রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপানি শিষ্যা মাদাম কোওরা তোমি স্মরণে

জাপানের নাগানো প্রদেশে অবস্থিত বিখ্যাত স্বাস্থ্যকর জায়গা কারুইজাওয়া। সবুজ-নীল পাহাড়ঘেরা শহরটি অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিগত ১৫০ বছর ধরেই এদেশের গর্ব। মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৮১২) মার্কিনি ও পশ্চিমা সাহেবরা পাশ্চাত্য শৈলীতে একে গড়ে তোলেন। শতবর্ষপ্রাচীন ভবন, সড়ক, স্কুল, কলেজ, গীর্জা, খেলার মাঠ, বাগান এখনো ছবির মতন আকৃষ্ট করছে দেশ-বিদেশি বহু পর্যটককে সারা বছর ধরে। বৈচিত্র্যময় উপহার সামগ্রী বিক্রয়ের বাজারও দেখার মতন এখানে। জাপানি ধনী ব্যক্তিদের অনেক গ্রীষ্মাবাস এখানে গড়ে উঠেছে গত কয়েক দশকে। জাপান সামুদ্রিক দ্বীপবর্তী দেশ হিসেবে পরিচিত কিন্তু এই প্রদেশে কোনো সাগর নেই। তবে রয়েছে গর্ভধারী আগ্নেয়গিরি আসামা মাউন্টেন। মাঝে মাঝে ভূকম্পন হলে পরে জ্বালামুখ থেকে লাল-কমলামিশ্রিত আগুনের ফুলকি সশব্দে বেরিয়ে আসে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান ভ্রমণ করেন তখন এখানে প্রায় ১০ দিন অবস্থান করেছিলেন। এদেশের প্রথম ‘মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে’র প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ড. নারুসে জিনজোও তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কারুইজাওয়া শহরে তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি আবাসিক প্রকল্পে বক্তৃতা দেবার জন্য। অধ্যাপক নারুসে ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং আমেরিকায় উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, প্রাচ্যাদর্শ ছিল তাঁর কাছে গভীর আরাধনার বিষয়। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কবিগুরু তাঁর আহ্বানে সানন্দে সাড়া দিয়েছিলেন।
নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে জাপানে আগমন করেছেন এই সংবাদ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমে। মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনতে জড়ো হয়েছিলেন ছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ। ছাত্রী ওয়াদা তোমিকোও তাদের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু এখানে দুজনের পরিচয় হয়নি। একজন বক্তা, অন্যজন শ্রোতাই থেকেছেন। ওয়াদা তোমিকো তথা কোওরা তোমির ভাষ্য থেকে জানা যায় কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে নাগানো-প্রদেশের কারুইজাওয়া উপশহরে। এই প্রসঙ্গ তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় একাধিকবার লিখেছেন। যেমন, ‘হিছেন অ ইকিরু : কোওরা তোমি জিদেন’ বা যুদ্ধবিহীন বাঁচা : কোওরা তোমি জীবনবৃত্তান্ত গ্রন্থে ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ’ উপঅধ্যায়ে ‘জীবৎকালের শিক্ষক’ শিরোনামযুক্ত স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘টেগোর মহাশয় নারুসে স্যারের আমন্ত্রণে জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়েও বক্তৃতা প্রদান করতে আসেন। মিলনায়তনভর্তি আমরা ছাত্রীদের উদ্দেশে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছেন খুব চমৎকার কণ্ঠে; নিম্নখাদ থেকে উচ্চখাদ পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠ যেন ঘণ্টাধ্বনির মতোই বারংবার মনে হয়েছে। আমাদের ছাত্রীদের হাতে তৈরি খাবার গ্রহণ করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন এখনো স্মরণে আছে।
প্রতিবছর মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন আত্মোন্নয়ন প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হত নাগানো-প্রদেশের কারুইজাওয়া সানছেনরিয়োও ছাত্রীনিবাসে। সেখানেই নারুসে স্যারের আমন্ত্রণে টেগোর মহাশয় আসছেন জানতে পেরে আমি সানন্দে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। এই সময় আমি ঋষিকবি টোগোরের সঙ্গে সকাল ও সন্ধেবেলা একসঙ্গে অবস্থান করে গভীরভাবে প্রভাবিত হই। সি এফ অ্যান্ড্রুজ এবং পিয়ারসনের সঙ্গে তিনি সানছেনরিয়োওর অন্য একটি গৃহে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে পশ্চিমদিকে অবস্থিত আসামা পর্বতের বিশালাকৃতি পটভূমির মধ্যবর্তী উঁচুস্থানে অশত্থসদৃশ মেদবহুল বৃক্ষের শাখাছড়ানো বিশাল আকৃতি অবলোকন করা যেত। যাতে এই দৃশ্য আরও সুস্পষ্টভাবে অবলোকন করা যায় তার জন্য উঁচুস্থানে কাঠ দিয়ে একটি মঞ্চবেদি নির্মাণ করা হয়েছিল, তাতে বসে সকাল ও সন্ধেবেলা তিনি ধ্যানে মগ্ন হতেন। আমরা টেগোর মহাশয়ের ব্যক্তিগত পরিচর্যায় নিযুক্ত ছিলাম বলে প্রতিদিন দেখা তাঁর ধ্যানমগ্ন মূর্তি সত্যিই মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। সূর্যাস্ত আসামা পর্বতের ধুম্রজালকে লাল রঙে রাঙিয়ে কবির দীর্ঘ চুল আর পদ্মাসনকে গোলাপি রঙে রাঙালে পরে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যেতেন—আমরা সেই মহিমময় প্রতিমূর্তি নিঃশ্বাস ভুলে গিয়ে দেখতাম।
তিনি এই আসামার পার্বত্য প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন। পাহাড়ের উঁচু-উঁচু চূড়ায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মধ্যে ধ্যানমগ্ন হয়েছেন এবং সেই ধ্যানের ভেতর থেকে অসংখ্য সুন্দর কবিতার জন্ম দিয়েছেন। তাঁর কোলের ওপর রাখা খাতায় কলম দিয়ে ‘উদভ্রান্ত পাখি’, ‘জোনাকি’ প্রভৃতি কবিতা একটার পর একটা লিখেছেন। প্রতিদিন সকালবেলা কুয়াশায় ঝিলমিলানো বুনোফুল দিয়ে সজ্জিত আমাদের ছাত্রীনিবাসের টেবিলে এসে প্রাতঃরাশ গ্রহণকালে তিনি সদ্যজন্মলব্ধ মণিমুক্তোসম বাংলা ভাষার কবিতাগুলো নিশ্চিতভাবে আমরা ছাত্রীদেরকে সহজ ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনাতেন।’
সেই যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিষ্কাম প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়লেন মাত্র ১৮ বছরের তরুণী ওয়াদা তোমিকো, বিবাহোত্তর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.কোওরা তোমি এবং ৯৭ বছর বয়সে তিরধান পর্যন্ত ক্রমাগত গভীর-গাঢ়ই হয়েছে সেই অনুরাগ, ভালোবাসা ও ভক্তি। মাদাম কোওরা হয়ে উঠলেন গুরুদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত। এরকম নারী ভক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুণমুগ্ধ বিদেশি নারী ভক্তদের মধ্যে আর কেউ ছিলেন বলে বাস্তবিকই জানা নেই। কানাগাওয়া-প্রদেশে নিজের বাড়ির নাম পর্যন্ত রেখেছিলেন ‘শান্তিনিকেতন’। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৮ সালে শান্তিনিকেতনস্থ রবীন্দ্রভবনের কিউরেটর ক্ষীতিশ রায় কর্তৃক ড. কোওরা তোমিকে লিখিত একটি অ্যারোগ্রাম থেকে।
ওয়াদা তোমিকো মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি ১৯১৭ সালে আমেরিকায় যান উচ্চশিক্ষার্থে। ১৯১৮ সালে ২২ বছর বয়সে বিখ্যাত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯২০ সালে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নাড কলেজ থেকে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর মেরিল্যান্ড প্রদেশের বাল্টিমোর শহরে অবস্থিত প্রসিদ্ধ জন্স হোপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগে ক্ষুধা বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। তখন তিনি ২৪। এই সালেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পুনরায় সাক্ষাৎ হয় আমেরিকার নিউইয়র্কে—এই প্রসঙ্গে ড. কোওরা তোমির স্নেহধন্য সহকর্মী জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোওরার সাক্ষাৎ ঘটেছিল মোট ছ’বার। ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন আমেরিকায় যান, কোওরা তখন সেখানকার পিএইচডি-র ছাত্রী। রবীন্দ্রনাথ এসেছেন খবর পেয়েই তিনি ছুটে যান তাঁর কাছে। গুরুদেব অতিব্যস্ততার মধ্যেও কোওরাকে অনেক সময় দেন। তাঁদের মধ্যে যে আলোচনা হয়, তাতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি কোওরার ভক্তি-শ্রদ্ধা আরও অনেক বেড়ে যায়। এটা ছিল দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার।’ অধ্যাপক আজুমা আরও জানাচ্ছেন যে, শান্তিনিকেতনে পৌঁছে মাদাম কোওরা সকলের সামনে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন একজন বিদেশিনী হয়েও। এতই বোঝা যায় কতখানি ভক্তি করতেন তিনি রবীন্দ্রনাথকে।
১৯২২ সালে কোওরা তোমি জন্স হোপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘Experimental Study of Hunger in its Relation to Activities’ বিষয়ে ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং স্বদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে কিউশুউ ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা অনুষদের মনোচকিৎসা গবেষণাকেন্দ্রে গবেষণা সহযোগী হিসেবে যোগ দেন। এই বছরের গ্রীষ্মকালে আমেরিকার বিখ্যাত মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, সমাজ সংস্কারক, সমাজকর্মী, সমাজতত্ত্ববিদ, জনপ্রশাসক, গ্রন্থকার এবং নারীনেত্রী নোবেলবিজয়ী জেইন আডামস জাপানে এলে পরে তাঁর দোভাষী হন। এবং তাঁরই প্রভাব গ্রহণ করে পরবর্তীকালে সমাজসেবা ও নারী অধিকার আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। লিখতে শুরু করেন নারীমুক্তি বিষয়ে, নারীমুক্তি আন্দোলনেও সক্রিয় হতে শুরু করেন। একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ও রচনাবলি পাঠ করে শান্তি ও সাম্যবাদী চিন্তার দিকে ঝুঁকে পড়েন। অবশ্য ১৯১৬ সালেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শোনার পর তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন।
১৯৬১ সালে ইংরেজিতে লিখিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড জাপান’ নামক প্রবন্ধে তাঁর স্বীকারোক্তি প্রণিধানযোগ্য, তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) চিন্তার দ্বারা অভূতপূর্ব প্রভাবিত আমি নিজের জীবনকে সর্বজনীন শান্তির জন্য উৎসর্গ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১৯২০ সালে নিউইয়র্কে অবস্থানকালে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশ জার্মানি থেকে অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক সংবাদ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, আমি উপশহরের এক হোটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের কারুইজাওয়ার স্মৃতি নিয়ে আরেকবার কথাবার্তা বলি।
(সে কথা) রবীন্দ্রনাথও অবশ্য পরবর্তীকালে বলেছেন। ১৯২৪ সালে তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবেন নির্ধারিত ছিল। প্রত্যাশা অনুযায়ী জাপান তাঁকে আহবান করবে কি করবে না সেটা বিবেচনা না করেই আমি আসাহিশিম্বুন (সংবাদপত্র) এর প্রধান সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করত, দুঃসাহসের সঙ্গে তারবার্তা মাধ্যমে তাঁকে জাপানে আমন্ত্রণ জানাই।’ সেই বছরই ওসাকা মহানগরে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার প্রথম দোভাষী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মঞ্চে ড. ওয়াদা তোমিকো ওরফে কোওরা তোমি। এরপর আরও একাধিক সভার দোভাষী হিসেবে গুরুদেবের পাশেই ছিলেন। এই বছর তিনি টেগোর সমিতি-জাপানের সভানেত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন।
এতেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর আত্মিক টান কতখানি প্রবল ও গভীর ছিল। দোভাষী এবং ভ্রমণ পরিকল্পনাকারী হিসেবে কবির সেবাযত্ন সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন। এমনই এক সময় তিনি গুরুদেবকে জাপানে আমন্ত্রণ জানান যখন তিনি আমেরিকার শিক্ষাজীবন শেষ করে ফিরেছেন মাত্র। কবির প্রত্যাশা মেটানোর মতো আত্মবিশ্বাসে তিনি তখন টইটম্বুর। তখন তিনি মাত্র ২৮। কবিগুরুর সঙ্গী ছিলেন অধ্যাপক ড. কালিদাস নাগ, অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন, চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং মার্কিন নাগরিক লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট। এছাড়া আরও দুজন চীনা ইতিহাসবিদ। মে মাসের ৫ তারিখ চিনের রাজধানী পিকিং-এ জন্মদিন উদযাপন এবং ৪টি বক্তৃতা দিয়ে ২০ তারিখ যাত্রা করে ৩১ শে মে তারিখে জাপানের নাগাসাকি বন্দরে পৌঁছান। কবির দলকে বন্দরে অভ্যর্থনা জানান ওয়াদা তোমিকোসহ অন্যান্য ঘনিষ্ঠ ভক্তবৃন্দ। নাগাসাকির উনজেন নামক পাহাড়ি পর্যটন কেন্দ্রের এক হোটেলে অবস্থান করেন অতিথিদের নিয়ে। এখানে পরবর্তীকালে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। এই তৃতীয়বার ভ্রমণের সময় ফুকুওকা, শিমোসেকি, কোবে, ওসাকা, নারা, কিয়োতো নগরসমূহ ভ্রমণ শেষে টোকিওতে আসেন ৭ জুন তারিখে। টোকিও রেল স্টেশনে কবিগুরুকে এক মহাঅভ্যর্থনা প্রদান করা হয়। প্রত্যেক জায়গায় বক্তৃতা প্রদান, জাপানের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে মুগ্ধতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির অনুকরণ ও অনুসরণেরও তীব্র সমালোচনা করেন কবিগুরু। ফলে জাপানি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে বেশ উষ্মা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এই ভ্রমণের সময় তিনি জাপানে আশ্রিত মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে মিলিত হন। জুন মাসের ১১ তারিখ কোবে সমুদ্র বন্দর থেকে ভারতের দিকে ফিরতিযাত্রা করেন। তাঁকে বিদায় জানান ওয়াদা তোমিকোসহ ভক্তবৃন্দ। এই ১২টি দিন ওয়াদা তোমিকে কবির দল নিয়ে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও তিনি উক্ত প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ও ভারতের মধ্যে মৈত্রী এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনকে কতখানি শক্তিশালী করেছেন; তাঁর জাপান ভ্রমণ এবং বক্তৃতাদ্বারা জাপানিরা কতখানি প্রভাবিত হয়েছেন, আবার তিনি হৃদয় খুলে জাপানিদের চিন্তা, অনুভব, কারিগরি এবং রীতিনীতি কতখানি গ্রহণ করেছেন—আমি এইসব বিষয় স্পর্শ করে যেতে চাই।’
গুরুদেব চলে যাওয়ার পর একটা অব্যক্ত শূন্যতা যে তিনি অনুভব করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। স্মৃতিকাতরতা থেকেই জুলাই মাসের ১১ এবং ১৮ তারিখে পরপর দুটি নিবন্ধ লেখেন কবিগুরুর সঙ্গে কারুইজাওয়াতে কাটানো সময়ের স্মৃতি নিয়ে জনপ্রিয় ‘কাতেইশুউহোও’ ম্যাগাজিনে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের বৃহদাকার উপন্যাস গোরার জাপানি অনুবাদ নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ মতামত লেখেন একই ম্যাগাজিনে মার্চ মাসের ২২ তারিখে। তাতে অনুবাদক একদা শান্তিনিকেতনে জুদোও ক্রীড়া প্রশিক্ষক ক্রীড়াবিদ সানো জিননোসুকের প্রশংসা করেন।
কারুইজাওয়ার শিক্ষাপ্রাঙ্গনের বটজাতীয় বিশাল বৃক্ষরাজির তলে সকাল-বিকাল যেমন বক্তৃতা দিয়েছেন আবার তেমনি ধ্যানও করেছেন। জায়গাটি তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেছিলেন। প্রগাঢ় প্রশান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি তাঁকে পশমি আঁচল দিয়ে যেভাবে জড়িয়ে নিয়েছিল তা তিনি ভুলতে পারেননি একেবারেই। ১৯৩৫ সালে গুরুদেবের টানে মাদাম কোওরা তোমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তখন তাদের মধ্যে প্রথম আলাপের স্মৃতিমুগ্ধ স্থান কারুইজাওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছিল। মৃত্যুর পূর্বে কবিগুরু আরেকবার কারুইজাওয়াতে আসার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন তিনি তাঁর নিকটবর্তী লোকজনের কাছে। সেইকথা জানতে পারেন মাদাম কোওরা তোমি যখন আবার শান্তিনিকেতনে পা রাখেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে। ওই বছর তিনি সদ্য স্বাধীন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জাপানের প্রতিনিধিত্ব করতে যান। ততদিনে তার পরমপ্রিয় গুরুদেব পরলোকবাসী হয়েছেন। গভীর বিষণ্নতার সঙ্গে শ্রদ্ধা ভরে তিনি গুরুদেবকে স্মরণ করেছিলেন।
১৯৬১ সালেও ভারতে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে তিনি অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী জাপানে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়েছিল ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বিপুল পরিকল্পনা ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও আয়োজনের জন্যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয় ১৯৫৭ সালে। এই কর্মযজ্ঞে অতিউৎসাহী অংশগ্রহণকারী ও অন্যতম সংগঠক ছিলেন মাদাম ড. কোওরা তোমি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি তিনি কখনোই বিস্মৃত হতে পারেননি। কারুইজাওয়াতে কবিগুরু প্রতিদিন নিভৃতে বসে কবিতা, গান লিখে ছাত্রীদেরকে শুনিয়েছেন। ছাত্রীরা ঋষি-কবিকে দেবতাজ্ঞানে সেবাযত্ন করেছে। মেয়েদের সুবিনীত ব্যবহার আর সুচারু সৌন্দর্যের মায়ায় বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন, ফলে বিদায়ের দিন তারা যেমন অশ্রুসিক্ত হয়েছেন, তেমনি কবিগুরুও। মাদাম কোওরা তোমির লিখিত জীবনবৃত্তান্তে এইসব স্মৃতিময় ঘটনার কথা জানা যায়।
এই কারুইজাওয়াতে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর প্রথম দৃষ্টিবিনিময় তারপর ঘনিষ্ঠতা এবং আমৃত্যু আরাধনা। গুরুদেবের ১২০তম জন্মবর্ষ স্মরণে বার্ধক্যে এসে আসামা মাউন্টেনের সবুজ পাদদেশে রবীন্দ্রনাথের একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জের স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করেন ১৯৮১ সালে, তখন তাঁর বয়স ৮৫। ভাস্কর্যটির নাম ‘জিনরুই ফুছেন’ বা ‘যুদ্ধহীন মানবজাতি’। এরকম ঘটনা বিশ্বের আর কোনো দেশে রবীন্দ্রনাথের কোনো নারীভক্ত ঘটিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। এই ভাস্কর্য স্থাপন প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা মিলে চাঁদা তুলে সেই চাঁদার অর্থে আমি ভারত-জাপান টেগোর সংস্থার সভানেত্রী হিসেবে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করেছি। এই ভাস্কর্যের বুকে “জিনরুই ফুছেন” বর্ণমালা খোদিত আছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনভর অহিংস পৃথিবীর জন্য আবেদন করে গেছেন।
এখন আমাদের উচিত তাঁর কথাকে আঁকড়ে ধরা। মানুষ হত্যা করে অর্থলাভ করা, ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টায় অগণিত লোককে রোধ করা সহজ নয়। অর্থলিপ্সা, ক্ষমতার লোভ মনুষ্যত্বের অভ্যন্তরে গভীর শেকড় ছড়ানো এক অশুভশক্তি। এই শক্তি কে বা কারা সেটা বলার চেয়ে সমস্ত মানবজাতি মিলে এই অশুভশক্তিকে রোধ না করলে নয়। অহিংসার লড়াই রাজনীতির ক্ষেত্রে, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে—যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন জীবন বাজি ধরেই লড়াই করতে হয়। এই লড়াই সমস্ত মানবজাতির লড়াই।’
জীবনভর মাদাম কোওরা তোমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রচুর রচনা, স্মৃতিকথা লিখে রেখে গেছেন, রবীন্দ্রকবিতা ও প্রবন্ধের অনুবাদ করেছেন। এমনটি কবিগুরুর বাঙালি কোনো নারীভক্তও করেননি। মাদাম কোওরা রচিত অতিক্ষুদ্র একটি গ্রন্থ শিসেই তাগো-রু তো কারুইজাওয়া তথা ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ এবং কারুইজাওয়া, তাতে কবিগুরুর প্রতি তাঁর প্রথম দেখার মধুরতম অভিজ্ঞতা বিধৃত হয়েছে। রবীন্দ্র অনুবাদের মধ্যে, শিন ৎসুকি.গিতানজোরি বা নতুন চাঁদ.গীতাঞ্জলি (১৯৬২), শি তো জিনসে তাগো-রু বা কবিতা ও জীবন : রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৭) ও ইউকান তেৎসুগাকু বা ফিলোসফি অব লেইজার (১৯২৯) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ১৯১৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেন্দ্র করে লিখিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার এবং স্মৃতিকথার সংখ্যা অনেক। বহুবার তাঁর বক্তৃতাসমূহেও রবীন্দ্রনাথের নাম ও বাণী উচ্চারিত হয়েছে গভীরতম শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে। ১৯৯৩ সালের ১৭ জানুয়ারি তারিখে ৯৬ বছর বয়সে এই মহীয়সী জাপানি রবীন্দ্রনারীভক্তের জীবনাবসান ঘটে। পরের বছর ১৯৯৪ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ‘জাপান ভবন’ তথা ‘নিপ্পন ভবনে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসন গ্রহণ করার কথা ছিল। গুরুদেবের এই স্বপ্ন পূরণের পেছনে মাদাম কোওরার অপরিসীম আগ্রহ এবং পরিশ্রম অনস্বীকার্য।
১৯২৭ সালে ওয়াদা তোমিকো ৩১ বছর বয়সে তাঁর মাতৃশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নিযুক্ত হন। নারীমুক্তি আন্দোলন, শিশুশিক্ষাসহ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে পত্রত্রিকায় প্রচুর প্রবন্ধ, নিবন্ধ, মতামত লিখতে থাকেন। দু’বছর পর ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে ওয়াদা তোমিকো বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক কোওরা তাকেহিসার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কোওরা তোমি নামে পরিচিত হন। ঠিক সেই বছরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত একটি তারবার্তা পান। যদিও তাঁদের মধ্যে চিঠিপত্র লেখালেখি ছিল বলে জানা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাদাম কোওরা তোমির গুরুশিষ্যা সম্পর্কের মধ্যে গুরুদেব রচিত দুটি ইংরেজি ছত্র কী অসামান্য কাব্যিকরূপে ধরা পড়েছে তা ব্যাখ্যা করা দুঃসাধ্য।
১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ তারিখে জাপানে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে লিখে উপহার দিয়েছিলেন যে চিরঞ্জীব দুটি ছত্র তা নিম্নরূপ:
It is not a bower made white with the bunches of Jasmine
It is waves swiging with the turbulent foam.
এ যে শুভ্র রঙে রঞ্জিত জুঁইফুলের কোনো নিকুঞ্জ নয়
এ যে দুরন্ত সফেন দোদুল্যমান তরঙ্গ।
তথ্যসূত্র :
১.ইনদো নো শিজিন, কোকুগি শিরোও, ২০০৬
২. রবীন্দ্ররচনাবলী, ঊনবিংশ খণ্ড
৩. টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন বুলেটিন সাচিয়া ২য় সংখ্যা
৪. রবীন্দ্রনাথের টুকরো লেখা কাজুও আজুমা
৫. জাপান ও রবীন্দ্রনাথ : শতবর্ষের বিনিময়, কাজুও আজুমা
৬. গেইজুৎসু নো পাতোরোন / ইয়াশিরো য়ুকিও
৭. হিছেন অ ইকিরু, কোওরা তোমি জিদেন
৮. জাপান ও রবীন্দ্রনাথ : শতবর্ষের বিনিময় , কাজুও আজুমা
৯. কোওরা তোমি নো সেই তো চোওসাকু, দাই নানা কান, ২০০২
প্রবীর বিকাশ সরকার শিশুসাহিত্যিক ও গবেষক। জাপান, জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গবেষণা তাঁর প্রিয় বিষয়। তার ২৯টির ওপর গ্রন্থ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ:উদোর পিণ্ড বুধোর ঘাড়ে, অবাক কাণ্ড, জানা অজানা জাপান (তিনখণ্ড), রবীন্দ্রনাথ ও জাপান : শতবর্ষের সম্পর্ক, সূর্যোদয়ের দেশে সত্যজিৎ রায়। অধুনালুপ্ত মাসিক মানচিত্র ও মাসিক কিশোরচিত্র-এর সম্পাদক। তিনি জাপানে বসবাস করেন।