প্রতিমা আসে 


ডুব সাঁতারের ইলিশ কইনা রূপা ঝিকমিক করে
কাঙানা কেন পড়ে রয়গো মরম পন্থা জুড়ে
ওই যে কেমন হাওয়ার ঘরে পদ্ম টলমল
পায়ের নিচে থেঁৎলে গেল তোমার চোখের জল ।।

এমনই এক ভৈরবী—এই যে সকল গাছগাছালি পাখপাখালি—আহারে কী যে ওম, তিনসত্যি ওমের পরাণ খুলে শীর্ণ নহর রঙের মালা সুবেহ সাদেক
গড়িয়ে এসে মিশেছে সূর্য ওঠার অগ্রবর্তী সময়ের পিঠে; কালিপদ দাস রোজকার মতো আজো এসে চৌকলদন্ডী গ্রামের উত্তর মাথায় অবস্থান করে যে নীলকর দালান : এ-দালান গম্ভীর, ভাঙা, নবাব ও ভিখারি—বাইরে ভীরিশন এক  জ্যামিতিক কাঠামো, কিন্তু ভিতরে তার গোলক ধাঁধা আট কুঠুরি—তার সামনে এসে  দাঁড়ায়।
প্রতিদিন যেরকম বলে কালিপদ—আজো তার ব্যত্যয় ঘটেনি কালিপদের  হাতে ঘড়ি বা সময় বলে কিছু নেই, কালপদ ধরে নেয় যে কিছুটা দেরি করে না এলে তাকে ঠিক মানায় না—কেমন ধারা সহযোগী লোক হলো সে যদি মনিবকে একটু  বকাঝকা করার সুযোগই করে না দেয়? কালিপদ চায় মবিনুল আহমদ সাহেব তাকে একটু বকুক—তাকে বকেই মুবিনুল আহমদের দিনটা শুরু হোক—কালিপদ ভাবে যা  হোক এতটুকু কাজেও তো আসি—নিজেই বুড়ো হয়েছি—চোখেও দেখি না ভালো—একটু বকাঝকা খাই—এটুকুই শান্তি—কতদিন, কতবছর হয়ে গ্যাল কালিপদ হিসাব মেলাতেও পারে না—কত আর বয়স প্রথম যখন কালিপদ মুবিনুল আহমদের সঙ্গে করাচিতে চাপরাশী হিসাবে কাজ শুরু করে! সেই থেকে আছে—কালিপদ মুবিনুল আহমেদের সুখেদুঃখে আছে—মাঝখানে খালি সংগ্রামের সময় কিছুদিন মুবিনুল আহমদ তাকে ধমকে ইন্ডিয়া পাঠায়—যুদ্ধ শেষ হলে আবার যেই কী  সেই কালিপদ এসে হাজির!
আমি এয়েছি!
সপ্তাখানিক দেরি করে এলি!
যা অবস্থা হুজুর, সড়ক ঘাট চলাচল বলে তো কিছু সোজা নেই— 
সব হেনস্থা ভাঙাচোরা—বড় কষ্ট করে এয়েছি! 
সারা জীবন কালিপদ কথা রেখেছে—কিছুটা পিছনে পড়ে থেকেছে—আগে  যেমন আজও তাই— 
হুজুর, আমি এয়েছি!
আজ কালিপদের দুই চোখের সীমারেখার ওপর ভারী দরজা দুখানি খোলেনি—একচুল নড়েওনি—স্থির! 
হুজুর, আমি এয়েছি!
দরজার, দালানের, এতবড়ো গম্ভীর একটা জ্যামিতিক নকশা ও বাতাসের কোন হেরফের হয়নি—স্থির! 
হুজুর! না হয় একটু বিলম্ব করেছি!
বার হয়ে আসেন—একটা খিঁচুনি দেন—কানমলা দেন— 
তা-ও কোন আলোড়ন, অভিযোগ নেই—স্থির!  
হুজুর, কিছু কী ঘটেছে আপনার, কথা যে কচ্ছেন না—কিছু কী হয়েছে হুজুর? 
সাহস করে কালিপদ ভারী দরজায় ধাক্কা দেয়—আরে দরজা তো খোলা—খালি ভেজানো—সিটকিনি নাই—তালা নাই—দরজা খোলা 
বিছানার উপর মুবিনুল আহমদ নাই—ফাঁকা পড়ে আছে পিছনে : বারান্দা—মুবিনুল আহমদ নাই—কালিপদ ঘরময় একটা জান্তব গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনতে পায়—ঘরও আধা অন্ধকার, কোনো কিছু পরিষ্কার ঠাহর হয় না—কিন্তু ওটা কী! কী  একটা গোলাকার পিণ্ড মেঝেময় গড়াগড়ি যায়, ঘরে এসে গণ্ডার ঢোকে কেমনে, তাজ্জব বিষয়!
কালিপদ এবার বুঝে ওঠে, পরিস্থিতি তার সামনে প্রকাশ পেয়ে বসে, অবিশ্বাস্য এক দুর্দিন কালিপদের সামনে হাঁটুর ভাঁজের মতন চোখেপড়া ছবির মতন বাস্তব এক ধরা দেয় যে, ওটা পিণ্ড নয়, আহত গণ্ডার নয়, কর্তিত মহিষ নয়—ওটা তিনি—মবিনুল আহমদ—তা-ও সম্ভব মুবিনুল আহমদ নিজেরই সম্পত্তির মেঝেতে গড়াগড়ি যায়!
হুজুর, কার এত বড়ো বুকের পাটা আমার স্যারকে বুকেপিঠে আড় করে বান্ধে, গামছা দিয়া চোখ আড়াল করে, কার এত্তোবড়ো সাহস!
কালিপদ এক বিদ্যুৎমুহূর্তে মুবিনুল আহমদের বাঁধন খুলতে যায় কিন্তু মুবিনুল আহমদ বজ্রে পোড়া মহিষের মতো চেঁচিয়ে ওঠে—কালিপদ, কালিপদ নজর করে  শোন বলি—আমাকে ছোঁবে না—ধরবি না বল্লাম ধরবি না—তুই তোর বসের কথা  অমান্য করিস—চাকরি নট করে দিবো—শোন কালিপদ! 
একবার স্যার, পুরা জীবনে একবার আপনার কথা অগ্রাহ্য করি—ক্ষমা দেন— চোখের বাঁধন খুলেই লম্বা দৌড় দিবো—এক দৌড়ে বড় সড়ক পার হবো।
বলি শোন, কালিপদ আমার কথা শোন—এই সুযোগ—সুযোগ হাতছাড়া  করিস না কলিপদ! এই মোক্ষম সুযোগ— 
আমার হাত বাধা পা বান্ধা চোখ বান্ধা—ঠিক যেমন রঙমালা আমার মা  রঙমালা, আমার মায়া আমার মেয়ে রঙমালা—এভাবেই আমি তারে কুয়ার মধ্যে ফেলি—আমি নিজের হাতে ওই ওই যে কুয়া তার ভিতর ফেলি—আমার প্রাপ্য—আমারেও কুয়ার ভিতরে ফেলা কালিপদ ...
না, না স্যার আমি পারবো না—আমি আপনার বাঁধন খুলে দিছি— 
হারামজাদা ক্যান বাঁধন খুলে দিছিস? এবার তোরে শেষ করবো—বল্লম কই— হারামজাদা!
কালিপদ এক নিঃশ্বাসে দৌড় দেয়, তার পিছনে বল্লম ছুঁড়ে মারে মুবিনুল আহমদ—হারামি কালি—কাইল্লা—তোর দিন শেষ! 
সামান্য ফারাকের জন্য বল্লম কালিপদের বদলে বিদ্ধ করে দেওয়াল।
কালিপদ হাউমাউ করে—কী হয় স্যার, কী হয় আপনার পোষ্য নোকর  কালিপদকে বলেন—বলা কী যায় না স্যার? 
এই নেন বল্লম, আপনার হাতে তুলে নেন—বলির পাঠার মতো কালিপদ  আপনার সামনে গড় হয়ে বসা স্যার—এই যে আমার পিঠ, এই কালিপদ পাঠার গলা  —নেন—পিঠের এ-ফোঁড় ওফোঁড় বিদ্ধ করেন স্যার, আপনার কী হয়? 
মুবিনুল আহমদ জানোয়ারের মতো গর্জন করে—কালিপদ সর সর, আমার  সামনে থেকে যা ... তুই আমার স্যার কালিপদ আমারে কুয়ার ভিতরে ফেলা!
হুজুর আমি আপনারে পাঙ্খার বাতাস করি!
না, না বাতাস না কালিপদ—আমার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে আমার পাঙ্খার বাতাস  লাগবে না—মরুভূমির একটু বাতাস যদি আসত ... ডুব দিবো ... থৈথৈ ভরা গাঙ্গে ডোব!
সত্যিই মরুভূমি থেকে একটা বাতাস আসে—সেই বাতাস বলে ঘুমিয়ো না  কেহ—ঘুম যেয়ো না মুবিনুল আহমদ—ঘুম বিষ ঘুম বিনানা—
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার
আসসালাতু খাইরুম মিনান নৌম...
মুবিনুল আহমদ জানে এ ভোরের আজান—ঘুম হইতে নামাজ উত্তম—আর  ঘুমিয়ে থেকো না ভাই, গা মোচড় দিয়ে জেগে ওঠো বোন—কিন্তু মুবিনুল আহমদের  মগজের নানা কোষ ঘোরাঘুরি করে দিগন্তে মেলানোর আগমুহূর্তে মুবিনুল আহমদের খামোকাই মনে হয়—একজন বাবা মরুভূমির দিগন্ত রেখা বরাবর তার হারিয়ে যাওয়া  একটি ছোট মেয়ে রঙমালাকে আর্তনাদ করে খুঁজে ফেরে : এই আহাজারি অন্য এক দীর্ঘ গীত আহ্বানের সঙ্গে মেলায়—ভোরের আবছায়া ঘোরে গরুদাগা কবিরাজ  হরিকমল এক দীর্ঘ হাঁক তোলে হোঁই ... হোঁই ... হোঁই ...
গিরস্থ বাড়ির গাই পুটকি করে ঠাই ঠাই
পেট ভরে ঘাস খাবি ধুনা ভরে দুধ দিবি
বছর বছর বিয়ান দিবি গিরস্থের দিল খুশি করবি।।
হোঁই ... হোঁই ... হোঁই ...
হরিকমলের চিৎকারের দীর্ঘ অগ্রভাগ গিয়ে বাড়ি খায় একটা সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে। চৌকলদন্ডীর আধাঘুম আধাজাগরণের মাঝ বরাবর এই ঘণ্টাধ্বনি এক শিহরণবাদী ছোট বা একটি শবরিপাতার মায়াঘ্রাণ যে দুধের কলস কাঙ্খে নিয়া কোনাবাড়ির দিকে বের হয় যার নাম বেদানা বানু তার মধ্যে হঠাৎ—আলোড়ন  তোলে; ফলে এই মেয়েটি সমাজসংসার যাকে বেদানা নামে চিহ্নিত করে সে এই বিজন ভোরের মোকাবেলায় পিচ্ছিল পিচ্ছিল শেওলার বিদুৎচ্চমকের মতো ছলকে ছলকে হেসে ওঠে যে মুহূর্তে বেদানার দানাগুলি পথের আনালে বিনালে ছিটকে ছিটকে পড়ে—হি হি হি ... হি হি হি ... হি হি হি ...
বেদানা বেগম দুধের কলসি মাটিতে রেখে সাইকেল ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে : সাইকেল কম্পাউন্ডার, ও সাইকেল কম্পাউন্ডার, আজকাল দেখি বড়ো সকাল সকাল মুরগির ইঞ্জিকশান দিতে চৌকলদন্ডী আসো—বড় রাস্তা থুয়ে ছোট গোপাটে আইসা গোত্তা খাও? 
বেদানা আঁইজ তুই ইয়ানে একখানা খাঁড়াও—আঁর দুঁইয়ান কতা হোন! 
ও খোদা, বোবার কইলজা দেহি জাম্বুরার মতন ফাইট্টা গেলো আজ।
তুঁই বালা কই জানো—আঁর বাড়ি এই দিস্টিক্ত ন্। বউত দূর—ইয়ান তনে  বউ্ত দূঁর! আঙ্গো চলন বলন, কতাবাইত্যা খাওনদাউন বেকতেততুন আলাদা। আঙ্গোত ইশারাই কও আর কুদানই কও তেঁইয়াও তঙ্গোততুন ফারাক।
সুলাইমান কম্পাউন্ডার আজগা তো দেহি মুখ দিয়া বিন্নি ধানের কৈ ফুটে!
আঁই ইয়ানে বিদেশি—হোশু ডাক্তারের অফিশে ফুট—ফরমাইশের কাম্ করি। আঙ্গো স্যারের বিয়ানে ঘুমুত্তুন উঠতে লাগে দেঁড়ঘণ্টা—ইঁয়ার ফরে কুরামুরি ভাঙ্গে  আরও এক ঘণ্টা। হেতেন আঁরে ডাকি কয়—এঁরই সুলাইমান, সাইকেল লৈ একখান  চক্কর দি চৌকলদন্ডীত্ন ঘুরি আসো, ফারমের ছোঁডো ছোঁডো মোরগের পাখনার নিচে ইঞ্জেকশান হান্দাবা! বেদানা, আঁই হেঁই ইঞ্জেকশন দিতে ভুলি যাই—তোঁয়ার হাঁসি  শুনি আঁই হথ্ ভুলি যাই।
এত কিছু কর ডাক্তার সাব, কই আমিতো কিছু বুঝি নাই। একদিনও একখান বাঁশের সাবান তো আমার দিকে ছুঁইড়া মারো নাই—খালি শোনি ঘনঘন সাইকেলের বেইল বাজাও।
একদিন এই সাইকেল লৈ আঁই ফুশকুনিত হড়ি গেছি গোই। বেদানা আঁই কিঁয়া করুম ক, আঁর নিজের উহর আঁয়ার কোনো কন্টোল নাই।
সুলাইমান মিয়া আমি কই কী—ঠিক মতো সান গোছল করো, সিনেমার  নায়কের মতন গলায় একখান ডোরাকাটা মাফলার প্যাঁচ দেও—চোখে কালাকালা  গগজচশমা লাগাও—দেখা যাক কী করা যায়! 
বেদানা, আঁই তোঁয়ারে হাচা করি কই—তোঁয়ার লাগি এই সাইকেল লৈ আঁর  তিনখান ঘটনা হয়—কী করি আঁরে ক! 
কইলাম তো আরও মাঞ্জামুইঞ্জা মারেন—ব্যবস্থা একটা হবে। 
আঁর মনটা বড় ফেরেশান। হত্যেকদিন হজরের হরে বিসমিল্লা কৈ যহন সাইকলত্ উডি—আঁর মনে অয় ইয়ান একখান সাইকেল, ইয়ার ফরে আগগাইয়া  আওনের হরে—বিশ্বাস করো বেদানা—আঁর মন কেঁইচ্ছা করে—মনে অয় আর দূর ন্।
লাগেজে আঁর সাইকেল একখান টমটম গাড়ি, মনে কয় আঁই চলি আইছি—থোরা কতক্ষণ হরে তোঁয়ার হাসি হুনুম—লাগেজে আঁর সাইকেল একখান হঙ্খিরাজ হই গেছে গোই। হেতে হঙ্খিরাজের মতো উড়ি চলে—কিন্তু তোঁয়ার সামনে খাড়নের  লগেলগে বেককিছু বাঙ্গা দাঁলানের মতো ভাঙ্গিচুরি ফড়ে।
আর তুই আঁর লগে মশকরা করি হাসো।
হি হি হি ... হি হি হি ... হি হি হি ...
অতঃপর বিধি মোতাবেক সুলাইমান কম্পাউন্ডার ঘনঘন সাইকেল এর ঘণ্টা বাজাতে শুরু করে, মনে হয় কেউ একজন উন্মাতাল হয়ে পড়ে, ভোরের ভৈরবী একটা ঠোকাঠুকির আওতায় নড়ে একটা শব্দের বেখাপ্পা বিলোড়ন ওঠে—ঘটনাটির  উৎপত্তি ঘটে চৌকলদন্ডীর উত্তরপাড়ায় শেষ মাথাকার মকবুল বেপারীর বাড়ি, সাইকেলের ঘণ্টা বাজে ধমকের আঙ্গিনায় ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ...
ধড়ফড়িয়ে ছমেদ আলী ঘুম থেকে জাগে, সঙ্গে সঙ্গে ছমেদ ধমক লাগায়— এখনো ঘুমাস তোরা ... শুয়োরের পাল, কম্পাউন্ডার সাব আইসা পড়ছে ... তোরা এখনো চিৎ হইয়া থাকোস। বানুরি, লইটকা জলদি উঠ, তাড়াতাড়ি কর।
উঠছি খালুজান উঠছি—আমিও উইঠা গ্যাছি—এখনি খোঁয়ার খুইলা মুরগী  ধরতাছি খালুজান।
পানি কই আমার ওজুর পানি কই—লইটকা। 
উঠেন, খালুজান ওঠেন, কলের ধুয়াউঠা পানি বদনায় লৈয়া আইতেছি—আপনি  উঠেন, পেশাব কইরা খালাশ কৈরা আসেন!
ও আল্লা, ও খালুজান কী করি কী করি, খোঁয়ারের দরজা খুইলা গ্যাছে—সব  মোরগ মুরগী বাইর হইয়া ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়ছে ও খালুজান, ও আম্মাজান!
মোরগমুরগী দীর্ঘ রজনীর সুখনিদ্রার পর ছাড়া পেয়ে পাখা ঝাপটে, দৌড়ঝাঁপ দিয়ে রীতিমত একটা শোরগোল ফেলে দেয় ... পোঁক পোঁক ... পোঁক ... পোঁক ... মোরগমুরগী গরুছাগল জঙ্গলের বেজি ও গুঁইশাপ, টিকটিকি আর মাকড়সা সবার মধ্যে এমন একটা সম্মিলিত কার্যপ্রণালী ছড়িয়ে পড়ে যে ওটি একটা সারবাঁধা শতসহস্র ইষ্টকখণ্ডের সারিবাঁধা পতনের মতো পুরো গ্রামে বিস্তার লাভ করে বসে। ফলে উত্তরপাড়া থেকে মাঝখানের লঙ্গরখানা হাটি—লঙ্গরখানা হাটি থেকে মিরধা বাড়ি,  মিরধা বাড়ির পর সুন্দরপাড়া সবখানে ছোটাছুটি হুড়াহুড়ি চিৎকার চ্যাঁচামেচি সংক্রমিত হয়ে পড়ে। পুরোনো শেওলাপড়া যে নীলকর দালানের ভিতর পথ খুঁজে পাবার জন্য এলোপাথারি দেওয়ালের পর দেওয়ালে এসে মাথা কোটে মুবিনুল আহমদ সেই দালানের দরজার চিকন এক ফোকর দিয়ে একবিন্দু বাতাসের মত দরকারি এক চিলতে ভোরের আলো এসে পড়ে, ফলে মুবিনুল আহমদ এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত দুইটি জিনিসের সন্ধান পায়— ১. তিনি বুঝতে পারেন কোথায় তাহলে দালানের  দরজা ২. আর বাইরে একটা হাঙ্গামা যেন সবলন্ডভন্ড করে দিয়ে তার পরিত্যক্ত দালানের দিকে ধেয়ে আসে দরজা খোলা মাত্র মুবিনুল আহমদ দেখতে পান—ছোট  একটি মেয়ে—রঙমালা—তারই ছোট মেয়ে রঙমালা—একখণ্ড আগুনলাগা গোলাপদানার সমতুল্য, চোখের একফোঁটা জলের সুষমা, শরীরের নাভির মতো অনিবার্য একটি গোলক—চুম্বনের দাগের মতো একটি তারা—তার মেয়ে রঙমালা বেজান দৌড়ে যায়— 
কোনখানে যাস তুই রঙমালা—কোনখানে পালাস—নামছে—গ্রামে মিলিটারি  নামছে—রঙমালা তুই এমন ছোট একটা মেয়ে আমার—আমার নাভির ভিতর  লুকাইতে পারিস না মা—আমার মাগো তুই কবে আমার নাভির থেকে বড়ো হইয়া  গ্যাছিস—তোরে ক্যান আমার নাভির ভিতর লুকাইতে পারি না! 
রঙমালার পিছনে পিছনে বাঘ ধাওয়া করে, রঙমালার পিছনে পিছনে আল্লার গজব ধাওয়া করে, রঙমালার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক তার পায়ে পায়ে একটা পৌরাণিক গল্প পলায়ন করে, মুবিনুল আহমদের মনে হয় এইতো সেদিনমাত্র সেইদিনের রঙমালা একটা পিচ্ছিল সরিষাদানার মতো দুনিয়ায় নেমে আসে—মুবিনুল আহমদের মনে হয়  কোথায় রঙমালা তো নাই ... এই চরাচর জুড়ে একটা প্রথমদিনের ওঁয়া ওঁয়া ধ্বনির ভিতর মুবিনুল আহমদ কার্য করে।
ওঁয়া ... ওঁয়া ... ওঁয়া ...
তোমরা আমার বাপ হও, আমার বড়বাপ লাগো, আমার এতটা জোনাইপোকার মতন মেয়েটাগো বাপ ...
তোমরা তারে ছাড়ো ...
মুবিনুল আহমদের সামনে কোন নদী নাই গাঙ ছিল না শুধু ঢেউয়ের পর ঢেউ খলবল করে! বাড়ি নাই ঘর উধাও কেবল পথ বহমান।
মুবিনুল আহমদ আর্মি অফিসারকে বলে সে তাদের সমর্থকানরী, এই নীলকর  দালান যেখানে কনসেনট্রেশান শিবির এখানে সহযোগী হিসাবে থাকার আর্জি জানায় মুবিনুল। তুমহারে করাচিওকা তুল্না ইজ দুনিয়ামে কিসি কে সাথ নেহি হে। মে পাকিস্তানকা অফিসার থা, ইন মুক্তিসালোকে পাচামে বাঁশ দেনেকে লিয়ে জে জে জরুরি হে ও হাম করেঙ্গে।
তুম হারা পরিখশা লেনা করে গা—তুম তাবহিরুখ সাত্থে হো আগার তুম কিসি  হিন্দু ইয়া মালাউনকা বাচ্চা না হোতো।
রঙমালার অবস্থান আর পরিস্থিতি জানতে আসা যাওয়ার পথে রঙমালার চোখে পড়ে মুবিনুল আহমদ। 
রঙমালা চিৎকার করে ওঠে—বাবাগো বাবা! 
হিশ্! আল্লার ওপর বিশ্বাস রাখিস মা।
আল্লাহ্ ভরসা, দেখি মা—কী করতে পারি! 
খালি জানটা বাঁচাইয়া রাখিস!
কয়েকদিনের মধ্যে ক্যাপ্টেন সরফরাজ খাঁর সামনে পড়ে মুবিনুল আহমদ।
ত্যারা নাম কিয়া হ্যায়?
ম্যারা নাম হে মুবিনুল আহমদ স্যার।
অ্যায়সে হাঁসফাস কিউ কার রেহে হো ব্রাদার। 
হামতো ভাইকো জানহে ভাই। 
স্যার মে বারবার উন লোগোকো আপকি বাতে সামঝারা রাহাহো ... আপকা কিৎনা বড়া কলিজাহে, আপকা পরিবার কিতনা খান্দানি হে!
ইয়ে সব ছোড়। উন লোগোকো বলো মেই কিত্না একেলা হু। ইয়ে পাতা করো কী মুক্তিবাহিনী হে কাহা। অর পাত্তা লাগাও কী হামারে বেহেনে হে কাহা!
ইসসে আচ্ছা হাম মেঘনা আর বুড়িগঙ্গা কি পাড়সে ঘুম কে আতা হে।
মুরগিকা বন্দোবস্ত হো গিয়া। হার তরফ অবভি লোগ ভিয়েজা গেয়াহে!
ইনকো বলো দেমাগপে যেয়াদা প্রেসার না ডালে।
করাচিকা লাড়কি দেখলো—কিয়া হোঁত্ হে, কিয়া আঁখে হে—উনকে রাঘো  মেতো আফগান আর ইরানিয়োকা খুন ডর রাহা হে। মুবিনুল!
জি সমাঝ পাইয়েছি।
দেখো রঙমালা সাহিসালামত হ্যায় কি নেহি। ওসকে লিয়ে অক্টোবর কি পনরা তারিখো নির্ধারিত কিয়া জায়ে।
রঙমালাকো ১৫ তারিখ মেরে ঘরতে ছোরকে জানা—পনার অক্টোবর! 
১৫ অক্টোবর ! আর মাত্র ৫ দিন—৫ দিন পরই তো ১৫ অক্টোবর। ওরা সব কই গেল—মুক্তিবাহিনী নিজাম তোফাচান দেরেশ দেবজ্যোতি—সব কই গেলো—এত গোলাগুলির আওয়াজ তাহলে কই হয়—মুক্তিবাহিনী এই নীলকর ক্যাম্প  আক্রমণ করবে না—মুক্তির কমান্ডার হাই সাহেবকে কেমনে একটা খবর দিই—আল্লাহ তুমি দয়ার সাগর! আগুনকে তুমি পানি বানাও পানিরে আগুন! ৫ দিনকে টেনে লম্বা করে  তুমি পাঁচ বছরের সমান করে দাও আল্লা!
রইসউদ্দিন, রইসউদ্দিন
হ, কী কবার কন! টানছি—পেট ভরে টানছি! 
মাথা ঝিমঝিম করতে আছে! কন কি কইবার কন। মুক্তিও জাউরা শালা বিহারিরাও খানকির পোলা!
কোনদিকে যাই।
অপারেশনে কবে যাইবা রইসউদ্দিন ভাই?
আগামী ১৪ তারিখ—১৪ অক্টোবর শালার বাস্টার্ড ক্যাপটেইন কয়— অপারেশনে যাইতে হবে ডিস্ট্রিক্ট ওয়ারি অপারেশন। কয়েকটা মাত্র বান্দির পোলা মাদারচুদ থাকবে—ক্যাম্প পাহারা দিবে, শক্ত পাহারা—১৫ তারিখে ফিরবে বড় বড়  শুয়োরকা বাচ্চা!
দেখতে দেখতে দিনতো চলে যায়—হাতবান্ধি পাও বান্ধি বিধি সময় বান্ধি  কিভা? আজ চৌদ্দ তারিখ—বাইরে পাহারা—শক্ত পাহারা—অফিসার সিপাই সব  ডিস্ট্রিক্ট অপারেশনে আউট—হাত বান্ধি পাও বান্ধি—ও আল্লাহ্ আমি আর তো কিছ্  পারি না—সময়ের হাত বানতে পারিনা—মেজরের ক্যাপ্টেনের পাও বানতে পারি না—
কিন্তু একজনের পারি—রঙমালার হাত বানতে পারি, রঙমালার পাও বানতে  পারি; আর কিছু না পারি এইটা তো পারি!
মুবিনুল আহমদ রঙমালার হাত যখন বান্ধে রঙমালা কয় কী কর বাবা; আমার হাত ক্যান বান্ধো—পাও যেইমাত্র বানতে চায় রঙমালা শিউরে উঠে বলে, বাবা পাও যদি বান্ধো তবে দৌড়ে পালাবো কেমনে? কথা কয় না মা, কথা বলার সময়তো নাই; আমার চোখ ক্যান বান্ধো বাবা—বাবা তোমার মুখখানা যে হারায়ে যায়! 
মা, মাগো আমার কথা কয়ো না। সময় নাই বাঁচতে হবে—মরতে হবে মা— মা ফাতেমা আমার!
আমারে লইয়া কই যাও বাবা—তুমি জানো না বাইরে মিলিটারি, পথে পথে  সিপাই? আমি চোখে তো দেখি না বাবা—তুমি পথ দেইখা যাও—ঘুটঘুইট্টা রাত তাই   না বাবা?
হ মা রাত রাইত, গলা ছাড়ো মা!
গলা ছাড় গলা ছাড় মা ... ও আল্লাহ্ বলেই মুবিনুল দালানের পিছনে কুয়ার ভিতর রঙমালাকে ছুঁড়ে ফেলে ... রঙ রঙ রঙমালা মা আমার রঙ রঙ বলেই মুবিনুল গভীর ঘন জন্মান্ধ অন্ধকারের স্ফটিকের ভিতর কূলহীন কিনারাহীন গোত্রহীন কৌমহীন মুবিনুল দৌড়ে দৌড়ে যায়!
মিনিটের পর ঘণ্টা ঘণ্টার পর দিন দিনের পর হপ্তা হপ্তার পর মাস মাসের পর বছর দশক দশকের পর শতক শতকের পর সহস্রাব্দ মুবিনুল—মুবিনুল দৌড়ে দৌড়ে  যায়—এত দৌড়ের পর এ-কেমন আশ্চর্য এক যাদুকরী তৃষ্ণা হয়—মুবিনুলের এ-তৃষ্ণা জলপানে যায় না—অলৌকিক তৃষ্ণায় তার কেবল রঙমালাকে আর একবার  দেখবার ইচ্ছা হয়।
বছরের পর বছর হাঁপানোর পর তৃষ্ণার পরও যখন মুবিনুল দ্যাখে তার মৃত্যু হয় না তখন আশ্চর্য এক টাকা মাছওয়ালা যাদুকর তাকে বলে রঙমালাকে না দেখে তার মৃত্যু হবে না—তার মৃত্যু বাঁধা রঙমালা নাম এক আমপাতাজামপাতা মেয়ের হাতে 
অতঃপর বহু বছর পর মুবিনুল নীলকর কুঠিবাড়ি কিনে নিয়ে তার নিজের বাড়ি থেকে ২৫ মাইল দূরে এসে একা ভাঙা দালানে থাকতে শুরু করে মুবিনুল আহমদ।
গতরাতে আবার এক রঙমালা এক আমপাতাজামপাতা প্রতিমা আসে। রাত তখন কয়টা হবে—২টা, ৩টা নাকি শেষ রাতের দিকে, এখনই আজান হবে? 
মুবিনুল আহমদ ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেনি—কয়েকটা লোক চারজন,  পাঁচজন, ছয়জন? কয়েকজন মানুষ একটা আমপাতাজামপাতা মেয়েকে মুবিনুল আহমদের সামনে এনে ফ্যালে—কেগো তুমি মা, আমার রঙমালা বুঝি? 
মেয়ে খালি বলে বাবা, বাবা আমাকে বাঁচাও বাবা। আমি সে-ই মেয়েই হবোগো বাবা তুমি যেই নামে ডাকো!
এইবার লোকগুলি কথা বলে—বান, এই শালা বুইড়াকে বান—মুখ বান চোখ  বান—না হয় চিল্লাচিল্লি করবে, থানায় ডায়েরি করবে! ঝামেলা রাখতে চাই না।  
এই বুড়া বুইড়ার বাচ্চা বুড়া কোন ঝামেলা করবি না—থানাপুলিশ করবি না— তোর নিরিবিলি বাড়ি, আমাগো কাজের সুবিধা। রাত পোহানের আগেই আমরা চলে যাবো—সব চলে যাবো—কী বললি? হা হা হা একখান সুন্দর নামও আবার দিলি  রঙমালা—আমরা সবাই যাবো—রঙমালাকেও নিয়া যাবো—তোর কোন ঝামেলা  হবে না। বাইরের বড় সড়কে আমাদের ট্রাক দাঁড়ানো!
আপনারা জানেন—তার সেই চিরদিনের কালিপদ যখন সুবেহসাদেকের  আশপাশের সময়ে আসে মুবিনুল আহমদ তখনো মেঝেয় হাতমুখচোখবাঁধা পড়েই আছে। তখনো গোঙায়!
কালিপদ তাঁর হাতপায়ের বাঁধন খোলার পর তাকে ব্যাপক ধমকায়।
কালি, কালিপদ তুই সর্ আমার সামনে থেকে সর্! কৈ কৈ দরজা কৈ! কালিপদ বল দরজা কোথায় গেল!
কালিপদ। কালিরে পাইছি ... ওই যে ওই যে সুতার মতো এক নালি তেরসা আলো আইসা আমার ঘরে পড়ে—দরজা, দরজা এইটাই দরজা! 
যাইরে কালিপদ যাই—আড়িয়াল খাঁ গাঙ্গে একবার সিনান করতে যাই।
শোন কালিপদ কতোদিন পর আজ আড়িয়াল খাঁর স্রোতবতী জলে ডুব দিয়ে গা ভিজাবো—আমার ছোট্ট মেয়েটি—আমার রঙমালা মেয়েটি নদীর পাড়ে গামছা নিয়ে  বসে থাকবে, আমি ডুব দিয়ে পাড়ে উঠলেই রঙমালা—ছোট মাছরাঙার মতো মেয়েটি বলে ওঠে :
বাবা, বাবা নাও তোমার গামছা!
কিন্তু এইবার কী যেন একটা ভুল হয় : রঙমালা বলে বাবা বাবা, কিন্তু আমি শুনি কার যেন আজ কেবল জন্মলাভ ঘটে—বলে ওঁয়া ওঁয়া 
ওঁয়া ... ওঁয়া ... ওঁয়া ...
রঙমালা আমাকে গামছা দিতে যাবে—কিন্তু দেখিযে রঙমালার পরণে বস্ত্রতো  নাই।
আড়িয়াল খাঁ বলে : মা, আমার জলের ভিতরে এসো, লজ্জা নিবারণ করো!
কিন্তু নদীতে পানিতো নাই বালু খর খর করে ।।


বদরুজ্জামান আলমগীর কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। প্রকাশিত বই—আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে, আবের পাঙখা লৈয়া। প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস। কাব্য : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর, নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো, দূরত্বের সুফিয়ানা। ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন। ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় বসবাস করেন।

menu
menu