আংটি রহস্য 


(কলিযুগে শ্রী কৌশিক সেন বিরচিত একাঙ্ক নাটিকা)


পাত্রপাত্রী 
মহাদেব রায়চৌধুরী  
অন্নপূর্ণা রায়চৌধুরী  
বিক্রম দাশগুপ্ত  
অনসূয়া দাশগুপ্ত 
শকুন্তলা 
রাজা দুষ্মন্ত
কবি কালিদাস  
শার্ঙ্গরব ব্রহ্মচারী

(স্টেজে একটি চেয়ার, টেবিল এবং টেবিলল্যাম্প। ডানদিকে একটি ছোট আলমারি। বাঁ দিকে আলনা সেখানে জামা কাপড় ঝুলছে। মহাদেববাবু চেয়ারে বসে আছেন। পরনে অফিসের পোশাক, হাবভাব পরিশ্রান্ত। সামনে চায়ের কাপ।)
মহাদেব : উঃ, আর তো পারা যাচ্ছে না। একদিকে বস, অন্যদিকে ক্লায়েন্ট এই দুই অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে বসে আছি মশাই। কোত্থেকে এক দক্ষিণ ভারতীয় ম্যানেজার এয়েছে, সে আবার মুখে কথা বলে না, গালমন্দ দিতে হলে ফটাং করে টেক্সট করে দেয়। টেক্সট তো নয় যেন মৌমাছির হুল। অফিসে সারাদিন মারধর খেয়ে বাড়ি এসে যে দুদণ্ড স্বস্তি পাব, ভগবান কি সে উপায় রেখেছেন? 
(খুব ব্যস্ত হয়ে অন্নপূর্ণা ঢোকেন। হাতে মোবাইলফোন। মহাদেব চা গিলতে গিয়ে বিষম খান)
অন্নপূর্ণা : বাবা লক্ষণ, গ্যাসের সিলিন্ডারটা তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছে দিও বাবা। রান্নাবান্না আছে। (ফোনের বোতাম টেপে) হ্যাঁ অনু আমি ঘণ্টাখানেকের জন্য বেরোচ্ছি, তুই সময়মতন চলে আসিস কিন্তু, (মহাদেবকে) এই যে শুনছ! বলি অফিস ফেরত যে জিনিসগুলো আনতে বলেছিলাম, এনেছ? 
মহাদেব : কোন জিনিসগুলো? মানে অফিসে বড্ড দেরি হয়ে গেল কিনা তাই— 
অন্নপূর্ণা : বাঃ বাঃ! জানতাম এই রকমটাই হবে। আজকেই তাড়াতাড়ি আসতে বলেছিলাম যে! আচ্ছা বেরোনোর সময় লিস্টি বানিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম, তা সে বুঝি পকেটেই থেকে গেল। 
মহাদেব : পকেট? মানে কোন পকেট? 
অন্নপূর্ণা : বুকপকেট (বুকপকেটে হাত ঢুকিয়ে এক টুকরো কাগজ বার করেন)। এই দ্যাখো স্পষ্ট লেখা আছে। সামান্য কয়েকটা জিনিস। 
মহাদেব : এই, এই পকেটে হাত ঢোকাচ্ছ কেন? 
অন্নপূর্ণা : কেন? পকেটে কার চিঠি আছে। 
মহাদেব : আজকাল চিঠি পকেটে থাকে না, ফোনে থাকে। দাও, এক্ষুনি নিয়ে আসছি। 
অন্নপূর্ণা : রক্ষা করো আমায়। এখন বেরোলেই তো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাত দশটায় ফিরবে। তারপরে আমাকে এক কাঁড়ি মিথ্যে কথা শুনতে হবে। আমি যাচ্ছি মেয়ের ওখানে, যা করার আমিই করব। (যেতে যেতে হঠাৎ ফিরে দাঁড়ায়, সন্দিগ্ধ চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখে) শোনো, জামাই আসবে, খবরদার যদি ওই সব ছাইপাঁশ গিলতে বসেছ তো তোমারি একদিন কি আমারই একদিন। 
মহাদেব : (অসহায় গলায়) ছাইপাঁশ কি কোথাও আছে যে খাব। সব তো ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছ। 
অন্নপূর্ণা : চুপ করো নেশাখোর কোথাকার, ভাবছ আমি কিছু জানি না। তোমার চোখ দেখলেই আমি বুঝতে পারি পেটে দ্রব্য পড়েছে কি না। বুঝেছ? 
মহাদেব : বুঝব না? এমন শাশুড়িমা না হলে এমন জাঁদরেল পুলিশ অফিসার জামাই হয়। 
অন্নপূর্ণা : আবার ঠেস দিয়ে কথা বলা হচ্ছে। বলি বিক্রমের মতন স্মার্ট আর করিৎকর্মা ছেলে আরেকটা খুঁজে বার করো দেখি। উঃ চাবিটা আবার কোথায় গেল? 
(অন্নপূর্ণা ব্যাগ থেকে নানারকম জিনিস বার করে টেবিলের ওপর রাখেন। চাবি পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যান কিন্তু কতগুলো কাগজ টেবিলের ওপরেই থেকে যায়। মহাদেব কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে উনি আলমারির ভেতর থেকে কাপড় জড়ানো একটি বোতল বার করে আনেন।) 
মহাদেব : যাক বাবা, আজ সন্ধ্যার মতন শান্তি (গ্লাসে ঢেলে বিরাট একটা চুমুক দেয়)। বংশদণ্ডটি আপাতত জামাই বাবাজির এলাকায়। (কাগজগুলো তুলে পড়তে শুরু করে।) আরে এটা আবার কোত্থেকে এলো। ওরই ব্যাগ থেকে বেরোলো না? (পাতা ওলটায়) হুঁ হুঁ ইন্টারেস্টিং। 
(যন্ত্রসংগীত। স্টেজের মধ্যে কুয়াশা, আলো জ্বলছে নিভছে—একটি মেয়ে দৌড়ে এসে প্রায় মহাদেববাবুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।) 
মহাদেব : আরে আরে এ কী হচ্ছে? আপনি কে? 
মেয়েটি : রক্ষা করুন। হে আর্যপুত্র আমাকে রক্ষা করুন। আমি মহর্ষি কণ্বের পালিতা কন্যা, রাজচক্রবর্তী সম্রাট দুষ্মন্তের ধর্মপত্নী শকুন্তলা। 
মহাদেব : কী সর্বনাশ। আপনি কোথা থেকে এসে হাজির হলেন।  
শকুন্তলা : মহারাজ আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাত কণ্বের শিষ্য আর্য শার্ঙ্গরব আমাকে সঙ্গে করে এই নগরীতে এনেছিলেন। তিনি এখন নগরীর এক পানশালায় আকণ্ঠ মাদ্ধী পান করে ওখানেই কোনো এক বারবনিতায় কক্ষে নিদ্রামগ্ন। মদ্যপের দল আমাকেও তাড়া করেছিল, আমি কোনোরকমে পালিয়ে এসেছি (কান্না চেপে দুই হাত জোড় করে নমস্কার জানায়)। আর্যপুত্র আপনার ভবনে আমি আজ রাত্রের মতন আশ্রয়প্রার্থী। 
মহাদেব : আমি নির্ঘাত স্বপ্ন দেখছি। এমন কিছু নেশাও তো করিনি। দ্বাপর যুগের জনগণ এই সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলো কেমন করে? 
শকুন্তলা : মহাশয় আপনি কি বিবাহিত?
মহাদেব : হ্যাঁ কিন্তু আমার স্ত্রী বাড়িতে নেই। 
শকুন্তলা : অহো কী সৌভাগ্য। আপনার কাছে সামান্য কিছু খাদ্য ভিক্ষা করতে পারি কি? সকাল থেকে আমি অন্নগ্রহণ করিনি। 
মহাদেব : আরে আরে, আগে বলবেন তো। গিন্নি বেরোবার আগে জলখাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে, এই দেখুন। (ঢাকনা খোলে)। মটরশুঁটির কচুরি আর ছোলার ডাল। অনেক আছে, আসুন ভাগ করে খাই। আর এইটা একঢোঁক খেয়ে দেখুন ভালো লাগবে। 
শকুন্তলা : (এক ঢোক খেয়ে মুখ বিকৃত করে) এই বুঝি মাদ্ধী। ক্ষমা করবেন আমি আগে কখনো খাইনি। 
মহাদেব : হ্যাঁ, প্রথমবার খেলে উৎকট লাগে বটে। ভাববেন না অভ্যেস হয়ে যাবে। 
শকুন্তলা : (খেতে খেতে) মহাশয় আপনি ধন্য। আপনার স্ত্রী কিন্তু রন্ধনে দ্রৌপদী।
মহাদেব : হ্যাঁ, রান্নাটা ভালোই করে, সংসারের সব দিকে নজর আছে, আমাকে কিছুই ভাবতে হয় না কিন্তু— 
শকুন্তলা : উনি অবশ্যই শৃঙ্গারকলায় পারঙ্গমা। হায়, কেউ যদি আমায় শিখিয়ে দিত। আজন্ম আমি তপস্বী ব্রহ্মচারীদের সংসর্গে কাটিয়েছি, কামকলার কিছুই জানি না। তাই বুঝি মহারাজ আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। উনি প্রমাণ চান, এদিকে আংটিটাও যে আমি হারিয়ে ফেলেছি। (কান্নায় ভেঙে পড়ে) 
মহাদেব : প্লিজ কাঁদবেন না। আরে আমার গিন্নির সঙ্গে আপনার কোনো তুলনা হয়? আপনি মহাকাব্যের নায়িকা, আপনার মধুর কণ্ঠস্বর যেন পাখির কাকলি, আপনার সরল সুন্দর মুখশ্রী, যেন ভোরবেলাকার শিশিরে ধোয়া ফুল।  
শকুন্তলা : মহারাজও ঠিক এইসব কথা বলেছিলেন, তারপর তো আর চিনতেই পারলেন না।
(নেপথ্যে জড়িতকণ্ঠে ডাক—শকুন্তলে। ভো ভো শকুন্তলে!)
 শকুন্তলা : কী সর্বনাশ। সেই দগ্ধানন ঋষি শার্ঙ্গরব ঠিক আমার পিছু পিছু এসেছে। আচ্ছা আপনার এই ঘরে লুকোবার কোনো জায়গা আছে?  
মহাদেব : লুকোবার জায়গা। মানে ওই আলমারিটা। যদিও জামাকাপড়ে ঠাসা। 
(কথা শেষ হয় না, শকুন্তলা একদৌড়ে আলমারির মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। স্টেজে আবার কুয়াশা। টলতে টলতে শার্ঙ্গরব ঢোকেন।)    
শার্ঙ্গরব : শকুন্তলে। হে সুন্দরী তুমি কোথায়। এই অনার্য পাপপুরীতে কে তোমাকে রক্ষা করবে? 
মহাদেব : ভর সন্ধ্যায় হল্লা করছেন কেন বলুন দেখি? কে আপনি? 
শার্ঙ্গরব : আমি শার্ঙ্গরব ব্রহ্মচারী, মহর্ষি কণ্বের চরণাশ্রিত শিষ্য। এই দেশের পাষণ্ডী রাজা দুষ্মন্ত আমার গুরুকন্যা শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে অন্তঃসত্ত্বা, স্ত্রীর স্বীকৃতি না পেলে অবৈধ পুত্রের জননী হবে, আশ্রমে আর তার স্থান হবে না। আমিও সেই অশুভ সংবাদ নিয়ে গুরুগৃহে ফিরতে পারবো না, তার চেয়ে আমার মৃত্যুই ভালো। কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়। 
মহাদেব : আপনার তো দেখছি বেশ চড়ে গিয়েছে। বসুন, এক গ্লাস জল খান। 
শার্ঙ্গরব : ঠিক আছে আপনি যা খাচ্ছেন তাই একটু দিন না হয়। 
মহাদেব : দূর মশায়, আপনার তো এখনো নেশা করার মতলব। এখানে বসে এই জলের গ্লাসটা ধরুন। তারপর বলুন দেখি আপনার ওই লম্পট রাজা তো শকুন্তলাকে ডিচ করেছে, এখন প্ল্যান বি বলে কিছু আছে কি?  
শার্ঙ্গরব : (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) আপনার বক্তব্যের শেষ অংশটি তো বোধগম্য হলো না। 
মহাদেব : শকুন্তলাকে পাওয়া গেলে কী করবেন? 
শার্ঙ্গরব : স্বামী পরিত্যক্ত কন্যাকে কোনো দুর্গম জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে। তারপর— 
মহাদেব : থাক থাক বুঝতে পেরেছি। শুনুন এ যুগে ওসব না করলেও চলে। তাছাড়া এখানে কেউ নেই, আমি শান্তিতে বসে একটু মাল খাচ্ছি, আজ বরং আপনি আসুন।
শার্ঙ্গরব : কিন্তু আমি যে তার অঙ্গের সুবাস পাচ্ছি। আমি নিশ্চিন্ত যে সে ধারেকাছেই আছে। হে মহাত্মন, অন্তত আজ রাত্রের মতন এই দরিদ্র ব্রাহ্মণকে আশ্রয় দিন। 
মহাদেব : এ তো ভারি মুশকিলে ফেললো। দেখুন আমার স্ত্রী বাড়ি নেই, আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না। তাছাড়া আপনাকে দেখে ঠিক দরিদ্র বলেও মনে হচ্ছে না। আপনি বরং ওই বসার ঘরে একটু অপেক্ষা করুন। 
শার্ঙ্গরব : বুঝতে পেরেছি। মহাশয় একান্তই স্ত্রৈণ।
মহাদেব : স্ত্রৈণ মানে? রেগুলার লাইফে একপিস অ-স্ত্রৈণ পুরুষমানুষ খুঁজে বার করুন দেখি, আমি আপনার চ্যালা বনে যাব। তাছাড়া আপনি তো ভারি অদ্ভুত লোক মশাই! বাড়ি বয়ে গাল দিতে এসেছেন। বেরোন বেরোন। 
শার্ঙ্গরব : না না, ক্রুদ্ধ হবেন না। গুরুদেব বলেছিলেন বটে, কলিযুগে নারীশক্তিই প্রবল। তা আমি না-হয় আপনার বহির্গৃহে বসেই দেবীর আগমনের অপেক্ষা করি। (বেরিয়ে যায়। শকুন্তলা সঙ্গে সঙ্গে আলমারি থেকে বেরিয়ে আসে) 
শকুন্তলা : আপনি ওঁকে আশ্রয় দিলেন কেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার পক্ষে। 
মহাদেব : দেখুন, আমি নিশ্চিন্ত যে আমার মাথা খারাপ হয়েছে কিন্তু আপনার বিপক্ষে কোন কাজটা করলাম বলুন তো। 
শকুন্তলা :  শুনলেন না, মুনিবর আমাকে কোন দুর্গম জায়গায় নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখতে চান। পিতারও নাকি তাই মত। কিন্তু আমি কেন চোরের মতন লুকিয়ে থাকব। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। রাজা দুষ্মন্ত রীতিমতন গান্ধর্ব বিবাহ করে তবেই আমাকে গ্রহণ করেছিলেন।  
মহাদেব : হ্যাঁ ওইসব সুবিধাজনক ব্যবস্থা পুরাকালে ছিল বটে—গান্ধর্ব বিবাহ, রাক্ষস বিবাহ। দুঃখের বিষয় এই যুগে ওসব অচল। আপনি চিন্তা করবেন না। কালিদাস লিখেছেন আংটি খুঁজে পাওয়া যাবে, রাজা আপনাকে চিনতে পারবেন, আপনার পুত্র ভরত রাজচক্রবর্তী হবেন, তাঁরই নামে এই দেশের নাম হবে ভারতবর্ষ। 
শকুন্তলা : কালিদাসের লেখা একটা কথাও আপনি বিশ্বাস করেন? মানুষ মেঘের সঙ্গে কথা বলতে পারে? 
মহাদেব : কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আজকাল কিন্তু সবাই মেঘের সঙ্গে কথা বলে। সত্যি বলতে কি তারা মেঘে মেঘেই ভেসে বেড়ায়। সে যাকগে, আসল সমস্যাটা এইখানে যে আমার গৃহিণী যেকোনো সময়ে ফিরে আসতে পারেন, তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, আমার কোনো ধারণা নেই। তার আগে আপনারা দুজন ভালোয় ভালোয় এখান থেকে বিদায় হলেই মঙ্গল। 
শকুন্তলা : আর্যপুত্র আপনার শুভনামটি তো জানা হলো না।
মহাদেব : শুভ, অশুভ জানি না, আমার নাম মহাদেব। এই মান্ধাতার আমলের পৌরাণিক নামটির জন্য আমাকে স্কুল থেকে বাসরঘর অবধি প্যাঁক খেতে হয়েছে। 
শকুন্তলা : কী সুন্দর নাম (দুই হাত জোড় করে আবৃত্তি করে) রণ নির্জিত দুর্জয় দৈত্যপুরং। প্রণমামি শিবম শিব কল্পতরুম। 
মহাদেব : (আপ্লুত হয়ে) এ আপনি কী বললেন ম্যাডাম। আমার সঙ্গে জীবনে কেউ এইভাবে কথা বলেনি। 
শকুন্তলা : আপনি আমাকে এই উৎকট যাবনিক ভাষায় সম্বোধন করছেন কেন বলুন তো ভদ্র মহাদেব? 
মহাদেব : তাহলে কী বলে ডাকব? ভদ্রিনী বলে কোনো কথা আছে কি? 
শকুন্তলা : (খিলখিল করে হেসে ওঠে) ভদ্রিনী! না তার চাইতে আপনি ভদ্রে বলতে পারেন, দেবী বললেও আপত্তি নেই। অবশ্য আমি চাই আপনি আমায় শুকু বলে ডাকুন। 
মহাদেব : সর্বনাশ। শেষ অবধি শুকু। 
শকুন্তলা : হ্যাঁ, তাত কণ্ব আর মাতা গৌতমী আমাকে ওই নামেই ডাকেন।
মহাদেব : শুকু আপনার জন্য কী করতে পারি বলুন। আপনাকে দেখার সাথে সাথে আমার মনের মধ্যে যেন একের পর এক বন্ধ দরজা দুহাট হয়ে খুলে যাচ্ছে, চোখ ধাঁধানো আলোর রশ্মিরা ছুটে বেড়াচ্ছে দিগ্বিবিদিকে। হাজার হাজার না-বলা কথা সেই আলোর স্রোতে ডানা মেলেছে। এত কথা কোথায় ছিল এতদিন? 
(বিক্রম ঢোকে, পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম, হাতে একটা থালা, সেখানে ঢাকা দেওয়া কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। শকুন্তলা এক ছুটে আলমারির মধ্যে ঢুকে যায়। কিন্তু তার আগেই বিক্রম দেখে ফেলেছে।) 
বিক্রম : বাবা। এসব কী হচ্ছে শুনি? 
মহাদেব : বিক্রম, তুমি কখন এলে বাবা? বোসো, বোসো, তোমার মা আর বউ এসে পড়ল বলে। 
বিক্রম : এই মেয়েটা কে। সিনেমা স্টার নাকি র‍্যাম্পে হাঁটা মডেল। বাবা আপনার এরকম লুজ ক্যারেকটার কবে থেকে হলো? 
মহাদেব : আরে বোসো তো আগে। বিশ্বাস করো তুমি যা ভাবছো তা নয়। ও হচ্ছে শকুন্তলা, ওর আংটি হারিয়ে গেছে। সে অনেক কেলোর কীর্তি, তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। বিশ্বাস না হয়, দেখে আসো পাশের ঘরে ওর বডিগার্ড বসে আছে। 
বিক্রম : দাঁড়ান এইটাকে আগে ফ্রিজে রেখে আসি। মামণির হুকুম (বাইরে যায়, তারপরেই উত্তেজিতভাবে শার্ঙ্গরবের গলার কাপড় ধরে ভেতরে ঢোকে)। এই লোকটা আমাদের ঘরে কী করছে? তোর কী মতলব? অ্যাঁ? তুই কি ওই মেয়েটার দালাল নাকি? 
শার্ঙ্গরব : রে রে পাষণ্ড রাক্ষস, এই মুহূর্তে নিবৃত্ত হ, না-হলে ব্রহ্মশাপে তোকে দগ্ধ করব। হে মহারাজ দুষ্মন্ত আপনি কোথায়? আপনার রাজত্বে যদি ব্রহ্মহত্যা হয়, তাহলে কিন্তু আপনি রাজধর্মে পতিত হবেন। 
বিক্রম—আরে, তোর মতন কতজন এ অবধি আমাকে দগ্ধ করল রে পাগল। এখানে চুপ করে বস, এবার ওই আলমারির মধ্যে মেয়েটাকে বাজিয়ে দেখি। (শার্ঙ্গরবকে হাতকড়া লাগিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। এর মধ্যে মহাদেব এসে আলমারির সামনে দাঁড়িয়েছে) আরে শ্বশুরমশায় আপনি আমাকে আটকাচ্ছেন কেন? যা করেছেন করেছেন, এখন তাড়াতাড়ি এদের এখান থেকে বার করতে না পারলে তারা এসে যাবে, তখন আপনি তো মরবেনই, আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে আমিও মারা পড়তে পারি।
মহাদেব : দাঁড়াও দাঁড়াও। বিশ্বাস করো ব্যাপারটা—
বিক্রম : সব মদনই ও কথা বলে। এখন সরুন দেখি। 
(স্টেজে আবার ধোঁয়া। রাজা দুষ্মন্তের প্রবেশ) 
দুষ্মন্ত : অয়ং অহম ভো। 
বিক্রম : তুমি কে বাবা? পি সি সরকারের মতন উদয় হলে। 
দুষ্মন্ত : অহো আস্পর্ধা। অনার্য দুষ্কৃতকারীর দল, দেশের রাজার সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় জানিস না। (কোমর থেকে তলোয়ার বার করে) তোরা যথোচিত শাস্তি পাবি। 
বিক্রম : (নিজের পিস্তল বার করে) হাঃ হাঃ, এ তো যাত্রা পার্টির গুণ্ডা রে। কার সঙ্গে কথা বলছিস জানিস? দাঁড়া দাঁড়া, বুঝেছি। তোরা দুজনে আর ওই আলমারির মধ্যে মেয়েটা মিলে গ্যাং বানিয়েছিস, না! আমার নিরীহ শ্বশুরমশায়কে ফাঁসাবার মতলব। বুড়ো শাঁসালো মাল, ছবিটবি তুলে পরে ব্ল্যাকমেইল করবি তাই তো? আজকাল এসব কেস খুব হচ্ছে।
দুষ্মন্ত : মেয়ে! মানে নারী। এখানে তো কোনো নারীকে দেখছি না। লুকিয়ে রেখেছিস নাকি। মনে রাখিস আমার রাজত্বে নারীহরণের শাস্তি নপুংসকরণ। আর তুই কেমন রাক্ষস রে, ওইটুকু একটা গদা নিয়ে ঘুরিস। 
(বিক্রম হকচকিয়ে যায়। পিস্তলটা একবার নাড়িয়ে দেখে।)
বিক্রম : চোপ! এটা দেখে তোর যাত্রাদলের গদা মনে হয়। আর নারীহরণের শাস্তি কি করণ বললি?
মহাদেব : ওর মানে খোজাকরণ অর্থাৎ হিজড়ে বানানো। 
শার্ঙ্গরব : মহারাজের জয় হোক। মহারাজ আমি খুব কৌশল করে শকুন্তলাকে আপনার কাননগৃহের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম। অর্ধপথে আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সে পালিয়ে যায়। মহারাজ এই লোকগুলো শকুন্তলাকে জোর করে আটকে রেখেছে। ওদের যমালয়ে পাঠিয়ে আপনি ওকে হরণ করে নিয়ে যান। 
(কালিদাস ঢোকেন।) 
বিক্রম : এই পুরুতমশায় আবার কোত্থেকে এসে হাজির হলেন? 
কালিদাস : স্বস্তি স্বস্তি। এখানে দেখছি বেশ একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। মহারাজ আপনি অস্ত্র সংবরণ করুন। এইসব ক্ষুদ্র মানবসন্তান আপনার ক্রোধের যোগ্য নয়।  
দুষ্মন্ত : প্রণাম বিপ্রবর। আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। 
কালিদাস : আমার নাম ভট্ট কালিদাস, আমি সামান্য একজন কবি ও নাট্যকার। 
মহাদেব : এই যে শুনুন টাইম আউট। আপনারা যে যাই হোন না কেন, এটা আমার বাড়ি, এবং আপনারা সকলে ট্রেসপাসার। আচ্ছা আপনারা কারা বলুন তো, ভরসন্ধ্যায় শুধু শুধু নরক গুলজার করছেন কেন? 
দুষ্মন্ত : আমি এই দেশের রাজা, মহারাজ দুষ্মন্ত! 
(হঠাৎ দরজার পাল্লা খুলে শকুন্তলা বেরিয়ে আসে। সকলে চমকে উঠবে।)
শকুন্তলা : মহারাজ আমাকে উন্মুক্ত সভায়, সকলের সাক্ষাতে স্বীকার না করলে আমি মহারাজের উপপত্নী হয়ে থাকতে চাই না। আমাদের সন্তানকে আমি একাই মানুষ করব।
বিক্রম : আলবাত করবেন। আর এই লোকগুলো আপনাকে জ্বালাতন করলে শুধু থানায় একটা ফোন করে দিলেই হবে। আমি নিজে চলে আসবো। 
শকুন্তলা : (কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা কালিদাসের সামনে এসে দাঁড়ায়।) কবিবর, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? দুর্বাসার শাপের গল্পটা আপনি বানিয়ে বানিয়ে লিখলেন কেন? যাতে মহারাজকে খুব খারাপ না দেখায় তাই তো? 
কালিদাস : শুনুন, অভিশাপ, বিস্মৃতি আর অভিজ্ঞান মিলিয়ে এমন একটা সাত অঙ্কের মিলনান্তক কাহিনি বানিয়েছি বলেই তো সে নাটক অমরত্ব পেয়েছে। বলি শিল্পের কথাটাও তো ভাবতে হবে। 
শকুন্তলা : ধিক!
দুষ্মন্ত : আর আমার কথাটা কে ভাববে শুনি? পাশে মহারানি বসে আছেন, চারদিকে শ্বশুরকুল আর শ্যালকের দল, তার মধ্যে শকুন্তলাকে এক কথায় স্বীকার করে নিলে কেউ আমাকে আস্ত রাখবে ভেবেছ? 
শকুন্তলা : কেন, সেদিন সেই লতাবিতানে মুগ্ধা বালিকার পাণিগ্রহণ করার সময় এইসব কথা মনে হয়নি মহারাজের। 
(দুষ্মন্ত মাথা নিচু করে। বিক্রম এগিয়ে গিয়ে দুজনের মধ্যে দাঁড়ায়।) 
বিক্রম : দেখুন একটা কথা বলি। পৌরাণিক ভাষা তো আমার জানা নেই, কিন্তু সাদা বাংলায় বলতে পারি যে মানে শকুন্তলা দেবী, আপনাকে না হঠাৎ করে সামনে দেখলে, বুদ্ধিশুদ্ধিগুলো একটু গুলিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। মানে পুরুষমানুষ তো, জন্ম থেকেই দুর্বল। তখন যা মনে আসে লোকজন তাই বলে দেয়, তারপর বাকি জীবন ধরে পস্তাতে থাকে। মাইরি বলছি। 
মহাদেব : তার মানে? তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করে পস্তাচ্ছ নাকি? 
বিক্রম : শ্বশুরমশাই চেপে যান। দিল্লিকা লাড্ডুর কেস, সেই মহাভারতের যুগ থেকে সবাই পস্তাচ্ছে। 
নেপথ্যে অন্নপূর্ণা : শুনছ। দরজার বাইরে এতগুলো জুতো এলো কোত্থেকে? 
মহাদেব : সর্বনাশ। গিন্নি এসে গেছে। 
(এক মুহূর্তের জন্য সবাই চুপ। অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকে চারদিকে বেশ করে একবার দেখে নিলেন। সবাই নার্ভাস।) 
বিক্রম : মামণি, আপনার জিনিস এসে গেছে। কথামতন আস্তই ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছি। 
মহাদেব : আস্ত ঢুকিয়ে রেখেছ? কী জিনিস? 
অন্নপূর্ণা : তাতে তোমার কী দরকার? তুমি তো আবার আমাকে লুকিয়ে নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছ। তা কী নাটক হচ্ছে শুনি? 
মহাদেব : মানে, আমি জানি না। পাত্রপাত্রীরা নিজে থেকেই এসে হাজির হয়েছেন। 
অন্নপূর্ণা : হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি। নাটকের নামটা আগে বলো দিকিনি? 
কালিদাস : অভিজ্ঞানশকুন্তলম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাটক। 
মহাদেব : হ্যাঁ, তবে ওই দুর্বাসার শাপ, মহারাজের স্মৃতিভ্রংশ আর শকুন্তলার আংটি হারানোর গল্পটা এই ভদ্রলোক বানিয়ে বানিয়ে লিখেছেন। ইনি কালিদাস। 
কালিদাস : আমি মহাকবি। আমার শৈল্পিক স্বাধীনতা আছে। 
বিক্রম : কীরকম স্বাধীনতা? 
মহাদেব : আর্টিস্টিক লাইসেন্স। শিল্পের খাতিরে সত্যের ওপরে রং চড়ানো। কিন্তু মহাকবি তার থেকে কিছু বেশিই করেছেন। মহাভারতে আছে দুষ্মন্ত দৈববাণী শুনে শকুন্তলাকে গ্রহণ করেছিলেন। 
শকুন্তলা : কিমাশ্চর্য্যমতঃপরম! মুখ দেখে যে চিনল না সে আংটি দেখে আর দৈববাণী শুনে চিনবে? মহারাজ জেনে শুনে আমাকে অস্বীকার করলেন, খোলা সভায় কুলটা, মিথ্যেবাদী বলে গালি দিলেন। আর আপনি? আপনি নাকি মহাকবি যিনি এই মিথ্যাচারের গল্প ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে নাটক লিখেছেন। সেই নাটক যুগ যুগ ধরে লোকে পড়ছে, অভিনয় করছে। 
অন্নপূর্ণা : ঠিক বলেছিস মা, এই সবকটা অকৃতজ্ঞ। আহারে তোর মুখটা শুকিয়ে গেছে, সকাল থেকে বোধহয় একফোঁটা জলও মুখে পড়েনি। চল দেখি আমার সঙ্গে, তোকে একটু ভালোমন্দ খাওয়াই। এই পোড়ামুখোগুলো এখানেই বসে থাকুক। শোন আমার মেয়ের নাম অনসূয়া, খুব ভালো অ্যাডভোকেট, তুই চাইলে ও তোর পক্ষ নিয়ে লড়বে। 
শকুন্তলা : অনসূয়া। আমার প্রিয় সখী। আমরা তিনজন, আমি, অনসূয়া আর প্রিয়ংবদা, তিন সখী মিলে অনেকগুলো হরিণশিশু পুষেছিলাম। তাদের কি অবস্থা হয়েছে কে জানে? 
বিক্রম : মামণি, আমারও যে খিদে পেয়ে গেছে। আমি কিনা নিজের জামাইষষ্ঠীর ইলিশ মাছ নিজেই কিনে নিয়ে এলাম। 
মহাদেব : কী? আজ বুঝি জামাইযষ্ঠী। খেয়াল ছিল না তো।
অন্নপূর্ণা : খেয়াল কবে থাকে তোমার। শোনো বাবা বিক্রম, খাবারটা এখনো ঠিক তৈরি হয়নি। এদিকে আমার এই মহাদেবটি তো সব ভুলে বসে আছেন। খালি নাটক আর নাটক। (শকুন্তলাকে) আয় তো মা, আমাকে একটু হেল্প কর। (দুজনে বেরিয়ে যায়। ছেলেরা অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে।)  
বিক্রম : ব্যাপারটা ক্রমশ ঘেঁটে যাচ্ছে দেখছি। বাবা, আপনার ওই বোতলটায় কি কিছু বাকি আছে? আসুন না ভাগ করে খাই। 
কালিদাস : উত্তম প্রস্তাব। কলিযুগের মাদ্ধী পান করার এই সুযোগ ছাড়া যায় না। আসুন মহারাজ। (সবাই হাতে হাতে মদ ঢালে।) 
দুষ্মন্ত : আচ্ছা কলিযুগে কি সকলেই শ্রীরামচন্দ্র? 
বিক্রম : না, অনেকেই হনুমান, কিংবা গৌ মাতার দুষ্টু বাছুর। কিন্তু আপনার বক্তব্যটা কী? 
মহাদেব : উনি জিজ্ঞাসা করছেন, সকলেই একদারনিষ্ঠ অর্থাৎ মনোগ্যামাস কি না। মহারাজ এই তল্লাটে আপাতত তাই। এই যে আমি মহাদেব, আমার একটিই স্ত্রী, অন্নপূর্ণা। 
কালিদাস : সাধু সাধু। মহাদেব ও অন্নপূর্ণা। আমার কুমারসম্ভব কাব্যেও আমি আপনাদের একদারনিষ্ঠার গুণগান করেছি। 
শার্ঙ্গরব : শুনেছি ওই কাব্য অতীব অশ্লীল। শিব-পার্বতীর প্রণয়কাহিনি নিয়ে লেখা। যাবনিক ভাষায় যাকে বলে পর্নোগ্রাফি। 
বিক্রম : চুপ! তাতে তোর কী রে। তা পণ্ডিতমশাই ওই কাব্যটি বাংলা করে একটু বলুন না, আমরাও সবাই শুনি।  
(অন্নপূর্ণা ঢোকেন। পিছনে একটা থালা হাতে শকুন্তলা, থালার ওপরে রান্না করা আস্ত ইলিশ মাছ।) 
অন্নপূর্ণা : থাক থাক, কুমারসম্ভবের কথা আর বলতে হবে না। ফুলশয্যার রাত্তিরে মহাদেব আমাকে পড়ে শুনিয়েছিল, দেবদেবীদের নিয়ে কী সব অসভ্য অসভ্য কথা। 
মহাদেব : কই, তখন তো অসভ্য অসভ্য লাগেনি।   
অন্নপূর্ণা : চুপ, আর একটা কথা বলেছ কি তোমারি একদিন নয় আমারই একদিন। 
কালিদাস : দেখুন আপনারা যে এতদিন বাদে বাসরশয্যায় আমার কাব্য পাঠ করছেন, একজন কবির জন্য সেই তো পরম প্রাপ্তি। সত্য না মিথ্যা, শ্লীল না অশ্লীল তার বিচার করবেন মহাকাল। 
অন্নপূর্ণা : শোনো সবাই, আজ জামাইষষ্ঠীর দিন ভেবেছিলাম জামাই বাবাজিকে আস্ত ইলিশ মাছ রোস্ট করে খাওয়াব। ওদিকে আমাদের মেয়েটা বরের হাতে মাছ পাঠিয়ে দিল কিন্তু নিজের দেখা নেই, আর এদিকে বাড়িতে নাটকের রিহার্সাল চলছে। যা আমার কপাল। তা বাবা বিক্রম তোমার জন্য রান্না, তুমিই আগে টেস্ট করে দেখো। 
দুষ্মন্ত : দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি একে অতিথি, তারপর রাজা। আস্বাদ করার দায়িত্ব আমিও নিতে পারি। 
শার্ঙ্গরব (জেগে ওঠে) : কী অপূর্ব সুবাস। বহুক্ষণ হয়ে গেল ক্ষুধিত হয়ে আছি। দেখি দেখি, এই দিকে নিয়ে আসুন।     
বিক্রম : ক্ষুধিত হয়েই থাকো। আজ জামাইষষ্ঠীর দিন, আমি আগে খাব। (মাছের থালা থেকে এক টুকরো তুলে মুখে দেয়, তারপরই আর্তনাদ করে ওঠে) উঃ দাঁতটা ভাঙল! 
মহাদেব ও দুষ্মন্ত একসঙ্গে—আরে আরে এটা দেখছি আংটি!
বিক্রম : তাই তো দেখছি। হীরের আংটি। তাহলে কি? 
দুষ্মন্ত : হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো আংটি পাওয়া গেছে। আমার রাজ অঙ্গুরীয়! আমার অভিজ্ঞান! শকুন্তলা আমার সব মনে পড়ে গেছে। এই দুই ব্রাহ্মণকে সাক্ষী রেখে আমি তোমাকে গ্রহণ করলাম। আজ থেকে তুমি আমার পাটরানি, তোমার পুত্র যুবরাজ হবে, সে-ই আমার পরে রাজ্যশাসন করবে।
কালিদাস : দেখুন। বলেছিলাম না মাছের পেটে আংটি পাওয়া যাবে।  
মহাদেব : কিন্তু আংটিটা যেন চেনা চেনা লাগছে। 
অন্নপূর্ণা : উঃ! চুপ করে থাকতে পারো না এক মিনিট।
শকুন্তলা : দৈববাণী কিংবা মাছের পেটে আংটি। কিছু একটা অলৌকিক ঘটনা দরকার, তবেই উনি আমাকে স্বীকার করতে পারবেন। না-হলে লোকে বলবে কী? মহারাজ, লোকনিন্দার যদি এতই ভয় থাকে, তাহলে কান খুলে শুনে রাখুন। সব নারীই সীতাদেবী নয়। আমি হেমকূট পর্বতে মাতা মেনকার কাছে যাচ্ছি। যদি ফিরিয়ে আনতে হয় তো নিজে গিয়ে সসম্মানে ফিরিয়ে আনবেন। 
শার্ঙ্গরব : সাধু সাধু। এই আশ্রমকন্যার তেজ দেখুন সকলে। শকুন্তলে চিন্তা করো না, মহারাজ আসুন না আসুন, আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাবো। গুরুদেবের আদেশ। 
দুষ্মন্ত : কী, আমাকে প্রত্যাখ্যান করা! এত অহংকার! আর ভণ্ড তপস্বী তুই আগাগোড়াই এই মতলবে আছিস, না রে? দাঁড়া, আগে তোকে মারব তারপর শকুন্তলাকে হরণ করে নিয়ে যাব। (তলোয়ার বার করে। শার্ঙ্গরব বিকট স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। কোলাহল। বিক্রম পিস্তল বার করে শূন্যে গুলি ছোড়ে। সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে চুপ করে যায়।)
কালিদাস : আপনি কে? বেতালসিদ্ধ মহারাজ বিক্রমাদিত্য নাকি?  
বিক্রম : দূর মশাই বোতলে সিদ্ধ হতে আমার বয়ে গেছে। শুনুন মহারাজ, আপনি একজন আইপিএস অফিসারের সামনে এই মহিলাকে আপনার স্ত্রী বলে স্বীকার করেছেন। এর পরে ট্যাঁ ফোঁ করলে জোচ্চুরি আর মেয়ে পটানোর দায়ে আপনাকে গ্রেফতার করে হাজতে চালান করব। (এক হাতে পিস্তল ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে সেলফোন বার করে।) হ্যাঁ দত্ত, তুমি দুজন সিপাইকে নিয়ে এখনই আমার শ্বশুরবাড়িতে হাজির হও দেখি। 
মহাদেব : হ্যাঁ, ধরে নিয়ে যাও দেখি বাবা। বাচ্চা মেয়েটাকে ফুসলিয়ে বিয়ে করে তারপর আবার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ভয় দেখানো হচ্ছে। দেব ধরে—(দুষ্মন্তকে মারার ভঙ্গি করে কিন্তু ওর তলোয়ার দেখে পিছিয়ে গিয়ে বিক্রমের পেছনে দাঁড়ায়) 
কালিদাস : অহো ভাগ্য, সর্বত্রই শুধু হিংসা হানাহানির কথা কেন? আংটি পাওয়া গেছে, মহারাজ শকুন্তলাকে স্বীকার করেছেন, এও মেনে নিয়েছেন যে শকুন্তলার পুত্রই রাজা হবে। নাটক শেষ, মধুরেণ সমাপয়েৎ।
বিক্রম : এই শর্তের ব্যাপারটা কিন্তু আমারও বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে।
দুষ্মন্ত : এই তো, এমনকি এই রাক্ষস ব্যাটাও আমার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে। আমি বিবাহিত, বাচ্চাকাচ্চাও রয়েছে, এক কথায় এইরকম শর্তে রাজি হওয়া কি সম্ভব। তাই একটু কৌশল করে—
শার্ঙ্গরব : আঃ হাঃ হাঃ! কৌশল করে! এদিকে আমি আশায় আশায় বারো বছর ধরে ব্যাকরণ মুখস্থ করছি। যাকগে, এখন দয়া করে আমার এই লৌহবলয় খুলে দাও, আমি আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করি, বাকি জীবন তপস্যা আর ব্রহ্মচর্যেই কাটিয়ে দেব।
বিক্রম : মনে হচ্ছে তুই হতাশ প্রেমিক। শালা, দালালের থেকেও খারাপ। 
অন্নপূর্ণা : যেতে দাও বিক্রম, নিরীহ লোক, ওদের ওপর অত্যাচার করে লাভ নেই (বিক্রম খুলে দেয়)। জেলে দিতে হলে তো সবকটাকেই দিতে হয়। 
(স্টেজে আবার কুয়াশা, পৌরাণিক চরিত্ররা একে একে বেরিয়ে যায়। শকুন্তলা যাবার আগে অন্নপূর্ণার হাতে মাছের থালাটা দিয়ে প্রণাম করে যাবে। অনসূয়া ঢোকে।) 
অনসূয়া : সরি, সরি বড্ড দেরি হয়ে গেল। (বিক্রমকে) সরি বেবি, আই নো ইউ আর রিয়ালি হাংরি। (এদিকে ওদিকে তাকায়) কি ব্যাপার বলো তো তোমাদের কেমন যেন দেখছি। সবাই ঠিক আছ তো? 
অন্নপূর্ণা : সব ঠিক আছে রে মা, সুযোগ পেয়ে শ্বশুর-জামাই মিলে আচ্ছাসে নেশা করেছে। থাক গে আজকের দিনে আর বকাবকি করিস না। আয়, সবাই খাবার ঘরে আয়। (বেরিয়ে যায়) 
অনসূয়া : না না বকুনি তো আমার খাওয়া উচিত। (বিক্রমের কাছে গিয়ে) তোমাকে ইউনিফর্মে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে বিক্রম। চলো আমি ডেজার্ট বানিয়েছি। অবশ্য যদি মায়ের রান্না খাবার পরেও পেটে কোন জায়গা থাকে।
বিক্রম : না না, অনেক জায়গা থাকবে। খুব খিদে পেয়েছে তো। 
অনসূয়া : আচ্ছা বিক্রম এই ঘরে কোথা থেকে একটা সুগন্ধ পাচ্ছি বলো তো। মনটা কেমন উদাস হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে অনেক দিনের পরিচিত কেউ একজন এসেছিল কিন্তু দেখা হবার আগেই সে চলে গেছে।
বিক্রম : এ কোন ভাষায় কথা বলে রে বাবা। 
অনসূয়া : এত সব পুরনো কথা মনে পড়ছে হঠাৎ। কলেজের কথা, বিয়ের আগের কথা। ইস দেখো দেখি আজকাল কাজে কাজে আর দেখাই হয় না আমাদের। চলো ছুটি নিয়ে বেশ একটা পাহাড়ি জায়গায় বেড়াতে যাই। 
বিক্রম : কালকে যে বলেছিলে মরার সময় নেই। 
অনসূয়া : আঃ, চলো না। 
(বিক্রমের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। স্টেজে মহাদেব ও অন্নপূর্ণা। মহাদেব আবার কাগজগুলো নিয়ে একটু আড়াল করে পড়তে শুরু করে। 
অন্নপূর্ণা : (আংটিটা আঙুলে পরে নিয়ে, মদের বোতল গ্লাস ইত্যাদি সরাতে সরাতে, হঠাৎ মহাদেবের দিকে তাকায়।)
অন্নপূর্ণা : কি, আমার স্ক্রিপ্ট ভালো লেগেছে? নেশা বুঝি তুমি একাই করতে পারো। 
(দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আধুনিক ও পৌরাণিক যুগের সবাই চারদিক থেকে এসে দাঁড়ায়। যবনিকা) 

 


কৌশিক সেন লেখক এবং চিকিৎসক। তাঁর সাতটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে দেশ, সানন্দা এবং কৃত্তিবাসে। পরবাস আন্তর্জাল পত্রিকার নিয়মিত লেখেন। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দশ। তিনি আমেরিকায় থাকেন।

menu
menu