একটি চরিত্রের সন্ধানে

বঙ্কিমচন্দ্র দেবী চৌধুরানী উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন—১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে আর প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ তে।

‘ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনী কান্ত দাসের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের যে সংস্করণ প্রকাশ করে তাতে ‘ঐতিহাসিক ভূমিকা’ লেখেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার।  

১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে দেবী চৌধুরানী যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন—‘ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভান করি নাই। দেবী চৌধুরানী উপন্যাসটিরও আনন্দমঠের ন্যায় ঐতিহাসিক মূল্য আছে। যদিও এই উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা না করিলে বাধিত হইবো ’

দেবী চৌধুরানীর আসল নাম ছিল শ্রী দুর্গাদেবী চৌধুরাণী। ব্রাহ্মণ জমিদারের বংশ। পরে, তিনি পারিবারিক কারণেই সরে দাঁড়ান আর তাঁর বজরা ভেঙে ফেলা হয়।

প্রায় দুশো ঊনত্রিশ বছর আগে এই বাংলা ও বিহারে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলে ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র গেরিলা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল বাংলার ফকির, সন্ন্যাসী, তাঁতি, কৃষক ও জেলেদের মধ্যে।  এক পর্যায়ে বর্তমান বাংলাদেশের রংপুরে কৃষকদের এক বিদ্রোহ হয়। এই সংগ্রামের সময়ের এক কিংবদন্তীর নায়িকা ছিলেন রংপুরের দেবী চৌধুরাণী, যাঁর সত্য কাহিনির ওপর ভিত্তি করে বঙ্কিম তাঁর দেবী চৌধুরানী উপন্যাস রচনা করেছিলেন। দেবী চৌধুরাণী ছিলেন এই সংগ্রামের এক পুরোধা ভবানী পাঠকের সহযোগী। এরা দুজনই আবার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বিখ্যাত মহানায়ক মজনু শাহের সাথী। 
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লেফটেনান্ট ব্রেনানের (লেফটেনান্ট ব্রেনানের কথা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রও লিখেছিলেন উপন্যাসে।) ডায়েরিতে তাঁর কাছে ১৭৮৭-এ লেখা রুংপুরের কালেক্টরের চিঠিতে দেবী চৌধুরাণীর ঐতিহাসিক সত্য লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। 

দেবী চৌধুরাণীকে ব্রিটিশেরা দস্যু রানি হিসেবে দেখলেও আসলে দেবী চৌধুরাণী ব্রিটিশদের অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিপীড়নমূলক নীতির দরুণ গরিব জনগণের দুঃখ কষ্টের প্রতিবাদেই মূলত তাঁর এই ব্রিটিশ বিরোধী আক্রমণ চালাতেন এটা পরিষ্কার। ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলায় ইংরেজ ও তাদের অনুগত বণিকদের পণ্য পাঠানোর নৌকাগুলোকে বারবার আক্রমণ করে লুঠ করতেন ।

(সেকালে অবশ্য জমিদারেরা লুঠপাঠ করতেন, রাজস্ব আদায়ের জন্য।)

অন্তত তিনটি আলাদা ঘটনাকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে অভিহিত করা হয়। যার একটি মূলত সম্মিলিত হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম মাদারী এবং ধার্মিক ফকিরদের বৃহৎ গোষ্ঠী দ্বারা। যারা পবিত্রস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে বাংলার বিভিন্নস্থান ভ্রমণ করতেন। 

যাওয়ার পথে এসব সন্ন্যাসীগণ গোত্রপ্রধান, জমিদার অথবা ভূস্বামীদের কাছ থেকে ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করতেন যা তখন রেওয়াজ হিসেবে প্রচলিত ছিল। 

সমৃদ্ধির সময়ে গোত্রপ্রধান, জমিদারগণও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদার ও অনুগত ছিলেন কিন্তু যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি ক্ষমতা লাভ করে তখন থেকে করের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় ফলে স্থানীয় ভূস্বামী ও গোত্রপ্রধানগণ সন্ন্যাসী এবং ইংরেজ উভয়কেই কর প্রদানে অসমর্থ হয়ে পড়ে। উপরন্তু ফসলহানি, দুর্ভিক্ষ যাতে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ হারায় যা তৎকালীন বাংলার মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ। এই সেই বিখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।    

সমস্যাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়  আবাদি জমির বেশিরভাগ ফসল শূন্য থেকে যাওয়া।  সেটা ছিল ১৭৬৯-১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ বা বাংলার ১১৭৬ সাল। 

১৭৭১ সালে ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। এটি ছিল অনেকগুলো কারণের একটি—যা ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এ ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় সংঘাতে বিশেষত নাটোরে, রংপুরে যা এখন আধুনিক বাংলাদেশের অন্তর্গত। 

এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে—এই ভবানী পাঠক কে ছিলেন? যদুনাথ বাবু লিখছেন—ভবানী পাঠক ভোজপুরী অর্থাৎ আরা জেলার ব্রাহ্মণ। এদিকে ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে বলছেন, ভবানী পাঠক সেই সিরাজের সেনাপতি মোহন লাল। আদতে যিনি কাশ্মিরি হিন্দু কায়স্থ।

লালা থেকে লাল। তাই মোহনের পদবি ছিল লাল। এঁরা বংশানুক্রমে করণিক বা কেরানির কাজ করতেন ।

এইখানেই লাগে খটকা। কারণ আরেক ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় ভবানী পাঠককে ‘বাংলার বিদ্রোহী নায়ক’ বললেও—তিনি যে মোহনলাল ছিলেন, সেটা লেখেননি।

আঠারো শতকে মোহনলাল কাশ্মীর থেকে মুর্শিদাবাদে আসেন। সঙ্গে ছিল বড়ছেলে শ্রীমন্ত লাল আর ছোটছেলে হুক্কালাল। আর ছিল বোন। স্ত্রীর উল্লেখ কোথাও নেই। আর তিনি কেন এই সুদূর বাংলাতে হতে পারে, তিনি যুদ্ধপারদর্শী ছিলেন বলে—এই বাংলাতেই আসেন, হয়তো দিল্লির দরবারে সেরকম পাত্তা নাও পেতে পারেন ভেবে! কারণ সেই সময়ে মোগল শাসন ভারতে দুর্বল হতে আরম্ভ করেছে।  বাংলায় আলীবর্দী খান জাঁকিয়ে বসা, তাই একটা হিল্লে হতে পারে ভেবে আসা—তবে সবটাই অনুমান।

মোহনলালের বোনের প্রকৃত নাম ছিল মাধবী। তাকে আদর করে হীরা ডাকা হতো। মোহনলালের সঙ্গে সিরাজের সখ্য থাকায়, সেই সূত্রে হীরার সঙ্গে সিরাজের অন্তরঙ্গতা হয়। এর ফলে হীরার গর্ভে সিরাজের এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। যার আকিকার (নামকরণ অনুষ্ঠান) নাম জানা যায় না।

সিরাজ দাদুর ভয়ে ছয় বছরের এই সন্তানকে ঘোড়ার ওপর চাপিয়ে বেঁধে, ঘোড়ার পেছনে তীর মারার ফলে—ঘোড়া ছুটতে থাকে। সিরাজের আশা ছিল—কেউ না কেউ ছেলেটিকে উদ্ধার করবে। হীরা জানতে পেরে দাদা মোহনলালকে সব বলেন। তিনি গিয়ে ছেলেটিকে উদ্ধার করেন, কিন্তু সিরাজের ওপর রেগে গিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

নবাব আলীবর্দী খাঁ জিজ্ঞেস করেন—কারণটা কী?

হীরার সঙ্গে সিরাজের অন্তরঙ্গতা ও সন্তানের খবর জানতে পেরে নবাব আলীবর্দী খাঁ খুবই বিচলিত হন। তিনি ঘটনাটি জানবার পর ইমামের সঙ্গে আলোচনা করে মীমাংসার সূত্র বের করেন, হীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে সমস্যার সমাধান সহজেই হয়ে যায়। হীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আর তার নতুন নাম করণ করা হয় আলেয়া (উচ্চবংশজাত)।

মোহনলালের একমাত্র জামাই ছিলেন ধর্মে মুসলমান। নাম বাহাদুর আলী খান। এই খান সাহেবও সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন।

‘মোহনলালের বোন যে সিরাজের স্ত্রী ছিলেন সে কথা নিখিলনাথ রায় উল্লেখ করেন। তবে তার নাম বলেননি।’ 

সিরাজ হেরে যাবার পর—মোহনলাল মুর্শিদাবাদ গোপনে ছেড়ে চলে যান, ভাগ্নেকে নিয়ে, কিন্তু হীরার কি হলো, সেই ইতিহাস আর মেলে না।

মোহনলালের সঙ্গে ছিলেন, তাঁরই দুজন বিশ্বস্ত অনুচর। নাম বাসুদেব আর হরনন্দ।  

ক্লাইভ ও মীর জাফর গুপ্তচর পাঠিয়ে তাদের ধরবার চেষ্টা করছে, এই খবর পেয়ে মোহনলাল ময়মনসিংহের বোকাই নগরে চলে গেলেও- সেখানে  নিরাপদ মনে করেননি। বোকাই নগর আছে এখনো এবং এটুকু জানা যায়—বোকা নামের এক কোচ জাতীয় লোকের নামে এই বোকাই নগর। 

মোহনলাল যে পলাশীর যুদ্ধে মারা যাননি, সে কথা ঐতিহাসিক এবং অধ্যাপক অমলেন্দু দে জোরের সঙ্গে এবং যথেষ্ট প্রমাণ সহকারে এটা লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত গবেষণার বই—‘সিরাজের পুত্র এবং বংশধরদের সন্ধানে’ (পারুল প্রকাশনী) বইতে।

মোহনলালের বিশ্বস্ত সঙ্গী বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায় আমহাটি গ্রামে বাস করতেন। মোহনলাল সিরাজের পুত্রকে সেই বাড়িতে রেখে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। মোহনলাল সিরাজ পুত্রকে দত্তক রাখার জন্য ময়মনসিংহের জমিদার কৃষ্ণকিশোর চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সম্মতি দান করেন। কারণ তাঁর ছোটভাই কৃষ্ণগোপাল দুবার বিবাহ করেও নিঃসন্তান ছিলেন। কৃষ্ণকিশোর ও কৃষ্ণগোপাল কেউই জানতেন না যে তারা সিরাজ পুত্রকে দত্তক নিচ্ছেন। তারা জানতেন যে বাসুদেবের কাকা আমহাটির বিনোদ রায়ের দ্বিতীয় ছেলেকে তারা দত্তক নিচ্ছেন। যথারীতি অনুষ্ঠান করে কৃষ্ণগোপাল এই পুত্রকে দত্তক নেন এবং তার নামকরণ করা হয় যুগল কিশোর রায়চৌধুরী। এই দত্তক পুত্র কৃষ্ণ গোপালের পিণ্ডাধিকারী ও উত্তরাধীকারী হন। এভাবে সিরাজ   ও আলেয়ার ছেলে ভিন্ন নামে পরিচিত হন। এই তথ্য মোহনলাল ও তাঁর দুই সঙ্গীছাড়া কারও জানা সম্ভব ছিল না। 

মৃত্যুর পূর্বে যুগল কিশোর তাঁর জীবন বৃত্তান্ত ও তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা পুত্র প্রাণকৃষ্ণনাথের কাছে ব্যক্ত করেন। যুগল কিশোর রায় ও নিজের প্রকৃত বংশ পরিচয় জানতে পেরে প্রাণকৃষ্ণ বিস্মিত হন। ব্রিটিশ শাসন কালে এই তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখা সর্ম্পকে তিনি বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন।

এটুকু পরিচয় দিয়ে—আসল বিষয়ে আসি। ১৭৯০ সালের পর সিরাজ পরিবারের ধারাবাহিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা যায়নি। অর্থাৎ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার স্ত্রী মারা যাবার পর সিরাজ পরিবারের ধারাবাহিক ইতিহাস সংরক্ষণ হয়নি। হয়ে থাকলেও ইংরেজরা, মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, সিরাজ-উদ-দৌলাসহ সমকালীন ইতিহাস বিনষ্ট করে দেয়।

১৭৯০ সালটা একটু অদ্ভুত ঠেকে আমার কাছে। এই সালেই ভবানী পাঠক মারা যান ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে।

কেন এই সমাপতন? কী উদ্দেশ্যে!

আমার মনে হয়—এই কারণেই মোহনলালের সঙ্গে ভবানী পাঠকের সম্বন্ধ ঠাহর করতে পারেননি পরবর্তী সময়ের ঐতিহাসিকরা। মোহনলালের এই ছদ্মনাম নেওয়া অস্বাভাবিক নয়, কারণ তিনি শাক্ত ছিলেন।

অনেকেই বলেন—ভবানী পাঠক, ভোজপুরী ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু সমকালীন ইতিহাস যদি আমরা ভালো ভাবে দেখি—তা হলে এটা সত্যি নয়, ওপরে বলা একই কারণে । 

এবারে বঙ্কিমচন্দ্র—দেবী চৌধুরানী উপন্যাসটি রচনা করার উপকরণ কোথা থেকে পেলেন?

প্রাণকৃষ্ণনাথ রায় চৌধুরীর প্রথম পুত্র কাজল ১২ বছর বয়সে মারা যায়। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হলো শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। শৌরীন্দ্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলেন নিজেকে সম্পৃক্ত করায় ব্রিটিশ প্রশাসকদের কাছে তিনি সন্দেহভাজন ছিলেন।

প্রাণকৃষ্ণনাথ রায় তাঁর পিতার ও বংশ পরিচয় শৌরীন্দ্রকে খুলে বলেন। এই কারণে এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে সমস্ত পরিবার বিপন্ন হয়ে পড়বে। গোপনীয়তা রক্ষা করে তারা দীর্ঘদিন ধরে চলছেন। শৌরীন্দ্র পারিবারিক অবস্থা উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি দুবার নাম পরিবর্তন করে এই অবস্থা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন এবং পড়াশোনায় নিমগ্ন হন। শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী প্রথমে হন প্রসন্ন চন্দ্র রায় চৌধুরী পরে নাম পরিবর্তন করে হন প্রসন্ন কুমরা দে। শৌরীন্দ্র প্রসন্ন রায় চৌধুরী নামে কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন।

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জুনিয়র স্কলারশিপ লাভ করেন। এই কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। এই হিন্দু কলেজ পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয়।

উল্লেখ্য, শৌরীন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী, প্রসন্নচন্দ্র রায়চৌধুরী ও প্রসন্ন কুমার দে একই ব্যক্তি ছিলেন।

প্রসন্ন কুমার দে হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি) পড়েন আর বঙ্কিম সেই কলেজেরই ছাত্র ।

সিরাজের বংশধর বলে 'পরিচিত' প্রসন্ন কুমার দে হিন্দু কলেজের (পরে প্রেসিডেন্সি) ছাত্র ছিলেন, বঙ্কিমও তাই।

যদিও, প্রসন্ন বাবুর সঙ্গে বঙ্কিমের সরাসরি পরিচয় ছিল বলে, প্রমাণিত নয়।

প্রসন্ন বাবু বঙ্কিম প্রয়াত হবার পর তাঁকে নিয়ে ইংরেজিতে কবিতা লিখেছিলেন।

এটাতেও কিছুই প্রমাণ হয় না।

কল্পনা করছি, প্রসন্ন বাবু বঙ্কিমকে তথ্য দিলেও, নানা কারণে, সেটা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন, তখন ইংরেজ শাসন চলার ফলে। ঔপনিবেশিক শাসনের কারণেই এই গোপনীয়তা ।

মোহনলালকে ভবানী পাঠক বানানোর পেছনে, বঙ্কিমবাবু কি শুধুই, মিথের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়েছেন? যদিও বঙ্কিমবাবু, মোহনলালের নাম কোথাও লেখেননি। কিন্তু ভবানী পাঠকের চরিত্রের সঙ্গে মোহনলালের মিল প্রচুর।

হয়তো সেই সময়ে বাংলার গ্রামেগঞ্জে মোহনলাল আর মীরমদনের বীরগাথা গানের আকারে প্রচলিত ছিল—কিন্তু ইংরেজদের ভয়ে সেগুলোর চর্চা হতো না, ফলে সব হারিয়ে যায় কালক্রমে।

বঙ্কিমচন্দ্র এই সব শুনে থাকলেও, শুনে থাকতে পারেন। 

এটা তো ঠিক—জলপাইগুড়ি থেকে রংপুর যাওয়া যেত, তিস্তা নদী দিয়ে।

জলপাইগুড়ি থেকে রংপুর, তিস্তা নদী দিয়ে দেবী চৌধুরানীর ক্ষিপ্র গতির বজরা যেত। মানুষ তখনই একজনকে দেবতা হিসেবে মানে, যখন তারা তার কারণে কারও অত্যাচারের হাত থেকে বেঁচে বাংলাদেশের রংপুর জেলার— পীরগাছা উপজেলা কার্যালয় ও পীরগাছা রেলওয়ে স্টেশনের অনতিদূরে দেবী চৌধুরাণীর জমিদার বাড়ি এখনো আছে। পীরগাছার স্থানীয় লোকজন মন্থনার জমিদার বাড়িকে রাজবাড়ি বলে ডাকে। রাজবাড়ির চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন ছোট বড় অনেক পুকুর। 

বাড়ির পিছনে ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে দেবী চৌধুরানীর খনন করা ঢুসমারা খাল অর্থাৎ হঠাৎ বা অকস্মাৎ সৃষ্টি খাল। দেবী চৌধুরানী এ খাল দিয়ে নৌকাযোগে নদী পথে বিভিন্ন গোপন অবস্থায় যাতায়াত করতেন ।

বিশাল এলাকা নিয়ে ছড়ানো ছিটানো এ রাজবাড়ির অসংখ্য দালান আজ ধ্বংসপ্রায়। দালানের ইট, পাথর ও সুড়কি খুলে পড়েছে। দেওয়ালের জীর্ণতা ও শেওলার আঁচড়ে পরগাছার রমরমা। 

ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজবাড়ির নাটমন্দির ও কাচারি ঘরটি বর্তমানে বাংলাদেশের পীরগাছা উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজবাড়ির ভিতরে নির্মিত প্রাচীন মন্দিরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। জমিদার জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ রায় বানিয়েছিলেন অপূর্ব কারুকার্য মণ্ডিত দেড় শতাধিক বছরের পুরানো দৃষ্টি নন্দিত ত্রিবিগ্রহ মন্দির। এখন ধ্বংসের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

সম্পূর্ণ কল্পনা হলে, আজও দেবী চৌধুরানী এবং ভবানী পাঠক পূজিত হতেন না জলপাইগুড়ির শিকরপুর চা বাগানে। 

মন্দির থেকে এটা অন্তত বোঝা যায়, বঙ্কিমের উপন্যাস দেবী চৌধুরানী গল্প নয়, হতে পারে কল্পনার মিশেল আছে। সে ভবানী পাঠক—মোহনলাল হন চাই নাই হন। নিজামতের (সরকারি দপ্তর) প্রায় সব দলিলই ইংরেজরা নিয়ে গেছিল, বিলেতে আর সেগুলোর পাঠোদ্ধার একরকম দুঃসাধ্য, কারণ এতই জরাজীর্ণ অবস্থা ছিল, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। ইংরেজরা ইচ্ছে করেই এসব মূল্যবান দলিলের এই অবস্থা করে।   

‘The Office of Indian Records being unfortunately in a damp situation, the ink is daily fading, and the paper moldering into dust— 
Preface to Stewart’s History of Bengal, 1813.’  

১৮১৩ সালেই যদি এই অবস্থা হয়ে থাকে, তবে ২০১৯-এ কী অবস্থা হয়ে আছে, দুর্ভাগ্যবশত সেটা কেউ জানে না ।

তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস মোহনলালই ভবানী পাঠক। প্রমাণ করা এখন অসম্ভব।

তথ্যঋণ
প্রয়াত ঐতিহাসিক অমলেন্দু দের লেখা, সিরাজের পুত্র এবং বংশধরদের সন্ধানে এবং নেটের বিভিন্ন সাইট।


রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল প্রাবন্ধিক। তিনি কর্মজীবনে ঔষধ বিপণন আধিকারিক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে অন্যতম : চাপড় ঘণ্ট, বেচু বাবু। সম্পাদিত গ্রন্থ : নুনেতে ভাতেতে। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।

menu
menu