সম্ভবত ফ্রেমবন্ধি একটা ফটোগ্রাফের মতন। সকালে যেরকম দুপুরেও সেরকম, রাতেও সেরকম, ভোরে, পরেরদিন, পরেরদিন, প্রতিদিন—একই  রকম বরফজমাট।

মাস কয়েক আগে আমার এক পেশেন্ট আমাকে একটা ভিন্ন ধরনের সমস্যার স্বাদ দিয়েছিলেন। এত ব্যস্ততা আর পেশাদারিত্বের ভেতরেও ব্যাপারটা আমাকে বেশ বাজিয়েছে। মনে খানিকটা স্বস্তিও হলো। যাক, সবাই অন্তত আমার মতন বেরসিক আর গৎবাঁধা হয়ে যায়নি।

ভদ্রলোক চল্লিশোর্ধ, লম্বা এবং সুঠাম সাস্থ্যের অধিকারী। পেশায় বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্র্মকর্তা। তারা তিন কলিগ-বন্ধু নিয়মিত মদ আর বিভিন্ন বয়সী নিশি কন্যাতে দীর্ঘ দিন থেকে আসক্ত ছিলেন। মদটা তারা বাসা-বাড়িতে ঢাক-ঢোল করেই চালাতেন। দ্বিতীয়টা চালাতেন সযত্নে সবার অগোচরে। তিনজনই বিবাহিত এবং কয়েক সন্তানের পিতা। তারা সংসার চাকরি বন্ধুত্ব এবং ওসব করে মোটের ওপর খুশি ছিলেন।

একদিন তিন জনের মধ্যে যিনি ওসব কাজে সব সময় অতি উৎসাহি তিনি বাকি দুজনকে প্রস্তাব করলেন—একটা  নতুন আইটেম করলে কেমন হয়? বাকি দু’জন কৌতূহল দেখালে উৎসাহী বন্ধুটি জানালেন তারা তিনজন এভাবে এলোমেলো তো অনেক শুয়েছে, সেই তো একই ঘটনা। একবার একটু টেস্ট চেঞ্জ। একসঙ্গে তিনজন একই বিছানায় একজন তরুণীর সঙ্গে একবার লড়ে দেখলে কেমন হয়? বাকি দুজন ছি ছি করে উঠলেন। এসব ব্যাপার এমনিতেই ভালো নয়, তার ওপর আবার তিনজন পুরুষ একসঙ্গে একটা মেয়ের সঙ্গে? না না এ মোটেও ভালো  দেখাবে না।

বেচারা উৎসাহী বন্ধু বাকি দুজনকে রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করলেন। বেশ ক’টা চিত্তাকর্ষক ভিডিও দেখালেন। নিজের অন্যদিককার কিছু ব্যবসায়ী বন্ধুর এমন দুর্দান্ত কীর্তির গল্প রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করলেন। ঘটনাটার তাপমাত্রা, থ্রিল, নতুনত্ব ধরে ধরে ব্যাখ্যা করলেন। তারা তবু রাজি হলেন না। উৎসাহী বন্ধুর উৎসাহে এরপর যে একদমই ভাটা পড়ে গেল এমন নয়। সময় সুযোগ মতন তিনি আড্ডায় মদের আসরে কিংবা নিশিকন্যাদের নিমন্ত্রণের আগে পরে; আকারে ইঙ্গিতে ওই ঢিলটি ছুড়েই গেলেন।

খুব বেশিদিন তাদের প্রতিরোধ ওই বন্ধুর প্ররোচনার মুখে টিকে থাকতে পারল না। দাম্পত্য, পেশাগত আর প্রথাবদ্ধ সকল একঘেয়েমির বিরুদ্ধে তারা আলাদা একটা স্বাদ নিতে শেষ পর্যন্ত একদিন রাজি হলেন। কিন্তু ভেতরের সংস্কারকে একেবারে ভুলে থাকা সম্ভব হলো না। মনের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা, লজ্জা এবং উত্তেজনা কাজ করল। তারা তাই আগেই ঘোষণা করলেন ঘটনাটা এই একবারই হবে। দ্বিতীয়বার এমন কিছুর কথা মুখেও আনা যাবে না।

তিন জনের একজনের খালি বাসায় গোপন অনুষ্ঠানটির আয়োজন হলো। ষোড়শী একজন তরুণীকে চড়া পেমেন্টে নিয়ে এলেন সেই বন্ধু। তারা মদ পান করলেন এবং অল্পকিছুক্ষণের মধ্যে সকল দ্বিধা সংকোচকে অতিক্রম করলেন। তরুণীটি দারুণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো। তাদেরকে যৌথ লীলার কয়েকটি সুবিধাজনক কায়দা সে হাতে কলমে শিখিয়ে দিল। ভদ্রলোকের ভাষ্য অনুযায়ী সেদিন তারা সত্যিই এক রোমহর্ষক পুলকের খোঁজ পেয়েছিলেন।

দিন কয়েক বাদে দাবার ঘুটি গেল উল্টে। এবার এরা দুজন হয়ে গেলেন অতি উৎসাহী। যিনি আগে প্ররোচিত করতেন তাকেই উল্টো এরা তাড়া দিচ্ছেন। আবার চাই, আবার, আবার। তিন জনের সময় সুযোগ একসঙ্গে করা, নিরিবিলি-নিরাপদ স্থান, প্রণয়িনীটির বন্দোবস্ত সব মিলে একটি আয়োজন তাদের জন্য বেশ সময় সাপেক্ষ। তাদের প্রবল আগ্রহের তোড়ে তবু মাসে—পনেরদিনে একবার করে আসর বসতে লাগল।  তারা তিনজন চেনা পুরুষ আর প্রতি আসরে একেকজন করে বিভিন্ন বয়সের নারী তাদের জন্য বয়ে আনল শর্তহীন আনন্দের বিরল সম্ভার।

উৎসাহী বন্ধুটি খবর দিল তাদের সঙ্গে এই অচেনা বিনোদনে তার চেনা—জানা আরও দু’একজন যোগ  দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাকি দু’জন তাতে ঘোরতোর আপত্তি জানালেন। ব্যাপারটিকে একটা নিজস্বতার বাইরে নিয়ে যাওয়াকে তারা বিকৃতির লক্ষণ বলে সিদ্ধান্ত দিলেন। উৎসাহী বন্ধুটি এদিকটায় আর বাড়লেন না। নিত্য নতুন ছন্দ-কলায় পটিয়শী পেশাদার সঙ্গীনী জোগাড়ে তিনি নিজের একের পর এক সফলতায় মনযোগ দিলেন।

আচমকা একজনের বদলির হুকুম এলো। তড়িৎ বদলি। গোপন আনন্দের বন্ধনে বেজে উঠল ভাঙনের বিউগল। তিনজনের চেষ্টায়ও সে বদলি ঠেকানো গেল না। নিরবিচ্ছিন্ন সুধা-মাধুর্যে পড়ল অনাকাঙ্খিত ছেদ। তিন জনের জায়গায় দুজন হয়ে যাওয়ায় ব্যাপারটায় আগের উদ্যম-উল্লাস কাজ করল না। ছেদের সুযোগ নিয়ে বরং কীভাবে কীভাবে যেন ঢুকে পড়ল সনাতন বিবেকের কাল সাপ। ভদ্রলোকের মনে পড়ল তিনি তার বিশ্বস্ত স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। দিনের পর দিন দাম্পত্যকে কলুষিত করেছেন। পারিবারিক সুস্থ-সুন্দর আবেগের প্রতি করেছেন ভীষণ অবিচার। এখন ফিরতে চান। সাদামাটা বিশ্বাস আর পুরনো জীবনের সরল চৌকাঠে। কিন্ত ওই যৌথ লীলার ঝাঁঝালো নেশাটি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। সুতরাং চিকিৎসা চাই।

এ মাসের গোড়ার দিকে একজন পেশেন্ট পেলাম যিনি আমাকে বেশ বিপদেই ফেলে দিলেন। বয়সে ইনি একদম কাঁচা। মাত্র ইউনিভার্সিটি পাশ করে একটা চাকরিতে ঢুকেছেন। চেহারা ছবিতে জ্বলজ্বল করছে তরতাজা তারুণ্য। চাখে-মুখে-কণ্ঠে গোপন একটা উদ্বেগ ছাড়া সবই মায়াকাড়া। আমি যখন নাম, বয়স, পেশা ইত্যাদি জিগ্যেস করছিলাম তখন না কামানো দু’তিন দিনের দাড়ি গোঁফের ভেতর খেলা করতে দেখলাম নীরব আতঙ্ক। চোখ বরাবর তাকিয়ে আমি পেশাদারি নির্ভরতার হাসি হাসলাম।

স্যার, আমি এইতো সেদিনও বেশ ভালোই ছিলাম। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতাম। নাস্তা করে দাড়ি কামিয়ে সোজা অফিসে চলে যেতাম। অফিসে কাজের খুব একটা চাপ নেই। নিজের কাজ শেষ করে পারলে আমি অন্যদের কাজেও সাহায্য করি। কেউ আড়ালে আমাকে নিয়ে প্রশংসা করলে আমার মন্দ লাগে না। সন্ধ্যার আগে আগে চলে যাই বন্ধুদের আড্ডায়। আড্ডা শেষে রাত নয়টা নাগাদ বাসায় ফিরি। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে পরদিনের অফিসের কথা মাথায় রেখে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। এ হলো আমার গড়পড়তা লাইফ স্টাইল। মাস খানেক আগে একদিন আমি অফিসে যাওয়ার জন্য বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। বাস আসতে দেরি হচ্ছিল। হঠাৎ দেখলাম রাস্তার বিপরীত দিকে আট তলা বিল্ডিংয়ের ছাদে ইউনিফর্ম পরা এক লোক আমার দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বুকটা ধ্বক্ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেললাম। ভুল দেখলাম না তো  ভেবে আবার মাথা উঁচু করে তাকালাম। না, ভুল নয়। আমি নিজের অজান্তেই দুই পা সরে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেলাম। তখন হুইসেল বাজিয়ে বাস চলে এলো।

সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আমি বাসের ভেতর থেকে দেখলাম ফুট ওভার ব্রিজের ওপর থেকে ঠিক ওরকম একজন বাসের দিকে রাইফেল তাক করে আছে। বাস তখন সিগনাল জটে আটকা। আমি আমার সহযাত্রীদের খেয়াল করলাম। তারা সবাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। একজনকে আমি আঙুলের ইশারায় দেখালাম। সে তেমন গুরুত্বহীন ভাবে বলল সে কোনো ইউনিফর্ম পরা রাইফেলধারীকে দেখছে না।

পরদিন থেকে আমি যেখানে সেখানে এমন একজনকে দেখতে লাগলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেছি-সেখানে, ছুটির দিনে বেড়াতে গেছি-সেখানেও। এমন কি গ্রামের বাড়িতে গেছি; দেখি আমাদের বড় দিঘিটার ওই  পারে ঝোপের ভেতর থেকে একজন কেউ রাইফেলের নল উঁচিয়ে আমাকে টার্গেট করে আছে। দৌড়ে গেলাম। দেখি ঝোপের মধ্যে কেউ নাই। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম। এবার অন্য পার থেকে রাইফেল ধরল।

জানেন স্যার, আমি নিজেও সামান্য সাইকো ডিজিজ নিয়ে বই পুস্তক ঘেটেছি। এটা যে একটা হাইপার হেল্যুসিনেশন তা বুঝতে পারি। কিন্ত হঠাৎ হঠাৎ কেমন গা কাঁটা দেওয়া ভয় এসে কাবু করে ফেলে। আমি রাতে ভয়ঙ্কর স্বপ্নও দেখছি সেই থেকে। সবগুলোতেই ইউনিফর্ম পরা রাইফেল হাতে কেউ একজন থাকেই।

—আজ যে আপনি আমার এখানে এসেছেন পথে তেমন কাউকে দেখেছেন?

—হ্যাঁ দেখেছি। তিতাস টাওয়ারের কার্নিশে দেখেছি।

—আপনি কি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত?
একদম না।

—ছোটবেলায় পুলিশ নিয়ে কোনো ভয়ের স্মৃতি আছে?

—না। 

—কখনো কি এমন কোনো ক্রাইম করেছেন যার জন্য আপনার নামে  মামলা বা আপনার জেল খাটার সম্ভাবনা আছে?

—না।

—কোনো অসামাজিক কাজ? 

—না।

তাকে প্রায় আধ ঘণ্টা যাবৎ প্রশ্ন করলাম। কিছুতেই কিছু মিলল না। সাধারণ ট্র্রিটমেন্ট আর কাউন্সেলিং করে পরের সপ্তায় দেখা করতে বললাম। সে কিছুটা বিষণ্ন মনে চলে গেল। অনেক্ষণ যাবৎ ছক কষেও আমি কোনো সূত্র মেলাতে পারলাম না। কিছু কমন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার কিংবা সোসিও-ইনসিকিউরিটি ফোবিয়ার মধ্যে সমস্যাটাকে ফেলে এগুলো হয়তো কিছুটা ফল পাওয়া যেতেও পারে। মুশকিল হলো এ সমস্যা একদম নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা কম। সমস্যাটার গোড়া মনে হলো অন্য কোথাও।

কিছু বই পুস্তক এবং জার্নাল এদিক-ওদিক ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। আমার বিশেষজ্ঞ বন্ধুর সঙ্গে ফোনে আলাপ করলাম। সে ফোবিয়া ডিজ অর্ডারে বেশ দক্ষ। লাভ হলো না। গোড়া থেকে পুরো কেসটাকে আবার কয়েকবার তদন্ত করলাম। কোথাও কোনো ক্লু পাওয়া গেল না। আমার প্র্যাকটিসের ক্যারিয়ারে এরচেয়ে জটিল জটিল কেস আমি অনেক সামলেছি। এটি নিশ্চয়ই জটিল নয়। কেবল একটা কোনো সূত্র পেলেই  হলো। আমি একটু একটু করে ভাবনার পুরনো মাকড়শার জাল বিস্তার করার চেষ্টা করলাম।

পরের সপ্তায় সে যথারীতি আরও আতঙ্ক বয়ে নিয়ে এলো। আমি তার জন্য একগাদা প্রশ্ন তৈরি করে রেখেছি। একের পর এক প্রশ্নগুলো করলাম। কিন্ত তাৎক্ষণিক কোনো ফল মেলাতে ব্যর্থ হলাম। তাকে নিরুদ্বিগ্ন ঘুম আর সকালে কিছু ব্যায়াম করার পরামর্শ দিলাম। পরবর্তী সময়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলাম তিন দিন পর।

চেম্বার শেষ করে তার উত্তরগুলো নিয়ে রাতে বসলাম। দেখলাম, দিনের মধ্যে তার বেশির ভাগ সময় কাটে ফেসবুক এবং ইন্টারনেটে। সেখান থেকে সে সারা দুনিয়ার খবর জেনে নেয়। দেশে কখন কী হচ্ছে না হচ্ছে—তার  খবরও সে রাখে নিয়মিত। এবং হত্যা, গুম, অপহরণ, লুটপাট, চালবাজি, রাজনৈতিক দুর্বিত্তায়ন ইত্যাদি তাকে নাড়া দেয়, আহত করে, আতঙ্কিতও। তখনই আমার মনে হলো একটা পথ মনে হয় আমি পেতে যাচ্ছি। গত দু’তিন মাসের পুরনো খবরের কাগজগুলোর চাঞ্চল্যকর খবর গুলোয় চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। নিজের অজান্তে ঠোঁটের কোনে আমার সামান্য একটা হাসি খেলে গেল। রাত তখন এগারোটা অতিক্রম করেছে। আমি তার নাম্বারে ফোন করলাম। বললাম, দুঃখিত আপনাকে একটা জরুরি প্রশ্ন করার জন্য এত রাতে ফোন করতে হলো। আপনি কি বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিজে যা বিশ্বাস করেন তা রাখ-ঢাকহীনভাবে প্রকাশ করেন? যেমন ধরুন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা স্পেশাল কিলার ফোর্স গুলোর বিরুদ্ধে ব্লাড সাইন?

হ্যাঁ তাতো প্রায়ই করি।

ওকে, দ্রুত সব ডিলেট করে দিন। আপাতত সকল রাজনৈতিক ইস্যুতে আপনার চোখ-মুখ-চিন্তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখবেন। এবং কোথাও কোনো ধরনের খবর পড়া যাবে না, দেখাও যাবে না। ইটস এ ব্ল্যাক মুন ফর য়্যু। পরশু আসার সময় খেয়াল করবেন ভয় বা রাইফেল আগের মতোই আছে কিনা। গুড নাইট।


• নোয়াখালি

menu
menu