নিন্দিত নন্দন ও তার বীভৎসতা


ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, একটি উজ্জ্বল নাম; তিনি তাঁর নিন্দিত নন্দন গ্রন্থটিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখতে গিয়ে বড় বেশি ক্লান্ত হয়েছেন বলেই মনে হয়। লিখতে লিখতে একেক সময় যেন হাঁপিয়ে উঠেছেন। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ হেঁটে হেঁটে চলে গেছে কতোটা দূরে, তবুও আমাদের মনে, প্রতিটি বাঙালির মনে হয় এইতো সেদিনের কথা! গোটা কয়েকটি দশক পেরিয়ে গেছে সেইসব বীভৎস স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে; আর সেইসব বীভৎস স্মৃতিকে লেখনির আলোকচ্ছটায় নিতে কষ্টেরই বিষয়; তবুও তিনি সারি সারি নাম লিপিবদ্ধ করেছেন অনায়াসে তাঁর গ্রন্থে শক্ত হাতে। ক্লান্ত হয়েছেন বটে! কিন্তু শ্রান্ত হয়েছেন বলে মনে হয় না। একের পর এক নাম উল্লেখ করেছেন অনায়াসে। এতো নামের সমাহার এই গ্রন্থে পড়তে পড়তে অবাক লাগে। বিস্মিত হতে হয়, কীভাবে এতো এতো নাম, এতো এতো জায়গার নাম, এতো এতো স্মৃতি কীভাবে আপন মনের মণিকোঠায় সাজিয়ে রেখেছিলেন তিনি! খুব শক্ত মনের মানুষ না হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এমন বীভৎসতার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর পক্ষে সুস্থ থাকাটাই অসম্ভব। এদিক থেকে প্রিয়ভাষিণীকে খুব শক্ত মনের মানুষ হিসেবে প্রমাণ করেছে তাঁর নিন্দিত নন্দন গ্রন্থটি। স্বাধীনতা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর স্মৃতিকথাগুলোতে তিনি যে কষ্টের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন, তা কষ্টের হলেও মধুরই মনে হয়েছে। কিন্তু মধু পান করতে করতে কখন যে বিষ এসে গেলো। প্রথম কিছুদূর পাঠে মনে হবে হয়তো গ্রন্থটি তিনি তাঁর সরস আত্মজীবনী লিখেছেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরেই যে কথাগুলো লিখেছেন সেখানে শুধু ধর্ষণের পর ধর্ষণের কথা উঠে এসেছে। একের পর এক ধর্ষণ। ধর্ষণের চিত্রগুলো এমন যে, পাক সেনাদের পাকীয় হাত, পাকীয় দাঁত, পাকীয় লিঙ্গ সবই যেন একেকটি অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে বাংলার অসহায় নারীদের ওপর। নারী তার নিজের স্তন চেপে ধরে রেখেও বাঁচাতে পারেনি নিজের স্তন। তাদের স্তনে পাকি হানাদারদের, পাকি সেনা অফিসারদের দাঁতের দাগ। দাঁত দিয়ে অসহায় নারীদের স্তনের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছে। একেই কি ধর্ষণ বলে? ধর্ষণ কি এতোটা বীভৎস? নিন্দিত নন্দন গ্রন্থটি এই প্রশ্নই জাগায় পাঠক মনে। সেই ক্ষত স্তনে অসহায় বাঙালি নারীরা মলম মেখে ক্ষত সারাতো আবার যেন পাক সেনারা তাদের দাঁত বসাতে পারে সেই স্তনে। কি নির্মম নিয়তি ঘাঁটি গেঁড়েছিল বাংলার গলিপথে। কি নির্মম ইতিহাস হেঁটে চলে গেছে মহাকালের পথে। এমন কত কালো সময় হারিয়ে গেছে অজানার পথে পথে, সবুজ ধানের আল ধরে হেঁটে গেছে কতো মা-বোন নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে, পারেনি কেউ এরা দৈত্য-জানোয়ারের সঙ্গে। গ্রন্থটি পড়তে পড়তে গা ছমছম করে উঠে। ধর্ষণের কথাগুলো পুরো নয়টি মাস জুড়েই; এ কেমন ধর্ষণ?  

এ কেমন যুদ্ধ ছিল? খুব জিজ্ঞাসা উঠে আসে কাঁপা কাঁপা বুকের ভেতর থেকে। খুব জানতে ইচ্ছে করে আমাদের বাংলার অসহায় নারীরা যারা ধর্ষিতা হয়েছিল তারা সবাই কি বেঁচেছিল? বেঁচে থাকলেও কোথায়, কীভাবে?  

ধর্ষণের দৃশ্যপট এতো বীভৎস! 

এই দৃশ্যপট পড়তে পড়তে যেকোনো সুস্থ মনের মানুষ, সুন্দর মনের মানুষকে মাথার উপর ঘূর্ণমাণ পাখার গতি বাড়াতে বাধ্য করবে। একজন নারী প্রতিদিন পাক সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে রাতের অন্ধকারে আর দিনের আলোয়ে সে তার স্তনে মলম মেখে নিজেকে আবার তৈরি করছে সেই ধর্ষণের জন্য। এই বিষয়টি কতখানি লোমহর্ষক! কতখানি ঘৃণা আনে মনে, আনে কতখানি দুঃখরাশি? কতখানি রক্তক্ষরণ হয় বাঙালি নারীর হৃদয়ে? কতগুলো স্তনের মাংস ছিড়েছিল  হায়না-শুয়োর? হিসেব রাখেনি ইতিহাস। 

১৯৭১-এর প্রথম দিকের কথা—‘এদিকে আমি প্রথম দিন অফিসে গিয়ে কয়েকবার উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার হই বিভিন্ন জন দ্বারা। বুঝতে পারছি না যুদ্ধের এ কোন ভয়াবহ রূপ! আমার বুকের স্তনের আগের দিনের ক্ষত এখনো শুকায়নি। নীল হয়ে আছে। পিএবিএক্স মেশিনের কাছে দাঁড়াতেই ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের একজন অফিসার সুলতান পানজুয়ানী ঢুকলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে সে আমার স্তন চেপে ধরলো। বারটার পরে ফিদাই সাহেব উপরে ডাকলেন। ঘরে ঢুকতেই ফিদাই সাহেব দরজা লক করে দেন। বললাম, স্যার অত্যন্ত বিশ্বাস করে আপনাকে দেখে জয়েন করেছি। আপনি উপকার করেছেন। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাই। আমার স্তনের অগ্রভাগে ততোক্ষণে ফুসকা পড়ে গেছে। আমি ফাঁক পেলেই একান্তে বুকে হাত দিয়ে কাতরাই। সহসা দেখলাম বাঙালি চিফ একাউন্ট্যান্ট নাছির আহমেদ উষ্ণ মেজাজে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। ভাবলাম যুদ্ধের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতে সবাই বুঝি এক নৌকাতে ঠাঁই নিয়েছি। তিনি বললেন চলো খুলনা যাচ্ছি তোমাকে নামিয়ে দেবো। গাড়িটি খুলনা গার্লস কলেজের কাছে, প্রায় নূরনগর পর্যন্ত গেলে, তখন নাজির সাহেবের কামার্ত গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে জানাতে শুরু করে, ‘দীর্ঘদিন হতে চললো স্ত্রী খুব অসুস্থ। এখানে একটি গেস্ট হাউস আছে। একজন মেজর আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ওরও একই অবস্থা। তুমি কি আমাদের একটু সাহায্য করতে পারো? সারাদিন আমি গোপনে স্তনে তুলা দিয়ে রেখে যন্ত্রণা উপশম করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। নাজির সাহেবের প্রস্তাব শুনে আমার ব্যক্তিগত ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা অনেক বেশি বেড়ে গেছে ততোক্ষণে। আমি অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলি, স্যার ক্ষমা করুন প্লিজ। রাগে-অহংকারে-পরাজয়ে তিনি এক ঝটকায় গাড়ি রাস্তার পাশে থামিয়ে বলেন, তাহলে তুমি এখানে নেমে যাও। ১৪ এপ্রিল, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের অতর্কিত আক্রমণে আমি ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হই। তার বিষদাঁতের আঘাত সহ্য করে চলতে হচ্ছে কদিন ধরে। সিদ্দিকদের বাসাতে ফিরেছিলাম সেদিন ক্ষত-বিক্ষত অবস্থাতে। এন্টিবায়োটিক নিতে শুরু করি। দুর্বৃত্ত একাত্তর কেঁড়ে নিলো আমার মনের সব ভালোবাসা। 

হঠাৎ গুলজারিন আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে তার বেডরুমে আমায় ধাক্কা দিয়ে তার বিছানায় ফেলে দিল। মুহূর্তেই খুনির চেহারা ধারণ করা দেখেই চোখ বন্ধ করেছি। হয়তোবা সেই মুহূর্তেই আমার মৃত্যু অনিবার্য হবার কথা। সমস্ত শরীরে আগুনের হলকা বয়ে চলেছে। তার লেলিহান জিহ্বার গনগনে আগুনে পুড়ছে আমার শরীর। আজও সেই সাপের বিষ লেগে আছে আমার সারা মুখে। যখনই চোখ বন্ধ করি, একাত্তর ভেসে উঠে আমার চোখে, স্মৃতিগুলো ঠিক তেমনি দুঃসহ। কমান্ডার গুলজারিনের পাশবিক নির্যাতন ভাষায় বর্ণনাতীত, যা আজও আমাকে নরক যন্ত্রণার  কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার মধ্যে ফুঁসে উঠে আগুনের অনির্বাণ শিখা। প্রতিশোধ না নিতে পারা প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধবোধ জাগে।”

নিন্দিত নন্দন  গ্রন্থের ১৩১ পৃষ্ঠার শেষ প্যারা থেকে—“সহসা দেখতে পেলাম একজন বাঙালি আমার সাথে বেশ উষ্ণ মেজাজে কথা বলছেন। ভাবলাম যুদ্ধের দুর্যোগপূর্ণ উত্তাল হাওয়াতে সবাই বুঝিবা এক নৌকোতে ঠাঁই নিয়েছি। তখন নাজির সাহেবের কামার্ত গলার স্বর, ক্ষীণ হয়ে জানাতে শুরু করে ‘দীর্ঘদিন হতে চললো স্ত্রী খুব অসুস্থ। এখানে একটি গেস্ট হাউস আছে। একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, তারও একই অবস্থা। তুমি কি আমাদের একটু সাহায্য করতে পারো? সারাদিন আমি গোপনে স্তনে তুলো দিয়ে রেখে যন্ত্রণা উপসম করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। নাজির সাহেবের প্রস্তাব শুনে আমার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা অনেক বেশি বেড়ে গেছে।”

প্রিয়ভাষিণীর স্মৃতি কথায় ছোপ ছোপ যে রক্তের দাগের কথা লিখেছেন তা বাদ দিয়েই শুধু ধর্ষণের কথাগুলোটুকু যদি সাজাতে বলা হয় তবুও সাজানো হবে না ঠিকঠাকমতো। হত্যাগুলো যেমন দুঃসহ, ধর্ষণগুলো তার চেয়েও অধিক। ১৫৯ নং পৃষ্ঠায় তাঁর উপর ধর্ষণের একটি চিত্র :

“ওরা আমাকে অফিসার্স ক্লাবের ছোট্ট একটি রুমে বসতে দিলো। ঘরটি ছিমছাম গুছানো। শোবার একটি ছোট খাট একটি হলসস্টোন অফিসাররা যেখানে মাথার টুপি খুলে রাখে। মোট কথা একটি ছোট রেস্ট রুম আমি সারা পথ ধরে নির্যাতিত হয়ে আসা কলঙ্কিত মুখটি ভালো করে ধুয়ে এসে চেয়ারে বসলাম। কেননা ওরা হুইস্কি ভরে, মাঝে মাঝে মনের উল্লাসে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আমার মুখে কুলি করে ছিটিয়ে দিচ্ছিলো। পাটের গুদামের পাশে গাড়ি রেখে একের পর এক নির্যাতন করছিলো। আমি অজ্ঞানের মতো নিথর দেহ মনে পড়েছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার কোনো জ্ঞান ছিলো না।” 

পাক সেনাদের প্রিয়ভাষিণীকে একটি জিজ্ঞাসাবাদের চিত্র – পৃষ্ঠা ১৬০

“তোমাকে এখানে আসতে বলা হয়েহে, আমাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে। একহাত লম্বা চিকন কাঠের স্টিক ঘোরাতে ঘোরাতে দুজন অফিসার আমার আঙ্গুলের ফাঁকে স্টিক ঢুকিয়ে দিয়ে বলে আমি ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। এদিকে স্টিকটির চাপ ক্রমেই আমার আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলার মতো। সে যন্ত্রণার বিবরণ দেওয়া কঠিন। অফিসার দুজন প্রশ্ন করে আমি নকশাল করি কিনা? আঙ্গুলের ব্যথায় চিৎকার করতেই অন্য অফিসার আমার স্তন চেপে ধরে তীব্র ব্যথার সঞ্চার করতে থাকে। আমি ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছিলাম। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে বুঝতে পারলাম আমার গর্ভে শত্রুর বিষাক্ত ভ্রূণ বাসা বেঁধেছে। এই বিপদের দিনে কি করবো তা বুঝতে পারছি না। আমি এ বিপদ থেকে মুক্ত হতে চাই। একা একা হাউমাউ করে কাঁদছি। এবার বোধহয় আমার আত্মহননের সময় এসেছে। বুকের মধ্যে ঘৃণা যেন গলিত লাভার মতো জ্বলছে মাতৃত্বহীন গর্ভধারিনী।” 

পাকিস্তানী সৈন্যরা পৈশাচিকতা চালিয়েছিল সে কথা ইতিহাস রেখেছে লিখে কিন্তু এই যে বাঙালিরা যুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের ওপর এমন নির্যাতন করেছে তার নাম কি দিয়েছে বাঙালি পুরুষ? যুদ্ধের ডামাডোলে বাঙালি এবং অবাঙালি পুরুষের উদ্দেশে প্রিয়ভাষিণীর বর্ণনা— 

“এই ভয়ংকর যুদ্ধ যেন প্রতিটি পুরুষকে জৈবিক মত্ততায় ঠেলে দিয়েছে। কিছু বাঙালি ছিল যারা এইসব সামরিক জান্তাদের প্ররোচিত করতো, তাদের সাথে হাত মিলিয়ে এদেশের নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন করতো।” 

একজন বাঙালি পুরুষের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় কি করা উচিত ছিল? একজন অসহায় বাঙালি নারীকে উদ্ধার করাই তার কাছে যুদ্ধ করা সমান ছিল। সেই বাঙালি পুরুষ নিজের কামের খোঁজ রাখতে গিয়ে আরেক বাঙালি পুরুষের জন্যও সে বাঙালি নারীর সন্ধানে রত ছিল। তার ব্রত ছিল দেশ উদ্ধার করা! যদি সে একজন অসহায় নারীকে উদ্ধারই না করতে পারলো পুরুষ জন্মে সে কি তার দেশ মাতৃকার কোন কাজে আসবে? 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নয়টা মাস শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ হতে হতে প্রিয়ভাষিণী এতটা ক্লান্ত হয়েছিলেন যে, তাঁর স্মৃতিকথার আত্মকথায় এক পর্যায়ে বলেছেন, “এখন থেকে আমি নিয়মিতভাবে প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের শিকার হয়ে চলেছি। রাতের বেলায় ঘুমের ঘোরে বসে থাকি। বিছানায় গেলে ঘুম হয় না।”

এই যে এতোটা ক্লান্তি, এতটা ধকল, এতটা নিজের বোধের ওপর কালি লেপে দিয়ে বেঁচে থেকেও নিজের মাতৃভূমির জন্য স্বাধীনতা কামনা করা—নারী কি তাকেই বলে? যারা একবার তাকে ধর্ষণ করে আরেকবারের জন্য আমন্ত্রণ দিয়ে রাখে। যারা তাঁকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করবার জন্য তাঁর জন্য বাংলো ভাড়া করে দেয়। মাছের কাঁটা গলায় বিঁধলে যা হয় তাই করে রেখেছিল তারা তাঁকে। মাছের কাঁটা যেমন নিজে বের করে ফেলে দেয়া যায় না, তেমনি তিনিও আঁটকেছিলেন কাঁটার মতো দীর্ঘ নয়টি মাস। এ কাঁটা বিঁধলে পরে ভুক্তভোগী বুঝে কতখানি বিষ গিলে ফেলেছে সে অন্তরমনে। কতখানি দাগ রেখেছে সে কাঁটা অবশিষ্ট জীবনের জন্য। তবুও ভোর হোক, মাতৃভূমির আকাশে একটি নতুন সূর্য উঠুক, ক্লেদমাখা জীবনে নতুন সূর্যের কিরণ পড়ুক; ধুয়ে যাক কালিমা, অবশিষ্ট জীবনটুকু বাঁচুক নিজস্ব ভূ-খণ্ডের মাটির মহিমায়। জরায়ু অক্ষত না থাকুক, স্তনের নিচে ক্ষতের দাগ থাকুক, নিঃশ্বাসে লাশের গন্ধ থাকুক, বিশ্বাসে ভালোবাসা থাকুক; আমার দেশ আমার হোক, আমার দেশ স্বাধীন হোক। তাই তিনি কোথাও বলেছেন—

“লোকলজ্জা ভয় যেখানে শেষ হয়, সেখানে অবশিষ্ট কিছু থাকে না।” অবশিষ্ট কিছু না থাকলেও মানুষ বাঁচে, মানুষ ভালোবাসে। তিনিও বাসেন ভালো, মানুষ বাসেন ভালো, দেশ বাসেন ভালো। সবকিছু লুণ্ঠিত হলে পরেও মানুষ থাকে সুন্দর, তারই প্রমাণ প্রিয়ভাষিণী। প্রিয়ভাষিণীর নন্দন কানন এইভাবেই লুণ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে পুরুষের হাতে কি বাঙালি, কি অবাঙালি দুই দলের পুরুষই তাকে ছিঁড়ে বিড়ে খেয়েছে। তাঁর গ্রন্থটির নাম নিন্দিত নন্দন যথার্থ হয়েছে। এমনই নিন্দিত নন্দন থেকে উঠে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের জাতীয় পতাকা, আমাদের নতুন সূর্য। এই নতুন স্বাধীন সূর্যের তলে এখনো বাঙালি নারী একের পর এক ধর্ষিতা হচ্ছে। তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঙালি নারীদের জন্য আরেক নিন্দিত নন্দন নামের দেশ বাংলাদেশ দিয়েছে, নাকি দিয়েছে স্বাধীন দেশ?... 


লাবণ্য কান্তা, প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ

menu
menu