উবা বোবা আমি ও আমার আক্কু ভাই

আক্কু ভাইয়ের সঙ্গে আমার মাখামাখি বহুদিনের। কারণ তিনি সরল মনের মানুষ, আবার খেলাধূলা, মাছ ধরা, পাখি শিকার এসব বিষয়েও দারুণ পারদর্শী। এসব ছাড়াও তার আরও একটা গুণ হচ্ছে  তিনি গল্প বলতে পারেন। তার কাছে অসংখ্য ভূতের গল্প আছে যা তিনি ছিদ্দত আলী কাহেনের কাছ থেকে শুনে মগজের হার্ডডিস্কে জমা করে রেখেছেন।
ছিদ্দত আলীকে যদি গল্পের গুরু বলা হয় তাহলে আমাদের আক্কু ভাইকে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ভূতানিকা বলা যেতে পারে। কেননা অসংখ্য ভূত পেতের নামধাম, এদের জীবন-যাপন তার নখদর্পনে। 
আক্কু ভাইয়ের সঙ্গে আমরা বিভিন্ন অভিযানে বের হই। যেমন দল বেঁধে মাছ ধরি, পাখি শিকার করি, হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলি। আমরা যখন নদীতে গোসল করতে নামি তখন পানির মধ্যে দুটো খেলা খেলি। ‘লাইলাই’ এবং ‘ওন্দুর আলী’। এ খেলার বিশেষত্ব হচ্ছে যে, বুক সমান পানির মধ্যে সবাই গোল হয়ে দাঁড়াই। তখন দলের ভেতর থেকে একজন শ্লোগানেরমতো করে বলেন ওন্দুর আলী। জবাবে আমরা সমস্বরে বলে উঠি হুইহুই। তিনি বলেন নায়ের মাঝি...। আবার আমরা বলে উঠি হুইহুই। এভাবে তিনি জারি-সারি বলে হঠাৎ একজনের দিকে আঙুল তুলে বলেন, তোর সঙ্গে আমাদের আড়ি। এটুকু বলেই তিনি ডুব দিয়ে দূরে সরে যান এবং আমরা তাকে অনুসরণ করে যে যারমতো সরে পড়ি। যার সঙ্গে আড়ি দেয়া হল তখন তার কাজ হচ্ছে দলের একজনকে দ্রæত ছুঁয়ে দিয়ে তাকে ওন্দুর আলী বানিয়ে দেয়া। সে তখন আর একজনকে ছুঁতে মরিয়া হয়ে উঠে। আমরা পানির নিচে ডুব দিয়ে ক্যারিক্যাচার করে তার হাত থেকে বাঁচতে চাই। 
এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টার জলকেলি চলতেই থাকে। চোখদুটো যখন করমচার মতো লাল হয়ে ওঠে তখন আমরা পানি থেকে উঠে আসি। এ অবস্থায় বাড়ি গেলে কারো কারো কপালে ধোলাইও জুটে। তবু আমরা খেলাধূলা বন্ধ করি না। কখনো কখনো আক্কু ভাইয়ের নেতৃত্বে ‘বিসনা’ বাড়ির ক্ষেতে গিয়ে মাছ ধরি। মাছ ধরে শরীরে প্যাঁক-কাদা মেখে বাড়ি ফিরে যদি বড় জ্যাঠার সামনে পড়ে যাই তখন আমাদের দেখে তিনি একটি কবিতা আউড়ান। কবিতাটি হলো এরকম :
“লিখিব পড়িব মরিব দুঃখে
মাছলি ধরিব খাইব সুখে।”
তারপর যতসব গাবর, ধীবর, মাউচ্ছা, মালো বলে ক্ষোভ ঝেড়ে একদিকে চলে যান ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেদেরকে মৌনতার চাদরে ঢেকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি চলে গেলে আমরা ডুলার মাছগুলি উঠোনে ঢেলে দিয়ে ভাগ করতে বসে যাই। মাছ কম হলে ভাগ হয় না। সবগুলো মাছ নিয়ে আক্কু ভাই কুসমির মার ঘরে চলে যান। সেখানে কেটেকুটে আঁশ ছাড়িয়ে ধুয়ে মাছগুলিতে লবণ মরিচ মাখিয়ে মাটির চুলায় আগুন জ্বালান। আগুন ধরে উঠলে চুলার ওপর একটা টিনের খোলা রেখে সবগুলো মাছ তার ওপর বিছিয়ে দেন।
একটু পরপর মাছগুলোকে উল্টিয়ে দেয়া হয়। মাছগুলি সেদ্ধ আর পোড়া হয়ে গেলে নামিয়ে কলা পাতায় রাখি। আক্কু ভাই নিজ হাতে সবাইকে ভাগ করে দেন। তার তৈরি মাছের বারবিকিউ খেয়ে আমরা কুদুমকুদুম করি। শুধু মাছই নয়, তার শিকার করা পাখির মাংসও আমরা এভাবে খাই। 
আক্কু ভাইয়ের মনটা আজ ভালো নেই! 
গতকাল তার তিন তিনটে ঘুড়ি কাটা পড়েছে। হাতেও পয়সা নেই যে ঘুড়ি কিনবে। অপর দিকে আমারও কোনো কাজ নেই। বিকেল বেলা তার সঙ্গে দেখা হলে আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে বসি। এখানে বসে নদীর নিসর্গ আর মাঝিদের জীবন-যাপন দেখি। এবছর এখানে অনেক নৌকা এসেছে। চালের নৌকা, ডালের নৌকা, শুঁটকির নৌকা আরও কত কি। গতকাল একটি বেদে বহরও এসেছে। এরা প্রতি বছরই আসে। 
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এমন সময় পূর্ব দিক থেকে অনেকগুলি কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল হরি বল বল হরি। আমরা দু’জনেই চমকে উঠি। আক্কু ভাই বললেন-শ্মশানে লাশ এসেছে। চল দেখি আসি।  
আমি বললাম, এখনই দিনের আলো মুছে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসবে, এসময় শ্মশানের দিকে যাওয়া ঠিক হবে না। 
কথাটা তিনিও মানলেন। পরক্ষণে তিনি বললেন, জানিস, শ্মশানে লাশ এলে ‘উবা’ খুব খুশি হয়! আমি বলি উবা আবার কে?
তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ওমা তুই জানিস না?  
জানবো কি করে, আগে তো শুনিনি! এটা নতুন কোনো ভূত নাকি?
তিনি বললেন, আরে না! উবা হচ্ছে রাক্ষস গোত্রের এক নিঃসঙ্গ দানব। যেকিনা শ্মশান থেকে শ্মশানে ঘুরে বেড়ায় আর মানুষের পোড়া মাংস খায়!  
শুনে একটু চমকে উঠি আমি।
তবে তিনি আমাকে আশ্বস্থ করে বললেন, ভয় পাবার কিছু নেই। উবা মানুষের পোড়া মাংস খেলেও জীবন্ত মানুষের কোনো ক্ষতি করে না! 
উবা দেখতে কেমন আক্কু ভাই?
দেখতে কুৎসিত, তবে ভয়ংকর নয়।
তুমি কখনো দেখেছ?
বোকা ছেলে। না দেখলে বলছি কী করে!
এ্যাঁ... তুমি সত্যিই দেখেছ উবাকে?
আবার আমাকে জিগায়!
কী করে দেখলে?
সে তুই বুঝবি না। তবে মনে রাখিস উবাকে দেখতে হলে বুকে সাহস লাগে। এবং আরও একটা জিনিস লাগে তা না হলে খালি চোখে দেখা যায় না।
ওটা কি চশমা-টশমা জাতীয় কিছু?
না না চশমা-টশমা না। তবে একন কিছু একটা!
কী ওটা বলো না শুনি।
আরে তুই বুঝবি না।
তুমি বুঝিয়ে বললেই তো বুঝব।
আজ না অন্য দিন শুনিস। বলেই তিনি উঠে পড়লেন। আমিও উঠলাম। 
আক্কু ভাই কখনো মিথ্যা বলেন না, কিন্তু তার রাক্ষস দেখার বিষয়টা কেন জানি মানতে পারলাম না। বিষয়টা ভালোভাবে জানার জন্য আমার মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল আর জেদ চেপে বসল। আক্কু ভাই এতোদিন শুধু ভূতের গল্পই শুনিয়ে গেছেন। এখন দেখছি তিনি নিজেই গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠেছেন। এ রহস্য জানতেই হবে আমার। আমি তক্কেতক্কে থাকি আর তাকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু তিনি এড়িয়ে যান।
কয়েক দিন পর আবারো তাকে জিজ্ঞেস করলাম। এবার প্রচÐ বিরুক্তি ঝেড়ে তিনি বললেন, বেটা তোর বয়স কম। এ বয়সে এসব জানলে ভয় পাবি। ঘুমের মধ্যে ভয়ে আঁতকে উঠবি। বুকে সাহস ছাড়া এসব জানা ঠিক না। 
আমি তার চালাকিটা বুঝতে পেরে চুপ করে থাকি। তিনি সাহস আর বয়সের দোহাই দিয়ে আজও পার পেয়ে গেলেন। তার চেয়ে আমার সাহস যেকোনো অংশে কম নয় সেটা তিনি নিজেও জানেন। আর বয়স? সে আর এমন কি? মা বলেছেন তার বয়স ষোল আর আমার চৌদ্দ। ঠিক আছে, সময় হলে নিজ থেকেই সবকিছু বলবেন। সে অপেক্ষায় থাকি আমি। তিনি পাখি শিকারে বেরুলে আমি তার সঙ্গি হই। তার হাতে গুলতি থাকে আর আমার হাতে থাকে গুলির ব্যাগ। তার হাতের নিশানা খুবই ভালো। কাঠবিড়ালির হাত থেকে বাড়ির নারিকেলগুলো রক্ষা করতে আরজু ভাই তাকে একটা গুলতি বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে কাঠবিড়ালি তাড়াতে গিয়ে তার হাতের টিপ এতোটাই অব্যর্থ হয়েছে যে কাঠবিড়ালি তো দূরের কথা, তার ভয়ে গাছের ডালে এখন একটি চিল, কাক ও বসে না। সেই থেকে আক্কু ভাইয়ের পাখি শিকার শুরু। এখন দশটা গুলি ছুঁড়লে পাঁচটা অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। শিকারে বেরুলে শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, শ্যামা, বক, হরিয়াল মেরে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসেন। 
সাধারণত বাড়ির সামনের আখ ক্ষেত থেকে আমাদের শিকার পর্ব শুরু হয় আর সেটা শেষ হয় মালো পাড়ায় গিয়ে। প্রথমে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আমরা নদীর তীরে আসি। নদীর ভেতরে সাদা বক ঠ্যাং তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। আর থাকে খঞ্জনা, কাদা খোঁচা ও হটটিটি। তিনি নিজেকে আড়াল করে পা টিপে টিপে পাখিটার কাছাকাছি গিয়ে গুলি ছুঁড়েন। এতে কখনো কাজ হয়, কখনো হয় না। হলে গুলি খাওয়া পাখিটা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকলে আমি দৌঁড়ে গিয়ে ওটাকে ধরি। তারপর দু’জনে মিলে জবাই করি। 
অনেক সময় গুলির আঘাতে ওটা আগেই মরে যায়। তবু মাংসটাকে হালাল করার লক্ষ্যে আল্লাহর নাম নিয়ে আক্কু ভাই মরাটার গলায় ছুরি চালান। এভাবে আমরা নদীর তীর ধরে পূর্ব দিকে এগুতে থাকি। 
কিছুদূর এলে একটা বাঁক পরে। এখানে এলে নদীর ওপাড়ের শ্মশানটাও দেখা যায়। শ্মশানের ভেতর শতবর্ষী কয়েকটা অশ^ত্থ গাছ ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা বেশ অন্ধকার। তাকালে গা ছমছম করে। এসময় চিতাটাও চোখে পড়ে। একেবারে নদীর কূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওটা। 
শ্মশানটার ডানে বায়ে বেশ কিছু কাঁচা বাড়িঘর আছে। ওখানে কে থাকে আমরা জানি না। তবে আমাদের এপাড়ে কোনো ঘরবাড়ি নেই। আছে দিগন্ত জোড়া আখের ক্ষেত, আর আছে শিয়াল। আক্কু ভাইয়ের সঙ্গে যখনই এপথ দিয়ে শিকারে যাই শ্মশানটার কাছাকাছি এলে আমার কেবল উবা’র কথা মনে পড়ে। আমি বট গাছের ডালে ডালে উবাকে খুঁজে বেড়াই। আক্কু ভাইকে ডেকে বলি ও... আক্কু ভাই, উবা এখন কোথায়? 
তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, আছে হয়তো কোথাও! 
তুমি তাকে দেখতে পাও না? 
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, আবারও সেই কথা! বললাম না ওটাকে খালি চোখে দেখা যায় না। 
আমি একদম চুপ হয়ে যাই। 
আমরা হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানের সীমানাটা পেরিয়ে আবারও আখ ক্ষেতের ভেতর দিয়ে নদীর বাঁধের উপর উঠে আসি।
বাঁধের নিচের গ্রামটাই ‘মালো’ পাড়া। গ্রামে ঢুকার আগে প্রথমে ধনঞ্জয় কোথায় আছে সেটা জেনে নেই। যদি শুনি সে বাড়িতে আছে আমরা হতাশ হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসি। যখন শুনি সে নেই তখনই দ্রæত গিয়ে তাদের বাঁশ বাগানে ঢুকি। অনেক বড় বাগান। বাগানে হরেক রকম পাখি থাকে। আর থাকে সাদা বক। গাছের ডালে ডালে বকের বাসা। প্রত্যেকটা বাসা ছানাপোনায় ঠাসা। আমরা গাছ বেয়ে উঠে বাসা থেকে ছানাদের চুরি করার চেষ্টা করি। আর না হয় এদের মা-বাবাকে গুলি করে মারি। 
এটা পাখিদের অভয় অরণ্য। আর ধনঞ্জয় হচ্ছে পাখিদের কেয়ারটেকার। কোনো পাখি অসুস্থ হলে অথবা খেলতে গিয়ে আহত হলে সে পরম মমতায় এগুলিকে সেবা শুশ্রƒষা দিয়ে সুস্থ করে বাসায় তুলে দিয়ে আসে। 
ধনঞ্জয়কে পাখিরা একটুও ভয় পায় না। আমরা পাই। আমাদের দেখলেই  সে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। দাঁত-মুখ খিচিয়ে গাল দেয়। কিন্তু শব্দ হয় না। কারণ ধনঞ্জয় কথা বলতে পারে না। সে বোবা। 
ধনঞ্জয়ের তাড়া খেয়ে আমরা ধান ক্ষেতের আল ধরে বাড়ির দিকে দৌড় দিই। নিরাপদ দূরত্বে এসে আক্কু ভাই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ান। তারপর হাতের গুলতিটাকে ধনঞ্জয়ের দিকে বাগিয়ে ধরে তার দিকে মিছেমিছি একটা গুলি ছুঁড়েন। এতে ধনঞ্জয় আরও রেগে যায়। সে পড়নের ধুতিটাকে মালকুচা দিয়ে আমাদের দিকে ক্ষীপ্র গতিতে দৌঁড়ে আসে। তখন আমরা লেজ তুলে পালাই। 
কিছুদিন পরপরই তার সঙ্গে আমাদের এ খেলাটা চলে। এতে করে তার আর আমাদের মাঝে বৈরীতার দেয়ালটা আরও উঁচু হতে থাকে।

২.
উবা’র বিষয়টা নিয়ে প্রচুর তানাবানার পর এখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন আক্কু ভাই। বিষয়টা তামাদি হওয়ার পথে। রাগে দুঃখে আমি তাকে এড়িয়ে চলি। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে একদিন নিজ থেকে এগিয়ে এসে কথা বলেন তিনি। কিরে হুতুম প্যাঁচার মতো গাল ফুলিয়ে আছিস কেন? চল, আজ ‘বুড্ডু’র বনে হরিয়াল মারব। 
আমি বলি না যাব না। 
কেন? ও বুঝেছি ওই বিষয়টা নিয়ে এখনো রাগ করে আছিস? ঠিক আছে! তুই যখন জানতে চাস তাহলে আয় তোকে বলি। 
শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠি আমি। নদীর পাড়ে গিয়ে বসি আমরা। তারপর কিছুক্ষণ একথা সেকথার পর তিনি মূল কথায় আসেন। তিনি বলতে থাকেন আর আমি শুনতে থাকি। এতে অনেক দিনের জমাট বাঁধা বরফ মাত্র কয়েক মিনিটে গলে পানি হয়ে যায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে আক্কু ভাইকে আমার সন্দেহ হয়। আমি অবিশ্বাসীমতো হঠাৎ তার সমস্ত কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বলি ঢপ ঢপ ঢপ! তিনি রেগে গিয়ে বলেন আমাকে মিথ্যাবাদি বলছিস তুই? 
তাহলে প্রমাণ দাও, আমি প্রমাণ দেখতে চাই।
দেখবি?
হ্যাঁ দেখব।
তোমার কোনো কথা বিশ্বাস করি না আমি। 
তিনি আরও বেশি রেগে গিয়ে বলেন, ঠিক আছে; দিনের যেকোনো সময় শ্মাশানে লাশ এলে আমাকে খবর দিবি। তখন দেখব তোর সাহস কত। 
পরস্পরের মধ্যে চ্যালেঞ্জ ছোড়াছুড়ির মধ্য দিয়ে আমাদের আলোচনা শেষ হয়। সেদিন থেকে আমিও উবা’র মতো লাশের অপেক্ষায় থাকি। 
হঠাৎ একদিন সাঁঝের বেলায় নদীর ওপাড় থেকে ধ্বনি উঠে হরি বল ... বল হরি। সে শব্দ নদীর দু’কূল ছাপিয়ে আমার কানে এসে আছড়ে পড়ে। আমি দৌঁড়ে গিয়ে আক্কু ভাইকে বলি-শ্মশানে লাশ এসেছে!
তিনি চমকে উঠেন! কিন্তু পরক্ষণেই বলেন, আজ হবে নারে ভাই। আজ আমার হাতে অনেক কাজ। শুনে আমার সব উদ্যোম ভাটা পড়ে যায়। প্রচÐ হতাশা নিয়ে ফিরে আসি আমি। আক্কু ভাইয়ের ওপর সাংঘাতিক রাগ হয় আমার। তাকে ঠগবাজ,  প্রতারক বলে গাল দেই। 
ইতোমধ্যে অনেক সময় পার হয়ে যায়। শ্মশানে লাশ আসে, উবা’র পেটে অনেক লাশ হজম হয়। শুধু আক্কু ভাইয়ের-ই সময় হয় না। ফলে দু’জনের সম্পর্ক নিম-নিশিন্দার মতো। কেউ কারও ছায়াটুকুও মারাই না। 
এমনি এক বৈরী সময় হঠাৎ একটা সুযোগ এলো। আক্কু ভাইয়ের দ্বারা এমন একটি অপরাধ সংঘঠিত হয় যা খুবই মারাত্মক আর আমিই একমাত্র ঘটনার সাক্ষী। যাকে বলে আই উইটনেস। বিষয়টা জানা-জানি হলে তার যে কী হবে আমি ভাবতেই পারছি না। 
তিনি কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার হাত ধরে বললেন, কাউকে বলিস না ভাই। সঙ্গে সঙ্গে আমি খল নায়কের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলি, বলব না মানে? আমি এক্ষুনি সবাইকে ডেকে আনছি। 
তিনি আৎকে উঠে বললেন, এসব কী বলছিস তুই? আমি না তোর ভাই। 
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বলি, ভাই না কচু। ভাই হলে আমার সাথে কখনো এমন প্রতারণা করতে না। 
তিনি অবাক হয়ে বললেন, আমি আবার কী করেছি? 
কী না করেছেন? দিনের পর দিন উবা’র বিষয়টি নিয়ে কত না তালবাহানা করেছেন মনে নেই? 
বিশ্বাস কর, তুই ভয় পাবি বলে বিষয়টির প্রতি তেমন গুরুত্ব দিইনি আমি। এই তোর গা ছুঁয়ে বলছি কখনো আর এমনটি হবে না। এখন থেকে যেকোনো দিন যেকোনো সময় শ্মশানে মরা এলেই তুই আমাকে খবর দিবি, আমি তোকে নিয়ে         গিয়ে উবাকে দেখাব। 
ভুল হবে না তো? 
একদম না। 
যদি আবারও চালাকি করো আমি কিন্তু সব বলে দেব। 
আক্কু ভাইয়ের কথায় আমি নতুন করে উজ্জীবিত হই। তার অপরাধ মুলতবি রেখে এখন প্রতিদিন শুধু লাশের অপেক্ষা করি। কিন্তু লাশ আর আসে না। দিন যায় আমার উদ্বেগ বাড়ে। একদিন হঠাৎ খবর আসে মালো পাড়ায় কেউ নাকি দেহ রেখেছেন। গিয়ে দেখি আসলেই তাই। ধনঞ্জয়ের জ্যাঠা রসরাজ মালো গতরাতে না ফেরার দেশে রওয়ানা হয়েছেন। এখন তার নশ্বর দেহ নিয়ে চলছে শোকের মাতম। তুলসি থানের নিচে তার দেহটি রাখা আছে। বেশ মোটা তাজা দেহ। শরীরে প্রচুর মাংস তার। 
ঠিক তখনই উবা’র কথা মনে হলো আমার। আজ সে প্রচুর মাংস খেতে পাবে। রসরাজ কি করে মরল এ বিষয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই! আমি শুধু জানতে চাইলাম তাকে কখন চিতায় তোলা হবে। সমবয়সী নিপেন বললো, সন্ধ্যার অগেই তাকে শ্মশানে নেয়া হবে। ব্যস! আমার কাজ এখন এখানে শেষ। সেখানে থেকে এক দৌড়ে ফিরে এসে আক্কু ভাইকে বিস্তারিত জানিয়ে বললাম, তুমি তৈরি হও। আমি জিনিসপত্র যোগার করতে যাচ্ছি। 
এটুকু বলে ঘরে এসে চৌকির নিচ থেকে কাঠ কাটার কুঠারটা বের করে ওটা নিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলাম আখ ক্ষেতে। সেখানে বহু চেষ্টার পর হাতল থেকে ধারালো অংশটাকে আলাদা করে দুটো অংশই বালির নিচে চাপা দিয়ে এসে আক্কু ভাইকে বললাম, সব রেডি করে ফেলেছি। আমার কাজ শেষ। আক্কু ভাই শুকনো হেসে বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে। 
সূর্যটা পশ্চিমে গিয়ে কাত হলে আমরা শ্মশানের দিকে রওয়ানা হই। আক্কু ভাই যেন অসুস্থ রোগী হাঁটতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন। আমি তাকে তাড়া দিয়ে বলি কি হলো ভাই। সঙ্গে সঙ্গে চলার গতি বাড়ে। আমি ঘাসফড়িং-এর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে তার আগে আগে চলি। মনে মনে বলি আজ আমি উবাকে দেখব।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে শ্মাশানটার কাছে চলে আসি। আখ ক্ষেতের ভেতরে এমন একটা জায়গা বেছে নিই যেখানে দাঁড়ালে চিতাটাকে পরিষ্কার দেখা যাবে। শব এখনো আসেনি। তবে কিছু লোক আগেই চলে এসেছে। তারা চেলা কাঠ সাজিয়ে রাখছে চিতার উপরে। 
রসরাজের মরদেহ ওপাড়ে নিতে হলে নৌকা লাগবে। সে কারণে ঘাটে একটা নৌকাও বাঁধা আছে। লাশ আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমার মধ্যে অস্থিরতা বাড়ে। ত্বর সইছে না। আমি আক্কু ভাইকে বলি, উবা এখন কোথায় আছে খুঁজে দেখব কী? 
তিনি না করে উঠেন। এদিকে সাঁঝ গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নদীর জলে কোলা ব্যাঙ আর আখের ক্ষেতে ঝিঁঝি পোকা বিরক্তিকর কনসার্ট শুরু করেছে। রাত জাগা পাখিরা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে পুবের পাহাড়ে। অথচ রসরাজের মরদেহ এখনো আসছে না, এলেই উবাকে আমি দেখতে পাব। এবং আক্কু ভাইয়ের পরে দ্বিতীয় ব্যক্তি যে কিনা একটু পরেই একটা রাক্ষসকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করবে! সেই খুশিতে বুকটা নেচে উঠে আমার। 
এসময় শ্মশানের ভেতরে কয়েকটা মশাল জ্বলে উঠে। মশালের আলোয় লোকগুলিকে স্পষ্ট দেখা যায়। আমি আক্কু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি মনমরা হয়ে আছেন। 
তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে আক্কু ভাই? 
তিনি গা ঝাড়া দিয়ে বললেন-আরে না না। 
ঠিক তখনই নদীর ঘাটে হ্যাজাকের আলো দেখা যায়। হরিবল... হরিবল ধ্বনি উঠে। রসরাজ আসছে। আমি উজ্জীবিত হই। অপর দিকে আক্কু ভাইয়ের অস্থিরতা বাড়তে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে রসরাজের মরদেহ শ্মশানে চলে আসে। চারদিক থেকে ধ্বনি উঠে হরিবল... হরিবল। 
তারপর কিছু ধর্মীয় আচার শেষে রসরাজকে চিতায় তোলা হয়। তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপর আরও কিছু কাঠ তুলে দেয়া হয়।
মৃতের বড় ছেলে পিতার মুখাগ্নি করতে এসে একপর্যায়ে জ্ঞান হারায়।  এসময় একজন দৌড়ে এসে চিতার উপর কেরোসিন ঢেলে দেয়। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। আমি বলি, এখন কি হবে আক্কু ভাই? 
দাঁড়া আগুনটা ভালো করে জ্বলে উঠুক। 
আগুনের লেলিহান শিখা চিতাটাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেললে আক্কু ভাই বললেন, এবার  লুঙিটা খুলে ফেল। 
আমি তাই করি। 
তিনি বলেন-এবার কুঠারটাকে দূরবিনের মতো করে ওর ভেতর দিয়ে চিতার দিকে তাকা। ভয় পাসনে। আমি তোর সঙ্গে আছি। 
তার কথামতো সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আমি কুঠারের ফাঁক দিয়ে উবাকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু সেখানে শবযাত্রী ছাড়া আর কাউকে দেখি না। আড়াইসের ওজনের লোহার পিÐটাকে একবার এদিক আরেকবার ওদিক ঘুরিয়ে ছিদ্রটার ভেতর দিয়ে তাকাই, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ে না আমার। 
আমি বলি ও... আক্কু ভাই কিছুই তো দেখছি না। 
সবুর কর। মাংসটা পোড়া হয়ে নিক। 
আমি তাই করি। আবারও তাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি একটু নীরব থেকে বলেন, এতোক্ষণতো চলে আসার কথা! 
তিনি সংশয় প্রকাশ করে বলেন, এসময়ে অন্য কোনো শ্মশানে কারও দাহ হচ্ছে কিনা কে জানে। 
আমি বলি হলে কী হবে? 
হলে একই সময়ে সে দুই জায়গায় থাকবে কি করে? 
ও তাইতো! 
আমি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাই। হাত থেকে কুঠারটা পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তবু একবার ওটার ফাঁক দিয়ে চিতাটার দিকে তাকাই। এমন সময় প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুÐের ভেতরে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যায়। রসরাজের বুকের উপর থেকে জ্বলন্ত কাষ্ঠ খÐগুলি চিতার দুই দিকে ছিটকে পড়তে থাকে। শব যাত্রীদের মধ্যে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। লোকগুলি চিতাটাকে ঘিরে হরি বল হরি বল ধ্বনি দিতে থাকে। ঠিক তখনই মৃত রসরাজ শুয়া থেকে উঠে পা ছড়িয়ে বসে পড়েন! আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। তাহলে কী উবা চলে এসেছে?
বোধহয় এসেছে!
তা না হলে রসরাজ উঠে বসল কেন?
আমি হয়তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু রসরাজ তাকে ঠিকই দেখেছে। উবা হয়তো মাংসের জন্য তার গায়ে হাত দিয়েছিল। রসরাজ তাকে আজ মাংস খেতে দেবে না। সে কারণেই সে উঠে বসেছে। 
রসরাজ উবাকে ধরবে নাকি? হয়তো ধরবে। এসময় লাঠি হাতে কয়েকজন দৌড়ে আসে। এদলে বোবা ধনঞ্জয়কেও দেখা যায়। তারাও কি উবাকে দেখেছে? হয়তো দেখেছে। আমিই কেবল দেখতে পাচ্ছি না। নিশ্চয় কোথাও ভুল হচ্ছে আমার। হাতের কুঠারটিকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। না! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। 
এসময় আক্কু ভাই বলেন, কী হয়েছে রে? 
আমি বলি-বোধ হয় উবা চলে এসেছে। 
তিনি আৎকে উঠে বলেন-কী বললি? 
আমার কথা শেষ না-হতে ধনঞ্জয়ের লাঠিয়াল বাহিনী লাঠি দিয়ে গুঁতিয়ে রসরাজকে আবার শুইয়ে দেয়। আক্কু ভাই অবাক হয়ে বলেন তুই কী সত্যিই উবাকে দেখতে পাচ্ছিস? 
আমি বলি, উবা নয় উবা নয় বোবা বোবা! 
ঠিক তখনই আমার হাত থেকে কুঠারটা মাটিতে পড়ে যায়। 
 

menu
menu