হোজ্জার প্রতিপক্ষরা

‘দেশে-বিদেশে’ গ্রন্থে সৈয়দ মুজতবা আলীর বিকেল-বেলার স্বাস্থ্য-ভ্রমণ সঙ্গী মুইন-উস-সুলতান এক টালমাটাল সময়ে হঠাৎ রাজা হয়ে গেলে অধ্যাপকদের দল সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে আসে! এদেমর কারোর দরকার ছিলো লম্বা ছুটি, কারোর পদোন্নতি, কারোর বা লাভজনক পদায়ন। সৈয়দ সাহেবের বন্ধু মৌলানা তখন বললেন, ‘স্বপ্নেই যদি পোলাও খাবেন তবে ঘি ঢালতে কঞ্জুসি করছেন কেন? যা চাইবার দরাজ দিলে চেয়ে নিন।’ এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হবে হোজ্জার কাজি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার গল্পটি। হোজ্জা মাত্র কাজি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। সে দেখলো, কদিন আগের জীবনের সঙ্গে এখন বিস্তর ফারাক! এখন তার আর ইয়ার বন্ধুদের অভাব নেই! সকাল-বিকাল বন্ধুরা হাজির হয়। একালে হলে হয়তো ফেসবুক ভরে যেতো হোজ্জার সঙ্গে সেলফিতে। এতো এতো বন্ধু দেখে তার সেরেস্তোদার জিজ্ঞেস করলো, হুজুর, আপনার বন্ধু কজন? হোজ্জা বললো, এখন গুনবো না। আগে আমার কাজিগিরির মেয়াদ শেষ হোক তারপর গুনে দেখবো। এখন প্রকৃত সংখ্যাটা পাওয়া অসম্ভব। হোজ্জা ক্ষমতার সঙ্গে বসবাস করেন নি। ক্ষমতার সঙ্গে ওঠবস করেছেন মাত্র। এতে  ক্ষমতা হয়েছে বিব্রত আর ক্ষমতাবানরা তার উপহাসের পাত্র।

নাসিরউদ্দিন হোজ্জার বিচক্ষণতায় প্রতিবেশীদের খুব আস্থা ছিলো। এক জমিদারের অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ হয়ে হোজ্জার কাছে জানতে চেয়েছিলো, ‘মরার পর অত্যাচারী জমিদার বেহেশত যাবে, না দোজখে যাবে?’ তারা আসলে সান্ত্বনা খুঁজছিলো অন্তত এ নির্যাতক দোজখে যাক, হোজ্জার এমন উত্তরে! কিন্তু হোজ্জা বলেছিলো, ‘কোনো সন্দেহ নেই জমিদার বেহেশতই যাবে। কারণ, লোকটা যেমন চতুর, বুঝতে পারি সে দরিদ্র কোনো প্রজাকে তার পরিবর্তে নরকে পাঠিয়ে সে ঠিকই বেহেশতে জায়গা করে নেবে। ‘এটা যে অসম্ভব কিছু না সেটা আমাদের দেশের কাণ্ডকারখানা দেখলে বোঝা যায়। বাংলাদেশে একটা মুভি হয়েছিলো এ বিষয়ে ‘আয়নাবাজি’। একজনের সাজা আরেকজন খেটেছে। ছবিটা ভালো ব্যবসা করেছে। মানুষ আমাদের ব্যবস্থা সম্পর্কে এমনই মনে করে হয়তো। তার আগে ‘মনপুরা’ ছবিটাও জনপ্রিয় হয়েছিলো বলে শুনেছি। সেটাতেও ভূস্বামী-সন্তানের হত্যাকাণ্ডের সাজা ভোগ করেছে দরিদ্র কামলা। সিনেমায় কল্পনা করতে হয়, আর বাস্তবে আকসার পত্র-পত্রিকায় এমন ঘটনা ছাপা হতে দেখি! ভুল ব্যক্তির জেলজীবন! এ সব দেখে আটশ বছর আগের হোজ্জার বিচক্ষণতার বিষয়টা সামনে চলে আসে।

সাধারণভাবে হোজ্জার বোকামি আর বেহুদা পাগলামির যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে আছে তার বিপরীতে চালাক-চতুর হোজ্জাকে আমরা পাই জমিদার, রাজা, কাজি এ ধরনের চরিত্রগুলোর সঙ্গে কথোপকথনে। হোজ্জার গল্পে তাই তৈমুরলঙ (১৩৩৬-১৪০৫) একটা জনপ্রিয় চরিত্র। তুর্ক-মঙ্গোল এ বিজেতা-যোদ্ধা একবার  হোজ্জার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোমার কাছে আমি কেমন মানুষ?’ মুখের ওপর এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ ছিলো না হোজ্জার জন্যে। তাই চতুরতার সঙ্গে সে বলেছিলো, ‘এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনো হয় নি।’  নিজের প্রশংসা শোনার জন্যে অধীর তৈমুরলঙ যখন আবার জানতে চাইলো, “তাহলে কখন উত্তরটা পাওয়ার সময় হবে” তখন হোজ্জা বাধ্য হয়ে বলেছিলো, “আপনার মরার পর।’ এ ধরনের একটা কৌতুক পড়েছিলাম সোভিতভস্কি কৌতুকভে।

            এটা ছিলো ক্রশ্চেভের যুগ। দাদিকে জিজ্ঞেস করছে নাতি; লেলিন কি ভালো ছিলেন?
            : হ্যাঁ, খুব ভালো ছিলেন।
            : আর স্তালিন ছিলেন খুব খারাপ, তাই না?
            : হ্যাঁ।
            : আর ক্রশ্চেভ কেমন?
            : এখনো জানি না। মরুক আগে। তারপর বলা যাবে।

তৈমুরলঙকে নিয়ে আরও কিছু কৌতুক পাওয়া যায়। যদিও হোজ্জার আর্বিভাবকাল আর তৈমুরের মধ্যে ব্যবধান দেখা যায়। সে সব ইতিহাসের বিষয়। আমরা লোক-ঐতিহ্যের হোজ্জার গল্প নিয়ে ভাবি বরং।

তখন তৈমুরলঙের সেরা সময় চলছে। দেশকে দেশ জয় করে চলেছেন তিনি। ছদ্মবেশে একবার তৈমুরলঙ একটা দরবেশি কুর্তা পরে আকসেহিরের জনপদে হাঁটতে লাগলেন। তখনো শহরটি তৈমুরলঙের দখলে আসেনি। রাস্তায় রাস্তায় মানুষজন তৈমুরের নিষ্ঠুরতার কথা বলছিলো। তৈমুরলঙ একটা জমায়েতের দিকে এগিয়ে গেলো যেখানে হোজ্জা দেশেদেশে তৈমুরলঙের নিষ্ঠুর অভিযান সম্পর্কে বক্তব্য রাখছিলো। দরবেশবেশী তৈমুরলঙ বললো, তোমার বক্তব্য ফিরিয়ে নাও হোজ্জা, তৈমুরলঙ শুনলে বিপদে পড়বে। তৈমুরলঙের জবান শুনে হোজ্জার সন্দেহ হলো, বললো, ওহ, প্রাজ্ঞ দরবেশ, কোন তখতআসন থেকে আপনার আবির্ভাব?  আপনি কোথা হতে এসেছেন? 

: আমি খোদার চাবুক। লোকটি বললো। এই বাক্যটি শুনে হোজ্জা সঙ্গে সঙ্গে তৈমুরলঙকে চিনতে পারলো। আবার জনতার দিকে ফিরে তার দুহাত উঁচু করে তুললো, তারপর বললো, ওহ, মোহাম্মদের ( স.) অনুসারীগণ! আমার জানাযার জন্য প্রস্তুত হও। এখনি তা অনুষ্ঠিত হবে। 

এরপরের গল্পটাও তৈমুরলঙকে নিয়ে।
 

তৈমুরলঙের বাহিনী নিয়ে তার ছিলো অনেক অহঙ্কার। সে মনে করতো তার জগতজোড়া খ্যাতির পেছনে এ বাহিনীর কর্তাদের অনেক ভূমিকা আছে। একবার তৈমুরলঙ তাঁর তীরন্দাজ বাহিনীর মহড়া দেখতে গেছেন। সঙ্গে ছিলো হোজ্জা। বাদশাহ নানা সময়ে হোজ্জার হাতে নাস্তানাবুদ হন। এবার ভাবলেন হোজ্জাকে একটু বাজিয়ে নিলে কেমন হয়! বললেন, হোজ্জা তুমি কি আমার তীরন্দাজদের মতো লক্ষ্যভেদ করতে পারবে? হোজ্জা ভাবলো পারবো না বললে বাদশাহ দুকথা শুনিয়ে দেবে। ও যে এ কাজের জন্য নিযুক্ত নয় সেটা ভাবতে চাইবে না। তাই বললো, অবশ্যই পারবো জনাব। তীরন্দাজ হিসেবে ভালোই দক্ষ ছিলাম।

“তাহলে দেখাও তো তোমার তীরের কেরামতি।”

হোজ্জা খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রথম তীরটা ছুঁড়লো। এ তীরটা লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে গিয়ে পড়লো। উপস্থিত সৈনিকেরা বিদ্রুপের হাসি হাসলো। হোজ্জা বাদশাহকে বললো, এটাতো আমি ছুড়েছি  আপনার প্রধান সেনাপতির মতো করে। এটা আপনার প্রধান সেনাপতি ছুড়লে যা হতো তাই হয়েছে।

পরের তীরটাও লক্ষ্যের ধারে কাছেও গেল না। সিপাহি-জনতার কোলাহল শুরু হলো। জনতাকে শান্ত করতে হোজ্জা বললো, এটা ছিলো উপ-প্রধান সেনাপতির ছোড়া তীর।

তৈমুরলঙ অপেক্ষা করছিলেন, এরপর হোজ্জা কী করে দেখতে। এভাবে হোজ্জা আরও কয়েকবার চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হলো যথারীতি। প্রত্যেকবার তীর লক্ষভেদে ব্যর্থ হলে পর হোজ্জা তৈমুরের এক-একজন সেনাপতির ছোড়া তীর বলে চালিয়ে দেয়। শেষতক একটা তীর লক্ষ্যভেদ করলে হোজ্জা চিৎকার করে বলে উঠলো, এটা হুযুর আমার নিজের ছোড়া তীর। দেখেন এটা কেমন লক্ষ্যভেদ করেছে।
 

তীর ছোড়ায় অদক্ষ হলেও কথায় যে হো্জ্জা পাকা ছিলো তা আর বলতে! আফগান মেয়েরা নাকি খুব চালাক। তারা জানে যে, ‘ধনীর কাছ থেকে টাকা বের করা শক্ত কিন্তু গরিবের দরাজ হাত।’ কথাটা সৈয়দ মুজতবা আলীর। তাই অবিশ্বাস করি কীভাবে? হোজ্জাকে এ ক্ষেত্রে আরও চালাক বলা যায়। হোজ্জা যেভাবে রাজার কোষাগার থেকে ২০০০ স্বর্ণ মুদ্রা খসিয়ে নিলো সেটা বেশ মজারই বটে।
 

মাথায় খুব সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন দামি একটা পাগড়ি পরে নাসিরউদ্দিন দরবারে গেল। সে জানতো এটা রাজা খুব পছন্দ করবে এবং সে সুযোগে এটা সে রাজার কাছে বিক্রি করে দিতে পারবে।

"এতো সুন্দর পাগড়িটা কত দিয়ে কিনেছো, মোল্লা।" বাদশাহ যথারীতি জানতে চাইলেন।

"দাম একটু বেশিই পড়েছে হুজুর।  ১০০০স্বর্ণমুদ্রায় জিনিসটা হাতে পেলাম।" 

রাজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন উজির। রাজার কানে কানে বললেন, " কোনো বেকুবই কেবল একটা পাগড়ির জন্য এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করবে।" 

রাজা বললেন, "এতো টাকা কেন দিলে একটা পাগড়ির জন্য? আমি কখনো শুনিনি একটা পাগড়ির দাম ১০০০স্বর্ণমুদ্রা হতে পারে।"

 "মহাশয়, আমি এটা জেনে শুনে কিনেছি। আমি জানি যে এ পাগড়ি কেনার মতো বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে কেবল একজন রাজাই আছেন। তিনি কেবল এর মূল্য বুঝবেন।"

এ কথা শুনে রাজা আর দেরি করলেন না। হোজ্জার তোষামুদিতে খুশি হয়ে দুই হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে পাগড়িটা কেনার জন্যে হুকুম দিলেন।

হোজ্জা এবার উজিরের কানে কানে বললেন, "তুমি হয়তো পাগড়ির আসল দামটা জানতে পারো, কিন্তু মনে রেখো আমি জানি রাজার দুর্বলতা কোথায় সেটা।"
 

রাজার ব্যাপারে হোজ্জা একটু বেশিই কঠোর বলে মনে হয়। কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘বাঘ হতে ভয়ঙ্কর কু-রাজার দেশ’। সৈয়দ সাহেব এর সঙ্গে অন্ত্যমিল দিয়ে লেখেন, ‘তারও বাড়া হবে ডাকু পরে রাজ-বেশ।’ সৈয়দ সাহেব কথাটা বলেছিলেন বাচ্চা সকাও (আফগান উপজাতি দস্যু) নামে এক ডাকাতের কাবুল আক্রমণের প্রেক্ষাপটে। এসব ক্ষেত্রে রাজা বলেন আর ডাকাত বলেন যেমনই হোক ক্ষমতাবানদের শ্লেষে-বিদ্রূপে নাজেহাল করে ছাড়তে দেখি হোজ্জাকে। এ ধরনের দুটো গল্প আমরা এখন হাজির করবো। দুটোই চীনা বংশোদ্ভুত গল্প। যেখানে হোজ্জা উইঘুরদের কাছে আফান্দি বা আফেন্দি নামে পরিচিত। গাছের ছায়া কেনা সহজ কাজ নয়। হোজ্জা সে কাজে বিনিয়োগ করে সুফল পেয়েছিলো, শুরুতে সে গল্প।
 

গ্রামের প্রধান সড়কের পাশেই ছিলো ধনীলোকটির বাড়ি। রাস্তা আর বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বড় বটগাছটি ছিলো পথচারীদের বিশ্রামের অবলম্বন। সকাল আর দুপুরবেলায় গাছটির ছায়া পড়তো  রাস্তা জুড়ে আর রাস্তার ধার ঘেঁষে। বিকেল-সন্ধ্যায় সে ছায়া বাড়তে বাড়তে লোকটার বাড়ি অতিক্রম করতো। গ্রামবাসী আর ক্লান্ত পথিকদের আশ্রয়দানকারী তরু ছিলো সেটি।

কিন্তু মুশকিল ছিলো ঐ ধনী লোকটি কাউকে এ গাছের তলায় বসে বিশ্রাম করতে দেখলে চেঁচাতে শুরু করতো : যাও, তোমরা যার যার নিজের গাছের ছায়ায় বস। আমার গাছের ছায়ায় কেন বসছো, আমাদের বিরক্ত করছো?

পথচারীরা তার গালিগালাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চলে গেলে পর সে চিৎকার থামাতো। বড়লোকের এই দুর্ব্যবহারে গ্রামবাসীদের খুব রাগ হলো। তারা শেষ পর্যন্ত এর প্রতিকারের জন্য আফেন্দির কাছে গেল। অনেক ভেবে-চিন্তে আফেন্দি গ্রামবাসীদের বললো, চারশো টাকা জোগাড় করে দিতে পারলে সে এ জটিলতার সমাধান করতে পারবে।

তারপর একদিন গরিব বন্ধুদের চারশ টাকা নিয়ে আফেন্দি সে বাড়ির পাশের গাছটার নিচে বসলো। ধনীলোকটি যথারীতি বললো, ভাগো, এখানে বসছো কেন? অন্য জায়গা দেখো।”

আফেন্দির মাথা ছিলো ঠাণ্ডা। ভদ্রভাবে বললো, জনাব, এটাতো সরকারি রাস্তা। আমি যদি এখানে বিশ্রাম নেই তাতে মহাশয়ের আপত্তি কেন, বুঝতে পারছি না।

লোকটা খেঁকিয়ে উঠলো, “রাস্তা সরকারি, তাতে কী হয়েছে? এ গাছের ছায়াতো আমার। এই গাছের প্রতিটা পাতার দাম ১টাকা করে। যারা পয়সা দিতে পারবে তারাই কেবল এর ছায়া খেতে পারবে।”

একথা শুনে আফেন্দি বললো, “তাহলে আপনি ছায়া বিক্রি করতে চান?” লোকটা আফেন্দিকে কটাক্ষ করে বললো, তোমার মতো ফকির-মিসকিনের পক্ষে এ গাছের ছায়া কিনে এখানে বসার ক্ষমতা নেই। তুমি মানে মানে কেটে পড়।”

আফেন্দি দেখলো সবকিছু ওর পরিকল্পনা মতো এগুচ্ছে। সে আরও নরম সুরে বললো, আমরা গরিব হতে পারি তাই বলে আপনাকে বঞ্চিত করার ইচ্ছে নেই। তা আপনার ছায়ার দাম কতো?” লোকটা ভাবতেই পারেনি আফেন্দি এতো বকা খাওয়ার পরও এখানে ভদ্রভাবে ছায়ার দাম জানতে চাইতে পারে! সে মহাআনন্দে গাছটির ছায়া স্থায়ীভাবে আফেন্দির কাছে চারশ টাকায় বিক্রি করে দিলো। একটা চুক্তি হলো দুপক্ষের মধ্যে : “রাস্তার পাশের এই গাছ যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন এর ছায়ার মালিক হবে আফেন্দি। কোনো পক্ষ এর শর্ত ভাঙতে পারবে না।”

গ্রামবাসীরা মহা-আনন্দে গাছের ছায়া আর শীতল হাওয়ায় দিন কাটাতে লাগলো। এখানেই গল্পের শেষ হলো না। গ্রামবাসীদের হৈচৈ আর হট্টগোলে ধনীলোকটি বিরক্ত হয়ে আফেন্দিকে বললো, তোমরা এখানে গোলমাল করছো কেন?

আফেন্দি বললো, আমরা গাছের ছায়া কিনেছি ছায়ায় বসে মন যা চায় তাই করি।  

লোকটি নিরুপায় হয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেল।

আর একদিন, ধনীলোকটি তার বাড়ির খোলা বারান্দায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। আফেন্দি তার গাধা নিয়ে উঠানে হাজির। লোকটি আফেন্দিকে উঠান থেকে চলে যেতে বললে আফেন্দি বললো, মাফ করবেন জনাব, আমি আমার কেনার ছায়ার দাঁড়িয়েছি।” লোকটার মুখে আর কোনো কথা সরলো না।

একদিন ছিলো হাটবার। ধনীলোকটির বাড়িতে অনেক মেহমানের আগমন ঘটলো। বিকেলে উঠানে সুন্দর ছায়া দেখে সবাই ছায়া উপভোগ করে আড্ডা দিতে নেমে এলো। সতরঞ্জ বিছানো হলো। মেহমানরা বসতে না বসতে আফেন্দি আর তার বন্ধুরা হাজির। আফেন্দির সোজা কথা বড়লোকটির আত্মীয়দের প্রতি : “আমরা চারশ টাকা দিয়ে এ গাছের ছায়া কিনেছি। তাই এ ছায়ায় কেবল আমাদের অধিকার। আপনারা এখানে ছায়ায় থাকতে পারেন না।“

আফেন্দির অভিযোগে ধনীলোকটি কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না। লজ্জায় মুখ লুকোলো। আর লোকটি এমন অদ্ভুত কাণ্ড করায় অতিথিরা লোকটার ওপর যারপরনাই বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে নিমন্ত্রণ না খেয়ে চলে গেলো। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়লো ছায়া-বেচার অদ্ভুত কাহিনি।

আরেকদিনের ঘটনা। গভীর রাতে প্রচণ্ড হট্টগোলে লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। লোকটা ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে এলো। দেখলো, আফেন্দি ও তার ইয়ার বন্ধুরা বাড়ির ছাদে উঠে হৈ-হুল্লোড়ে মেতেছে। লোকটার কিছু বলার আগেই আফেন্দি বললে, “জনাব, নিজের কেনা গাছের ছায়ায় বসে শীতল হাওয়া সেবন করছি। ধনী লোকটির খুব রাগ হলো। বললো, এখন রাত তুমি ছায়া পেলে কোথায়?” আফেন্দি বললো, “আকাশে পূর্ণ চাঁদ। চাঁদের ছায়া দেখেন বাড়ির ছাদকে ঢেকে রেখেছে। “লোকটি এবার চীৎকার করে বললো, “আমি চাঁদের আলোর গাছের ছায়া তোর কাছে বিক্রি করি নি।”

আফেন্দি না-ছোড়। সেও চীৎকার করে বললো, জনাব, চুক্তি দেখেন। তাতে কেবল গাছের ছায়া বলা হয়েছে। সেখানে ছায়া সূর্য না চাঁদের সে কথা বলা হয় নি।

লোকটি আর প্রতিবাদ না করে ঘরে ফিরে গেল। এদিনকে তার স্ত্রী তাকে এ ধরনের বোকামি করার জন্য বকতে লাগলো। তারতো টাকার দরকার ছিলো না। সে কেন টাকার লোভে এমন অদ্ভুত চুক্তি করলো। একটিবার স্ত্রীর সঙ্গেও পরামর্শের প্রয়োজন বোধ করলো না?

লোকটা হিসেব করে দেখলো সূর্য আর চাঁদের অবস্থান অনুযায়ী ছায়ার অবস্থানও পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ আফেন্দির এ ফাঁদ থেকে তার আর মুক্তি নেই।
 
আর কোনো উপায় না দেখে লোকটা তার সুন্দর বাড়িটা ছেড়ে বাধ্য হয়ে শ্বশুর বাড়িতে পালালো।
 

টাকা পয়সা ধার দিয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলে এমন মহাজনদের ব্যাপারেও আফেন্দি কঠোর ছিলেন। এ গল্পটা এক মহাজনকে ঘায়েল করার গল্প।
 

আফান্দি বাড়ি বানানোর জন্য মহাজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিলো। মহাজন ছিলো চতুর।নতুন বাড়ি দেখে মহাজনের খুব লোভ হলো। বাড়িটা দখলে নেয়ার ফন্দি আঁটলো। সে বললো, আফান্দি, তোমাকে আমার টাকা আর ফেরত দিতে হবে এক্ষুণি। না হয় দোতলায় আমাকে থাকতে দিতে হবে।

আফান্দি মহাজনের মতলব বুঝতে পারলো। সে বললো, ঠিক আছে। আপনি দোতলায় থাকুন।
হাজন মহানন্দে দোতলায় উঠে গেলো। ২দিন পর আফান্দি  লোকজন এনে নিচতলার দেয়াল ভাঙতে শুরু করলো। মহাজন বিরক্ত হয়ে বললো, কী করছো আফান্দি?  আমার ঘর ভেঙে পড়বে।

: আমার ঘর আমি ভাঙি তোমার কী? নিচতলাতো আমি তোমাকে বিক্রি করি নি। 
অবস্থা বেগতিক দেখে মহাজন জীবন বাঁচাতে পড়ি মরি করে বাড়ি ছাড়লো।
 

হোজ্জার থাপ্পড় বিষয়ক বেশ কটি গল্প আছে। এ গল্পটার তাৎপর্য কম নয়। আপাত অর্থে সরল এ গল্পটি একটু গভীর অর্থ বহন করে মনে হয়। 
 

বাজারে দাঁড়িয়ে ছিলো হোজ্জা। হঠাৎ এক ব্যক্তি বিনা  কারণে হোজ্জার মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে, ‘মাফ করবেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার বন্ধু’। ব্যাখ্যাটা হোজ্জার পছন্দ হলো না। সে লোকটাকে কাজির কাছে নিয়ে গেল এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করলো। কাজির আদালতে গিয়েই সে বুঝলো এখানে সুবিচার পাওয়া কঠিন হবে। কারণ লোকটা কাজির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে কাজি সুবিচারক বটে। দুজনের কথাবার্তা শুনে কাজি লোকটার মাত্র এক দিনার জরিমানা করে দিয়ে বললেন, 

‘যদি তোমার কাছে এ মুহূর্তে  এক দিনার না থাকে তুমি তোমার সুবিধা মতো নিয়ে আসতে পারো।  বাদী অপেক্ষা করবেন’। 

হোজ্জা অপেক্ষা করতে থাকে, লোকটা আর আসে না। দিন গড়িয়ে গেল। লোকটার আসার কোনো লক্ষণ নেই। হোজ্জা কাজিকে জিজ্ঞেস করলো, 

‘আপনি কী মনে করেন এক দিনার একটি থাপ্পড়ের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জরিমানা?’ 

‘অবশ্যই’।

হোজ্জা সঙ্গে সঙ্গে কাজির মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,  আমি এক দিনারের জন্য আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো? বিবাদি ফিরে এলে আমার প্রাপ্য জরিমানাটা আপনার প্রাপ্য হলো জনাব।’

হোজ্জা ও অধ্যাপক এ দুটি চরিত্র এক সাথে কম পাওয়া যায়। এখানেও তার সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।

এক অধ্যাপক জরুরি বিষয়ে আলাপের জন্য হোজ্জার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলেন। হোজ্জা পরদিন দুপুর ১২টায় সময় দিলো। অধ্যাপক যথাসময়ে হাজির হলেন হোজ্জার বাসায়। দেখলেন, ঘরে তালা দেয়া। কেউ নেই। অধ্যাপকের খুব রাগ হলো। তিনি একটা স্টিকারে ‘ইডিয়ট’ কথাটা লিখে দরজায় সেঁটে দিয়ে চলে এলেন। হোজ্জা বাড়ি ফিরে লেখা দেখে খুব লজ্জিত হলো। সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপকের বাড়ি গিয়ে হাজির। অধ্যাপককে বললো, দুঃখিত অধ্যাপক সাহেব। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আপনার কথা। আমার বাড়ির দরজায় আপনার হাতে আপনার নিজের নামটা দেখেই মনে পড়লো, তাই চলে এলাম।
 

হোজ্জার প্রতিপক্ষরা সব সময় সমাজের উচ্চবর্গ। হোজ্জার বোকামি নয় বরং বুদ্ধিমত্তার চরম প্রকাশ ঘটে এদের বিরুদ্ধে। সোভিয়েত রাশিয়ায় একটা ছবি হয়েছিলো হোজ্জাকে নিয়ে। অত্যাচারী রাজাকে বুদ্ধির খেলায় নানাভাবে নাস্তানাবুদ করে হোজ্জা গণচিত্ত জয় করে ফেলেছিলো। আমরা দেখেছি, হোজ্জার বুদ্ধির চমক ঝলসে ওঠে অত্যাচারী রাজা, দাম্ভিক ধনী, তোষামুদে উজির, পক্ষপাতদুষ্ট কাজি, লোভী জমিদারদের বিরুদ্ধে। হোজ্জার গল্পগুলোর এটা একটা অন্যতম শক্তি। এমনি আর একটি গল্প দিয়ে আমরা আমাদের এ পর্ব শেষ করবো।

নাসিরউদ্দিন আফান্দির সুখ্যাতি শুনে এক বাদশা তার উজিরদের বললেন, “শুনেছি আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যে নাসিরউদ্দিন আফান্দি নামে এক লোক আছে। সে নাকি দুনিয়ার সেরা বুদ্ধিমান? তার বাদশাহকেও সে বোকা বানিয়ে দেয়? এটা কি সত্যি?”

“এটা সত্যি বটে জাঁহাপনা। আমরাও শুনেছি আফান্দি খুবই বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। কেউ বুদ্ধিতে তাকে হারাতে পারে না।“

উজিরদের কথা শুনে বাদশা বেশি খুশি হতে পারলেন না। একটা গ্রামের লোক একটা রাজার চেয়েও বুদ্ধিমান কী করে হয়! তিনি উজিরদের বললেন, “বাদশার চেয়ে তাঁর প্রজার বুদ্ধি বেশি এমন অযৌক্তিক কথা কেউ কোথাও শুনেছো?”

বাদশার উদ্ধত ও দাম্ভিক ভাব দেখে উজিররা পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। তারপর তোষামুদে হয়ে উঠলো।

“জ্বী , জাঁহাপনা আমরাও এটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করি না।”

বাদশাহ সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিবেশী রাজ্যে গিয়ে আফান্দিকে বোকা বানিয়ে আসবেন। ছদ্মবেশী ব্যবসায়ীর বেশে তিনি অনেক ঘুরে আফান্দির রাজ্যে প্রবেশ করলেন। বাদশাহ এক লোককে জমিতে কাজ করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “শুনেছি এ রাজ্যে আফান্দি নামে একটা লোক আছে। তার সন্ধান দিতে পারো? সে কত বুদ্ধিমান আমি একবার পরখ করে দেখতে চাই।”

চাষাটা নিজেই আফান্দি। প্রশ্নকর্তার ভাব দেখে আফান্দি তার আগমনের ‍ উদ্দেশ্য বুঝে গেল। সে বললো, “আমিই আফান্দি। আমার খোঁজ কেন করছেন, মহাশয়।”

“ওঃ তুমি তাহলে আফান্দি। বাদশাহ তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, শুনেছি তুমি খুব ধোঁকাবাজ। আমাকে ধোঁকা দিতে পারবে? শোনো, আমাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না।”

“বেশি বড়াই ভালো না, ভাই। ধোঁকা আমি আপনাকেও দিতে পারি। তবে এ জন্য আমিতো প্রস্তুত নই। দেখছেন না খেতে কাজ করছি। আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আমার বাড়ি যেতে হবে। সেখানে ধোঁকার ঝুলিটা রেখে এসেছি। তারপর আপনাকে ধোঁকা দেখাবো। যদি আপনি আমার ধোঁকার ঝুলিতে ভয় না করেন, তাহলে আপনার ঘোড়াটা আমাকে ধার দেন। আমি বাড়িতে যাবো আর আসবো।”

“ঠিক আছে একটি দুটি নয়, দশদশটি ধোঁকার ঝুলি আনলেও কোনো কাজ হবে না। হা হা হা ধোঁকার ঝুলি আনবে! “বলে ঘোড়াটা আফান্দির হাতে দিয়ে শেষ করলেন বক্তব্য, “তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। দেখবো তোমার কত ক্ষমতা!”

আফান্দি মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়াটা নিয়ে উল্কাবেগে বাদশাহর নজরের বাইরে চলে গেল। বাদশা জমির ধারে বসে অপেক্ষা করে চললো। এ ‌দিকে সূর্য ডুবতে বসেছে। রাতের অন্ধকার নেমে এলো। আফান্দি আর ফিরে আসে না। শেষমেষ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাদশাহ বুঝলেন আফান্দি তাঁকে ধোঁকা দিয়ে ছেড়েছে।


• কোটবাড়ী, কুমিল্লা

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

menu
menu