শান্তিনিকেতনের রোজনামচা

বিশ্বভারতীতে নোবেল চুরি একটা বড় ঘটনা। তারপর থেকেই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আমাদের অবাধ ঘোরাফেরা ও অনন্ত আড্ডার দিন শেষ হলো। তিনপাহাড়, গৌরপ্রাঙ্গণ, পুরনো ঘণ্টাতলা এমনকি কুমির ডাঙ্গার মাঠেও যে দিনযাপন চলত তাতে বাধা এল। তখন বাইরে যেমন পাঁচিল ছিল না, আমাদের মনেও কোনো পাঁচিল ছিল না। শান্তিনিকেতনের স্থানীয় মানুষ বোলপুর এবং আশেপাশের গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তখন থেকেই মেলামেশার পরিধি আমাদের ছিল। তারাও আসত ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতে। অনেকের সঙ্গেই তখন বন্ধুত্ব হয়েছিল যা আজও অটুট। এই উদার ক্যাম্পাসে আড্ডা মারার ক্ষেত্রে নানা দ্বন্দ্ব যখন শুরু হলো আমরা ধীরে ধীরে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেলাম কোপাই সোনাঝুরির দিকে। কোপাই সোনাঝুরি তখন নির্জন ছিল। জীবক পেরোলেই সন্ধ্যাবেলা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। শ্যামবাটী থেকে কোপাই এর রাস্তা ছিল গড়ান। আর দুদিকে ছিলো অনেক গাছ। আমাদের তখন অনেকেরই সাইকেল। চলে যেতাম ঢালু দিয়ে গড়গড়িয়ে। রোদের সময়ও ছায়া ছিলো রাস্তায়। তাই কষ্ট হতো না। খোকনদার চায়ের দোকান হয়নি তখনো। জল কম থাকলে ব্রিজের নিচের খোপ খোপ ঘর গুলোয় আমরা খেলা করতাম। সেই ছিল আমাদের রাজত্ব। আমাদের রাজা ছিল  সবুজদা। আমরা ওকে আরণ্যকের দবরুপান্না বলতাম। ধীরে ধীরে খোকনদার চায়ের দোকান হলো।  পোঁতা হলো বটের চারা। সেই বটগাছে এখন ঝুড়ি নেমেছে। এখন ওকে দেখে বয়েস মাপি। সকাল বেলায় মর্নিং ওয়াক এর নাম করে আমরা পৌঁছে যেতাম নদীর পাড়। খোকনদা নিয়ে আসতো হাঁসের ডিম। গরম গরম ডিম সেদ্ধ খেয়ে  নদীতে মাছ ধরা দেখতাম বসে বসে। এসব মাছ মাঝেমাঝে  নিয়ে আসতাম বাড়িতেও। তখন সুবোধ দাস বাউল বেঁচেছিল। তার ছিল পায়ের সমস্যা। খোঁড়া পা নিয়ে বহু বহু মাইল সাইকেল চালিয়ে সুবোধ ক্ষ্যাপা আসতো দোতারা নিয়ে।  সমস্ত কথা শেষে ক্ষ্যাপা বলতো, ‘তাই ল্যায়’ (তাই নয়?)  সবুজ দা তাই নাম দিয়েছিল ‘ল্যায় ক্ষ্যাপা’। সে কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত জানতো না। সবুজদার মনে হলো, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারলে  ক্ষ্যাপা কিছু পয়সা বেশি পাবে টুরিস্টদের কাছে। শুরু হলো তাকে গান শেখানো। অনেক চেষ্টা করেও গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথের পর, একটা লাইনও তোলানো গেল না তাকে। শনি-রবিবার টুরিস্টদের ভিড় হলে পুরনো ঘণ্টা তলায় ক্ষ্যাপা বসতো। মাঝে মাঝে সবুজদা গিটার বাজিয়ে গান গাইতো ক্ষ্যপার সঙ্গে।  সেদিন রোজকার হতো বেশি ক্ষ্যাপার। একদিন তাকেও বারণ করা হলো ক্যাম্পাসের ভিতর বসতে। আমি একদিন কোল্ডড্রিংস নিয়ে গেলাম। ক্ষ্যাপা কোনোদিন কোল্ডড্রিংস খায়নি। গ্লাসে ঢেলে দিলাম কোল্ডড্রিংস। সবাই আমরা তাকিয়ে আছি কেমন লাগবে ক্ষ্যাপার? খাওয়ার  পর ক্ষ্যাপা মুখ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ভালো লাগছে আবার ফুরিয়েও যেচে।’ সেদিন বুঝিনি আজ বুঝি ভালোলাগা আর ফুরিয়ে যাওয়া একই সঙ্গে চলে। এখনো কোপাই যাই। বুঝতে পারি সময় অনেক বদলেছে। ক্যাম্পাসের ভিতর শুধু নয় ক্যাম্পাসের বাইরে গোটা শহরে পড়েছে বহু পাঁচিল। সোনাঝুরির রাস্তা, শ্যামবাটি থেকে প্রান্তিক যাওয়ার রাস্তা, বোলপুরের চারিদিকে কংক্রিটের রাস্তা দেখে, মাঝে মাঝে ভ্রম হয় ‘এটা কী বোলপুর’ না অন্যশহর। দুদিকে শর ফুলের দুলুনি দেওয়া নিরুপদ্রব রাস্তাগুলো আর নেই। দুম করে আকাশ ছুঁতে পারা মাঠগুলো নেই। একদিকে বিশ্বভারতীর পাঁচিল অন্যদিকে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে, দৃশ্য দূষণ তো হচ্ছেই, আবার কারোর কারোর কাছে এ দৃষ্টিনন্দনও। সময় বলবে ইতিহাস বলবে এসবের কী কী প্রয়োজন আছে, বা কতটা উন্নয়ন হয়েছে আমাদের স্থানীয় জীবনযাত্রার মান। আমি ভাবি পাঁচিল তো বাহ্যিক বিষয় নয় শুধু। সে তো আমাদের  অন্তরেও থাকে। তাই যতই পাঁচিল পড়ুক আমাদের বেড়ে ওঠার শিক্ষা অন্তরের পাঁচিল দিতে পারবে না আর বেঁচে থাকতে। কোনো বিদ্যালয়, কোন অরগানাইজেশন আমাদের পাঁচিল দিয়ে আলাদা করতে পারবে না। আজ কোপাই গিয়েছিলাম ভীড় নেই পুরোনো দিনের মতো লাগলো। নদীতে বান এসেছে।
নদীর দিকে তাকালে মনে হয়, এখন সে কেবল বয়ে যেতে চায়। প্রতিকূলতার দিকে তার কোন দৃষ্টি নেই। ভ্রুক্ষেপ নেই। এখনো তেমন জল বাড়েনি। তবু টান আছে। তার প্রাগ্রসরতার টানে ছোট-বড় পাথরগুলিও, সকলের অজান্তে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে কোথায়! ধরিত্রীর বুকে যত ক্লেদ, যত ব্যর্থতা—যা দীর্ঘকালের ব্যবধানে জমা হয়েছে, তাই কি আজ মোচড় দিয়ে উঠছে? বয়ে যাচ্ছে কাদাজল! যে জলে কোন প্রতিবিম্ব পড়ে না—তাকেও সে গ্রাস করে নেয়।( ধুলা উড়ানি—সৈকত রক্ষিত)
 আমরাও তো নদীর মতো হতে পারি  যা কিছু প্রতিকূলতা,  যা কিছু  ব্যর্থতা তাকে গ্রাহ্য না করে, রচনা করতে পারি নিজেদের যাপন যেখানে কোনো দেয়াল থাকবে না। এই টুকুই।


• কবি, ভারত।  

menu
menu