জাপানে অজস্র রবিচ্ছবি

১৯১৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। এই বছর ২০১৬ সাল কবিগুরুর জাপানভ্রমণের শতবর্ষ। বিগত এই শতবর্ষে বহু ঘটনা এবং স্মৃতির জন্ম হয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে। তার অধিকাংশই আমরা জানি না। সেইসব স্মৃতিগুলোকে কেন্দ্র করে আমার জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক নিয়ে কাজ। তারই কিছু এখানে পত্রস্থ করার প্রয়াস নিয়েছি: 

এক 
রবীন্দ্রভক্ত তাকাশি য়োকোয়ামা 
জাপানের বিখ্যাত নিহোনগা চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের পৌত্র তাকাশি য়োকোয়ামার সঙ্গে এই ছবিটি গৃহীত হয়েছিল ২০০১ সালে উয়েনো শহরস্থ য়োকোয়ামা তাইকান স্মৃতি জাদুঘরে। তাঁর একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ এবং তাইকান সম্পর্ক নিয়ে। সেটা দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তাইকান। ১৯০৩ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু প্রমুখের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেন পাঁচবারই তাইকান তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। কবি ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান সফরকালে তাইকানের বাসভবনে প্রথম ১০ দিন আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন পরে য়োকোহামাস্থ সানকেইএন বাগানবাড়িতে চলে যান। তাইকানের সেই বাসভবনটিই এখন ‘তাইকান স্মৃতি জাদুঘর’ যদিওবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুড়ে গিয়েছিল বাড়িটি পরে পুনরায় নির্মিত হয়। তাকাশি য়োকোয়ামা এই জাদুঘরের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। তিনি জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার নেতৃত্বে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। তাইকানপুত্র তাকাশি নিজেও একজন রবীন্দ্রভক্ত। 

দুই 
বাহাইয়ের সভায় রবীন্দ্রনাথ 
পৃথিবীর প্রতিটি প্রধান ধর্মই হাজার বছরের পথপরিক্রমায় জাপানে এসে স্থিতু হয়েছে। জাপানের মতো শান্তিবাদী দেশ আর দ্বিতীয়টি নেই। এই শান্তিকে কেন্দ্র করে এই দেশে অভূতপূর্ব এক ধর্মীয় বৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। ইসলাম ধর্মের শিয়া অনুসারীদের একটি শাখা হচ্ছে বাহাই। বাহাউল্লাহ্ বা আবদুল বাহা তথা মির্জা হুসাইন আলী নূরী (১৮১৭-১৮৯২) উনিশ শতাব্দীতে পারস্য বর্তমান ইরানে এই বাহাই উম্মাহ্ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৫ সালে দুজন বাহাই অনুসারী জর্জ জেকব অওগুর এবং শ্রীমতী আগনেস আলেকসান্ডার জাপানে আগমন করেন। কালক্রমে বাহাই জাপানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান ভ্রমণের সময় টোকিওতে তৎকালীন বাহাই সম্প্রদায়ের এক সমাবেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমন্ত্রিত হন। এই সমাবেশে জাপানের প্রাচীন ধর্ম শিন্তোও, বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টান, হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাহ্মধর্মাবলম্বী হিসেবে এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন কিনা জানা যায় না। 

তিন 
জাপানে রবীন্দ্রনাথ 
১৯৬১ সালে জাপানে মহাসমারোহে শততম রবীন্দ্রজন্মোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে। এমনটি আর  কোনো দেশে হয়নি সম্ভবত ভারতেও নয়। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। বহু কাজ হয়েছে তখন রবীন্দ্রনাথের ওপর। তার অধিকাংশই সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি, বেশকিছু অবশ্য সংরক্ষণ না করার কারণে হারিয়েও গেছে। ১৮টি প্রবন্ধ নিয়ে জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কবিষয়ক দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘জাপানে রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেছি। আশা করছি গ্রন্থটি ২০১৬ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হবে ঢাকা থেকে। প্রবন্ধগুলোর সব তথ্যই জাপানি ভাষার গ্রন্থ, সাময়িকী, পত্রিকা এবং দলিলপত্রাদি থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করে লিখিত।  সেইসঙ্গে অনেক দুর্লভ আলোকচিত্র যা দেখেনি দুই বাংলার বৃহত্তর বাঙালি। এই ছবিটি শততম জন্মজয়ন্তীর একটি অজানা চিত্র। সেইসময় টোকিওতে মঞ্চস্থ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের একাংশ জাপানি শিল্পীদের দ্বারা। পরিচালনা করেছিলেন ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের প্রশিক্ষক সাকাকিবারা কিইৎসু। তার নৃত্যসংস্থার সদস্যরা অভিনয় করেছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় ধ্রুপদী নাচ শেখার জন্য। 

চার
শতবর্ষী রবীন্দ্রগবেষক ডাঃ হিনোহারা শিগেআকি 
২০১১ সালে রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে টোকিওস্থ ভারতীয় দূতাবাসে রবীন্দ্রভক্ত হিনোহারা শিগেআকি সেনসেই (স্যার) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল আমার। শতবর্ষী স্বনামধন্য চিকিৎসক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেইরোকা হাসপাতালের অবৈতনিক চেয়ারম্যান ডাঃ হিনোহারা তরুণকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত। বহু বছর ধরে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চিন্তা করছেন, করছেন গবেষণা। তিনি একজন প্রথিতযশা লেখক হিসেবে জাপানে শ্রদ্ধাভাজন। শতাধিক তাঁর গ্রন্থসংখ্যা। ‘ইকিকাতা জোওজু’ বা ‘দক্ষ জীবনযাপন’ গ্রন্থটি বেস্ট সেলার্স হয়েছে ২০১০ সালে। তিনি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘প্রকৃতি বিজ্ঞানী’ বলে অভিহিত করেছেন। এমন অভিধা আর কেউ দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। 

পাঁচ
রবীন্দ্রনাথ প্রেরিত বই 
২০১১ সালে জাপানের য়োকোহামা বন্দরনগরীতে অবস্থিত ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবনে যাই অনেক দিন পর। এর কর্ণধার ছিলেন একদা রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রথম জীবনে কাগজ ব্যবসায়ী পরবর্তীকালে তোওয়োও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ ড.ওওকুরা কুনিহিকো। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র এখানে খুঁজে পাই ১৯৯৯ সালে। এসবের মধ্যে ব্যতিক্রম হল রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ১৯৩০ সালে ড. কুনিহিকোকে প্রেরিত নিজের লেখা বাংলা ও ইংরেজি শতাধিক গ্রন্থ। এই বইগুলো নিয়ে কাজ করতেই ২০১১ সালে গিয়েছিলাম য়োকোহামার নাগরিক বিশিষ্ট রবীন্দ্রভক্ত শ্রীমতী ওওবা তামিকোকে নিয়ে। এই নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়। 

ছয় 
রবীন্দ্রগবেষক কাজুও আজুমা 
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবিতকালে শান্তিনিকেতনে চীনা ভবন তৈরি হচ্ছিল। তখন (১৯৩৩) শান্তিনিকেতনে সংস্কৃত ভাষার অলঙ্কার বিষয়ে শিক্ষালাভ করছিলেন টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ৎসুশোও বিয়োদোও। পরের বছর যখন অধ্যাপক বিয়োদোও জাপানে ফিরে যাবেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অনুরোধ জানালেন, চীনাদের মতো শান্তিনিকেতনে জাপানি ভবনও প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
অধ্যাপক বিয়োদোও গুরুদেবের সেই অনুরোধ বিস্মৃত হননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁরই শিষ্য রবীন্দ্রভক্ত ও গবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা এই ঘটনা জানতে পারেন। তারপর প্রায় ১৪ বছরের প্রাণান্তকর লড়াই করার পর তিনি ১৯৯৪ সালে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের বাস্তবরূপ দেন ‘নিপ্পন ভবন’ প্রতিষ্ঠা করে। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র আজুমা স্যার আমাকে দিয়েছিলেন। এই ছবিটি সেগুলোর অন্যতম। জাপানে রবীন্দ্রপ্রচার এবং শান্তিনিকেতনে তথা পশ্চিমবঙ্গে অধ্যাপক কাজুও আজুমার যে অসামান্য অবদান তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আশা রাখি।


সাত 
রবীন্দ্রভিত্তিক বুলেটিন মাসিক ‘সাচিয়া’ 
জাপানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বহু কাজ হয়েছে যা এককথায় বিস্ময়কর! অনেক দলিলপত্র খুঁজে পেয়েছি বিগত কয়েক বছরে। মাসিক বুলেটিন ‘সাচিয়া’ বা ‘সত্য’ নামে ২২টি জাপানি ভাষার ট্যাবলয়েড আবিষ্কার করেছি বছর দশেক আগে  য়োকোহামা বন্দরনগরীতে। সবগুলো সংখ্যাই রবীন্দ্রভিত্তিক। এটা প্রকাশিত হয়েছিল টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন থেকে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। সবগুলো পড়া হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে একটা পরিচিতি লিখেছিলাম প্রিয় কাগজ সাপ্তাহিক ‘সাপ্তাহিকে’। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু আমি জানি না। ভুলে গেছিলাম। অনুজপ্রতিম বন্ধু খায়রুল আনাম রায়হান জানালো বলে জানতে পারলাম। 

আট 
ওকাকুরা তাকেশি স্যারের সঙ্গে একদিন 
জাপান এবং ওকাকুরা তেনশিন একসূত্রে গাঁথা। তাঁকে বাদ দিয়ে জাপানের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা নিহোনগা এবং আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাস লেখা অসম্ভব। বিশ্বখ্যাত এই প-িত ও মনীষী ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁদের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল ১৯০২ সালে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতায়। সেই থেকে আধুনিককালে জাপান-বাংলা দ্বিপাক্ষিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়ের সূচনা। ওকাকুরা দুবার ভারত তথা কলকাতা পরিভ্রমণ করেন। ত্রিপুরা রাজ্যও তাঁর ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল কিন্তু ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী সরকার তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। ত্রিপুরা রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসজ্জা ও  দেয়াল অঙ্কনের পরিকল্পনা করার কথা ছিল তাঁর বলে জানা যায়। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁর প্রধান দুই শিষ্য জাপানের নমস্য চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসোওকে পাঠিয়েছিলেন কলকাতায় কাজটি করার জন্য। কিন্তু তাঁরাও পারেননি। রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেছিলেন।
    গুরুদেব জাপানকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন তাঁর জন্মস্থান ভারতের পর। শান্তিনিকেতনকে তিনি জাপানি সংস্কৃতির প্রয়োগে সৃজনশীল আনন্দভূমিতে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলোর নাম য়োকোহামা বন্দরনগরীতে অবস্থিত ভুবনখ্যাত সবুজস্বর্গ ‘সানকেইএন’ বাগানবাড়ির আদলে রেখেছিলেন বলে চিত্রশিল্পী মুকুলচন্দ্র দের ভাষ্য থেকে জানা যায়। এখানে কবি ইকেবানা বা ফুলসজ্জা, চাদোও বা চা-অনুষ্ঠান, নিহোনগা তথা জাপানি চিত্রকলার রীতি, নিহোনগো বা জাপানি ভাষা, জুদোও বা জুজুৎসু, তেইএন বা জাপানি বাগান প্রভৃতি প্রচলন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই সেসব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ওকাকুরা ও রবীন্দ্রনাথ পরস্পর তাঁদের চিন্তাভাবনাদ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওকাকুরা মাত্র ৫০ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৯১৩ সালে যে বছর রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন বন্ধু ওকাকুরার মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পরে। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম জাপান সফরকালে ওকাকুরার বাসস্থান ইবারাকি-প্রিফেকচারের ইজুরা নামক আধাশরের এক স্থানে তাঁর বিধবা পতœী ও স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রায় সপ্তাহ খানেক অবস্থান করে স্বর্গবাসী বন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এশিয়ার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ওকাকুরা-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। ভারত-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এঁদের অবদান অসামান্য এবং চিরস্মরণীয়।
    রবীন্দ্রনাথকে জাপান যে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছে তা আর কোনো দেশ করেছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। কবি জাপান পাঁচবার ভ্রমণ করেছিলেন। জীবনের শেষদিনগুলো জাপানে কাটানোর বাসনা প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩৫ সালে তাঁর স্নেহধন্য ভক্ত ও দোভাষী মাদাম তোমি কোরার কাছে শান্তিনিকেতনে। মাদাম কোরার জীবনবৃত্তান্তে এই তথ্যটির সন্ধান পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের প্রচুর ভক্ত জাপানে ছিলেন এবং এখনো আছেন এমনটি আর কোনো দেশে দেখতে পাই না। রবীন্দ্রনাথের এত অনুবাদ এবং তাঁকে নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা হয়েছে যে বিস্ময় জাগায়! ১২ খ-ে রবীন্দ্র রচনাবলি জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে যা অভাবনীয়! কী পেয়েছিলেন জাপানিরা রবীন্দ্রনাথে যা বাঙালি পায়নি এটাই গবেষণার বিষয় হতে পারে। বিষয়টি সহজ হলেও জাপানি মানসের মতোই জটিল। সেই রবীন্দ্রাথের শততম জন্মবর্ষ সাড়ে তিন বছরব্যাপী (১৯৫৮-১৯৬১) জাপানে উদ্যাপনের ঘটনা একেবারেই বিরল বললে বেশি বলা হয় না, ভাবতেই পারি না! বিপুল কাজ হয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে এই সময় যা এক স্বতন্ত্র ইতিহাস।
    ২০১১ সালেও কবির সার্ধশত জন্মবর্ষ জাপানে উদযাপিত হয়েছে তবে অত ঘটা করে নয়। পরিকল্পনাটির কথা প্রথমে আমি ভাবি এবং জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা স্যারকে অবহিত করি। তিনি তখন হাসপাতালে শায়িত এবং প্রচ- অসুস্থ। শুধু সম্মতি দিয়েছিলেন হাত তুলে। এর আগে ২০০২ সালে জাপান-বাংলা সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্কের শততম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে স্যারকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করেছিলাম। সঙ্গে ছিলেন য়োকোহামায় জন্ম রবীন্দ্রভক্ত আমার বান্ধবী ওওবা তামিকো। এবারও আমি তাকেই আহবান করলাম: কবিগুরুর ১৫০তম জন্মবর্ষটি উদযাপন না করলে ওকাকুরা-রবীন্দ্র সম্পর্কের ওপর অন্যায় করা হবে। তুমি তো য়োকোহামার মানুষ ওকাকুরাও য়োকোহামায় জন্ম আবার কবিগুরু য়োকোহামাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। তিনি বারংবার এখানে এসেছেন। ১৯১৬ সালে প্রায় তিন মাস শিল্পপতি হারা  তোমিতোওর সানকেইএন বাগানবাড়িতে অবস্থান করেছিলেন। এসো একটা উদ্যোগ নিয়ে দেখি। যদিও জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে তাছাড়া যুগটাও ভিন্ন হয়ত অত লোকজনের সাড়া পাওয়া যাবে না। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওকাকুরা-রবীন্দ্র সম্পর্কের ইতিহাসটা আদৌ নতুন প্রজন্মগুলোর কাছে তুলে ধরা হয়নি। দুজনই নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন বলে প্রতিভাত হবেন। 
    তামিকো সানের আগ্রহ আর আমার প্রতীজ্ঞা মিলিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে এখানে সেখানে ফোন লাগিয়ে প্রথম বৈঠকটি করলাম য়োকোহামাতে, রবিবার ছিল এবং কম পক্ষে ২০ জন এসেছিলেন। এরপর আরও কয়েকবার বসলাম আমরা বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু তেমন সাড়া পাচ্ছিলাম না। তামিকো সানকে প্রস্তাব দিলাম, রবীন্দ্রনাথের বন্ধুদের নাতি-নাতনী বেশ কয়েকজন আছেন তাদের কাছে চলো কথা বলে দেখি। এতে কাজ হল এবং কয়েকজন সাড়া দিলেন। আর্থিক সাহায্যের  আশ্বাসও পাওয়া  গেল। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু চিত্রশিল্পী কাম্পো আরাই এর দৌহিদ্র কাওয়াই ৎসুতোমু এগিয়ে এলেন আগ্রহসহকারে। তিনিও রবীন্দ্রঅন্তঃপ্রাণ। তোচিগি জেলার উজিয়ে শহরে গড়ে তুলেছেন রবীন্দ্র-কাম্পো স্মরণে একটি আধুনিক উদ্যান। উদ্যানটি উপহার দিয়েছেন উজিয়ে নগরপ্রশাসনকে। এটা এখন প্রশাসন দেখ্ভাল্ করে। (কাম্পো-রবীন্দ্র সম্পর্ক নিয়ে লিখিত আমার একটি প্রবন্ধে এই বিষয়ে বিস্তারিত আছে।) যাহোক, কাজ বেশ এগিয়ে চলেছে এর মধ্যে হল মহাভূমিকম্প ও ৎসুনামি। পরিকল্পনা পিছিয়ে গেল সঙ্গত কারণে, এপ্রিল মাসে শুরু হওয়ার কথা ছিল সেটা জুলাইয়ে চলে গেল। আমিও একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে বাংলাদেশে চলে গেলাম। তার আগে দুএকটি অনুষ্ঠানে ছিলাম। য়োকোহামাতে একটি অনুষ্ঠানে আমি ও তামিকো সান উপস্থাপনা করলাম। সেদিন এসেছিলেন ওকাকুরা তেনশিনের প্রপৌত্র স্বনামধন্য অধ্যাপক ও গবেষক ওকাকুরা তাকাশি (১৯৪৫-) স্যার। তাঁর একাধিক গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে। ওকাকুরাকে নিয়েও তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ লিখেছেন, আমাকে এক কপি উপহার দিয়েছেন সাইন করে। টোকিওর দাইতোও বুনকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওকাকুরা স্যার মনে হয় ইতোমধ্যে অবসর নিয়েছেন। 
    সেদিনের অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে স্যারের সঙ্গে আমাকে ক্যামেরায় বন্দী করলেন তামিকো সান। অসামান্য এক স্মৃতি। কী সৌভাগ্য আমার ওকাকুরা তেনশিনের বংশধরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পেরে। ২০০৬ সালে স্যার আমাদের একটি অনুষ্ঠানে প্রথম এসেছিলেন অতিথি হয়ে তাঁর দাদাঠাকুর ওকাকুরা তেনশিন লিখিত ভুবনখ্যাত গ্রন্থ ‘দি বুক অব টি’র প্রকাশনার শততম বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে য়োকোহামাতে বক্তৃতা করার জন্য। সেদিন দারুণ আলোচনা করেছিলেন গ্রন্থটি রচনার পটভূমি সম্পর্কে যা আমাদের জানাই ছিল না! সেদিন তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তামিকো সান। অনুষ্ঠান শেষে এক চা-চক্রে কথায় কথায় জানালেন কোনোদিন তিনি ভারতে যাননি। শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম! আজুমা স্যার অনেক জাপানিকে নিয়ে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে-কলকাতার জোড়াসাঁকোতে, শান্তিনিকেতনে এবং বাংলাদেশেও কিন্তু কেন তিনি ওকাকুরা তাকাশিকে আমন্ত্রণ জানালেন না সে এক মহারহস্য হয়ে রইল আমার কাছে। অবশ্য ২০১৩ সালে ওকাকুরার ১৫০তম জন্ম এবং ১০০তম মৃত্যুবর্ষ উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল অধ্যাপক ওকাকুরা তাকাশির। কিন্তু গিয়েছিলেন কিনা জানি না। স্যারের সঙ্গে সম্প্রতি যোগাযোগ হচ্ছে না ব্যস্ততার কারণে। গিয়ে থাকলে অন্ততপক্ষে সংবাদপত্র মাধ্যমে জানতে পারতাম। 

নয় 
রবীন্দ্রবক্তৃতা সংকলন ইনিশিয়ে নো মিচি বা পুরনো পথ 
৮০ বছর জীবিতকালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেশে-বিদেশে বিচিত্র সব মানুষের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তেমনি একজন জাপানের নাকায়ামা তাইচি (১৮৮১-১৯৫৬)। তিনি ছিলেন মেইজি, তাইশোও এবং শোওয়া যুগের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। আধুনিকমনস্ক তাইচি জাপানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘কুরাবু কসমেটিকস’ নামে একটি প্রসাধনী  কোম্পানি ১৯০৩ সালে। তারপর ১৯১৯ সালে ‘পুরাতোন’ নামে একটি দাপ্তরিক পণ্যসামগ্রী প্রস্তুতকারী কারখানা এবং আরও পরে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ১৯২২ সালে তাঁর প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় ফ্যাশনভিত্তিক একটি ম্যাগাজিন ‘জোসেই’ বা ‘নারী’ নামে। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ ঘটে ১৯২৪ সালে কোবে শহরে। কবি তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এহেন তাইচির উল্লেখযোগ্য অবদান হল, ১৯২৪ সালেই রবীন্দ্রনাথের ২৩টি বক্তৃতার একটি সংকলন প্রকাশ করেন ‘ইনিশিয়ে নো মিচি’ বা ‘পুরনো পথ’ নামে। তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে আমার একটি প্রবন্ধ আছে ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ গ্রন্থে। প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক ২০০০ ম্যাগাজিনে। 

দশ 
কারুইজাওয়ায় রবীন্দ্রস্মারক 
জাপানের নাগানো-প্রিফেকচারের একটি বিখ্যাত জায়গা কারুইজাওয়া। একটি স্বাস্থ্যকর স্থান এবং বিশ্বখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। শতবর্ষ পূর্বে এটা ইংরেজরা উন্নয়ন করেছিল তাদের বসবাসের জন্য। এখনো অনেক পুরনো বাড়িঘর, রাস্তা ও উদ্যান বিদ্যমান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই জায়গাটা। এই শহরটি আগ্নেয়গিরিবাহী ‘আসামা’ পর্বতের জন্যও বিখ্যাত। (নাগানো-প্রিফেকচারের শিনানোমাচি অঞ্চলে আমার শ্বশুরের আদিবাড়ি। একাধিকবার গিয়েছি সেখানে।)     ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম জাপান ভ্রমণ করেন তখন এখানে এসেছিলেন। জাপানের মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা ছিল এখানে। এর প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ড. নারুসে জিনজোওর আমন্ত্রণে কবি ছয় দিন অবস্থান করেছিলেন। ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে বক্তৃতা দিয়েছেন, ধ্যান করেছেন এবং ছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন বিদায় নিয়ে চলে যান ইবারাকি প্রিফেকচারের দিকে তখন রেল স্টেশনে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল বলে জানা যায় কবির ভক্ত ও দোভাষী মাদাম তোমি কেরার জীবনবৃত্তান্তে। ছাত্রীরা সমবেত হয়ে বিদায় জানাতে গিয়ে অঝরে কাঁদছিল, কাঁদছিলেন কবিও। 

১৯৮১ সালে রবীন্দ্রনাথের ১২০তম জন্মবর্ষে তাঁর স্নেহধন্য মাদাম কোরা কবির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার স্মৃতিকে জাগরুক করে রাখার জন্য ব্রোঞ্জের এই আবক্ষ স্মারক ভাস্কর্যটি নির্মাণ করান মাউন্ট আসামার সবুজ পাদদেশে। মাদাম  কোরা আজীবন ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত, তার  দোভাষী, অনুবাদক এবং গাইড। তাঁর বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘শান্তিনিকেতন।’ শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলেন কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ১৯৩৫ সালে। কবির মৃত্যুর পরও গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগে পুনরায় কারুইজাওয়া যেতে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন মাদাম  কোরার কাছে। তাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল এই কারুইজাওয়াতে। রবীন্দ্রনাথ ও মাদাম  তোমি  কোরাকে নিয়ে আমার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ গ্রন্থে, প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল  সাপ্তাহিক ২০০০ ম্যাগাজিনের ২০০৮ সালের ঈদ সংখ্যাতে।

এগারো
রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’র জাপানি অনুবাদ করেছেন ‘সাইগো নো শি’ নামে খ্যাতিমান সাহিত্যিক, গবেষক এবং তোকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উসুদা মাসাইউকি। তিনি বাঙালি, বাংলা ভাষা এবং রবীন্দ্রনাথের অকৃত্রিম ভক্ত। বাংলাদেশ নিয়ে যেমন গবেষণা করেছেন, গ্রন্থ লিখেছেন তেমনি বাংলা কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের অনুবাদ করেছেন একাধিক। ‘শেষের কবিতা’র অনুবাদ নিঃসন্দেহে তাঁর একটি সুদূরপ্রসারী অনন্য প্রতিভার সাক্ষর বহন করবে। উল্লেখ্য যে, তিরিশের দশকে জাপান প্রবাসী মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে প্রথম জাপানি ভাষায় ‘শেষের কবিতা’ অনুবাদ করেছিলেন যৌথভাবে। 

রাসবিহারী বসু যে শুধু ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন মহাবিপ্লবী ছিলেন তা নয়, মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন সরসিক প্রেমিকও। প্রেম না থাকলে রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসা কঠিন। যে ঠাকুরবাড়ি থেকে স্বদেশি আন্দোলনের সূচনা সেই বাড়ির অন্যতম প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর জাপানে একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর জাপানি স্ত্রী তোশিকো বসুকে এত গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন যে তিনি একবার তাঁর প্রতি বিদেশি স্ত্রীর ভালোবাসার পরীক্ষা পর্যন্ত নিয়েছিলেন। সে অধ্যায় জানার পর আমার মনে হয়েছে কঠিন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু একজন কোমল হৃদয়ের প্রেমিকও ছিলেন। এবং মাত্র ২৬ বছর বয়সে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রী যক্ষ্মারোগে দীর্ঘদিন ভুগে ইহলোকত্যাগ করার পর তিনি আর বিয়ে করেননি শাশুড়ির অনুরোধ সত্ত্বেও, মৃত্যু পর্যন্ত স্ত্রীর পবিত্র স্মৃতি বুকের ভেতরে সযতেœ ধরে রেখেছিলেন। ‘শেষের কবিতা’য় যে চিরকালের শাশ্বত মানববিচ্ছেদকে অঙ্কন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার ছায়া গভীর প্রভাব ফেলেছিল রাসবিহারীর মননে। তাই হয়তো এই উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন।  

বারো 
রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা 
১৯৬১ সালে জাপানে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ ঘটা করে উদযাপিত হয়েছিল আগেই উল্লেখ করেছি। ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের অন্যতম একটি অনুষ্ঠান ছিল মে মাসের ৬ তারিখ। সেদিন ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের মঞ্চাভিনয় যার শিল্পীরা সবাই ছিলেন জাপানি। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল জাপানের দ্বিতীয় প্রচারবহুল দৈনিক আসাহিশিম্বুন পত্রিকা।  সেই অনুষ্ঠানের একটি দুর্লভ আমন্ত্রণপত্র আবিষ্কার করেছিলাম ১৯৯৯ সালে য়োকোহামার ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবনের গ্রন্থাগারে।

তেরো 
তেনশিনের ‘রোকুকাকুদোও’ পরিদর্শন 
২০০৭ সালে ইবারাকি-প্রিফেকচারে বাস করেন গবেষক য়োশিদা ইউকের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঘরোয়াভাবে বক্তৃতা দেবার জন্য। তাঁর গবেষণা সংস্থায়  সেদিন উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় অধিবাসী প্রায় ৬০ জন, তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা সকলেই প্রথম জানলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। যাঁর সঙ্গে জাপানের প্রাতঃস্মরণীয় প-িত ও মনীষী ওকাকুরা তেনশিনের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ওকাকুরা এই ইবারাকি-প্রিফেকচারের ইজুরা নামক স্থানে সমুদ্রের তীরে নিজ আবাস গড়ে তুলেছিলেন। এখানে তাঁর শিল্পকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিহোন বিজুৎসুইন বা জাপান চারুকলা ইনস্টিটিউট এর ছাত্র য়োকোয়ামা তাইকান, হিশিদা শুনসোও, কানজান শিমোমুরা, কিমুরা বুজান প্রমুখ আবাসিক অবস্থায় ছবি আঁকতেন, শিল্পকলা নিয়ে গবেষণা করতেন।  তেনশিন তাঁর বাড়ির পাশেই সমুদ্রের তীর ঘেঁষে নিজস্ব ধারণাসম্বলিত একটি অভূতপূর্ব বিশ্রামাগার ‘রোকুকাকুদোও’ বা ছ’কোণবিশিষ্ট একটি কুঠুরি নির্মাণ করান ১৯০৫ সালে। এখানে তিনি বিশ্রাম নিতেন, লিখতেন, চিন্তা করতেন এবং সাগর-আকাশ-প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। 
১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ইজুরাতে যান বন্ধু ওকাকুরার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। ওকাকুরা ১৯১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন মাত্র ৫০ বছর বয়সে। রোকুকাকুদোও বিশ্রামাগারেও কবি সময় কাটান, বন্ধুকে স্মরণ করেন। 
আজ ওকাকুরা নেই কিন্তু তাঁর প্রাচ্যবাদী চিন্তাদর্শন ও কীর্তি জাপানি ভক্তদের দ্বারা সংরক্ষিত ও অনুসারিত হয়ে আসছে। আমার বক্তৃতা শেষে য়োশিদা সান আমাদেরকে ইজুরা নিয়ে যান। সেখানে ঘণ্টা খানেক সময় কাটাই, ওকাকুরার পরিত্যক্ত পুরনো বাড়িঘর আর ওই বিশ্রামাগার পরিদর্শন করি। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে ওকাকুরার স্মৃতি বিজড়িত আবাসবাড়ির প্রতিরক্ষক ইবারাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তাতে ওকাকুরার মুখ খোদিত আছে আর লেখা আছে কানজি অক্ষরে ‘আজিয়া’ অর্থাৎ ‘এশিয়া’। ওকাকুরা এশিয়ার সন্তান ছিলেন তাই উচ্চারণ করেছিলেন ‘এশিয়া ইজ ওয়ান’ বা ‘এশিয়া এক’ এখন একটি আপ্তবচন। 

menu
menu