‘উড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিশাপ

২৮তম কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (KIIF) এ গিয়ে নিজেদের দেশের সিনেমা দেখলাম। কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া ছবিটি সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছে। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন মুহাম্মদ কাইয়ুম। ভাটির দেশের মাটির ছবি কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া। নাম শুনলেই বুঝা যায় এই সিনেমাটি বাংলার ভাটি অঞ্চলের মানুষের গল্প নিয়ে নির্মিত। বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে টিকে থাকার লড়াইরত একদল প্রান্তিক মানুষের গল্প খুব দারুণভাবে উঠে এসেছে এই সিনেমায়। 

বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চলের মানুষের যাপিত জীবনের নানারূপ এই সিনেমায় উঠে এসেছে। কুড়া পক্ষীকে সাধরণত বলে ডাহুক পাখি। এই পাখি জলাশয়ের কাছাকাছি থাকে। ডাহুক পাখির প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ, জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা, শ্যাওলা, ধান ইত্যাদি। পোষা ডাহুক চাল, ভাত খায়। অনেক সময় খাবারের খোঁজে মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। বাসা বাঁধে জলার ধারে, ঝোপে কিংবা বাঁশঝাড়ে, তবে পানি এদের প্রধান আশ্রয়। ডাহুক পাখি যেন হাওরের মানুষের প্ৰতিচ্ছবি। তাই কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া সিনেমাটির নামকরণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। জলাশয়ের কাছাকাছি থাকলেও খাবারের সন্ধানে একটা সময় ডাহুক পাখিকে যেমন শূন্যে উড়াল দিতে হয় তেমনি হাওরের মানুষকেও সর্বস্ব হারিয়ে একসময় অজানার পথে পাড়ি জমাতে হয়। ফসল অর্থাৎ ধান যে কত আরাধ্য একটা ব্যাপার হতে পারে, কতটা পূজনীয় হতে পারে তা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায়।

হাওড় অঞ্চলের মানুষ এর জীবন ধারণ মূলত কৃষি নির্ভর। হাওড় এর পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সেই কৃষি ফসল নিমিষেই নষ্ট হয়ে যায়। প্রাকৃতিক বিরূপ পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই করতে হয় বেঁচে থাকার লড়াই। আমরা শহুরে মানুষ যেমন বৃষ্টি হলে খিচুড়ি গরুর মাংস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই ঠিক তখন হাওড় এর মানুষ তাদের সারা বছরের অন্নসংস্থান ফসল বাঁচাতে লড়াই করে। হাওড় এর মানুষ এর এই জীবন সংগ্রাম এবং তাদের সুখ দুঃখ হাসি কান্না এই সিনেমায় চিত্রায়িত হয়েছে। বাংলার ছয়টি ঋতু সুন্দরভাবে এই সিনেমায় উপস্থাপন করা হয়েছে। সিনেমায় ক্যামেরার দৃশ্যায়ন এর কাজ খুবই নান্দনিক। চোখের জন্য দারুণ প্রশান্তিময়। হাওড় এর রূপ পরিচালক সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন।

এই সিনেমাতে আলাদা করে সকাল, সন্ধ্যা এবং রাত এর চিত্রায়ন দর্শক আবিষ্কার করতে পারবে। হাওড় অঞ্চলে বৃষ্টি আসলে সারা আকাশ যখন কালো মেঘে ঢেকে যায়, তারপর ঝুম বৃষ্টি নামে এই ধরনের চিত্রায়ন খুব একটা সহজ নয় কিন্তু সেটিও পরিচালক করে দেখিয়েছেন। এই ধরনের লোকেশনে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে কোন সিনেমার শুটিং করা অনেক কঠিন। পরিচালক তার সৎ প্রচেষ্টার জন্যই তা করতে পেরেছেন। সিনেমাটির সবচাইতে সুন্দর দিক কলাকুশলীদের অভিনয় এবং তাদের সাজসজ্জা। হাওড় অঞ্চলের ভাষা রপ্ত করা এবং সেই ভাষায় অভিনয় করা মোটেও সহজ নয়। তাদের সাবলীল অভিনয় এর জন্য একবারো মনে হয়নি তারা হাওড় অঞ্চলের মানুষ নন।

সিনেমাটিতে দুটি গান রয়েছে, দুটিই প্রচলিত। এর একটা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান। আর একটা রাধারমণ দত্তের ধামাইল গান। ধামাইল গান এর  যে সরলতা আছে এবং একটা আত্মিক টান আছে তা দারুণ ভাবে উপভোগ্য। সিনেমার মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়িতা মহলানবিশ, উজ্জ্বল কবির। আরও রয়েছেন আবুল কালাম আজাদ, সুমি ইসলাম, বাদল শহীদ, সামিয়া আক্তারসহ আরও অনেকে।

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া একটা চমৎকার, নান্দনিক এমনকি মাটি এবং মানুষের ছবি হয়ে উঠতে পেরেছে। আন্তরিক সদিচ্ছা ছাড়া এমন শিল্পকর্ম সহজে হয়ে ওঠে না। পরিচালকের এমন সদিচ্ছাকে সম্মান জানাই। সম্মান জানাই কলাকুশলীদের। কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া সিনেমার মতো চলচ্চিত্রগুলো আমাদের শহরে থেকেই গ্রামের সাথে, শেকড়ের সাথে, যোগাযোগ স্থাপনের একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছে। 


এস.এ.এম আল মামুন সংস্কৃত কর্মী। সাধারণত চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা লিখেন। কুমিল্লার সংস্কৃতি অঙ্গনে পরিচিত মুখ। তিনি কুমিল্লায় থাকেন।

menu
menu