কবিকে লেখা কবির চিঠি

অক্টোবর ২৭, ২০২২ 
খালেদ ভাই, 
এখন কোথায়? কেমন আছেন? মাঝে কয়েকবার করে লিখব ভেবেও লিখতে পারিনি। ঠিক একটানা বসে লেখার মতো অবসর পাইনি আসলে। অফিসে এই মুহূর্তে গেল কয়েকমাস তেমন কাজ না থাকার কারণে দেখা যায় সময়টা পুরো অলস কেটে যায়। সেই সুযোগে লেখার চেষ্টা করি কিন্তু মাঝে মাঝে কেউ আসা-যাওয়া করলে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। ফলে দেখা যায় ভাবনার শৃঙ্খলা ও নির্জনতা নষ্ট হয়ে যায়। যা লিখতে চাই আর যা ভাবি সেটা হারিয়ে যায়। 

গেল সোমবার সাত্রাং-এর প্রভাবে সারাদিন হওয়া বৃষ্টিটা খুব উপভোগ করেছি। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে রেইনকোট পরে সাইক্লিং করে অফিসে এসেছি আবার ফিরেছিও ঠিক একইভাবে। সকালে অফিসে আসার পথে বৃষ্টিটা তেমন উপভোগ না করতে পারলেও ফেরার পথে ইস্কাটন থেকে বেশ উপভোগ করেই ফিরেছি। রাস্তা ফাঁকা ছিল। যখন ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতাল অতিক্রম করে মানিকমিয়া এভিনিউর রাস্তায় উঠলাম তখন চারপাশ ছিল অন্যদিনের চেয়ে আরও বেশি সুনসান। একটা প্রাণীও নেই। সন্ধের অন্ধকার ক্রমশ ঘন হচ্ছিল রাতের দিকে। ঝরো বাতাসের সঙ্গে জ্যামিতিক কোণে তীর্যকভাবে গায়ে পড়া বৃষ্টির অনুভূতি অন্যরকম ছিল। ঠিক কেমন তা বুঝানো মুশকিল তবে বেশ পরিণত অনুভূতি ছিল। সেদ্ধ ডিমের গায়ে আঁচড় দিলে যেমন আঘাত লাগবে অনেকটা তেমন! 

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম একটা কাঠবাদাম গাছের নিচে। পাশেই বাতাসে ছিঁড়ে যাওয়া কচি বাদামসহ পাতাযুক্ত একটা থেঁতলানো ডাল। বৃষ্টিকে এমনভাবে শেষ কবে উপভোগ করেছি ঠিক মনে নেই! বারবার মনে হচ্ছিল আমার থেকে একশো মিটার দূরে দাঁড়িয়ে কোনো এক নারী, চওড়া বুকের খাঁজ, সুঠাম দেহ নিয়ে শাড়িতে ভিজে অপেক্ষা করছে কিংবা অপেক্ষা না করেই নিজের খেয়ালে বৃষ্টি উপভোগ করছে। তার পরনে লালচে কিংবা হালকা পাতা কালার ব্লাউজের ভেজা কুচি হাতের ওপর দিয়ে কিংবা পিঠের দিক দিয়ে ভাসমান। বৃষ্টির ভারী ফোটায় চোখের কাজল ধুয়ে গেছে, কপালের টিপ খসে গেছে। নিরাভরণ এক নারী তাঁর অন্তর্গত বিপুলা বিশ্ব আর ঐশ্বর্য নিয়ে এই বৃষ্টিতে আমার দিকে ধেয়ে আসছিল অথবা আমি তাঁর দিকে ধেয়ে যাচ্ছি। অবশ্য খুব বেশিক্ষণ এই দৃশ্যকল্প আর ঘোর ধরে রাখা যায়নি। পাশেই শুকনো খেজুর গাছের ডাল বাতাসে ছিঁড়ে পড়তেই সব উধাও হয়ে গেল। যখন পুনরায় রওনা শুরু করি তখন এই ভাবনাটা পিছু পিছু ধাওয়া করলেও আর পাত্তা দেইনি। কারণ অস্তিত্বের আশ্চর্য নিঃসঙ্গতা কখনো কখনো এত বিভৎস অথবা এক্সিজটেন্স ইটসেলফ এজ এন এনটিটি অব ইউনিভার্স হিসেবেও যে ভয়ঙ্কর-সুন্দর নিঃশব্দ নিয়ে থাকে, সেখানে শব্দের কোনো কাজ নেই তাই ভাষা বলেও কিছু নেই! তবে তরঙ্গ আছে। 

আমার কি মনে হয় জানেন, মিসটিকদের অনেকে বুঝতে না পারার কারণ হলো– 'আল্টিমেট' এর এক্সপেরিয়েন্স কেউ কীভাবে বলবে? যখন সে বিলীন হয়ে যায়, এক্সিপেরিয়েন্সার আসলে সেখানে থাকে না! তাহলে হু উইল রিলেট টু দ্য এক্সপেরিয়েন্স? সাবজেক্ট না থাকলে অবজেক্ট তো অদৃশ্য হয়ে যাবেই। নদীর তীর বিলীন হয়ে যায়, থাকে কেবল নদী… কখনো কখনো যদি আপনার অভিজ্ঞতার পর কিংবা দর্শনের (অবজার্ভেশন) পর তা প্রকাশে শব্দকে নিছক কঙ্কাল বা ইউজলেস মনে হয় তখন বুঝবেন আসল জিনিসটাই ঘটছে। আমার প্রায়ই তেমন ঘটে থাকে। আমি জগতের সঙ্গে এই অর্গেজমটাই চাই। বলতে পারেন সেটার জন্য মরিয়া হয়ে থাকি। 

স্প্যানিশ-অ্যামেরিকান দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানাকে নিয়ে একটা গল্প আছে এমন– হার্ভাড ফ্যাকাল্টি যেদিন তাকে বিদায় দিচ্ছিলেন হল রুম ভর্তি শ্রোতারা বসে আছে। সান্তায়ানা সেখানে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। কিন্তু শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বার বার তাঁর নজর গিয়ে পড়ছিল জানালা দিয়ে দৃশ্যমান এপ্রিলের প্রথম তুষারস্নাত ফরসিথিয়া (Forsythia intermedia) ফুলের দিকে।এক পর্যায়ে তিনি আর বক্তৃতায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারেননি। পুরো বক্তৃতা শেষ না করেই হ্যান্ড গ্লাভস, লাঠি আর হেট নিয়ে হল রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরে  আবার একটু উঁকি দিয়ে হল রুমে ফেরত এসে বলছিলেন, ’আই শেল নট বি অ্যবল টু ফিনিশ দ্য সেন্টেন্স। আই হ্যাভ জাস্ট ডিসকভারড দ্যাট আই হ্যাভ অ্যান অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইথ এপ্রিল।’ আমি এই বিষয়টা দারুনভাবে উপলব্ধি করি। প্রকৃতিতে সৃষ্ট প্রতিটি উপদানই আমাদের জন্য নিমন্ত্রণ। এই নিমন্ত্রণ স্বীকার করতে পারলেই জগৎ আনন্দময়। 

গেল সপ্তাহের বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে একদিনের জন্য মধুপুর গিয়েছিলাম। রাতের দিকে জার্নি করাটা একটু অসুবিধার ছিল বিশেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের পর ওইদিকটায় (সর্বোচ্চ রাত দশটা) আর যানবাহন পাওয়া যায় না আবার পাওয়া গেলেও মোটরসাইকেলে অনেকটাই রিস্কি। ফলে সন্ধ্যার পর ঢাকা থেকে রওনা হওয়াটাও একটু অনিরাপদ। যদিও বৃহস্পতিবার যাওয়ার দিন আমার এই আশঙ্কাটা ছিল। এবং তাই হয়েছে। আমি অবশ্য মনে মনে স্থির করে নিয়েছিলাম, এইবার নিস্তব্ধ অন্ধকারে বনের পথে ভয় এবং নির্জনতাকে উপভোগ করবো। প্রচুর জ্যাম ছিল উত্তরায় সেজন্য উত্তরা থেকে বাস বের হতে সময় নিয়ে নিলো রাত সাড়ে নয়টা। এরপর মধুপুর বাজারে গিয়ে যখন নামি তখন রাত সাড়ে বারোটা। বাজারের একটা ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আবার মোড়ে আসতে বেজে গেল রাত একটার মতো। মোটরসাইকেল ছাড়া অল্প কিছু অটোরিক্সা ছিল কিন্তু তারা আবার ওদিকটায় (ইদিলপুর) যেতে চায় না! শেষমেশ একটা বয়স্ক লোকের রিক্সা পেলাম, ব্যাটারি-চালিত। ভাড়ার কথা চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলাম। অবশ্য ভাড়াও খুব একটা নেয়নি। 

মধুপুর পৌরসভার মূল সীমানা পার হতে হতে মুরুব্বির রিক্সাওয়ালা জানালো সে রাত দুইটা পর্যন্ত চালায়। বৃহস্পতিবার রাত যেদিন ঢাকা থেকে অনেকেই আসে সেদিন রাত তিনটা-চারটা পর্যন্তও চালান। একটু একটু করে চালাচ্ছিলেন। পৌরসভার দোকানপাট, স্কুল ঘর, সিনেমা হল আর কিছু চায়ের দোকানের ছাউনির আলো ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে একটা ঘন-গভীর অন্ধকারের দিকে। রিক্সা ছুটছে তো ছুটছে... 

এদিকে আমার সুবিধা হলো, মুরুব্বি খুব ধীরে চালাচ্ছিলেন। আমিও সেটা চাইছি। আর যেহেতু এটা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহের বাইপাস রাস্তা ফলে মাঝে মাঝে দূর থেকে একটা দুটো বড় গাড়ি আমাদের অতিক্রম করে যায়। বাজার থেকে সিনেমা হল পার হয়ে মধুপুর সরকারি কলেজের ফটক এরপরেই পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটা দূরত্বের পর রানি ভবানী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। উচ্চবিদ্যালয়ের পর একটা প্রাইমারি স্কুল। এই জায়গাটার নাম চাড়ালযানী। স্কুলের আগেই হাতের বায়ে একটা রক্ষা-কালী মন্দির, এরপর থেকেই চাড়ালযানী শুরু। দিনের বেলায় ‍এই জায়গাটাকে দেখলে যে কেউ ধারণা করতে পারবে একসময় মৎস্যজীবী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জমজমাট আবাসস্থল ছিল। যেহেতু বংশী নদী একদম কাছেই।এই জায়গাটায় আসলেই বরাবরই আমি ভাবতে থাকি শুধু 'চণ্ডাল' জনগোষ্ঠীর যাতায়াতের পথ ছিল বলেই কি 'চাড়ালযানী' নাম হলো নাকি সত্যি 'চাড়ালযানী' নামে কোনো রূপবতী কন্যা ছিল যার হৃদয় জয় করেছিল 'কচ' নামের কোনো মৎস্য শিকারি সাহসী যুবক!

এরমধ্যে নদীর উপরে 'ধন্যবাদ আবার আসবেন। মধুপুর পৌরসভা' লেখা সিমেন্টের ফলকে একটা গাড়ির হেডলাইট পড়ল। চাড়ালযানীর ছোট একটা বাজারে বিশাল বড় বড় মোটা ছাতিম গাছে এত ছাতিম ফুল ফুটেছে যে, এইটুকু পথ অতিক্রম করে সরু বংশী নদী পাড় হতে গেলেই একরকম মাদকতা ভর করবে। পৌরসভা ছাড়িয়ে রিক্সা যখন দু-পাশে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে এগুচ্ছে আমি সত্যি আমার নিজেকে যেন হারিয়ে ফেললাম। এত বিশাল, বিস্তীর্ণ নক্ষত্রভরা আকাশ কত বছর পর যে দেখলাম, কী বলব। 

এই সাত কিলোমটার পথ শুধু রিক্সায় বসে দুই হাত দিয়ে দুই পাশে শক্ত করে ধরে আকাশ দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলাম। কেবল একটা কথাই মনেপ্রাণে ভাবছিলাম, 'আমরা যা-কিছু জানি তার কিছুই থাকবে না এবং যা চিরকাল থাকবে তার আমরা কিছুই জানি না।' এই বেদনা ক্রমশ পুরো অস্তিত্বে ছেয়ে যখন আমাকে নুইয়ে দিচ্ছিল তখন দূরের ক্ষীণ আলো একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে মনোযোগ ভেঙে দিল। পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে 'কাকরাইদ' বাজারের মোড়ে চলে এসেছি। বাইপাস রোড সোজা চলে যাবে আর ডান দিকের রাস্তায় মোড় নিয়ে আমি চলে যাব ইদিলপুর বাজারের দিকে। আরও দুই কিলোমিটার পথ যেতে হবে। কাকরাইদ বাজার মোড়ে এসে আমার খুব মন খারাপ হলো। এই মোড়ে একটা বিশাল আকাশমণি গাছ ছিল। মোড়ের কালো পিচের রাস্তায় আকাশমনির হলুদ ফুল ধান শুকানোর মতো করে বিছিয়ে থাকতে দেখেছি। কিন্তু রাস্তা বড় করার চক্করে সুন্দর গাছটা আর নেই। গেল সপ্তাহেও দেখেছিলাম!

কে জানে? এই আকাশমণি গাছটাই বোধহয় গত জন্মে আমার ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা চামড়া কুচকানো ফর্সা চেহারার কাকা ছিলেন অথবা সেই ফড়িং যার লেজে সুতা বাঁধতে গিয়ে ডানা দুটো ছিঁড়ে গিয়েছিল। মন খারাপ বয়ে নিয়ে কচকচ শব্দে রিক্সা ডানদিকে সোজা পথে চলছে। আবারও আমি ডুবে যেতে থাকলাম। আকাশের দিকে চেয়ে 'নিভৃত নীল পদ্ম লাগি' নিজেকে ভ্রমর মনে হচ্ছিল। বিবাগী হচ্ছিলাম কত শত, হাজার, লক্ষ, কোটি নক্ষত্র দেখে। এই যে, পূর্বে আমি আপনাকে বলেছিলাম 'এক্সপেরিয়েন্সারই যদি না থাকে, বিলীন হয়ে যায়' তাহলে প্রকাশ ঘটবে কি করে! শব্দ তখন আমার কাছে বোঝা মনে হচ্ছিল। এই বিশাল নক্ষত্র ঢাকা আকাশ আমার ঊর্ধ্বে আর আমি কত হীন, ক্ষুদ্র জীব এই উপলব্ধিতে চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। প্রায় দেড় কিলোমিটার বিস্ময়ে চোখের জলের জোয়ার আমাকে একরকম শুদ্ধ করে দিয়েছিল। নিজেকে সামলে ইদিলপুর বাজারে যখন নামি তখন জনমানবহীন এক শশ্মান মনে হচ্ছিল। দোকান ঘরের বাতিছাড়া আর কিছুই নেই। পাশেই একটা দোকানের খালি অংশে শুকনো পাতায় আগুন জ্বলা ছাই থেকে ধুয়া উড়ছিল। এই বাজার থেকে আরও ১ কিলোমিটার পথ যেতে হবে। সচরাচর দিনের বেলা হেঁটে কিংবা ভ্যানে করে যাওয়া গেলেও এই রাতে (আনুমানিক রাত পৌনে দুইটা) যাওয়া অনেকটা ভয়ের, আতঙ্কেরও। কারণ দলবদ্ধ শেয়াল আক্রমণ করতে পারে! রিক্সা বিদায় করে দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। চারপাশে তাকালাম। বাজারে টহল দেওয়া চৌকিদার বলল, লাভ নেই অপেক্ষা করে, হেঁটেই চলে যান। 

সত্যিকথা বলতে কি একদিকে যেমন আমার ভয় কাজ করছিল অন্যদিকে আবার একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আকাঙ্ক্ষাও ছিল। পাশাপাশি ভাবছিলাম এত ভয়! আজ অবজার্ভ করে ছাড়ব এই ভয় কোথা থেকে আসে, কেন আসে, কীভাবে আসে। কিন্তু মুশকিল হলো, এই এক কিলোমিটার পথের মাঝে কোনো আলো নেই। একটা স্কুল পড়বে সেখানে সামান্য আলো আর একটা মিশনারী বোর্ডিং স্কুল সেটার গেইটে সামান্য আলো। আর বাকিপথ ঘন অন্ধকার। 

মেঠোপথের দু-পাশে বুনো কূল, আনারস বাগান আর শ্যাওড়ার ঝোপ। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাজার শেষ করেই, কয়েকটা বাড়ির পর উচ্চতায় আমার দ্বিগুণ এমন ঘাসের ঝোপ দুই পাশে। কেন যেন অবচেতন মনেই  বহুদিন আগে দেখা ইন্টু দ্য গ্রাস হরোর মুভির কথাটা মনে আসলো। পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। এদিকে আমার ক্যাডসের শব্দ মাটিতে ঘর্ষণ করে যেন চার বার শব্দ করছে এমনটা মনে হতে লাগল। দুইবার আমার পায়ের বাকি দুইবার হয়তো আমার পেছনে আসা কারোর। আমি থমকে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকাই। আমি জানি কেউ নেই তবুও তাকালাম। সম্ভবত এই ভয়টা আমাদের জিনে সেই আদিম মানবের সময় থেকে বয়ে বেড়াচ্ছে। হার্টবিট একটু বেড়ে যায় তো আবার কমতে থাকে। কিন্তু হাঁটা বন্ধ করছি না। বন্ধ করলেই মনে হয় যেন সামনে কিংবা পেছন থেকে কিছু একটা এসে আক্রমণ করবে! 

আবার হাঁটছি। একপাশে আনারস ক্ষেত তো আরেকপাশে পুরানো ভাঙা কিছু ভিটা ঘিরে বড় বড় প্রকাণ্ড লিচু গাছ এবং কিছু ক্রুশ চিহ্নের কবর। পারিবারিক কবর। হ্যন্ডমেইড ক্রুশ। অন্ধকারে যদিও স্পষ্ট সব দেখা যাচ্ছে না কিন্তু দিনের বেলায় প্রায় অনেকবার যাতায়াত করে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল। এরমধ্যে আনারস বাগানের পরে একটা ঢালু জমিতে শুরু, শ্যাওড়ার ঝোপে আওয়াজ! থমকে গেলাম। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বাড়তে লাগল। ভাবছি শেয়াল হবে। তাই হলো। আমার সামনে দিয়ে একে একে তিনটা শেয়াল একপাশ থেকে আরেকপাশে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার আগেই স্কুল ঘরটা পার করে এসেছি। সামনে অপেক্ষা করছি সেই মিশন স্কুলের গেইটে জ্বালানো লাইটের আলো দেখার। ইতোমধ্যে আমার ভয়টা উধাও হয়ে গেছে। কারণ আমি ডিপলি অবজার্ভ করছিলাম আমার ভয়টাকে। হুট করে সারা শরীর হালকা হয়ে ভয় নাই হয়ে গেল। আমি বীরদর্পে হেঁটে চলছি। ঝিঁঝিঁর শব্দ! কোথাও পাতা খসে পড়ার শব্দও কানে আসছে। কি যেন একটা পাখি নাকি পেঁচা কামারের লোহা পেটানোর মতো শব্দে বিরতি দিয়ে ডাকছে। এবার রাস্তার দুই পাশে শাল, মেহেগনি, হরিতকি আর কড়ই গাছের সারি। দূরে কলাবাগান আর ধানক্ষেত। মিশনারি স্কুল গেইটে আসতেই সেখানে একটা কালো-বাদামি কুকুর দেখা গেল। খুবই স্বাভাবিক! আমাকে দেখে হামলেও পড়ল না। এই গেটে কুকুর থাকবে এটা আমার সাইকোলজিতে আগেই সেট করা ছিলো। দিনের বেলায় অনেক সময় এইখানে এক-দুটো কুকুর চোখে পড়েছে। তাছাড়া এখানে প্রায় প্রতিটি গারোদের বাড়িতেই কুকুর থাকে। ফলে ভয় পাইনি। কিন্তু যতই সামনে এগুচ্ছি ততই মনে হচ্ছে এই কুকুরটাকে আম চিনি... এ কি, এতো ব্ল্যাকি! একটা কান ভাঙা (আগেও এমন ছিল) কদিন আগেই যখন এসেছিলাম তখন ওর কাঁটা ঘায়ে আমি ওষুধ দিয়ে দিয়েছিলাম। ব্ল্যাকি আমাকে রিসিভ করে সামনে হাঁটতে লাগল আমি পেছনে। বাকিপথ, মিশনারি স্কুল পার হয়ে হাতের ডানে মোড় নিয়ে ব্ল্যাকি আমাকে নিয়ে চলল। সামনে ব্ল্যাকি, আর পেছনে আমি। মৃ’কে মোবাইল করে জানিয়ে রাখলাম চাবি নিয়ে এসে বাসার মেইন গেইট খুলে রাখতে।  বাসার গলিতে ঢুকে গেইট পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম কিন্তু সামনে ব্ল্যাকিকে আর দেখলাম না! সেই গলির পথ ধরে ঢুকতেই ওকে দেখেছি। তেমন মাথা ঘামাইনি। কারণ পাশের বাসার গলি দিয়েও সে ঢুকে যেতে পারে কারণ দিনের বেলা কখনো কখনো এভাবেই যাতায়াত করে। কখনো সামনের বড় গেইট ব্যবহার করে ব্ল্যাকিকে বের হতে দেখিনি। বাসায় ঢুকতে গেইটের ডানদিকে কাঠগোলাপ গাছের নিচে এই মধ্যরাতে শিশিরভেজা দুটো তরতাজা কাঠগোলাপ পড়ে থাকতে দেখে মনটা খুব প্রসন্ন হয়ে গেল। হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পরদিন কাজ-কর্ম শেষ করে আবার রাতের মধ্যে ঢাকায় ফিরেছি। 

কয়েকদিন আগে মাত্র জানলাম, পূজার ছুটিতে আমি যেদিন মৃ'দের বাড়িতে ব্ল্যাকির শরীরের ঘায়ে ওষুধ দিয়ে এসেছিলাম তারপর দিন পর্যন্ত (মানে আমি এসেছি শুক্রবারে শনিবার পর্যন্ত) ব্ল্যাকি বাড়িতে ছিল। রবি-সোমবার থেকে আর ব্ল্যাকিকে দেখা যায়নি। বুধবার মৃদের বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া-আসা এমন এক বয়স্ক মহিলা উত্তর পাড়ায় ব্ল্যাকির মৃত দেহ দেখে নিশ্চিত করেছিলেন সে মারা গিয়েছে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত ব্ল্যাকি আর বাড়িতে আসেনি। আমি এই ঘটনা কাউকে বলিনি। মৃ'কেও না। আমি ভাবছি ব্ল্যাকি কেন সেদিন আমাকে এগিয়ে দিয়ে গেল? ওই পথে আমার জন্য কি কোনো বিপদ অপেক্ষা করেছিল? নাকি সিম্পলি সে ঋণ শোধ করলো? আমি জানি না...

মনে হয় আর কোনোদিন ব্ল্যাকির সঙ্গে আমার দেখা হবে না। হবে কি? তাও জানি না! কিন্তু সত্যি ওর জন্য খুব মায়া হয়েছিল। এত বড় একটা ক্ষত নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বাঁচার কি আকুতিটাই না ছিল তার। 

আজকের মতো শেষ করি। অনেক বড় লিখে ফেলেছি মনে হচ্ছে। তবে শেষ করার আগে জয়দেব রাউতের একটা কবিতা পড়াতে চাই আপনাকে। কবিতাটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে! জন্মান্তরে আমার বিশ্বাস নেই। ইনফ্যাক্ট আল্টিমেট কোনো এক্সিজটেন্সেও না! তবুও কেন জানি এই কবিতাটা এত ভালো লাগল! কে জানে জগতের কী রহস্য! কবিতার শিরোনাম 'অচিন'।
 
মাঝে মাঝে পুরনো সম্পর্কগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার মাঝখানে পিঁড়ি পেতে বসি। এই পিড়িতেই আমার ঠাকুমা শ্রীলক্ষ্মী বসাতেন। ভাবি, এ জন্মের যিনি মা, যে আমার মেয়ে, পরের জন্মে হয়তো সে উঠোনের কোনটাতে পঞ্চমুখী জবা অথবা বাগানে কাঠবেড়ালটি হয়ে দৌড়ে পালাবে তখন আমি চিনতে পারব কি? প্রজন্মেও তো কত ফুল কত পোকা কত মানুষের মুখোমুখি—চিনতে পারিনি৷ যে আমায় হঠাৎ মারল তাকে বলতে পারিনি তুমি বিগত জন্মের তীরে গেঁথে যাওয়া হরিণের নরম মাংস ছিলে। আমিই তোমাকে মেরেছি। এই ঠাকুরের পিঁড়ি, যার পিঠে বসে এসব ভাবছি, সেই পরজন্মের প্রজাপতি, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ কি? 
  
ভালো থাকবেন। সময় পেলে মেইল করবেন। আপনার মেইলের অপেক্ষায়...

[আমরা মফস্বল শহর থেকে ঢাকা এসেছি। কারণে অ-কারণে কত কত সময় আমাদের একসঙ্গে কেটেছে। নগর ঢাকায় প্রায় ৩ বছর আমাদের দেখা নেই। অজিত একদিন প্রস্তাব দিল, চলেন আমরা ই-চিঠি লিখি। তার প্রস্তাবটা খুব ভালো লাগে। গত ৩ মাসে ১৫/১৬টি ই-চিঠি আদান-প্রদান করেছি। তার মধ্য থেকে একটি চিঠি প্রকাশ করা হলো]
—নি.স


অজিত দাশ কবি ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৮৯, কুমিল্লা শহরে। কম্পিটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ : ওশোর গল্প (বেহুলাবাংলা, ২০১৮), প্রজ্ঞাবীজ (মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯)। 

menu
menu