পড়ো, তোমার প্রভুর নামে

পড়তে পারাটা আমার কাছে একটা ম্যাজিকের মতো মনে হয়। হাজার বছরের সমস্ত মানুষের কথা আমি ইচ্ছে করলেই জানতে পাচ্ছি। ইচ্ছে হলেই হারিয়ে যাচ্ছি মিশর, ব্যাবিলন, মেসোপটেমিয়া, ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতায়। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর গুহা আমার কাছে উন্মোচন হয়ে যাচ্ছে নতুন আলোকে।

ইচ্ছে হলেই সক্রেটিসের কথা শুনতে পাচ্ছি, তাঁর সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছি এথেন্সের পথে পথে। মহামান্য দার্শনিক আমার কাঁধে হাত রেখে বলছেন, শোনো, নিজেকে জানো।

এতো আমার কল্পনা নয়, বাস্তব, বুদ্ধর সঙ্গে আমি বসে আছি নৈরঞ্জনা নদীর পাড়ে। তাঁর সঙ্গে আমিও আলোকপ্রাপ্ত হয়ে উঠছি। এ কি আমার স্বপ্ন যে আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পদ্মার বোটে চড়ে বেড়াচ্ছি, আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে আর আমি তাঁর সঙ্গে বসে আবৃত্তি করছি আরও পেছনের কোনো প্রেমিকের পত্র-মেঘদূত! 

কুরুক্ষেত্র কি আমার চোখের সামনেই ঘটেনি? পাণ্ডব আর কৌরবরা যখন রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিল তখন আমিও কি মহাকবি ব্যাসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম না পাহাড়ের মাথায়? 

অন্ধ কবি হোমারের সঙ্গে আমিও কি গেয়ে বেড়াইনি, শোনো, দেবী, অ্যাকিলিজের ক্রোধের কাহিনি। 

পড়তে পারাটা একটা বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারা খুবই দুর্ভাগা যাদের পড়তে শেখার সুযোগ হয়নি। তাদের চেয়েও দুর্ভাগ্য তাদের যারা পড়তে শিখেও পড়ল না। 

পড়লে কী হয়?

এমনিতে মানুষের গড় পড়তা আয়ু ষাট-সত্তর বছর। ধরা যাক আমার বয়স ৪০, যখন আমি পেছনের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস জানবো আমার বয়স হয়ে যাবে পাঁচ হাজার ৪০ বছর! আমি জানি এই মহাকালের বয়স সাড়ে তেরো বিলিয়ন বছর। আক্ষরিক অর্থেই আমার বয়স এখন ১৩.৫ বিলিয়ন ৪০ বছর! সমগ্র মহাবিশ্ব আমার চোখের সামনে বিস্ফোরিত হয়েছে! এই যে আমি দেখছি একেকটা গ্যালাক্সি কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই যে আমাদের মিল্ক ওয়ে গ্যালাক্সি। এই যে আমাদের সৌরমণ্ডল। এই তো পৃথিবী সৃষ্টি হলো মাত্র ৪০০ কোটি বছর আগে। ওই যে, আদিম সমুদ্রে জেগে উঠছে আদিমতম প্রাণ প্রোটোপ্লাজম। এই যে প্রাণের আদি কোষ ভেঙে যাচ্ছে...। আরকিয়ান যুগ থেকে জুরাসিক যুগ অতিক্রম করে বরফ যুগ, পাথর যুগ পার হয়ে আমি মানুষ হয়ে উঠলাম। তারপর আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। কেউ আমাকে বলল, শোনো, তুমি তো আদতে মানুষই নও, তুমি তো বানরের বংশধর। কেউ বলল, তুমি আশরাফুল মাখলুকাত। আমি দিকভ্রান্ত হয়ে গেলাম। তখন সক্রেটিস আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, শোনো, তুমি নিজেকে জানো! লাও ৎস আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি শুধু এই মহাবিশ্বের অংশ নও, তুমিই মহাবিশ্ব!

মুহম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে আমি হেরা গুহায় বসে ছিলাম। তখন আল্লাহ বাণী পাঠালেন, পড়ো, তোমার প্রভুর নামে।

সাধারণ মানুষ সাধারণত খুব নিকট অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারে না। জৈবিক তাড়নাতেই তাদের জীবন চালিত। অতীত বলতে তাদের থাকে কিছু স্বার্থগত স্মৃতি আর ভবিষ্যত বলতেও ওই কিছু সঞ্চয়ের পরিকল্পনা। খাওয়া-খাদ্য, বাসস্থানের স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প কিছু ইতরশ্রেণির প্রাণীরও থাকে। সারা জীবন ধরে আমি খুঁজে গেছি মানুষের সঙ্গে পশুর পার্থক্যটা আসলে কতদূর?

এমন একটা সময় গেছে যখন আমি পাগলের মতো ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আর ঈশ্বর আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন আমাদের দেখা হয়ে গেল। আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। 

অস্তিত্ববোধ আমাকে পাগল করে ফেলেছিল। আমি জেনেছিলাম, মানুষ আসলে মহৎ কোনো পরিকল্পনার অংশ নয়। সে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়। সে অভিশপ্ত। 

ফুকো আমাকে বলেছিলেন, মানুষের মানুষ ধারণাটা খুবই সাম্প্রতিক। মানুষ শব্দটা সমুদ্র তীরে বালু দিয়ে লেখা। যেকোনো মুহূর্তে একটা ঢেউ এসে সেটা মোছে দিবে। মানুষ নিজেই নিজের ওপর মহত্ব আরওপ করেছে। মানুষের কোনো মানবিক সত্তা নেই।

আমি ভয়াবহ আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়েছিলাম। 

তারপর আমি জানলাম, মানুষ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে। মানুষ ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারে। 

লালন আমাকে বললেন, সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার!

আহারে! এমন মানবজনম আর কী হবে!

মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম বলেই না আমার বোধের জগতে প্রতি মুহূর্তে একেকটি নতুন নতুন জগতের দরজা খুলে গেছে। একেকটি বই হাতে নিয়েছি আর আমার শরীরে বিদুৎ লেগে গেছে! বই পড়েও যে গায়ে একশো চার ডিগ্রি জ্বর এসে যেতে পারে এটা বই যারা পড়ে না তারা কোনোদিনই বুঝবে না। কথা হচ্ছে, জ্বর আনার জন্য বই পড়তে হবে কেন? কারণ, ওই জ্বর সারার পর নবজন্ম লাভ হয়!  

শুধু বই পড়ার কারণেই আমি জানতে পারলাম, কিছু কবিতা পড়লেই শরীর অবশ হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে একজন মানুষ জন্মেছিলেন, তিনি কিছু কবিতা লিখেছিলেন, গত তিন হাজার বছরের যেটুকু জ্ঞান আমি আহরণ করেছি, আমার মনে হয়েছে এ মানুষটি সমস্ত মানবকুলে এ পর্যন্ত যতো মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে একজন মহত্তম মানুষ। এই মানুষটির নাম জীবনানন্দ দাশ। আমি তাঁর সঙ্গে হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেছি। সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর পাড়ি দিয়ে অবশেষে বনলতা সেনকে খুঁজে পেয়েছি। তার পাখির নীড়ের মতো চোখের দিকে তাকিয়ে দুদণ্ড শান্তি পেয়েছি।

বই না পড়েও যে মানুষ নিগূঢ়তম চিন্তার জগতে ঢুকতে পারে না, তা না। কিন্তু, ওটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যথাপোযুক্ত লোক খুঁজে নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ চালানো। বই হচ্ছে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে সহজতম পদ্ধতি হাজার বছরের মানুষের চিন্তার ইতিহাসকে সংযুক্ত করার। হয়তো ভবিষ্যতে এর চেয়ে সহজ কোনো উপায় বের হতে পারে। হয়তো এমন কোনো চিপ বের হবে, জন্মের তিন সপ্তাহর মধ্যে ব্রেনের সঙ্গে সেট করে দিবে, তাতে অটোমেটিক্যালি সব জানা হয়ে যাবে! 

রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দর করে বলেছেন, ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে! বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে। কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে। কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে। অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক -একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে’ (লাইব্রেরি) 

মানুষ আসলে কেন জানতে চায়? জ্ঞান দিয়ে কী হয়?

কেন জানতে চায় না এ প্রশ্নটির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন জানতে চায়!

বেশিরভাগ মানুষই জানতে চায় না। এটাতো আমাদের চারপাশের মানুষদের দেখলেই দেখি। কিছু সীমাবদ্ধ ধারণা নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেয়। হয়তো বাসে-ট্রেনে, হোটেলে আলাপ-আলোচনায় কিছু জানে, পেপার-পত্রিকা পড়ে, টিভি দেখে, সিনেমা দেখে, আত্মীয়-পরিজন বাড়ি এলে তাদের সঙ্গে দুএকটা খোশগল্প করে, মওকা মতো লোক পেলে দুটো খাঁজুরে আলাপ, আরেকটু রসিক হলে দুটো রাজনৈতিক কচকচানি, বড়জোর, দুএকজন পীর-দরবেশ হাতের কাছে পেলে দুএকটা আধ্যাত্মিক কথাও ওঠে, হুজুর, কই থাইকা আসলাম! কই যামু? কন ইকটু।

ভাষাগত এই ভাসমান কথোপকথনই বেশিরভাগ মানুষের জীবন-নির্বাহের পাথেয়। এর বাইরে গিয়ে খুব অল্প লোকই আত্মাকে রক্তাক্ত করে জানতে চায়, কোত্থেকে আসলাম, কেন আসলাম, কোথায় যাব! জরথুস্ত্রের মতো খুব অল্প লোকই দশ বছর জঙ্গলে কাটিয়ে এসে বলেন, শোনো, ঈশ্বর তো মারা গেছেন। ওনার জ্বর হয়েছিল।

কেন মানুষ জানতে চায় এটা আসলে একটা প্রহসনমূলক প্রশ্ন। মানুষের স্বভাবধর্মই হচ্ছে জানতে চাওয়া।  

জানছে বলেই তো মানুষ মানুষ হয়েছে। মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সে জানবে। অসীম কৌতূহল আছে বলেই তো সে মানুষ। সৃষ্টির আদি থেকেই সে পা বাড়িয়েছে শুধু জানার জন্যই। আদিম মানুষ যদি পা না বাড়াতো তাহলে  তো আমরা এখনো গুহার মধ্যেই থাকতাম। পাথর ঠুকে ঠুকে আদিম মানুষ আগুন জ্বেলেছিল বলেই-না আমরা এখন একটি ম্যাচের কাঠির ঠুকায় আগুন জ্বেলে ফেলতে পারি। এটা কি বিস্ময়কর ব্যাপার, মানুষ এখন বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণাটিকেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে ফেলেছে! এরচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার আর কী হতে পারে যে মানুষ আলোর কণাটিরও পরিমাপ করে ফেলতে পারছে! কোয়ান্টাম বলবিদ্যা থেকে তার চিন্তা বিস্তৃত হয়ে গেছে আপেক্ষিক মহাবিশ্বে।  

ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কিছু মানুষ জ্ঞান-অন্বেষণের জন্য তাদের জীবন ছাড়খাড় করে ফেলেছেন। আজ আমরা সেগুলো শুধু ঘরে বসে বসে পাঠ করলেই জানতে পারি। তারপরও অনেকে জানতে চায় না কেন?

এটাই হচ্ছে আশ্চর্যজনক প্রশ্ন, কেন বেশিরভাগ মানুষই জানতে চায় না! 

এ কথা সত্য, জানার কোনো শেষ নাই। তাই বলে ও কথা তো সত্য নয়, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।

জানা কি খারাপ না ভালো?

জ্ঞান দিয়ে কী হয়?

কিছু হয় কি আদতে?

বই পড়া ভালো না খারাপ?

বইপড়াকে সামাজিকভাবে উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু, আবার নিরুৎসাহিতও করা হয়। 

আমাদের ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সমস্ত বইকে চিহ্নিত করা হয়েছিল আউট বই হিসেবে। এবং আউট বই হাতে থাকা মানেই ছেলেটা বখে গেল। আমি তো আমার জীবন তছনছ করে ফেললাম আউট বই পড়তে পড়তে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম বলে জামাল স্যার আমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলেছিলেন। তারপরও যখন আমাকে নিভৃত করা যায়নি তখন বাড়িতে হলুদ চিঠি পাঠিয়েছে। আমার মা আমার গল্পের বই টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। 

তারপরও আমাকে থামানোর যায়নি। লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়তাম। এক সময় এটা আমার অসুখ হয়ে গেল। পড়ি আর না পড়ি হাতের কাছে একটা বই না থাকলে অস্বস্তিবোধ করি। কেমন যেন একা একা লাগে। সমগ্র মহাকাল আমার মাথার ভেতর ভনভন করে ঘুরতে থাকে। আর অদ্ভুত সব প্রশ্ন! তখন তো গুগোল নেই, এমন কোনো নির্দিষ্ট বইয়ের কথাও জানি না যা পড়লে মুক্তি পেয়ে যাব। এমন কোনো মানুষও নেই যে আমাকে হাত ধরে পৌঁছে দিবে মুক্তির সোপানে ।

তোতাপাখির মতো বুলি সবাই আওড়াতে পারে। যে যার নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের শিক্ষা ও বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু, একদিন না একদিন আত্মাকে রক্তাক্ত করে জানতে হয়, যদি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির কোনো অর্থ থাকে তাহলে মানুষের জীবনেরও একটা অর্থ আছে। সেই অর্থটা কী!

এই জন্যই সক্রেটিস বলছেন, নিজের জীবনের মুখোমুখি হলো না যে-ব্যক্তি, কর্তব্য-অকর্তব্য, উত্তম-মহোত্তমের আদর্শ খুঁজল যে-মানুষ, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত, শ্রেয়-পরিহার্য স্থির করতে পারল না যে, তার বেঁচে থাকা তো উদ্ভিদ বা কীট-পতঙ্গের বেঁচে থাকা। তার মূল্য কী?

মনে পড়ছে মওলানা রুমির কবিতা। সাগরের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছো তুমি তোমার কাপড় শুকনা রাখবা? তোমাকে ন্যাংটা হয়ে ঝাঁপ দিতে হবে। অতল থেকে অতলান্তে!

জীবন হচ্ছে একটা মহাসাগরের তীর ধরে হাঁটা। আমরা জানি না আমরা কোথায় পৌঁছাব। কিন্তু, ঘুমিয়ে পড়ার আগে হেঁটে যেতে চাই মাইল মাইল পথ।

বই পড়া সেই হাঁটার গতিকে অনেকখানি গতিশীল করে দেয়। একজন মানুষের পক্ষে মানবজীবনের সমস্ত অনুভূতি আহরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু, শেকসপীয়র, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, দস্তইয়েভস্কি, মার্কেস, মানিক বন্দোপাধ্যায় পড়লে তার অনেকখানি লাঘব হয়। 

বই পড়া মানে হচ্ছে একজীবনের মধ্যে বহুজীবন যাপন করা! 

সত্যি করে বলতে, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান এতদূর বিস্তৃত হয়েছে যেকোনো একজন মানুষের পক্ষে আর তার নাগাল পাওয়া সম্ভব না। জ্ঞান মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। কে যেন বলেছিলেন এ কথা, সম্ভবত কবি শামসুর রাহমান, যে, মানুষের জ্ঞান যে-পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে তার সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেতে হলেও একজন মানুষের কম পক্ষে চারশো বছর বেঁচে থাকা দরকার।

আবার ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষ ইচ্ছে করেই নিজের জীবনকে টেনে লম্বা করে। এত লম্বা করার আসলে কিছু নাই। যা জানার তা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই বেসিক ধারণাটা হয়ে যায়। তারপর মানুষ শুধু চর্বিতচর্বণ করে।

আমারও তাই মনে হয়। ফ্রয়েডের সঙ্গে আমি কিছুটা একমত। কেউ যদি জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত জানতে চায় তাহলে কে আপত্তি করবে? মৎসচাষ থেকে গোলাপচাষ, মৌমাছি পালন পদ্ধতি পর্যন্ত জানতে হলে হাজার বছরেও কুলোবে না। এবং সব জানাতেই কিছুটা সুখ পাওয়া যায় বটে। সুখ পাওয়া যায় কারণ প্রতিটা নতুন তথ্যেই মস্তিষ্কের নতুন কিছু নিউরন আন্দোলিত হয়। তবে, সব জানাই বোধ ও মননকে উন্নত করে না। নিছক তথ্য আহরণ দিয়ে কিছু হয় না। এই জন্য আমি ক্যারেন্ট এফেয়ার্স পছন্দ করি না। এই জন্যই আমি কবিতা পছন্দ করি সবচেয়ে বেশি। কবিতা সে অর্থে কোনো তথ্য পরিবেশন করে না। ওটা কবিতার প্রাথমিক শর্ত নয়। ওর কোনো ব্যাখ্যাও নেই। ওটা হচ্ছে সম্পূর্ণ অনুভবের ব্যাপার। এবং এই জন্যই কবিতা মহত্তম শিল্প। তবে, কবিতাকে বুঝতে হলে অনুভূতিকে খুব ধারালো হতে হয়। আর অনুভূতিকে ধারালো করতে হলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানতে হয়।

যার যতটুকু ধারণা, জানাশোনা, অনুভবের গভীরতা তার জীবন ও জগৎ ঠিক ততোটুকু। জগৎ আমাদের বাইরে নয়, জগৎ আমাদের ভেতরে। যে জানে না এই পৃথিবীর বাইরেও আরও এমন অসংখ্য পৃথিবী থাকতে পারে তার জীবন ঠিক এই পৃথিবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যার জীবন তার কুয়োর মধ্যেই আবদ্ধ। 

এ কথা উঠতেই পারে, যতটুকু জানি ততোটুকুই যথেষ্ট। হ্যাঁ, এ কথা তো সত্যই। যে যার শরীর ও মন নিয়ে বাস করে। এবং নিজস্ব জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক সুখ নিয়ে যে যার মতো পরিতৃপ্ত। কিন্তু, আপনি নতুন কিছু জানতে আগ্রহী হচ্ছেন না-মানে হচ্ছে আপনি আপনার জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন। এত জেনে কী হবে এই প্রশ্ন এখানে অমূলক। একমাত্র উত্তর, ওটাই মানুষের ধর্ম। প্রতি মুহূর্তে সে তার সীমা ছাড়িয়ে যাবে।

বাথরুমের বালতির পানিতে গোসল হয়। ওতে শরীর পুরোটাই ভিজে। তাই বলে কি পুকুরে গোসল করা আর বাথরুমে গোসল করা এক কথা! পুকুরে তো একটু সাঁতরানো যায়। আবার নদীতে গোসল করা আর পুকুরে গোসল করাও এক কথা নয়। পুকুরেও সাঁতরানো যায় নদীতেও সাঁতরানো যায়—তাহলে নদীর সঙ্গে পুকুরের পার্থক্য কোথায়? নদীতে স্রোত আছে। ভয়ও আছে—ভেসে যাওয়ার। ওই ভয়কে জয় করে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটানোর মতো সুখ পুকুরে কোথায়? আবার সমুদ্রে নামলে কী হয়! বিশালত্বে নিমজ্জন! গহীন জলে অবগাহন! আবার সমুদ্রের তীর ধরে সাঁতার কাটা আর সমুদ্রের মাঝখানে নামা নিশ্চয়ই একই অনুভূতি হবে না। আমার খুব ইচ্ছে করে, এ সাহস আমার জীবনেও হবে না জানি, তারপরও খুব ইচ্ছে করে, বিশাল এক মহাসাগরের মাঝখানে নেমে অতল-গভীর-গহীন জলের ওপর চিৎ হয়ে ভাসতে ভাসতে অনন্ত অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবব, কোথায় এলামরে!

বাস্তবে অনেক কিছুই হয় না। বাস্তবে যা হয় না সেখানে কল্পনার লাগাম ছুটিয়ে দেয়া যায়। জানাশোনা এই কল্পনার লাগামকে বিস্তৃত করে দেয়। এ কথা কেউ বলতে পারে, যা বাস্তব নয়, তা কল্পনা করে কী করবো! বাস্তব কী? যদি কল্পনা বলে কিছু না থাকে তাহলে বাস্তব বলেও কিছু নেই। যে কল্পনা আমাকে বাস্তবতার মতোই শিহরিত করে তোলে তাকে আমি অস্বীকার করি কী করে!  কবিগুরু বলেছেন, 

ঘটে যাহা তাহা সত্য নয়।
সত্য তাই যা রচিবে তুমি।
কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

বই পড়া মানুষের জীবনকে কিছুটা সহনশীল করে তোলে। আমি যদি সঠিক হই অপর কেন সঠিক নয়! অপর কেন আমার মতো নয়? আমি কেন অপরের মতো নই এই বোধ জাগ্রত করে। 

পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষের হাজার হাজার বিশ্বাস। এবং এই বিশ্বাস নিয়েই লাগে যতো গণ্ডগোল। শুধুমাত্র নিজস্ব বিশ্বাস, মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা নিয়েই যুগ যুগ ধরে হয়ে গেছে অসংখ্য যুদ্ধ, অজস্র রক্তপাত। 

যেকোনো নতুন চিন্তা মানেই আগের চিন্তার বিপরীত। বাঁহাত দিয়ে খাওয়া নিষেধ, কিন্তু, ওটা তো আমারই হাত, সে-হাত পরিষ্কার থাকলে তোমার অসুবিধা কী? কিন্তু, ডানহাতও বলতে পারে যে-হাত দিয়ে তুমি শৌচকর্ম করো সেটা কেন খাওয়ার কাজে ব্যবহার করছো, নালায়েক! তোমার গর্দান যাবে।

বই পড়া এতটুকু সহনশীল করে মানুষকে, ঠিক আছে, তোমার হাত, তুমি ওটা দিয়ে খাও না তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকাও সেটা একান্তই তোমার নিজস্ব ব্যাপার। আমি শুধু হাতের ব্যবহারের ভালো-মন্দের কথা বলতে পারি। কিন্তু, দয়া করে তোমার বাঁহাত আমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ো না। বই যারা পড়ে না তারা ওখানেও আপত্তি করবে। তোমার বাঁ হাত তুমি তোমার গুহ্যদ্বারেও ঢুকাতে পারবে না। ওই অধিকার তোমার নেই। তোমাকে সমগ্র মানবসত্তার অংশ হতে হবে। তা না-হলে হাত কেটে ফেলা হবে, বদমাশ কোথাকার!

আমার যেটা মনে হয়, যে-কেউ তার বিশ্বাসের কথা বলতে পারে, ভদ্রচোতিভাবে, সেটা যদি কেউ গ্রহণ করে তো ভালো, না করলেও জোর চলে না, অন্যের জিভ নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার কারও নেই। কেউ পটল খাবে না বেগুন খাবে এটা তো একদমই তার ব্যাপার। 

কিন্তু, আসলে ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। মানুষ যখন গোত্রবদ্ধ হতে শিখল খাদ্যান্বেষণের প্রয়োজনে, বন্যপ্রাণীর হাত থেকে নিরাপত্তার প্রয়োজনে, ঠান্ডা-খড়ায়-ঝড়-বাদলে সঙ্গবদ্ধ হয়ে বাঁচার তাগিদে, এবং তারপর, আরও বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করলো ব্যাপক উৎপাদন ও চাহিদা-যোগানের সুবিধার্ধে, সেখানে অনিবার্যভাবেই একদল মানুষকে একই বিশ্বাসের আওতায় আনা অনস্বীকার্য ছিল যেকোনো ধর্ম ও মতবাদের নামে। 

রাষ্ট্র থাকলে সেখানে বিশ্বাস থাকবেই, এবং বিশ্বাস নিয়ে গণ্ডগোল হবেই। 

তবে কিছু উন্নত রাষ্ট্র এই সহনশীলতায় পৌঁছেছে যে, যার যার বিশ্বাস তার তার। যে যার মতো থাকুক। রাষ্ট্রীয় আইন মেনে সে যা কিছু করুক ওটা তার ব্যাপার। তুমি তোমার বিশ্বাস নিয়ে থাকো, অন্যের বিশ্বাসে তুমি নাক গলিয়ো না।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা এখনো সেই সহনশীল স্তরে পৌঁছায়নি। তাই পান থেকে চুন খসলেই আমাদের এখানে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যায়।

এর অবশ্যই অনেক নৃতাত্ত্বিক কারণও আছে। আমাদের এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশ হয়েছে তাও ফেলে ছড়িয়ে খুব বড়জোর একদেড়শো বছর হবে। সেই শিক্ষাও পুরোটাই বাণিজ্যিক। কিছু কেরানি, সেলসম্যান তৈরি করাই তার প্রধান ভূমিকা। তুমি একটা প্রোডাক্ট বিক্রি করতে পারো কিনা এটাই হচ্ছে তোমার সমস্ত শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি! ইংরেজরা যখন এদেশে আসল হিন্দুরা তখন তাদের ওখানে কিছু চাকরিবাকরি জোটানোর জন্য শিক্ষার প্রচলন করে, তাদের দেখাদেখি মুসলমানরাও শিক্ষাগ্রহণ করতে পা বাড়ায়। তারপর উদ্দেশ্য ও বিধেয় দুটোই প্রকৃত শিক্ষার বিপরীতেই চলে গেছে। 

অথচ, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ছিল নিজের অস্তিত্বের কারণ অন্বেষণ। একটা সহনশীল সমাজ গঠন। সেটা হয়নি। জিজ্ঞাসা আসে নাই। তার আগেই এসে গেছে উত্তর। তুমি এই এই এই। এখন এই এই করো। এই এই পাবে। মানুষকে একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তুমি যদি আরেকজনকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে উপরে উঠতে পারো তাহলে তুমি জয়ী। আর না-হলে তুমি যতই পড়ো, যতোই জানো, তুমি নির্বোধ, অবাঞ্চিত, বহিরাগত একজন। 

এখন আমাদের দেশে বারো পদের শিক্ষা ব্যবস্থা। একটা মাদ্রাসার ছেলের সঙ্গে একটা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রের বৈষম্য আকাশ-পাতাল। এবং তারা উভয়েই জানে না এদেশের সংস্কৃতি কী? এদেশের ঐতিহ্য কী? মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী? কেন মানুষ বেঁচে থাকে? 

এর নিশ্চয়ই অনেক কারণ রয়েছে। সেগুলো নিয়ে লিখতে গেলে অন্য একটা প্রবন্ধ কিংবা আস্ত একটা বই-ই লেখা উচিত। কিন্তু, লিখতে গেলেও আজকাল ভয় লাগে। বিশেষত যখন জানি, আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র এর অনুকূলে নয়, বরং প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে প্রতি পদে পদে।

একটা রাষ্ট্র মানে শুধু তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়। সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষ উত্তর উত্তর আরও উন্নত সমাজে, উন্নত মানুষে রূপান্তরিত হবে। 

আমাদের এখানে চিন্তার এক ভয়াবহ ক্রান্তিকাল শুরু হয়েছে। জানি না এর শেষ কোথায়? আগামীতে হয়তো তা আরও ভয়ঙ্কর আকারেই রূপ নিবে।
একদল হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর উগ্রপন্থী, আরেকদল তাদের দমন করার জন্য কলম হাতে নিয়ে হয়ে উঠেছে তাদের চেয়ে বেশি উগ্র মৌলবাদী।

একদল ধর্মের বিরুদ্ধে গালাগালি করে প্রগতিশীল হয়ে উঠতে চায়, আরেকদল তাদের দমন করার জন্য চাপাতি হাতে কতল করতে চায়। একদল আরেকদলের ইগোকে জাগ্রত করে তুলছে। একদল যত প্রগতিশীল হয়ে উঠছে আরেকদল তত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। হায়, কী হাস্যকর এক বর্বরোচিত ছেলেখেলা শুরু হলো আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে!

যতো যা-ই হোক, এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় মুক্তচিন্তাই। বই, একমাত্র বই-ই মুক্তি দিতে পারে এ-থেকে। আমি আমার বই লিখি, তুমি তোমার বই লিখো। আমি তোমারটা ইচ্ছা হলে পড়বো, তোমার ইচ্ছা না হলে আমারটা পড়ো না। কথা এই পর্যন্তই থাকতে পারত থাকা উচিত, কিন্তু, থাকেনি, বরং উস্কে দেয়া হয়েছে, ওরটা খুঁজে বের করে আনো, ও নিষিদ্ধ বই লিখেছে, ওকে হত্যা করো। হায়, যদি বিপরীত চিন্তার বইকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে পৃথিবীতে শুধু একটা বই-ই থাকবে, যার যার বিশ্বাসের একটা বই, আর সমস্ত বই-ই জ্বালিয়ে দিতে হয়!

যেকোনো নির্দিষ্ট একটা জ্ঞানই মৌলবাদী। আমার চিন্তাই একমাত্র সঠিক, আমার পথই একমাত্র সঠিক পথ এ কথাটাই মৌলবাদ। সত্যি করে বলতে, মানুষের চিন্তাজগতে এমন কিছু রহস্যময় ব্যাপার আছে যার কোনো ব্যাখ্যা নাই। হয়তো ব্যাখ্যা আছে, আমি জানি না। আমরা যতটুকু জানি তারচেয়ে অনেক বেশি কিছুই এখনো জানি না। তাহলে কীভাবে বলা সম্ভব এটা প্রমাণ করা যে আমার বিশ্বাসই একমাত্র সঠিক! এ বিশ্বাস আমার হয়েছে যে, আমার মধ্যে কিছু সংশয় আছে। এ জন্য নিজের বিশ্বাস নিয়ে আমি কখনোই জোরজবদস্তি করি না। বরং অন্যের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করি। তার যে বিশ্বাস হলো, সেটা আমার কেন হলো না! তার মানে আমার অন্বেষণে গলদ আছে। আমি সেই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্য আবার জীবনপাত করি। এই আমার জীবন। হ্যাঁ, একটা বিশ্বাস থেকে আরেকটা বিশ্বাসের দিকে যাত্রা করাই আমার জীবন। 

যেকোনো বিশ্বাসই হচ্ছে একটা পুকুর, এবং পুকুরের জল দূষিত হতে বাধ্য, যেহেতু সে আবদ্ধ। 

সংশয় হচ্ছে একটা স্রোতস্মিনী নদী, সে ক্রমান্বয়ে ছুটে ছুটে চলে অসীম সমুদ্রের দিকে। 

আবার এ নিয়েও তর্ক উঠতে পারে, এটা কোনো কথা হলো, সারাজীবন ধরে শুধু তুমি বিশ্বাস বদলে যাবে, কোথাও স্থির থাকবে না, তাহলে তোমার আইডেনটিটি কী? 

আচ্ছা, কেউ কি হলফ করে বলতে পারে যে আমি সারাজীবন একই বিশ্বাসে থাকবো, কিংবা বদলে ফেলবো! এটা কি ইচ্ছে করে রাখা যায় না বদলে ফেলা যায়! যুক্তিতর্কে শিক্ষায় এটা তো আপনা থেকেই গড়ে ওঠে। এ বয়স পর্যন্ত আমি এটাই দেখেছি। হয়তো ভবিষ্যতে আর এরকম নাও হতে পারে। 

বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বইটই পড়ে আমি জেনেছি, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের পর খুব বেশি অদল-বদল হয় না চিন্তার জগতে। ফ্রয়েডের কথাটাই স্বরণযোগ্য। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে কি, আমরা যা বিশ্বাস করি, বা যে-বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে অন্য বিশ্বাসে প্রবেশ করি, কিংবা, যে নতুন চিন্তা গ্রহণ করি বা করি না, তার সমস্ত কিছু ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত।

আমরা শুধু একজনের হাত ছেড়ে দিয়ে আরেকজনের হাত ধরি। যার হাত ধরি ছাড়ি সেও কিন্তু আমাদের মতো একজন মানুষই। তার মানে মানুষ মাত্রই হচ্ছে পরাশ্রয়ী। এবং এই সমগ্র মানবসত্তাকে বেঁধে রেখেছে ভাষা, ভাষাকে বেঁধে রেখেছে বই।

চিন্তা মানেই ভাষা, ভাষা মানেই চিন্তা। মানুষ মাত্রই ভাষাশ্রয়ী প্রাণী। যার ভাষা নাই তার চিন্তা নাই। মানুষের বৃহত্তর মানবিক সত্তায় তার অংশ নাই।

আমি তোমাকে হত্যা করতে চাইলে তুমিও আমাকে হত্যা করতে চাইবে, তুমি আমাকে হত্যা করো না, আমিও তোমাকে হত্যা করবো না, এই হচ্ছে মানুষের সার্বজনীন ভাষা। এই ভাষার অধীনে যে নয়, সেই মনুষ্য-সমাজ থেকে বিচ্যুত।

সমগ্র মানবিক সত্তা এই ভাষাগত চেইনে আবদ্ধ। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই চেইনটা তৈরি করেছে। এবং নিজেদের পশু থেকে আলাদা করে ফেলেছে।

বেশিরভাগ মানুষ শুধুমাত্র ওই ভাষাকে মুখস্থ করে, সমাজে চলার মতো কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা আয়ত্ত করে। যে, রাস্তা পার হতে গেলে তোমাকে লাল বাতি নীল বাতি খেয়াল করতে হবে। তা নাহলে দুর্ঘটনায় পতিত হবে। এ হচ্ছে একটা ভাষা। যেমন  E=MC2 একটা ভাষা। শক্তি হচ্ছে ভর ও আলোর গুণফল। যা বস্তু তাই হচ্ছে এনার্জি। এখন আমি যদি বলি X=Y, Y=Z .আমি আসলে একই সঙ্গে বস্তু আবার এনার্জি। আমি একই সঙ্গে আছি আবার নাই। নাই যখন বলছি তখন তো আমি আছি। আবার আছি যখন বলছি তখন তো আমি ভাবছি। তাহলে আমি যে আসলে আছি এটা আমার ভাবনা! আবার একদিন যে আমি থাকবো না এটাও আমি ভাবছি! আচ্ছা, এমনও কি হতে পারে, যখন আমি থাকবো না তখনো আমি ভাবতে পারবো আমি আসলে আছি! কিংবা নাই! না থাকলে আমি নাই তা আমি ভাববো কী করে! তাহলে সত্য কী! আমি যে আছি এটার প্রমাণ কী? কারণ, তুমিও বলছো, আমি আছি। তুমি আমাকে দেখছো, আমি তোমাকে দেখছি। আমরা দুজন দুজনের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেছি যে আমরা আছি। যখন আমি একা থাকবো তখন আমি কী করে প্রমাণ করবো যে আমি আছি!

এই যে কথাগুলো বললাম এগুলো আসলে একটাও আমার কথা না। উপরে আমি যত কথা বললাম তার সমস্ত কথাই ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। খুব অল্প মানুষই বৃহত্তর ভাষার জগতে দুএকটা নতুন শব্দ, ভাবনা সংযুক্ত করতে পারেন। তারা মহৎপ্রাণ মানুষ। এবং এর জন্য তারা নিজের জীবনকে কীরকম বিপন্ন করে তুলেন তাও আমরা জানি। 

কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের সমস্ত লেখা পাঠ করতে গেলেও আমাদের সারাজীবন চলে যাবে। তাদের চিন্তার সূত্র ধরতে পারাও আমাদের জন্য একটা বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। জ্ঞান-অন্বেষণের জন্য একটু অধিক আয়ুও জরুরি। এ্যারিস্টটল বলেছিলেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য দুটো জিনিস খুব দরকার। সম্পদ আর অবসর। সে আর আমাদের জীবনে কোথায়? প্রতি মুহূর্ত চলে যাচ্ছে অনিশ্চয়তায়, অস্থিরতায়। 

খুব নিগূঢ়তম চিন্তা-অন্বেষণ নয়, আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে বই পড়াটা হচ্ছে অনেকটা বিনোদন। সময় কাটানো। কিছু সুখ-পাঠ্য গল্প-উপন্যাস ছাড়া ব্যাপক চিন্তাশীল বইয়ের জগতে আমাদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি।

তাও আমি বলি, তবু বই পড়াটা জরুরি। কারণ, শেষবেলায়, কোনো-না-কোনো সময়, হঠাৎ করেই আমাদের একদম একা হয়ে যেতে হয়। আমোদফূর্তি সারাক্ষণ ঘটে না জীবনে। একটা ক্লান্তিকর অলস অবসর মুহূর্ত আসে। তখন নিজের সঙ্গে নিজে সম্পূর্ণ একা। বই-ই হচ্ছে একমাত্র সহজতম মাধ্যম যার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিভৃতে সময় কাটানো যায়। 

এ কথাও সত্য, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ না-থাকলে, কোনো অন্বেষণ না থাকলে খুব বেশি দূর আগানো যায় না পড়াশোনা করে। কী পড়বো, পড়ে কী হবে, এই চিন্তাটাই যখন মাথায় ঢুকে যায় তখন আর তল পাওয়া যায় না। 

সত্যি করে বলতে, বই পড়েও যে খুব কিছু হয় তা-ও না। শেষ পর্যন্ত আমরা আসলে জীবনপাঠ করি। বই পড়ে আমরা জীবন মিলাই। যার জীবনপাঠ নাই তার বইপাঠও নাই। এমন অনেককে দেখেছি, অনেক অসাধারণ বইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে, কিন্তু অনুভূতির জগতে খুব সাড়া পড়েনি তাদের।

ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট পড়ে যার আত্মা রক্তাক্ত হয়নি, রাশকোলনিকভের মতো যে পাগল হয়ে যায়নি সে কীসের ওই বই পড়েছে? শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা পড়ে যে একদিনও নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হয়নি তাহলে সে কীসের ওই বই পড়েছে! রূপসী বাংলা কি ঢাকা শহরের বহুতল ভবনে বসে পড়ার জিনিস! পাটপঁচা গন্ধ গায়ে মেখে যে এই বাংলার ধুলোমাখা পথে না হেঁটেছে সে কী করে বুঝবে বেহুলার লহনার মধুর জগতের কথা! 

আমাকে দিয়েছে তৃপ্তি; কোনোদিন রূপহীন প্রবাসের পথে
বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শুকের মতন
কাটাইনি দিন মাস, বেহুলার লহনার মধুর জগতে
তাদের পায়ের ধুলো-মাখা পথে বিকায়ে দিয়েছি আমি মন
বাঙালি নারীর কাছে—চাল-ধোয়া স্নিগ্ধ হাত; ধান-মাখা চুল
হাতে তার শাড়িটির কস্তা পাড়; —ডাঁসা আম কামরাঙা কুল। 

আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র বই-বান্ধব নয়, বরং বই-প্রতিবন্ধক। প্রতি বছর একুশে বইমেলায় তিন-চারহাজার বই বেরোয়। তার বেশিরভাগই অখাদ্য, বস্তপঁচা ভূষিমাল। ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু গল্প ফাঁদা। এদেশের সাহিত্য হয়ে গেছে এখন বন্ধুবান্ধবনির্ভর। টাকা-পয়সা খরচ করে দুই-তিনশো বই বের করে, বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধরাধরি কিছু বিক্রি করে। এবং বন্ধু যেহেতু, একটু প্রশংসাই পায়। মেলা ফুরালেই ওই বই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। 

ভালো করে খুঁজলে বছরে দশটা বইও পাওয়া যায় না। ষোলো-সতেরো কোটি মানুষের একটা দেশ, নিজস্ব ভাষা ও ঐতিহ্য নিয়ে যার বুকভরা গর্ব, চিন্তার তার এতো দৈন্যতা, এক বছরে দশটা ভালো বই বেরোয় না এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী আছে। 

এটা সত্য, চিন্তার জগৎ হঠাৎ উল্লম্ফন হয় না। তার একটা ধারাবাহিক চর্চা থাকতে হয়। সেই চর্চাটাই আমাদের এখানে নেই। গত দশ-পনেরো বছর ধরে সেটা আরও আড়ালে চলে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে এখন টিভি, ডিশ, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, হাতে হাতে মোবাইল। সেই মোবাইল সেটে ফেসবুক, ইউটিউব—বই পড়ার সময় কোথায় মানুষের। 

কিন্তু, বই ছাড়া উপায় কী? যে যান্ত্রিক অসহিষ্ণু একটা সমাজ গড়ে উঠছে, এর থেকে কীসে মুক্তি দিবে!

সবচেয়ে বড় কথা, সমগ্র পৃথিবীটাই হয়ে উঠছে মানুষের বসবাসের অযোগ্য। বাংলাদেশ পৃথিবীর এক কোনায় একটা ক্ষুদ্র অঞ্চল। আমাদের কথায় কিছু নড়েও না, চড়েও না। বরং আমরা প্রভাবিত হই। আমাদের এখানের শ্রেষ্ঠচিন্তাবিদরাও ধরতে গেলে অন্যান্য বিখ্যাত চিন্তাবিদদের রিভিউয়ার। আমরা হয়তো কিছু বদলাতে পারবো না। কিন্তু, তারপরও আমাদের এটুকু চেষ্টা তো অন্তত করতে হবে যেন আমাদের ঘরটি, আমাদের সমাজটি আমাদের মতো করে শান্তিপূর্ণ থাকে। 

পড়ো, পড়ো, আর পড়ো।
পড়ো তোমার প্রভুর নামে।
পড়ো তোমার নিজের নামে।
পড়ো সমগ্র বিশ্বসত্তার নামে।

জ্ঞানের ওপর বিশ্বাস রাখো।
জ্ঞানের প্রতি নতুজান হও।
জ্ঞানের প্রতি আস্থা রাখো।
জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করো। 
জ্ঞানকে ভালোবাসো।
জ্ঞান সময় কাটনোর বিনোদন নয়।
জ্ঞান হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রার্থনা।
জ্ঞানই তোমাকে মুক্তি দিবে।
অর্থ-সম্পদ হারিয়েছ, দুঃখ করো না, পড়ো।
প্রিয়জন হারিয়েছো, দুঃখ করো না, পড়ো।
স্বাস্থ্য হারিয়েছ, দুঃখ করো না, পড়ো।
জ্ঞান ছাড়া আর সবকিছু হারিয়ে যায়।
জ্ঞানই কখনো হারায় না।
জ্ঞান প্রাপ্তিতে সব প্রাপ্তি হয়। 
অর্থ-সম্পদ, স্বাস্থ্য, এমন কি, প্রিয় মানুষও।
জ্ঞানের মধ্যেই তুমি খুঁজে পাবে নিজেকে।
যাকে তুমি এতদিন ধরে খুঁজছ।
নিজেকে পাওয়ার আগ পর্যন্ত আর কী তোমার কাছে মূল্যবান!
যখন তুমি নিজেকে পাবে তখন তুমি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে পাবে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে পাওয়াই হচ্ছে জ্ঞান।
যতক্ষণ তুমি সমগ্র সৃষ্টিজগতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে না পারো ততোক্ষণ পড়ো।

দুদিন খাওনি, দুঃখ করো না, তুমি মরবে না।
তোমার শরীরে যে-পরিমাণ চর্বি আছে সেগুলো দিয়ে আরও দুদিন বাঁচবে।
পানি খাও, পানি মাগনা পাবে।


কামরুল আহসান কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। কবিতা লেখা ছাড়া লেখালেখির সব অঙ্গনের সঙ্গেই যুক্ত। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি দর্শন-মনস্তত্ত্ব নিয়ে লেখালেখি করেন। টেলিভিশনের জন্য অসংখ্য নাটক লিখেছেন। তিনি ঢাকায় থাকেন। 

menu
menu