সিনেমা : নির্ঘুম স্বপ্নের জাল

লেয়ার লেভিনকে তো আমরা সামনাসামনি দেখিনি। ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময় লেয়ার লেভিন তরুণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে আমেরিকা থেকে কলকাতায় আসেন, তার আগমন-উদ্দেশ্য পাকিস্তানি উদ্ভট শাসক এবং বর্বর ও বোকা সামরিক জান্তার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের ফলে ইন্ডিয়া অভিমুখী বাঙালি শরণার্থীদের ফুটেজ তুলবেন। তিনি সেসময় তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান থেকে উদ্বাস্ত হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া লাখো লাখো শরণার্থীদের ফুটেজ তুলেছিলেন তার ক্যামেরায়। কলকাতায়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র-গণমাধ্যম হিসেবে যুদ্ধের খবর পাঠ ও অন্যান্য দেশাত্ববোধক অনুষ্ঠানমালা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে চালু থাকলেও, ভিন্নভাবেও ইন্ডিয়াতে ট্রেনিং নিতে যাওয়া বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ নানারকমভাবেই প্রতিরোধ গড়েছে, প্রতিবাদ করেছে যুদ্ধের। 

শরণার্থীদের সাহস যুগিয়েছে তারা, কখনো গানে গানে, কবিতা পাঠ করে, দেশপ্রেমের জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েও। সেরকমই একটা দল, যারা ট্রাকে করে ঘুরে ঘুরে নানান শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে গান করে, সাহস যোগায় ট্রেনিংরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধকালীন, সেই দলটি কখনো কখনো ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চল পশ্চিমবাংলার একেবারে নিকটে এবং কোথাও কোথাও যা মুক্তাঞ্চল হিসেবে গণ্য। সেই গান-বাজনার দলে ছিলেন সেদিনের বাঙালি শিল্পী মাহমুদুর রহমান বেনু, শাহীন মাহমুদ পরে সামাদ, বিপুল ভট্টাচার্য, লুবনা মরিয়ম, নায়লা মরিয়ম, স্বপন চৌধুরী, সারয়ার আলীসহ আরো অনেকেই। দেখা গেল একদিন, আমেরিকান তরুণ লেয়ার লেভিন তার ক্যামেরা নিয়ে এই শিল্পী দলটির সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন। ফলে, লেভিনের ক্যামেরায় ফুটেজ সংগ্রহ হতে থাকল ভরপুর। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের লাইভ ফুটেজ। রক্তাক্ত, লড়াকু। শরণার্থীদের মুখের অনিশ্চয়তা ধরা পড়ে লেভিনের ক্যামেরায়। দেশ স্বাধীন হলো ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। 

লেয়ার লেভিন তার ফুটেজ সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেলেন আমেরিকায়। তারপর সময় গড়িয়ে ইতিহাস হয়ে গেল। আমরা আর জানলাম না লেয়ার লেভিনের তোলা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সে-সব অরিজিনাল ফুটেজ কোথায়? যে ফুটেজের মধ্যে রয়েছে সেদিনের স্বাধীনতাকামী অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার উদ্দীপ্ত মুখ, অক্লান্ত রণভঙ্গি, অসীম সাহসী যুদ্ধ প্রস্তুতি, কোথাও কোথাও খণ্ডযুদ্ধের রক্তপ্রাণ-ধ্বস্ত-বিধ্বস্তচিত্র, পোড়া পোড়া গ্রাম-শহর, এবং সর্বোপরি সেই ‘স্বাধীন বাংলা শিল্পী পরিষদ’-এর ক্যারাভান-যাত্রার প্রামাণ্য দলিল।

বেনু, শাহীন, স্বপন, বিপুল, লুবনা, নায়লা, সারয়ারসহ একঝাঁক তরুণ শিল্পী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগাতে ট্রাকে করে, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকায় চড়ে নদী দিয়ে ঘুরে ঘুরে গান করেছেন। যে গান আমাদের প্রাণ, প্রেরণা, শক্তি, মুক্তির ধ্বনি। লেয়ার লেভিনের ফুটেজে যা ধরা আছে। কিন্তু লেভিনই হারিয়ে গেলেন। এদিকে, সময়টা সত্তরের দশকের শেষভাগ হয়তো। লেখক আহমদ ছফার অনুবীক্ষণে ধরা পড়েছেন শিল্পী এসএম সুলতান। নড়াইল অঞ্চলের লাল মিয়া। কৃষিজীবী জীবনের বাংলাদেশই যার ক্যানভাসের মৌল উপাদান। ঔপনিবেশিক কারণেই এদেশের চিত্রকলায় চর্চিত পশ্চিমা রীতির একাডেমির বাইরে তার ওয়াশ, রেখা, আলো-ছায়া-দিন-রাত। ছফা, সুলতানের কাজের ওপরে একটি অনবদ্য আর্টিকেল লিখলেন।

নগর জীবনের বাইরের শিল্পী সুলতান হিডেন থেকে একেবারে নাগরিক শিল্পীদের আলোচনায়, পাদপ্রদীপে চলে এলেন, নিশ্চয়ই তাঁর নিজের সৃজনী শক্তির বলেই। কিন্তু সুলতানকে ঢাকার নাগরিক জীবনে উন্মোচনে ধাত্রী হয়ে উঠেছিলেন লেখক-চিন্তক আহমদ ছফা। আবার ছফার টোলের যারা ছাত্র, তাদেরই একজন তরুণ চলচ্চিত্র করিয়ে তারেক মাসুদ।

সুলতানের মিথ হয়ে যাওয়া শিল্পের জীবন যে তারেক মাসুদের ১৬ মি.মি. ক্যামেরায় ‘আদম সুরত’এ ধরা পড়ল, নেপথ্যে ছফার ভূমিকাও আমাদের জানা থাকা দরকার। আর, তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র নির্মাণের মৌলিক প্রেরণা-সমর্থন অর্জন করেছিলেন নির্মাতা আলমগীর কবিরের কাছেও। আলমগীর কবির কাজ করেছেন সাহসী নির্মাতা জহির রায়হানের সঙ্গে। যেন সবই পরম্পরায় গাঁথা। তবে, পরবর্তীতে, তারেক মাসুদের জীবনে, অনেকটাই মুখ্য হয়ে যুক্ত হয়ে গেলেন ক্যাথরিন, অ্যান আমেরিকান ফিমেল, এডিটর, তারেকের যোগ্য সঙ্গিনী। তারেক মাসুদের জীবনে সেই মার্কিন ফিমেল যে একদিন ‘ক্যাথরিন মাসুদ’ হয়ে গেলেন, তারও ঘটক আহমদ ছফা। ছফা সর্বত্র বিরাজমান, যে সর্বত্র ‘অখণ্ড বাংলাদেশ’ নিহিত। 

নড়াইল গিয়ে গিয়ে শ্যুটিং করে আনা ‘আদম সুরত’-এর নির্দেশক তারেক মাসুদ, সিনেমাটোগ্রাফার মিশুক মুনীর। ১৪ ডিসেম্বর ’৭১ বিজয়ের দুদিন আগে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, সেই হত্যা হয়ে যাওয়াদের একজন নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, তার যোগ্যপুত্র মিশুক মুনীর। তারেক ও মিশুক দুজনে বন্ধু। একসঙ্গে কাজ করেছেন অনেক, মরেছেনও একসঙ্গে, মানিকগঞ্জের রাস্তায় গাড়ি এক্সিডেন্টে। সেই সঙ্গে মারা গেছেন প্রডাকশনের আরো তিনজন। আহত হয়ে বেঁচে গেছেন শিল্পী ঢালী আল মামুন, শিল্পী দিলারা বেগম জলি, ক্যাথরিন ও আরো তিনজন। চরম ট্র্যাজেডি হয়ে থাকল এটা, আমাদের জাতীয় জীবনে, চলচ্চিত্রিক চেতনায়, আড্ডায়, আলোচনায়। তো ‘আদম সুরত’ শেষ করতে করতে প্রায় সাত আট বছর শেষ। সম্ভবত আশির দশকের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে তারেক  ও ক্যাথরিন আমেরিকা চলে গেলেন। পরে আমরা জেনেছি, আমেরিকাতে ক্যাথরিন ১৯৯০ পরবর্তী কোনো এক সময়ে লেয়ার লেভিনের সন্ধান পান, যার কাছে আছে সেই দলিল, যে দলিলের মধ্যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন প্রামাণ্যচিত্র ধরা আছে তাজা। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন খুবই উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে লেয়ার লেভিনের ফুটেজ সংগ্রহ করে কাঁটা-ছেঁড়া করলেন। শেষাবধি অনেক যত্নে, অর্থ খরচ করে দাঁড় করালেন ‘মুক্তির গান’। তারপর ১৯৯৫ সালে ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন বাংলাদেশে। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসব। আমার মনে পড়ে, শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের দোতলার অডিটোরিয়ামে ‘মুক্তির গান’-এর প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। লেয়ার লেভিন ঐ প্রদর্শনীতে উপস্থিত থাকবেন, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল বটে, কিন্তু তখন লেভিন এতটাই অসুস্থ এবং প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার পক্ষে আমেরিকা থেকে বিমানে চড়ে ঢাকায় আসা সম্ভব হয়নি। সেজন্য, ‘মুক্তির গান’ প্রদর্শনীর ঠিক আগমুহূর্তে ‘মুক্তির গান’ বা নিজের তোলা ’৭১-এর ফুটেজ সম্পর্কে লেভিনের ভিডিও বক্তব্য স্ক্রিনিং করা হয়েছিল। সেই প্রথম, আমরা নবপ্রজন্ম ১৯৭১ সালের সেই মার্কিন সিনেমাটোগ্রাফার কাম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা বাংলাদেশের চিরকালের বন্ধু লেয়ার লেভিনকে দেখলাম। স্ক্রিনে, বক্তব্যসহ। লেভিনের স্ক্রিন-পিচ-এর পরপরই ‘মুক্তির গান’ প্রিমিয়ার শো স্ক্রিনিং। এবং স্ক্রিনিং পরবর্তী মঞ্চে উঠে সেদিন অনেকেই আবেগ সামলাতে পারলেন না। 

মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটটা পর্দায় ভেসে উঠল। এর কয়দিন পর থেকেই শাহবাগ জাতীয় গণগ্রন্থাগারের মূল অডিটোরিয়ামে ‘মুক্তির গান’ স্ক্রিনিং শুরু হলো। প্রথম সপ্তাহখানেক দর্শকের মধ্যে ‘মুক্তির গান’ ঠিক ঢোকেনি হয়তো, কিন্তু তারপরই শুরু হলো ঢাকার মধ্যবিত্তদের ‘মুক্তির গান’ দেখার ঢল, ব্যাপক উদ্দীপনা, উৎসাহ, আলোচনা, ’৭১ এর বিভীষিকা-অধ্যায়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়া। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার শুরু হলো। সাড়া ফেলল সবার মধ্যেই, কারণ, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ঘটনা।

সেই সময়, ’৯৫ সালে, আমি পড়ালেখা করছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে, স্নাতক পর্যায়ে। তারেক ভাইয়ের কয়েক ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই বাবু, আমাদের বন্ধু, বাবুর ছোটটা নাহিদ, নাহিদও বন্ধু। এবং আরো বেশ কয়েকজন আমরা তখন পাবলিক লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে ‘মুক্তির গান’ প্রদর্শনীর গেটম্যান বা টিকেট কাউন্টারের লোক। ভলান্টিয়ারি সার্ভিস। আমাদের ভালো লাগছিল যে, ‘মুক্তির গান’ এর প্রদর্শনীর প্রথম দু’মাস আমরা ভলান্টিয়ার ছিলাম। গেটম্যান ছিলাম, টিকেট কাউন্টারে বসতাম। ঐ সময় আমি হয়তো, প্রায় দু-আড়াইশো বার ‘মুক্তির গান’ দেখেছি। কারণ লোকজন হলের মধ্যে ঢুকে পড়ার পর গেটে দাঁড়িয়ে আর কী করব-ভেতরে ঢুকে ছবি দেখতে থাকি। সিট তো পূর্ণ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখি। বাইরে, পাবলিক লাইব্রেরির মূল আঙিনা ছাড়িয়ে দর্শকের লাইন গিয়ে ঠেকতো জাতীয় জাদুঘরের সামনের রাস্তায় তালগাছটা পর্যন্ত। প্রচুর দর্শক। 

ফলে, প্রচুর আর্থিক রিঅ্যাকশনও খুব ভালো। সে সূত্রেই, রিকশায় আসা-যাওয়া করা তারেক ভাইয়ের প্রোডাকশনে গাড়ি এসে গেল। সিনেমা থেকে স্বচ্ছলতার উন্মেষ শুরু হলো ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার তারেক মাসুদের জীবনযাত্রায়। দিনে ৩/৪টা করে শো হতো ‘মুক্তির গান’ এর। প্রায় দু’আড়াইমাস একটানা চলল পাবলিক লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে। এক ছবি আমার এতটাই দেখার সুযোগ হল গেটম্যান হবার সুযোগে যে, ছবি শুরু হয়ে গেলে বাইরে দাঁড়িয়ে হলের ভিতর থেকে আসা আবছা-ঝাপসা শব্দ শুনেই আমি বুঝতাম, এখন কোন্ দৃশ্য এখন যাচ্ছে, পর্দায় কে কি করছেন? মনে হয় এতবার ছবিটা দেখা হয়ে গেল দু’মাস গেটম্যান হবার সুবাদে যে, ‘মুক্তির গান’-এর পুরো সাউন্ড-মিউজিক ট্র্যাকগুলো আমার মুখস্থ। প্রতিটা ক্যারেক্টারের (প্রামাণ্য চরিত্র) মুভমেন্ট আমার মুখস্থ। 

একদিন শো শুরু হয়ে গেছে, প্রায় বারো-তেরো মিনিট পরে বাইরে গাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে তারেক ভাই নেমে ছুটে এলেন অডিটোরিয়ামের গেটে। অডিটোরিয়ামে দুইটা গেট। এক গেটে অন্য দুজন কেউ, অন্য গেটে তখন আমি আর কেউ একজন। তারেক ভাই বললেন, ‘অ্যালার্ট থাকো। এক্ষুণি একজন দর্শক এসে হলে ঢুকবেন।’ বললাম, শো’তো অলরেডি ১২/১৩ মিনিট আগেই শুরু হয়ে গেছে। তারেক ভাই বললেন, ‘হোক। আবার শুরু করা হবে।’ একটু পরেই, সেই পঁচানব্বই সালের এক বিকেলেবেলায় তখনকার জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ‘মুক্তির গান’-এর দর্শক হিসেবে এসে পাবলিক লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে ঢুকলেন, যিনি বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ এ কথা ভাবতে ভালোই লাগছে যে, শেখ হাসিনা যখন ‘মুক্তির গান’ ছবির দর্শক, তখন সেই সিনেমা’র হলের (পাবলিক লাইব্রেরির প্রধান অডিটোরিয়াম) গেটম্যান দুজনের একজন আমি। কেমন যেন আনন্দের স্মৃতি। আমি নিশ্চিত, কোনো সিনেমা দর্শকই হলের গেটম্যানকে কখনো মনে রাখতে পারে না, ভালো করে তো তার দিকে তাকানোরই অবকাশ থাকে না। কারণ তখন, দর্শকের ইচ্ছে থাকে কখন হলের ভিতরে গিয়ে সে পর্দায় চোখ রাখবে, আলো-ছায়া-শব্দের ভেতরে ঢুকবে! শেখ হাসিনা হলের মধ্যে ঢোকার পর ১৫ মিনিট আগে শুরু হয়ে যাওয়া ‘মুক্তির গান’ ফের প্রজেকশন শুরু হলো। দু’একজন দর্শক ‘কী হলো কী হলো’ বলে চিৎকারও করল। ছবি দেখা শেষে তারেক ভাই মঞ্চে উঠে বললেন, একজন দর্শকের জন্যে ছবিটা ১৫ মিনিট পর ফের স্ক্রিনিং করা হয়েছে। সেই দর্শককে তিনি মঞ্চে ডাকলেন ‘মুক্তির গান’ দেখার প্রতিক্রিয়া জানাতে। মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। তখনকার বাস্তবতায়, মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের লাইভ ফুটেজ দেখে বেশিরভাগ দর্শকের যা হতো, সেদিন দেখলাম, কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললেন ‘মুক্তির গান’এর দর্শক শেখ হাসিনাও। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট যিনি পিতা-মাতা-ভাইসহ স্বজনদের হারিয়েছেন।

মানুষ ‘মুক্তির গান’ দেখে হল থেকে বেরুত চোখ মুছতে মুছতে। ১৯৯৫ সালে বসে ১৯৭১ সালের প্রামাণ্য দলিল দেখে বাঙালি সিনেমা দর্শকের সেদিন আবেগ সামলানো আসলেই অসম্ভব ছিল। ছবিটা দেখে, সবাই যেন ফিরে গেছে ’৭১-এর অনিশ্চিত-ভয়াল বাঁচা-মরার দিনগুলোতে।
তারপর ‘মুক্তির গান’ ছবি থেকে ইতিহাস হয়ে গেল। দিন বদলে গেল। তারেক মাসুদ-ক্যাথরিন মাসুদ এরপর আরো কিছু ছবি করলেন। ‘মাটির ময়না’ ‘নরসুন্দর’ ‘রানওয়ে’। তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীর দু’বন্ধু জুটি হয়ে কাজ করছিলেন। এটাই সত্য, বাংলাদেশের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম নির্মাণের পথিকৃৎ তারেক মাসুদ। তারেক ভাই ছিলেন আমাদের জন্য সাহস, অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজের বা নিম্নবর্গের মানুষের চিন্তা-চেতনার ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা এবং এর ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব একসঙ্গে গেঁথেছেন তারেক মাসুদ তাঁর কাজে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশজাত ‘শিক্ষিত’ সমাজের ‘আধুনিক’ বাংলাদেশে মাদ্রাসার ছাত্র যে সিনেমার প্রধান চরিত্র হতে পারে, সেটি তারেক ভাই না হলে আমরা কার ছবিতে দেখতাম? জানি না, আর কার ছবিতে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক জীবনের আলো-অন্ধকার দেখব? বিষয়ের গোড়া এমন যে, তারেক মাসুদ একদা নিজেই প্রায় পাঁচটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছেন, পারিবারিক ইচ্ছায়। 

তাছাড়া এটাও সত্য, এখনো বাংলাদেশের নিম্নবর্গের মানুষের সন্তানদের একটা বড় অংশই মাদ্রাসার ছাত্র। হয়তো এই সত্য ভবিষ্যতেরও সত্য। মাদ্রাসা শিক্ষাকে ভেতর থেকে দেখে তা সিনেমায় প্রজেকশন করা-এটা দেখলাম অকালপ্রয়াত এই প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতার কাজে। আমাদের সাহসী অগ্রজ তারেক মাসুদ। ‘কাগজের ফুল’ তারেক ভাইয়ের লালিত স্বপ্নের প্রজেক্ট। এখানেও সিনেমাটোগ্রাফার সেই বন্ধু মিশুক মুনীর। শিল্প নির্দেশনায় শিল্পী ঢালী আল মামুন। আর ক্যাথরিন তো আছেনই নির্দেশনায় যৌথ ভূমিকা নিয়ে, আছেন ধারণকৃত ফুটেজের যথার্থ এডিটিংয়ের খুঁতখুঁতানি নিয়ে।

আমাদের জানা মতে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পটভূমিকায় ‘কাগজের ফুল’ নির্মাণ হওয়ার কথা। কিন্তু লোকেশন দেখে ফেরার পথে মানিকগঞ্জের কাছে তারেক ভাইদের মাইক্রোবাসটি উল্টো দিক থেকে আসা আরেকটি দূরপাল্লার বড় বাসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে গেল। স্পট ডেড পাঁচজন। প্রডাকশনের তিনজন, মিশুক মুনীর আর আমাদের একমাত্র ইন্ডিপেন্ডেন্ট নির্মাতা তারেক মাসুদ। পাঁচটি প্রাণ রক্তাক্ত হয়ে মাইক্রোবাসের মধ্যে শেষ। চেহারা দেখে চেনা যাচ্ছিল না, কার মুখ কেমন ছিল দেখতে! এক্কেবারে থেঁতলে যাওয়া। এর আগে, ১৯৮৯ সালে আরিচায় ফেরির ওপরে স্টে করা নিজ প্রাইভেট কারে বসে থাকা নির্মাতা আলমগীর কবির (১৯৭১ সালে আলমগীর কবির প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে ইংরেজিতে খবর-বুলেটিন পাঠ করতেন) এবং তার ছবির নায়িকা টিনা খান পানিতে ডুবে মারা গেলেন। ফেরিতে ওঠা একটি ট্রাকের ধাক্কা খাওয়ার আগে সেই কারে ছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী মুনীরা মোরশেদ মুন্নী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। 

ট্রাক ফেরিতে ওঠার একটু আগেই মোরশেদ ভাই সিগারেট কিনতে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন। ফলে, ‘সিগারেট’-এর নেশা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ট্রাকের ধাক্কায় কারটি একমুহূর্তেই পানিতে পড়ে যায়। ফেরিঘাটের লোকজন তড়িঘড়ি করে পানিতে ডুবন্ত কারের কাচের জানালা ভেঙে ভেতর মুন্নী আপাকে বের করে আনতে পারলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা, এদেশের চলচ্চিত্রকে সবচেয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানুষটি, ডিরেক্টর আলমগীর কবির ও অভিনেত্রী টিনা খান নিজের কারগাড়ির মধ্যে ডুবে মারা গেলেন। কী ট্র্যাজেডি! 

মুক্তিযুদ্ধের আগেই বানানো রাজনৈতিক বিবেচনায় এদেশের সবচেয়ে সাহসী ছবি ‘জীবন থেকে নেওয়া’ জহির রায়হানের অন্যতম সেরা কাজ। জহির রায়হানের সঙ্গেই এডি হিসেবে চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেছিলেন আলমগীর কবির। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। দলে দলে শরণার্থীরা ইন্ডিয়া থেকে দেশে ফিরল। কলকাতা থেকে ফিরলেন নির্মাতা জহির রায়হান। পরের মাস অর্থাৎ জানুয়ারির ৩১ তারিখে সদ্যস্বাধীন দেশে ঢাকার মিরপুরে গুপ্তহত্যার শিকার হলেন জহির রায়হান। সেই হচ্ছে ট্র্যাজেডির শুরু। এক কথায়, জহির রায়হান, আলমগীর কবির ও তারেক মাসুদ তিনজনই ছিলেন তাঁর তাঁর সময়ে বাংলাদেশের সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ববান পরিচালক। 

সেই তিনজনই উধাও হলেন, অস্বাভাবিকভাবে। হতভাগ্য বাংলাদেশ, মহা হতভাগ্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প। আমাদের চলচ্চিত্রের ট্র্যাজেডি-ট্রিলজি বলব আমি একে? বলতেই পারি। এই ট্র্যাজেডি-ট্রিলজিতে বাংলা চলচ্চিত্র পরিবারের এবং বাংলাদেশের খুব ক্ষতি হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যেই সেই ক্ষতিটা উঁকি দিয়ে যায় আমার মনে। কারণ, চলচ্চিত্র নির্মাণের নেশায় যখন জেগে থাকি, সংগ্রাম করে চলছি ভালো ছবি বানানোর অভিপ্রায়ে, তখনই তারেক ভাইকে খুব মনে পড়ে। অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি এই সংগ্রামী স্বপ্নবান মানুষটাকে। ভালো সিনেমা বানানোর লড়াইয়ে তারেক ভাইকে আমাদের প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে দেখেছি। তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। থাকবেন। আগামীর জন্যেও। মূর্খ-অসভ্য-অসংস্কৃত পুঁজির মালিকের নষ্টামি ও খবরদারিকে থোড়াই কেয়ার করে জয় হোক স্বাধীন সিনেমা নির্মাণের, জয় হোক স্বাধীন সিনেমা নির্মাতার। জয় হোক যে-কোনো অনাপোষী স্বপ্নের, যে স্বপ্ন নির্ঘুম করে রাখে দূরগামী কোনো তরুণকে।
 

menu
menu