বিড়াল

‘Wish a safe life for all the cats in the world.’ 

সকালে ঘুম থেকে উঠেই পোস্টটি চোখে পড়লো। একটি মেটে রঙয়ের বিড়ালের ছবি—রিস্টপুষ্ট, বড় আর কান খাড়া, পাশে পৃথিবীর মানচিত্র। যেন বিনয়ের সাথে মনে করিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবীটা শুধু মানুষের না বিড়ালেরও! 

নভেরা তার সাময়িক প্রোফাইল পিকচার করেছে। ওর যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করে। উপরে নিচে লেখা  August 8 is world cats day. নিশ্চয় দুধ-কর্নফ্লেক্স, কড়কড়ে মাছভাজা ইত্যাদি সব দিয়ে ও বাসার পোষাটাকে সেলিব্রেটও করেছে। কুইবেকের হিমশীতল ঠান্ডায় মেয়েটি এতো প্রাণবন্ত থাকে কেমন করে ভাবতে ভাবতে দিন কেটে গেলো। কি গ্রেট হার্ট! সত্যিই বিড়ালের মতোই  তুলতুলে, পেলব, রহস্যময় ও মায়াবী ওর হৃদয়!

এদিকে বিকেলেও শহরজুড়ে লোডশেডিং। আজকাল এটা ঠিক প্রত্যাদেশের মতো মাথায় চেপে বসে। গরম হাওয়ার ভ্যাপারে শহর অবরুদ্ধ প্রায়। তবু ব্যতিব্যস্ততার কমতি নেই। নোনভেজা মানুষেরা ক্লান্ত মাছির মতো এদিক ওদিক করছে। ওদের দলে আমিও এতক্ষণ ছিলাম। আমার পোড়া চামড়ায় রসালো নুনের নহর বইছিলো বেশ করে। মনে হচ্ছিলো যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই চামড়া ফুঁড়ে ভেতরে হাড়মাংসে ঢুকে যাবে সহজে। চোখের পাতা ক্লান্তিতে নুয়ে পড়তে লাগলো। তাই বাইরের দুনিয়া থেকে শেষমেষ নিজেকে সরিয়ে নিলাম। 

এ মুহূর্তে আমি বেশ কাহিল। মাথাটা ঠিক কাজ করছে না, করার কথাও না। শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক ভাবনাগুলো যে যার মতো বলগাহীন ছুটছে। আমার যা অবস্থা তাতে বলা যায়, রাবো’র ‘নরকের ঋতু’র মতো অভিশপ্ত প্রহর পার করছি। এ শহরের শীতল মৃদুমন্দ হাওয়া আজ বিরতিহীনভাবে উধাও। যাবতীয় ভারে ন্যুব্জ আমাদের নিচতলার বাসাটি এখন তন্দুর রুটি ঝলসানো চুলার মতো তাপ ছড়াচ্ছে। উপরের তিনটি তলার নরকসম্ভার বুঝি এখানেই পগার পার দেয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে ঘাম মুছা এবং কষ্টের জন্য বিলাপ করা ছাড়া আমার আর করণীয় নেই। আমার স্ত্রী এয়ার কন্ডিশন নেই বলে তাঁর মন্দভাগ্যের মাতন করেই চলছে। তাঁকে থামানোর সাধ্য আমার কোথায়! অবশ্য নুন ঝরতে ঝরতে সে-ও যখন ক্লান্ত, তখন প্রলাপে ক্ষান্তি দিলো। 

সম্ভবত তাকে খুশি করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ রূপ বদলালো। এখন আমাদের মাথার উপর ঘন মেঘ। কোথা থেকে এসে হাজির হলো কে জানে! মেঘেদের মতো এমন উড়নচণ্ডী, ভবঘুরে আর হয় না! 

দেখতে দেখতে পড়ন্ত গোধূলী। যেমন করে মানুষও তার বয়সের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে যায় আর কি! একটা কিছুর জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, যেমন অপেক্ষা করতে হয়। সেটা বিদ্যুতও হতে পারে, অন্যকিছুও হতে পারে। ব্যাপারটা ঠিক বেকেটের ‘হ্যাপি ডেজ’-র মতো—যার পুরো অঙ্ক জুড়ে আশার সূর্যটা ঘন মেঘের আড়ালে আর্তনাদ করে। কখন, কবে সূর্যটি রাহুমুক্ত হয় এটি সত্যিই একটি অনিশ্চিতি। অন্তত, আমাদের এই প্রাচ্যদেশীয় স্যাঁতস্যাতে জীবনে এমন করেই দিন কাটে। আশাবাদ বা কথা চালাচালি করেই আমরা এখানে গুটিপোকার মতো দিন পার করছি।  

একটু আগের পরিস্থিতিটা দেখতে দেখতে বদলে গেলো। এখন শীতের লু হাওয়ার মতো খানিকটা শীতল হাওয়া বইছে। দারুণ আশাবাদী হওয়া! বিশ্রী একটা জট পাকানো অবস্থা থেকে এখন আমাদের মনে খানিকটা প্রশান্তি এলো। তবে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই জুনের এই দীর্ঘ আকাশে ঘনিয়ে এলো সাততাড়াতাড়ি অন্ধকার। এখন আমরা মাথার উপর একটানা ছিপছিপে বৃষ্টিশলাকা বহন করছি। 

রাতে আবারও লোডশেডিং। এবার দীর্ঘকালীন হবে মনে হচ্ছে। আফসোস করলাম কেন মোবাইল ফোনটি চার্জে দিয়ে রাখলাম না। যা ভেবেছিলেম ঠিক তাই। দীর্ঘ হলো অন্ধকার। মাঝরাত পর্যন্ত একনাগাড়ে বৃষ্টি। তবে ভগ্নহৃদয় নারীর নাকিকান্নার মতো বিরতিহীন হালকা মাতন। মনে হলো অশরীরী কোনো প্রেতিনীর প্রলুব্ধকর আহ্বান। প্রাগৈতিহাসিক অরণ্য থেকে ডাকছে, মানুষ ধরার ফাঁদ পেতেছে সে মোহনীয় সুরে। অস্থির করে তুলছে জনপদ। ধেৎ, সেই যুগ কবে চলে গেছে, ওসবে আর আমি মোটেও ভীত না। 

বিছানায় এলিয়ে পড়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকলো না। অন্ধকারে হাতড়িয়ে কোনোমতে মশারি টানিয়ে শুয়ে পড়লাম। বলতে দ্বিধা নেই, ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার আগে একমনে চারপাশের শব্দ কানে তোলা আমার প্রাত্যহিক অভ্যাস। 

২.
নিঝুম অন্ধকার ঘর। বৃষ্টির ছাট তীরের ফলার মতো মাটিকে গেঁথে চলছে। তার অবিরাম শব্দ কানে হু হু করে জমা হচ্ছে। অন্ধকার আর বৃষ্টি মিলে চারপাশের সবকিছু আচ্ছন্ন। শুয়ে কান পেতে আছি। বৃষ্টির শব্দ হালকা হতেই অন্য আর একটি শব্দ এসে ভিড়লো। দুর্বল অথচ এমন যে, না শুনে উপায় নেই। মৃদু বুদবুদ তোলা সেই স্বর বাতাসে বারবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হয়তো বারান্দার ওপাশে পূবদিকের কোনো প্রান্ত থেকে। ওদিকে রাস্তাসংলগ্ন মাটিতে ফিনফিনে লম্বা মেহেদি, অর্কিডের হালকা ঝোপ। ওখান থেকেই হয়তো শব্দটা আসছে। 

হ্যাঁ। শব্দটি তো ওদিক থেকেই আসছে! কি আর করা, চুপচাপ কান লাগালাম। ততক্ষণে অন্ধকারে সব মিশে গেছে। এখন আমার শারীরিক অবয়ব বলে কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে আমি নিজেকে এভাবে মমির মতো অসহায়ভাবে সমর্পণ করতে পারি না। আর শব্দটিরও একটা বিহিত করা দরকার। বিছানায় উঠে বসে আড়মোড়া কাটলাম যেন নতুন করে প্রমাণ করা যে, আমি এখনও মমি বা হলোম্যান হয়ে যাই নি। আমি তো বাইরের পৃথিবীর শব্দ শুনতে পাচ্ছি!

একটানা কাতর আর্তনাদ, অস্পষ্ট তবু বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সেই করুণ দুর্বল স্বর আমাকে বিচলিত করে তুললো। আমি তো একটু স্বস্তি ও ঘুমের কথা ভাবছি! তার মানে আজ রাতে আমার জন্য আরও দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে! বিরক্তিতে কাতরে উঠলাম। মনযোগ সরানোর জন্য ডানে বায়ে পাশ ফিরলাম। নিজের চিন্তার জগতটাকে ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করাই উত্তম। এক্ষুণি চারপাশের সবকিছু ভুলে যাবো। আমি তো আমার ইচ্ছার ক্রীতদাস না। এমনকি একটুও ভাবার চেষ্টা করবো না যে বাইরের জগৎ বলে একটা কিছু আছে। আর তা প্রগৈতিহাসিক না ইতিহাস বর্জিত, শব্দময় না নিশ্চুপ, কালো না জ্বলজ্বলে, বৃষ্টিময় না রোদেলা, জোৎস্নাপ্লাত না অমানিশা তাতে আমার কী আসে যায়! 

হ্যাঁ, এই তো আমি পারছি একটু একটু করে নিজেকে সরিয়ে নিতে... 

শেষমেষ আমার সব প্রচেষ্টাই ঠুনকো খেলনার মতো ভেঙে পড়লো। আচমকা ভাবলাম, ইস্, আমি কী বোকা! আজ রাতের ইঙ্গিতটাই আমি বুঝতে পারি নি। ওটা নির্ধারিত এবং ধারালো। কোনোকিছুই ওটাকে নিবৃত্ত করতে পারে না। ওর সাথে আমাকে বোঝাপড়া করতেই হবে। পেতে দিতে হবে একটি লম্বা মই যা বেয়ে ওটি এখন আমার কানে জায়গা করে নিবে। 

আগন্তুক শব্দেরা হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকলো। ভাবলাম, আসছেই যখন, আমার তো অন্তত এই চেষ্টাটি থাকা উচিত—ওটার সাথে পরিচিত হওয়া। চেষ্টা করতেই আমার বাকি ঘুমটা পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম  হলো। কষ্টে ডুকরে উঠলাম। আহা রে, আমার অসহায় বেচারি! তবে ভয়ে খানিকটা গা-ও শিউরে উঠলো। ভয়টা লাগতো না যদি এলেন পো’র কালো বিড়ালটির কথা মনে না পড়তো। কিন্তু এখানে ঐ রকম ভয়ানক কিছু হওয়ার কথা না। কিন্তু হবে না যে, তাই বা বলি কীভাবে? আর সেটি কালো না সাদা তা কি আমি নিশ্চিত? তবে যাই হোক আমার পক্ষে তাকে ফুঁসলিয়ে হত্যা করা অসম্ভব। পরক্ষণে ভাবলাম অসম্ভবই বা কোথায়! আমি এমন এক সময়ের মানবরত্ন যখন মানুষ নির্বিচারে আরেকজন মানব সন্তানকে প্রকাশ্যে জনবহুল রাস্তায় কুপিয়ে কুচি কুচি করে ফেলছে। তবে এসব ছাইপাশ ভাবনার মাঝেই হ্যালি বেরির ‘ক্যাটস ওমেন’ ছবির দৃশ্যগুলোও চোখে ভাসতে লাগলো। সেখানে বিড়ালই তো মহাশক্তিধর। হ্যালি বেরির কেমন কাটা কাটা চাহনি, ক্ষিপ্রতা, সাদা চুলের মাথায় কালো সুন্দর শক্তিশালী মুখটা থেকে আত্মবিশ্বাস আর কাম-লাবণ্য গলে পড়ছে টুপটাপ করে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে কালো অসহায় মেয়েটির বিড়ালের বর পাওয়ার পর। সুতরাং বিড়ালটির অসহায় হওয়া অসম্ভব।   

৩.
শব্দটি আসছে ব্যালকনির বাইরে পূর্বপাশ থেকে, যেখানে ওকে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর বৃষ্টি না হলেও দেখতে চেষ্টা করতাম কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। এমন ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকটা সময় পেরোলাম। এমনও ভাবলাম ওকে নিয়ে টান টান উত্তেজনায় ভরা একটি গল্প তো অনায়াসে লিখে ফেলতে পারি। পাঠকরা নিশ্চয় এটা বেশ উপভোগ করবে। আর বাস্তবে যাই ঘটুক গল্পের মধ্যে দিয়েই ওটাকে সাহায্য করা হয়ে যাবে। ওটা অমরত্ব পাবে। 

একদিকে আমি যখন এমন ছাইপাশ ভেবে দার্শনিকগিরি করে সময় কাটাচ্ছি তখন তার নিজেকে নিয়ে জোর লড়াই চলছে। ওর জানটাই বুঝি যায়! আমার বোধোদয় হলো, এমন পাগলামির কোনো মানে হয় না। 

ওটা কি কোথাও আটকা পড়েছে? তাহলে তো সারারাত ওকে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। জমা পানিতে হাবুডুবুও খেতে হতে পারে। আবার ভয়ানক কোনো বিপদে পড়ে থাকলে প্রাণটাও যাবে। হয়তো ক্ষুধায় কাতর হয়েও এমন আর্তনাদ করতে পারে। ক্ষুধার বিষয়টিও কম গুরুতর না। এ পৃথিবীতে খাদ্য আসলেই পরম কাঙিক্ষত। কিন্তু, ফাঁদে বা ক্ষুধায় যাই হোক কে ওকে অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজে উদ্ধার করতে যাবে? বরং যদি সকাল পর্যন্ত নিজেকে সে টিকিয়ে রাখতে পারে তখন ভিন্নকথা। এ পর্যন্ত উপসংহার টেনে আমি ওটার কান উপড়ানো আর্তনাদ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। আহা, আমি কী হৃদয়হীন সুখী বেচারা! 

৪.
পরদিন সকালে উঠেই হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুললাম। একনাগাড়ে ডেকেই যাচ্ছে। তবে শব্দটা এখন খুবই দুর্বল। সম্ভবত ক্ষুধায় ক্লান্তিতে এতোক্ষণে ভয়ানক কাহিল হয়ে পড়েছে। ওকে উদ্ধার করে কিছু খাবার দেয়া দরকার। তাছাড়া ওটিকে দেখাও তো প্রয়োজন—সত্যি সত্যি ওর রঙ কালো কিনা!। যদিও কালো মায়ের ছানার রঙও সাদা হতে পারে। 

একটুকরো রুটি হাতে ছিঁড়ে নিয়ে আমি ওকে খুঁজতে লাগলাম। ওই তো! এতো ছোট! রাতে কল্পনাতেও আসে নি! কী ভয়ানক নির্মমতা! এটাই কী সারারাত থেকে কাতরে যাচ্ছে! গলাটা কি ওর ফানা ফানা হয়ে যায় নি! আহা, আমি এত নির্মম! 

ওটা গ্যারেজের কোনায় রাখা মোটর সাইকেলের নিচ দিয়ে ওটা হাঁটাহাঁটি করছে। সাদা। পুতুলের ঘোলা পুতি চোখের মতো চোখ বিঁধিয়ে আমার দিকে তাকালো সে। দেখেই শব্দ বাড়িয়ে দিলো। হয়তো আক্রমণের আশঙ্কায়। রুটির টুকরোটি রেখে আমি ওকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাতে চেষ্টা করতে থাকলাম যে, আমি অন্তত শত্রু না। কিন্তু সে পুরোপুরি আস্বস্ত হতে পারলো না। জন্ম, আশ্রয়, খাদ্য, দুনিয়াগিরি, মৃত্যু—কোনোকিছু সম্পর্কেই ওর ধারণা গড়ে ওঠে নি। তাই টুকরোটি রেখে আড়ালে চলে এলাম।  

নাস্তার টেবিলে আমার ছোট ছেলে জানালো সম্ভবত মা বিড়ালটি মারা পড়েছে। সে নাকি স্কুলে যাওয়ার পথে ওটির মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে। সার্কিট হাউজের পূর্ব দেয়ালের প্রান্ত বরাবর মাঝ রাস্তায় পড়ে আছে। ওর মৃতদেহের উপর সারারাত বৃষ্টি ঝরেছে। পেটটি ইতোমধ্যে ফুলে উঠেছে আর কাদাতে ওর দেহটি দলা পাকিয়ে গেছে। শুনেই আমি শিউরে উঠলাম। আহারে, তাইতো এমন আর্তনাদ! দুর্ভাগা! মাকে হারানোর পর থেকেই বিলাপ করে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম, তাহলে তো ছানাটি মা’র মৃতদেহের পাশেই ঘুরঘুর বা বিলাপ করবে। ওটা এখানে কেন? 

হয়তো জানেই না যে ওর মা আর নেই। থাকার জায়গাটি হয়তো আশপাশেই ছিল। মা বিড়ালটি ওকে রেখে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো। হঠাৎ চাপা পড়েছে কোনো বেপরোয়া চালকের খামখেয়ালীতে। এদিকে মা’র জন্য অপেক্ষা করতে করতে ছানাটি ক্ষুধায় কাতর হয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। তার ফিরে আসার অপেক্ষা করছে। অথচ ওর মা আর কখনই আসবে না। আমাদের খাবার টেবিলকে উদ্দেশ্য করে কেউ যেন ভাষণ দিচ্ছে, এ পৃথিবী থেকে যারা মরে যায় তারা কি আর কখনও ফিরে আসে? জীবন একবারের জন্যই মঞ্চস্থ হয়। তা সে বিড়ালেরই হোক বা মানুষেরই হোক। এখন আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে, হতভাগা এ শোক সইবে কেমন করে? 

আবারো অস্পষ্ট কাতরানি শোনা গেলো। সারা রাতের পরে এই সকাল। রাতের দীর্ঘ প্রতীক্ষায় কোনো ফল আসে নি বলে এই সাতসকালে তাহলে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। হয়তো তার মন ছুঁয়ে গেছে যে, তার মা আর কখনও ফিরে আসবে না। হয়তো বৃষ্টি থেকে বাঁচতে রাতেই আশ্রয় নিয়েছে। রুটিটা একটুও খায় নি সে। আমার স্ত্রী বললো, এতো ছোট, খেতেই শিখেনি! ও তো এখনও বুকের দুধেই চলছিলো খেতে জানবে কী করে!

তার মনটাও ছানাটির জন্যে অসম্ভব আকুপাঁকু করতে লাগলো। সে তো মায়ের জাত! আমি আমার স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় গলে গেলাম, তার মহানুভবতা সত্যিই চমৎকার। এমন একটি অনুভূতি যেন ওটি আমারই কোনো স্বজন যাকে সে মহানুভবতা দেখাচ্ছে এবং যার প্রতি সে দয়াশীল। 

তাই তো খেতেই শিখেনি! হঠাৎ আমার স্ত্রীর স্ফীত বুকের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম যেন বুঝতে না পারে। যদিও বর্তমানে ওর দুগ্ধদানের ক্ষমতাই নেই তবু কল্পনা আমাকে ছাড়লো না। বিড়ালশিশু কি মানুষের বুকের দুধ পান করতে পারে? একদম নাহ্। কিন্তু কেন না? ও তো স্তন্যপায়ী! বুকটা পেতে দিলে ঠিকই চুষে নেবে। কিন্তু আমার স্ত্রী বা কোনো নারীই এ কাজটি করতে সম্মত হবে না, অতীতেও সম্ভবত কেউ সম্মত হয় নি বলে। এমন সময় আমার হুঁশ ফিরলো। মিছেমিছি আমার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না, বেঁকে বসবে। এমনকি মাথা বিগড়ালে ওটাকে বড় রাস্তার আবর্জনার স্তূপে ছুঁড়ে আসতেও পারে। 

এমন সময় আমার ভালোমানুষ স্ত্রী ওর জন্য বাজার থেকে একটি নিপল আনতে বললো। নিশ্চয় ওকে দুধ পান করানোর কথা ভাবছে! তাঁর প্রতি ভালোবাসায় মনটি গলে গেলো। ততক্ষণে সে বাটিতেও খানিকটা দুধ ওর জন্য রেখে এলো। 

৫.
মাঝরাস্তার আধোভিজে কাদায় মা বিড়ালটি পড়ে আছে। ব্যাংকের বিশাল উঁচু প্রাচীরের পাশে, গলিতে। পূর্ব পাশের ব্যাংকের ঐ উঁচু প্রাচীর এতোটাই উঁচু যে, ওটাকে একমাত্র জেলখানার দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সাথেই তুলনা করা যায়। এর পাশে সার্কিট হাইজেরও মজবুত লম্বা প্রাচীর তবে তা অতটা উঁচু না, মানুষের কাঁধ সমান হবে। তিন কোনা মোড়ে বিপরীত পাশে বাড়ির নিচু সীমানা প্রাচীরও রয়েছে। অর্থাৎ উচুঁ বা নিচু, লম্বা বা খানিক—যাই হোক না কেন ভাঙ্গাচোরা রাস্তাটির পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে চারপাশে প্রাচীরের বেষ্টনী দেয়া কারাগার।  

মা বিড়ালটির মৃত্যু হয়েছে যেন জেলখানার উঠানে। কারও মনে হতে পারে অনেক বছর কয়েদ খাটার পর বিচারের রায়ে তার ফাঁসির দড়িতে মৃত্যু হয়েছে। পো’র কালো বিড়ালের ফাঁসির মতো। কিন্তু ওটাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে কেন? ওটা কি খুনজখম বা ভয়ানক অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল? বিড়াল কাউকে খুনজখম করে না। হয়তো কারও হেঁশেলে ঢুকে চুপিসারে মাছভাজাটি মুখে তুলে বেরোতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কিন্তু তাই বলে কি ... 

না ওর মৃত্যু হয়েছে গাড়িচাপায়। ভয়ানক রকমের নিয়ন্ত্রণহীন এক গাড়ি, হাইলাইট দিয়ে গলির মোড় পেরোচ্ছিলো। হঠাৎ জ্বলন্ত চোখ মৃত্যুদূতের মতো চেপে বসেছিলো ওর তুলতুলে শরীরে। থেৎলে দিয়েছে ওর শরীর, হাড় গোড় মুড়মুড়ে ভেঙে দিয়েছে নিমেষে। এর জন্যে ঘাতককে কোনো কৌফিয়ৎ দিতে হয় নি। বিড়ালের জন্যে জবাবদিহিতা—এই দেশে রীতিমত হাস্যকর!


গত রাতে ছিলো বৃষ্টি। কাদায় লেপ্টে আছে ওর শরীরের নিচের দিকটা। ভিজে লোমগুলো ভেজা জুতার ব্রাশের মতো গায়ে লেপ্টে আছে। মনে মনে রাগ হলো—তুই তো মরেই খালাস, ওটাকে যে জন্ম দিয়েছিস এখন ওর কি হবে? হুঁশ করে চলতে পারিস নি! 

আমি যখন একটু থেমে মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছিলাম তখন একটা মোটর বাইক পাশ দিয়ে সোঁ করে চলে গেলো। কি অনিরাপদ করে ফেলা হয়েছে পৃথিবীটাকে! ভাগাড়! আমার রাগ গিয়ে পড়লো সেই অজ্ঞাত, অদৃশ্য গাড়িচালকের ওপর, যে মা বিড়ালটিকে চাপা দিয়েছে। ওকে হাতের নাগালে পেলে আমি আমার হাতের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতাম কিনা সন্দেহ।  

এতো গাড়িঘোড়া এই ছোট্ট শহরে! রাস্তাগুলো যানবাহনের জঞ্জালে ভরা— ভেঁপু, ঘর ঘর শব্দ, কোলাহল। মানুষের স্বস্তি নেই। অন্য প্রাণীদের তো কোনো স্থানই নেই। জল মাটি আকাশ— গোটা দুনিয়াটাই যখন মানুষ দখল করে নিয়েছে তখন আর অন্যদের কথা বলা! 

‘সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা দয়াকরে যদি ওটাকে সরিয়ে নিয়ে যায়’—ভাবতে ভাবতে বাসার দিকে পা বাড়ালাম। হ্যাঁ পৃথিবীটা সত্যিই শুধু মানুষেরই দখলে। এখানে অন্যদের নির্ভার হওয়ার সুযোগ নেই। ...আপনি ভালো করে তাকিয়ে দেখুন সেই সব তথাকথিত ইতর প্রাণীদের, পথকুকুরদের চোখের দিকে—কত ভয়, কত অনুকম্পা পাওয়ার আশা, জীবন নিয়ে কত হতাশা সেখানে জড়িয়ে আছে। দেখুন না মশাই একটু ভালো করে! আপনার পোষা প্রাণীর দিকে তাকিয়ে দেখুন সে কী নিরীহ! বনের জন্তুদের দেখুন, ওরা কত উদভ্রান্ত, পলায়নপর, অসহায়! আসলে পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি মাটিতেই ওরা উদ্বাস্তু। ফেরারি। আমার মনটা ডুকরে ওঠলো এই প্রার্থনায় —বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের কর্তা, খোদা এ কী অবিচার নয় যে, এমন অত্যাচারিতের জন্যে তোমার সীমাহীন স্বর্গের দুয়ারও নিষিদ্ধ। সেখানেও শুধু তুমি মানুষকেই বেছে নিলে!

গেইট খুলতেই আবার সেই শব্দ তরঙ্গ কানে আঘাত করলো। ভাবলাম কাছে গিয়ে বলি, ‘জানিস, কষ্টটা আমারও বেশ হচ্ছে। দেখে এলাম তোর মা’কে। আর পাবি না। কি করবি এখন! নিষ্ঠুর পৃথিবীকে মানিয়ে নিয়ে চল। এদেশে কত মানুষকে প্রতিদিন দুর্ভাগ্য বরণ করে নিতে হয় জানিস?   

৬.
ওটি কোনো কিছুই পারে না এক আর্তনাদ ছাড়া। গত দু’দিন শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। ইচ্ছে করেই ওটাকে দূর থেকে চোখে চোখে রাখলাম। কাছে না যাওয়ার ভয় একটাই, যেন কোনো ক্রোধ আমাকে ভর না করে। বাচ্চারা দয়াপরবশ হয়ে ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসতে চাইলেও নোংরা হওয়ার ভয়ে আনা হলো না। তবু আমরা দু’জনেই ওর নিরাপত্তা ও খাদ্যের জন্যে উদগ্রীব। ও কি না খেয়েই  মারা যাবে, কিন্তু বাঁচার জন্যে পড়িমিড়ি কে না করে! আমি মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম এমন একটি অবস্থার জন্য যা ওর জন্য সুফল বয়ে আনবে। 

পরের দিন সন্ধ্যারাতে ওকে আমি দেখতে পেলাম অর্কিড ঘের দেয়া ছোট্ট প্রাচীরের ওপর ওঠে বসে আহাজারি করতে। ওটি বুঝতেও চাইছে না কিছু বা বাস্তব দুনিয়ার কারসাজি তার বুঝার কথাও না। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা হলো যে, যে পা ফসকে ড্রেনের পানিতে পড়লেই ওখান থেকে আর রক্ষা পাবে না। কিন্তু ওকে সরিয়ে আনার জন্য এগিয়ে গেলে যদি আক্রমণ ভেবে ড্রেনের পানিতেই লাফ দেয়! বরং আশাবদী মন নিয়ে ভাবতে থাকলাম যে, ওটা নিশ্চয়ই সরে আসবে। 

পরের দিন বিকেলে শব্দটি নেই। মোটরবাইকের টায়ারের সামনে পেছনে উঁকি দিয়ে, আশপাশ খুঁজে কোথাও পেলাম না। তবে কি ড্রেনের পানিতেই? মায়ের মতোই অপমৃত্যু! একটু যদি বুঝতো! গত সন্ধ্যায় দেখেই তো শিউরে উঠেছিলাম। এ পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে কিছু তো যোগ্যতা লাগে। এই কুরুক্ষেত্রময় দুনিয়ায় রেসের ঘোড়ারা কে কাকে সাহায্য করে! আমার সব রাগ গিয়ে পড়লো বোকার হদ্দটার ওপর। 

নাকি কোথাও চলে গেছে? আমার স্ত্রী অনুমান করে বললো, হয়তো অন্য কোনো মা বিড়াল এতিম শিশুটিকে পালন করার ভার নিয়েছে। খানিকটা স্বস্তি ফিরে পেলাম ওর কথায়। তবে তো বিড়াল জাতী খুবই মহানুভব যা আজকাল মানুষও না! বাহ নিজের সন্তান না অথচ দেখো ঠিকই আপন করে নিলো। আকালের দুনিয়ায় মুখের সামান্য খাবারটাতেও নিশ্চয় ভাগ দেবে। এটা খুব খুশির খবর, ঠিক উজ্জ্বল দিনের মতো মন ভালো করা একটি ব্যাপার। আর বোধহয় সেসব দিন আসন্ন যখন ওদের কাছে আমাদের খুব করে মাথা নোয়াতে হবে। 

ঠিকই। পরের দিন সকালে আমার ছোট ছেলে জানালো ও নাকি ওর মা’কে পেয়ে গেছে! শুনে আমার বিশ্বাস হতে চাইলো না। এ কী করে সম্ভব! এত ছোট শিশুকে ছেড়ে দু’দিন কেমন করে থাকতে পারে মা বিড়ালটি। যত বিপদেই থাকুক ছানাটিকে সে অবশ্যই নিতে আসবে। মা বিড়াল দু’দিন চুপ থাকবে—এটা হতেই পারে না। তাছাড়া ওর মা’র মৃতদেহ তো নিজে গিয়ে দেখে এলাম! নাকি ওটা ওর মা-ই না, অন্য  কোনো দুর্ভাগা? সামনের দোকানের ছোকরাটি বলেছিল ছানাটিকে কেউ রেখে গেছে। তাই দুদিন হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে হয়তো অবশেষে ছানাটিকে পেয়েছে। তাহলে শেষমেষ এ ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো। 

বেশ কয়েকটি দিন চলে গেছে। আমার ধারণা, ইতিমধ্যে আমাদের তুলতুলে বাবুটি সম্ভবত একটু বল শক্তি পেতে শুরু করেছে। মায়ের সাথে খাবার চুরি করা বা ইঁদুর ধরতে ধরতে হাত পাকাচ্ছে। নয়তো মায়ের সাথে উপবাস করে করে হাড়চিমড়ে হয়ে যাচ্ছে। এতোদিনে আমি ওকে ভুলেই যেতাম যদি সার্কিট হাউজের পিছনের গলিটা দিয়ে আমাকে মাঝেমধ্যে যাতায়াত করতে না হতো। ওই মোড়টা এখন সাদামাটা পড়ে আছে। কে দেখে বলবে যে এই ক’দিন আগেই এখানে একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে!

মোড়টা পার হওয়ার সময় আমি আড়চোখে মাঝরাস্তায় তাকাতাম যেখানে ওর মৃতদেহটি ছিলো। কিন্তু প্রতিবারই আমি দেখতে পেলাম যে ওটি এখনও ওভাবেই পড়ে আছে। কালো, রোমশ, ফুলে ওঠা নিথর দেহ। দুর্ভাগ্যের আর্তনাদ যেন ফুটে বেরোচ্ছে ওর থেৎলানো মুখটি থেকে। নীরবে অভিশাপ দিচ্ছে পৃথিবীর মানুষদের যারা ওর জীবন নিয়েছে ও প্রিয়তম সন্তানকে করেছে বিপন্ন। ভয় ও শঙ্কায় আমি কুঁকড়ে ওঠি। জানি না সেই গাড়িচালক বা পাড়ার লোকেদের ভাগ্যে কি আছে। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে খানিকটা এগিয়ে গেলাম। ফের পিছন ফিরে এক পলক তাকালাম—কই কিছুই তো নেই!

সাতদিন পরের বিকেল। গায়ে একটু বাতাস লাগাতে সার্কিট হাউজের ফুটপাত ধরে হাঁটছি। ব্যস্তসমেত বড় রাস্তায় পৃথিবী যেন আরও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কিছুদূর হাঁটার পর হোঁচট খেয়ে স্যান্ডেলটার ফিতে বেরিয়ে গেলো। এর চেয়ে জঘন্য উৎপাত আর কি হতে পারে! গুঁজে দিতে যাবো হঠাৎ দেখি, ফুটপাতের পাশে একটি সাদা বিড়াল পড়ে আছে। ওর নাক দিয়ে এখনও তাজা রক্ত চুইয়ে পড়েছে। হয়তো খানিক আগেই... আমি লাফিয়ে উঠলাম। ভয়ে গা এমন কাঁটা দিলো যে, চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। সম্বিত ফিরে পেয়ে বাসার দিকে তাড়াতাড়ি পা চালালাম। বাকি দিনটি কেমন করে কেটে গেলো বুঝলামই না। মনে হলো বছরের সবচেয়ে আশ্চর্য এক ছোট দিন। 

আগেভাগে শুয়ে পড়লেও চোখে ঘুম নামতে নামতে মাঝরাত। রাতের তারাফোটা নির্মল আকাশ। সুনসান নীরবতা। আবারও একটা দুর্বল আওয়াজ—থেমে থেমে ভেসে আসছে অর্কিডের ঝোপ থেকে। আমি যতই ওটাকে পাশ কাটাতে চাইছি ততই আমার মনযোগ কেড়ে নিচ্ছে। মনে হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নাছোড় আকর্ষণ আমাকে টেনে তুলবে। বারবার এপাশ ওপাশ করলাম। ব্যর্থ হয়ে মাথাটা গুঁজে দিলাম বালিশে। অসহ্য আওয়াজ সেই ডাকের। আমার স্ত্রী ঘুমিয়েছে অনেক আগেই। হঠাৎ সে ঘুমজড়ানো গলায় বললো, ছিচকাঁদুনে! 

পরের দিন আগস্টের ঘুমজড়ানো সকালে ঘুম থেকে ওঠে নভেরার পোস্টটি নজর কাড়ে— Black Cat Appreciation Day, 17 August. আদুরে চোখের একটি কালো বিড়ালের সাথে নভেরার সুখী  পেলব এমনকি অসম্ভব প্রলুব্ধকর মুখাবয়ব। তখুনি মন থেকে এলেন পো বা হ্যালি বেরি দূর হয়ে গেলো। আমার চোখে এখন ম্যাডোনা এন্ড দ্য চাইল্ডের প্রতিচ্ছবি—সুখী এবং কামুক।


• রংপুর  

menu
menu