ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (৫ কিস্তি)

—তোমার পাসপোর্ট দাও।
—এই নাও। 
সোলেমন পাসপোর্ট এগিয়ে দিল। লোকটি পাসপোর্ট আর ভিসা উল্টেপাল্টে নিরীক্ষা করতে লাগল। পাসপোর্টের নম্বরটি বার্মিজ সংখ্যায় এবং ইংরেজিতে লিখল।
—তুমি মুসলিম? 
—হ্যাঁ।
—তুমি কী উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছো?
—চাকরি করতে। 
—কী চাকরি?
—পরামর্শক।
—বুঝলাম না।
—আমি ইউএনডিপির হয়ে কাজ করতে এসেছি।
—তুমি ইউনাইটেড নেশন-এর লোক? 
—হ্যাঁ।
—কোথায় কাজ করবে তুমি?
—রাখাইন স্টেটে।
—তুমি কী কাজ করবে?
—গ্রামীণ শিক্ষা বিস্তারে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করব।
—তুমি কি শিক্ষক?
—না। আমি একজন উন্নয়ন কর্মী, আমি গ্রামীণ শিক্ষাকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করব। 
—তুমি ইঞ্জিনিয়র?
—কী সহযোগিতা করবে তুমি?
—এদেশের শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পে ইউএন সহযোগিতা করছে। আমি এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ তদারকি করব।
—কিন্তু কোন এলাকায় তুমি কাজ করবে সেটা বললে না তো। 
—আমি তো মাত্র এসেছি, আমি নিজেও জানি না কোথায় কোথায় আমাকে কাজ করতে যেতে হবে। 
—তুমি কী ধরনের শিক্ষার জন্য কাজ করবে?
—বুঝলাম না।
—তুমি কি ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করতে এসেছো? 
—এদেশে কি ধমীয় শিক্ষা প্রচলিত? 
—না। প্যাগোডা ভিত্তিক শিক্ষা প্রচলিত আছে, তবে সাধারণ শিক্ষাই সর্বত্র প্রচলিত।  
—ভেবো না। আমি কোনো স্কুলে মাস্টারি করব না।   
—তাহলে তুমি ঠিক জানো না, তুমি কোন এলাকায় কাজ করবে। 

সোলেমন এবার একটু বিরক্ত হলো, আচ্ছা, তুমি আমাকে অত অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করছ কেন? তুমি তো গোয়েন্দা কিংবা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের লোক নও। আমি যতটা জানি, আমার কর্মক্ষেত্র রাখাইন স্টেটের কোথাও না কোথাও হবে। আর সেটা কোন এলাকায় স্থানীয় ইউএনডিপি অফিস আমাকে বলবে। তোমার আর কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাকে করে ফেল।  

—ঠিক আছে। 

অভ্যর্থনা ডেস্কে আসীন লোকটা একটা নিবন্ধন ফরম সোলেমনের সামনে রাখে। এবার লোকটি বিব্রত আর একটু যেন নরমও হলো। সে দেখে, ফরমটা দ্বিভাষিক? বার্মিজ এবং ইংরেজি। 

—আমি কি ফরমটা পুরণে তোমাকে সাহায্য করতে পারি ?
—হ্যাঁ। তুমি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবে।
—আমি নিজেও পুরণ করে দিতে পারি। 

লোকটা সোলেমনের মুখের দিকে তাকাল, তুমি তো বার্মিজ নও। আর তুমি বার্মিজও জানো না। তাই না? 

সোলেমনের ভুল হয়ে যাচ্ছিল। সে শোধরে নিয়ে বলল, আমি তো ইংরেজি জানি।

লোকটি একগাল হেসে বলল, ইংরেজি থাকলেও ছকটি আমাকে বার্মিজ ভাষাতেই পূরণ করতে হবে। বিদেশিরা যাতে বুঝতে পারে ছকে কী তথ্য চাওয়া হয়েছে সে জন্য কোথাও কোথাও ইংরেজি রাখা হয়েছে। তোমার সুবিধার্থে তোমাকে আমি ইংরেজিতেই প্রশ্ন করব। আর তোমার মুখে শোনা তথ্য নিয়ে আমি বার্মিজ ভাষায় বদল করে ছক পূরণ করে নিব। তুমি দয়া করে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবে। 

সোলেমন খেয়াল করল, কোনো কোনো শূন্য ছক কেবল সন্দেহভাজন ব্যক্তির বেলায় পূরণ করার মতো। বার্মিজ ভাষার নিচে কোনো কোনো ছকে ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে। তবে সব তথ্যছকে ইংরেজি নেই। যেমন নাম, পেশা, যে দেশের নাগরিক সে দেশের না, ধর্ম পাসপোর্ট নম্বর ইত্যাদি। কেবল যেসব ছকের নিচে ইংরেজি নেই সেগুলোর ওপর বার্মিজ লেখার উপর * দিয়ে লেখা রয়েছে ‘কেবল দাপ্তরিক প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পূরণযোগ্য।’ সোলেমন ভাবে, সব রাষ্ট্রেরই কিছু গোপনীয় বিষয় থাকে। একজন বিদেশি নাগরিক এসে কোনো হোটেলে উঠলে তার পরিচয় ও তার সম্পর্কে তথ্য থাকা দরকার। যেমন, যে ব্যক্তি এখানে উঠেছেন তার আগমনের উদ্দেশ্য এবং তার অবস্থানকাল কতদিনের আর কোথায় তিনি অবস্থান করবেন এসব তথ্য তো থাকতেই হবে। এদেশে আগমনের আগে তিনি কী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং তার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কে এটাও জানাতে হবে। তিনি রাষ্ট্রের চোখে সন্দেহভাজনও হতে পারেন এসব বিষয়ও হোটেল কর্তৃপক্ষকে মাথায় রাখতে হয় বৈ কি। কিন্তু ব্যক্তিটির ধর্মীয় বিশ্বাস কী সেটাও কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে?

—ঠিক আছে। তুমি ইংরেজিতে বল আমি উত্তর দিচ্ছি।
—তোমার দেশ কোথায়?

সোলেমনের দেশ কোথায়! সোলেমন এবারও একটা ধাক্কা খেল। দেশ মানে স্বদেশ। ওর জন্মভূমি আছে। স্বদেশ নেই। মানুষ কোথাও না কোথাও জন্মগ্রহণ করে। যেখানে জন্মগ্রহণ করে সেটা জন্মভূমি অবশ্যই, কিন্তু স্বদেশ নয়। 

সোলেমন বিলম্ব না করেই বলল, আমি ফ্রান্স থেকে এসেছি।

—এখানে স্বাক্ষর কর।  

লোকটা ফরমটা এগিয়ে দিলে সোলেমন ফরমটায় চোখ বুলিয়ে নেয়। সে দেখে, তারকাচিহ্নিত ঘরে লোকটা বার্মিজ ভাষায় তার মন্তব্য লিখেছে। সে লিখেছে, ওকে সন্দেহজনক কোনো আগন্তুক মনে হয় নি। এবার সে লোকটার ওপর মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু সোলেমন খুশিটা তাকে বুঝতে দেয় না, ইউরোপীয় মেজাজটা তখনো ধরে রাখে। আর যেন অনর্থক ঝামেলা করার কারণে অনেকটা  বিরক্তি নিয়েই সোলেমন স্বাক্ষর করে, ‘এসকে’।

পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে লোকটা বেল টিপলে একটি যুবক এসে সোলেমনের কাছে দাঁড়াল। মাথা ঝুঁকিয়ে ওকে সালাম জানাল। 

লোকটি বার্মিজ ভাষায় যুবকটিকে বলল, এই ভদ্রলোকের মালামাল উপরে ৯৬৩ কক্ষে নিয়ে যাও। আর শোনো, তিনি কিন্তু মুসলিম, তিনি কী কী খাবেন আর কী কী খাবেন না, সব জেনে নিও। তারপর সোলেমনের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলল, তুমি এই ছেলেটার সঙ্গে যাও, সে তোমাকে কক্ষে পৌঁছে দেবে আর সবকিছু বুঝিয়েও দেবে। 

—তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।
—তোমাকে স্বাগতম। হঠাৎ লোকটার মহদং-এর ওপর নজর পড়ল। সে সোলেমনের কাছে, জানতে চাইল, তুমি কাল কোথাও যেতে চাও?


সোলেমনের মনে পড়ল, কাল স্থানীয় অফিসে যেতে হবে। সেখানে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। আর এমন প্রাচীন একটা শহর না দেখে হোটেলে বসে থাকতে বিরক্ত লাগবে।

—আমি বের হবো। স্থানীয় অফিসে যাব আর তারপর সময় পেলে শহরটার এদিক ওদিক ঘুরে দেখব।  
—এ শহরে অনেক কিছু দেখার আছে। তুমি চাইলে ঘুরে দেখতে পার। কিন্তু কোথায় কীভাবে যাবে? 
—তোমাদের কী গাড়ি আছে? আর কোনো গাইড, ঘুরে দেখাবার মতো?
—না। তুমি বললে টুরিজম ডিপার্টমেন্টর গাড়ি আর গাইড ডেকে আনা যাবে। কিন্তু সে ইংরেজি বলতে পারবে কি না আমার ধারণা নেই। আর তার জন্য তোমাকে কিয়াট গুনতে হবে। সেটাও খুব অল্প হবে না। 
—তাহলে আমি আমার অফিসে কী করে যাব? বিকল্প কী ব্যবস্থা করা সম্ভব? 

লোকটা আবার সোলেমনের দিকে তাকাল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বরং এই ট্যাক্সিড্রাইভারকে কালকেও নাও। সে আমাদের চেনাজানা। সে আমাদের তালিকাভুক্ত এবং ওর লাইসেন্সের ফটোকপি আগে থেকেই হোটেলে জমা আছে। এই হোটেলের অনেক অতিথিকে সে আগে শহর ঘুরিয়ে দেখিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় নিয়েও গেছে। যাদের নিয়ে গেছে তারা সকলেই ওর প্রশংসা করেছে। 

সোলেমন ইচ্ছা করেই বাড়তি প্রশ্ন করে, তুমি কি তাকে বিশ্বস্ত মনে করো?

—সে কখনো বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, এমন তথ্য আমার কাছে নেই। তবু তুমি নিজে থেকে সাবধান থাকবে। নিরাপত্তা আসলে নিজের বিষয়।
—আমি বিদেশি লোক, আমাকে তো সাবধান থাকতেই হবে।

অভ্যর্থনাকারী অতিথির দিকে তাকিয়ে বলল, নবম তলায়, ডানদিকে। আর ওয়েটারের হাতে কক্ষের চাবি দিয়ে বলল, এই ছেলেটি তোমাকে বরাদ্দকৃত কক্ষে নিয়ে যাবে। আশা করি, তুমি মারমেইড-এ নিরাপদে আর আনন্দে থাকবে। কোনো প্রয়োজনে শূন্য চেপে আমাকে অথবা আর কাউকে পাবে। তোমার সিটোয়ে অবস্থানকাল সুখের হোক।

—তোমাকে ধন্যবাদ।   

লিফটে চড়ে সোলেমন নবম তলায় উঠল। অতঃপর লম্বা করিডোর পেরিয়ে সেওর জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষের দরোজায় পৌঁছে গেল।

কক্ষটি বেশ বড়, পরিপাটি আর সাদা পর্দায় জানলা ঢাকা। সোলেমন জানলার পর্দাটা সরিয়ে দেখতে পেল,দিগন্ত ছুঁয়ে আছে অসীম নীলাকাশ আর এর নিচে অফুরন্ত জল ততোধিক নীল। ওর মন আলোকিত আকাশ আর নীল জল দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেল। সে মনে মনে মহদংকে অন্তত একারণে একটা ধন্যবাদ দিল। আর জামা কাপড় পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখল, টেবিলে রাখা ফেনায়িত কফির পেয়ালা থেকে বাষ্প উঠছে।

সোলেমন গরম কফিতে চুমুক দিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে ওর আন্দাজ সঠিকই ছিল। বিশাল নীলের নিচে সফেদ ঢেউ একের পর এক ভাঙছে আর গড়ছে। সফেদ ঢেউয়ের উপর পাখা মেলে উড়ছে আরো সাদা সাদা সমুদ্রকপোত। দু’একটি জানলার খুব কাছে এসে কাচে পাখার ঝাপটা দিয়ে আবার দূরে চলে গেল। সোলেমনের মনে হয়, পাখিগুলো ওকে স্বাগত জানাতে এসেছিল। কফি শেষ করে সফেদ চাদরে ঢাকা বিছানা দেখে ওর চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে। 

পাঁচ

দু’পাশের ঘরবাড়ি আর পথের যানবাহন দেখতে দেখতে সোলেমন পথ চলছে। ঐতিহ্যবাহী নকশা করা চাল আর দেয়ালে কারুকার্যময় কাঠের দরোজা লাগানো বাড়িঘর চোখে পড়ছে। আধুনিক দালানকোঠা কমই চোখে পড়ছে। ব্রিটিশ শাসনামলের স্মৃতিবহ কিছু দালানকোঠা আর বাংলো দেখা যাচ্ছে। তবে রাস্তায় মটর গাড়ি চোখে পড়ছে না। দু’একটা খোলা জিপ অনেক যাত্রী নিয়ে প্রকট শব্দ করে চলছে আর পথে পথে যাত্রী তুলছে আর নামাচ্ছেও। পেছনে একটা লোক পা রাখার জায়গায় দাঁড়িয়ে হাকডাক করছে, থামবার জন্য আর চলবার জন্য শব্দ করছে। এমনটা সে বাংলাদেশে দেখেছে। বিশেষ করে কক্সবাজার আর টেকনাফ সড়কে একই রকম গাড়ি একই কায়দায় চলতে দেখেছে। তিনচাকার যানবাহনই রাস্তা দখল করে রেখেছে। তবে যন্ত্রচালিত তিনচাকার চাইতে শারীরিকশক্তি চালিত তিনচাকাই অধিক। কিছুদূর এগোলে তৈরি পোশাক, প্রসাধন আর ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানপাট চোখে পড়ল। দোকানে নারীরা পসরা সাজিয়ে বসে আছে। খদ্দের তেমন চোখে পড়ছে না। কোনো কোনো দোকানে বার্মিজ গান বাজছে।

একটা জটলা দেখে মহদং হর্ন বাজালেও কয়েকটা ত্রিচক্রযান পথ আটকে রইল। পথের উপর ট্রাইসাইকেলে যাত্রী বসিয়ে রেখেই চালকরা তর্ক-বিতর্ক করতে থাকল। তারপর একসময় অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজও শুরু হলো। সোলেমন লোকটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল একটি মাঝ বয়সী রোহিঙ্গা তার সাইক্কার চাকা অপর একটি সাইক্কার চাকার শিক থেকে ছাড়ানোর জন্য গলদঘর্ম কসরত করে যাচ্ছে। মহদং গাড়ি দাড় করিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে লোকটার গাল খেতে খেতে চাকা ছাড়ানোর কসরত দেখছে। আর তখন একজন বার্মিজ ভাষায় গালি দিয়ে তেড়ে এসে লোকটার মুখে ঘুষি লাগিয়ে দিয়েছে। ট্রাইসাইকেলের আরোহিণী ভয় পেয়ে নেমে গেল। লোকটি প্রথমে গালি এবং তারপর মুখের উপর মারটাও নীরবে সহ্য করছে। শেষ পর্যন্ত সে ছাড়াতে পারলেও চাকার শিক দুটো ছিঁড়ে গেছে। সে কোনো রকমে ওর তিনচাকা সরিয়ে নিয়ে পথের পাশে রাখল। তারপর মুখের উপর আঘাতের স্থানে হাত দিয়ে ঘষতে লাগল। যেন এতক্ষণ পর মুখে আঘাতটা টের পাচ্ছে। 

মহদংও গাড়ি বন্ধ করে দাঁড়িয়ে বিমর্ষ চোখে মারখাওয়া লোকটার গালে হাত ঘষা দেখছে। ওর চেহারায় গতকালের সেই উৎফুল্লতা আর নেই। সোলেমন বুঝতে পারছে লোকটার জন্য সেও ব্যথিত হয়েছে। সোলেমনের মনে হলো আঘাতটা মহদং-এর মুখেও লেগেছে। কিন্তু সে ওহ শব্দটাও করতে পারছে না। সে কিছু করতে পারছে না বলেই যেন অস্থির বসে বসে অক্ষম দুহাতের আঙুল মটকাতে লাগল। 

যানজট ছুটে গেলে মহদং গাড়ি স্টার্ট নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে গজ গজ করতে করতে থাকে। কিছুদূর গিয়ে খাস রোহিঙ্গা ভাষায় ভেতরের ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল, কত আর মার খাবে রোহিঙ্গারা? এদেশে মুসলমানদের মেরে ফেললেও কেউ এগিয়ে আসবে না। কোথাও কারো কাছে নালিশও করা যাবে না। এমন অপমানজনক জীবন যাপন মানুষ করতে পারে? এ দেশটা কি চিরকাল মগের মুল্লুকই থেকে যাবে?

তারপরও সোলেমন কোনো মন্তব্য করল না। সে বাইরে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে, সেও বুঝি নীরবে একটা আঘাত হজম করেছে। পথে লোকজনও বেশি চোখে পড়ছে। ধীরে ধীরে গাড়ি চলছে। সে বুঝতে পারছে না এমন একটা জনাকীর্ণ পথ ধরে মহদং ওকে নিয়ে যাচ্ছে কেন। সে মনে মনে বিরক্ত হলো, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারল না। 

আর এ সময় মহদং নিজে থেকেই আবার মুখ খুলল, তোমার কি মনে হয় আর কোনো দেশে একটি জাতিগোষ্ঠি এমন অপমানজনক জীবন যাপন করে? 

সোলেমন চুপ করে থাকে। এরপর মহদং কিছুক্ষণ চুপচাপ, গাড়ি চলছে। জবাব না পেলেও সে আবার প্রশ্ন করে, হাজার বছর ধরে বাস করলেও দেশের মাটিতে অধিকার জন্মাবে না, এমন দেশ কি পৃথিবীতে আর কোথাও আছে? বল তুমি। 

আয়নায় মহদং-এর রাগান্বিত মুখটা একপলক দেখে নিয়ে সোলেমন আবার জানলার বাইরে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। গাড়ি বসতি আর দোকানপাট দুপাশে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব সিনেমার মতো ওর চোখের সামনে থেকে সরে গেলেও মনের ভেতর হাজার বছরের আরাকান ভেসে উঠছে।

একজন বিদেশি ভেবে মহদং মনের আবেগ হয়তো ধরে রাখতে পারছে না। আর সোলেমন কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। বৈসালি, ম্রোহং আরো কত কত নাম আর জনপদের কথা সোলেমনের মনে ভেসে উঠতে লাগল। তবে সবকিছু ছাপিয়ে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার প্রেক্ষাপট নিয়েই সে ভাবতে থাকে।  

তুমি যে দেশে জন্মেছ সেটা কি তোমার স্বদেশ নয়? মাতৃভূমি তোমার দেশ হবে না! তুমি সে দেশের নাগরিক হবে না? তুমি বলো, আমাকে। 

মহদং সোলেমনের চোখে চোখ রাখল। সে কেবল তাকিয়ে থাকে তা নয়, ওর উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে। যেন সঠিক উত্তরটা সোলেমনের কাছেই সে পাবে। কিন্তু সোলেমন এ প্রসঙ্গে নিজেকে সংযত রাখবে। সোলেমনের মনে হয় মহদং-এর বুকের ভেতরের রাগ আর গাড়ির শব্দ যেন মিলেমিশে বের হয়ে আসছে। গাড়ির চাকার ঘর্ষণেও বুঝি যন্ত্রণার কাতরানি প্রকাশ পাচ্ছে। সে চুপ করে থাকে আর মহদং তখন বিগড়ে যাওয়া পুরোনো গাড়ির ইঞ্জিনের মতো ফুস ফুস করতে থাকে।     

একটা দেশে হাজার বছর বাস করেও সে দেশের নাগরিক হবে না? এটা কে মেনে নেবে, তুমি বল? তুমি কি মেনে নেবে? কোনো দেশের লোক মানবে? 

গাড়িটা চলতে থাকে এবং হঠাৎ কোথাও ধাক্কা খায়। মহদং-এর প্রশ্ন সোলেমনকে বুঝি ধাক্কা দিয়ে ওর ভেতরের কথা বের করে নিতে চায়। সে সোজা হয়ে বসে। কিন্তু কথা বলে না। সে ভুলে যায় না, মহদং এখন বার্মিজ আর ইংরেজি মিশিয়ে কথা বললেও খুব কমই সেখানে ইংরেজি শব্দ উপস্থিত। হয়তো সে ভুলে গেছে একজন বিদেশি লোক বার্মিজ ভাষা জানবে না। অথবা বিদেশি লোক যে বার্মিজ জানবে না, সেটা ভেবেই সে বকে নিচ্ছে। সোলেমন আন্দাজ করছে, যে কারণেই হোক, মহদং ওর বুকে জমে থাকা আক্ষেপ বের করতে চাইছিল, সেটা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করতে পারছিল না বলেই মওকা পেয়ে আজ প্রকাশ করছে। মহদং কাদের সম্পর্কে বলছে সোলেমন আন্দাজ করতে পারলেও ওকে সে কথা বুঝতে দিতে চায় না। 

—তুমি কাদের কথা বলছ?
—রোহিঙ্গা-এদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী। তুমি এদের সম্পর্কে জান না কিছু? রোহিঙ্গাদের ওপর কী নিপীড়ন চলছে তোমরা তার কিছুই জান না? (চলবে)


ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (৪ কিস্তি)

menu
menu