বাঙালি বিশ্ববিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম

আমাদের এ-জনপদে যে কয়জন বিজ্ঞানীর নাম নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যে দেদীপ্যমান, যাদের নাম উচ্চারণ করে সারা বিজ্ঞান বিশ্ব গর্ব অনুভব করে তাঁদের শীর্ষস্থানীয় একজন প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের মানচিত্রে তিনি দেশকে, আমাদেরকে, আপন মহাকাশগামী প্রতিভায় ধ্রুবরেখায় স্থাপন করে গেছেন। 

তাঁর মৃত্যুতে প্রেরিত শোকবার্তায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লিখেছেন :

'There are so few people anywhere who could match Jamal in human kindness as well as intellectual brilliance.'

জামাল নজরুল ইসলামের মানবিক ঔদার্য ও ঐশ্বর্য, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ঔজ্জ্বল্য ও প্রাখর্যের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি মেলে তার জীবনচর্যায় এবং বিশ্ববিশ্রুত সব মনীষীর তাঁর সম্পর্কিত লেখনিতে।

তাঁর বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সরকারি কর্মকর্তা—বিচার বিভাগীয় মুন্সেফ।  এক সময় তিনি অবিভক্ত বাংলার (ভারপ্রাপ্ত) আইন সচিবও ছিলেন। তাঁর নানা শামসুল ওলামা কামালউদ্দিন ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম মুসলিম অধ্যক্ষ। দেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন তাঁর ফুফাতো ভাই। বিখ্যাত রবীন্দ্রসাধক দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুব ছিলেন তাঁর মামা। তাঁর বোন সুলতানা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি এদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্যে পরিকল্পিত কাজের অগ্রদূত। ভগ্নিপতি লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার।

চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণ হাট ইউনিয়নের মহানগর গ্রামে। 

তাঁর পিতামহ ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের জেলা সাবজজ। তাঁর দাদাও ছিলেন মুন্সেফ। হাসমতুল্লা মুন্সেফ। কাপাসগোলা এলাকায় এখনো হাসমতুল্লা লেইন তাঁর সে-স্মৃতি বহন করছে। ফটিকছড়িতেও হাসমতুল্লা মুন্সেফের বাড়িটি এলাকায় বড় বাড়ি হিসেবে পরিচিত।

জামাল নজরুল ইসলাম ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।

বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ হিসেবে জগতজোড়া খ্যাতির অধিকারী ছিলেন তিনি। মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে ছিল তাঁর মৌলিক গবেষণা। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে : দি আলটিমেইট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স, ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি, রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি, অ্যান ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিকেল কসমোলজি, মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ, স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ, দ্য ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স।

সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল উল্লেখ করার মতো। বন্ধুদের আড্ডায় তিনি প্রায়শ পিয়ানোতে দুটি গানের সুর তুলতেন। বাজিয়ে শোনাতেন। 
'আমার পরাণ যাহা চায়' এবং 'আমার সোনার  বাংলা' আমাদের পরম প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত তাঁর অত্যন্ত প্রিয় দুটি সঙ্গীত।

ছাত্রাবস্থায় তিনি সেতার বাজাতে শিখেছিলেন। ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের একটা রাগসঙ্গীত তিনি কারও কাছ থেকে যেন শিখেছিলেন। এবং পরে তা পিয়ানোতে বাজানো শিখেছিলেন। তাঁর ইচ্ছেগুলোর মধ্যে একটি ছিল : একদিন আমজাদ আলী খানকে তিনি পিয়ানোতে বাজিয়ে শোনাবেন তাঁরই সেই পুরনো রাগিণী।

২০০১ সালে একুশে পদক পান জামাল নজরুল ইসলাম। জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন এক সৃষ্টিশীল সৃজনমনস্ক মানুষ। শিশুর মতো সরল ছিল তাঁর মন।
শিশুদের খুব ভালবাসতেন বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। মৃত্যুর ৮ মাস আগে ২০১২ সালের ৪ঠা জুলাই গবেষণা কেন্দ্রের এক কর্মচারীর ছোট্ট মেয়েকে নিজ হাতে লিখে দিয়েছেন  একটি ছড়া।

ছড়াটির শেষে লিখে দিয়েছেন 'আর মনে নেই' কথাটি। এমনি ছিলো তার সারল্য আর ছেলেমানুষি। তিনি লিখলেন :প

টুনটুনি ছিল এক দেখতে খাসা
দুষ্টু বেড়াল তার ভাঙলো বাসা
বাসা ছিল বাগানে বেগুন গাছে
টুনটুনি চললো রাজার কাছে।
বললো রাজা তুমি খাচ্ছো খাজা
দুষ্টু বেড়ালকে কে দেবে সাজা?
শুনে রাজা বললো 'বিল্লী লে আও'
লোকলস্কর হলো অমনি উধাও
বিল্লীকে দেখে লোকে কামান দাগে
তাই শুনে বিল্লী জোরসে ভাগে
(আর মনে নেই)

কৃষ্ণবিবর (Black hole) পরিভাষাটি প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম প্রথম চালু করেন। বাংলাভাষায় তাঁরই সংযোজন এই পারিভাষিক শব্দ।
ভাষাশহিদ গ্রন্থ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত তাঁর 'কৃষ্ণবিবর' বইটি সকল বিবেচনাতেই অসামান্য। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে বইটির প্রথম প্রকাশ। মহাকাশের এক বিস্ময় কৃষ্ণ বিবর। যা সকল কিছুকে তার নিজের গভীরে টেনে নেয়। এমন কি আলোকেও। তার ভেতর থেকে কোনো আলোকরশ্মিও বেরিয়ে আসতে পারে না। যে-কারণে এর নাম কৃষ্ণ বিবর অর্থাৎ কালো গহ্বর। বইটিতে বিজ্ঞানের নানা তত্ত্বের আলোকে এ-বিজ্ঞানী বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন ঠিক কী করে জন্ম নেয় এই কৃষ্ণ বিবর, কেমন তার প্রকৃতি, এবং তার স্থায়িত্ব বিষয়ক নানা প্রসঙ্গ। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসারে আলোচনা করেছেন নক্ষত্রের তিন ধরনের মৃত্যু নিয়ে। নক্ষত্রের জীবনের অন্তিম অবস্থা নিয়ে। চন্দ্রশেখর সীমা নিয়ে।

বইটির 'কৃষ্ণ বিবর ও কোয়েসার' অধ্যায়ে বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম কৃষ্ণ বিবরের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন :

'আইনস্টাইনের অভিকর্ষের তত্ত্ব অনুসারে যখন নক্ষত্রের পদার্থ একটা নির্দিষ্ট ছোটো আয়তনে আসে তখন তার সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কেননা কোনো আলোকরশ্মি অথবা তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ বা কোনো বস্তুকণা সেই নক্ষত্র থেকে বাইরে আসতে পারে না। মাধ্যাকর্ষণ বল সব কিছুকে ভেতরের দিকে টেনে নেয়। নক্ষত্রের এই অবস্থাকে 'কৃষ্ণ বিবর' বলা হয়।'

মহাকাশ বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম কৃশকায় এই বইটিতে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা, আধুনিক পদার্থবিদ্যা, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এবং জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র ইত্যাদির আলোকে কৃষ্ণ বিবরের বিস্ফোরণে কী ঘটতে পারে, উন্মুক্ত বিশ্ব এবং আবদ্ধ বিশ্ব আসলে কী এসব বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। বিষয়সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যে বিশেষভাবে এবং এমনকি আমার মতো সাধারণ পাঠকের জন্যেও এতে বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান লাভের একটা সুযোগ ঘটে যায়।

ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিউটন সম্পর্কে বলেছিলেন :

The marble index of a mind forever voyaging through strange seas of thought alone.
অর্থাৎ মর্মরের সূচকস্বরূ

মেধা, সর্বদা চিন্তার অদ্ভুত সাগরে একাকী ভ্রমণশীল।

মহাবিশ্ব নিয়ে তাঁর অন্তহীন ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভেতর এক ধরনের শক্তি অনুভব করেন। তাঁর মুখে, তাঁর লেখায় বহুশ্রুত পঙক্তিদ্বয় :

'মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকাল মাঝে,
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে।'

(In the great universe, in the great skies, in the midst of eternity, I, human, alone, wander in wonder, wander in wonder.)
এবং এ-পরিপ্রেক্ষিতে কবি নজরুলকে উদ্ধৃত করেছেন বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। 

নজরুল বলেছেন : 'এই বৃহৎকে বুঝবার সাধনাই জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা।'

জীবনভর বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম এই সাধনাতেই নিমগ্ন ছিলেন, কর্মতৎপর ছিলেন।

'বাংলাদেশের উন্নয়ন' শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, 'অবিচারকে সীমাবদ্ধ করা যায় না; একবার কোন একটি গোষ্ঠীর ওপর অবিচার করলে সেটা অবশেষে সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে আছে। 

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম সব সময় জাতীয় উন্নয়নের জন্য জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলতেন। দলগুলো যাতে Holier than thou মনোভঙ্গি এড়িয়ে চলে এ-উপদেশ দিতেন। গত শতাব্দের দুটি মহাযুদ্ধে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে স্যার বলতেন, লিখেও গেছেন, এ-সব ঘটেছে 'গোপন হিংসা'র কারণে।

পরিস্থিতি প্রতিরোধের জন্যে, সংশোধনের জন্যে সমন্বয়ী মনোভাবের কথা তিনি বলতেন এবং এ-প্রসঙ্গে উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা উদ্ধৃত করতেন :

I was angry with my friend
I told my wrath, my wrath did end.
I was angry with my foe:
I told it not, my wrath did grow.

(আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে রাগ করেছিলাম, তাকে বললাম— আমার রাগ শেষ হয়ে গেল। আমি শত্রুর সাথে রাগ করেছিলাম, তাকে বলিনি—আমার রাগ বেড়ে গেল )

'উপমহাদেশ এবং পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত' বিষয়ক নিবন্ধে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম স্যার পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একাধিক সুরের সামঞ্জস্য সম্পর্কিত বিষয় বা Harmony এবং অন্যদিকে আমাদের উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একক সুরের দিকে যে বিবর্তন বা Melody সম্পর্কেও বিস্তৃত লিখেছেন। 

বাখ, মোতজার্ত এবং বিঠোফেন প্রমুখ জগৎ বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা করেছেন প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। 
A passage to India গ্রন্থের লেখক E M Forster তাঁর Howards End উপন্যাসে বিঠোফেনের পঞ্চম সিম্ফনি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তার উদ্ধৃতিও মেলে স্যারের রচনায়।

'It will be generally admitted that Beethoven's Fifth Symphony is the most sublime noise that has ever penetrated into the ear of man.'

তাঁর প্রবন্ধ পাঠে কত কিছুই না জানা যায়। স্যার লিখেছেন : বিঠোফেনের নবম সিম্ফনির মূল বিষয় হলো মানবজাতির ভ্রাতৃত্ববোধ।  জার্মান কবি য়োহান ভন শিলারের Ode to joy ব্যবহার করে সিম্ফনিতে এই বিশ্ব নন্দিত সুর তুলেছিলেন বিঠোফেন। এ-সব জ্ঞানগর্ভ তথ্যসূত্র আমাদের জানিয়েছেন তাঁর 'উপমহাদেশ এবং পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত' শিরোনামের ব্যতিক্রমী প্রবন্ধে।

Centre for Mathematical and Physical Sciences স্থাপন করে দেশবিদেশের বহু ভৌতবিজ্ঞানী,  গণিতশাস্ত্রীকে জড়ো করেছিলেন তিনি। সর্বোপরি বিশ্ববিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানব্রতীদের। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর ইমেরিটাস ফ্রিম্যান ডাইসন বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লিখেছেন :

 ‘His (J N Islam) published papers and his book on the long range future of the universe have had an important influence on my own research. I particularly admire his loyalty to Bangladesh, which led him to stay at Chittagong and build up science in his native country, when he had several attractive offers of positions in other parts of the world. He has devoted his life to serving his country and his university.'

আনন্দের খবর হচ্ছে তাঁর জগৎ বিখ্যাত গ্রন্থ The ultimate fate of the universe (মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি) বাংলায় অনূদিত হয়েছে৷ অনুবাদ করেছেন : অনঙ্গভূষণ দাস। উল্লেখ্য, অনূদিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।

বড়লেখা, মৌলভীবাজারের এম মুন্তাজিম আলী মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক অনঙ্গভূষণ দাস তাঁর এ অনুবাদের মাধ্যমে জ্ঞানের এক অধরা জগৎকে বাংলাভাষায় স্থান করে দিয়েছেন। আর এ-গ্রন্থ  প্রকাশ করার ভেতর দিয়ে নাগরী প্রকাশন, বারুতখানা, সিলেট একটি অসামান্য কাজ করেছে। বাংলাভাষায় মহাকাশ বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের চিন্তা-ভাবনা-ভাষাকে-ভাষাকে স্থায়িত্ব দিয়েছে, দেশীয় বিজ্ঞানবিষয়ক প্রকাশনার ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে। ফেব্রুয়ারি ২০২২ প্রথম প্রকাশ।

উল্লেখ্য, আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বাজাতেন এস্রাজ আর আমাদের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম বাজাতেন পিয়ানো। 
 

কৃষ্ণ বিবর বইটির উপসংহারে এই বিজ্ঞানী আমাদের সামনে জগৎ ও জীবনের মহাকাশ ও মহাকালের নানা রহস্য ও বিস্ময়ের কথা তুলে ধরেছেন। এবং লিখেছেন বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষরূপে বিশ্লেষণ করলেই কেবল সে বিস্ময়কর জগতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। 

'উপসংহার'-এ এসে এ বিশ্ববরেণ্য মহাকাশ বিজ্ঞানী যা লিখেছেন তা উদ্ধৃত করছি :

'শেক্সপিয়রের নাটক হ্যামলেটে ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট তাঁর বন্ধু হোরেশিওকে বলেন, There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy. এখানে শেক্সপিয়র বলতে চেয়েছেন যে মানুষের চিন্তা ভাবনার বাইরে বিশ্বে আশ্চর্যজনক জিনিস অনেক কিছু আছে।’ ইংরেজিতে আর একটি প্রবাদ আছে যেটা হলো Truth is stranger than fiction, অর্থাৎ বাস্তবতা গল্পের চেয়ে বেশি অদ্ভুত।

এই গ্রন্থে আমরা কয়েকটি বিষয়ের পরিচয় পেয়েছি যেগুলো পাঠকদের অবশ্যই অদ্ভুত মনে হবে। একটি কৃষ্ণ বিবর অদ্ভুত জিনিস বই-কি, কিন্তু তার সম্বন্ধে অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। একটি কৃষ্ণ বিবরের কেন্দ্রস্থলে কী ধরনের ঘটনা ঘটে এবং সেখানে পদার্থের কী পরিণাম হয় সেটা অত্যন্ত রহস্যজনক ব্যাপার। কিন্তু যদিও একটি কৃষ্ণ বিবরের উদ্ভব বিশ্বের জটিল এবং দুর্বোধ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে গণ্য, তবু তাকে ব্যাখ্যা করতে হলে সবগুলো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে বিস্তৃত এবং প্রসারিত করা প্রয়োজন।

এটাও মেনে নিতে হবে যে বিশ্বে এমন অসংখ্য জিনিস বা প্রক্রিয়া বিদ্যমান যেগুলো সম্বন্ধে সচেতন হলে অত্যন্ত বিস্ময়কর লাগবে। মহাবিস্ফোরণে যে প্রাণহীন এবং জড় পদার্থ চতুর্দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তার মধ্যে একদিন প্রাণী এবং চেতনার আবির্ভাব ঘটেছিল। এই চেতনায় শ্রদ্ধা জাগে প্রকৃতির বিশালতার প্রতি, এই চেতনায় অনুভূতি জাগায় প্রকৃতির অসীম রহস্য এবং অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতি।

আপাতঃ দৃষ্টিতে সামান্য জিনিসকে বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও আশ্চর্যজনক লাগবে। বিশাল এবং অগণ্য জ্যোতির্লোক, সপ্তর্ষিমণ্ডল এবং ছায়াপথ অবশ্যই বিস্ময়কর। কিন্তু একটা পুরাতন পুষ্করিণী থেকে এক বালতি পানি নিয়ে সেটাকে রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষরূপে বিশ্লেষণ করলেও একইভাবে বিস্ময়কর জগতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। প্রকৃতির রহস্য বিশ্বের প্রতিটি অংশে—তা সে ক্ষুদ্রই হোক বা বৃহৎই হোক।'


মুজিব রাহমান কবি, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। পেশাগতভাবে সরকারি কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তিনি চট্টগ্রামে বসবাস করেন।

menu
menu