অমল যে হাত সে ছুঁয়েছিলো

অন্য সময় হলে এ প্রশ্ন আসতো না। এতো চুলচেরা কথা বুননেরও দরকার পড়তো না। সাদাচোখে, দেখেশুনেই বেশ বুঝা যেতো। রাণু এখন কেমন করে জানবে, ইমতিয়াজ হাসান যার সঙ্গে সে বছর দু’য়েক আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল, দেড় বছরের একীভূত জীবনে এই প্রথম কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাবে। ছটফট করতে থাকবে যন্ত্রণায়। সে নিজে তো এখন অন্য কোথাও।

সব সুখাবেশ, শান্তি বা ভালোলাগার চেয়ে সব দুঃখ, অশান্তি বা অপ্রত্যাশিত তিক্ততাই জীবনে বারবার সামনে এসে ভিড় করে, আচমকা হানা দেয়। তখন দৃশ্যপট সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়। রং পাল্টে যায় চিরচেনা চারপাশের। তাই এখানে থাকলে নিমেষেই সে দেখতে পারতো, হাসানের অবস্থাও এখন তাই-ই। অথচ একটু আগেও রাণু এখানেই ছিল।

রাণু জানে, এক অনিঃশেষ যন্ত্রণা আড়াল করে সে নিজে আনাড়ির মতো সংসার সংসার খেলার দিনগুলো পাড় করেছে। সত্যি বললে, দিন মানে অচলায়তনের পাথার। পই পই করে মাথার কোষ যন্ত্রণার পোকায় কেটেছে, ডিম ফুটিয়েছে। টু শব্দটি পর্যন্ত হাসানের সামনে সে কোনোদিন করেনি। বুঝতে দেয়নি তার অব্যক্ত কষ্টের ছিঁটোফোটা।

অবশ্য এর জন্য হাসানের দোষ সে দেয় কী করে? সকাল-সন্ধ্যা অফিস; যানজটে ফিরতে ফিরতে রাত নটা দশটা। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনেও দৌড়। ক্যাঙারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয় হাসানকে। তারপরেও, সে তো তাকে নিয়ে বেরিয়েছে শপিংয়ে। মাঝে মধ্যে দামি রেস্তোরাঁয় শ্রাদ্ধ করেছে ওর ওভার টাইমের টাকা। দু’একবার তো বেইলি রোডেও নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাণুর যে পাথার তা পাথারই থেকে গেছে। রাণু হাসানের কাছে একটা জীবন চেয়েছিল। হাসানের দেয়া একটু অন্যরকম সময়, ভালোলাগা বা ওই জাতীয় কিছু। হাসান তা দিতে পারেনি।

হাসান ওকে নিয়ে হেলাফেলা করেছে এ কথাও বা সে বলে কী করে! সে তো সাক্ষী, ঘর-অফিসের ম্যারাথনে হাসানের পা হয়ে পড়েছে অটোমোশনড চাকা। হাসান যেন ঘোরের মধ্যে তার গতিরেখায় পাঁক খায়। সে মানুষ থেকে যান্ত্রিক মানবে বিবর্তিত। তাছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে; অমন করেই তো আজকাল নগর জীবনে বেঁচেবর্তে থাকতে হয়। রাণু বুঝতো হাসান তার কষ্টটুকু ধারণ করতে পারবে না। তার পক্ষে অতকিছু সম্ভব না। যা হবার তাই-ই হলো। অনিবার্য নিয়তির মতো তাকে পান করতে হলো এর অমোঘ গরল। রাণু বুঝতে পারেনি যে, তার অমন অপরিপক্ক আবেগ এ জগতসংসারে যায় না। রাণু নিজেকে পাল্টাতে পারেনি।

কিন্তু এ তো জানা কথা যে, হাসান এখন বিছুটির কামড়ের জ্বালায় ছটফট করতে থাকবে রাখঢাকহীনভাবে। চঞ্চল পায়চারী; মুহূর্তে আবেগের আচমকা ঝাঁপটা এসে তার চোখেমুখ লেপ্টে দিবে। একসময় হয়তো নিজের উদাসীনতা বা হেলাফেলা নিয়ে ভাববে। চকিতে এ গলি ও গলিতে কারণ অনুসন্ধানে লিপ্ত হবে। খানিকটা হয়তো রাণুর বোকামিতেও রুষ্ট হবে। খুঁজে বের করতে থাকবে রাণুর হেলাফেলা যা এই সময়ে মোটেও করা উচিৎ হয়নি। আরও নানা কারণ খুঁজতে থাকবে। হাসানের এই স্বভাবটি সংসারজীবনে এসেই রাণুর বেশ চেনা হয়ে গেছে। তবে রাণু জানে, কোনোটারই সমাধান হাসান পাবে না। সময় ওকে কোনো সুযোগই দিবে না।

দিনে দিনে হাসানের সাথে নিবিড় প্রেম, তার পরিণতি, বিয়ে। দু’পক্ষের নিজ নিজ বাড়িতে আলোকসজ্জা, ধুমধাম, আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের সরব উপস্থিতি। মুখস্থ  করা নামতার মতো-সচরাচর যা হয়। একরকম ঝঞ্ঝাটহীন কেটে গেছে দু’জনেরই। বিয়ের মাসছয়েক পর যার যার মেস থেকে প্রমোশন। বাড়ি ভাড়া নেয়া হলো সংসার পাতার জন্য। নয়া ভাÐে দই পাতার মতো। নতুন সংসার। ছোট্ট সংসারের সবকিছুই আতিপাতি করে গোছানো। অমনটাই তো চেয়েছিলো রাণু-সুসজ্জিত কারাগার।

রাণুর বেশ মনে পড়ে, বিয়ে ও বৌভাতের দিনে পার্লারে নিয়ে গিয়ে তার চেহারাটা পাল্টিয়ে আনার কথা যে চেহারায় সে কনের আসনে বসেছিলো। নতুন একটি চেহারার জীবন শুরু হয়েছিল তার, সেটা রাণু বুঝেছিল। সে নিজেই ব্যাকুল হয়েছিল ওই চেহারাটার জন্য, অন্যেরাও তো সেটিই চেয়েছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি, সে রংটা অনেক অনেক ধূসর হতে থাকবে তার প্রণয়ের মাত্র দুই বছরের মাথায়। অন্যদিকে, হাসানের চেহারাটাও একটু একটু করে দ্যুতি হারাতে থাকবে। যাকে দেখামাত্রই বিদ্যুৎ চমকাতো রাণুর মাথায়, বুকটা ঢিপঢিপ করতো, সে নিতান্ত সস্তা আর মামুলী হয়ে যাবে। দিন দিন ওর সব ভঙ্গি যা রাণুর চোখে আবেশ ছড়াতো, ওর গা থেকে খসে পড়বে শুকনো বাকলের মতো। হাসান আর দশ জনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। হয়তো হাসানের চোখেও রাণু দিনে দিনে ঠিক অমনটি হয়ে উঠেছিল।

 

২.

পিঠে সেঁটে থাকা ভারি ব্যাগ, ওয়াটার পট; ইউনিফর্ম পড়া স্কুল বয়ের মতো ছককাটা হাসানের জীবন। একটুও বুঝি এদিক ওদিক করতে নেই। পান থেকে চুনটাও খসতে নেই। ব্যাকরণসম্মত নিখুঁত জীবনযাপন। হেয়ালীর কোনো সুযোগ ছিলো না সেখানে। রাণু ভাবে, বিয়ের আগে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলো হাসান এসব নিয়মের বালাই! তখন তো সে ছিলো বল্গাহীন ঘোড়া। তাকে নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতো উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু। প্রশান্ত সাগরের জলের অতলে ওকে নিয়ে খেলা করতো নীল তিমির মতো। কোথায় গেলো তার ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে নিয়ে খুনসুঁটি করার কৌশল। তখন কেমন করে হেয়ালীপনাই বারবার তাকে মত্ত করে রাখতো! ছকের ঘোড়া কেমন করে ছকের সীমানা ছেড়ে বল্গাহীন হতে পেরেছিল।

হাসানের কী-ই না বদলে যাওয়া। যেই না ঘর বাঁধলো, ঘরটাও বেঁধে ফেললো ওকে। ঘরটা নিয়ে পড়িমরি করতে করতে বাইরটা হয়ে গেলো অধরা, আড়াল বা নির্বাসিত। প্রথম হোঁচট খেলেও অমন ছিমছাম ছকেবাঁধা জীবন কাটাতে কাটাতে রাণু খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। না হয়েই বা কি করবে, নগরজীবনে অত চুলচেরা নিয়ে ভাবাভাবির সময় কোথায়? এ শহরের সকল সুসজ্জিত কয়েদিও তার মতো জীবন কাটায়।  

মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠতো রাণু। কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায় তার ওই ঘরকন্যা করা স্যাঁতস্যাতে জীবনটাকে, ওটা কী কোনোকিছুর সাথে মেলানো যায়? বেশ যায়! ঠিক একটি এক্যুরিয়ামে ঠাঁই নেয়া মৎস্যকন্যা। যাকে রুটিন করে পানি বদলিয়ে দেয়া হতো। অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিকঠাক রাখা হতো। আর খাবার দেয়া হতো মেপে মেপে-একটু কম বা বেশিও না। ঠিক যতটুকু দরকার ততটুকু। আর তার চারপাশে ছিল নকল গহŸবর, ঘের দেয়া স্বচ্ছ কাচের দেয়াল। কাচের দেয়ালে বন্দী মৎসকন্যা সে। পরিষ্কার দেখা যাবে চারপাশটা। শুধু যাওয়া যাবে না, ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না। ওসব করতে গেলেই হাসানের ত্রিশ দিনের ছকে কাটা পূর্ব নির্ধারিত রুটিনে বাঁধা আসবে। আর তাতে দুঃশ্চিন্তা বিরক্তিতে সব কিছু ভেঙে পড়বে হাসানোর মাথায়। সে ছটফট করতে করতে মাথায় পিছনটায় চুলে বিলি কাটবে একটু পর পর। এখন যেমন সে করছে।

রাণু ওর এখনকার অবস্থাটা বেশ উপভোগ করতে পারতো। দেখতে পারতো তাকে নিয়ে হাসানের কি অসম্ভব উত্তাপ চলছে। শুধু কি হাসান, বাসায় উপস্থিত তিন/চারজন মানুষেরও তাকে নিয়ে হুল্লোড় ছুটাছুটি। কত গুরুত্ব আর কত সমাদর রাণুর! সবাই কত ব্যস্ত-ব্যাকুল ওকে নিয়ে! হে জনাব  জীবনসঙ্গী, পাটিগণিতের স্বজনরা, ভদ্র মহোদয়গণ! এতদিন কোথায় ছিলেন আপনারা?

এরপরেও অনেক কিছু চলছিলো, জগত-সংসারে রুটিন বাস্তবতার মহড়ায় যা হয় আর কী? কিন্তু ততক্ষণে ওসব বুঝার ক্ষমতা লোপ পেয়েছিল। তাকে ঘিরে সবার চেঁচামেচি, ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি বা আতঙ্ক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। যদিও কোনোটিরই কোনো মানে তার কাছে ছিল না।

 

৩.

শেষরাতে পৃথিবী ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়েছিল। এরই মাঝে আচমকা দৈব পতন। একটা অস্পষ্ট ঘোর সবার চোখে। চোখ কচলাতে কচলাতে ¯œায়ুর আড়ষ্টতা কাটাচ্ছিল। দু’চার মিনিট। সিঁড়িটা প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে হাসান রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কোনো কিছুরই দেখা মিললো না। খনিক পথ দৌঁড়ে আবার অগত্যা সে ঘুরে আসে। এরপর আশপাশের ফ্লাটে ছুটাছুটি করলো-তিনতলা দোতালার কলিংবেলে চাপ দিলো। কিন্তু সাড়া মিললো না। নীরবতার চাদর ঢেকে রেখেছে রাত তিন প্রহরের বসতিকে।

রাত সোয়া চার। মেইন রোডে চুইয়ে পড়া জলের মতো দু’একটি দূরবর্তী ট্রাকের একটানা মসৃণ শব্দ। তবে পাড়ায় বা গলিপথে চলাচলের লেশমাত্র অস্তিত্ব নেই। শুধু পথকুকুরদলের দু’একটা ঘেউ ঘেউ আওয়াজ বাসাবাড়ি বা বদ্ধ দোকানের দেয়ালে বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। অন্ধকারে ল্যাম্পপোস্টগুলো পথশিশুর মতো নির্জীব পড়ে আছে আর বিলিয়ে যাচ্ছে বরফের মতো চকচকে আলোক ছটা।

দু’বছর পরেই মেইন রোড। কিন্তু পথটা একেবারে কম নয়। হাঁপাতে হাঁপাতে গেলেও কোনো কিছুর দেখা মিললো না। রোড ডিভাইডারের মাঝখানে কলার কাদির মতো দু’পাশে তাতানো স্ট্রিটলাইট। রাস্তাটা আলোকিত থাকলেও বদ্ধ দোকানের বারান্দা বা পাড়ার গলিমুখে অন্ধকার লেপ্টে আছে। একসময় জনমানবহীন রাস্তাটাকেও মনে হচ্ছে অন্ধকার তেপান্তর। ছিমছাম ভৌতিক নীরবতা। তবে এমন সময়েই হঠাৎ করে ভিনগ্রহের সসারের মতো ডিউটি পেট্রোল এসে হাজির হয় আর নানা জেরা শুরু করে। হাসান দাঁড়িয়ে রইলো নিশুতিময় নিয়তির অপেক্ষায়।

মিনিট পাঁচেক পরে বিন্দুর মতো হেডলাইটের আলো এগিয়ে আসতে দেখা গেল। হাসান রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো-যা হয় হোক, উপর দিয়ে চালিয়ে দিলেও সে নড়বে না। রাজধানী শহরে এমন ভঙ্গিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এ কাজে কৌশলে মেয়েদের ব্যবহার করা হয়। তাই অধিকাংশ গাড়িই হাইলাইট ও পাস দিয়ে কৌশলে কাটিয়ে চলে যায়। কখনো বা হেলপার গাড়িতে রাখা লাঠি বের করে ঘা তুলে।

প্রায় কাছাকাছি আসতেই পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভার নিরুপায় হয়ে গাড়ি  ¯েøা করে। একটা জলজ্যান্ত মানুষ খুন করা তার পক্ষে সম্ভব না। হাসান কাঁপতে কাঁপতে পাশে আসতেই ড্রাইভার আঁচ করে যে যুবক অন্তত ছিনতাইকারী না।

রাণুর বডিওয়েট এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাকে পাঁচতলা থেকে নামানো চারজনের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। কিন্তু সবাই জানে অজ্ঞান বা মৃত্যুপথযাত্রী বা মৃত মেয়েটিকে নামাতেই হবে। রাণুর দেহ ছিল নিথর, চোখ দুটো পাতাবদ্ধ, পরাজিত; বিরক্ত অথবা বিক্ষুব্ধ। তার নাক ও ঠোঁটের দু’প্রান্ত দিয়ে তখনও চুইয়ে চুইয়ে ফোঁটা ফোঁটা কালচে রক্ত ঝরছিল।

এইট মান্থ। বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল, তখন থেকেই নাকে-মুখে বিøডিং।

রুটিন চেকআপে ছিল না?

ছিল।

সিভিয়ার এটাক।

 

 

৪.

জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও রাণু বুঝতে পারেনি। শেষেমেষ মৃত্যু একটু একটু করে পায়ে পায়ে তার দিকে আসতে লাগল এবং ক্রমান্বয়ে হিমশীতল অন্ধকার কুঠুরিতে তাকে ঠেলে দিতে থাকল। আর তখনই সে নিগূঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে পারলো বেঁচে থাকাটা কতটা মূল্যবান, কতই না জরুরি! গর্ভস্থ সন্তানের কথা মনে পড়তেই বেঁচে থাকার একটা অদ্ভুত আকুতি এর মাঝেই ক্রমশ বেয়াড়া হতে শুরু করেছিল। ততক্ষণে সবকিছু ক্রমশ ঝাপসা হয়ে উঠছিল।

রাণুর কাছে সে ছিল এক অনাগত-অচেনা অতিথি তবু যেন চিরচেনা। পরাশ্রয়ী অথচ তার চির আপন। বর্ণচোরা অথচ জ্যোতির্ময়। যার ক্ষীণতম অনুরণন মুহূর্তে সুখে ভরিয়ে দিতো তার কেন্নোর জীবনের অর্থহীনতাকে। তাকে আশ্রয় করে সজীব হয়ে উঠতো চেতনার কুঠুরিগুলো। শেষমেষ তার অস্তিত্বের মাঝেই তো রাণু  বেঁচে থেকেছে। ভ্রƒণ থেকে প্রস্ফুটিত হয়েই প্রতিমুহূর্তে জানান দিয়েছে তার সরব উপস্থিতি। খোলসাবৃত ও অন্তর্মুখী ছিল সে। কিন্তু শিহরণে, উপলব্ধিতে, শৈলীতে অনন্য। পরম মমতায় লালিত এক অমোঘ আত্মীয়। ভাংচুর হওয়া অস্তিত্বের মাঝে আর এক আকাক্সিক্ষত অস্তিত্ব। প্রতি পলে পলে লুকোচুরি খেলা ছিল ওর কাজ। আকাশের অসীম নীল জমিনে খিলখিল দাপিয়ে বেড়ানো ঘুড়ি। যেন কখনই নেমে আসবে না পৃথিবীতে।

রাণু জানতো একদিন ধরা সে দেবেই। খিলখিল হাসিতেই নেমে আসবে সে। তার কোল জুড়াবে, আবর্তিত হবে তাকে ঘিরে। রাণুর সুখ উতলে উতলে পড়বে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সীমাহীন ক্রমপ্রসারিত মহাশূন্যেই তার অস্তিত্ব ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। তলিয়ে যাচ্ছে সুদূর নীহারিকায়। দূর, দূর ক্রমাগত দূর শূন্যে নিঃসীম তার পথ চলা। এই মুহূর্তে কোথায় সে? এখন না আছে তার লুকোচুরি না স্পন্দন। সে কী শুধু অথৈ সাগরে দ্রæত তলিয়ে যেতে থাকা ছোট্ট নুড়িখÐ যাকে আর কখনই খুঁজে পাওয়া যাবে না?

ইতোমধ্যে এক দুর্লঙ্ঘ ঝড় সবকিছু লÐভÐ করে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে দিয়েছে রাণুকে। তাকে পরাস্ত  করে দিয়ে এখন তা শান্ত। ধীরে ধীরে অনুভুতিগুলো ফিকে হতে শুরু করেছে। এমন কি প্রিয় আমন্ত্রিত অতিথির আবিলতার শেষ আবেশটুকুও। কোথাও কোন স্পন্দন নেই। না ভেতরে, না পারিপার্শ্বিক মায়ার ইন্দ্রজালে। দেখতে দেখতে হাত-পা গুলো ক্রমাগত নুইয়ে পড়তে শুরু করল। আর অভাগা কোনো বাদুড়ের মতো যেন ঝুলে রইলো মরণঘাতী তারে। তার সহযাত্রী এখন প্রিয় ক্রুশবিদ্ধ শিশু যিশুু!

৫.

ঘর-বাড়ি-মাঠ-পুকুর শাঁ শাঁ করে পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। বিকট সাইরেন আর্তনাদের মতো আছড়ে পড়ছে দিগন্তে। পৃথিবীর মৃত্যু ঘোষণা করতে করতে অ্যাম্বুলেন্স ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। মনে হয় কেউ পেছন থেকে উদ্ধত তলোয়ার নিয়ে ধাওয়া করছে অ্যাম্বুল্যান্সটাকে। এই গতি গতরাতের দুঃসহ সময় আর তার ভয়ংকর প্রতিচ্ছবিগুলো থেকে পালিয়ে  নিয়ে যাচ্ছে।

পলায়ন সত্যিই জীবনের জন্য এক অন্যরকম প্রশান্তি। হাসানের মাথায় ঘূর্ণির পাক। অতীতের সব চিহ্ন গুলিয়ে গেছে তাতে। সে এখন যাবতীয় ক্লেদ থেকে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু সে কি সত্যিই তা থেকে নিস্তার পাবে? রাণু তো পাশেই শুয়ে আছে! রাণুর মুখ তো সে দেখতে পাচ্ছে না!

আড়াল করা দৃষ্টি। ভীষণ ক্লান্ত, মনমরা রাণু। সে কি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে না? কিন্তু ওর আর রাণুর মাঝে এখন দুর্ভেদ্য প্রাচীর। হাসান এক নিবিষ্টে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিটাকে আড়াল করতে রাণু নিজেকে দেয়ালে মুড়েছে। সে এখন অসম্ভব মূল্যবান হয়ে উঠেছে। তার সব ভঙ্গিমা কিছুই এখন অপ্রকাশিত। কেউ বুঝতেও পারবে না তাকে। দেয়ালের গায়ে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসান প্রাণপণে বের করার চেষ্টা করছে সেই মুখের ব্যঞ্জনা। হঠাৎ আচমকা বিষণœতার বেনো জলের তোড় ভাসিয়ে নেয় তাকে পলকা খড়কুটোর মতো। হাসান দুঃস্বপ্নতাড়িত ঘুম থেকে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে।

menu
menu