ঘাটে নামবে কিন্তু জল ঘোলা করবে না

রুক্ষ বাবরি চুল। গোঁফের বাহাদুরি। হাতে একতারা এবং ডুগডুগির টুং টাং শব্দ। পায়ে একজোড়া কাঠের খড়ম। ইদানীং পায়ে চপ্পল, গায়ে কখনো সাদা বা গেরুয়া রঙের থানকাটা কাপড়ের পাঞ্জাবি এবং পরনে সেলাই ছাড়া লুঙ্গি। সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু বিচিত্রতা তাদের। যাদের মন-মনন, জীবন, জগৎ সংসার, চলাফেরা, আচার-ব্যবহার অন্যদের চেয়ে কিছুটা হলেও ভিন্ন। এরা প্রচলিত ধর্ম বা সমাজের বাঁধাধরা নিয়মকে মেনে চলে না। ভাবনায় নিজেদের ধারা সৃষ্টি করে এদের জীবন চলা। একটু ভিন্ন ধাঁচের গান শুনলেই এদেরকে চেনা যায় তারা হলো বাউল। অর্থাৎ বা-উল কিংবা বাতাসের মধ্যে অনুসন্ধানের যে আকাঙ্ক্ষা সেই অনুসন্ধানকারী মানুষই হলো বাউল।

বাউল মতবাদ পৈত্রিক কোন ধর্ম নয়। ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবাদী ধর্ম এবং সামাজিক আন্দোলন থেকে এই মতবাদকে আবিষ্কার করার উৎস বলে মনে করা যায়। প্রাচীন এক ঐতিহ্য গুরু সূত্রস্য ও পরম্পরায় বাহিত এবং পরিবাহিত হয়ে বাউল তত্ত্ব বয়েই চলেছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ইহজাগতিক অমানবিক দর্শন, ধর্মীয় কথায় জড়িয়ে দেওয়া কুসংস্কার অথবা সামাজিক অনৈতিক রীতি-নীতির বিরুদ্ধে  প্রতিবাদী স্রোতের সম্মিলিত রূপই বাউল। বৌদ্ধ, বৈদিক, সুফি, বামাচারী সাধকের সাধনা, তন্ত্র, বৈষ্ণবতায় বা বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকের ধ্যান বা জ্ঞানে বাউল মতবাদের জন্ম হয় নাই। মূলতঃ লোক সমাজের প্রতিবাদ থেকে এর জন্ম। প্রতিবাদের পরেও প্রতিবাদই একে পুষ্ট করে এবং বাঁচিয়ে রাখে। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দশম শতকের নাঢ় পণ্ডিত এবং তাঁর স্ত্রী নাঢ়ীকে বাউল মতের আদি প্রবক্তা মনে করেন।

বাউলদের উদ্ভব বা বিকাশ যে ভাবেই হোক না কেন, বাংলাদেশের বাউলেরা দুই ধারায় দর্শন প্রচার করে থাকেন। প্রথমত, বৈষ্ণব সহজিয়া মতবাদ এবং দ্বিতীয়ত, হলো সুফি মতবাদ। তবে এই দুই ধারার বাউলদের বিশ্বাস উপস্থিত এক জায়গাতে। ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে এই দেহ ভাণ্ডে।’ অর্থাৎ প্রকৃতি এবং সৃষ্টি রহস্যের তাবৎ অনুচ্ছায়া আমাদের শরীরে বিদ্যমান। আমাদের তীর্থালয় হলো আপন আপন দেহ ভাণ্ডার। আবার আমাদের দেহঘড়ি আপন আপনার কাছে তা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও বড়। বাউলদের জীবন-যাপন দুই ধরনের। এরা এক হলো গৃহী, দুই হলো যোগী বা সন্ন্যাসী। অন্য বৈশিষ্ট্য যাই থাকুক না কেন, সকল বাউলেরা সংগীত সাধন করে থাকেন। যোগী বা সন্ন্যাসী বাউলের দেখা মেলা ভার এখন এই দেশে। এ জন্য আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার দূরাবস্থা অনেকটা দায়ী।

আমাদের দেশে গৃহী বাউলের সংখ্যা বেশি। এদের বসবাস আবার দেশের উত্তর এবং দক্ষিণ অঞ্চলেই বেশি। হিন্দু কিংবা মুসলমান যে ধর্মের বাউলই হোক না কেন এদের মধ্যে ধর্মে কোন বিভেদ নেই। বাউলেরা উভয়েই পরিচ্ছন্ন, শান্ত এবং তাঁরা গোষ্ঠীবদ্ধ। এরা যেকোনো সামাজিক কোন্দলকে এড়িয়ে চলেন। এরা সরল এবং সাবলীল জীবন যাপন পছন্দ করেন। এরা যৌক্তিকতা পোষণ করেন তবে কোনো বাহাস বা তর্কে নয়।

ধর্মান্ধ মৌলবাদিরা বাউলদের পরম শত্রু। বাংলা ১৩ শতকের ত্রিশ দশকে বাউলেরা এদের কারণে প্রবল বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। যশোহর, রাজশাহী এবং কুষ্টিয়াতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয় সরকার, পাগলা কানাই, গগন হরকরা, মহামতি লালন এবং কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কারণে বাউল সাধন চর্চা গতি পেয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাবকে ছোট করে দেখাও ঠিক হবে না। পির মাশায়েকদের মাধ্যমে সুফিবাদের প্রভাব ঘটেছিল এ অঞ্চলে। 

কেউ কেউ মনে করেন, বিন্দু সাধনা থেকে বাউল ধারার উৎস এসেছে। অর্থাৎ বিন্দু সাধনাকে রূপান্তরিত করে এসেছে বাউল মতবাদ। বিন্দু, হাওয়া, নিরঞ্জন, প্রাণপাখি এমন এক শুক্রকীটের অনেক নাম। আবার ইড়া, পিঙ্গলানাড়ী, সুষমা এ সকলকে নিয়ন্ত্রণ করে বীর্য ক্ষমতাকে ধারণ করাই বাউল সাধনার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তবে এই বিন্দুর সঙ্গে আরও চারটি বিষয়কে সংযত পর্যায় রাখতে হয়। কিন্তু তা ইচ্ছে করলেই পরিত্যর্য নয়। তা হলো—রজঃ, মল, মূত্র এবং বীর্য। বাউলদের মতে, এগুলো হলো তাদের ভাষায় চারি চন্দ্র। এগুলো বায়ু, পানি ও আগুনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। বাউলেরা বিশ্বাস করেন এই বিষয়গুলো দিয়ে মানব শরীর গঠিত হয়। সুতরাং সাধনার উপজীব্য বলতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণও বটে।

বাউলধারা আরও মনে করেন, দীর্ঘ জীবন এবং অসুখ-ব্যাধি থেকে রেহাই পেতে শরীরে সৃষ্ট জিনিস শরীর ফিরে পেলে তা সম্ভব হয়। রজঃ, মল, মূত্র এবং বীর্য এই চারি চন্দ্রের সমাহারে বাউলেরা ‘প্রেম ভাঙা’ নামে পেঁপের বীজের মতো দেখতে একধরনের বটিকা তৈরি করেন এবং তা নিয়মিত মুখের মধ্যে দিয়ে রাখেন। বাউলেরা বিশ্বাস করেন এই বটিকার কারণে তাদের জটিল অসুখ-বিসুখ হয় না। তাঁরা আরও বিশ্বাস করেন, দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল রোগের হাত হতে রেহাই পেতে নারীদের বুকের দুধ নাকি পান করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

এমনকি এই দুধ পান করলে দীর্ঘ সময় যৌবনকে ধরে রাখা যায়।  তবে আর যাই হোক বাউলদের জীবন চলে তাদের ভক্তিবাদ এবং দেহতত্ত্বের গান পরিবেশনা দিয়ে। তাদের গানের শব্দ এবং সুরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে—তাদের ধর্ম জ্ঞান, বিশ্বাস, কর্তব্য সমূহ। বাউলদের গানের কথাগুলো বেশ দুর্বোধ্য। তবে তা বাস্তবমুখী ও হৃদঙ্গম বিষয় বটে। বাউলদের গানে বৌদ্ধ ধর্মের, বৈষ্ণব ভক্তিবাদ ছাড়াও সুফিবাদের সূত্রযুক্ত আছে। গুরুসাধনায় সফল হলে, তাঁরা এই গানের সাধনতত্ত্ব উপলদ্ধি করতে পারেন। গুরু সাধনের মাধ্যমে শিষ্যের বিনির্মাণ সম্ভব। এই বিনির্মাণ হলে, দেহ থেকে আত্মার মুক্তির উপায় হিসেবে তা বিবেচিত হয়। 

সঙ্গিনী ছাড়া বাউলধারা একেবারেই মিছে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী রূপে অথবা নির্বাচিত সঙ্গিনী হিসেবে বাউল দর্শন বা তাদের ক্রিয়াকলাপ সমূহ পালন করে থাকেন। লোক ধর্মগুলোতে সন্তান জন্ম দেয়া যায়। বাউল ধারায় সন্তান জন্মের কোনো স্থান নেই। নিঃসন্তান সাধক বাউলেরা, বাউল ধারায় পরম শ্রদ্ধেয়। বৈষ্ণব-বৈষ্ণমীদের সন্তান হলে আখড়া বাসের অধিকার থাকে না।

তবে কর্তাভজাদের সন্তান দেয়া অসাধুত্বের লক্ষণ না হলেও বাউলরা কিন্তু পতিকে ভজনা করেন, তবে সৃষ্টিকে করেন না। পশু মাংসের জন্য অন্ধ বিচারহীন তীব্র কামনা, ক্রোধ, হিংস্রতা প্রভৃতি আসে। ডিম ও মাংস মানবদেহে কামনা বৃদ্ধি করে এবং উত্তেজনা ছড়ায়। বাউলেরা বলে পৃথিবীর বাইরে কোন সুখ-দুঃখ নেই। দেহ বহির্ভূত কোন আল্লাহ নেই। দুই না হলে কোন সৃষ্টি হয় না। বাউলেরা গৃহস্থ এবং ত্যাগীদের মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকেন। তারা ঐশ্বর্য, যশ, বির্য, জ্ঞান ও বৈরাগ্যে ডুবে আকুণ্ঠ তৃপ্তি গ্রহণ করেন। সন্তান, সম্পত্তি, ভোগবাদে তাদের অনীহা। তাদের অম্বিষ্ট সাধুত্ব এবং আত্ম-স্বার্থহীন হলো  মানবতা।  

বাউলেরা মনে করেন ‘শ্বাস’ কে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবে জীবনকে সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য করা সম্ভব। নিজেদের শ্বাসকে ভিত্তি করে বাউলরা তাদের যৌন জীবনকে ভোগ্যময় করে গড়ে তোলেন। যৌন মিলনের সময় কখন কীভাবে নসারন্ধ্রের কোন পার্শ্বদিয়ে শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে এবং পুরুষদের যে পার্শ্ব ব্যবহার হয়, তখন নারীদের কোন পাশে শ্বাস প্রবাহিত হয়, কিংবা কোন পাশ ব্যবহার করা উচিত তার কৌশল ও ক্রিয়া কলাপের বিষয় রপ্ত করে নিতে হয়। যৌন বির্যপাতের সময় শ্বাস প্রবাহ বন্ধ করে রাখতে হয়। এভাবে সময় ক্ষেপণ করে, আবারও তারা যৌন কাজে লিপ্ত হয়ে থাকেন। এতে দীর্ঘক্ষণ তারা যৌনতাকে উপভোগ করেন। তবে পুরুষ বাউলেরা এক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গে নারীদেরকে উপভোগ্য করে তোলেন।

বাঙালি অন্য মেয়েদের মতো বাউল মহিলাদের যৌন জীবন পদ্ধতিতে মিল পাওয়া গেলেও, পুরুষদের ক্ষেত্রে বাউল ধারাটা যৌনচারে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তাত্ত্বিকতায় বাউলেরা ভাবেন, অটল বা মূলবস্তুর নির্গম সম্পুর্ণ বন্ধ করা অসম্ভব এবং তা শরীরের জন্য ক্ষতি করে। পুরুষের মূলবস্তু না পেলে নারীদের দেহ নষ্ট হয়। পুরুষ বাউলেরা নারীদেরকে চরম আনন্দের এক ক্ষেত্র হিসেবে ভেবে থাকেন। তাঁরা এটাই ভাবেন যে, নারীদের ছাড়া পুরুষদের বাউল সাধনা একেবারেই অসম্পূর্ণ ও অচল। তবে যৌন আনন্দে বাউলেরা সৃষ্টিকে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসেন।

সৃষ্টির রহস্য না জানার ফলে ‘অযোগ্য’ সন্তান উৎপাদন করলে তা অন্ধ, বোবা, কালা, মূর্খ সন্তান সৃষ্টি হয়। বাউলেরা ‘সুযোগে’ ইচ্ছেমত সন্তান জন্ম দেয় না। তাদের সৃষ্টির পূর্ব পরিকল্পনা জাত-পাতের কামের অন্ধ আবেগজাত নয়। বাউলদের কথায় আত্মসুখই ব্যাভিচার। তাদের অতীন্দ্রিয় তৃপ্তির ইচ্ছে এবং অহং কেন্দ্রিক কামের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাউলেরা। আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে গোপী সখিরা কৃষ্ণের সুখেই সুখি। বাউলরা সাধুসভায় দারুণ মনোযোগী গান মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। দেহ মিলন ও ভোগবাদ যাইহোক না কেন, তাদের মতবাদ, প্রকৃতির আকূলতার প্রতি বাউল বা সাধু সমাজ অধিকতর মনোযোগী। তাদের মতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ বৃদ্ধিতে আপত্তি আছে।

বাউলেরা নিজেদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে খাদ্য এবং নেশা জাতীয় পণ্য ব্যবহারের প্রতি সজাগ দৃষ্টিপাত রেখে চলেন। যদি অমৃতত্ব লাভের কথা বলি, তবে অমৃতত্ব অর্থ হলো মুক্তি, যা থেকে আসে মহা মুক্তি। এ প্রসঙ্গে কঠোপনিষদে বর্ণনা করা আছে, ‘ মানব হৃদয়ে ১০১ নারী থাকে। তাহার মধ্য হইতে একটি নিঃসৃত হইয়া মূর্ধায় গিয়াছে। তাহাতে ঊর্ধ্বে উঠিলে অমৃতত্ব লাভ করে।’ অমৃতত্ব হলো ভাব যন্ত্রণা থেকে চূড়ান্ত  মুক্ত হওয়া। জন্ম এবং মৃত্যুর যে যন্ত্রণা তা থেকে রেহাই পাওয়া।

বাউলদের মতে, যে খাদ্য মানুষের শরীরে সহ্য হয় না, তা হারাম। আবার যে খাদ্য মানুষের শরীরে হিতকর তাই হালাল। দেহের উত্তেজক শক্তি বৃদ্ধি করে এমন খাদ্য বাউল সমাজে হারাম। গোমাংস খাদ্য বাউল সমাজে নিষিদ্ধ। এই মাংস হিন্দু এবং মুসলমান বাউল সমাজে নিষিদ্ধ হওয়াতে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে। নিষেধ সত্ত্বেও গঞ্জিকার অপ্রতিহত প্রভাব বাউল সমাজে পড়েছে। সাধুদের অন্ন, তেল এবং তামাক, গাঁজা সেবা দেওয়া আবশ্যক। বাউলেরা মনে করেন, মদ বা তাড়ি খাওয়া বাউল সমাজের নৈতিক আপত্তি, এ নেশা মানুষকে উত্তেজিত এবং উশৃঙ্খল করে তোলে। কিন্তু গাঁজা বা আফিম এর নেশা মানুষকে আত্মমগ্ন করে। গাঁজা প্রাকৃতিক নেশা। যা থেকে গাঁজা, ভাঙ্, গঞ্জিকা, চরস তৈরি হয়। তা কাঁচা, শুকনো, শেকড় ও ডাল দিয়ে তৈরি হয়। তারা মনে করেন সামাজিক উশৃঙ্খলা গাঁজা নেশা থেকে হয় না।

গাজা বিষাক্ত নেশা দেহস্থ কামের বিষকে নিস্ক্রিয় করে মনকে ঊর্ধ্বগামী করে দেয়। সন্তানের কামনা মানুষের সহজাত। কোন কামনাকে দমন করলে তা থেকে শারীরিক ও মানসিক বিকৃতি ঘটে। যাদের সন্তান কামনা আছে তারা ১-২ টি সন্তান জন্ম দিতে পারেন। মহামতি লালন প্রকৃতি পুরুষের অভেদ মিলনের কথা বলে গেছেন। রতিক্রিয়ায় যৌনের যে সহ সংযোগ, সে ক্রিয়ার মাধ্যমে আপন দেহ এবং মনকে সৃষ্টিমুখী করা হয়। পিতৃ শুক্রাণুর সঙ্গে মাতৃ ডিম্বাণুর মিলিত রূপে মানবের দেহ তৈরি হয়। তবে মাতৃ উদোরে সাত পর্যায়ক্রম দেহ গঠনের ক্রিয়া করে থাকে। তা হচ্ছে ত্ব, অস্তি, শুক্র, শোণিত, মজ্জা আর মাংস। তবে  যিনি অন্তর সাধনায় সফল হয়ে যান, তিনি সৃষ্টির গুপ্ত ভান্ডার লাভ করেন। লালন তাই বলেছেন,

“ক্ষীরোদ মৈথুনের ধারা
ধরোরে রসিক নাগরা
যে ধরাতে অধর ধরা
থেকোরে সচৈতন্য হয়ে।”

মহামতি লালনের কথায় বলা চলে, মানুষ হলো অযোনি, সংস্কারবাদী মানুষ এবং সহজ মানুষ। তার মতে, অযোনি তারাই যারা নিজ থেকে নারীর আকুলত্বকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হন তিনি। এই শ্রেণির মানুষ সব সময় যেকোনো মোহ মুক্ত তারা বংশকে সৃজন করেন না। তারা বস্তু জগতের লোভ-লালসাকে এড়িয়ে চলেন। তার তৃপ্ততা আসে পরম দিব্যসত্ত্বায় পরম অবস্থানে একীভূত হয়ে। যদি সাধারণ মানুষের কথায় আসি, তবে তারা বস্তু জগতের বিচিত্রতায় মোহে আচ্ছন্ন থেকে কাম ও ভোগকে ধারণ করেন। তারা সৃষ্টি সৃজনে কামিয়া হয়ে ওঠেন। এতে এরা নিজে যেমন ডোবে, আবার এরা অন্যকেও ডুবিয়ে ছাড়েন। এরা প্রকৃতির রহস্যতেও সব সময় হাবুডুবু খেয়ে থাকেন। মানুষ ভোগের মোহে কামনা-বাসনাকে ধরতে গিয়ে জন্ম সৃষ্টির ঘোরটোপে পরে একবার জন্মে আবার মৃত্যু এই চক্রে জড়িয়ে যায়। আসলে সাঁইজী এই ভোগ কে অজ্ঞান কর্ম বলে বর্ণনা করেছেন।  

বাউলদের মতে জন্ম-জীবন সব সময় উপভোগ্যময়। প্রাণীর প্রেম সৃষ্টি হয় তার মন, মনের শক্তিরস, ভাব প্রেমের অনুসঙ্গ মিশে। যিনি রসরঙ্গের রসিক তিনি সুধা পান করেন, অনুরাগ, প্রণয়, প্রেমে, রোজ বিহারে। তিনি তা করেন তার সাধন ভজন বিলিয়ে। যে জন্য কাম উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করে ভোগ ক্রিয়াকে দীর্ঘ করে রাখাটা সমীচীন তাদের কাছে। এভাবে গানে গানে আত্ম উপলদ্ধিকে জাগ্রত করে রাখতে, তাঁরা গানকে ধারণ করে, মন কে আনন্দময় করে তোলেন। তবে তা সৃষ্টিকে আঁকড়ে নয়। মহামতি লালনের কথায় বলতে গেলে,
 
‘‘ আজব মানব দেহ ঘড়ি, চলতে চলতে চলে না
জীবন মানে জন্ম মৃত্যু, মাঝখানে কেউ থাকে না।’’

সৃষ্টির রহস্যের মাঝে জড়িয়ে আছে সৃজনশীলতা। যদি এই সৃজনের রিসোর্সের জায়গা খুঁজি, তবে তা একক ভাবে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নর এবং নারীকে। পুরুষের (বাউল) সহজাত বৈশিষ্ট্যর বাইরে নারীর নিঃসৃত দয়া, মায়া, বাৎসল্য, ক্ষমা, প্রেম, ভালোবাসা ব্যতিত সৃষ্টি আদৌ সম্ভব নয়। জীবনের উপলক্ষ রূপায়ণে এ জন্য নারীদের এই অলঙ্কারকে ভিক্ষে করে নিতে হয় পুরুষদেরকে। তারপর আসে সৃষ্টির সৃজন। অর্থাৎ সিদ্ধ লাভে সিদ্ধি হয়। যদিও লক্ষনীয়, বাউলদের যে সঙ্গীরা, তারা আসেন নিরন্তর প্রান্তিক অঞ্চলের অসহায় মানুষেরা। তারা কারও স্ত্রী বা সংসার ত্যাগী, নচেৎ বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা, বৈরাগী। তবে বাউলদের যে সঙ্গীই থাকুক না কেন তারা প্রকৃতি প্রাপ্ত হলে, সে প্রেমি হিসেবে গণ্য হয়। এ ক্ষেত্রে বলতে পারি, বাউলদের সাধন সিদ্ধিতে দেহ আবশ্যিক এক উপজীব্য, বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গ। সেজন্য লালনের কথায় এসেছে—

“নরদেহ নৈলে কোন তত্ত্ব নাহি জানে
সাধনের মূল এই নরদেহ গণে।” 

অথবা 

“শুদ্ধ প্রেম সাধলে যারা কাম রতিকে রাখলে কোথা,
বলগো রসিক রসের মাফিক ঘুঁচাও আমার মনের ব্যথা।
আগে উদয় কামের রতি, রস আগমণ তারি সাথী
সেই রসে হয় স্থিতি, খেলছে মানুষ প্রেমদাতা।

বাউলেরা ভাবের বেলায় উন্মাদ প্রকৃতির। তাদের যে সমাজ তাকে আমাদের প্রচলিত সমাজ স্বীকৃতি যেমন দেয় না। তাদের যে বাউলি তত্ত্ব তাকে ভর করেই তাদের জীবন ধারা। যে ভাবকে বহন করে তারা চলুক না কেন, তারা কিন্তু ব্যাভিচারী নন। বাউলদের দ্বৈত জীবনেও আছে নিয়ম। বিশেষ করে গুরুর অনুমতি কিংবা অনুশাসনের শৃঙ্খল। তারা যৌন ক্ষেত্রে সকলেই ব্যক্তিত্ববান। নিজেদের সংযম এবং প্রত্যয়ী আচরণে অবস্থান। বাউলদের সঙ্গে প্রতিজন শয্যাসঙ্গী হলেও তারা সার্থক প্রেমের সুধাময়ী।

ঋণ স্বীকার
বাস্তুবাদী বাউল শক্তিনাথ ঝা 
এবং মাসিক গণস্বাস্থ্য, ঢাকা, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা বাংলা ১৩৯১ সংখ্যা।


গৌতম কুমার রায় প্রাবন্ধিক, উদ্ভাবক-গবেষক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব। তিনি  কুষ্টিয়ায় থাকেন। 

menu
menu