গুচ্ছ কবিতা ।। গুলতেকিন খান 

উপনিবেশ ১

“Mistah Kurtz—he dead.” 
—Joseph Conrad, Heart of Darkness  

আজ তবে উপনিবেশের কথা বলি :
যে কথা শোননি তুমি তুলার বণিক,
জানি আমি বহু রাত, বহু কাল ধরে।
 
যে কথা ভুলেছ তুমি ধূর্ত নীলকর,
মসলিন কাটা হাত লুকিয়ে আস্তিনে,
মহামারী এনেছিলে কামানের নখে।
 
ত্রিমুখী বাণিজ্য বেয়ে শেকল পরেছো,
অতলান্ত জল ছুঁয়ে কূল থেকে কূলে,
দড়ি ভেবে অজগর নিয়েছো জড়িয়ে।
 
গজমতি দাঁত নেবে স্বর্গচূত যিশু,
রক্ত ঢেকে সভ্যতার টুপিতে আবার।
ঘামে, শ্রমে, স্বপ্নশোকে না ফেরা পাখিরা,
 
মাঝপথে জননীকে ছেড়ে গেল যারা:
আঁধারকে আজো তারা কেন ভয় পায়?
 
উপনিবেশ ২

I am subject to a tyrant, a sorcerer/ 
that by his cunning hath cheated me of the island.
—William Shakespeare: The Tempest, Act 3, Scene 2 

ঝড় শেষে কিছু লোক নিঃস্ব হয়ে যায়;
ঢলে পড়ে মেরি আঁতোনিয়েতের কেক।
মানুষেরা ইতস্তত রুটি খুঁজে ফেরে।

উপকূলে জাগে চোখ ডুবোজাহাজের,
ফসলের দানা অকারণে ডোবে ঘামে,
আধমরা মানুষেরা ইন্দ্রজাল খোঁজে।

কালোর ওপরে সাদা, হয়তোবা পীত,
পিঠাভাগ সীমান্ত প্রাচীরে বানরের;
ধর্মের নাম ওড়ে লোভী পতাকায়।

এ দ্বীপ দেখেছি আমি জন্মাবধি মাগো -
যাযাবর পাখি আর সৈকতে তিমি,
গুবরে পোকাও ছিল বন্ধু আজীবন।

আমাকে বানালো পশু, যারা যাদুকর,
অগ্নিগিরির ভয়ে নুয়ে যাবে তারা।

উপনিবেশ ৩

“I am not defending a case, nor are you trying one. 
We are both of us slaves.”
—E M Forster: A Passage To India, Part II,  Chapter 24

প্রতিটি ঝড়ের শেষে নিঃস্ব হয়ে পড়ি
ঝড় কিন্তু তবুও থামে না মারাবারে।

রেলগাড়ি ঝমঝম সভ্যতার খরা,
জমশেদপুর থেকে কোয়েটা অবধি,
শাসন শোষণ আর পেয়াদা তোষণ।

এ কোন ঈশ্বর যাকে মসনদে তুলি?
কে দিল তাদের এই দৃপ্ত নামাবলী,
হিল স্টেশনের বাতি জ্বালাবার ভার?

কালো আর সারমেয় এক সাথে বেঁধে
উপনিবেশের গ্লানি কোহিনূরে ঢাকি
যেন কেউ ঝাড়বাতি দেখেনি কখনো।

আন্দামান দ্বীপ থেকে জালালী কৈতর
নতুন আধার পায় কৈলাশ মেলায়:
আলোর রশ্মি ফিঁকে মারাবারে আজো।

তোমাদের মঞ্চ থেকে

তোমাদের মঞ্চ থেকে দূরে চলে গেছি বলে
আমাকে দিয়েছ শাপ আঁধারের
মুখ টিপে হেসেছো প্রতিদিন
ঝুলি থেকে ক্ষুদকুঁড়ো, শুকনো হরিতকি,
ছুঁড়েছো পথের ধারে
যেন নতজানু হতে হয় তোমাদের এই নাটকের
যদি বাঁচি, তবে যেন সারাবেলা হাঁটু মুড়ে থাকি
অথবা পা টেনে হাঁটি, কাঁপা হাতে জড়ভিক্ষে করি।

আমাকে বলেছ রাহু, পিশাচিনী,
যেন আমার ভেতরে কোনো আলো নেই
পাদপ্রদীপের আলো সবটুকু দখলে নিয়েছো
আর বণিকের ধূর্ততায় হেলেদুলে 
বাজিয়েছো পারকাশন এক দুই করে,
সযত্নে বিষাদিনী সেজেছো সন্ধ্যায়।    

সুপ্তির বালিশটুকু চিরে ফেলে তুলো গুলি
তুচ্ছতায় ভাসমান করেছো হাওয়ায় 
সুর খুঁজে হারিয়েছে যে সমস্ত গান
তারা তো মঞ্চে নেই, আলোতেও নয়।

ভুলে গেছো আগুনেও শীতলতা আছে
স্তব্ধতাও লতিয়ে উঠে মহীরুহ হয়
নাটকেও পর্দা নামে, আলো নিভে যায়
তারপর ধীরে, অতি ধীরে,
পিশাচিনী সূর্য হয়ে ওঠে।


• কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক, বাংলাদেশ।  

menu
menu