হোজ্জার চিড়িয়াখানা
শামসুর রাহমানের কবিতায় চিড়িয়াখানার সন্ধান পেয়েছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ব্যাপারটা তাঁর মুখেই জেনে নেই। ‘তাঁর কবিতায় শোনা যায় ঘোড়ার খুরের ক্লিপক্লাপ, হরিণ, শজারু, নেকড়েদের পদপাত, বিবিধপাখির ওড়াওড়ির শব্দ।’ হোজ্জার গল্পগুলো পড়তে গিয়ে আমিও পাখি, কুকুর, বেড়াল, ঘোড়া, ভেড়া, খরগোশ বিচিত্র সব প্রাণীর সমাগম দেখতে পাই। আর গাধা ছাড়াতো হোজ্জার গল্প হয়ই না। সন্দেহ হয় হোজ্জা স্ত্রীকে নিয়ে যত গল্প করেছে, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি গল্প ছেড়েছে গাধাকে নিয়ে। স্ত্রীর চেয়ে গাধাকে বেশি ভালোবাসতেও দেখা যায় হোজ্জাকে। শামসুর রাহমানের চিড়িয়াখানার একটি তোতাকে নিয়ে আমরা পরিদর্শন শুরু করতে পারি হোজ্জার চিড়িয়াখানার।
প্রভু, শোনো এই অধমকে যদি ধরাধামে পাঠালেই
তবে কেন হায়, করলে না তুমি, তোতাপাখি আমাকেই?
দেখা গেছে, হোজ্জা তোতাপাখি হতে চাননি, শামসুরের মতোই। কথা বলেছেন স্পষ্ট ভাষায়। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো তিনি কেন গাধার পিঠে উল্টো বসে চলা-ফেরা করেন। হোজ্জা জবাবটা তোতাপাখির মতো দেন নি। বলেছিলেন, ‘আমি যদি গাধার দিকে মুখ করে বসি তাহলে আপনি আমার পেছনে পড়বেন আর আপনি যদি গাধার সামনে যান তাহলে আমাকে পাছা দেখাবেন, এটা কি ঠিক হবে?’ এতোটাই যুক্তিবাদী হোজ্জা! হোজ্জার গাধার পিঠে চড়ার প্রসঙ্গটা যখন এসেই গেলো, আমরা বরং তাঁর গাধার পিঠে চড়ার বিড়ম্বনার গল্পটা বলেই ফেলি। এ গল্পটা বোকা মানবগোষ্ঠীর বিবেচনাবোধের একটি দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে।
হো্জ্জার ছেলেটা তখন কিশোর বয়সী। আদরের ছেলেকে গাধার পিঠে চড়িয়ে হোজ্জা পাশে পাশে হাঁটছে। রাস্তায় পথচারীরাএ দৃশ্য দেখে বললো, ‘কীরকম দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ছেলে! বৃদ্ধ বাপকে হাঁটিয়ে জোয়ান পোলা গাধার পিঠে চড়ে যাচ্ছে!’
হোজ্জার ছেলে খুব শরম পেল। সে গাধার পিঠ থেকে নেমে বাবাকে গাধার পিঠে চড়াল। কিছুদূর যেতে না যেতেই পথচারীরা এবার বলতে লাগলো, ‘কেমন বেয়াকুফ বাপ, ছেলেটাকে এই পাথুরে রাস্তায় হাঁটিয়ে মর্দ্দটা গাধার পিঠে যাচ্ছে!’
এবার হোজ্জা বেচারা খুব বিব্রতবোধ করল। সে কী আর করে, ছেলেকেও গাধার পিঠে তার সামনে নিয়ে বসালো। দুজন মানুষের অতিরিক্ত ভারে গাধাটা ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় কোনোমতে এগুতে থাকলো। এ দৃশ্য দেখে প্রাণীর প্রতি হোজ্জার নির্দয়তায় ক্ষোভে ফেটে পড়ল পথচারীরা— ‘কেমন বে-ইনসাফ বাপ-বেটা, সামান্য একটা গাধার পিঠে দু-দুজন তাগড়া জোয়ান উঠে বসেছে! গাধাটা বাঁচবে কী করে!’ এটা শুনে হোজ্জার খুব রাগ! ‘দেখি এবার কে কী বলে!” বলেই পিতা-পুত্র দুজনেই তড়িঘড়ি গাধার পিঠ থেকে নামলো। তারপর একটা লম্বা বাঁশ জোগাড় করে সেটাতে গাধাটার পায়ের সামনের জোড়া আর পেছনের জোড়া আলাদা আলাদা বেঁধে তাকে চ্যাঙদোলা করে টেনে নিয়ে চললো।
নোয়াখালিতে একটা গ্রাম্য প্রবাদ আছে, ‘ঠাডায় বগা মরে, হইরের কেরামতি বাড়ে’। অর্থাৎ বজ্রপাতে বক মরলে ফকির বলে এটা তারই কেরামতি!এ গল্পে কেরামতিটা কার—আমরা বুঝে নিতে চেষ্টা করতে পারি ব্যাঙের, না গাধার, নাকি হোজ্জার নিজের?
একদিন নাসিরউদ্দিনের প্রিয় গাধাটা খুব তুষ্ণার্ত ছিলো। হঠাৎ একটা বড় ডোবা দেখে পানির উদ্দেশ্যে সে দিকে দৌড় দিলো। ডোবার ধারটা ছিলো খাড়া। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে গাধাটার গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলো। ঠিক সে মুহূর্তে একটা ব্যাঙ পানিতে উচ্চস্বরে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে ডাক তোলার রিহার্সাল শুরু করে।
পড়ে যাওয়ার আকস্মিকতা আর ভয় গাধাটাকে এতো ভীত করে তুলেছিলো যে গাধাটা তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামাল দিয়ে কোনোরকমে রক্ষা করলো।
পুরো ব্যাপারটা দেখে নাসিরউদ্দিন অভিভুত। ব্যাঙটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি স্বর্ণ-মুদ্রা ছুঁড়ে দিলো ডোবায়। বললো , ‘আজ আমার বড় উপকার করলে বন্ধু। এ নাও তোমার ইনাম।’
তবে পরের গল্পটা প্রাণীর প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত ইনাম প্রদানের নয়। তাই গল্পটা নিরীহ ঘরাণারও নয়। মাংসাশী প্রাণী হিসেবে নাসিরউদ্দিনও কম যায় না। তার গল্পের মধ্যে সুঁড়িখানা, চা-দোকান, খাবারের দোকান, ভুরিভোজন এসব ঘুরে ফিরে আসে। তার নামে ছাগল বা বকরির মাংস খাওয়ার যেমন গল্প আছে, তেমনি আছে এসব প্রাণীর কলিজার স্যুপ খাওয়ারও। এ গল্পটা তেমনি একটি গল্প।
নাসিরউদ্দিন কলিজা কিনে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। পথে মনে হলো তার, স্যুপ খেতে তো রান্নার রেসিপি দরকার। সঙ্গে সঙ্গে পাশে বন্ধৃর বাড়ি গেলো। বন্ধুর দেওয়া রেসিপির কাগজ এক হাতে অন্যহাতে সে কলিজার টুকরাটা নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে যাচ্ছিলো।
পথে হঠাৎ দুষ্ট ছেলের দল হোজ্জাকে ভয় দেখাতে একটা বিকট শব্দ করে উঠলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত থেকে কলিজার টুকরাটা রাস্তার ময়লা-কাদার মধ্যে পড়ে গেল। নাসিরউদ্দিন দেখলো এ টুকরাটা রান্নার উপযোগিতা নেই।
রেগে নাসিরউদ্দিন চিৎকার করে বলে উঠলো, বেকুবের দল! আমার কাগজের রেসিপি তো দেখ ঠিকই আছে। এটার তো কিছু করতে পারিস নি। এটা দেখে ঠিকই রাঁধতে তো আমি পারবো। কলিজা নষ্ট হলে কিই বা হবে!
প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাওয়াখাওয়ির এসব গল্পে আমরা না থেকে আমাদের প্রাণিজ সম্পদ কিংবা অর্থ সম্পদ কীভাবে বাড়াতে পারি সেটা বরং নাসিরউদ্দিনের থেকে শিখে নেই না কেন?
“জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে বেশি সংখ্যক চতুষ্পদ প্রাণীর সরবরাহ দরকার। পারবে নাসির?” এক স্বেচ্ছাচারী, কৃপণ রাজন্য জানতে চাইলেন নাসিরউদ্দিনের উঠোনে এসে। আরও বললেন, “এবং আমার সঙ্গে কেউ যদি একান্তে যোগাযোগ করে তাহলে চতুষ্পদীর জন্য উপযুক্ত দামসহ আমি প্রচুর ইনামও দিতে পারি।”
এ পর্যায়ের রাজ-অমাত্যের পক্ষে উপযুক্ত দাম ও উপহার না দিয়ে প্রতারণা করা কঠিন সে জন্যে নাসিরউদ্দিন ব্যবসার উদ্দেশ্যে অভিজাত রাজন্যের কাছে গেলেন।
মোল্লা বললেন, হে মহানুভব, আপনার কি চাষযোগ্য জমি আছে?
“হ্যাঁ, তা লাখ খানেক বিঘা তো হবে।”
“আপনি কি চতুষ্পদী ব্যবহার করেন জমিতে চাষের জন্যে।”
“তাতো করিই।”
“আপনি কি আমার কাছ থেকে ১২ ডজন চতুষ্পদী কিনবেন প্রতিটি পাঁচ রৌপ্য মুদ্রায়।”
অভিজাত রাজন্যের লোভে চোখ চকচক করে উঠলো। কারণ সে জানতো চাষের জন্য প্রতিটা চতুষ্পদীর দাম শত রৌপ্য মুদ্রার কম নয়। সে সঙ্গে সঙ্গে চুক্তি করে নিলো।
নাসিরউদ্দিন বাজারে গেল। প্রতিটা ১ রৌপ্য মুদ্রায় সে ১২ডজন খরগোশ কিনলো। তারপর রাজঅমাত্যের কাছে গিয়ে চতুষ্পদীগুলো উপহার দিলো।
খরগোশ দেখে লোকটাতো রেগে আগুন! দুজনে চুক্তি নিয়ে কাজীর দরবারে হাজির হলো। কাজীর প্রশ্নের জবাবে হোজ্জা বললো, মান্যবর, আমাদের আইনের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। এর প্রতিটি শব্দের প্রতি আমাদের আনুগত্য থাকতে হবে। ‘চতুষ্পদী’ শব্দটা দেখুন। আমার খরগোশগুলো পরীক্ষা করুন। প্রতিটির চারটি করে পা আছে। এগুলো চতুষ্পদী।”
লোকটার আবেদন কাজীর দরবারে খারিজ হয়ে গেল।
এটা ছিলো বুদ্ধিমান নাসিরউদ্দিনের গল্প। এ সঙ্গে আরেকটা বুদ্ধিমান নাসিরউদ্দিনের গল্প আমরা পড়ে ফেলতে পারি। এ গল্পটির বৈশিষ্ট্য এটা একটু বড়। তবে বুদ্ধিমান নাসিরউদ্দিনের আদিরূপ (আর্কিটাইপ) এতে ধরা আছে।
একদিন রাজদরবারে নাসিরউদ্দিনকে জব্দ করার জন্যে একটা কৌশল নিলেন, “মোল্লা, তুমি যেহেতু নিরবচ্ছিন্নভাবে এটা প্রমাণ করতে চাও যে আমাদের মধ্যে তুমি সবচেয়ে চালাক এবং জ্ঞানী, তাহলে দেখি তোমার প্রিয় গাধাটিকে পড়তে শেখাতে পারো কি না?
“অবশ্যই পারবো জনাব” খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে নাসিরউদ্দিন জবাব দিলো। “এ ধরনের একটা কাজ আমার জন্যে ডাল-ভাত মাত্র।”
“আমাকে বেহুদা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করো না। সত্যি পারবে তো?” রাজা আবার বললেন।
“জনাব। অবশ্যই পারবো। তবে আমাকে এ মুহূর্তে এক লাখ টাকা দিতে হবে। আমি গ্যারন্টি দিচ্ছি গাধাকে পড়তে শিখিয়ে আপনার সামনে নিয়ে আসবো। আর একটা কথা গাধার ব্যাপার তো বুঝেন তো সময় লাগবে।”
“কতদিন তোমার সময় প্রয়োজন?” রাজা জানতে চাইলেন।
“তা দশ বছর তো দরকার হবে।” রাজা সঙ্গে সঙ্গে এক লাখ টাকা দিয়ে শর্ত জুড়ে দিলেন যে, যদি সময় মতো গাধাকে শিক্ষিত করতে না পারে নাসিরউদ্দিন তাহলে টাকার দ্বিগুণ ফেরত দিতে হবে এবং জেলে যেতে হবে।
নাসিরউদ্দিন রাজি হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। পরদিন বন্ধুদের সঙ্গে গল্পটা করল নাসিরউদ্দিন। “তুমি কি পাগল হলে মোল্লা,” বন্ধুরা ধরে বসলো, “গাধা কখনো পড়তে পারবে? একটা গাধাকে দাড় করানো শেখানো যায় না সহজে, সে কীভাবে পড়তে পারবে। তুমি আসলে ফতুর হয়ে জেলে যাবার বন্দোবস্ত করে এসেছো।
“দেখ, আমাদের রাজার বয়স ৮৫ চলছে, চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে আরও ১০ বছর তাঁকে বাঁচতে হবে। ততদিনে আমি, না হয় আমার গাধাও মরে যেতে পারে। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে। বর্তমানে তো ভাবতে হবে।”
এ গল্পটা একটু দার্শনিক ভাব নিয়ে এলো মনে হয়। আমার মনে হয়, এ সময়ে গল্পটা লেখা হলে রাজাকে করোনা ভা্ইরাসের সংক্রমণে ফেলার চক্রান্ত করা যেতো হয়তো। সে যাক, পাখির গল্প তো করা হলো না, এ চিড়িয়াখানার। এবার কাকের একটি গল্প বলা যাক। কাক তার গল্পে বারবার ঘুরে ফিরে আসে না।
একবার নাসিরউদ্দিন গভীর বনে পথ হারিয়ে ফেললো। এদিক ওদিক ঘুরে পথের দিশা না পেয়ে ক্লান্ত নাসিরর্উদ্দিন তাকালেন আসমানের দিকে। প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন, হে খোদা আমাকে পথ দেখাও। আমি বড় অসহায় হয়ে পড়েছি। সে সময়ে একটা কাক ওর মাথার ওপর বিষ্ঠা ছেড়ে দিলো। এবার নাসিরউদ্দিন বললেন, হে খোদা আমি তোমার কাছে মাটির পথের দিশা চাইছি, আসমানের পথ নয়।
গল্পটা আমি তারাপদ রায়ে পেয়েছি। বিড়ালের গল্প। তারাপদ রায় সদ্য যুবা, বিবাহযোগ্য। এক বিবাহ যোগ্যা তরুণী তাঁকে মুগ্ধ করার জন্যে বললো, জানেন আমার বাসার বিড়াল নিজের নাম বলতে পারে। তারাপদ বাবু অভিভূত! তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা দেখার জন্যে মেয়েটার বাড়ি গেলেন। বিড়ালটার শব্দ শুনে তিনি অবাক হলেন। ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, বিড়ালটার নাম কী? তরুণী কৃত্রিম রাগ করে বললো, কেন শুনতে পেলেন না? মেঁয়াও বললো যে! তারাপদ রায় সম্ভবত আর আগান নি। এ গল্পটা পড়তে গিয়ে শুরুতে আমার মনে হয়েছিলো এটা মনে হয় ফ্যাবল। বিড়াল বেটা কথা বলে ছাড়বে। পরে দেখি নিরেট বাস্তববাদী গল্প। আবার হোজ্জার গাধায় ফিরে আসি।
একদিন হোজ্জার গাধাটা উঁচু বাধের ওপর থেকে পড়ে মরে গেল। হোজ্জা আর কী করে! গ্রামবাসীদের ডেকে নিয়ে গেল বাঁধের ধারে। বললো, দেখুন, আমার গাধাটা পড়ে মরে গেছে। আপনারা যখন গ্রামে ফিরে যাবেন, তখন আমাকে “তোমার গাধাটা কোথায়?” “কীভাবে গাধাটা মরলো?”, “তুমি খেয়াল করনি পড়ার সময়?” —এ জাতীয় প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেন না আশা করি।
এ গল্পটিরই একটি হুমায়ূন আহমেদীয় রূপ পেয়েছিলাম তাঁর এক নাটকে। বৃদ্ধ ভদ্দরলোক। জ্বর-কাশি হয়েছে। মনে রাখবেন তখন করোনা ছিলো না। সুতরাং সেদিকে কেউ ভাববেন না। করোনা রোগীকে তো কেউ দেখতে যায় না। গল্পের পটভূমিটাই মাটি! আত্মীয় স্বজনরা দেখতে আসে। এসেই জিজ্ঞেস করে, কয়দিন জ্বর? কীভাবে হলো? কাশিতে কফ আছে কি না? বৃষ্টিতে ভিজেছেন কি না? সর্দিটা গাঢ় না পাতলা ? —এসব আর কি! তিনি দেখলেন মোট তেরটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে। এই সামাজিকতার চাপে অতিষ্ঠ মানুষটি একটা বড় বোর্ড বানিয়ে নিলেন। সেখানে প্রশ্নগুলোর নম্বর চিহ্নিত উত্তর সাজানো আছে। এরপর কেউ প্রশ্ন করলেই উত্তর দেন ১০ নম্বর। প্রশ্নকর্তা অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে তিনি লম্বা কাঠি দিয়ে বোর্ডের ১০ নম্বর চিহ্নিত উত্তরটিকে নির্দেশ করেন। সেখানে লেখা থাকে পাতলা পায়খানা বন্ধ হয়েছে। এরপরের প্রশ্ন করার জন্যে প্রশ্নকর্তা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এটা বাংলাদেশে যে খুব কার্যকর পদ্ধতি এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।
মার্ক টোয়েন নাকি একবার বলেছিলেন, কুকুর আর মানুষের পার্থক্য হলো : ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার দিলে, আদর করে দিলে সে আর কামড়ায় না। কিন্তু মানুষ বিপরীতটাই করে। মানুষকে নিয়ে এতো খারাপ না ভাবলে বরং বেশি ভালো হয়। মোল্লার সঙ্গেও আমরা দেখি তার গাধাগুলো ভালো আচরণ করতে। মানুষ মোল্লার সঙ্গে বিরূপ হয় কিন্তু গাধারা হয় নি। বরং মোল্লা তো মানুষ তাই বিভিন্ন সময়ে সে গাধাদের ওপর নিষ্ঠুরই হয়েছে। এ গল্পটাও নিষ্ঠুরতার বার্তাই বহন করে।
মোল্লা নাসিরুদ্দিন সব সময় সত্যবাদী। কিছুদিন ধরে মোল্লাকে দেখা গেল গাধার পিঠে চড়ে বারবার গ্রিস ভ্রমণ করতে। প্রতিবার ইরান থেকে যাওয়ার সময় হাতে থাকতো দুটো চামড়ার ব্যাগ, ফিরতো খালি হাতে। প্রতিবারই কোতোয়াল তার তল্লাশি চালাতো চোরাচালান সন্দেহে। তারা কখনো সন্দেহজনক কিছু পায় নি।
: তুমি কী বহন করছো, নাসিরুদ্দিন?
: আমি তো চোরাকারবারি। মোল্লার স্পষ্ট জবাব।
কয়েক বছর পর মোল্লার আর্থিক উন্নতি চোখে পড়লো সবার, সে এখন আর ইরান-গ্রিস করে না। আনকোরা নতুন দেশ মিশরে বসবাস করে। কিন্তু মোল্লার সম্পদ অর্জনের জটতো খোলে না। এক শুল্কআদায়কারী তার সঙ্গে মিশর গিয়ে দেখা করলো।
: মোল্লা, তুমি তো এখন আমাদের বিচারের আওতার বাইরে। মিশরে থাকছো। আমাকে বলো, কী জিনিস তুমি পাচার করেছো এ বিলাসী জীবনের জন্য, যা আমরা এতো চেষ্টা করেও ধরতে পারি নি?
: গাধা। মোল্লার সোজাসাপটা উত্তর।
তাই বলে মোল্লা সব সময় গাধার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছে এমন নয়। সে গাধার জন্যে সংসারে তুমুল হট্টগোলও কম করে নি। সেরকম একটা গল্প দিয়েই আমাদের শেষ।
সেবার নাসিরুদ্দিন হোজ্জা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নিজের গাধাটাকে খাওয়ানোর জন্য বিবিকে বললেন। হোজ্জার বিবি একটু ত্যাদড় টাইপের। সে গাধা কে খাবার দিতে অস্বীকার করল। দুজনের মধ্যে এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। তারপর একটা সমঝোতা হল, যে আগে কথা বলবে সে গাধাকে খাওয়াবে। হোজ্জা বাজিতে জেতার ব্যপারে ডিটারমাইন্ড ছিল।
সেইদিনই, হোজ্জার বিবি বাইরে গেছে, খালি বাসা দেখে একটা চোর ঘরে ঢুকল। হোজ্জা বাসায় ছিল, কিন্তু বাজিতে হেরে যাওয়ার ভয়ে চোরকে কিছু বলল না। চোর নির্বিঘ্নে ঘরের সব কিছু নিয়ে চলে গেল। হোজ্জার স্ত্রী বাসায় ফিরে এসে যখন দেখল সব কিছু খালি, চিৎকার দিয়ে বলল, “হায় আল্লা! কি হইছে?”
হোজ্জা খুশিতে লাফিয়ে উঠল, “আমি জিতছি বাজিতে, এখন তোমারেই গাধাকে খাওয়ান লাগবে।
এ গল্পে কে যে আসল গাধা আমরা বলে দিচ্ছি না।বরং হোজ্জার বোকামির আরেকটা গল্প করে নেই।
এ গল্পটা বোকা হোজ্জার বলাই যায়। হোজ্জার তখন টাকার দরকার। হাতে কিছু আছে। বাকি টাকার জন্য সে তার প্রিয় গাধাটাকে বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে গেল। এক দালাল ৩০ দিনারে গাধাটা কিনে নিল সঙ্গে সঙ্গে। হোজ্জার কোনো কাজ নেই। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো দালাল কী করে! দালাল গাধাটাকে নিলামে তুললো। প্রথমে গাধাটার নানা গুণের বর্ণনা দিতে লাগলো সে নানা ভাবে।
আপনারা কি এমন শক্ত সামর্থ্য গাধা জীবনে দেখেছেন? এটা গাধাদের মধ্যে সেরা গাধা। এমন সুন্দর! এমন কষ্ট সহিষ্ণু! এতো কম খেয়ে এতো বেশি কাজ করে! এতো ভার বহন করে’ এভাবে সে প্রশংসার তালিকা দীর্ঘ করতে লাগলো! প্রথম ব্যক্তি গাধাটার দাম হাঁকলো ৫০ দিনার। শুনেই হোজ্জার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর গাধাটা এতো ভালো, সে জানতোই না! দালালের কথায় দাম যতই চড়তে লাগলো, হোজ্জার মন ততই খারাপ হতে শুরু করলো। “কত বোকা আমি! ভাবলো হোজ্জা, “এ অতুলনীয় প্রাণী লাখে একটা মেলে আর আমি কি না ৩০ দিনারে বেচে দিলাম।” ভাবতে ভাবতে সে দেখে দালাল নিলাম গুটিয়ে আনছে।
“৭৫ দিনার এক ৭৫ দিনার দুই...”
হোজ্জা হাত তুলে শেষ ক্রেতা হিসেবে অংশ নিল, “৮০ দিনার।”
শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হলো হোজ্জার চিড়িয়াখানায় এতো এতো গাধা কিন্তু ভেড়া কই? চলুন না, হোজ্জার ভেড়াটাও দেখে আসি।
একবার রাস্তায় একটা ভেড়া পেয়ে হোজ্জা বাড়ি এনে কেটে খেয়ে ফেললো। প্রতিবেশী দেখে বললো, কী করলে হোজ্জা? তোমার বিচার হবে, শাস্তি হবে। হোজ্জা বললো, না, আমিতো কোনো ভেড়া খাই নি, কেউ তো দেখে নি। মালিক তো দেখেনি। কোনো সাক্ষী নেই তো? প্রতিবেশী বললো, ইহকালের শাস্তি কে আর পায়? পরকালের শাস্তি তো মাফ নেই। শেষ বিচারের দিন ভেড়াটা নিজে এসে সাক্ষ্য দেবে। বলবে, এ লোক আমাকে রাস্তা থেকে এনে খেয়ে ফেলেছে।
: তাই না কি? তাহলে ভালোই হলো। ভেড়াটা যখনি আমার সামনে আসবে আমি ভেড়াটাকে ধরে নিয়ে মালিককে ফেরত দিয়ে দেবো। (চলবে)
• কোটবাড়ী,কুমিল্লা
আরও পড়ুন হোজ্জার সংসার