অবশেষে মনু পাগল হয়ে গেল

একটা লোক এভাবে গায়েব হয়ে গেল! 

মনুকাকার হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যাওয়াটা ভীষণ ভাবিয়ে তুলল তাকে। বিয়ের আগে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন হদিস পেল না লোকটার। থানা, র‌্যাব, হাসপাতাল, থানার ড্রেন, হাসপাতালের সেপটি ট্যাঙ্কি, আঞ্জুমানের তালিকা সর্বত্রই খুঁজল। পত্রিকার পাতায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিল। কিছুতেই কিছু হলো না। গুম হলো কি না, সেটাও ভাবল। এরূপ নিঃস্ব, রাজনীতিবিযুক্ত, বয়স্ক একজন মানুষ গুম হবে কেন? তাহলে থাকল কী? পালিয়ে যাওয়া। তাহলে কী বিয়েকে কেন্দ্র করে তার আব্বা মনুকাকাকে কোন কটু কথা বলায় দুঃখ পেয়ে চলে গেলেন তিনি? সে সম্ভাবনাও তার ক্ষীণ মনে হলো। কারণ, প্রথমত : তার আব্বা সেভাবে কোন কটু কথা বলে না। আর মনুকাকার ব্যাপারে তো প্রশ্নই ওঠে না। দ্বিতীয়ত : মনুকাকারও যা স্বভাব সে তার আব্বার কোন কথায় পারতপক্ষে রাগ করে না। কারও কথায় না। তবু এখন খাবার টেবিলে বসে সে জিজ্ঞেস করল, আব্বা কী মনুকাকাকে কিছু বলেছেন না কি?  

না তো। 

যাবার আগে টাকা পয়সা কিছু চেয়েছিল?

 না, তাও না।

প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে একবারই হাজার দুয়েক টাকা নিত মনু। সে টাকা নিয়ে কী করত তা কেউ জানত না। এক দু বার জানতে চেয়েও যখন জানা গেল না, তখন সবাই ধরে নিল এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে কেউ তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করেনি আর।

আমি বলি কী বেয়াই সাব, ভালো করে খোঁজ নেন, তন্ন তন্ন করে খোঁজেন। আমার তো মনে হয় বড় কোন ছক্কা মেরে পালিয়েছে লোকটি। উপযাচক হয়েই কথাটি বলল আশফাক মিজি।

মিজির এ ব্যাপারে নাক গলানো একদম পছন্দ হলো না তার। আঁড়চোখে তাকাল শ্বশুরের দিকে। কটাক্ষ স্বরেই বলল, না, মনুকাকা ওরকম লোক নয়। আমাদের মতো অতটা জটিলতা নেই তার মধ্যে।

মিজি মেয়ে জামাইর বিরক্তিটা হয় ধরতে পারল না, না হয় না বুঝার ভান করল। সে বফবফ করে হাসতে হাসতে বলল, জামাই বাবাজি, আপনাদের এখনও বয়স কম। মানুষের দেখেছেন টা কী! এসব মুর্খসুর্খ লোকদের কোন বিশ্বাস নেই।

এবার তার আব্বা মিজির দিকে মুখ ঘোরাল। না, বেয়াই সাব, আপনার জামাইর কথাই ঠিক। মনু আসলে সেইরকম নয়। 

আশফাক মিজির মুখ লাল হয়ে গেল, লোকগুলো হাবগোবা কিনা—ভাবল মিজি। যেমন বাপ তেমন তার ছেলে। সোজার সোজা। অবশ্য নিজেকে সে আশ্বস্ত করল, আমার হাতে যখন পড়েছ বাপধনেরা ...।

নয় মাস গত হতে না হতে সবাই যখন ভুলে যেতে বসল সবকিছু। তখনই কাজিমুদ্দি খবরটি দিল। আশ্বিনের মঙ্গায় দূরদূরান্তের যে শহরটিতে তারা কাজে যায়, সেখানে নোংরা কাপড়চোপড় পরিহিত মনুকে ভিক্ষা করতে দেখতে পেয়েছিল সে। 

তা কেমন দেখলি মনু কাকাকে? শুকিয়ে গেছে না রে? কথা বলিসনি কেন? নিয়ে এলেই তো পারতি? রাজ্যের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে সে কাজিমুদ্দির মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইল।

না ভাইজান ওইরম কাছে থেইকা দেকি নাই। আসার সময় চলতি বাস থেইকা বইসা থাইকতে দেইকছি মাত্র।

কাজিমুদ্দির মুখ থেকে সব জেনে মনুকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার মন উদগ্রীব হয়ে পড়ল। রাতটা তার কাছে দীর্ঘতর ঠেকল। উৎকণ্ঠায় তার ঘুম এল না। কোন রকম রাতটা পার করে সাত সকালে বেরিয়ে পড়ল সে। স্টেশনে এসে একটা টিকিট কেটে বসল বাসে। বাস ছাড়ার কথা দশটা বিশে এখন বাজে এগারোটা পাঁচ। কিছু লোক জটলা করছে। সবই বাসের লোক। যাত্রী টানাটানি করছে। ভেতর থেকে লোকজন হাঁকডাক পাড়ছে। এ ড্রাইভার কী হলো, বাস ছাড়ছেন না কেন? এভাবে হাঁকডাক দিলে ড্রাইভার সিটি বাজায় ও ছোট একটা টান দেয়। তারপর আবার ব্রেকে চাপ দিয়ে বসে থাকে। এভাবে গত আধঘণ্টা ধরে চলছে। এবার মনে হয় ফাইনাল টান দিবে। কাগজ হাতে এসিস্ট্যান্ট গাড়িতে উঠছে। ঠিকই টানটা দিল। গতি পেতে শুরু করল গাড়িটা।    

গাড়ি ঘণ্টা খানেক চলার পর জ্যামে পড়ল। লোকজন বলাবলি করছিল জ্যাম অনেক বড়। সে ভাবছিল মনুকাকার লাপাওা হওয়া নিয়ে। কেন লোকটি বাড়ি ছেড়ে ভিক্ষার জীবন বেছে নিতে গেল, কী এমন ঘটে গেল তার মধ্যে যা এ বাড়ির কেউ জানতে পারল না, সে নিজেই এর জন্য দায়ী কি না। এ ভাবনাও তার এল। তাকে দেখে মনুকাকার কীরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। ভিক্ষুকের বেশে এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে, নাকি লজ্জা-শরমে মাথা নিচু করে বসে থাকবে। এমনও তো হতে পারে, তাকে দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করবে। তখন কী করবে সে? অনেক কিছুই মাথায় এল, কিন্তু কোন কিছুরই কূলকিনারা করতে না পেরে সে জানালা দিয়ে যানজটের দিকে তাকিয়ে রইল। লম্বা অজগরের মতো দীর্ঘ লাইন। এক দুই ঘণ্টায় এ জট খুলবে বলে মনে হলো না। মনুকাকার কাছে ছুটে যাবার বাসনা সত্ত্বেও জটটা তার খারাপ লাগল না। ভাবল, এটাইতো কতজনের হিল্লে করে। এ যে ছোট পিচ্ছিটা বাদাম বাদাম করে চ্যাঁচাচ্ছে, বুড়োটা বিক্রি করছে জালমুড়ি, চনাগরম চনাগরম বলে একজন ছুটে আসছে গাড়ির দিকে, শশাওয়ালা, গাজরওয়ালা—কাইট্টা চিল্লা লবণ..., ভিক্ষুকগুলো, মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানার রসিদ হাতে ঘুরে বেড়ানো পাঞ্জাবি পরিহিত  লোকগুলো—এদের জন্য এ জটতো বড়ই আশীর্বাদ, আল্লার নেমত! যানজটের এমন একটা সমাজতাত্ত্বিক  ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পেরে আত্মতৃপ্তি বোধ করল সে। তখনই দেখতে পেল গজল বলে বলে একটা লোক ভিক্ষে চাইছে। নির্লিপ্ত চেহারা! অসহায় ঘোলা চোখ, নির্মেদ হালকা গড়ন, বয়সেও খুব বেশি গরমিল হবে না। লোকটার মধ্যে মনুকাকাকে খোঁজে পেল সে। হয়তো তিনি এভাবেই ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন। পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে সে ভিক্ষুকের থালায় দিল। 

মনুকাকাকে খুঁজে পেতে তার দু’দিনের বেশি লাগল না। কাজিমুদ্দির নির্দেশিত জায়গার আশে পাশে তাকে পেয়ে গেল। কিন্তু মনুকাকার আচরণ দেখে তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এখন তাকে নিয়ে হোটেলে উঠলে পাগলামির মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো মনুকাকা তাকে চিনতেই পারল না। 

গনগনে দুপুরে তারা বাড়ি পৌঁছাল। তার আগে বাড়ির লোকজন মনুর আগমনের খবর পেয়েছিল। খবর পেয়ে উপস্থিত হলো আশফাক মিজিও। বড় মিয়া আর আশফাক মিজি দু’বেয়াই মিলে কাচারি উঠোনে চেয়ার পেতে বসল। সদর দরজাতে মনুই প্রথম দেখতে পেল ওদের। মুনাজাত ঢঙে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল সে। পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল তার। তাদের সামনে উপস্থিত হতেই ওয়াক ওয়াক করে বমি করল। বমির অবশিষ্টাংশ দাঁতে লেগে থাকলে কায়দা করে জিহ্বা দিয়ে বের করে আনল। হঠাৎ করে থুতুসহ তা ছুঁড়ে মারল মিজির চোখেমুখে। মিজির কপাল থেকে ভুরু, তা বেয়ে বেয়ে চোখের ভেতর ঢুকে গেল কিছু অংশ। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল দেখাল মিজিকে। বড়ই পাংশু দেখাল মুখটি। 

লোকটা তো দেখছি পুরো পাগল হয়ে গেছে। জামাই বাবাজি দেখছেন কী, বান্ধেন হারামজাদারে।

জামাইর মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। হতাশ দেখাল মিজিকে। তিতা গিলে তিতা হজমের অবস্থা হলো তার। ইচ্ছে করছিল শুয়োরটাকে কষে একটা লাথি মারে। জামাই বাড়ি বলে কথা। তাছাড়া মেয়ের জামাইটা যেভাবে তাকে যত্ন আত্তি করছে! ইচ্ছেটাকে দমন করল কোনভাবে। কষ্ট করে হজম করতে হলো।

এদিকে সে কিছু না করলেও তার আব্বা মনুর গালে কষে একটা থাপ্পড় মারল। 

এত বড় বেয়াদব হয়েছিস তুই। বাড়ির কুটুমের গায়ে থুতু মারিস। 

পাগল মানুষ। তার বোধবুদ্ধি থাকলে তো! তোমরাও তো কম না। বলেই সে মনুকাকাকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতর ঢুকল।
 
মনু হা.. হা.. করে হাসতে থাকল। ভাবল, খেলটা ভালই দেখিয়েছে। এ ক’দিনকার পাগলামির কারণে এখন নিজেকে সত্যিই পাগল মনে হচ্ছিল। মিজির গালে থুতু ছিটানোর পর এক বেপরোয়া শৈত্যবোধে আক্রান্ত হলে নিজের অজান্তেই পরনের কাপড় কাঁধে উঠে আসল তার। কাঁপছিল ঠকঠক করে। ছালার বস্তা, পুরনো কাপড় চোপড়, নোংরা কোট আর হাবিজাবি গায়ে দেয়া পাগলগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কেন তারা প্রচণ্ড গরমেও এসব হাবিজাবি গায়ে জড়ায় তার হেতু বুঝার চেষ্টা করল।

পাগল না হয়ে উপায় ছিল না। যখন তাকে দেখল, প্রথমে চোখে পানি এসে গেল। বিয়ের পর মানুষ মোটাসোটা হয়। আর ছেলেটা হয়ে গেল শুকনো কাষ্ঠের মতো। ভাবল পালিয়ে যাবে। চোখ তাকে কাছ থেকে দেখার লোভ সম্বরণ করতে দিল না। তখনই মনু ধরা দেয়ার সিদ্ধান্তটা নিল।

এদিকে মিজি আমানুল্লাকে চিনতে পেরে ভাবনায় পড়ে গেল। কী করা যায় তাৎক্ষণিক একটা পরিকল্পনা আঁটল। মনে মনে শাপশাপান্ত করল সহযোগী জামাইল্যার। দায়িত্বটা ছিল জামাইল্যার ওপর। প্রথমে অবশ্য সে কাজটা করেছিল ঠিকমতো। স্ত্রী আর তার পরকীয়া প্রেমিক হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন। খালাস পেলে পুনরায় অন্য কোন মামলায় ঢুকিয়ে দেয়া বা ফায়ারিং স্কোয়াডে দেয়ার কথা ছিল। সে জন্য জামাইল্যাকে ভালো পেমেন্টও দিয়েছিল। সেই বেইমানটা তার বাসায় কাচ্চি খেতে খেতে তাকে আশ্বস্ত করেছিল।

ধরে নেন আমানুল্লা ইন্তেকাল ফরমাইছে। এ নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই বড় মিজি। 

শেষমেষ সেও বেইমানি করে বসল। কীট কোথাকার! কথাটা মুখের মধ্যে রেখে দিয়েই দাঁতে দাঁত কামড়াল আশফাক মিজি। আর এখন কিনা আমানুল্লা হারামজাদা এ শহরেই স্বাধীন জীবন কাটিয়ে দিল এতোটা বছর! তাও পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে। একেবারে জামাই বাড়ি! হারামজাদা নাম নিয়েছিস মনু, না। তোর মনুগিরি আমি ছুটাচ্ছি। আশফাক মিজির অস্থিরতা বেড়ে গেল। এখন খাবার টেবিলে বসে সে জামাইর সন্ধান করল 

উনি তো মনুকাকাকে গোসল করাতে নিয়ে গেছে। বাপকে বলল কুসুম। 

পাগলের আবার গোসল টোসল। ওর দরকার এখন চিকিৎসা। বেয়াই সা’ব, অরে আমার হাতে ছেড়ে দিন। ভালো খোনকারের সন্ধান আছে। দু’দিনেই ভালো হয়ে যাবে ইনশাল্লা। মাছের কাঁটা চিবুতে চিবুতে বলল আশফাক মিজি।

কিন্তু আপনার জামাই। সে তো মনে হয় আজই মনুকে নিয়ে মেন্টাল হাসপাতালে যাবে। 

না না, সেটা ঠিক হবে না। মেন্টাল হাসপাতাল আজ পর্যন্ত কোন পাগলের চিকিৎসা করতে পেরেছে নাকি? ওখানে গেলে তো সুস্থ মানুষই মেন্টাল হয়ে ফিরে আসে।

তার আব্বার কাছে কথাটা যুতসই মনে হলো।

ঠিক আছে। ছেলে আসুক, আমিও বলব। আপনিও বুঝান।

মনুকাকাকে পাশে বসিয়ে খাওয়াতে বসল সে। মনু খেতে চাচ্ছিল না। পাগলামি করছিল। ভাত ছিটাচ্ছিল এদিক ওদিক। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিল এদিকে সেদিকে। 
 
দেখো কাকা, তুমি না খেলে কিন্তু আমিও খাব না।

মনু সম্বিৎ ফিরে পেল। ভাবল, এসেই যখন পড়েছে খেতে তো হবে। তাছাড়া সে যখন তাকে ছাড়া খাচ্ছিলই না, তখন তো অবশ্যই খেতে হবে। দ্রুতই সে ভাতগুলো টেবিলে ঢেলে দিল আর গো গ্রাসে গিলতে থাকল। পানি খেল হাতে কোশ করে। এ হারামিরা যে পাতে খায়, সে পাতে আমানুল্লা খেতে পারে না। মনু তার প্রতিজ্ঞা রক্ষায় কৌশলি হলো।

এদিকে জামাইর খাওয়া শেষ হয়েছে কি না বারবার খবর নিচ্ছিল আশফাক মিজি। হাতপাখাটা জোরে জোরে ঘুরিয়েও তার গা জুড়াচ্ছিল না। এ বাড়িটা খুবই অসহ্য লাগছিল। আবার ছেড়েও যেতে পারছিল না। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে আমানুল্লা হুঁশের মধ্যে নেই। যদি সে সুস্থ থাকত, যদি সব জানাজানি হয়ে যেত কী হতো তাহলে! ভাবতেই তার গায়ে কাঁটা দিল। এখন সেসব ছাপিয়ে আমানুল্লার বিহিত করাটাই তার কাছে বড় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।     

জামাইর সাথে কথা বলতে গিয়ে পুনঃ আমানুল্লার মুখোমুখি হলো। এবার তাকে দেখে পাগলামির চূড়ান্ত করল সে। বুড়ো বানরের মতো আশফাক মিজিকে ঘিরে নাচতে শুরু করে দিল। আর মুখে ধুয়োটাও তুলল যুতসইভাবে—
 
নাচ ভেল্কি নাচ, সফিকের নামে নাচ, সফুরার নামে নাচ। 
 
নাচ আমার ময়নারে তুই ঘুরে ঘুরে নাচ। 

নাচের সময় মনুকে লাফাতে হচ্ছিল বেশি। সে আশফাক মিজির ছায়া মাড়াতে চায় না। সূর্য মিজির বিপরীতে অবস্থান করলে সুকৌশলে সে তাকে এড়িয়ে লাফদাফ দিয়ে দিয়ে নাচতে থাকল।

আশফাক মিজি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। সফিকটা আবার কে? সফুরাকে চিনতে অসুবিধা হলো না তার। সফিকের কথা মনে করতে পারছিল না কোনভাবে। মাথাটা ঠিক কাজ করছিল না। হিন্দু মুসলমান নামের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলল। সফিক বলতে কি শ্যামা দাসের পোলা সমীর দাসের কথা বলছে নাকি হারামজাদাটা? ওরে তো বিশ হাজার টাকার মুচলেকায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। একদিনের আল্টিমেটাম দিয়ে ছেড়েও দিয়েছিলাম। কিন্তু বজ্জাতটা সন্ধ্যায় এসে বলে কিনা, ঘরে এ সাত হাজার টাকাটাই আছে কাকু। জ্ঞাতি কুটুম্ব হগগলেই তো চলে গেলো হেইপারে, আর আমি রয়ে গেলাম মাটির টানে। তো আমারে ক্ষ্যামা করন যায় না কাকু। 

সেই হারামিটাকে পুটুস করেছিলাম খালপাড়ে। কাকপক্ষিও টের পায়নি। এ হারামজাদা জানল কেমনে?  মিজির মধ্যে ভয় ও সন্দেহ কাজ করতে থাকল।  

ওইদিকে আমানুল্লার ভাবনাও কম না। সেদিন তো কিছুই করতে পারল না। আজ হাতের মুটোয় পেয়েও ছেড়ে দেয় কী করে। এ হারামি শুয়োরটাইতো তার সফুরাকে খুবলে খুবলে খেয়েছিল। সফুরার আউলা ঝাউলা চুল, খুবলানো মুখচ্ছবি, আঁকিবুকি পেট, উরু, নিতম্ব, জংঘা, নগ্ন নিশ্চল পা দুটি—পুরো নিথর দেহটাই এখন তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল। যেদিন আশফাক মিজি ওকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে  গিয়েছিল, সেদিন যুদ্ধের মধ্যেও খাবারের সন্ধানে বের হতে হয়েছিল আমানুল্লাকে। ঘরে বউকে না পেয়ে পাগলের মতো ছুটেছিল আশফাক মিজির বাড়ি। মিজি আশ্বাসও দিয়েছিল তাকে। বলেছিল, পরদিন সন্ধ্যায় চৌধুরীদের পোড়াবাড়িতে দশহাজার টাকা নিয়ে  উপস্থিত থাকতে। টাকা যোগাড় করতে না পেরে শেষসম্বল বাড়ির দলিলখানা নিয়ে হাজির হয়েছিল সেখানে। কিন্তু গিয়ে যা দেখেছিল, সে কথা মনে হতে এখন শীত তাকে আরও কাবু করে ফেলল।  

মিজির দুই সঙ্গী কাতলা মাছের মতো করেই ছেলেটাকে চেপে ধরেছিল। আবছা আলোতে আমানুল্লা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল, মিজি প্রথমে তার ডান চোখ তোলল, তারপর বাম চোখ...। তারপর তিনজনে মিলে কোরাসের সুরে বলল, বল্ কিছু দেখস নাই।

যুবক ছেলেটি পিচাশগুলোর  থাবার মধ্যে পড়েও বিন্দুমাত্র নতি স্বীকার করল না।

আড়াল থেকে আমানুল্লা শুনতে পেল সে বলছিল, তোরা কুত্তা। তোরাই সফুরাকে মেরেছিস। ওর মরাদেহে চড়েছিস। তোরা মানুষ না, তোরা জানোয়ার, তোরা হায়েনা। 

তিনজনে মিলেই ছেলেটাকে পরে ইট দিয়ে মাথা থেতলে থেতলে মেরেছিল। সফুরার মরদেহের পাশেই পড়েছিল তার চোখ উপড়ানো লাশ।

পরে মনু জানতে পেরেছিল এ ছেলেটিরই নাম সফিক। সে সেদিন একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের হয়ে রেকি করতে গিয়েছিল চৌধুরীদের পোড়াবাড়ি। সফুরার নির্মম নির্যাতন দেখতে পেয়ে একাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওদের ওপর। অথচ স্বাধীন দেশেই কিনা মিজিদের ষড়ষন্ত্রে সফিক সফুরার পরকীয়া প্রেমের কাহিনী ছড়াল। স্ত্রীর প্রেমিক হত্যার জন্য যাবজ্জীবন জেল খাটতে হলো আমানুল্লাকে। 

অনুশোচনা হলো তার, কেন সেদিন তাদের ভয়ে জীবন নিয়ে পালাতে গেল; না গেলেই তো ভালো হতো বরং। এতকিছু দেখতে হতো না তাকে। মিজি এভাবে বোল পাল্টিয়ে ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে ভাবতেই তার গায়ের লোম খাড়া দিয়ে উঠল। থমকে দাঁড়াল সে। এদিকে মিজি ক্রোধে ফেটে যাচ্ছিল, তোরা দেখছিস কি, পাগলা কুত্তাটাকে খাঁচায় ভর, চেইন দিয়ে বাঁধ।

বারান্দায় ঘরের এক কোণায় মনুকে বেঁধে রাখা হয়েছে। আলো আঁধারের মধ্যেই মনু ভাবছে—অনেক কিছুই করার ছিল তার। নরপিচাশগুলোর সাথে লড়তে লড়তে সেদিন সফুরা সফিকের মতো লাশ হতে পারতো। স্বাধীনের পর জেল খেটে খেটে জীবনটা অতিষ্ট হয়ে গেলে একবার ভেবেছিল কোথাও পড়েটড়ে মেরে গেলেই হতো। এক জেলারের বদৌলতে এ বাড়িতে কাজ পেলে, এ বাড়ির বড় ছেলেটাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করতে করতে সফুরার পেটে আলোর মুখ না দেখা ভ্রুণটার স্থলাভিষিক্ত কল্পনা করে জীবনের এক নতুন অর্থ খোঁজার চেষ্টা করল। আর মিজির মেয়ের সাথে সেই ছেলেটার বিয়ে পাকাপাকি হয়ে যাবার পর সে যখন জানতে পারল এ সেই মিজি যার বিচারের আশায় আশায় সে প্রতিবছর দুই হাজার টাকা খরচ করে এতিম খাওয়াতো। তখন পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর থাকল না। 

আজও চোখের সামনে সেদিনের মতো আলো আঁধারের এক বিভ্রম। নাচের ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুক্ত মিজির লোলুপনেত্রে শিকারির হিংস্র প্রতিচ্ছবি। ইশারায় কে যেন তাকে পালানোর পথনির্দেশ করল। পালাতে ইচ্ছে করল না তার। ভাবল, পালানোর চেয়ে পাগলামি ঢের ভালো। সে নতুন করে পাগলামি শুরু করে দিল।


• কুমিল্লা

menu
menu