অতল জলের ডুবকথা

সদ্য ফিরেছি রাধানগর বিচ থেকে একটা অনবদ্য সূর্যাস্ত দেখা সেরে। করিডরে পৌঁছতেই রিসর্টের ম্যানেজার পেছন থেকে ডাকলেন। “স্যর, আই কেপ্ট বিজয় ওয়েটিং ফর য়্যু।” 
ওহো, ম্যানেজার বলেছিলেন বটে বিকেলের মধ্যে ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। কথা রেখেছেন তাহলে।
বিজয় স্থানীয় স্কুবা ডাইভিং এজেন্সির পরিচালক। সুন্দর, সুঠাম চেহারা, লম্বায় ছ-ফুটের কাছাকাছি। গায়ের রঙ মাজা। ডান হাতের তর্জনী চাবির রিঙে। আমাদের দেখেই বিজয় হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য।

আমাদের দেশে স্কুবা ডাইভিংয়ের সবচেয়ে ভালো জায়গা আন্দামান আর লাক্ষাদ্বীপ। আমার ও আমার ‘পার্টনার ইন ক্রাইম’ অর্থাৎ আমার স্বামীর আন্দামান ভ্রমণের একটি অন্যতম উপলক্ষ্যই তাই ছিল স্কুবা ডাইভিং।
আকাশপথে পোর্টব্লেয়ার পৌঁছেছি দিন তিনেক আগেই। গত দুদিনে পোর্টব্লেয়ার ও তার আশেপাশের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো দেখে আজ সকালের ম্যাক্রুজে চেপে দুপুরের আগেই সোজা হ্যাভলকে এসে পৌছেছি। ব্রিটিশ শাসনাধীন আন্দামানের তৎকালীন জেনারেল হেনরি হ্যাভলকের নাম থেকেই এই দ্বীপের নাম।
হ্যাভলকের সবচেয়ে ভালো থাকবার জায়গাটি নিঃসন্দেহে ডলফিন বিচ রিসর্ট। অপূর্ব নীলরঙা লেগুন সংলগ্ন সরকারি রিসর্টটি যথেষ্ট অভিজাত। বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো কটেজ, অজস্র গাছপালা, রিসর্টের সামনেই নীল সমুদ্রের ফেনিল সোহাগ।
এই মুহূর্তে আমাদের ঠিক পাশের কটেজটিতে রয়েছেন আন্দামান ও নিকোবরের গভর্নর এ কে সিং। কটেজের বাইরে বজ্র আঁটুনি সিক্যুরিটি তাই।

সে যাই হোক, বিলাসিতা নয়, আমাদের আসল উদ্দেশ্য হ্যাভলকের সৌন্দর্য আত্তীকরণ করা। তাই, ডলফিনে থাকার মূল কারণ ডলফিনের লোকেশন।
এর সঙ্গে স্কুবাও বহুদিন ধরে আমাদের বাকেট-লিস্টে। সেটাতে টিক মারা বাকি।
আসলে ডিসকভারি চ্যানেলে ডুবুরিদের চোখে দেখা সমুদ্রের নিচের অচেনা জীবজগৎটাকে একটিবার নিজের চোখে দেখবার স্বপ্ন বুনেছিলাম বহুদিন ধরে। তারপর ২০১১-র মাঝামাঝি মুক্তি পেল একখানা মায়াবী ছবি ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’! এই একটা ছবি আমাদের দুজনেরই ইচ্ছেপূরণের দুয়ারটি ঝটকা টানে খুলে দিয়েছিল। সত্যিই তো, ওই ছাপোষা দু-আনা চারআনা হিসেব আর অন্যের শর্তে বাঁচতে গিয়ে কি নিভিয়ে দিতে হবে মনের ভেতর ঘরের সুপ্ত বাসনার আলোকমালাগুলো? জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে লাভটাই বা কী হল যদি দিনের শেষে নিজের ভালোলাগার কাজটাই করে উঠতে না পারা গেল? সব্বাই যেটা করে, যেভাবে করে, আমাকেও সেটা করতেই হবে এবং সেভাবেই— এটার আমি বরাবরের বিরোধী। বরং স্বল্পায়ু এই জীবনে সবার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য করেও মেয়েদের নিজেদের ভালো রাখার প্রতিও দায়বদ্ধ থাকা উচিত। অবশ্যই এখানে আপনার পার্টনারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো বিয়ের আগে কতদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছি যে, একটা হাড় কিপটে বর জুটেছে আমার। যাই বলি তাকে, সে গোমড়া মুখে হাত নেড়ে শুধু বলে, “এখন হবে না!” ভয়ে ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসতাম আমি! 

যাক গে, কোথা থেকে কোথায় চলে গিছলাম। ফিরে আসি যথাস্থানে। বিজয়ের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, পরদিন সকাল ৭টায় পৌঁছে যেতে হবে বিচ নাম্বার ২-য়ে। 
হ্যাভলকের ২ নম্বর বিচের নিমো রিফ বেশ নামকরা ডাইভ-স্পট। রং-বেরঙের অ্যানিমন ফিশ বা ক্লাউন ফিশের জন্য সুপরিচিত এই স্পট। ডিজনির জনপ্রিয় সিনেমা ‘ফাইন্ডিং নিমো’-র নিমোই হল আসলে অ্যানিমন ফিশ।
তা, সেখানে প্রথমে ঘণ্টাখানেক আমাদের ট্রেনিং সেশন চলবে। তারপর সমুদ্রের গভীরে ঢুকে পড়তে হবে গাইডের হাত ধরে। খুব গভীর নয় যদিও, জলের ১৫-২০ ফুট নিচ অবধি নিয়ে যাওয়া হবে আমাদের। জলের নিচে ছবি তোলা ও ভিডিওগ্রাফিও হবে। সবমিলিয়ে ঘণ্টাদুয়েকের মামলা। দক্ষিণা দুজনের মোট আট হাজার টাকা।

অর্থাৎ, পরদিনই আমরা যাচ্ছি সমুদ্রের নিচে। এতক্ষণ অব্দি “যাচ্ছি,  যাব” ভাবতে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু আসল সময় সমাগত যখন, তখন বুকের মধ্যে একটু গুড়গুড় যে করছিল না, তা কিন্তু নয়।
সুতরাং, ইনিয়ে বিনিয়ে...

—ইয়ে, মানে তুমি একা করলেই হয় না? এত্তোগুলো টাকার ব্যাপার!
—তোমার টাকার কথা ভাবার দরকার নেই তো!
—নাহ, মানে আমার শরীরটাও দুপুর থেকে ঠিক...
—কই? লাঞ্চের প্লেটটা দেখে তো মনে হল না যে শরীর কিছুমাত্র খারাপ।

এরপর বলার আর কিছুই বাকি থাকতে পারে না। অতএব সমুদ্রের ধারে হ্যামকে শুয়ে শুয়ে আর ‘কাল যে কী কপালে আছে’ ভাবতে ভাবতে মনের দুঃখে দু-প্লেট মাছভাজা আর একটা রাজা নারকেল (কিং কোকোনাট) পানি একাই সাবাড় করলাম।

সকাল হতে না হতেই পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম বিচ নম্বর ২-এর উদ্দেশ্যে। আন্দামানের রাস্তা, মাঠ-ঘাট পুরোটাই যেন একটুকরো বাংলা। তীব্র নীল সমুদ্দুরটাই যা বেমানান! গরমের ভোরে এখানেও একটা শান্ত- ফুরফুরে হাওয়া দেয় দেখছি।

বিজয়ের সঙ্গে স্কুবালভে ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেল। সাদর আমন্ত্রণে নিয়ে গেলেন ভেতরে। রিসেপশন ডেস্কে নাম-ঠিকানা-টাকাপয়সা মেটানোর পরে একটা ফর্ম সই সাবুদ করিয়ে নিলেন, যার বক্তব্য স্কুবা চলাকালীন কোনোরকম অ্যাক্সিডেন্ট মায় অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ হলেও কাউকে কিছু বলার থাকবে না! এরপরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল সেই ঘরে, যেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে স্কুবা ইকুইপমেন্টস। স্কুবা ইকুইপমেন্ট ডেমন্সট্রেশনের পর নিজেদের সরঞ্জাম বেছে নেবার পালা।

স্কুবা কথার অর্থ সেল্ফ কনটেইন্ড আন্ডারওয়াটার ব্রিদিং অ্যাপারেটাস, যাতে মূলত থাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার আর ব্যুয়েন্সি কন্ট্রোল ডিভাইস জ্যাকেট, যে জ্যাকেটের মধ্যে হাওয়া ভরে ভেসে থাকা যায়, আর হাওয়া ছেড়ে ডুবে যাওয়া যায়। কোমরে বাঁধা থাকে ওয়েটবেল্ট, যার বাটখারার মতো ওজন জলে ডুবতে সাহায্য করে। সিলিন্ডারের সঙ্গে লাগানো রেগুলেটরের সাহায্যে নিঃশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া দুই-ই করতে হয় মুখ দিয়ে। নাকের কোনও কাজই নেই এখানে। সঠিক পদ্ধতিতে নিঃশ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটাই জলের তলায় ভেসে বেড়াবার মূলমন্ত্র। থাকে নাকঢাকা মাস্ক আর বিশেষ চশমা, যে চশমা চোখের চারপাশে খানিক বাতাস ভরে দিয়ে চোখকে জলমন্ডলের মধ্যেও দেখার উপযোগী করে তোলে। এছাড়া, নিজস্ব পোশাকের ওপরে ওয়েটস্যুট আর কম পরিশ্রমে সহজে সাঁতার কাটার জন্যে ফিনও পরতে হয়।
আমার শাশুড়ি মা-ই আমায় সাহায্য করলেন এ সমস্ত স্যুট-ফিন পরতে। এরপর অগভীর সমুদ্রের ধার ধরে ঘন ম্যানগ্রোভের জঙ্গল পেরিয়ে পৌছলাম নিমো রিফে৷ 

ইন্সট্রাকটরের সাথে আলাপ হল। হাঙ্গেরিয়ান ভদ্রলোক। নাম, লেস। আমার বর বোধ হয় ক্যাটরিনা কাইফসদৃশ কোনও অতীব সুন্দরীকে আশা করেছিল। বদলে দাড়িওয়ালা মধ্যবয়সি একজন পুরুষ ইন্সট্রাকটর দেখে কেমন যেন হতাশ হয়ে গেল বলে মনে হল। অবিশ্যি সে হতাশা দীর্ঘস্থায়ী হল না! কারণ লেস এক আশ্চর্য অমায়িক মানুষ। নিজের ব্যবসা আর হাঙ্গেরি ছেড়ে সমুদ্রকে ভালোবেসে স্কুবা-ইন্সট্রাকটর হয়েছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবী। ডুব দিয়েছেন ইজিপ্সিয়ান রেড সি থেকে হাওয়াই সাগরের অতলে।
মূল ডাইভের আগে অপেক্ষাকৃত কম-গভীর জলে দাঁড়িয়ে ডাইভিং-এর প্রাথমিক টেকনিক রপ্ত করলাম প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে। লেস শুধুমাত্র আমাদের দুজনকেই ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রচুর দেশি-বিদেশি মানুষ এসেছেন স্কুবার টানে। বেশিরভাগই পুরুষ। মহিলা খুবই কম, তাও যারা এসেছেন, সকলেই বিদেশি। বরকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে দেখালাম। যদিও তিনি আমল দিলেন না; ট্রেনিং নিতেই ব্যস্ত।

ট্রেনিং-এ সংক্ষেপে যেটুকু বুঝলাম—

১. রেগুলেটরটিকে শক্ত করে কামড়ে ধরে থাকাটা একটা আর্ট। লিপ লক ঠিকঠাক হওয়াটা খুব জরুরি স্কুবা করার সময়। দাঁতে ঠিক করে চেপে ধরার পর ঠোঁট দিয়ে পারফেক্টভাবে রেগুলেটরটাকে চেপে ধরতে হবে। ঠোঁটের ওই শেপটাকে বলে ‘পারফেক্ট ও’। এটা ঠিকঠাক হলেই আর জল ঢোকে না মুখে। 
আমি কিছুতেই রপ্ত করতে পারছিলাম না। সুতরাং বারবার মুখে লবণ-জল ঢুকে যাচ্ছিল। লেস অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় গম্ভীরভাবে বুঝিয়ে বললেন, “Just hold the regulater in such a way you are kissing someone!” এর পরে আর ভুল হয়!

২. জলের নিচে আমাদের কান, ফুসফুস, সাইনাস ইত্যাদি সংকুচিত হয়ে থাকে। কারণ, সমুদ্রের তলায় জলের চাপ ভূ-পৃষ্ঠের বায়ুর চাপের চেয়ে অনেক বেশি। নাগাড়ে নাক চেপে ধরে কান ফুলিয়ে এই চাপের মোকাবিলা করতে হয়। একে বলা হয় ইক্যুয়ালাইজ করা।
যত গভীরে যাওয়া হবে তত বেশি প্রয়োজন এই ইক্যুয়ালাইজেশনের। এটিও যথেষ্ট জটিল প্রক্রিয়া। আমি এক্ষেত্রেও ছড়াচ্ছিলাম ভালো রকমই।

৩. কোনও কারণে, মাস্কে জল ঢুকে গেলে মাথাটা একটু ওপরের দিকে তুলে নাক দিয়ে জোরে শ্বাস ছেড়ে জল বের করে দেওয়ারও বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে; এবং তাতেও কাজ না হলে রেগুলেটারের ওপরের নবটা টিপে জল বের করে দিতে হয়।

৪. জলের নিচে যেহেতু কথা বলার কোনও ব্যবস্থা নেই, তাই কোনোরকম অসুবিধে হলে বোঝাবার জন্যে আছে কিছু সাইন-ল্যাংগুয়েজ। একমাত্র এটিই দেখলাম খুব সোজা জিনিস এবং আসল ডাইভিং-এর সময় নানাবিধ অসুবিধেয় পড়ে গড়ে মিনিট দশেক বাদে বাদেই একবার করে ‘কাঁচকলা’ দেখিয়ে আমি উপরে উঠে আসছিলাম। 

ট্রেনিং শেষে আমরা নিজেদের প্রথম ডাইভের জন্য প্রস্তুত হলাম। ট্রেনার যদিও হাত থুড়ি জামা খামচে থাকবেন। যা কিছু টেকনিক শিখলাম এতক্ষণ, তার সদব্যবহার করতে পারব কি না সেই চিন্তায় প্রথমে একটু ভয় করছিল। মনকে শক্ত করে রেগুলেটর মুখে কামড়ে ধরে বিসিডি-র হাওয়া ছেড়ে ডুব দিলাম জলের নিচে।
এখানে মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, স্কুবার জন্যে সাঁতার জানাটা কতটা আবশ্যিক? সত্যি কথাটা হল, সাঁতার জানার কোনও প্রয়োজন হয় না। বুকে খানিক বল ছাড়া আর কোনও কিছুরই তেমন প্রয়োজন হয় না৷ আমার সঙ্গী-ভদ্রলোকটি মোটেও সাঁতার জানেন না। তথাপি, আমার থেকে অনেক ভালোভাবে জলের নিচে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।

জলের তলায় প্রথমে খানিকক্ষণ নতুন পরিবেশ দেখে আনন্দে-রোমাঞ্চে হতবাক হয়ে পড়লাম। সামনে এক আশ্চর্য-অপার্থিব জগত! এতটা বয়স অবধি যা দেখে এসেছি, তার থেকে এক্কেবারে আলাদা। জলের মধ্যে রঙিন পাথর, কোরাল, সামুদ্রিক গাছপালা আর ততোধিক রঙিন মাছেদের ঝাঁক! আমাদের নাকের ডগায় তারা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু ধরতে গেলেই পালিয়ে যায় আঙুলের ফাঁক গলে।
এতরকমের প্রাণী আর উদ্ভিদ আছে, আর তাদের এমন অবিশ্বাস্য রং? এ কি সত্যি আমাদেরই পৃথিবী, না কি ফুসমন্তরে চলে এসেছি ভিনগ্রহে? আর, চারপাশটাই বা কী অসীম নিস্তব্ধ! কী আশ্চর্যরকমের শান্ত!

কতরকম রং-বেরঙের মাছই যে দেখলাম— প্যারট ফিস, স্ন্যাপার ফিস, বাটারফ্লাই ফিস, সুইটলিপ্স, জ্যাক ফিস। তবে, সবচেয়ে বেশি দেখতে পেলাম নিমো বা ক্লাউন ফিশ। আগেই বলেছি অ্যানিমন ফিশের জন্যেই নিমো রিফের খ্যাতি। ৩-৪ ইঞ্চি মাপের মাছগুলোর কোনোটার রঙ হলুদ, কোনোটার বা কমলা। গায়ে আড়াআড়ি ডুরে। সি-অ্যানিমন (যা আদতে বিষাক্ত এবং তাই জন্যেই নিমোদের নিশ্চিন্ত আস্তানা)-এর নরম আঙুলের মতো শুঁড়ের মধ্যে ওরা লুকোচুরি খেলছিলো।
এছাড়াও জলের নিচে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল জ্যান্ত কোরাল (প্রবাল)। ওপরের পাহাড়ের মোতাবেক সমুদ্রের নিচেও রয়েছে পাথুরে দেওয়াল। আর সেই দেওয়াল ঢেকে গেছে লাল, কমলা, নীল, হলুদ, বেগুনি রঙের জীবন্ত প্রবালে। এর কোনোটা আঙুলের মতো দেখতে, তাই নাম ফিংগার কোরাল; কোনোটা বা মানুষের ব্রেনের মতো দেখতে; কোনোটিকে আবার মাশরুমের মতো দেখতে। এর বাইরেও অসংখ্য প্যাটার্নের প্রবাল আছে, যা বর্ণনা করা এক দুঃসাধ্য কাজ। ঝাঁকে ঝাঁকে সেখানে খেলে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছেরা। ঢেউয়ের দোলায় প্রবাল একবার ফুলে ওঠে, পরমুহূর্তেই আবার চুপসে যায়। এদের দেখে যতই বিস্ময় জাগুক, হাত দেওয়া বারণ।
পাথরের গায়ে বসে থাকা একটি স্টোনফিসকে আহ্লাদিত হয়ে কাছে দেখতে যেতেই মনে পড়ল, এটি মারাত্মক বিষাক্ত। 
একটি স্টিং রে আমাদের পাশ কাটিয়ে একটু দূর দিয়ে চলে গেল হঠাৎ। আচম্বিতে মনে পড়ে গেল, স্টিভ আরউইনের করুণ পরিণতির কথা!
বড় লবস্টার আর স্টারফিশ দেখলাম চুপটি করে পড়ে আছে নিচে বালিতে। পায়ের কাছ দিয়ে একটি সাপও চলে গেল এঁকেবেঁকে। একটা দশাসই অক্টোপাস দেখলাম ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে।
মাথার উপর দিয়ে কী সুন্দর  হলুদ মাছের একটি বিরাট ঝাঁক চলে গেল। মাছদের ঝাঁক বেঁধে চলাটাও একটা দর্শনীয় জিনিস। একসাথে ছন্দ-বেঁধে চলন... যেন ওয়াঘা সীমান্তে সেনাদের প্যারেড দেখছি! 
সীমাহীন মুগ্ধতায় ভুলে গেলাম মুখ দিয়ে নোনা জল পেটে ঢুকে যাবার আতংক কিংবা মাস্কে জল ভরে যাবার ভয়।
সমুদ্রকে এত কাছ থেকে দেখে সুনিশ্চিত ভাবে যেটা মনে হল, সমুদ্রের নিচের জগতটা আমাদের এই ওপরের জগতের থেকে ঢের বেশি রঙিন। অপার সৌন্দর্য সেখানে, স্কুবা না করলে যে সৌন্দর্য অধরাই থেকে যেত আমাদের কাছে।

ঘণ্টাখানেক পরে যখন জল থেকে উঠে এলাম, সূর্য বেশ চড়া। বালিতে রোদ পড়ে চিকচিক করছে।
একটা অদ্ভুত মন-কেমন অনুভূতি হচ্ছিল। এই যে এতটা কাল ধরে একটা স্বপ্ন পুষে রাখা ছিল হৃদয়ের গোপনপুরে, এতগুলো বছর, এতগুলো দিন ধরে জড়িয়ে ছিলাম যে স্বপ্নটাকে, এই মুহূর্ত থেকে সেটা কেমন ফুরিয়ে গেল! স্বপ্নপূরণের তৃপ্তির সঙ্গে তাই সমান্তরালভাবে একটা খালি খালি অনুভূতিও বোধ করি সকলেরই হয়।

লেস জানাল, সুনামির আগে আন্দামানের কোরাল রিফের সৌন্দর্য অন্যমাত্রায় ছিল। সুনামিতে সামুদ্রিক এই প্রবালস্তরের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। এখনও হয়ে চলেছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে।
ওর থেকেই জানলাম, এখানে নাইট-ডাইভিং-এর ব্যবস্থাও আছে। অন্ধকার চরাচরে জলের রঙ যখন কালো, সেই অবস্থায় সমুদ্রে ডুবুরিগিরি করলেই মিলবে দীপাবলির অভিজ্ঞতা। 
নাহ, সেই অসামান্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সাহস জোগাড় করতে পারিনি আমরা।
তবে সমুদ্রের নিচের অত্যাশ্চর্য জগতের যেটুকু দেখে ফিরছি, বুড়ো বয়সে চায়ের কাপ হাতে একবারান্দা গল্প করার জন্যে তা যথেষ্টই। 

আর বাকিটা?
হ্যাভলকের এই ছোট্ট স্কুবা ভবিষ্যতে Open Water Diving সার্টিফিকেশন কোর্স (Professional Association of Diving Instructors বা PADI-র এই কোর্সগুলো করা যায় পণ্ডিচেরী, চেন্নাই বা কোজিকোড় থেকে) করার জন্য একবুক সাহস ভরে দিয়েছে আর দিয়েছে এই উপলব্ধি যে, জীবনে অন্তত একবার হলেও স্কুবার স্বাদ নেওয়া উচিত। কারণ জিন্দেগি না মিলেগি দো বারা!


• পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

menu
menu