মানুষের আধিপত্য

আমার মাথায় প্রায়ই একটা চিন্তা ঘুরেফিরে আসে, এই পৃথিবীতে মানুষ ও তার আধিপত্য, এ ঠিক কতখানি অবশ্যম্ভাবী ছিল?
আমরা জানি, ডাইনোসররা ১৬.৫ কোটি বছর পৃথিবীর এই বায়োস্ফিয়ারে রাজত্ব করেছে। এই দীর্ঘ সময় কি আরও দীর্ঘ হতে পারত না? ডাইনোসররা এই ধরাধাম দাপিয়ে বেড়িয়েছে, যে ১৬.৫ কোটি বছর তার তুলনায় তারা যতদিন আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই সময়টা অর্ধেকেরও কম, মাত্র ৬.৬ কোটি বছর!
ডাইনোসরদের ১৬.৫ কোটি বছরের রাজত্বের শেষ হওয়াটা বেশ মর্মান্তিক! একটি গ্রহাণুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়া, ব্যাস ডাইনোসরদের ১৬.৫ কোটি বছরের ডায়নাস্টি শেষ! অনেকেই বলবেন কেন ডাইনোসররা তো আজও আছে পাখি হয়ে! হ্যাঁ পাখিরা আছে, যারা সরাসরি ডাইনোসরদেরই বংশধর! কিন্তু এই পাখিরা যদিও খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তারা ডাইনোসরদের মতো আজ আর অ্যানিম্যাল কিংডমের প্রধানতম নয়!
যাই হোক, মানুষের জয়যাত্রার গল্পটা দীর্ঘ। একটু আগেই বললাম, শুরুটা হয়েছিল, একটা বড়সড় গ্রহাণুর আছড়ে পড়া দিয়ে, যার ফলে ডাইনোসররা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যায়! আমাদের পূর্ব-প্রাণীগুলো শুধুই স্তন্যপায়ী ক্ষুদ্র ইঁদুর জাতীয় ছিল না, এগুলো ছিল ছোট ছোট বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী যারা বুঝতে পেরেছিল কীভাবে ওই পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া যায় এবং মৃত জীবদেহ ইত্যাদি খেয়েও বেঁচেবর্তে থাকা যায়। বেসিক্যালি তারা ছিল সর্বভুক, যা পাওয়া যেত তাই খেত, ডাইনোসরদের মতো মোটেই বিশেষ ধরনের খাদক অর্থাৎ শুধু শাকাহারী বা মাংসাহারী ছিল না।
এরপর, এর অনেক অনেক কাল পরে, আজ থেকে ৫-৬ মিলিয়ন বছর আগে, বানর জাতীয় একটি প্রাণী প্রথম, দু’পায়ে চলে ফিরে বেড়াতে শিখল। এ ছিল বিরাট এক উল্লম্ফন! হাত দুটি মুক্ত হবার ফলে, এই অবমানবরা ক্রমশ আরও উদ্ভাবনশীল হয়ে উঠল, একসময় শিখল হাতিয়ার তৈরি করতে ও তার সাহায্যে শিকার করতে। মুক্ত হাত শুধু হাতিয়ার বা জিনিস তৈরি করতে সাহায্য করেনি, এটি মস্তিষ্কের বিকাশেও বিরাট সাহায্য করেছিল।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড, এরও অনেক দিন পর, আরও প্রায় ৪ মিলিয়ন বছর পর, মৌখিক ভাষা এলো, তখন মস্তিষ্কের কাজ আরও বেড়ে গেল। ফলে বাড়তে থাকল মস্তিষ্কের আয়তন। আবার মস্তিষ্কের আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কগনিটিভ স্কিল বাড়ল আরও অনেক।
এই যে মানুষের ছোট ছোট দলে সঙ্ঘবদ্ধ জীবন, এরকম হয়তো আরও কিছু কিছু প্রাণীর রয়েছে, আজও রয়েছে, কিন্তু আধুনিক মানুষের পূর্বতন জনগোষ্ঠী ভাষার সুবাদের শুধু নিজেদের দল বা উপজাতির সঙ্গেই শুধু নয়, অপর উপজাতিগুলোর সঙ্গেও কিছু পরিমাণ হলেও যোগাযোগ বা ভাববিনিময় করতে পারল। ফলে বিভিন্ন ইনফরমেশন বা তথ্য-উপাত্ত ‘মানুষ’ নামক প্রজাতিটি খুব ভালোভাবে ব্যবহার করতে শিখল এবং তা কোনো এক জায়গায় থেমে থাকল না, প্রজাতিটির সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ল। এই জ্ঞানবৈচিত্র খুব সহজেই সন্তান-সন্তানাদি বা পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারল মানুষ। ফলে জ্ঞানের বিকাশ তো ঘটলোই আর নতুন নতুন সংযোজনের সঙ্গে সঙ্গে এর একটা কন্টিনিউটি থাকল এবং অবশেষে লিখিত ভাষার উদ্ভব হলো। এসবই প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে মানুষকে অনেক যোজন এগিয়ে দিচ্ছিল।
অনেকেই হয়তো ভাবেন, মানুষের বুদ্ধি থাকলে কী হবে, মানুষ তো অন্যান্য অনেক প্রাণীর থেকে শারীরিকভাবে দুর্বল। এটাও সর্বাংশে ঠিক নয়। প্রথমত প্রাথমিক মানুষ আধুনিক মানুষের থেকে অনেকগুণ শক্তিশালী ছিল। দ্বিতীয়ত মানুষই একমাত্র প্রাণী যে বর্শা, পাথর ইত্যাদি ছুড়তে পারে। অর্থাৎ হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে। মানুষ অন্য যেকোনো প্রাণীর থেকে বেশিক্ষণ একই গতিতে ছুটতে পারে। এমনকি খুব বেশি দূরত্ব ২৫/২৬ কিমি, রেসে মানুষ ঘোড়া বা চিতাকেও হারিয়ে দেবে। ঘোড়া খুব বেশিদূর একটানা একই গতিতে ছুটতে পারে না। ২০ কিমির বেশি একটা ঘোড়া সাধারণত দৌড়াতে পারে না। চিতা আরও কম দূরত্ব! অন্যদিকে মানুষ কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে লং ডিস্ট্যান্স রানার! তাছাড়া খুব যদি ডিফিকাল্ট রাস্তা হয়, খুব আনস্পেক্টেড টার্ন হয়, খুব বেশি দূরত্ব, যেরকম বললাম ২৫/২৬ কিমি, মানুষ প্রায় যেকোনো প্রাণীকে হারিয়ে দেবে! এভাবেই হাতিয়ার ব্যবহার, নিজেদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, পরিকল্পনামাফিক, শত্রুকে আক্রমণ, শিকার, সুবিধাজনক বাসস্থান খুঁজে ব্যাবহার করা, এসবই মানুষকে অনেক এগিয়ে দিয়েছিল।
মানুষের অগ্রগতির জন্য প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় ধর্মীয় এবং অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের ভূমিকাকে, এটা কিন্তু সর্বার্থে ঠিক নয়! মানুষের এই উল্কার গতিতে উন্নতিতে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরাট ভূমিকা ছিল। ধর্ম-বিশ্বাসের উদ্ভব, প্রাথমিক মানুষেরা যা বুঝতে পারেনি তা ব্যাখ্যা করার প্রয়াসে। কিন্তু এই ধর্মবিশ্বাস আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাথমিক নৈতিক নীতি এবং নৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। বস্তুত এই শৃঙ্খলাই গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ধর্মবিশ্বাস প্রবর্তিত নীতিগুলো মানুষকে একে অপরকে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং মানুষ হয়ে উঠেছিল সহমর্মী। ফলে নিজেদের ভেতর সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় কমে এসেছিল। সমাজগুলো স্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং শান্তিপূর্ণ সময়ে জ্ঞানের আরও অগ্রগতি হয়, উদ্ভাবনশীল হয়ে ওঠে।
আমি কল্পনা করি হান্টার-গ্যাদারার্স মানুষ, বিশেষত পূর্ণবয়স্করা সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে শিকার করে ফিরে এসেছেন, আগুন জ্বালিয়ে মায়েরা ঝলসে নিচ্ছেন শিকার আর বয়স্করা তারা-ভরা উজ্জ্বল আকাশের নিচে ছোটদের গল্প শোনাচ্ছেন! গল্প-কাহিনির আগমনও মানুষের জীবনে অগ্রগতিতে বিরাট সাহায্য করেছিল। কেননা, গল্প বানাবার ক্ষমতা, এমনকি গল্প বলার (বর্ণনাশক্তি) ক্ষমতা মানুষের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটিয়েছিল। অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসগুলো, আগেই বলেছি, মানুষেরা যা বুঝতে পারেনি তা ব্যাখ্যা করার প্রয়াস! এই প্রয়াস মানুষের কল্পনাশক্তি তথা বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়েছিল।
ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন না হলে কী হতো তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়! আমাদের সেই ছোট স্তন্যপায়ী পূর্বপুরুষরা কি আর বিবর্তিত হয়ে ‘মানুষ’ হতো? আমাদের অনেক অনেক আগের প্রপিতামহ-মহী সেই চারপেয়ে কাঠবেড়ালি জাতীয় প্রাণীটি হয়তো কোনো ডাইনোসরের বিকেলবেলার স্ন্যাক্স হয়ে যেত! সেই অর্থে আমরা ভাগ্যবান যে একটি গ্রহাণু ডাইনোসরগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে!
আরেকটা বিষয় আমাকে আশ্চর্য করে তোলে যে অন্য কোনো গ্রহেও কী একটি গ্রহাণুকে আছড়ে পড়ে সেই গ্রহটির ডমিন্যান্ট প্রাণীকুল, ডাইনোসর জাতীয় কোনো প্রাণীকে কী নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে দুপেয়ে কোনো মহাকাশ-অনুসন্ধিৎসু বুদ্ধিমান প্রাণী আবির্ভাবের জন্য? এই লেখাটির একটি কেন্দ্রীয় ভাবনাই এই। নিয়মিত একটা চিন্তা আমার মাথায় আসে, আর তা হলো, এই মহাবিশ্বের অন্য কোথাও যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী থেকেও থাকে, তবে তা ঠিক কতটা ‘মানবিক’? অথবা পৃথিবীর মানুষের তুলনায় ঠিক কতখানি আলাদা সেটা? একটা উদাহরণ দিই, তাহলে এই বিষয়টা নিয়ে আমি কতটা অবসেসড হয়তো বোঝাতে পারব। ধরা যাক আমি একটা ফুটবল খেলা দেখছি, আমার হঠাৎই মনে হয়, অন্য কোনো গ্রহে যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তবে কী তারাও এরকম কোনো খেলা খেলবে, হতে পারে গোলপোস্ট হবে রাগবির মতো, বা তিন কোনা, অথবা মাঠের চারদিকে অনেকগুলো করে বারপোস্ট থাকবে, কিন্তু খেলার নিয়ম অনেকটা এরকম! মানে পা-দিয়ে খেলতে হবে এবং বিপক্ষের গোলে বল ঢোকাতে হবে! অথবা ধরা যাক একটা বারে বসে আমি বিয়ার খাচ্ছি। আমি ভাবি সেই উন্নত সভ্যতায়ও কী এরকম পাব থাকবে? হয়তো অন্য এক প্রকারের পানীয় সার্ভ হবে, হয়তো অ্যালকোহলিক বেভারেজে ওই প্রাণীটির নেশাই হবে না, তাই একদম অন্য পানীয়! আচ্ছা সেখানেও বিয়ার সাধারণত যেরকম স্টুলে বসে পান করা হয়, সেরকমই বার স্টুল থাকবে? এরকম আর কী! আমি ভাবতেই থাকি, ভাবতেই থাকি... শুধু একটা দুটো বিষয় নিয়ে নয়, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি বিষয় নিয়ে। যৌনতা (আমাদের যেমন 'মেইনস্ট্রিম' দু’টি যৌনতা, পুং লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ, ওদের?) থেকে শুরু করে পলিটিক্স (কমবেশি ক্যাপিটালিজম, মার্ক্সিজম) পর্যন্ত! ভাবি, ঠিক কতটা আলাদা হবে সেই সভ্যতা, সেই ‘উন্নত জীবন’!
আবার পরক্ষণেই মনে হয়, হতে পারে, চিক্সুলুব (Chicxulub) গ্রহাণুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার কারণেই, আমরাই, এই মহাবিশ্বে আমরাই হয়তো একমাত্র মহাকাশ অন্বেষণকারী প্রজাতি। পৃথিবীতে আমরা অবশ্যই একমাত্র বুদ্ধিমান প্রজাতি নই। অক্টোপাসগুলোও বেশ স্মার্ট, তবে তারা কেবল এক বছর বাঁচে এবং সঙ্গমের পরে মারা যায়। এসবের কারণে সুদূর ভবিষ্যতেও তারা যে রকেট, জাহাজ, কলকারখানা তৈরি করবে সে সম্ভাবনা নেই।
বিবিসি নিউজের একটি আর্টিকেল অনুসারে, প্রজাতি হিসেবে আমাদের এই যে আধিপত্য তাতে এনার্জির ব্যবহার একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। আগুন ব্যবহার করতে শেখা, মানুষ হয়ে ওঠার জন্য ছিল এক সুবিশাল ধাপ। বলা হয় এমনকি এই আগুনের ব্যবহার আমাদের শরীর বা বায়োলজিকেই বদলে দিয়েছিল! আগুনে পোড়ানো বা ঝলসানো খাবার, কাচা মাংস ইত্যাদির থেকে সহজপাচ্য হওয়ায় মানুষের লিভারের অনেক কম শক্তি ব্যয় করতে হয় খাবার হজম করবার জন্য আর সেটাই অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের মস্তিষ্কের আয়তন। এর অনেককাল পর এলো জীবাশ্ম জ্বালানি, যা শিল্প বিপ্লবকে চালিত করেছিল। শুধু জেট ফুয়েল যা আমাদেরকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরো মহাদেশ অতিক্রম করতে সক্ষম করেছে, বা আমরা যে বোমা তৈরি করেছি যা একটা দেশকেও অনায়াসে উড়িয়ে দিতে পারে শুধু সেই শক্তিই নয়। প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ শক্তি, নিত্য নৈমিত্তিক কাজে আমরা সকলেই ব্যবহার করি। এইভাবে এনার্জির ব্যবহারই মানুষের আধিপত্যের চাবিকাঠি।
সুতরাং অসংখ্য ফ্যাক্টর, মানুষকে আজকের মানুষ করেছে। কেউ এটা ভাবতে পছন্দ করুন বা না করুন, মানুষই এই গ্রহের ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করবে এবং মানুষ আজকের পৃথিবীতে, ডাইনোসরদের সময়ে ডাইনোসরদের চেয়েও অনেক অনেক গুণ প্রভাবশালী প্রজাতি।
কিন্তু কেন ডাইনোসরদের সাড়ে ষোলো কোটি বছরেও বিবর্তিত হয়ে একটা ‘বুদ্ধিমান’ প্রজাতি তৈরি হলো না, যারা সারা পৃথিবীকে মানুষের মতো করে অধিগ্রহণ করতে পারে, এর উত্তরও সম্ভবত লুকিয়ে আছে ডাইনোসরদের মস্তিষ্কের আয়তনের মধ্যে!
২
ধরা যাক ট্রুডনের (Troodon) কথা। সঙ্গের ছবিটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সম্ভবত এরা মূলত দু'পায়ে চলাফেরা করত এবং 'হাত' দুটি একটু-আধটু ব্যবহারও করতে পারত! এই ছোট্ট প্রাণীটির শরীরের অনুপাতে মস্তিষ্ক ছিল আধুনিক পাখি এবং ছোটখাটো স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো। এরা সম্ভবত দ্রুত চলতে পারত, বেশ বুদ্ধি করে শিকার ধরতে পারত।
একটি সরীসৃপের জন্য খারাপ কী! কিন্তু ট্রুডন একটি ব্যতিক্রম ছিল, নিয়ম নয়। বেশিরভাগ ডাইনোসরের দেহের আকারের তুলনায় তুলনামূলকভাবে মস্তিষ্ক ছিল ছোট। আর এর প্রধানতম কারণ, তাদের বেঁচে থাকার জন্য বড় মস্তিষ্কের প্রয়োজন ছিল না। বিবর্তন ডাইনোসরগুলোকে পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে মানিয়ে টিকে থাকবার জন্য বর্ম, শিং, স্পাইক, নখর, দাঁত, গতি, আকার ইত্যাদি অনেক কিছু দিয়েছিল। এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের খাদ্য খুঁজে পেতে, শিকার হয়ে যাওয়া এড়াতে এবং সফলভাবে প্রজনন করে প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। বড় মস্তিষ্ক ‘পোষা’ শরীরবৃত্তীয় দিক থেকে খুব সহজ নয়। বড় মস্তিষ্কের জন্য প্রচুর শক্তি, অর্থাৎ নিত্যদিন পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। বড় মস্তিষ্কের জন্য আর একটা মূল্য চোকাতে হয়, আর তা হলো দীর্ঘকালীন পরিপক্বতা কিন্তু অতি ধীর বৃদ্ধি বা ম্যাচিওরিটি।
সুতরাং, বিরাট এভোলিউশনারি প্রেশার না থাকলে, প্রাকৃতিক সমাধানসূত্র বা অভিযোজন সাধারণত বিরাট মস্তিষ্কের পক্ষে কখনো ঝোঁকে না, প্রাকৃতিক অসুবিধেগুলো মানিয়ে নেবার অন্য কোনো সমাধানসূত্র খোঁজে।
এই সব কারণেই ডাইনোসররা আমাদের মতো সুপার স্মার্ট হয়ে ওঠেনি। তারা অবশ্যই তাদের মতো করেই বহুদিন টিকে থাকতে সফল হয়েছিল, এবং তারা এমন কোন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হয়নি যে বৃহৎ পরিসরে তাদের বুদ্ধিমান বা উদ্ভাবনশীল হবার প্রয়োজন ছিল।
বেঁচে থাকার ও টিকে থাকার জন্য সম্ভাব্য অভিযোজনের যে বিশাল বৈচির্ত্র্য, তার মধ্যে বিশাল মস্তিষ্ক বা সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তা শুধুমাত্র একটি বিবর্তনীয় অভিযোজন। আর কে না জানে এই সুপার স্মার্টনেসই মানুষের ১০ হাজার বছরের ‘আধুনিক’ সভ্যতাকে প্রায় ধ্বংসের মুখে নিয়ে এসেছে। কলকারখানা, শিল্পবিপ্লব, ফসিল-এনার্জি থেকে শুরু করে করে যেকোনো প্রযুক্তির কথাই ভাবা যাক না কেন, এসব ছাড়াই ডাইনোসররা কিন্তু সাড়ে ষোলো কোটি বছর বাল-বাচ্চা নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থেকেছে, চিক্সুলুব গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আছড়ে না পড়লে, হয়তো আজও থাকত!
অনেকেই অবশ্য বলবেন, টিকে থাকাই তো জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়! একথা অবশ্যই ঠিক, টিকে থাকাই অবশ্যই একমাত্র উদ্দেশ্য নয় জীবনের, তবে এটাই যে একমাত্র উদ্দেশ্য বিবর্তনের, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকবার কথা নয় কারও। আর সেইদিক থেকে মানুষের বিরাট বুদ্ধিমত্তা ও তার সৃজনশীলতা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে! মানুষ তার বুদ্ধির কারণেই ধ্বংসের খুব কাছে চলে এসেছে!
মণিশংকর বিশ্বাস কবি, প্রাবন্ধিক ও প্রযুক্তবিদ। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করেন।