‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ ও দেশান্তরের  পটভূমিকায় দলিত উদ্বাস্তু অবস্থান

বিগত এক দশক ধরে চলতে থাকা দলিত সাহিত্যের সংজ্ঞা, চর্চা-প্রচার এবং প্রসারের ইতিহাসটি বর্তমান ভারতীয় সাহিত্যে ভীষণভাবে লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে, দলিত আন্দোলন, দলিত সংগঠন, দলিত লেখক, এবং সর্বোপরি দলিত সাহিত্যের প্রেক্ষাপটটি বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আলোচনাতেও এক  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার অন্যদিকে দলিত সাহিত্যের উত্থান, লক্ষ্য ও ক্রমবিকাশের ইতিহাসে দলিত আন্দোলনের অবদানও অনস্বীকার্য। দলিতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ম্যেসি বলেছেন, ‘the term “dalit” has also its parallel in Hebrew with the root “daal” means low, weak, poor, helpless etc.’ (Christian Dalits: A Historical Perspective), অর্থাৎ আর্থিক ও সামাজিক বিন্যাসে যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষ দীর্ঘকাল সমাজের তলানিতে থেকেছেন কিংবা থাকতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরাই তাঁদের আত্মকথন দিয়ে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখে নির্মাণ করে চলেছেন সাহিত্যের এক নতুন ধারা (বিশ্বাস, ১৩)।

আবার এই নতুন সাহিত্যের ধারা শুধুই শিল্প ও সৃজন কেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় মেতে নেই, বরং মানব কল্যাণের সার্বিক বিকাশের দিকটি নিয়েও সচেতন। এই জন্যই এ সময়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ‘দলিত সাহিত্য’র আন্দোলন, যা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সমাজ-বদলের বৈপ্লবিক চেতনা দিয়ে বদল করে নিতে চাইছেন জাতির চিরায়ত মন ও মননকে (বিশ্বাস, ১৮)। তাই, দলিত সাহিত্য হলো এমন একটি সাহিত্যবর্গ যা সমাজের জাতিগত দলন, সাংস্কৃতিক দলন, অর্থনৈতিক দলন, জাত-লাঞ্চছনা ও অস্পৃশ্যতার অভিশাপে তলিয়ে যাওয়া মানুষের মর্যাদা লাভের লড়াই। শ্রেণি-শোষণ এবং বর্ণাশ্রমকে যুগপৎ আক্রমণ করে এই সাহিত্যের বিকাশ ও অগ্রগতি কোনো তাৎক্ষণিক চমকের বিষয় না, বরং অস্পৃশ্যতার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া জীবনের আত্মকথা পাঠক সমাজে তুলে ধরা ও তার তীব্র প্রতিবাদ করাও এই সাহিত্যের অন্যতম লক্ষ্য। তাই বলা যায়, দলিত আত্মকথন দলিত সাহিত্যের আন্দোলনে এক প্রতিবাদী ক্ষেত্র। মানবসভ্যতার বিবর্তনে মানুষ যখন খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদক হয়ে উঠল তখনই তারা স্থায়ী গোষ্ঠী গঠন করল, যা পরবর্তীকালে আবার বিবাহ ও জাতিত্বের বন্ধন দ্বারা শক্তপোক্ত হয়েছিল।

বহু উপজাতি বা জনজাতি গোষ্ঠী প্রাগার্য সময়েও ছিল। তাই, আর্যদের আগমনের আগে যেসব জনগোষ্ঠী ছিল তাদের আর্যরা ‘দস্যু’ ও ‘দাস’ নামে অভিহিত করে (সেন, ১১)। আর্য-অনার্য ভাগ ছাড়াও আর্য গোষ্ঠী-প্রধানদেরও বড়ো বড়ো যৌথ পরিবারের সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছিল। তখনো জমির মালিক ছিল জনজাতি গোষ্ঠী অথবা একান্নবর্তী কুল বা গোত্রগুলো। এগুলো থেকেই পরে নানা বংশের সৃষ্টি হয়েছিল এবং এভাবেই বস্তুগত পরিপ্রেক্ষিত বদলের ফলে ভেদাভেদ এবং বৈষম্যের প্রতিফলন ঘটে বর্ণ প্রথায়। এই প্রথায় বৃত্তি ও কর্মকে জুড়ে দেবার কথা বলা হলেও, উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটত। এরফলে, ক্রমশই শূদ্রের অবস্থান হীন থেকে হীনতর হতে থাকে ও গুপ্তযুগের পূর্বেই অনেক দৈহিক শ্রমের কাজকে ঘৃণ্য মনে করে ব্রাহ্মণরা অস্পৃশ্যতার ধারণা তৈরি করে (সেন, ১২)। এই অস্পৃশ্যতার আগুনে দীর্ঘদিন জ্বলতে থাকা জীবনের গল্পই দলিত আত্মকথন রচনার এক অন্য উদ্দেশ্য। তাই বলা যায়, দলিত আত্মকথন এক অন্য জীবনের গল্প বলে। 

হাজার বছর ধরে নিষ্পেষিত, অবহেলিত মানুষের গল্প কোনো ইতিহাসে বা কোনো সাহিত্যে তেমনভাবে আলোকপাত হয়নি। এমনকি উনিশ শতক থেকে সচেতনভাবে গড়তে থাকা বাঙালি জাতির ইতিহাসেও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত মানুষই স্থান পায় না। ভারতীয় জাতিব্যবস্থার কাঠামোতে একদম নিচে থাকা মানুষ, তাদের বাস্তবতা, তাদের ইতিহাস বাঙালির প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে, ঐতিহ্যে অনুপস্থিত হয়েই থাকল। তারা ‘শূদ্র’, ‘চণ্ডাল’, ‘অস্পৃশ্য’, ‘প্রান্তিক’, ‘ছোটলোক’ বলেই চিহ্নিত হয়ে থাকল। তাই উনিশ শতকের শেষের দিকে ‘চণ্ডাল’ পরিচয় বিলোপের জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয় তা মূলধারার ইতিহাসে স্থান পায় না। মূলধারার বাংলা সাহিত্যে অনেকসময় ‘দলিত জীবন’ সাহিত্যে প্রকাশিত হয় বটে, তবে তা আসে সহানূভূতির রসে সিঞ্চিত হয়ে। বাস্তব দলিত জীবনের অভিজ্ঞতার কথা অনুচ্চারিতই থাকে (প্রামাণিক, ৩৫৫)। খুব ভালোভাবে এখনো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাঙালির ঐতিহ্যময়ী পত্রিকা দেশ-এ দলিত জীবন, দলিত ইতিহাস নিয়ে আলোচনা সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে, সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছাতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমাজ চেতনার বিকাশও ঘটতে থাকে।

এরই ফলস্বরূপ,  বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ধীরে ধীরে সারা ভারতে দলিত অস্তিত্ব নিয়ে দলিত মানুষেরাই ভাবতে থাকে। জ্যোতিবা ফুলে, পেরিয়ার, আম্বেদকর, গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতো মহর্ষিরা এই জাগরণের পথ দেখানোর দায়িত্ব নেয়। অবশেষে দলিত মানুষেরা নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই নতুন করে তৈরি করতে চাই তাদেরই লেখা আত্মকথা বা আত্মজীবনীকে হাতিয়ার করে। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু দলিত আত্মজীবনী যেমন কল্যাণী ঠাকুরের কেন আমি চাঁড়াল লিখি, বেবী হালদারের আলো আঁধারী, মনোহরমৌলি বিশ্বাসের আমার ভুবনে আমি বেঁচে থাকি, বনমালী গোস্বামীর অবর বেলায় পাড়ি ইত্যাদি দলিত সাহিত্যের পরিসরে বহুআলোচিত ও বহুপ্রশংসিত। এখানে বেশিরভাগ আত্মকথনগুলিতে দলিতে লেখক তাদের নিজেদের যন্ত্রণা, অপমানের কাহিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখা ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন-এ লেখক যেমন তার দলিত জীবনের অভিজ্ঞতা, অসহায়তা ও সংগ্রামের কথা বলে গেছেন, তেমনই তার লেখায় উঠে এসেছে ১৯৫০-এর দেশান্তরের পটভূমিকায় তলিয়ে যাওয়া এক উদ্বাস্তু দলিত সমাজের ইতিহাস।

স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সুলুক-সন্ধান করলে দেখা যাবে যে, দেশভাগ পরবর্তীকালের দাঙ্গা ও উদ্বাস্তুদের দেশান্তরের সমস্যায় জাতপাতের আলোচনা প্রাধান্য পায়নি। আরও বলা যায়, বাস্তুহীনদের দেশান্তর ও পুনর্বাসনের সমস্যার আড়ালে চাপা পড়ে যায় এক বড় অংশের দলিত সমাজের মানুষের ভোগান্তি। তাই, ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন-এ বর্ণিত বাংলার প্রেক্ষিতে দেশভাগ এবং পুর্নবাসনের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া সেই অচ্ছুৎ অস্পৃশ্য দলিত সমাজের ইতিহাসকে তুলে ধরাই হলো এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশের আলোচনা। 

ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বইটির প্রথম খণ্ডের সূচনাতেই শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘বইটি পড়ে মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎচমক তৈরি হয়েছিল। আঘাতে আর দীপ্তিতে পূর্ণ এ রকম একখানা বই লিখলেন সমাজের একজন অবহেলিত মানুষ, লিখলেন তাঁর নিজের কটূ—কিন্তু অপরাজেয়—অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ রুপটি।’  দলিতের আত্মকথন বোধহয় এমনই  ‘অভিজ্ঞতার’ গল্প শোনায়, যা ‘কটূ’ অথচ ‘অপরাজেয়’, যা সত্য অথচ অবিশ্বাস্য। এই প্রসঙ্গে লেখক নিজেই বলেছেন, ‘আত্মজীবনীর এই এক মস্ত অসুবিধা—কোন আড়াল থাকে না’। আসলে আত্মকথন সেই সত্য সামনে আনে, যে সত্যের শরীরে কোন পোশাক থাকে না। দলিত আত্মকথন সেই অভিজ্ঞতার কথা বলে, যা শুধু ব্যক্তির না, সমগ্র জাতিরও। লিম্বালের মতে, ‘এই অভিজ্ঞতা বিশেষ জাতির বিশেষ অভিজ্ঞতা। এইজন্য এই অভিজ্ঞতা একজন ব্যক্তির হয়েও তা সমগ্র জাতির।’ 

ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন-এর লেখার শুরুতেই লেখক দৃঢ়প্রত্যয়ে জানিয়েছেন তাঁর জন্ম ‘জন্মগত কারণে অপরাধী ঘোষিত অচ্ছুত অস্পৃশ্য এক দলিত পরিবারে’। বরিশালে জন্ম হলেও দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে আসেন। অনান্য বাস্তুচ্যুত পরিবারের মতো তাদেরও উদ্বাস্তু জীবন শুরু হয়। আর এই উদ্বাস্তু জীবনে বা ক্যাম্প লাইফে চলাকালীন যে উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ রাজনীতি তার এই জলন্ত চিত্রই লেখক তাঁর আত্মকথনে তুলে ধরেছেন। লেখার শুরুতেই লেখক নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার প্রসঙ্গে বলছেন, ‘অপমান, ঘৃণা হিন্দুধর্মে উচ্চবর্ণের নিকট থেকে নমঃশূদ্ররাও পেয়ে থাকে। তাকে ছুঁয়েও ওরা চান করে, উঠোনে দাঁড়ালে গোবর জল ছেটায়। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্ররা তেমন কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। কিন্তু মুসলমানরা পেরেছে। খেপে গেছে তারা, যে ধর্ম—যে মানুষ আমাদের ঘৃণা করে আমরা আর তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি নই।

এই কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভয়ে আতঙ্কে—অসুরক্ষায়, ভিটে মাটির মায়া ছেড়ে, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মানুষ ‘ইন্ডিয়া’ নামক এক অচেনা ভূভাগের দিকে’। এভাবেই এক দলিত পরিবারের উদ্বাস্তু জীবনের গল্প শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে লেখক বলছেন, ‘উচ্চবর্ণের যেখানে টিকে থাকা দায়, সেখানে নিম্নবর্ণ থাকবে কি করে, যারা শিক্ষিত, আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল, সমাজের মাথা, উচ্চবর্ণের লোক তাদের সবাই পালিয়েছে সবার আগে। যে দু পাঁচ জন আছে তারাও সব পালাই পালাই করছে। এই অবস্থায় যারা নির্ধন নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ তারা সেদেশে বাস করবে কোন সাহসে?’ বলাবাহুল্য, অনিচ্ছাকে সয়ে নিয়ে, নিজের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির দয়ামায়া স্নেহমমতা পাশ কাটিয়ে যখন হাজার হাজার পরিবার শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য অন্যদেশে পাড়ি দিচ্ছে, তখনো সেখানে মানুষের জাত পরিচয়  তার ক্ষমতার একমাত্র পরিচায়ক হয়ে  উঠছে। এরপরেই ক্যাম্প জীবনের কথা লেখক বলছেন।

শুরুতেই শিরোমণি ক্যাম্পের বর্ণনা করছেন, যেখানে—‘হাত আটেক লম্বা হাত ছয়েক চওড়া সেই তাঁবুর মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়েছে পাঁচ ছয় সাত সদস্যের এক একটা পরিবার”, যেখানে তীব্র দাবদাহে প্রবল জলকষ্ট ছিল নিত্যদিনের সাধারণ ব্যাপার, যেখানে ‘ডোল’ থেকে পাওয়া চালে অস্বাস্থ্যকর বোটকা গন্ধ ছড়ানো ভাত ছিল তাদের একমাত্র খাদ্য, যেখানে সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কান্না ছিল নিত্যদিনের সাধারণ দুঃখ। এ প্রসঙ্গে আরও বলছেন—

‘রিফিউজি ক্যাম্পগুলো ছিল একটা বদ্ধ জলাশয়ের মতো নিথর নিশ্চুপ নির্জীব। মানুষগুলোর চোখের মনিতে কোন আলো আশা ঔজ্জ্বল্য ছিল না। মুখে ছিল না গল্প গান হাসি কথা। সব যেন তখন হতাশায় দড়িবাঁধা জাবরকাটা গরুর মতো ধুঁকছে।’ লেখা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে এরকম নারকীয় অবস্থার বর্ণনা আমরা আরও পেতে থাকি। এরপরের ঘটনা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে যখন লেখক এই উচ্চবর্ণীয় উদ্বাস্তুদের করা নোংরা রাজনীতির সত্যতা দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘যে মানুষ দেশভাগ জনিত কারণে বাঁধভাঙা বন্যার জলের মতো একান্ত বাধ্য হয়ে আছড়ে পড়েছিল এপার বাংলায়, এই সব ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে ছিল স্পষ্টতঃ দুটো ভাগ। একভাগ সচ্ছল শিক্ষিত উচ্চবর্ণ – এককথায় যাদের বলা হয় ভদ্রলোক। আর একদল হলো নিঃস্ব, নিরক্ষর, নির্ধন, নিম্নবর্ণ যারা তথাকথিত ভদ্র লোকদের কাছে ছোটজাত ছোটলোক। যারা ভদ্রলোক তারা তাদের চিরকালের বর্ণবিদ্বেষ প্রসূত মানসিকতার কারণে নমঃ পোঁদ জেলে কামার কুমোর জোলা হাড়ি মুচি মানুষদের সাথে সহাবস্থানে রাজি ছিল না। তাই তারা কেউ খাতায় নাম লিখিয়ে ডোল নির্ভর ক্যাম্প বাসিন্দা হতে চায়নি।’ লেখকের এই বক্তব্যটি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এটি প্রমাণ করার জন্য যে জাতিবিদ্বেষ এমনই এক মানসিকতা যা নিজের ভিটেমাটি ছাড়ার যন্ত্রণাকে ছাপিয়েও সমানভাবে নিজ ক্ষমতায় অবস্থান করে। শুধু তাই নয়, এই উচ্চবর্ণীয় রিফিউজিদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও আত্মস্বার্থগত অবস্থানকে ভালোভাবে বোঝানোর জন্য লেখক আরও বলছেন, ‘এরা সরকারের স্বজাতের নেতা মন্ত্রীদের সমর্থন সহযোগিতায় কলকাতা ও তৎসংলগ্ন নানা অঞ্চলে একের পর এক প্রায় দেড়শত জবরদখল কলোনি গড়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

কিছু লেখাপড়া জানা থাকার কারণে কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগের ফলে, কিছু জাতিগত ধূর্ততা শঠতার কৌশলে চাকরি ব্যবসা বা অন্য কোন উপায়ে রুজিরোজগার ধনাগমের সুব্যবস্থা করে নিতে বিশেষ কোনো অসুবিধার সামনে পড়েনি। এরা সুখেই ছিল এবং সত্য এটাই যে অনেকে এত সুখ পূর্ববাংলায়ও ভোগ করতে পারেনি।’  যেখানে উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকেরা জবরদখল কলোনিতে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে, সেখানে লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্ণের মানুষেরা নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে রিফিউজি ক্যাম্পে। এবার প্রশ্ন রয়েই যায়, এখানে দুপক্ষই তো বাস্তুহারা, তারপরেও কেন এমন বিভাজন? এর উত্তরেও লেখক জানাচ্ছেন, ‘কারণ কোথাও কোন জবরদখল কলোনিতে নীচু জাত হবার অপরাধে এদের জন্য কোন প্লট দেবার নিয়ম ছিল না।’  অতএব বলাই যায়, এমন উথালপাথাল অস্থির সময়েও দলিতরা পুনরায় জাতপাতের স্বীকার হয়। ভাবতে অবাক লাগে, দেশ ছেড়ে আসার যন্ত্রণা বুকে নিয়েও যখন জাতিবিদ্বেষের বিভীষিকা থেকে এই অসহায় দলিতরা মুক্তি পায় না, তারপরেও কি অদম্য প্রাণ শক্তি নিয়ে এই ‘ছোট জাত’ মরতে মরতে উঠে আসে। এরপরেও তারা আবারও অস্তিত্বের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপরেও তারা একচিলতে জমি পেলে ঘর বাঁধে। 

শরণকুমার লিম্বালে তাঁর দলিত নন্দন্তত্ত্ব গ্রন্থে বলছেন, ‘দলিতের দুঃখ, তার হয়রানি, তার দাসত্ব, অধঃপতন, ব্যঙ্গ, দরিদ্রতা ইত্যাদির শৈল্পিক প্রকাশ যে সাহিত্যের মধ্যে দেখা যায়, তাকেই বলব দলিত সাহিত্য। এই সাহিত্যে যন্ত্রণার এক উদ্দাত্ত প্রকাশ।’  আর এই যন্ত্রণাই যখন প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে ওঠে, তখনই তা দলিত সাহিত্য আন্দোলনের এক অন্য ইতিহাস রচনা করে। ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন এ লেখক শুধুমাত্র বাস্তুচ্যুতির পরবর্তী সময়ের ‘ট্রমা’র কথা বলেই থেমে জাননি, বরং তীব্রকণ্ঠে শাসকশ্রেণির ঔদাসীন্যের প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মরিচঝাঁপির দ্বীপে তাদের ওপর চলা পৈশাচিক অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলছেন, ‘একই কারণে একদেশ থেকে একই সময়ে বিতাড়িত হওয়া একদল মানুষ।

যাদের একদলকে জামাই আদরে কলকাতা শহরের মধ্যে বহুমূল্য জমি বিনা বাধায় দিয়ে দেওয়া হলো। আর একদল মানুষকে সুদূর সুন্দরবনের এক দ্বীপ মরিচঝাঁপির নামমাত্র মূল্যের জমি থেকে নৃশংসতায় হত্যা ধর্ষণ অগ্নি সংযোগে লুঠপাট দ্বারা ভীত সন্ত্রস্ত্র করে উৎখাত করে দেওয়া হলো।’ সঙ্গে আরও বলেছেন, ‘এখন একটাই প্রশ্ন, শাসকশ্রেণী দু দল মানুষের প্রতি এই দু-ধরনের মনোভাব কেন দেখিয়ে ছিল? এর পিছনে রয়েছে সেই চিরকালীন বর্ণঘৃণা।’ এভাবেই দলিত আত্মকথন দলিত সাহিত্যে তার প্রতিবাদী ক্ষেত্র তৈরি করে, কখনো জাত-পাত-বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, তো কখনো দমন-পীড়ন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আবারও বঞ্চিত কণ্ঠের রোমাঞ্চিত ইতিহাস এভাবেই যুগে যুগে রচিত হয়। 

উদ্বাস্তু-জীবন-সাহিত্যে ভিটেমাটি ছেড়ে আসা মানুষদের অসহায়তা, ক্যাম্প জীবনের ভয়াবহতা, শিশু মৃত্যুর ঘটনা, নারী নির্যাতনের কাহিনি কোনো নতুন ইতিহাস নয়। কিন্তু, রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনে দলিত জীবন ও জাতপাতের আলোচনা নেই বললেই চলে। এমনকি রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে দেশান্তরিত মানুষদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যা সৃষ্টিশীল কাজ বা গবেষণা হয়েছে, তার সিংহভাগই দেশভাগের অব্যবহিত পরে চলে আসা মূলত বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে। ‘চাঁড়াল’, ‘চণ্ডাল’, ‘নিম্নবর্ণ’ বা ‘দলিত’ অভিধায় পরিচিত মানুষদের নিয়ে নয় (প্রামাণিক, ৫৬৩)। তাই অবশেষে বলা যায়, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বর্ণ-প্রশ্ন ও দলিত উদ্বাস্তুদের আলোচনাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে বাংলার প্রেক্ষিতে দেশান্তরের ইতিহাসকে এবং দলিত আন্দোলনের ইতিহাসকে সফলভাবে সংযুক্ত করতে পেরেছে। 

এভাবেই কালের গতিতে ইতিহাসও তার প্রকাশের পথ খুঁজে নেয়। শত বিষাদ, পরাজয়, যন্ত্রণা, মৃত্যুভয়, জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদের সুদূরপ্রসারী স্মৃতি নিয়েও দলিতরা তাদের বঞ্চনার ও প্রতিবাদের ইতিহাস রচনা করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে, গুরুদাস বিশ্বাসের একটি কবিতা উল্লেখ না করলেই নয়, 

“শুদ্র ধরেছে রুদ্র মূর্তি অতীব ভয়ংকর
শত বন্ধন ছিন্ন করিয়া দলিত বেঁধেছে জোট
বিধাতার বরে গণতন্ত্রে হাতে শাণিত অস্ত্র ভোট
কেড়ে নেবে আজ সিঙ্ঘ-শাসন
মানিবে না আর মিথ্যা শাসন
অযুত সেনানী মিলেছে আহবে মানে না শঙ্কা ডর।”(প্রামাণিক, ৫৭৭)


তথ্যসূত্র  
১. বিশ্বাস, মনোহর, দলিত সাহিত্যের রুপরেখা, বাণীশিল্প, কলকাতা, ২০০৭ ।
২. ব্যাপারী, মনোরঞ্জন, ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন (প্রথম পর্ব এবং দ্বিতীয় পর্ব), ওয়েস্টল্যান্ড পাবলিকেশন, ২০১৯।
৩. প্রামাণিক, মৃন্ময়, দলিত সাহিত্য চর্চা, গাঙচিল, ২০২২।
৪. লিম্বালে, শরণকুমার, দলিত নন্দনতত্ত্ব, অনুবাদ, মৃন্ময় প্রামাণিক, ২০১৭।
৫. সেন, সুজিত, জাতপাত ও সংরক্ষণ : ভারতীয় প্রেক্ষাপট, গ্রন্থমিত্র, ২০০৮।
৬. Dasgupta, Sayantan, Dalit Writing in Bangla: Repression and Resistance in Manoranjan Byapari and Manju Bala’s Narratives, JJCL, vol.46, 2008-2009. 
৭. Bandopadhyay, Sekhar, & Anasua Basu Ray Chaudhury, Caste and Partition in Bengal: The Story of Dalit Refugees, 1946-1961., Oxford University Press, 2022. 
৮. Singh, Bijender, Dalit Women’s Autobiographies: Convergences and Divergences, Kalpaz Publication, 2021.


রিনা বিশ্বাস প্রাবন্ধিক এবং গবেষক। তিনি পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।

menu
menu