লকডাউন পৃথিবীর কবিতা 

পাপের ষোলকলা পূর্ণ করেছো মানুষ
এবার প্রায়শ্চিত্ত করো।

তোমার জ্ঞানে কুলায় এমন কোনো পাপ নেই
তুমি করোনি। মানুষ থেকে বোবা প্রাণী
সুরম্য প্রাসাদ এমনকি সড়কের ফাটল পর্যন্ত
রেহাই পায়নি তোমার নগ্নতা থেকে।
ধর্ষণের পর নির্মমভাবে কেটে নিয়েছো অঙ্গ।

উজার করেছো বন, নদী নালা বিল
ভরাটের পর গড়ে তুলেছো স্থাপনা, শহর।
মাথার তালুতে বসিয়েছো অ্যান্টেনা
যেন বিবেকের দংশন তোমাকে না পোড়ায়।
মনকে বেঁধে দিয়েছো গাড়ির চাকায়
যেন তার চিৎকার না শোনা যায়
উচ্চস্বরে বাজিয়েছো গান।

পশুর চামড়াতে তোমার চকচকে জুতো
সাপকে করেছো গলার হার, আর পাখিকে ধরে
বন্দী করেছো খাঁচায়। ভাবো ওই বনসাইয়ের
জায়গায় নিজেকে। লোহার খোলে কেউ
আটকে রেখেছে তোমাকে। তুমি মাথা ঠেলে
উঠতে চাইছো পারছো না। নামতে চাইছো নিচে
তলা খুঁজে পাচ্ছো না।

অভিশাপ নাও প্রকৃতির, মাথা ঠুঁকো।
 
ঈশ্বরকে ডেকে লাভ নেই, তিনি শুকনাতে
আছাড় খেতে আসবেন না। পাতার গোটা থেকে
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, রাক্ষসের দল কিছুই
ছাড়ছে না, পারলে এক লহমায়
সাবাড় করে পুরো পৃথিবী। 

দেখো, আজ বাতাস ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে
বাড়িতে তোমার আসে না। আকাশ আর সাজে না
অপরুপ রঙধনুর রঙে, জোনাকির অন্ধ চোখে
কেবলই অন্ধকার, কুয়াশায় ভেজা মাঠ
শিশির সিক্ত ঘাস কারখানার বর্জ্যে
তুমি ঢেকে দিয়েছো মানুষ, তোমার ক্ষমা নেই

তোমার জন্যে কেবলই কবরের নিস্তব্ধতা
তোমার এপিটাফে লেখা থাকবে খুনি, খুনি!

হে মানুষ! কোথায় গেলো তোমার বাহাদুরি?

মহাবিশ্বের কোণায় কোণায় তোমার নাম
আকাশ পাতাল ভেদ করে, উর্ধ্ব থেকে উর্ধ্বে
ছুটেছে তোমার দ্রুত যান (রফরফ বোরাক)।
কারে শোনাও এই গালগল্প?

কী গ্যারান্টি! বুকে হাত দিয়ে বলতো
খেলেই বেঁচে যাবে, আছো এমন
দাওয়াই আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে?

আনবিক বিস্ফোরণে মাত্র কয়েক মিনিটেই
ধ্বসিয়ে দিতে পারো—লক্ষ বছরের পৃথিবী।
এমন শক্তি তোমার। পারো তো বীজ থেকে
একটা বাদাম তৈরি করে দেখাও।

কোনো কাজেই তো আসছে না ধর্ম, দর্শন

এক অদৃশ্য ভাইরাসে মুছে দিচ্ছে তোমার
নাম নিশানা। কোথায় ঘটালে উন্নয়ন
হে মানুষ? আগুন যুগ, প্রস্তর যুগ মিথ্যা?
বিবর্তনের ক্রমধারায় বন্য জানোয়ার থেকে
উন্নততর মানুষে পদার্পণ মিথ্যা?

এখনো আদিম প্রবৃত্তি—স্রেফ খাওয়া পরার
লড়াইয়ে টিকতে হচ্ছে মানুষকে। মঙ্গল গ্রহের
বায়ুমণ্ডলের ভর আবিষ্কার কি কাজে আসলো?
কি হবে জেনে শুক্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব কিনা?
যখন এই চিরচেনা পৃথিবীতেই
মানুষ আজ অস্তিত্ব সংকটে।

দম্ভে মাটিতে পা পড়ে না তোমার
কিসের তুমি সৃষ্টির সেরা? ক্ষুদ্র মশার ভয়ে
ঢুকে আছো মশারীর ভেতর। এই
শেষ সুযোগ। যদি অকৃতজ্ঞ হও, ভুল থেকে
শিক্ষা নিতে না পারো, তবে মরো।

২.
প্রেমিকার ঠোঁটে প্রথম চুমু খাওয়ার পর
দ্বিতীয় চুমুর জন্য যেমন মুখিয়ে থাকে
প্রতিটি প্রেমিক। তোমার বড়শিতে গাঁথা আদারের
জন্য কার্প জাতীয় মাছের ন্যায়—জলে
হা মুখে কেমন ভুরভুরি কাটছি দেখো।

তোমার বিষাক্ত ধূলায় ফুসফুসটাকে
আবার ভরবো বলে। তোমার চিরচেনা ব্যস্ততার
পাশে বাউন্ডুলে আমি—পথে পথে কবিতা খুঁজে
সাকুরায় আকণ্ঠ গলা ভেজাবো বলে
রেফারির বাঁশি বাজানোর অপেক্ষায়
মাঠের খেলোয়ার আর টিভি স্ক্রিনের সামনে
অগণিত দর্শকের ন্যায় অধীর আগ্রহে
অস্থির হয়ে বসে আছি।

চৈত্রের গরমে ঘেমে নেয়ে কর্মজীবী স্ত্রীর
বাড়িতে ফেরার ক্ষণ গণনা করে, তার শরীরের
ঘ্রাণে—জ্ঞান হারানোর আনন্দঘন স্মৃতিতে
বিভোর হয়ে—দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে 
আমি সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে আছি,

কবে উঠবে এই লকডাউন, ঢাকা?

৩.
প্রিয়তমা! ভেবো না
এই মেরুন রঙ মহামারীর পর অচেনা
নতুন এক পৃথিবীতে প্রবেশ করবো আমরা।

পুরাতন, জরাজীর্ণ, মরা
ছাদের পলেস্তরার ন্যায় খসে পড়বে মেঝেতে।
ধুয়ে মুছে যাবে যত পাপ ও পঙ্কিলতা
আষাঢ়ের ঝরো বৃষ্টিতে।

সবুজে ভরে উঠবে চারপাশ
হবে অলঙ্কার বৃক্ষের, লতা আর গুল্ম।
পাখির কুজনে নামবে সন্ধ্যা
গোল হয়ে আসবে গরুর পাল।

নেচে নেচে বউচি খেলবে জলে, আর লাফিয়ে উঠে
নেমে যাবে নিচে, সৈকতে সুনীল ডলফিন।
আসবে গৃহস্ত বাড়িতে বেড়াতে হরিণ
যেন হৃদয়বান পড়শি, নিয়মিত খোঁজ খবর নিতে।

রাস্তায়, নির্জন পার্কে হঠাৎ হ্যান্ডশ্যাক করে
ঘাবড়ে দেবে জিরাফ, ছেলেবেলার বন্ধুর মতো।
লাল লাল কাকড়ার ব্রিজ জোড়া লাগিয়ে দেবে
নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের ন্যায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোকে। 

মাতা প্রকৃতি মানবে না, সকল সন্তানকে
সমানভাবে বুঝিয়ে দেবে তাদের নিজ নিজ পাওনা
আর টেনে দেবে নির্দিষ্ট সীমা—যাতে কেউ 
সাদা কালির দাগ কখনো না পেরুতে পারে।

সকলের জন্য, সবাইকে নিয়ে
এই অকালবোধন মহামারীর পরেই
এমন এক মানবিক নগর গড়ে উঠবে, প্রিয়তমা!
তোমার স্বপ্নের মতো।

যার জন্য তুমি—  
পৃথিবীতে আসতে চাইবে বারবার
চাইবে অনন্তকাল বাঁচতে।


• ঢাকা

menu
menu