সাহিত্যের অনুষঙ্গ

সাহিত্য জীবন ও যাপন, চিন্তা ও সাধনা, দ্বন্দ্ব ও দহন, আনন্দ ও স্বপ্নগুলোকে বহুমাত্রিকভাবে উপস্থাপন করে। যেহেতু একজন সাহিত্যিক মাত্রই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ, তাঁর হৃদয় প্রবলভাবে সংবেদী, তাই জীবনের নানা রূপ ও রং তিনি উপলব্ধি করেন সর্বাগ্রে। জীবনকে দেখার তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণের মতো নয়, বরং আলাদা। তাই রাষ্ট্রে-সমাজে সাহিত্যিক মাত্রই একজন বিশেষ মানুষ। কিন্তু এই বিশেষ মানুষটি যখন সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হন তখন লেখার উপকরণ কোথায় পান তিনি? অথবা লেখালেখির অনুষঙ্গ হিসেবে তিনি কী কী ব্যবহার করেন? অর্থাৎ সাহিত্যের অনুষঙ্গের প্রশ্ন যখন সামনে ছুঁড়ে দেয়া হয়-তখন এর উত্তরের জন্যে আমাদের কিছুক্ষণ ভাবতে হয়। যদিও এই ভাবনাটা একক ও সম্পূর্ণ নয়। এই সত্য ও সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই সাহিত্যের অনুষঙ্গ বিষয়ে কিছু কথা উপস্থাপন করা যাক। 

দুই
সাহিত্যের অনুষঙ্গকে ভাববাদ ও বস্তুবাদের দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনা, দহন, পীড়ন, চিন্তন, মোহ, কামনা, প্রেম-বিরহ ইত্যাদি বিষয় আমাদের সাহিত্যের দীর্ঘদিনের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নারী, নদী, বৃষ্টি, জ্যোৎস্না, বৃক্ষ, ফুল, পাখি, মাছ, মাটি, মা ইত্যাদি একইভাবে ব্যবহৃত। অর্থ, বিত্ত, কীর্তি, সম্পত্তির অবস্থানও সাহিত্যের অনুষঙ্গ হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি অনুষঙ্গ হিসেবে প্রেমের কথা বলি, তাহলে বিশ্বসাহিত্যের অধিকাংশ রচনাই এর অন্তর্ভুক্ত হবে। অধিকাংশ লেখকের লেখাতে যদি প্রেমই থাকে, তাহলে তারা স্বাতন্ত্র্য কীভাবে? এর উত্তর এভাবে দেয়া যায় যে—যদিও অনেকে অনুষঙ্গ হিসেবে প্রেমকে বেছে নিয়েছেন—তবু চিন্তা ও উপস্থাপনগত দিক দিয়ে তারা স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। এ প্রেক্ষিতে দু-তিনটি উদাহরণ দেয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রেম ‘ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী, চেয়ো না তাহারে’ ধরনের, আবার রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে।’ 

যদি উপন্যাসের দিকে দৃষ্টি রাখি তখন স্পষ্টতই দেখবো ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের টুনি-মন্তুর প্রেম এক রকম; আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির কুবের-কপিলার প্রেম ভিন্নতর। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালির বিনোদিনীকে এদের সাথে মেলানো যায় না। বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলার সাথে অন্য কোনো প্রেমিকার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একই সাথে বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখবো ‘ইলিয়ড’-এর নায়িকা হেলেনের প্রেম পরিণতি এবং তলস্তয়ের আনার চূড়ান্ত পরিণতি পরস্পর বিপরীতমুখী। এই যে নর-নারীর প্রেম, যার মূল এক কিন্তু বিস্তার ভিন্ন ভিন্ন। একারণেই লেখকের অনুষঙ্গ এক হলেও উপস্থাপন, গল্পের প্লট ও দর্শনের ভিন্নতায় প্রত্যেকটি রচনা পরস্পর থেকে উজ্জ্বল দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে।

সাহিত্য অনুষঙ্গ হিসেবে নারীর উপস্থিতি বহুল ও বিপুল। এই উপস্থিতি একই সাথে বৈচিত্র্যময়। কেবলমাত্র তারাশঙ্কয়ের ‘কবি’ উপন্যাসের ‘বাসন্তী’ ও ‘ঠাকুরজি’র দিকে নিবিড় দৃষ্টি দিলেই এই বৈচিত্র্য উপলব্ধি করা যায়। ঠাকুরজি যেই অর্থে সামাজিক মানুষ, বাসন্তী সেই অর্থে নয়। লালসালুর মজিদের দুই-স্ত্রী আমেনা ও জমিলা পরস্পর বিপরীতমুখী মানুষ। আমেনা ও জমিলার মধ্যে সেই তফাৎ লক্ষ্যণীয়, যে পার্থক্য একজন দ্রোহী এবং একজন নীরবতা পালনকারীর মধ্যে বিদ্যমান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সচেতনভাবেই ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জমিলার কণ্ঠস্বরকে সুউচ্চ করেছেন। নারীকে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ বিবেচনা করলেও এমন দু-একজন কবিকে অন্তত খুঁজে পাওয়া যাবে যারা তা মনে করেন নি। সেটা সুচিন্তিতভাবে হোক অথবা অবচেতনে।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের উদাহরণ এখানে উপস্থাপনযোগ্য। তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ হিসেবে শ্রমজীবী ও শোষিত মানুষ আলোকিত। শ্রেণি বৈষম্য ও শোষণ থেকে মুক্তি পেতে কবি শব্দমালা তৈরি করেছেন ঠিকই কিন্তু অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে তিনি যেনো নারীর কথা ভুলেই গেছেন। তাঁর কবিতায় নারীর উপস্থিতি অনুজ্জ্বল। অন্যদিক বিবেচনায় এটি কবির সীমাবদ্ধতাকেও চি‎হ্নিত করে।

তিন
যদি সাহিত্যকে নাগরিক ও গ্রামীণ উপকরণে দু’ভাগ করা যায় তবে আমরা স্পষ্টতই দু’দল লেখককে দেখতে পাবো। প্রথমত, গ্রামীণ অনুষঙ্গের ব্যবহারে জসীম উদ্দীনের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে। তাঁর মতো করে পল্লী জীবনকে আর কেউ কবিতার ফ্রেমে বাঁধতে পারেন নি। গভীরতার দিক দিয়ে এর পরপরই প্রকৃতি নিমগ্ন জীবনানন্দ দাশ চলে আসেন। এখানে লক্ষ্যণীয় পল্লী নিবিষ্টতা থাকলেও ভাব ও দর্শনে জীবনানন্দ জসীম উদ্দীনের স্বগোত্রীয় নন। দু’জন দু’মেরুর মানুষ। মিথ ও পুরাণের অনুষঙ্গ জীবনানন্দ দাশকে জসীম উদ্দীন থেকে আরো পৃথক দূরত্বে নিয়ে গেছে। আবার জীবনানন্দ দাশ যতোটা মৃত্যু চিন্তাপ্রবণ ছিলেন, বিষণ্নতাকে সঙ্গী করেছিলেন-জসীম উদ্দীন তেমন নন।

পল্লীকে যারা কবিতায় প্রধান অনুষঙ্গ করে নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বন্দে আলী মিয়া ও যতীন্দ্রমোহন বাগ্চীও পড়েন। অথচ এ দু’জনের মধ্যে মিল যতোটুকু আছে অমিলটুকু তারচেয়ে অনেক বেশি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্রোহকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন-নজরুলের বিদ্রোহ তেমন নয়। আবার ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ দৃষ্টিকোণে লালনের সাথে নজরুল ইসলামের চিন্তার মিল রয়েছে। কিন্তু দর্শনের কারণে লালন নিজেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছেন। অথচ যদি অসাম্প্রদায়িকতাকে ছাতা হিসেবে বিবেচনা করি তবে দেখা যাবে লালন-নজরুল একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। অনুষঙ্গ মানবতা তবু উপস্থাপন শৈলীর কারণে লালন-নজরুল নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। উপন্যাসের কথা ধরলে ‘পথের পাঁচালী’ অবধারিতভাবে পল্লীর রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে নিজে হাজির হয়। একই সূত্রে আসে হাজার বছর ধরে, পদ্মা নদীর মাঝি, লালসালু, সূর্য দীঘল বাড়ি, পুতুল নাচের ইতিকথা ইত্যাদি উপন্যাসও।

‘পথের পাঁচালী’তে প্রকৃতি যেভাবে চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়েছে রচনার অন্যতম অনুষঙ্গ, অন্য উপন্যাসগুলোতে সেভাবে দাঁড়ায় নি। চরিত্রভেদে, প্লট ও প্রেক্ষাপটভেদে প্রকৃতি অনুষঙ্গ হিসেবে কখনো উজ্জ¦ল হয়েছে, সাহিত্যে কখনো হ্রাস পেয়েছে প্রকৃতির প্রভাব।
সাহিত্যের অনুষঙ্গ বিবেচনায় স্থান ও কাল খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্থান ও কালের পরিবর্তনে অনুষঙ্গের পরিবর্তন ঘটে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য দীর্ঘসময় ধরে দেব-দেবী নির্ভর ছিলো। মানুষকে মর্ত্যরে মানুষ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা সেখানে উল্লেখযোগ্য নয়। অথচ আমাদের প্রাচীন সাহিত্যকর্মে সাধারণ মানুষের স্থান ছিলো ভালোভাবেই। সেখানে সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধনতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছিলো সাধারণ মানুষের মধ্য দিয়ে।

ডোম্বী, চাড়াল, মাঝি, শবর, জেলে প্রভৃতি পেশার মানুষজন চর্যাপদে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে মধ্যযুগে এসে বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম অনুষঙ্গ হয়ে পড়ে কেবলমাত্র দেব-দেবী বন্দনা। মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি সাহিত্য কর্মগুলো এই কথাটিকেই উচ্চকিত করে। অনুষঙ্গ হিসেবে মধ্যযুগে যেখানে স্বর্গীয় বিষয় উপস্থিত ছিলো যেখানে আধুনিক কালে এসে সেই অনুষঙ্গের আমূল পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি। স্বর্গের মানুষকে মর্ত্যে নিয়ে আসেন আধুনিক সাহিত্যিকরা। সাথে সাথে পরিবর্তন হয় সাহিত্য অনুষঙ্গেরও। মধ্যযুগের দেবতা বন্দনা ও তাদের প্রচার বিলুপ্ত করে আধুনিক সাহিত্যে প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয় মানুষের সুখ-দুঃখ ও জীবন-যাপনের কথা।

পূর্বেই বলেছি, প্রাচীনকালে ধর্মীয় সাধনতত্ত্ব সাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গ ছিলো। এ অনুষঙ্গ যেমন গুরুমুখী তেমনি সাধারণ মানুষ পরিবেষ্টিত। অবশ্য এখানে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে মানুষ অনুষঙ্গ হিসেবে বড় হয়ে উঠতে পারে নি। মধ্যযুগে এসে দেবতা নিভর্রতা বেড়েছে মঙ্গল কাব্যে। প্রণয়োপাখ্যানে উপেক্ষিত হয়েছে সাধারণ জীবনযাপন। কেবল প্রেম ও ভাবালুতাই ছিলো সাহিত্য অনুষঙ্গ। এটা অবশ্যই মধ্যযুগের অনুষঙ্গের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করে। আধুনিক যুগে সাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে মানুষের ক্রিয়াকলাপ, প্রেম ও দ্বন্দ্ব, সুখ ও দ্বন্দ্বের কথা দীপ্যমান হয়েছে। অনুষঙ্গ বিবেচনা আধুনিক কাল বহুবিধ বিষয়কে নিয়ে হাজির হয়েছে সাহিত্য  স্রষ্টার দরজায়। অন্যদিকে সময়ের পরিবর্তনে আধুনিক কাল বর্জন করেছে বিগত দিনের নানা অনুষঙ্গ ও উপকরণ। অনুষঙ্গ বা বিষয় হিসেবে সাহিত্যে দেব-দেবীর উপস্থাপন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ মধ্যযুগীয় সাহিত্যে যে অনুষঙ্গটি বহুল ব্যবহৃত ছিলো—সেটি আধুনিক কালে এসে বর্জিত হয়েছে। আবার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রাচীন কালের সাধন তত্ত্বেরও বিস্মৃতি ঘটেছে। বিলুপ্ত ও বর্জনের বিষয়ে আরেকটি কথা না বললেই নয়।

সাহিত্য নানা অনুষঙ্গকে সময়ের প্রয়োজনেই কখনো বর্জিত করেছে, আবার কোনো কোনো অনুষঙ্গ প্রকৃতি-পরিবেশ ও যাপন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে বলে সাহিত্যেও সেগুলো আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। কারণ, সাহিত্য সমকালের মধ্যে দিয়ে মহাকালের দিকে ধাবিত হয়। সমকাল স্পর্শ ব্যতীত মহাকালের দিকে কতটুকু যাওয়া যায় এ নিয়ে প্রশ্ন রাখা যেতে পারে। 

কিন্তু সমকালীন বোধ নিয়ে কোনো গল্পকার বা ঔপন্যাসিক গরুর গাড়িতে চড়ে নববধূ নিয়ে বর বাড়িতে যাচ্ছে—এমন দৃশ্যপট উপস্থাপন করতে পারবেন না। করলে সেটা সমকালীন উপযোগিতা ও কালের ঐক্যকে অস্বীকার করা হবে। কারণ, গরুর গাড়িতে করে বরযাত্রী যাবে বা আসবে—এমন দৃশ্যাবলি বাঙালির জীবন থেকেই বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে অনুষঙ্গ হিসেবে গরুর গাড়িতে বর কনে ‘বেমানান’ এবং বর্জিতই হবে। সমকালের বোধে নীল চাষ, জমিদার, ইংরেজ লর্ড, পাইক পেয়াদা, হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়া প্রভৃতির অনুষঙ্গেরও উপস্থাপন সঙ্গত নয়। এ থেকে স্পষ্ট যে, সমকালীন বোধে যাপন থেকে বিলুপ্ত কোনো অনুষঙ্গ উপস্থাপন করা অসম্ভব বটে। তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এমন চিন্তা অবশ্যই প্রাধান্যের দাবি রাখে।

চার
সময়ের আবর্তনে সাহিত্যের অনেক অনুষঙ্গ যেমন তার উপযোগিতা হারিয়েছে তেমন সাহিত্যে যোগও হয়েছে বিপুল অনুষঙ্গ। এসব অনুষঙ্গ সাহিত্যের উপস্থাপনকে বদলে দিয়েছে। যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ বাড়লে সাহিত্যের অনুষঙ্গও বাড়বে—এমনটাই স্বাভাবিক। এ কারণে ফেসবুক, টুইটার, নাগরিক প্রেম, মোবাইল, ভার্চুয়াল, গেম, এসি, রকেট, সেলফি, মেসেজ, কল, ইন্টারনেট প্রভৃতি প্রযুক্তিজাত অসংখ্য শব্দ সাহিত্যের অনুষঙ্গের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাব ও বক্তব্য অক্ষুণ্ন থাকলেও অনুষঙ্গ ঠিকই বদলে গেছে। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যে ‘চিঠি’ দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গের স্থান দখল করে ছিলো।

এককালে চিঠিই ছিলো যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। বিশেষত, প্রেমিক প্রেমিকাকে অথবা প্রেমিকা প্রেমিককে চিঠি লেখার ঘটনার কথা বাংলা সাহিত্যে অজস্র আছে। আমরা রবীন্দ্রনাথে দেখি চোখের বালির বিনোদিনী চিঠির জন্যে অপেক্ষা করছে। শরৎচন্দ্রের গৃহদাহের অচলা চিঠির প্রতীক্ষা করছে। কবিগুরুর ‘নষ্টনীড়’-এর কিছু অংশ এ প্রসঙ্গে পাঠ করা যাক, যেখানে চারু অমলের চিঠি না পাওয়ার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে এভাবে : ‘...মাল্টা হইতে চিঠি পাওয়া গেল, তাহাতেও পুনশ্চ-নিবেদনে বউঠানের প্রণাম আসিল। চারু অমলের একখানা চিঠিও পাইল না। ভূপতির চিঠিগুলি চাহিয়া লইয়া উলটিয়া পালটিয়া বারবার করিয়া পড়িয়া দেখিল, প্রণাম জ্ঞাপন ছাড়া আর কোথাও তাহার সম্বন্ধে আভাসমাত্রও নাই। চারু এই কয়দিন যে একটি শান্ত বিষাদের চন্দ্রাতপচ্ছায়ার আশ্রয় লইয়াছিল অমলের এই উপেক্ষায় তাহা ছিন্ন হইয়া গেল। অন্তরের মধ্যে তাহার হৃৎপিণ্ডটা লইয়া আবার যেন ছেঁড়াছেঁড়ি আরম্ভ হইল।’ কিন্তু সমকালীন বাংলা উপন্যাসে চিঠি পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে কি এতো ব্যাকুলতা লক্ষ্যণীয় হবে? কালিক উপযোগিতা বিবেচনায় সেটা হবে না।

কেননা, যুগবদলের মিছিলে চিঠির দায়-দায়িত্ব বর্তেছে মোবাইল, ফেসবুক, ভাইবারসহ প্রভৃতি প্রযুক্তিজাত মাধ্যমের উপর। এজন্যেই বর্তমানে চিঠির পরিবর্তে গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায় মোবাইল, ফেসবুক জাতীয় অনুষঙ্গের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। আমাদের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের একটি গ্রন্থের কথা এখানে উল্লেখ্য। গ্রন্থটির নাম ‘ভালোবাসা ডট কম’। ‘ডট কম’ শব্দটি নিঃসন্দেহে সমকালীন বাস্তবতার ফসল। ‘ভালোবাসা ডট কম’ রচনাটিরও কিঞ্চিত পাঠ নেয়া যাক—‘লামিয়ার রিকশা খানিকটা এগিয়ে যেতেই রাজু ফোনের দিকে তাকায়। এরমধ্যে সানজি তিনটা মিসড কল দিয়ে ফেলেছে। বাপরে, কী ঘটনা! সে মোবাইলের বোতামে চাপ দেয়, রিং হচ্ছে, হ্যালো...’। এখানে উদ্ধৃত ‘মোবাইল’, ‘মিসড’, ‘কল’, ‘ফোন’, ‘রিং’ ইত্যাদি সাহিত্যের নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনুষঙ্গ হিসেবে এসব প্রযুক্তিজাত শব্দের উপযোগিতা একদিকে যখন বাড়ছে, তখন অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবেই কমছে ডাকটিকেট, হলুদ খাম, চিঠি, পিয়ন, ডাকঘর-এর উপযোগিতা।

ভৌগোলিক অবস্থানের পার্থক্যে সাহিত্যের অনুষঙ্গে ভিন্নতা লক্ষ্যণীয় হবে—এটাই স্বাভাবিক বিষয়। কারণ, লেখক মাত্রই তিনি তাঁর পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত, তাঁর রাষ্ট্রের প্রচলিত মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও আইন দ্বারা আক্রান্ত। এসব বিষয়-আশয় তাই যুক্তিসঙ্গতভাবে লেখকের লিখনীর অনুষঙ্গ হয়ে উঠে। এজন্যেই দেশে দেশে সাহিত্যের অনুষঙ্গ ব্যবহারে ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। এ ভিন্নতা হলো জীবনযাত্রা ও পরিবেশের ভিন্নতা। জাপানের সাহিত্যে ‘ম্যাপল পাতা’ অনুষঙ্গ হিসেবে যতোটা তাৎপর্যবাহী, কাঁঠালপাতা  সেরকম হবে না। উল্টো করে দেখলে বাংলা সাহিত্যে কাঁঠালপাতার তাৎপর্য ‘ম্যাপল পাতা’ বহন করতে সক্ষম হবে না।

পাঁচ
অনুষঙ্গ নির্বাচনে ও ব্যবহারে লেখকে লেখকে প্রভেদস্পষ্টত লক্ষ্যণীয়। সব লেখকেরই পছন্দের কিছু অনুষঙ্গ থাকে। সেই অনুষঙ্গগুলো চেতনে বা অবেচতনে লেখকের লেখায় বারবার উঠে আসে। যেমন জসীম উদ্দীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবন অনুষঙ্গ হিসেবে যেভাবে স্পর্শ করেছে সেভাবে নাগরিক জীবন ছোঁয়নি। যদিও ব্যক্তি জসীম উদ্দীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ এবং এম.এ পাস করেন। অন্যদিকে কর্মজীবনে তিনি ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। অর্থাৎ নাগরিক জীবন তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। সে হিসেবে নাগরিকতা তাঁর সাহিত্য যেভাবে ধারণ করে থাকার কথা সেভাবে ধারণ করে নি। কারণ সচেতনভাবে তিনি পল্লীর পথে ঢুকে গিয়েছিলেন। আর সেজন্যে রাখাল ছেলে বেশধারী জসীম উদ্দীন পরম নিমগ্নতায় উচ্চারণ করতে পারেন—

‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে।
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া ভাই,
শরষে ফুলের পাপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।’
(রাখাল ছেলে)

মূলত রাখাল ছেলে কবিতার রাখাল ও কবি জসীম উদ্দীন মুগ্ধতায় অভিন্ন। কারণ, প্রকৃতি মুগ্ধতা দু’জনকে একসূত্রে গেঁথে দেয়। মিঠেল রোদ, শিশির-ঝরা ঘাস রাখালকে যেমন খেলতে ডেকেছে, তেমনি বাস্তব জীবনে কবিকেও দু’হাতে ডেকেছে প্রকৃতি। তাই সবুজ গাঁ, কলাপাতা, শিশির, রাখাল, মটরসুটি, সর্ষে ফুল, ক্ষেতের আল, লোক গান, কোমল লতা, ফুল, ঋতু উন্মাদনা, গ্রাম্যবধূ, কৃষাণ, জেলে, ফসল, চিকন ধান, বাঁশি, পাট বন, শাপলা, তাবিজ, সিঁদুর, বন-বাঁদাড়, নৌকা, সাঁঝের বেলা-ইত্যাদি অনুষঙ্গ তাঁর রচনায় বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।  অন্যদিকে শামসুর রাহমান তাঁর ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছেন। নাগরিক সুখ-কাঁতরতা, যাপন ও বিবর্ণতা তাঁর কবিতায় স্পষ্ট।

কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে নাগরিক উপকরণকেই তিনি বেছে নিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের নিসর্গ প্রেম প্রবল। তাঁর বহুল ব্যবহৃত অনুষঙ্গের মধ্যে শঙ্খচিল, ঘুঙুর, ভোরের দোয়েল, চাঁদ, লক্ষ্মীপেঁচা, নক্ষত্র, শিশির, পাণ্ডুলিপি, কার্তিক, নবান্ন, হলুদ পাতা, মাছরাঙা, ঝাউগাছ, বেতফল, পোকামাকড়, ধানসিঁড়ি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কবির মগ্নতা, দুঃখবোধ প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ সহযোগে প্রকাশিত হলেও তাঁর কবিতায় মিথের ব্যবহার কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিভিন্ন মিথকে অনুষঙ্গ রূপে তাঁর কবিতায় তিনি উপস্থাপন করেছেন সার্থকভাবে। জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি-নিসর্গ-মিথ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিলো। কিন্তু সমকালীন চেতনা তাঁকে তেমন স্পর্শ করতে পারে নি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাই একবার বলেছিলেন—জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে মনেই হয় না যে এই ভূ-খণ্ডটি পরাধীন ছিলো।

শামসুর রাহমান এক্ষেত্রে সফল ছিলেন। সময়ের সামগ্রিক অভিঘাত তার কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে। সমকালীন ঘটনা প্রবাহকে অনুষঙ্গ করে শামসুর রাহমানের মতো এতো কবিতা দ্বিতীয় কেউ সৃষ্টি করেন নি। আল-মাহমুদ নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের সংমিশ্রণে তাঁর কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নগর ও গ্রামের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে তিনি সফলভাবে তাঁর কবিতায় ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি উদাহরণ দেয়া যাক— 

‘বত্রিশ সায়েদাবাদ ঢাকা-এই বিষণ্ন দালানে 
তেমন জানালা কই যাতে বাঁকা নদী দেখা যায়
ধবল পালের বুক যেনো মা’র বক্ষের উপমা...’
(ফেরার পিপাসা)

এই যে, শহরে বসে গ্রামের তাকানো-এটিই আল মাহমুদের বিশিষ্টতা। কিন্তু তিনি পল্লী জীবনের রূপকার নন। তাঁর কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ ঐতিহ্যের মিথস্ক্রিয়া, সংস্কৃতির সম্মিলন। তিনি অনুষঙ্গ ব্যবহারে শহর ও গ্রামের উপকরণের মধ্যে সংযোগ সেতু গড়ে তুলেছেন।

ছয়
বাংলা উপন্যাসেও অনুষঙ্গ প্রয়োগে উপস্থাপন ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। এই ভিন্নতা অবশ্যই তাদের মৌলিকতার প্রকাশ। আগেই উল্লেখ করেছি বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গকে এতোটা গভীরভাবে কাজে লাগিয়েছেন যে—প্রকৃতি সেখানে একটি চরিত্র হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখ তাঁকে টেনেছে। আবার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে টেনেছে ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোড়ামী, ভণ্ডামীর মতো বিষয় আশয়। লালসালুর মজিদ, চাঁদের অমাবস্যার বড় বাড়ির কাদের, বহ্নিপীরের বহিপীর—তাঁর এমন চিন্তারই নিদর্শন। শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে প্রেমকে উপজীব্য করেছেন বহু মাত্রায়। 

একালের হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের জীবনকে বেছে নিয়েছেন অনুষঙ্গ হিসেবে। জীবনের দৃঢ়তম রহস্য, বিভৎসতা তাঁর লেখায় অনুপস্থিত। তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়কে দেখি সেই দৃঢ়তম রহস্য, নিচু তলার মানুষের যাপনকে স্থান দিয়েছেন তাঁদের রচনায়। মানিকের পদ্মা নদীর মাঝির উপন্যাসের জেলেপল্লী, পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসের গ্রাম—এই অনুষঙ্গের নিদর্শন। অন্যদিকে প্রেমেন্দ্র মিত্র যেভাবে জীবনের বিক্ষিপ্ত ও নিকৃষ্ট রূপ গল্পে তুলে ধরেছেন—তা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের চেয়েও গভীর ও গূঢ়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি—অনুষঙ্গ নির্বাচনে লেখকে লেখকে প্রভেদ স্পষ্ট। আবার অনুষঙ্গ নির্বাচন এক হলেও উপস্থাপনের ভিন্নতা তাদের মধ্যে দেয়াল তৈরি করে দেয়। এজন্যে মুক্তিযুদ্ধ অনুষঙ্গ হলেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ।

সবশেষে এতটুকু বলা যায়, বিভিন্ন অনুষঙ্গ সহযোগে সাহিত্যিক তাঁর ভাবটুকু লেখায় উপস্থাপন করেন। সময়ের অভিঘাতে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পট—পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের অনুষঙ্গেরও বহুমাত্রিক পরিবর্তন ঘটে। কেননা, লেখক তাঁর সময়কে ধারণ করেন এবং চিন্তা-চেতনা ও উপলব্ধিতে তিনি সময়ের চেয়েও এগিয়ে থাকেন। সময়ে সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ, অভিঘাত, দ্বন্দ্ব ও মুখরতা যতই বৃদ্ধি পাবে—সাহিত্যের অনুষঙ্গ ততই সমৃদ্ধ হবে। এমন প্রবাহমান ধারা-ই হাজার বছর ধরে বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যে বহমান।

menu
menu