আমাদের আত্মায় জীবনানন্দ দাশ

বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় (১৩৪৫, বৈশাখ সংখ্যা) কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতার ওপর একটি প্রবন্ধের লিখেছিলেন। 

“সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি—কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু, সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়”।

জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী শত বৎসরে কবিতার বিনির্মাণ এবং কাঠামোগত বিন্যাস নিয়ে অনেক আধুনিক কবিরা তাদের বিভিন্নরকম মত দিয়েছেন। কেউ  কেউ কবিতার শব্দের গাঁথুনির ওপর জোর দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ শব্দকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ভাষার মাধুর্যকে শিরধার্য করেছেন, কেউ কবিতার ব্যাকরণগত দিক নিয়ে অনেক বেশি সচেতনতার কথা বলেছেন, কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতার শরীর জুড়ে ‘প্রশান্তির’র কথা বলেছেন। হাল আমলে কবি শহীদ কাদরী বলেছেন, ‘কবিতা একটি ঘরের মতো যেখানে বসবাস করা যায়’। তবে কবিতা নিয়ে যে যাই কথা বলুক কবিতা হলো একটি গানের সুরের মতো। যে সুরটি আমাদের কানে নিত্য বাজে। সে কারণে কবি শহীদ কাদরী একবার কথায় কথায় বলেছিলেন ‘কবিতার জন্যে একটি কান থাকা খুব জরুরি।’ বিষয়টি একজন কবি এবং যিনি কবিতাটি পাঠ করছেন তাদের দু’জনের জন্যেই সমানভাবে প্রযোজ্য। সেই সঙ্গে কবিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি কাজ করে তাহলো তাদের অর্šÍদৃষ্টি। একজন কবি তার কল্পনায় পৃথিবীটাকে যেভাবে দেখতে পারেন এবং সেখানে যে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলতে পারেন তা অন্য সাধারণ মানুষের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। অথবা বলা যায় অন্য সাধারণ মানুষরা হয়তো সেটি উপলব্ধি করতে পারবেন কিন্তু তা কাব্যিক প্রকাশ করাটা কঠিন। সেখানেই একজন সাধারণ মানুষ এবং একজন শিল্পীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য। কথা হলো শিল্পের একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে। সেই ভাষায় নান্দনিকতার ছোঁয়া রয়েছে, সেখানে একাডেমিক ফর্ম খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সবচেয়ে বড় কথা সেখানে যখন মানুষের মনের এবং মননের, রুচির এবং ভাবনার এক অসাধারণ মেল বন্ধন ঘটে তখনই আমরা ভালো একটি সাহিত্যের জন্ম হয়। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়’। আমার কাছে এই লাইনটির গুরুত্ব অপরিসীম। যাদের সূক্ষ্ম চেতানাবোধ আছে, ভাবনার ডালপালা যারা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার করতে পারেন এবং সেই সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গী যাদের সুদূর বিস্তৃত তারাই ভালো কবি হতে পারেন অথবা একজন উঁচু দরের লেখক হতে পারেন। একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি যে সাহিত্য মানুষের জীবন থেকে বাইরের কোন বস্তু নয়। একজন লেখক তার যাপিত জীবনের আয়নায় যে জীবনকে দেখেন তাই তার মস্তিষ্কে বার বার আঘাত করে, রক্তাক্ত করে। লেখক তখন তার বাস্তব দুনিয়ার মশলার সঙ্গে শিল্পের রঙ মিশিয়ে শব্দের জাদু তৈরি করে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। বিচিত্র তাদের ভাবনা আর চিন্তার জগৎ। একমাত্র মানুষই বিচিত্র সব চিন্তার সঙ্গে ডুব সাঁতার খেলতে ভালোবাসে। স্বপ্নের পরিধিটাকে বিস্তার করে অনায়াসে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে পারে। আমাদের চিন্তা এবং চেতনায়, সত্তা ও মননে সেকারণেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা সবসময়ই এক বিশেষ জায়গা দখল করে বসে আছে। সে কারণেই হয়তো জীবনান্দ দাশ বাঙালির খুব প্রিয় একজন কবির নাম। একজন আধুনিক এবং উত্তর আধুনিক কবির নাম। প্রকৃতি, প্রেম, মুগ্ধতা, নির্জনতা, একাকিত্ব, সমাজ এবং সমকাল তাঁর কবিতা অন্যতম অলংকার। আর সে কারণেই জীবনানন্দ দাশ আমাদের বাঙালি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনানন্দ ছাড়া কে আর এভাবে বলতে পারে?

তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে
কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে।
কোকিল কুকুর জ্যেৎস্না ধুলো হয়ে গেছে কত ভেসে?
মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে? (মহাপৃথিবী)

জীবনানন্দ দাশ আমাদের অন্যতম প্রিয় কবি হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এই কবির কবিতা পড়লে আমাদের বাঙালি আত্মার খুব ভেতরে বাস করা এক ‘হাহাকার’কে আবিষ্কার করি। জীবনে কী জানি পাওয়ার কথা ছিল অথচ কি জানি পাইনি। কী পাইনি? কেন সেই হাহাকার? আমাদের জীবনে তখন আশ্রয় নেয় ধূসর কাব্যেমালা। বিকেলের পেঁচাও তখন মুখ গোমরা করে উল্টো দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন জীবনানন্দের কবিতায় হাহাকার এত গুরুত্বপূর্ণ রূপ নিয়ে ধরা দেয়?  তাঁর কবিতায় আমাদের অন্তরাত্মার কোন সে বেদনার ছবিটি ফুটে উঠে?  রোমান্টিকতার হাহাকারকে বুকে ধারণ করে আমরা যে জীবন পারি দিতে চাই জীবনানন্দ আমাদেরকে সেদিকেই নিয়ে যান? ঘায়! আমাদের জীবনে বসন্ত আসে, শীত আসে। তারপর আবার বসন্ত চলে যায়, কোকিল তার ঘরে ফিরে যায়। তখন শুধু জীবনের ধূসর প্রান্তে বসে আমাদের নানা রকম ভাবনায় পেয়ে বসে। সত্যি বলতে এইতো জীবন! জীবন বাস্তবতা! জীবন মানেই কি হঠাৎ এক ঝলক সুদীপ্ত আলোর ছটা আবার যেন তমস ঘেরা এক অজানা গন্তব্য! যে গন্তব্যের খোঁজে আমরা নিত্য হাঁটি। পথটাকে খুঁজে পাওয়ার আকুলতা নিয়ে আমাদের জীবন রচিত হয়। অনেকটা চাঁদের সঙ্গে মেঘের নিত্য ডুব সাঁতার খেলার মতো? এই মানুষ আর তার তৈরি করা সমাজ হেমন্তের ফসলের মতো আমাদের সামনে তখন ফিঁকে হয়ে ধরা দেয়। জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় আমাদের সেই আশার কথাটিই শুনাতে চান।

এদিকে কোকিল ডাকছে—পউষের মধ্য রাতে;
কোনো—একদিন বসন্ত আসবে ব’লে? 
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার? 
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে। (শীতরাত)

তারপরও আমরা নক্ষত্রের দিকে প্রতিনিয়ত চেয়ে থাকি। স্বপ্ন আছে বলেই আমরা সামনের দিকে পথ চলি। কিন্তু জীবন বাস্তবতা ভিন্ন। সেখানে জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন আরেক জগৎ। ফরাসি কবি বোদলেয়ারও জীবনের এই হাহাকারকে তার কবিতায় স্থান দিয়েছেন। যে কারণে তাকে শ্মশান কবি বলে ডাকতে অনেকেই ভালোবাসেন। জীবন মানেই তো আর সুন্দরের প্রলাপ নয়। বরং সেখানে নিত্য জড়িয়ে থাকে জীবনের বাস্তবতা। সেই বাস্তবতায় রয়েছে জীবনের নিবীর বাস্তবতা, এক অন্তিম নিশীথ অন্ধকার। তিনি তার অন্তলোকের সঙ্গে একিভুত হয়ে যেন মগ্ন চৈতন্যে নিত্যই ডুব দিয়ে থাকতে পছন্দ করেন। সে কারণেই জীবননান্দ দাশের কবিতা আবেগে থরথরে কাঁপা কোন কবিতা নয়। কবি তাঁর কবিতায় নিঃসঙ্গতা, আর সেই জীবনের আলো আধারী লুকোচুরি যেন গভীর ভাবে অনুধাবন করেন। 

শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন
জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;
চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়,
সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে
যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর
পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে।   (একটি নক্ষত্র আসে)

আমরা জীবনের দিকেই মুখ ফিরাই। জীবনের কঠিন বাস্তবতার প্রকৃতি প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে সুন্দরকে আলিঙ্গন করি। চোখের সামনে কল্পনায় দেখা এক স্নিগ্ধতাকে বসিয়ে দেই। শুধু কল্পনা কেন? রোমান্টিকতা তখন আমাদের চারপাশে জোনাকি পোকার মতো ঘিরে ধরে। সেই রোমান্টিক প্রকাশ ঘটুক আর নাই ঘটুক আমরা তা আমাদের যাবতীয় ইন্দ্রিয় শক্তি দিয়ে লালন করি। এইতো জীবনের ধর্ম। আর সে কারণেই জীবনানন্দ দাশ  আমাদের এত প্রিয়। জীবননান্দ দাশ যেন আমাদের জীবনের সর্বগ্রাসী, সেচ্ছাচার প্রেমকে নৈসর্গিক বর্ণনার মাধ্যমে তার কবিতায় তুলে রেখেছেন। তার কবিতায় কোন যৌনতা নেই, কোন শরির নেই আবার যেন সবই আছে। কোন এক পরম ভালোবাসার নারীকে প্রবলভাবে দেখার লোভও তখন সামলানো যায় না।

আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে;
বলেছিলো : ‘এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;
সব ক্লান্তি বিহ্বলতা 
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।’ (সে)

জানি এবং কথাটা মানিও। শুধুমাত্র নৈসর্গিক বর্ণনার জন্যেই নয় জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় আধুনিক মানুষের রূপ রসের যে উপাদান রয়েছে তা বাংলার অন্য কবিরা খুব কমই তাদের কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন। এমন উত্তর আধুনিক কবি আর কটা আছে আমাদের দেশে? আমরা তাঁর কবিতা যত বার পড়ি ততবারই অভিভূত হই, নতুন করে জীবনকে আবিষ্কার করার নেশায় পেয়ে বসে। আকাশ লীনা কবিতাটার কথা ভাবুন। সেখানে সুরঞ্জনা যেন কল্পনায় আঁকা নারীকে বাস্তবেও আমরা দেখতে পাই। প্রকৃতির কাছে তিনি যেন বারবার নিজেকে সমর্পণ করেছেন।

জীবনানন্দ দাশের কবিতার আরেকটি বিষয় আমাদের খুব নিবিড়ভাবে কাছে টানে আর তা হল তাঁর কবিতার শরির জুড়ে রয়েছে অসাধারণ সব শব্দ প্রয়োগ। শব্দগুলো আমাদের বাঙালি করোটিতে যেমন খুব পরিচিত আবার একই সঙ্গে তা আমাদের নৈসর্গিক উদাস মনের সাথে যেন খাপ খেয়ে যায়। তিনি নরনারীর প্রেম, অভিমান, প্রকৃতি, সেই একই সাথে দেহাতীত আকর্ষণ করে তার কবিতায় মূর্ত হয়ে ধরা পরে। সম্ভবত এ কারণে আমাদের বোধের জগৎে একমাত্র তিনিই যেন নাড়া দিতে সমর্থ হোন। 

আলো আর অন্ধকারে যাই  মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে; (বোধ)

জীবনানন্দ দাশ আমাদের আত্মার এক বড় অহংকার। তাঁর মতো আধুনিক কবি এই বাংলায় বিরল।

menu
menu