ইফতেখার ডাক্তারের স্বপ্ন ও বাস্তব

রোদ উবে গেছে। দাঁড়কাকের মতো একটা কালো মেঘ উড়ছে আকাশে, বিশাল পাখায় চারিদিক ঢেকে। তার নখরে কৃষ্ণ কুয়াশা। যদি কেউ বলে, কালো চাদরে ঢাকা কালো পেতনীর উড়াল, তাও ভুল হবে না। অথবা কালো-পালের কোনো বিপথগামী নৌকা। অবাস্তবও বাস্তব এখন, আলোতেও ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। তবে কালোপালের সব নৌকাই বিপথগামী হয় না, গ্রিসের উপকূলে ভিড়েছিল ট্যাসিয়াসের যে কালো-পালের নৌকা, তা ছিল বিজয়ের বার্তাবাহী। অবশ্য বিজয়ও বিপথগামী হয়, হয়েছে বহুবার, বহুদেশে, দৃষ্টান্ত খুঁজতে দূরে যেতে হয় না। তবে এসব উঁচুমার্গের কথা। এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়, বিশেষ করে, ডা. ইফতেখারের তো নয়ই। যখন জীবন ও মরণ নির্ভর করে একটিমাত্র বদ শ্বাস-গ্রহণের ওপর, তখন কে রাম, কে রাবণ, সে প্রশ্ন, আয়েশি তার্কিক ব্যতীত, খুব বেশি মূল্য বহন করে না।

একা চুপ করে নাস্তা করছে সে। সে সচরাচর সবার আগে ওঠে, নাস্তা করে কাজে যায়। সচরাচর নাসরিনও ওঠে। কিন্তু এখন উঠে লাভ নেই, কাছে আসতে পারবে না। ওরা উপরে, এখনো ঘুমে। যেহেতু করার কিছু নেই, যাবার জায়গা নেই, ইফতেখারই বলে দিয়েছে খুব ভোরে না উঠতে। সদ্যই ঘুম থেকে উঠলেও ভীষণ ক্লান্ত সে। মনে হয় ঘুমায়নি কত দিন! আজকের দিনটি গতকালের মতো, গতকাল ছিল আগের দিনের মতো এবং তার আগের দিনটি ছিল তারও আগের দিনের মতো... যেন কালো পিঁপড়ার পেছনে কালোপিঁপড়া কালো-দিন। খোঁজ করলে হয়তো নির্ণয় করা যাবে কবে শুরু হয়েছিল এই সব বিষণ্ণ দিনরাত্রির। শুমারহীন মৃত্যু ও লাশ কাঁধে নিয়ে যখন আন্তোনাইন (165-180 AD), সাইপ্রিয়ান (250-266 AD), জাস্টিনিয়ান (541-542) প্লেগগুলো ইউরোপ ও এশিয়া তছনছ করে চলছিল, সেই তখন? অথবা বুবনিক প্লেগের কালো মৃত্যু (১৩৪৬-১৩৫৩) যখন তার লাল জিভ বের করে ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা জনমানব শূন্য করেছিল কালী নৃত্যে, তখন? কিন্তু খুঁজেই বা কী হবে। তখনো তো সারা পৃথিবী এমনভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। বেনিয়ারা বাণিজ্য করেছে, কৃষকেরা শস্য বুনেছে, শিক্ষকেরা পড়িয়েছে, সৈন্যরা যুদ্ধ করেছে। সমস্ত পৃথিবী, এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত এমন থম্ করে দাঁড়িয়ে যায়নি কোনদিন। তাই পৃথিবী বদলে গেছে, উত্তর পুরুষ হয়তো সময়ের বিভাজন করবে AC (after corona ) এবং BC (before corona ) হিসাবে। 

ডা. ইফতেখারের কাজে যাওয়া দরকার। ডাক্তারের কাজ কাজে যাওয়া, রোগীর চিকিৎসা করা। অর্থ নয়, রোগী! কিন্তু ডাক্তার ফেরেশতা নয়, অর্থের প্রয়োজনীয়তা, মানবিক দোষগুন, ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো থেকে ডাক্তারকে কেউ মুক্ত করে দেয়নি। করোনায় মৃত্যু-ভয় ডাক্তারের নেই, এ কথা ভাবা ঠিক নয়।
মানুষ ঘরে বসে করোনার ভয়ে মারা যায়, ডাক্তার প্রতিদিনই করোনার সাথে মল্লযুদ্ধ করছে। একদিকে রোগীর প্রাণ, অন্যদিকে নিজের, কোনটার মূল্য কম, কোনটার বেশি? তবে বাঁচা মরা নিয়ে চিন্তা করার সময় কোন ডাক্তারেরই নেই, যদিও চিন্তাগুলি অসভ্যের মতো, অনুমতি না নিয়েই মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। বন্ধু সালাম মারা গেছে রোগী দেখতে দেখতে। সাইফুলের যখন শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, সে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে নাই। মইনুলও গেছে চট করে। আশা ভেন্টিলেটরে, ডোরিসের টেস্ট পজিটিভ।

রুথের আত্মহত্যার খবরটি ধূসর পৃথিবীটাকে সম্পূর্ণ রঙহীন করে দেয়। খুব বেশি সময় দিত সে রোগীদের পেছনে, করোনা শুরু হবার মাস দুই আগে ওর স্বামীর অবিশ্বস্ততা ধরা পড়ে। সেই থেকেই অসম্ভব ডিপ্রেশনে ভুগতো। দিনরাত হাসপাতালেই পরে থাকতো। শেষ পর্যন্ত এমন হয় যে, কোনটা তার নিজের কষ্ট, কোনটা রোগীর সে আর তফাত করতে পারতো না। যখনই কোনো রোগী মারা যেত, সে কাঁদতো। কিন্তু তার কান্না মৃত্যু থামানোর জন্য কার্যকর কিছু ছিল না। কাঁচি হাতে মাথাল মাথায় চাষির মতো করোনা আসে মৃত্যুর ফসল তুলতে। অচিরেই সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তার মনে হতে থাকে, সে অকর্মণ্য ডাক্তার, তার শিক্ষার কোনো দাম নেই, কী করে এমন হয় যে, ভেন্টিলেটর থেকে একজন রোগীকেও সে জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে না। আর তাই যদি হয় বেঁচে থাকার কী অর্থ? কাউকে কি সে বলেছে তার এই চিন্তার চলাচলের আলপথের কথা? না। ডাক্তার হচ্ছে সবচাইতে বাজে রোগী!

২.
ফুল ফুটুক বা না ফুটুক, বসন্ত বসন্তই, তবে বসন্ত এবারও বঞ্চিত করেনি, মৃতপুরীতে ফুলের ঝুড়ি উপচে পড়েছে। মানুষ মরছে, ফুল ফুটছে।
পৃথিবী মানুষশূন্য হয়ে গেলেও কি ফুল ফুটবে? 
মানুষ যখন ছিল না, ফুল কি ফোটেনি?
আজব একটা চিন্তা ঘুরপাক খায়। ড্রাইভ করতে করতে ইফতেখার ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা, থামা জীবনে সামান্য স্পন্দন তুলে, কদাচিৎ একটা দুটা গাড়ি দেখা যায়। যে শহরে এক মুহূর্তের স্বস্তি ছিল না, সেখানে ফুল দেখতে গিয়ে গাড়ির গতি কমে গেলেও কেউ পেছন থেকে হর্ন দেয় না। এক জোড়া শালিক হাঁটছে রাস্তার পাশ দিয়ে, তাদের পায়ের আঙুলগুলো এমনকি নখগুলোও দেখা যায়। হাঁটে তারা হাস্যকরভাবে, হেলে দুলে, ধীরে সুস্থে। ডা. ইফতেখার যেন সেই শালিকের পায়ে হেঁটে হাসপাতালের দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢোকে। এই মৃত্যু-প্রাসাদ এখন “করোনা হাসপাতাল”, যেখানে আজরাইল ফুলটাইম চাকরি নিয়েছে। অন্য সব রোগীদের অন্য হাসপাতালে সড়িয়ে নেয়া হয়েছে।

প্রতিদিনের মতো মাস্ক, গ্লাভস, মাথা ঢাকা গাউন, গগলস গায়ে চাপিয়ে ডা. ইফতেখার ফ্লোরে যায়। দেখতে তাকে ভিনগ্রহের প্রাণির মতো মনে হয়। ফ্লোরে সবাই দেখতে তার মতোই অপরিচিত। তারই অবয়বহীন,অ্যালিয়েন, অসংখ্য সহকর্মী। বাইরে অজস্র ফুল কিন্তু এখানে সারা বছর ফুলের প্রক্সি দেয়া নার্সদের আর চেনা যায় না। তাদের চোখের ঝিলিক, ঠোঁটের মিমিক, বুকের ঢিমিক, বা হাসির রৌদ্রকণা সবই এখন ভাইরাস প্রতিরোধকারী কস্টিউমে ঢাকা। প্রতিদিনই তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আসে এখানে। শিরদাঁড়া বেয়ে শির শির করে ভয় যে, হয়তো আজই ঘটনাটি ঘটবে। সমস্ত সাবধানতা সত্যেও করোনা ঠিকই খুঁজে নেবে প্রবেশের পথ। কাচের মতো ভঙ্গুর করে দেবে ফুসফুসের বুদবুদগুলো, ফাঁসিতে ঝুলানো মানুষের মতো থমকে দাঁড়াবে শ্বাস-প্রশ্বাস। শ্বাস হলো একটি মুহূর্ত, কিন্তু মোটেও ড. ফাউস্টের সুন্দরতম মুহূর্ত নয়।

সে ফ্লোরে রাউন্ড দেয় আনমনে। যাদের গতকাল রেখে গিয়েছিল, তাদের অর্ধেক নেই। মানে আছে, মর্গে। অনেক নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। তারাও আগামীকাল বিছানা খালি করে চলে যাবে। সবারই অবস্থা ক্রিটিকাল। স্ট্যাবল যারা, তারা আর হাসপাতালে আসে না। হাসপাতাল এখন স্বাস্থ্য-সেবা পেয়ে সুস্থ হবার জায়গা নয়, বরং উল্টা, যাদের অস্তিত্বে অনস্তিত্বের লালবাতি জ্বলেছে, তাদের শেষ সময়টা কাটানোর স্থান। সে রোগীদের ঘুরে ঘুরে দেখে, কেইস হিস্ট্রি লেখে।

“ডক্, তোমার শরীর ভালো তো?”
সারা জিজ্ঞেস করে। কণ্ঠ ছাড়া চেনার উপায় নেই।
“আছি, ভালো আছি সারা, তুমি কেমন?” দুজনই মলিন হাসে, কিন্তু কেউ কারো হাসি দেখতে পায় না। সারা তার জীবনের ৩৫ বছর এই ফ্লোরে কাজ করেছে। এমন সে কখনো দেখেনি। দুজনেই যেন স্পষ্ট শুনতে পায় কারা কথা বলছে, “রোমের ভিত্তিতে চিড় ধরিয়ে দিয়েছিল সেই মহামারি, প্রতিদিন ৫০০০ করে লোক মারা যেতো। মড়ক শেষ হতে হতে মৃত্যুসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫০ লক্ষ। রোম শহর উজার হয়ে গিয়েছিল। এ শহরও কি রোমে পরিণত হবে?” আন্তোনাইন প্লেগ নিয়ে কেউ কথা বলছে, বাইরে না মগজে, বোঝা যায় না। আগে মর্গ ছিল হাসপাতালের সামান্য একটু অংশ নিয়ে, এখানে তার বিস্তার বাড়ছে, এই গতিতে চলতে থাকলে হয়তো অচিরে মর্গই দখল করে নেবে পুরোটি হাসপাতাল, এবং ডাক্তার নার্স হবে মর্গের দৌবারিক। 

ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ক্লান্তি ও ডিপ্রেশনে পা চলে না। কাজ থেকে ফিরে ইফতেখার জামা কাপড় চেঞ্জ করে গ্যারেজে। তারপরে সরাসরি বাথরুমে চলে যায়। স্নান করে। মেয়েরা দোতলায় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলে। নাসরিন নেমে আসে সিঁড়ির শেষ ধাপে। কিন্তু এর বেশি কাছে আসা তাদের নিষেধ। ৬ ফুট ১২ ফুটের কোনো প্রশ্ন এখানে নেই। যে প্রতিদিন করোনা নিয়ে নাড়াচাড়া করে তাকে মনে করতে হবে করোনার রোগী।

মেয়েরা কাছে এসে বাবাকে আলিঙ্গন করতে চায়। আমেরিকার ব্যস্ত জীবনের রুটিন মেনে যা চলে এসেছে চিরকাল, তাতে যতি পড়েছে। বুকটা হুহু করে, ওদের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কঠিন অনুশাসনে সে ঢিলা দিতে পারে না। এক মুহূর্তের দুর্বলতা সারা সংসার ধ্বংস করে দেবে। ইফতেখার যেন পাথর বা অনুভূতিহীন রোবট। মানুষ যদি মানুষের কাছে আসতে না পারে, প্রিয় যদি প্রিয়জনকে স্পর্শ করতে না পারে, তাহলে এই বেঁচে থাকায় আনন্দ কোথায়? যুক্তি দিয়ে বাঁচা কি সত্যিকারের বাঁচা? ভালোবাসা কি যুক্তির শৃঙ্খল মেনেছে কোনোদিন? ঘরের এই মানুষগুলো বন্দি। বাইরের পৃথিবীর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। একমাত্র ইফতেখার বাইরে যায়। টুকটাক বাজার করতে হলে সেই করে। কখনো দূরত্বে থেকেই নাসরিনের সাথে কথার আদান-প্রদান হয়। 

“কী খবর, কেমন আছো?”
“ভালো।”
“মেয়েরা কেমন?”
“ভালো, সারাদিন ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস করে, আর খেলে, গান শুনে দিন কাটায়। এ ছাড়া করবেই বা কী?”
বিশেষ কিছু বলার থাকে না। আজ ১৫ জন মারা গেছে ফ্লোরে। ৪ জন ডাক্তার আর ৫ জন নার্স অসুস্থ। পিপিই নাই, টেস্টিং কিট নাই, লোকবল ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাসাপাতালের মর্গে জায়গা শেষ হয়ে গেছে, মোবাইল ফ্রিজ-মর্গ এনে এন্কর করা হয়েছে হাসপাতালের পাশেই। একটি নয় কয়েকটি। এ কথা কি বলা যায়? উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে লাভ কি? সেই বরং সব সময় বলে টিভি বন্ধ রাখতে, খবর শুনলে সুস্থ যে কেউ পাগল হয়ে যাবে।

৩.
বেডরুমে গিয়ে বই খুলে পড়তে চেষ্টা করে, কিন্তু মন বসে না। ঘুমাতে চায়, ঘুম আসে না, যদিও ক্লান্তি, মনোমান্দ্য ও মনোবৈকল্যে শরীরের প্রতিটি আঁশ বোধ হারিয়ে ফেলেছে। চোখ বুজে পড়ে থাকে। কখনো যদি ঘুম নেমে আসে, তা ঘুম নয়, কাশমার! দুঃস্বপ্ন। সে যেন অদৃশ্য এক উচ্চতা থেকে ভারি পাথরের মতো নিচে পড়তে থাকে, দ্রুত থেকে দ্রুততর, সে তার চামড়ায় অনুভব করে পতনের ত্বরণ, ধরফর করে জেগে ওঠে।  এভাবেই সে আধা ঘুম আধা তন্দ্রার ডিঙি নৌকায় দোলে। “কোড ব্লু সেকোন্ড ফ্লোর”,  “কোড ব্লু সেকোন্ড ফ্লোর”, “কোড ব্লু...” সে পরিস্কার ঘোষণাগুলো শুনতে পায়। মৃত বা মৃত্যুমুখী রোগীর কাছে দ্রুত ছুটে যাবার আহ্বান। হাসপাতালের করিডোর নয়, যেন মার্ক অরেলিয়াসের রোমের অলিগলি।

গতকাল নাসরিন বলেছিল, জানো রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। আমি কোন একটা শিশুকে বুকের দুধ দিচ্ছি। শিশুর মুখটি দেখতে পাই না, কিন্তু মনে হয়, বয়েস ২ বা ৩। লিকলিকে, হাড় থেকে হাড় পৃথক, চোখগুলো বড় বড়, যেন মাছের ডুলার গভীরে বসানো। একটি বেঞ্চে শুয়ে সে আমার স্তন চুষছে। আমি উবু হয়ে বুক দিচ্ছি। বলি, এভাবে আমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি বরং আমার কোলে এসে শোও। বলতে না বলতেই সে আমার কোলে এসে শুয়ে পড়ে। বেশ লম্বা, আমার কোলে আটেনা, তারপরেও যেভাবে মেয়েদের স্তন দিতাম, সেভাবে বুকে চেপে রাখি। আমার কি যে ভালো লাগে! মনে হয় যেন বয়েস অনেক কমে গেছে, আমি পৃথিবীর মতো বুড়ি নই। আমার স্তন ফুলে ওঠে, আমি দুধের প্রবাহ টের পাই, একটা অপার প্রশান্তি মগ্ন চৈতন্যের আফিমে দ্রবীভূত হতে থাকে...

আসলেই অদ্ভুত স্বপ্ন। মেনোপজে পৌঁছে মেয়েরা বা মায়েরা কি এমন স্বপ্ন দেখে? করোনা, গৃহবন্দিত্ব, কোটরাগত চোখের ক্ষুতার্ত শিশু, বুড়ো পৃথিবী, মাতৃত্বের আনন্দ… কেমন হেঁয়ালি যেন! গতকাল থেকে গায়ে জ্বর জ্বর বোধ করছে ইফতেখার। একটা শুকনো কাশি খুশ খুশ করে গলায়। নাসরিন শঙ্কিত, কিন্তু সে পাত্তা দেয় নাই। ঠিক যে দেয় নাই তা নয়। নাসরিনকে ঘাবড়ে দিতে চায় নাই। নিজেও জানে না সে সুস্থ না অসুস্থ। চেতনার ওপরে এমন চাপ যেখানে, সেখানে মুমূর্ষ অবস্থায় না পৌঁছালে কোনটা সুস্থ, কোনটা অসুস্থ পৃথক করা মুশকিল। তার কখনো অ্যাজমা ছিল না কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে যেন শ্বাস-ফতুর এক অ্যাজমা রোগী। তা সত্ত্বেও সে ঘুমিয়ে পড়ে। মনে হয় যেন মাথার উপর দিয়ে বিশাল বুমেরাংয়ের আকারে অসংখ্য হাঁস উড়ে যাচ্ছে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে ব্যাপক কোলাহল তুলে। সে মনোযোগ দেয়, না আওয়াজটা ঠিক হাঁসের আওয়াজের মতো নয়। ব্যাঙ, অসংখ্য ব্যাঙ ডাকছে। কম করে হলেও ১ লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার সোয়া সাতষট্টিটি ব্যাঙ। হঠাৎ তার চিন্তায় ছেদ পড়ে, আজব ও অযৌক্তিক এই সংখ্যাটার উৎপত্তি কোথায়, সে বুঝে উঠতে পারে না। মগজে হাতড়ায়, চিন্তার সহি কোনো মোকাম খুঁজে পায় না। শুধু পায়ই না, আরো একটি প্রশ্ন গড়িয়ে আসে, ব্যাঙের সংখ্যা ভগ্নাংশ অর্থাৎ ‘সোয়া’ হয় কি করে? এবং সে নিজেই তাজ্জব হয়। সত্তার ভেতরে, মানে সমুদ্র-তলার মত মনের অনেক গহীনে, আরো কেউ বাস করে কি? কে যেন বলে, সোয়া যেটা তা হলো ব্যঙ্গাচি, একটা আস্ত ব্যঙ্গাচি, সবার সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে শিখছে। সে নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না, ক’জনের সমষ্টি সে? একজন? না-দুজন? না-কোনোজনই নয়?

বিষয়টি তীব্রতর হয় যখন কেউ যুক্তি নিয়ে দাঁড়ায়—মধ্য শহরে, যেখানে অজস্র দালান, কংক্রিট-পিচের রাস্তা, দোকানপাট, হকার, ফুটপাতে দোকান-পাট, রসালো চটি বই এবং যেখান থেকে ডোবা নালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে কম করে হলেও ১২৯ বছর আগে, যেখানে গাড়ির প্যাঁ প্যাঁ, রিক্সার টুন টুন, সিএনজির ভট ভট অতিক্রম করে স্পষ্ট গলায় কেউ একজন গালি দেয়, “অই শালার পো শালা, তর মায় রে...”—এতসব জীবন চাঞ্চল্যের মধ্যে এত অসংখ্য ব্যাঙের ডাক কী করে সম্ভব? নাকি তার মস্তিষ্কের মরা ডোবায় কোনো বিশাল অরাজকতা ও বিভ্রাটের ডুগডুগি বাজতে শুরু করেছে! এবং সে জেগে ওঠে। কাশিটা ব্যাঙগুলোর মতো ডাকতে থাকে। সে বুঝতে পারে না সে ঘামছে কিনা, শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে কিনা। সে আধা-জাগ্রত আধা-নিদ্রা, দুই আধা’র ঘোলনায় ওলট পালট ডুবা-ভাসা করে। দেখতে পায় তার বাড়ির পাশ দিয়ে ঢোরা সাপের মতো দ্রুত ছুটে যাওয়া, তীব্র কটালের বর্ষার খালটি। খালের উপরে হিজল গাছ, জলে হিজল পাতার প্রতিবিম্ব। জলে দুলতে দুলতে দ্রুত ভেসে যাচ্ছে একান্তই দলছুট, দুরন্ত একটি কচুরি, মাথায় এক মঞ্জরি ফুলসহ। তার শিকড়গুলো জলে দেখা যায়। পুষ্পমঞ্জুরির দিকে তাকাতেই চোখের সামনে ফুলগলো অনবতুল এক কিশোরীতে বদলে যায়। নাসরিন নয়, অবিকল অর্চির মুখের মত মুখ তার। অর্চি কে? হঠাৎ প্রশ্ন জাগে। সে মনে করার চেষ্টা করে।

অর্চি, অর্চি, অর্চি, নিজের চুল ধরে টানতে টানতে যেন অন্তঃস্থলে জপ করে। দরজা জানালা রুদ্ধ, অন্ধকার প্লেগ বা করোনাক্রান্ত কোনো নগরীতে নিজেকে মাথান্যাড়া পথহারা মনে হয়। অনুসন্ধানের ঘুটঘুটে টানেলে দূরাগত ক্ষীণ কোন কিরণের একটি মাত্র রশ্মি দেখতে পায়। কিন্তু আলোর উৎসটি মুখ ঢেকে থাকে। তা সত্ত্বেও ইফতেখারের হৃদয়ে কী এক প্রশান্তি দোলা দেয়। মৃদু আন্দোলিত জলে প্রস্ফুটিত হিজল ফুলের প্রতিবিম্বের দোলনের মতো ।
কিন্তু অচিরেই দুর্ঘটনা ঘটে। হঠাৎ সিলিং থেকে নিজস্ব জালে প্যারসুটের মতো উড়াল দিয়ে একটি মাকড়সা পড়ে তার মুখে। মাকড়সা জালের অদৃশ্য সুতাগুলো এক অস্বস্তিকর পারেস্থেশিয়ার সৃষ্টি করে। বারবার হাত দিয়ে মুছেও সে তা থেকে মুক্ত হতে পারে না। অসম্ভব ব্যতি-ব্যস্ত থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ দেখে মাকড়সাটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে অ্যালিয়েনের মতো ড্যাব ড্যাবে চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

সে ডান হাত দিয়ে একটা মস্ত চড় মেরে বেহায়া কীটটিকে তাড়াতে যায়, এবং প্রায় সাথে সাথেই জমে যাওয়া ভারী সিমেন্টের বস্তার মতো একটা অসহ্য ওজন তার ফিজিওনমিতে ল্যান্ড করে। এবং ভোর হয়ে আসে।বাইরে অসংখ্য পাখির কিচির মিচির শুরু হয়। এত পাখির ডাক শৈশবের পরে ডা. ইফতেখার কোনদিন শোনেনি। হয় পাখিই ছিল না, নয় মনোযোগ দেবার সময় ছিল না। অথচ কী অদ্ভুত পাখিদের হাট এখন! প্রত্যেকের নিজস্ব কণ্ঠ, নিজস্ব সুর। যেন অপার আনন্দ তাদের মনে। তারা কি মানব-শূন্য পৃথিবীর ইঙ্গিত পেয়েছে প্রকৃতির কোন কোণা থেকে? ডা. ইফতেখারের চোখে হঠাৎ রাজ্যের ঘুম এগিয়ে আসতে থাকে আর্কটিক, এন্টার্কটিক মহাদেশ, আফ্রিকার জঙ্গল, আমাজন বন, এশিয়ার স্তেপ ইত্যাদির উপর দিয়ে রণ পায়ের মতো বড় বড় পা ফেলে।এবং সে ঘুমিয়ে পড়ে অসংখ্য পাখির হৈ চৈ ডাকাডাকি অগ্রাহ্য করে। 


• ওকালা, যুক্তরাষ্ট্র

menu
menu