জর্জ অরওয়েল : জীবন ও পুনর্পাঠ

‘সবসময় আমার সূচনা বিন্দুটি হয়ে থাকে এক প্রকার অংশীদারিত্বের অনুভূতি ও এক প্রকার বিচারহীনতার বোধ থেকে। আমি যখন লিখতে বসি, তখন আমি নিজেকে কখনো বলি না, “আমি একটি শিল্পকর্ম তৈরি করতে যাচ্ছি”। আমি এটি লিখছি কারণ কিছু মিথ্যা আছে যা আমি প্রকাশ করে যেতে চাই। কিছু সত্য আছে যার প্রতি আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। পাশাপাশি আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে শ্রুতিতে নিয়ে আসা। যদি এটি একটি নান্দনিক অভিজ্ঞতাই না হতো তাহলে আমি একটি বই তো দূরে থাক সাময়িকপত্রে একটি দীর্ঘ নিবন্ধও লিখতে পারতাম না।’
—জর্জ অরওয়েল (আমি কেন লিখি?)   

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক জর্জ অরওয়েল। অ্যানিমেল ফার্ম এবং নাইনটিন এইটি ফোর গ্রন্থের স্বপ্নদর্শী লেখক এবং প্রত্যক্ষদর্শী, নন-ফিকশন ধ্রুপদী গ্রন্থ ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন, দ্য রোড টু উইগান পিয়ার এবং কাতালোনিয়ার স্রষ্টা। অরওয়েলের ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে তিনি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিজের ভাবনার মতোই অত্যন্ত অসামান্য এক ব্যক্তি। অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের মতো, লেখক কেবল একজন ব্যক্তি হিসেবেই নয়, একজন লেখক হিসেবেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। তিনি 'শীতল যুদ্ধ' শব্দটি রাজনৈতিক ভাষায় প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পাঠকদের নিকট তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে রয়েছে তাঁর প্রচুর নামডাক। তাঁর কালজয়ী গল্প লেখার আকাঙ্ক্ষা কোথা থেকে তৈরি হলো, বিষয়টি জানতে তাঁর জীবনীর মাধ্যমে একটি ছোট ভ্রমণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, খুব কম লোকই জানেন অরওয়েলের আসল নাম কী। 'জর্জ অরওয়েল'-এই ছদ্মনামের আড়ালে কালোত্তীর্ণ ভুবন বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক লেখকের প্রকৃত নাম এরিখ আর্থার ব্লেয়ার। অরওয়েল কখনই তাঁর আসল নাম পুরোপুরি ত্যাগ করেননি। ১৯৩৩ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন গ্রন্থের রচয়িতার নাম জর্জ অরওয়েল ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। এই নামের উপাধিটি তিনি পূর্ব অ্যাঙ্গলিয়ার সুন্দর নদী ‘অরওয়েল’ থেকে নিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই ছদ্মনামটিই তাঁর সঙ্গে গেঁথে যায়। নিকট আত্মীয় ছাড়া খুব কম লোকই জানতেন যে তাঁর আসল নাম এরিখ আর্থার ব্লেয়ার। নামের পরিবর্তনটি অরওয়েলের জীবনধারায় একটি গভীর পরিবর্তন তৈরি করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার একজন রক্ষক থেকে তিনি সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহীতে রূপান্তরিত হন।

এরিক আর্থার ব্লেয়ার অর্থাৎ আমাদের জর্জ অরওয়েল ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন তারিখে ব্রিটিশ ভারতের মতিহারীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ চার্লস ব্লেয়ার ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত ধনী এবং ডরসেটের জ্যামাইকান প্ল্যান্টেশনের অনাবাসী মালিক। ওয়েস্টমোরল্যান্ডের অষ্টম আর্লের মেয়ে লেডি মেরি ফেনকে বিয়ে করেছিলেন চার্লস ব্লেয়ার। অরওয়েলের পিতামহের নাম থমাস রিচার্ড আর্থার ব্লেয়ার। তিনি ছিলেন একজন অ্যাংলিকান ধর্মযাজক। অরওয়েলের পিতা রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার ছিলেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আফিম বিভাগে একজন সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট। চীনে বিক্রির জন্য আফিম উৎপাদন ও মজুদ করার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তিনি। অরওয়েলের মা, ইডা মেবেল ব্লেয়ার বার্মার মৌলমেইনে বেড়ে ওঠেন। ইডার ফরাসি বংশোদ্ভূত পিতা সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অরওয়েলের দুটি বোন ছিল। জ্যেষ্ঠ বোনটি মার্জোরি তার পাঁচ বছরের বড় এবং তার পাঁচ বছরের ছোট কনিষ্ঠ বোনটির নাম এভ্রিল। অরওয়েলের বয়স যখন এক বছর তখন তার মা তাকে এবং মার্জোরিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। ১৯০৪ সালে ইডা ব্লেয়ার তার সন্তানদের সঙ্গে অক্সফোর্ডশায়ারের হেনলি-অন-টেমসে বসবাস শুরু করেন। এখানেই অরওয়েল তার মা এবং বোনদের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন। ১৯১২ সাল পর্যন্ত তিনি তার বাবাকে দেখতে পাননি। পাঁচ বছর বয়সে অরওয়েলকে হেনলি-অন টেমসের একটি কনভেন্ট স্কুলে পাঠানো হয়। রোমান ক্যাথলিক এই কনভেন্টে তার বড়বোন মার্জোরিও পড়তেন। তার মা তাকে পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার পরিবার ফি বহন করতে সক্ষম ছিল না। ইডা ব্লেয়ারের ভাই চার্লস লিমুজিনের সামাজিক সুসম্পর্কের কারণে অরওয়েল পূর্ব সাসেক্সের ইস্টবোর্নের সেন্ট সাইপ্রিয়ানস স্কুলে বৃত্তি অর্জন করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য আবাসিক স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি, শুধুমাত্র অবকাশকালীন ছুটিতে বাড়িতে আসতেন। যদিও তিনি 'হ্রাসকৃত ফি' সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তবে তার বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি একটি দরিদ্র ঘর থেকে এসেছেন। ব্লেয়ার স্কুলটিকে ঘৃণা করতেন এবং বহু বছর পরে সেখানে তাঁর সময়ের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রবন্ধ ‘সাচ, সাচ উইয়ার দ্য জয়েস’ লিখেছিলেন। সেন্ট সাইপ্রিয়ানস-এ ব্লেয়ারের প্রথম দেখা হয় লেখক সিরিল কনোলির সঙ্গে। তিনি হরাইজন-এর সম্পাদক ছিলেন এবং অরওয়েলের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অরওয়েল এর পরিবার অক্সফোর্ডশায়ারের শিপলেকে চলে যায়। সেখানে এরিক বুডিকম-এর পরিবার ও বিশেষ করে তাদের মেয়ে জ্যাসিন্থার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাদের প্রথম সাক্ষাতের ক্ষণে তিনি একটি মাঠে মাথার উপর ভর দিয়ে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। উল্টো হয়ে কেন জানতে চাইলে তিনি জ্যাসিন্থাকে বলেন, ‘সঠিক স্বাভাবিক অবস্থার চাইতে উল্টো হয়ে মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়ালে অন্যদেরকে বেশি লক্ষ্য করা যায়।’  জ্যাসিন্থা এবং অরওয়েল কবিতা পড়েন এবং লেখেন এবং বিখ্যাত লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

তিনি প্রায়ই বলতেন যে এইচ জি ওয়েলস-এর এ মডার্ন ইউটোপিয়া-এর আদলে একটি গ্রন্থ রচনা করার স্বপ্ন তাঁর। সেন্ট সাইপ্রিয়ানসে থাকাকালীন, ব্লেয়ার দুটি কবিতা লেখেন যা হেনলি এবং সাউথ অক্সফোর্ডশায়ার স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা স্কুলের বহিরাগত পরীক্ষক দ্বারা প্রশংসিত হয় এবং তিনি ওয়েলিংটন এবং ইটনে বৃত্তি অর্জন করেন। কিন্তু ইটনে স্কলারশিপ লাভ করলেও থাকার বাসস্থানের নিশ্চয়তা ছিল না। ইটনে একটি বাসস্থান জোটানোর আগ পর্যন্ত তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সেন্ট সাইপ্রিয়ানে থেকে যান। জানুয়ারিতে তিনি ওয়েলিংটনে স্থানান্তরিত হন। এখানে তিনি বসন্তকালটি অতিবাহিত করেন। ১৯১৭ সালের মে মাসে ইটনে 'কিংস স্কলার' হিসাবে স্থান পান। এ সময় অরওয়েলের পরিবার নটিংহিল গেটের মল চেম্বার্সে বসবাস করত। অরওয়েল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ইটনে ছিলেন। বয়সটি তখন তাঁর ১৮ এবং ১৯ এর মাঝামাঝি। তাঁর প্রধান শিক্ষক ছিলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ ফেলো এ.এস.এফ. গো।  অ্যান্ড্রু সিডেনহ্যাম ফারার গো একজন ডাকসাইটে ইংরেজি শাস্ত্রীয় পণ্ডিত ও শিক্ষক। ১৯১৪ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে ইটন কলেজে মাস্টার হিসেবে এগারো বছর ছাড়াও কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তার কর্মজীবন সম্পূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়েছে। অরওয়েলের ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়েও তিনি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন। ইটনে অরওয়েলের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদ ও বহুভাষাবিদ স্টিভেন রানসিম্যান। এ সময় ইংরেজ লেখক এবং দার্শনিক অ্যালডাস লিওনার্ড হাক্সলি তাদেরকে সংক্ষিপ্তাকারে  ফরাসি ভাষা শেখান। রানসিম্যান উল্লেখ করেছেন যে তিনি এবং তাঁর সমসাময়িকরা হাক্সলির ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন।

স্টিভেন রানসিম্যান এর মতে, প্রাচ্য সম্পর্কে অরওয়েলের একটি রোমান্টিক ধারণা ছিল। তাই তাঁর পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় যে অরওয়েলকে ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের পূর্বসূরি ইম্পেরিয়াল পুলিশে যোগদান করা উচিত। এ জন্য তাঁকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি ইটন ছেড়ে চলে যান এবং ৪০ স্ট্র্যাডব্রোক রোড, সাউথওল্ড, সাফোকে বসবাসরত তাঁর অবসরপ্রাপ্ত বাবা, মা এবং ছোট বোন এভ্রিলের সঙ্গে মিলিত হন। তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পুলিশ বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় ২৬ জন কৃতকার্য প্রার্থীর মধ্যে তিনি সপ্তম হন। অরওয়েলের মাতামহী তখন বার্মার মৌলমেইনে থাকতেন, তাই তিনি বার্মায় পোস্টিং বেছে নিলেন। বার্মা তখনো ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি বার্মায় ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশে যোগদানের লক্ষ্যে সুয়েজ খাল এবং সিলন হয়ে যাত্রা করেন। এক মাস পর তিনি রেঙ্গুনে পৌঁছেন এবং মান্দালয়ের পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে হাজির হন। তিনি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ নভেম্বরে সহকারী জেলা সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন। বার্মার অন্যতম হিল স্টেশন মায়মিওতে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯২৪ সালের শুরুর দিকে তাঁকে ইরাবদি বদ্বীপের মায়াংম্যার সীমান্ত ফাঁড়ির দায়িত্ব দেয়া হয়। অরওয়েল যখন একজন ইম্পেরিয়াল পুলিশ অফিসার হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্বপূর্ণ কাজ করছেন তখন তার সমসাময়িকদের অধিকাংশই ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে তাঁকে রেঙ্গুনের কাছাকাছি সিরিয়ামে বদলি করা হয়। সিরিয়ামে 'বার্মা ওয়েল কোম্পানি'র একটি তেল শোধনাগার ছিল। আশেপাশের ভূমি ছিল একদম অনুর্বর মরুময়। শোধনাগারের স্তূপ থেকে অনবরত নির্গত হওয়া সালফার ডাই-অক্সাইডের ধোঁয়ায় সমস্ত গাছপালা মরে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর রেঙ্গুন শহরটি নিকটবর্তী হওয়ায় সুযোগ পেলেই তিনি শহরে যেতেন। একঘেয়েমি পুলিশের চাকরির ক্লান্তি কাটাতে তিনি বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতেন, রেস্তোরাঁয় ভাল রান্না চেখে দেখতেন। বার্মায়, তিনি তাঁর বেশিরভাগ সময় একা কাটিয়েছেন। তিনি কখনোই পুরোদস্তুর সাহেবিয়ানা দেখাননি। স্থানীয়দের ক্রিয়াকলাপ অনুসরণ করেছেন, যেমন কারেন জাতিগোষ্ঠীর গির্জায় যোগদান করা। ১৯৬৯ সালে বিবিসির জন্য  দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সহকর্মী রজার বিডন স্মরণ করেন যে অরওয়েল দ্রুততম সময়ে স্থানীয় ভাষা  রপ্ত করেছিলেন। তিনি বার্মা ছেড়ে যাওয়ার আগে বার্মিজ পুরোহিতদের সঙ্গে সাবলীলভাবে অনর্গল বার্মিজ ভাষায় কথা বলতে সক্ষম ছিলেন। অরওয়েল বার্মায় থাকাকালীন চেহারায় পরিবর্তন আনেন। উল্লেখযোগ্য একটি ক্ষুদ্র পেন্সিল গোঁফ রাখেন তিনি। তাছাড়াও বার্মিজ আদিবাসীদের অনুকরণে তিনি তাঁর শরীরে স্থায়ী কিছু ট্যাটুও আঁকিয়েছিলেন। বার্মিজ ডেজ-এর ভূমিকায় এমা লারকিন লিখেছেন, ‘বার্মায় থাকাকালীন, তিনি সেখানে অবস্থানরত ব্রিটিশ রেজিমেন্টের অফিসারদের কেতায় গোঁফ রেখেছিলেন।’ ১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মৌলমেইনে তাঁর মামার কাছে চলে আসেন। সেই বছরের শেষের দিকে, তাঁকে বার্মার উঁচু অঞ্চল কাথা'য় নিযুক্ত করা হয়, এখানেই ১৯২৭ সালে তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন। অসুস্থতার কারণে অর্জিত ছুটি নিয়ে সে বছর জুলাই মাসে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ইংল্যান্ডে ফেরার পর ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকার সময় অরওয়েল তাঁর জীবনকে পুনর্মূল্যায়ন করেন। তিনি বার্মায় আর ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শৈশব থেকে অরওয়েল  একজন লেখক হতে চেয়েছেন। লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যেই ১৯২৮ সালের ১২ মার্চ তিনি ইম্পেরিয়াল পুলিশ বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি অনুধাবন করেন যে, বর্মীরা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। তখন তিনি ঔপনিবেশিক পুলিশ অফিসার হিসাবে তাঁর ভূমিকার জন্য উত্তরোত্তর  লজ্জা বোধ করেন। পরে তিনি তাঁর বার্মিজ ডেজ উপন্যাসে এবং 'শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট' এবং 'আ হ্যাঙ্গিং'—এক্সপোজিটরি গদ্যের ক্লাসিক দুটি উজ্জ্বল আত্মজীবনীমূলক স্কেচে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। 

জর্জ অরওয়েল এর বার্মিজ ডেজ গ্রন্থে ১৯২০-এর দশকের বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) বসবাসরত কতিপয় ইংরেজদের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। তারা বার্মা অঞ্চলে যাপিত জীবনের তীব্র এবং অবর্ণনীয় একাকীত্ব দূর করার জন্য ইউরোপিয়ান ক্লাবে হুইস্কি পান করতে মিলিত হতেন। সেই সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ বার্মার উঁচু অঞ্চলের কিউকতাদা জেলায় এই গল্পের শুরু। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফ্লোরি, ৩৫ বছর বয়সী ইংরেজ কাঠ ব্যবসায়ী যিনি বার্মায় তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবন কাটিয়েছেন। নিঃসঙ্গ ফ্লোরির একজন জীবনসঙ্গিনী খুঁজে বেড়ানোর গল্প এবং কিউকতাদা ইউরোপীয় ক্লাবে প্রথবারের মতো জনৈক ন্যাটিভ সদস্যের অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে উপন্যাসটি আলোকপাত করে। ফ্লোরির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তার মুখের বাম পাশে একটি বড় অর্ধচন্দ্রাকৃতির জন্মদাগ। তিনি মাসের তিন সপ্তাহ জঙ্গল ক্যাম্পে অবস্থান করেন। ইংল্যান্ডে রপ্তানির জন্য সেগুনকাঠ উৎপাদনের তত্ত্বাবধান করাই তার দায়িত্ব। বাকি সপ্তাহটা তিনি শহরে কাটান, যেখানে তার জীবন ইউরোপিয়ান ক্লাবকে কেন্দ্র করে। ফ্লোরির প্রগতিশীল মতাদর্শ এবং বার্মিজ সংস্কৃতির প্রতি তার ভালোবাসার কারণে তিনি ক্লাবে একজন বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ক্লাবের অন্যান্য সদস্যরা, বিশেষ করে উগ্র বর্ণবাদী এলিস তাকে উত্যক্ত করে। মা-হ্লা-মে নামে ফ্লোরির একজন বার্মিজ উপপত্নী থাকা সত্ত্বেও তিনি নিদারুণভাবে একাকীত্বে ভোগেন। তিনি একজন ইউরোপীয় স্ত্রীর অন্বেষণ করেন যে তার মতো করে এদেশকে ভালোবাসবে এবং এহেন ভয়ঙ্কর জীবন থেকে তাকে রক্ষা করবে। এখানে ফ্লোরির একমাত্র বন্ধু ভারতীয় শল্যচিকিৎসক ডক্টর ভেরাস্বামী, একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে ফ্লোরি খোলামেলা নিজের সব কথা বলতে পারেন। তাদের কথোপকথনের সময় ফ্লোরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে চুরির বাহন হিসেবে সমালোচনা করেন যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফ্লোরির এই ধারণা সাম্রাজ্যের একজন কট্টর রক্ষক ভেরাস্বামীকে আন্দোলিত করে। উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র, দুর্নীতিবাজ এবং চক্রান্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট ইউ পো কাইন। একজন ন্যাটিভ সদস্য নির্বাচন করার বিষয়ে ক্লাবের সিদ্ধান্ত জানতে পেয়ে সে নিজের স্বার্থরক্ষায় ডাক্তার ভেরাস্বামীর প্রতিপত্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র করে।

গল্পের মধ্যে মিস্টার এবং মিসেস ল্যাকারস্টিনের অনাথ ভাইঝি সুন্দরী তরুণী এলিজাবেথের আগমন ফ্লোরির একাকীত্ব দূর করে।  তিনি মা-হ্লা-মেকে তার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। ঘটনাচক্রে এলিজাবেথকে একটি বুনো মহিষের কবল থেকে রক্ষা করার পর ফ্লোরি তাকে প্রণয় নিবেদন শুরু করেন। ফ্লোরির শিল্পের প্রতি বেশি ভালোবাসা এবং বার্মিজদের রটানো কুৎসা  সত্ত্বেও এলিজাবেথ নিজের দারিদ্র্য এবং যৌন নিপীড়ক কাকার হাত থেকে রেহাই পেতে ফ্লোরির পূর্বরাগকে উপভোগ করে। ফ্লোরি বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাবেন এমন সময় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এর কিছুসময় পরেই উপন্যাসে ভেরাল নামের একজন সুদর্শন ও অভিজাত অশ্বারোহী সামরিক অফিসারের আগমন ফ্লোরির সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয়। এলিজাবেথ তখন ফ্লোরিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়ে ধনী এবং অহংকারী অফিসার ভেরালের বাহুলগ্না হয়। ওদিকে, ম্যাজিস্ট্রেট ইউ পো কাইন ডাক্তার ভেরাস্বামীর বিরুদ্ধে তার অপপ্রচার অব্যাহত রাখে। কাইন ডাক্তারকে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে বেনামী চিঠি পাঠায়। কাইন একটি কৃত্রিম বিদ্রোহ সংগঠিত করে তা দমনের কৃতিত্ব নেয়। বিদ্রোহকালে বন কর্মকর্তা ম্যাক্সওয়েল জনৈক ন্যাটিভ বিদ্রোহীর পিঠে গুলি করে। এর পর দেখা যায়, ফ্লোরি ডাক্তার ভেরাস্বামীকে ক্লাবের সদস্যপদের জন্য সমর্থন করে। কিন্তু ভোটাভুটির সময় ন্যাটিভরা  ম্যাক্সওয়েলের মৃতদেহ ক্লাবে নিয়ে আসে। প্রতিশোধপরায়ণ ন্যাটিভরা তাকে হত্যা করেছে। ম্যাক্সওয়েলের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য উগ্র বর্ণবাদী এলিস জনৈক কিশোর নেটিভকে সহিংসভাবে আক্রমণ করে বসে। এভাবেই কিউকতাদা বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। বিদ্রোহের সময় বার্মিজ বিদ্রোহীরা ক্লাবটি ঘিরে ফেলে এবং উগ্র বর্ণবাদী এলিসকে তাদের হাতে হস্তান্তরের দাবি জানায়। ফ্লোরি অস্বাভাবিক সাহসিকতা প্রদর্শন করে এবং স্বেচ্ছাসেবকদের পুলিশ লাইনে ঢুকতে নব উদ্দমে উৎসাহ যোগায়। এছাড়াও, জেলা কমিশনার ম্যাকগ্রেগর পুলিশকে ন্যাটিভদের ভিড়ের মধ্যে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দেবার পর ফ্লোরি এই নির্দেশকে অস্বীকার করেন। এর ফলে পুলিশ তাদের মাথার ওপর দিয়ে ফাঁকা গুলি চালায়। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লোরিকে একজন বীরের মর্যাদায় স্বাগত জানানো হয়। ফ্লোরির সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে ভেরাস্বামীর আত্মসম্মান রক্ষা হয়। অফিসার ভেরাল তখন এলিজাবেথকে পরিত্যাগ করে। এরপর এলিজাবেথ তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ফ্লোরির দিকে ফেরান। ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে বলে রাগান্বিত ইউ পো কাইন অন্য ইউরোপীয়দের কাছে ফ্লোরির সঙ্গে মা-হ্লা-মে এর পূর্বতন ব্যাভিচারের কথা প্রচার করে। এটি সম্পূর্ণরূপে ফ্লোরির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। এলিজাবেথ তাকে বলে যে সে তাকে কখনো বিয়ে করবে না। বরং মৃত্যু বা চিরকুমারিত্ব বেছে নেবে। জীবনের আর কোনো মূল্য অবশিষ্ট নেই ভেবে ফ্লোরি বাড়িতে ফিরে আসে। সে তখন তার প্রিয় কুকুরকে হত্যা করে এবং তারপরে নিজেকেও। ফ্লোরির প্রস্থানের পর ভেরাস্বামীকে পদচ্যুত করে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। ইউ পো কাইন ঔপনিবেশিক প্রশাসন দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ক্লাবে যোগদান করে। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে ইউ পো কাইন প্যাগোডা নির্মাণে অর্থায়নের মাধ্যমে তার কর্মফল খণ্ডনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু শুরু করার আগেই তিনি অপোলেক্সিতে মারা যান। এলিজাবেথ নিঃস্ব হাতে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। অতঃপর ম্যাকগ্রেগরের অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব গ্রহণ করে এলিজাবেথ সুখের সঙ্গে তার বাকি জীবন আরামে কাটায়। স্থানীয় অধিবাসীরা তাকে ভয় পায় এবং অসম্মানজনক অবজ্ঞার চোখে দেখে।

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর তারিখে হার্পারস ২০০০ কপির একটি সংস্করণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বার্মিজ ডেজ উপন্যাসটি প্রকাশ করে। হেরাল্ড ট্রিবিউন সহ বিভিন্ন কাগজে উপন্যাসটির বিষয়বস্তু ‘বাস্তব সম্মত উপায়ে, বিশ্বস্তভাবে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে উপলব্ধি করা হয়েছে’ বলে প্রশংসা কুড়ায়। কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়। গ্রন্থাকারে বার্মিজ ডেজ প্রকাশিত হওয়ার আগের ইতিহাস না জানলে অরওয়েলকে পুরোপুরি জানা অসম্ভব। বার্মা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে অরওয়েল তাদের সাউথওল্ডের পারিবারিক বাড়িতে উঠেন। স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং একটি 'ওল্ড ইটনিয়ান' নৈশভোজে যোগ দেন। এসময় তিনি কেমব্রিজে তাঁর পূর্বতন শিক্ষক এ.এস.এফ. গো-এর সঙ্গে দেখা করে লেখালিখি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনে চলে যান। রুথ পিটার নামের তাদের জনৈক পারিবারিক হিতাকাঙ্ক্ষী তাঁকে বাসস্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলেন। ১৯২৭ সালের শেষের দিকে তিনি পোর্টোবেলো রোডের বাসস্থানে থাকেন। সেখানে এখনো একটি নামফলকে অরওয়েলের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। এবার অরওয়েল তাঁর প্রিয় লেখক জ্যাক লন্ডনের অনুকরণে লন্ডনের দরিদ্র অঞ্চলগুলো চষে বেড়ান। ১৯২৭ সালের শরৎকাল থেকে তিনি এমন জীবনাচার শুরু করেন যা একজন লেখক হিসেবে তাঁর চরিত্রগঠন করতে ব্যাপক সহায়ক হয়। জাতি এবং বর্ণের বিভেদ রেখা তাঁকে বার্মিজদের সঙ্গে মিশতে বাধা দিয়েছিল বলে নিজেকে দোষী মনে করতেন অরওয়েল। তিনি এবার ভাবলেন, ইউরোপের দরিদ্র এবং ঘরছাড়া মানুষের জীবনে নিজেকে নিমজ্জিত করে তাঁর খানিকটা অপরাধের মোচন হলেও হতে পারে। ছিন্নবস্ত্র পরিধান করে তিনি শ্রমিক এবং ভিক্ষুকদের মাঝে নিম্নমানের বাসস্থানে বসবাসের জন্য লন্ডনের 'ইস্ট এন্ড' এলাকায় যান। তিনি পেশাদার ভবঘুরেদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রাস্তায় টই টই করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধে তিনি প্যারিসে যান। তিনি প্যারিসের বস্তিতে সময় কাটিয়েছেন। তিনি ফিফথ অ্যারোন্ডিসমেন্টের শ্রমিকশ্রেণির বসতি এলাকায় বসবাস শুরু করেন। অরওয়েলের মাসী নেলি লিমুজিনও তখন প্যারিসে থাকতেন এবং প্রয়োজনে তাঁকে সামাজিক ও আর্থিক সহায়তা দিতেন। এসময় অরওয়েল একজন সাংবাদিক হিসেবে সফলতা অর্জন করেন। এরপর ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হেনরি বারবুস-এর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। হেনরি বারবুস ছিলেন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের আজীবন বন্ধু। তাঁর সম্পাদিত রাজনৈতিক/সাহিত্যিক জার্নাল মন্ড-এ অরওয়েলের নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সাল থেকে পেশাদার লেখক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাসমূহে অরওয়েলের নিবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। লা প্রগ্রেস সিভিক কাগজে পরপর তিন সপ্তাহে তিনপর্বের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল ‘বেকারত্ব', 'ট্র্যাম্পের জীবনের একটি দিন' এবং 'লন্ডনের ভিক্ষুকদের নিয়ে আলোচনা'। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৪তম অ্যারোন্ডিসমেন্টে তাঁকে কোচিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটি ছিল একটি বিনামূল্যের হাসপাতাল যেখানে মেডিকেল ছাত্রদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তাঁর সেখানকার অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল 'দরিদ্র কীভাবে মারা যায়'। কিছুদিন পর, তাঁর থাকার ঘর থেকে সমস্ত টাকা-পয়সা চুরি হয়ে যায়। আর্থিক প্রয়োজনে বা লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্য  তিনি 'রু দ্য রিভোলি'র একটি অভিজাত হোটেলে থালা-বাসন ধোয়ার মতো সামান্য কাজও করেন। সেই সব দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোই পরবর্তী সময়ে অরওয়েলকে ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন গ্রন্থ রচনার উপাদান দিয়েছে। যেখানে বাস্তব ঘটনাগুলিকে কল্পকাহিনির মতো করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি তাঁকে প্রথমবারের মতো সাহিত্যিক স্বীকৃতি এনে দেয়।  

প্যারিসে প্রায় দুই বছর থাকার পর ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে অরওয়েল ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং সাফোকের একটি উপকূলীয় শহর সাউথওল্ডে সরাসরি তার পিতামাতার বাড়িতে যান। পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে তিনি এখানেই থাকেন।  পরিবারটি শহরে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তার বোন এভ্রিল সেখানে একটি চা-বিক্রয়কেন্দ্র চালাতেন। তিনি শহরের সেন্ট ফেলিক্স গার্লস স্কুলের জিম-শিক্ষিকা পাদ্রীর মেয়ে ব্রেন্ডা সালকেল্ড সহ অনেক স্থানীয় অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন। অরওয়েল তখন অ্যাডেলফির জন্য রিভিউ লিখছিলেন এবং সাউথওল্ডে একজন প্রতিবন্ধী শিশুর ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। এরপর তিনি তিনজন তরুণ ভাইয়ের গৃহশিক্ষক হয়েছিলেন। ওই ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন রিচার্ড পিটার্স। পিটার্স পরবর্তী সময়ে একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হয়ে ওঠেন। ১৯২৯ সালের আগস্টে তিনি লন্ডনের জন মিডলটন মুরির নিউ অ্যাডেলফি ম্যাগাজিনে দ্য স্পাইক-এর একটি কপি পাঠান। ম্যাক্স প্লোম্যান এবং স্যার রিচার্ড রিস দ্বারা সম্পাদিত ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য প্লোম্যান কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। এখানে অ্যাডেলফি সম্পর্কে একটু আলোচনা প্রয়োজন। ঘটনাক্রমে প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক এবং বিশিষ্ট সমালোচক জন মিডলটন মুরির সঙ্গে পরিচয় হয় জর্জ অরওয়েলের। মুরি তাঁর জীবদ্দশায় সাহিত্য, সামাজিক সমস্যা, রাজনীতি এবং ধর্মবিষয়ক ৬০টিরও বেশি গ্রন্থ এবং হাজার হাজার প্রবন্ধ এবং পর্যালোচনা লিখেছিলেন।  মুরি ১৯২৩ সালে একটি সাহিত্য জার্নাল হিসাবে দ্য অ্যাডেলফি প্রতিষ্ঠা করেন। অ্যাডেলফি তখন 'ইনডিপেনডেন্ট লেবার পার্টি'র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। ব্রিটিশ সমাজবাদী প্রবন্ধকার এবং ঔপন্যাসিক জ্যাক কমন ১৯৩০ এর দশকে অ্যাডেলফির সার্কুলেশন প্রোমোটার এবং সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন। ১৯২৯ সালে জর্জ অরওয়েল দ্য নিউ অ্যাডেলফিকে একটি নিবন্ধ পাঠান। অরওয়েল পরিচিত হন রিচার্ড রিস-এর সঙ্গে। রিচার্ড রিস বা স্যার রিচার্ড লোডোভিক এডওয়ার্ড মন্টাগু রিস ছিলেন একজন ব্রিটিশ কূটনীতিক, লেখক এবং চিত্রশিল্পী। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে তিনি কাতালোনিয়াতে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। রিস ছিলেন অরওয়েলের সাহিত্য নির্বাহক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন পশ্চিম ফ্রন্টের যোদ্ধা ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা এবং লেখক ম্যাক্স প্লোম্যান ১৯৩০ সালে জন মিডলটন মুরি এবং রিচার্ড রিসের সঙ্গে যোগ দিয়ে দ্য অ্যাডেলফিকে একটি সমাজতান্ত্রিক মাসিকপত্রে রূপান্তরিত করেন। অরওয়েলের সঙ্গে প্লোম্যানের বন্ধুত্ব হয় এবং এই বন্ধুত্বের সুবাদে অরওয়েলকে তিনি বই রিভিউ করতে পাঠাতেন। ১৯৩১ সালের আগস্টে এ হ্যাঙ্গিং প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দারিদ্র্যের খোঁজেই দিন কাটে অরওয়েলের। এ ক্লারজিম্যানস ডটার-এর প্রধান চরিত্রের মতো তিনি ইস্ট এন্ড-এর কেন্ট হপে কাজ করার রীতি অনুসরণ করেন। বড় কষ্টের ছিল সেই দিনগুলো। এরপর তিনি তাঁর পিতামাতার আর্থিক সহায়তায় উইন্ডসর স্ট্রিটে চলে আসেন এবং 'বড়দিন' এর উৎসব পর্যন্ত এখানে থাকেন। নিউ স্টেটসম্যানের  ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর সংখ্যায় অরওয়েলের হপ পিকিং প্রকাশিত হয়। ১৯৩২ সালের এপ্রিলে তিনি পশ্চিম লন্ডনের হেইস এলাকায় 'দ্য হাথর্নস হাই স্কুল' নামের ছেলেদের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বেসরকারি এই ছোট স্কুলটিতে স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং দোকানিদের সন্তানেরা পড়ালেখা করত। স্কুলটিতে সর্বসাকুল্যে ১৪ থেকে ১৬ জন ছাত্র ছিল। যাদের বয়স দশ থেকে ষোল বছরের মধ্যে। আর ছিল অন্য একজন মাস্টার। স্কুলে থাকাকালীন তিনি স্থানীয় প্যারিস চার্চের কিউরেটের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং  সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িত হন। ১৯৩২ সালে গ্রীষ্মের শেষ দিকে অরওয়েল সাউথওল্ডে ফিরে আসেন। এখানে তাঁর বাবা-মা উত্তরাধিকার সূত্রে নিজস্ব একটি বাড়ি পেয়েছেন। অরওয়েল এবং তাঁর বোন এভ্রিল বাড়িটিকে বাসযোগ্য করে তুলে ছুটির দিনগুলি এখানেই কাটান। এসময় তিনি বার্মিজ ডেজ উপন্যাসেরও কাজ করেছিলেন।   

জেলখানার কয়েদিদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিতে তিনি একবার হাজতবাসের ব্যর্থ চেষ্টা চালান। সেই ব্যর্থ প্রচেষ্টার বর্ণনা দিয়ে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাডেলফির আগস্ট সংখ্যায় 'ক্লিঙ্ক' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এরপর তিনি হেইসে শিক্ষকতা পেশায় ফেরেন। এসময়েই তিনি তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস এবং লন্ডন প্রকাশনার জন্য প্রস্তুতি নেন। তিনি ভাবলেন, ভবঘুরে জীবনের বিবরণ সমৃদ্ধ এই গ্রন্থ প্রকাশ হলে নিজের পরিবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। তাই তিনি একটি ছদ্মনামে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। তিনি অবশেষে 'জর্জ অরওয়েল' ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। 'জর্জ' নামটি এসেছে ইংল্যান্ডের পৃষ্ঠপোষক সন্ত থেকে অনুপ্রাণীত হয়ে। আর তাঁর পছন্দের স্থানগুলির মধ্যে সুন্দরতম নদী 'অরওয়েল' থেকে নামের শেষাংশ এসেছে। এভাবেই এরিখ আর্থার ব্লেয়ার হয়ে ওঠেন 'জর্জ অরওয়েল'। লন্ডনে ১৯৩৩ সালের ৯ জানুয়ারি ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন প্রকাশনা সংস্থা ভিক্টর গোলানকজ। গ্রন্থটি অনুকূল পর্যালোচনা পায় এবং ব্যবসায়িকভাবেও সফলতা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার নিউইয়র্কের হার্পার অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণ করে। ১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি ব্লেয়ার পশ্চিম লন্ডনের উক্সব্রিজের ফ্রেস কলেজে শিক্ষক হওয়ার জন্য হাথর্নস ছেড়ে যান। এসময় তিনি একটি মোটরবাইক কিনে আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ান। এই অভিযানগুলোর একটিতে তিনি ভিজে গিয়েছিলেন। ঠান্ডা লেগে তাঁর নিউমোনিয়া হয়েছিল। প্রায় জীবন বিপন্ন অবস্থায় তাঁকে উক্সব্রিজের একটি কটেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন তিনি তাঁর পিতামাতার সহযোগিতায় সুস্থ হওয়ার জন্য সাউথওল্ডের বাড়িতে ফিরে আসেন। ১৯৩৪ সালের জানুয়ারি মাসে স্কুল থেকে ছুটি নেয়ার পর তিনি আর কখনো শিক্ষকতায় ফেরেননি। সাউথওল্ডে অরওয়েল তুলনামূলকভাবে নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছিলেন। বাড়ির অনতিদূরের সবজিবাগানে কাজ করা, একাকী হেঁটে বেড়ানো এবং তার বাবার সাথে সময় কাটানো -এভাবেই চলছিল। অক্টোবরে তিনি লন্ডনে চলে গেলেন। তার মাসী নেলি লিমুজিনের সুপারিশে তিনি হ্যাম্পস্টেডের 'বুকলভারস কর্নার' নামের একটি পুরাতন বই বিক্রয়কেন্দ্রে খণ্ডকালীন সহকারী পদে যোগ দিলেন। বিক্রয়কেন্দ্রটি পরিচালনা করতেন ফ্রান্সিস এবং মাইফানউই ওয়েস্ট্রোপ। এরা এস্পেরান্তো আন্দোলনে নেলি লিমুজিনের বন্ধু ছিলেন। ওয়েস্ট্রোপ এর আচরণ খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল। তিনি অরওয়েলকে পন্ড স্ট্রিটের ওয়ারউইক ম্যানশনে আরামদায়ক আবাসনের ব্যবস্থা করে দেন। অরওয়েল বিকেলে বই বিক্রয়কেন্দ্রে কাজ করতেন আর সকাল বেলায় লিখতেন। সন্ধেবেলাটি তিনি সামাজিক কাজে ব্যয় করতেন। এই অভিজ্ঞতাগুলোই তার 'কিপ দ্য অ্যাসপিডিস্ট্রা ফ্লাইং' (১৯৩৬) উপন্যাসের পটভূমি হিশেবে কাজ করে। ১৯৩৫ সালের শুরুতে তিনি ওয়ারউইক ম্যানশন থেকে সরে গিয়ে পার্লামেন্ট হিলে বসবাস করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ 'আ ক্লার্জিম্যানস ডটার' প্রকাশিত হয়। এবছরের শুরুর দিকে অরওয়েলের সাথে তাঁর ভবিষ্যত স্ত্রী আইলিন ও'শাগনেসির সাক্ষাৎ ঘটে। অরওয়েল তখন 'দ্য নিউ ইংলিশ উইকলি'র জন্য নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা লিখছেন। জুন মাসে বার্মিজ ডেজ প্রকাশিত হয়। অরওয়েল তখন 'কিপ দ্য অ্যাসপিডিস্ট্রা ফ্লাইং'-এ কাজ করছেন এবং নিউজ ক্রনিকলের জন্য একটি সিরিয়াল লেখারও ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তিনি 'বুকলাভার্স কর্নার'-এর চাকরি ছাড়ার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৩৬ সালের জানুয়ারির শেষ অবধি ওখানেই ছিলেন।

এই সময়ে ভিক্টর গোলানকজ অরওয়েলকে অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত উত্তর ইংল্যান্ডের সামাজিক অবস্থার প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব দেয়। দুই বছর আগে জে বি প্রিস্টলি উত্তর ইংল্যান্ড সম্পর্কে একটি আগ্রহ উদ্দীপক প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এই অর্থনৈতিক মন্দা উত্তর ইংল্যান্ডের বেশ কিছু শ্রমজীবী   লেখককে পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণির তেমনি একজন লেখক জ্যাক হিলটনের কাছে অরওয়েল পরামর্শ নেন। জ্যাক হিলটন ছিলেন একজন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং ভ্রমণ লেখক। তাঁর লেখায় প্রায়শই শ্রমজীবী মানুষ ও পরিবেশ উঠে এসেছে। তিনি বিশেষ করে ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের জনজীবনকে চিত্রিত করেছিলেন। রচডেলের পরিবর্তে উইগানে ভ্রমণ করলে বেশি অভিজ্ঞতা পাওয়া সম্ভব—হিলটন তাকে এরকম পরামর্শ দিলেন। এরপর অরওয়েল গণপরিবহনে এবং পদব্রজে কভেন্ট্রি, স্টাফোর্ড, পটারিজ এবং ম্যাকলফিল্ড হয়ে ম্যানচেস্টারে পৌঁছান। ব্যাঙ্কসমূহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ম্যানচেস্টারে পৌঁছে তিনি একটি সাধারণ লজিং-হাউসে থাকেন। উইগান অঞ্চলে মানুষ কীভাবে বসবাস করে তা দেখার জন্য তিনি অনেকগুলো বাড়িতে গিয়ে আবাসন পরিস্থিতি এবং অর্জিত মজুরি সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। তিনি তখন 'ব্রাইন হল কয়লা খনি'র জনস্বাস্থ্য রেকর্ড এবং কাজের অবস্থার ওপর প্রতিবেদন তৈরিতে স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরির সহায়তা নেন। এর মধ্যে তিনি লিভারপুলে ঝটিকা সফরে যান। মার্চ মাসে দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারে অবস্থান করেন, শেফিল্ড এবং বার্নসলে এলাকায় সময় কাটান। অরওয়েল এসময় স্যার অসওয়াল্ড এরনাল্ড মোসলির সঙ্গে পরিচিত হন। ষষ্ঠ ব্যারোনেট ও ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ অসওয়াল্ড মোসলি ১৯২০-এর দশকে সংসদ সদস্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৩০-এর দশকে মূলধারার রাজনীতির প্রতি মোহভঙ্গের ফলে বিভ্রান্ত হয়ে ব্রিটিশ ইউনিয়ন অফ ফ্যাসিস্ট (BUF) প্রতিষ্ঠা করেন। অরওয়েল কমিউনিস্ট পার্টি এবং অসওয়াল্ড মোসলি-এর সভায় যোগদান করেন। তিনি হেডিংলিতে তার বোনের সঙ্গেও দেখা করেন। উত্তরাঞ্চলের এই ভ্রমণের ফলে সৃষ্টি হয় অনবদ্য গ্রন্থ দ্য রোড টু উইগান পিয়ার'। ১৯৩৭ সালে লেফট বুক ক্লাবের জন্য গোলানকজ্ এই গ্রন্থটি প্রকাশ করে। ১৯৩০-এর দশকে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে আঘাত হানা অর্থনৈতিক মন্দার পটভুমিতে অরওয়েল এই গ্রন্থটি রচনা করেন। ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের উইগান শহরটির মূল অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির পাশাপাশি অধিবাসীদের কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস ছিল কয়লার খনি। মন্দার ক্ষতিকর প্রভাব উইগান অঞ্চলে প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়। অরওয়েল তাঁর গ্রন্থে উইগানবাসীদের দুঃখ-কষ্টের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি লাগামহীন পুঁজিবাদেরও কঠোর সমালোচনা করেন। গত শতকের সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে লিখিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে দ্য রোড টু উইগান পিয়ার অন্যতম। গ্রন্থটি প্রকাশের পর ১৯৩৬ সাল থেকে ১২ বছরের জন্য অরওয়েলকে রাস্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ শাখার নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।

অরওয়েল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন এলিন ও'শাগনেসিকে বিয়ে করেন। এর কিছুদিন পরেই স্পেনে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়। স্পেনীয় রাজতন্ত্রের দুর্বলতা স্পেনকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কুরুক্ষেত্রে পরিণত করে। রাজা আলফানসোর ক্ষমতাচ্যুতি, রিভেরার সামরিক একনায়কত্ব, প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের নির্বাচনী সাফল্য এবং দক্ষিণপন্থী জোটের প্রতিক্রিয়া স্পেনের রাজনীতিতে তুমুল অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী সেনাপ্রধান ফান্সিস ফ্রাঙ্কোর অংশগ্রহণ স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে (১৯৩৬-১৯৩৯ খ্রি.)। প্রজাতন্ত্রকে উৎখাত করে আবার পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ফ্রাঙ্কো তার মরক্কোর সেনাবাহিনী নিয়ে স্পেনে পৌঁছেন। শুরুতে ভাবা হয়েছিল ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদ কখনোই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হারাতে পারবে না। স্পেনের কৃষক ও শ্রমিকগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের অধিকারকে রক্ষা করবার জন্য একজোট হয়েছিলেন। আশা করা হয়েছিল যে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাস্ট্রসমূহ বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কিছুতেই মুখ বুজে ফ্রাঙ্কোর এই স্পর্ধাকে প্রশ্রয় দিবে না। কিন্তু প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যেতেই দেখা গেল সশস্ত্র হস্তক্ষেপ না করার অজুহাতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরোক্ষভাবে ফ্রাঙ্কোকেই সাহায্য করেছে। আর ফ্রাঙ্কোকে মদত দেবার জন্য ইতালি ও জার্মানি সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছে। অচিরেই বোঝা গেল যে স্পেনের গৃহযুদ্ধ আসলে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া। স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ নির্দেশক ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা ১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময়ে নিজগৃহ ‘কায়েহোনেস দে গারসিয়া’তে অবস্থান করছিলেন। ফ্রান্সিস ফ্রাঙ্কোর সৈন্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে। ১৯ আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে কবরস্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে তাঁর লাশ গুম করে ফেলে। লোরকার মৃত্যু ছিল সত্যিই হৃদয়বিদারক। অরওয়েল প্রজাতন্ত্রের পক্ষের হয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে স্পেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্যারিসে আমেরিকান ঔপন্যাসিক হেনরি ভ্যালেন্টাইন মিলারের সঙ্গে দেখা করেন। নিউইয়র্ক এবং প্যারিসে বসবাসের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা মিলারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ট্রপিক অফ ক্যানসার, ব্ল্যাক স্প্রিং, ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন প্রভৃতির কারণে তিনি বিখ্যাত ও বিতর্কিত ছিলেন। মিলার অরওয়েলকে বলেন যে কিছু বাধ্যবাধকতা বা অপরাধবোধ থেকে গৃহযুদ্ধে লড়াই করা হলো 'নিছক মূর্খতা'। তিনি আরও বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, গণতন্ত্র রক্ষা করা ইত্যাদি ইত্যাদি সম্পর্কে ইংরেজদের ধারণাসমূহ একধরনের বেহায়াপনা’। মিলারের সঙ্গে খাবার খেয়ে অরওয়েল স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কয়েকদিন পর তিনি বার্সেলোনা শহরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি (ILP) অফিসের জন ম্যাকনায়ারের সঙ্গে দেখা করেন। অরওয়েল কাতালোনিয়ার একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পা রাখেন।  বেশ কয়েকটি উপদল রিপাবলিকান সরকারকে সমর্থন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এদেরকে সমরাস্ত্র ও সাহায্য দিয়ে সমর্থন করেছিল। অরওয়েল এরকম একটি উপদল POUM-এ যোগ দেন। বার্সেলোনার লেনিন ব্যারাকে কিছুদিন থাকার পর তাকে জর্জেস কপের অধীনে অপেক্ষাকৃত শান্ত আরাগন ফ্রন্টে পাঠানো হয়। ফ্রন্টে ফিরেই তিনি এক রাতে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একজন শত্রু সৈন্যকে বেয়নেট উঁচিয়ে তাড়া করেন এবং শত্রুর রাইফেল ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেন। এপ্রিল মাসে, অরওয়েল বার্সেলোনায় ফিরে আসেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে তিনি আরাগন ফ্রন্টে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরার পর একদিন স্নাইপারের একটি বুলেট গলায় বিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন তিনি। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি দীর্ঘ অরওয়েল স্প্যানিশ যোদ্ধাদের চেয়ে যথেষ্ট লম্বা ছিলেন। তাই তাকে ট্রেঞ্চের সামনের আত্মরক্ষামূলক দেয়ালের উল্টোদিকে না দাঁড়াতে সতর্ক করা হয়েছিল। গুলি খাওয়ার পর কথা বলতে অক্ষম অরওয়েলের মুখ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। তাঁকে স্ট্রেচারে করে সিয়েটামোতে নিয়ে যাওয়া হয়। বারবাস্ট্রো হয়ে একটি অস্বস্তিকর পথ পাড়ি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে নিয়ে লেইডা হাসপাতালে পৌঁছে। একটু সুস্থ হয়ে ওঠার ১৯৩৭ সালের ২৭ মে তাঁকে টাররাগোনায় এবং এর দুই দিন পর বার্সেলোনার শহরতলির একটি স্যানাট্যারিয়ামে পাঠানো হয়। বুলেটটি তাঁর প্রধান ধমনীর খুব কাছাকাছি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাঁর কণ্ঠস্বর অস্ফুট শোনা যাচ্ছিল। ক্ষত সারিয়ে তুলতে সংক্রমণ রোধে অবিলম্বে ক্ষারজাতীয় পদার্থের দ্বারা স্থানটি পুড়িয়ে দেবার মতো জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ইলেক্ট্রোথেরাপি চিকিৎসা দেবার পর তাঁকে চিকিৎসার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে প্রজাতন্ত্রের সমর্থনে যুদ্ধ করতে অরওয়েল স্পেন চলে যান। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি আহত হন। গৃহযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া বইটি। ১৯৩৮ সালে তাঁকে শারীরিক অসুস্থতায় পেয়ে বসে। একটি স্যানাটোরিয়ামে কিছুদিন থাকতে হয় তাঁকে। এরপর থেকে কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হননি তিনি। মরক্কোতে মাস ছয়েক ছিলেন অরওয়েল। এ সময় লেখেন কামিং আপ ফর এয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হোম গার্ড এবং বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিসে কাজ করেন তিনি। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ওই কাজেই নিয়োজিত ছিলেন অরওয়েল। পরে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন ট্রিবিউন পত্রিকায়। এ সময় রাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। একই সঙ্গে অবজারভার এবং ম্যানচেস্টার ইভনিং নিউজ পত্রিকায়ও লিখেছেন। জর্জ অরওয়েলের চমৎকার রূপকধৰ্মী সাড়াজাগানো রাজনৈতিক উপন্যাস অ্যানিমেল ফার্ম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। এখানে তিনি একটি পশুখামারের ভেতর একটি রাজনৈতিক পটভূমি সৃষ্টি করেছেন। এটা মূলত রাশিয়ান রেভুলেশনের স্টেনের বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে লেখা। গ্রন্থটি অরওয়েলের জন্য খ্যাতি নিয়ে আসে। জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছলতা অর্জন করেন।

অ্যানিমেল ফার্ম উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, 'ম্যানর ফার্ম'-এর মালিক কৃষক মিস্টার জোন্স তার ফার্মের প্রাণীদের ওপর দিনের পর দিন অবিচার করে চলে। সে তাদের কখনোই সময়মতো খাবার দেয় না। এছাড়াও প্রতিদিনই সে পানশালা থেকে মদ্যপ অবস্থায় ফিরে এসে প্রাণীদের ওপর নানা অত্যাচার চালায়। এভাবে চলতে থাকে অনেকদিন। একদিন ফার্মের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং বয়স্ক শুয়োর 'বৃদ্ধ মেজর' ম্যানর ফার্মের প্রাণীদেরকে একটি সভায় আহ্বান করেন। তার ডাকে প্রাণীরা বড়ি একটি শস্যাগারে জড়ো হয়। বৃদ্ধ মেজর তাদের ওপর মানুষের দ্বারা নির্যাতনের ইতিহাস শোনায়। খাদ্যাভাবে খামারের প্রায় প্রত্যেক প্রাণীরই জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। এহেন শোচনীয় অবস্থা থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখান বৃদ্ধ মেজর। সমস্ত প্রাণীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং মনুষ্যশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানান তিনি। তিনি তাদের বলেন যে, তিনি প্রাণীদের বিষয়ে একটি স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে সমস্ত প্রাণী একসঙ্গে বসবাস করবে এবং তাদের ওপর মানুষেরা অত্যাচার বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এরকম একটি স্বপ্নের স্বর্গোদ্যান রচনায় তিনি প্রাণীদের যুগপৎ কাজ করতে পরামর্শ দেন। পাশাপাশি তিনি তাদেরকে 'বিস্ট অফ ইংল্যান্ড' নামে একটি গান শেখান। এই গানটির কথার মাধ্যমে তার স্বপ্নের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হয়েছে। প্রাণীরা মেজরের উদ্দেশ্যকে সোৎসাহে অভিবাদন জানায়। সভাটি করার মাত্র তিন রাতের মধ্যে বৃদ্ধ মেজর মারা যান। কিন্তু বিপ্লবের স্বপ্ন এখানে থেমে যায় না। এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে ফার্মের সবচেয়ে বুদ্ধিমান তিনটি তরুণ শুয়োর। স্নোবল, নেপোলিয়ন ও স্কুয়েলার। তারা মেজরের মূল নীতিগুলোর সমন্বয়ে 'প্রাণীবাদ' নামক একটি দর্শন প্রণয়ন করে। একদিন সব প্রাণী ঐক্যবদ্ধ হয়ে অতর্কিত আক্রমণ করে ফার্মের অত্যাচারী মালিক মিস্টার জোন্সকে ফার্ম থেকে বিতাড়িত করে। তারপর শুরু হয় সম্পূর্ণ প্রাণীদের রাজ্য। সকল প্রাণী মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে 'ম্যানর ফার্ম'-এর নাম পালটে রাখা হয় 'অ্যানিমেল ফার্ম'। আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় ঘোড়ার জিন, ঠুলি, চাবুক এবং আরও এমন সব জিনিস, যা প্রাণীশ্রেণির পরাধীনতার স্মারক বলে মনে করা হতো। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই 'অ্যানিমেল ফার্ম'-এর নেতারা একটি সংবিধান রচনা করে। 'প্রাণীবাদ' প্রতিষ্ঠার জন্য ফার্মের সকল প্রাণীর জন্য অবশ্য পালনীয় ৭টি নীতিমালা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। নীতিমালাগুলো সকল প্রাণীর সামনে ফার্মের দেয়ালে লিখে রাখে শুয়োরদের মধ্যে মেধাবী বলে খ্যাত ‘স্নোবল’।
১. Whatever goes upon two legs is an enemy.
২. Whatever goes upon four legs, or has wings, is a friend.
৩. No animal shall wear clothes.
৪. No animal shall sleep in a bed.
৫. No animal shall drink alcohol.
৬. No animal shall kill any other animal. 
৭. All animals are equal.

কত সুন্দর গণতান্ত্রিক একটি সংবিধান। আর মানুষের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করে বলে ফার্মের একটি স্লোগান ছিল—‘Four legs good, two legs bad’। 'অ্যানিমেল ফার্ম'-এর নেতৃত্বদানকারী তিনটি শুয়োর নেপোলিয়ন, স্নোবল ও স্কুয়েলার। স্কুয়েলারের কাজ হচ্ছে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো। ওদিকে, প্রাণীরা মেজরের স্বপ্নপূরণে নিজেদের উৎসর্গ করে। পরিশ্রমী ঘোড়া বক্সার এবং ক্লোভার উপন্যাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বক্সার বৃদ্ধ হলেও সে নেপোলিয়নের নির্দেশ মতো পশু খামারের উন্নয়নের জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করে যায়। সে-ও স্বপ্ন দেখে এমন এক অ্যানিমেল ফার্মের যে স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছিলেন 'বৃদ্ধ মেজর'। গাড়িটানা ঘোড়া বক্সার বিশেষ উদ্যমের সঙ্গে লক্ষ্য অর্জনে নিজেকে নিবেদিত করে। বক্সার 'এনিম্যাল ফার্ম'-এর সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রবল শক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ‘আমি আরও কঠোর পরিশ্রম করবই’ ঘোষণাটিকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত প্রত্যয় হিসেবে গ্রহণ করে বক্সার। পশু খামার উন্নতি লাভ করে। স্নোবল প্রাণীগুলোকে পড়তে শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর মধ্য থেকে নেপোলিয়ন একদল তরুণ কুকুরছানাকে 'প্রাণীবাদ' দর্শনে শিক্ষিত করে তোলার জন্য গুপ্তস্থানে নিয়ে যায়। মিস্টার জোন্স তার খামার ফিরিয়ে নিতে আবারও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। প্রাণীরা সবাই মিলে তাকে আবারও পরাজিত করে। এই লড়াইটি ‘গোয়ালঘরের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। প্রাণীরা বিজয়ের স্মারক চিহ্ন হিসেবে কৃষকের পরিত্যক্ত বন্দুকটির দখল নেয়।

সময় বয়ে চলে। ওদিকে নেপোলিয়ন এবং স্নোবল উভয়েই খামারের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে ক্রমাগত কলহে লিপ্ত হয়। খামারের অন্য প্রাণীদের ওপর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি লাভের হীন মতলবে তারা উভয়েই পরস্পর দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে শুরু করে। স্নোবল একটি বিদ্যুৎ—উৎপাদনকারী বায়ুকল তৈরির প্রকল্পের পরিকল্পনা হাতে নেয়। কিন্তু নেপোলিয়ন দৃঢ়ভাবে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে। প্রকল্পটি অনুমোদনের বিষয়ে ভোটাভুটির সভায় স্নোবল একটি আবেগপূর্ণ ভাষণ দেয়। ওদিকে নেপোলিয়ন শুধুমাত্র একটি সংক্ষিপ্ত ধারালো প্রত্যুত্তর দেয়। এর পরপরই সে একটি অদ্ভুত সাংকেতিক আওয়াজ করে। আওয়াজ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আগে থেকে প্রস্তুত নয়টি জঙ্গি কুকুর শস্যাগারে হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেয়। তারা খামার থেকে স্নোবলকে তাড়া করে। স্নোবলকে ধাওয়াকারী সেই নয়টি কুকুর ছিল নেপোলিয়নের ছাত্র যারা প্রাণীবাদে 'শিক্ষিত' হওয়ার জন্য নেপোলিয়নের তত্ত্বাবধানে গুপ্তস্থানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এবার নেপোলিয়ন অ্যানিমেল ফার্মের নেতৃত্ব গ্রহণ করে এবং ঘোষণা দেয় যে আর কোনো মিটিং মিছিল হবে না। এই মুহূর্ত থেকে প্রত্যেক পশুর কল্যাণের তরে একমাত্র শুয়োরগণই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবে। নেপোলিয়ন এরপর বায়ুকল সম্পর্কে তার পূর্বের অভিমত পরিবর্তন করে। বিশেষ করে বক্সারের ন্যায় নিবেদিত প্রাণীরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। একদিন, ঝড়ের পর প্রাণীরা দেখতে পায় বায়ুকলটি ভেঙে পড়েছে। ওদিকে এলাকার মানব কৃষকেরা চোরাগুপ্তাভাবে প্রচার চালায় যে প্রাণীরা দেয়ালগুলিকে খুব পাতলা করে গড়েছিল। ওদিকে নেপোলিয়নের দাবি, স্নোবলই বায়ুকল ধ্বংস করেছে এবং এই কুমতলবে সে খামারে ফের ঢুকেছিল। তখন সে একটি দুর্ধর্ষ শুদ্ধি অভিযান চালায়। অর্থাৎ এক সময় যেসব প্রাণী স্নোবলের মহাষড়যন্ত্রের সহযোগী ছিল অর্থাৎ নেপোলিয়নের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্বের বিরুদ্ধবাদী প্রাণীগুলোকে জঙ্গি কুকুরের দংশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। নিজ নেতৃত্বকে প্রশ্নহীন করতে নেপোলিয়ন তার ক্ষমতার পূর্ণ অপব্যবহার করতে শুরু করে দেয়। স্নোবলকে খলনায়ক প্রতীয়মান করার জন্য সে ইতিহাস পুনর্লিখন করে। তার একান্ত অনুগত বক্সার এবার দ্বিতীয় ম্যাক্সিমটি গ্রহণ করে, ‘নেপোলিয়ন সর্বদা সঠিক’। নেপোলিয়নও আগের তুলনায় আরও বেশি করে মানুষের ঢংয়ে কাজ করতে শুরু করে। মানুষের মতো বিছানায় ঘুমানো, হুইস্কি পান এবং প্রতিবেশী মানব কৃষকদের সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত হওয়া শুরু করে।

আদি প্রাণীবাদী নীতিসমূহে এধরনের কার্যকলাপকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু নেপোলিয়নের প্রচারক স্কুয়েলার, অন্যান্য প্রাণীদের কাছে প্রতিটি কাজের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে তৎপর হয়ে উঠল। তাদের মগজধোলাই দেয়া হলো যে, নেপোলিয়ন একজন মহান নেতা এবং প্রত্যেকের জন্য জিনিসগুলিকে আরও ভাল করে তুলছেন—যদিও বাস্তবে সাধারণ প্রাণীরা, নিষ্প্রাণ, ক্ষুধার্ত এবং অত্যন্ত কর্মক্লান্ত। প্রতিবেশী জনৈক মানব কৃষক মিস্টার ফ্রেডেরিক নেপোলিয়নকে কিছু কাঠ কেনার জন্য প্রতারণা করে। তারপর খামারে আক্রমণ করার মাধ্যমে ব্যয়বহুলভাবে পুনর্নিমিত বায়ুকলটিকে ডিনামাইট দিয়ে গুড়িয়ে দেয়। বায়ুকলটি ভেঙে ফেলার পর, একটি কঠিন লড়াই হয়। লড়াইয়ের সময় বক্সার আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পশুরা কৃষকদের পতন করে ঠিকই, কিন্তু বক্সারের আঘাত তাকে ক্রমশ নিস্তেজ করে দিতে থাকে। পরে যখন সে উইন্ডমিলে কাজ করার সময় পড়ে যায়, তখন সে অনুভব করে তার অন্তিম সময় আসন্ন। তারপর একদিন, বক্সারকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। স্কুইলার প্রচারণা চালায়, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর বক্সার শান্তিতে মারা গেছে। শেষ নিঃশ্বাসেও সে বিপ্লবের জয়ধ্বনি করেছে।  বাস্তবে ঘটনা ঘটেছিল অন্যরকম। নেপোলিয়ন হুইস্কি খাওয়ার অর্থের প্রয়োজনে তার সবচেয়ে অনুগত এবং দীর্ঘকালের কর্মীকে জনৈক আঠা প্রস্তুতকারকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। স্বাধীন খামারের মুরগিগুলো ডিম পাড়ে। আগের চেয়ে বেশি বেশি পরিশ্রম করে সবাই। শুধু শুয়োরগুলো পরিশ্রম করে না। অন্য সব প্রাণীরা পরিশ্রম বেশি করলেও তাদের ঠকানো হয়। দুধ আর আপেলগুলো খেয়ে নেয় অলস শুয়োরগুলো। অন্য প্রাণীদের খাবারের পরিমাণ সীমিত, মানুষের শাসনামলে যা জুটতো তা-ই। কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু প্রাণীগুলো মানুষকে চরম ঘৃণা করে। তাই তাদের সংবিধানে মানুষ যা করতো তা নিষিদ্ধ। পশুর খামারে বছরের পর বছর কেটে যায়। শুয়োরগুলো আরও বেশি করে মানুষের মতো হয়ে ওঠে—সোজা হয়ে হাঁটে, চাবুক বহন করে এবং পোশাক পরে। অবশেষে, প্রাণীবাদের সাতটি নীতি, যা সাতটি আদেশ নামে পরিচিত এবং শস্যাগারের পাশে খোদাই করা হয়েছে সেখানে পরিবর্তন করে লেখা হয়, ‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী অন্যদের চেয়ে বেশি সমান।’  নেপোলিয়ন একদিন নৈশভোজে মি. পিলকিংটন নামে একজন মানব কৃষককে আপ্যায়ন করেন। এরপর মানব ও পশু উভয় সম্প্রদায়ের শ্রমিক শ্রেণির শত্রু মানব কৃষকদের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়ান। তিনি অ্যানিমেল ফার্মের নামটিও আবার 'ম্যানর ফার্ম'-এ পরিবর্তন করেন এবং দাবি করেন যে এই শিরোনামটিই 'সঠিক'। খামারবাড়ির জানালা দিয়ে অভিজাতদের পার্টির দিকে তাকালে কোনটি শুয়োর আর কোনটি মানুষ—বিষয়টি সাধারণ প্রাণীদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। দিন যায়, ঋতু বদলায়। অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে অ্যানিমেল ফার্মের। কিন্তু প্রাণীদের দূরাবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

অ্যানিমেল ফার্ম প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ও আলোচিত হন জর্জ অরওয়েল। এরপর ১৯৪৬ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন আরও একটি উপন্যাস রচনার। ডিস্টোপিয়া কিংবা অন্ধকার সমাজের বার্তাকে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করতে অরওয়েল আবারও পুরোনো টাইপরাইটারে ঝড় তুললেন। অরওয়েলের 'ম্যাগনাম ওপাস' হিসেবে খ্যাত এই নতুন উপন্যাসটির নাম নাইন্টিন এইটি ফোর। ১৯৪৯ সালে নাইনটিন এইটি ফোর গ্রন্থটি লেখা শেষ করেন জর্জ অরওয়েল। এই উপন্যাসে অরওয়েল ১৯৮৪ সালের পৃথিবীর কথা কল্পনা করেছেন। সেই পৃথিবীতে বাক-স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই। সেখানে মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সরকার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র উইনস্টন স্মিথ। লন্ডনে বসবাসকারী একজন ছোটখাট পার্টি কর্মচারী। শহরটি তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ কিছুদিন পরে সংঘটিত একটি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারা বিধ্বস্ত। 'আউটার পার্টি'র সদস্য হিসেবে তার ওপর দায়িত্ব পড়ে বর্তমান রাজনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সত্য মন্ত্রণালয়ে ইতিহাস পুনর্লিখন করার। উইন্সটন স্মিথের স্মৃতি থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরাশক্তি রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলো ইউরোপে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উপন্যাসের বয়ান অনুযায়ী সেটা ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে ঘটে। যুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের ফলে যুক্তরাজ্যের বড় শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। বিভিন্ন সংকটের মুখে ব্রিটেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে 'ইংরেজ সমাজতান্ত্রিক পার্টি' ক্ষমতা দখল করে এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আমেরিকান দেশগুলোর সঙ্গে মিলে গড়ে তোলে ওশেনিয়া নামক শক্তিশালী রাষ্ট্র। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপের দখল নিয়ে গড়ে তোলে ইউরেশিয়া। আর তৃতীয় পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় পূর্ব এশিয়া। এই তিন মহারাষ্ট্র অন্যান্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো দখল করার নিমিত্তে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যে যুদ্ধের কোনো ফলাফল ছিল না। এই যখন বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা, তখন দেশগুলোর অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে এক অসম সমাজ ব্যবস্থা। ওশেনিয়ার জনগণ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। দলের অভ্যন্তরীণ সদস্যবৃন্দ (ইনার পার্টি), কর্মজীবী সমাজ (আউটার পার্টি) এবং সবশেষে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী। সেই সমাজে ইনার পার্টির সদস্যগণ ছিলেন শতকরা দুই ভাগ। আউটার পার্টির ১৩% এর বিপরীতে প্রায় ৮৫% মানুষের শ্রমজীবী সমাজ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ

‘এপ্রিল ৪, ১৯৮৪’। ভাঙা অক্ষরে নতুন ডায়েরির পাতায় তারিখ লিখলেন 'আউটার পার্টি'র সদস্য উইনস্টন স্মিথ। সত্য মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড বিভাগে কর্মরত উইনস্টনের জীবন অত্যন্ত সাদামাটা। কর্মক্ষেত্রে সরকারি নথিপত্র সংশোধন এবং পুনর্লিখনের কাজ তদারকি করতেই দিন কাটে তার। এভাবে দিনের পর দিন ইতিহাসকে নিজের হাতে ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তুলছেন। কিন্তু সবকিছুই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী 'বিগ ব্রাদার'দের নির্দেশে করছেন। কাজে ফাঁকি দেয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ এক বিশালাকৃতির ক্যামেরা সর্বক্ষণ তাকে নজরদারিতে রাখছে। অফিস, বসতি, ক্যাফেটেরিয়া, পথঘাট সর্বত্র নজর রাখছে সেই ক্যামেরা। এই নজরদারি থেকে কেউ রেহাই পায় না। বিষয়টি যেন কেউ ভুলে না যায়, এজন্য সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়—'বিগ ব্রাদার তোমার ওপর নজর রাখছেন, তাই সাবধান!' উপন্যাসে ব্যবহৃত এই সংলাপটির মাধ্যমে 'বিগ ব্রাদার' শব্দটি ইংরেজি গণমাধ্যমে সরকারি নজরদারির প্রতীক হিসাবে প্রচলিত হয়ে যায়। পুরো পৃথিবী তখন তিন ভাগে বিভক্ত। ওশেনিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং ইউরেশিয়া নামক তিনটি সাম্রাজ্য একে অপরের সঙ্গে বহুবছর ধরে এক অমীমাংসিত যুদ্ধে লিপ্ত। ওশেনিয়ার সর্বক্ষমতার অধিকারী বিগ ব্রাদাররা জনগণকে মুক্তচিন্তা এবং বুদ্ধিবিকাশ থেকে বিরত রেখে এক পঙ্গু মানব সমাজ সৃষ্টি করেছে। এমনকি মুক্তচিন্তা করাও ছিল মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো গুরুতর অপরাধ। শহর জুড়ে টহল দিচ্ছে 'থট পুলিশ' বা চিন্তা দমনকারী পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ। এমন অন্ধকার অভিশপ্ত সমাজে টিকে থাকতে হলে চিন্তা-যুক্তি বাদ দিয়ে অন্ধের মতো বিগ ব্রাদারদের নির্দেশ মান্য করার কোনো বিকল্প নেই। হয়তো উইনস্টনও তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু তার এই আশা পূরণ হলো না। ক্রমশ বিষিয়ে যেতে থাকে তার মন। এভাবে আর কতদিন বেঁচে থাকা যায়? বিগ ব্রাদারদের এই স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করেন তিনি। শুরু করেন ডায়েরি লেখা। বিগ ব্রাদারদের ক্যামেরার নজর থেকে ডায়েরিকে আড়াল করে রাখতেন সবসময়। ধরা পড়লে রক্ষে নেই! শুরু হয় এক নতুন জীবন। নতুন জীবনের শুরুতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কল্প মন্ত্রণালয়ের জুলিয়া নামের এক নারীর সঙ্গে প্রণয় হয় তার। বদ্ধ সমাজ ব্যবস্থায় জুলিয়া যেন সামান্য অবকাশের সুবাতাস নিয়ে হাজির হন তার জীবনে। জুলিয়ার ভেতরেও বিদ্রোহ দানা বাঁধছিল। ধীরে ধীরে উইনস্টন আরও গভীর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ঘটতে থাকে একের পর এক শ্বাসরুদ্ধকর সব ঘটনা। উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা পাঠকদের উদ্বিগ্ন করে রাখে। সবার মনে একই প্রশ্ন—‘উইনস্টন স্মিথরা পতন ঘটাতে পারবেন তো এই বিগ ব্রাদারদের?’ বিগত শতাব্দীর কোনো উপন্যাসই জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর-এর চেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। তাই উপন্যাসটি প্রকাশের প্রায় সত্তর বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও ১৯৮৪ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তখন যা ছিল কল্পকাহিনি, এখন সেটি মোটেই তা নয়। ১৯৯৫ সালে এই বইটি ডাব্লিউ. এইচ. স্মিথ এবং পেঙ্গুইন বুকস থেকে 'শতাব্দীর সেরা গ্রন্থ'-এর পুরস্কার অর্জন করে। মূলত অ্যানিমেল ফার্ম এবং নাইনটিন এইটি-ফোর-এই দুটি বইয়ের জন্যই জর্জ অরওয়েল বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন।

ততদিনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। হিটলারের পতন হয়েছে। পৃথিবী নামের গ্রহটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক দুই পরাশক্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অরওয়েল ইতোমধ্যে হিটলারের জার্মানিকে দেখেছেন। সেদেশে একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান দেখেছেন। একই সময় দেখেছেন স্তালিন নামক এক চূড়ান্ত একনায়ক ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক আরেক রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বগ্রাসী জয়রথ। এদের সবাইকে ছাপিয়ে মহাসমুদ্রের ওপারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রথম উত্তর-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আজীবন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী অরওয়েল এই ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে অতিক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর লাগামহীন উত্থানের ফলে রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে নিপীড়নের যন্ত্র। আপন মতপ্রকাশের যাবতীয় স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাও লোপ হতে পারে ব্যক্তির। জনসাধারণের প্রতিটি পদক্ষেপে নজরদারির অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে সরকার। এরপরও ভিন্নমত চর্চার কোনো চেষ্টা হলে, রাষ্ট্রযন্ত্র অফুরন্ত ক্ষমতা ও শক্তি ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি অথবা দলকে পিষে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। স্বৈরতন্ত্রের বিপদ সম্বন্ধে পৃথিবীর মানুষকে সাবধান করে দিতেই লেখা হয়েছিল নাইনটিন এইটি ফোর গ্রন্থটি। অরওয়েল কেবল সাবধান করেই পার পেয়েছিলেন। ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি মাত্র ৪৬ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই খ্যাতিমান লেখক। 

তথ্য কৃতজ্ঞতা :
১. From Bengal to St Cyprian's. The Unknown Orwell and Orwell: The Transformation by Peter Stansky; William Abrahams, (1994).  Stanford, California, Stanford University Press.
২. George Orwell the Essayist: Literature, Politics and the Periodical Culture  by Peter Marks. Bloomsbury Publishing. 
৩. Orwell: The Life by D.J. Taylor . Henry Holt and Company(2003).
৪.  Eric and Us by Jacintha Buddicom (1974). Frewin. 
৫. Why Orwell Matters by Christopher Hitchens.
Basic Books. 2003.
৬. A Study of George Orwell: The Man and His Works by Christopher Hollis.
Chicago. Henry Regnery Co. 1956.
৭. Orwell in Southwold by Ronald Binns (2018). Zoilus Press.
৮. Secret Histories: Finding George Orwell in a Burmese Teashop by Emma Larkin. Penguin. 2005.
৯. Remembering Orwell by Stephen Wadhams,(1984).Penguin.
১০. Orwell : The Authorized Biography by Michael Shelden. HarperCollins. 1991.
১১. Encyclopedia of British Humorists: Geoffrey Chaucer to John Cleese by Steven H Gale. (1996). , Volume 1. Taylor & Francis.
১২. The Orwell Foundation Institute of Advanced Studies. South Wing Wilkins Building UCL, Gower Street, London WC1E 6BT.
১৩.  স্পেনের গৃহযুদ্ধ: পঞ্চাশ বছর পরে, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, দেজ প্রকাশনা, কলকাতা, ১৮ জুলাই, ১৯৮৮। 


মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাণ, আবৃত্তি ও অনুবাদের পাশাপাশি একজন পরিব্রাজক। বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। তাঁর পৈত্রিক আদিনিবাস ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিকস্থান কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে। ভারতবর্ষে ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ গ্রন্থ চাচনামাহ্ -এর প্রথম ও পূর্ণাঙ্গভাবে অনুবাদ তার হাতে। 

menu
menu