ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (৪ কিস্তি)
আকিয়াব বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে। মহদং আরো জানাল, ওখানেই প্যাগোডাও। এ মন্দিরের নাম থেকেই তো ইংরেজরা বন্দরের নাম আকিয়াব রেখেছিল। ঐ প্রাচীন স্থাপনা এখনও পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ। পর্যটকরা ওখানে বেড়াতে যায়। আর স্থানটি কারো জন্যই নিষিদ্ধ নয়।
সান্দিকান সম্পর্কে সোলেমন জানে। আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহং এ এটার অবস্থান। আকিয়াবের সবচাইতে প্রাচীন মসজিদ সান্দিকান। রাজা নরমিখলা মুসলিম সৈনিক বসতির জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সান্দিকান মাদ্রাসাও এর কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি আকিয়াবের সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা। সোলেমনের মনে আছে, ওর পিতা এই মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছিলেন। এটি একটি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আরব বণিকদের উত্তরসূরীরা তাদের সন্তানদের ইসলামি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে নিজেদের উদ্যোগে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল। এখানে মুসলিম রীতি অনুযায়ী একই সঙ্গে ইসলামি দর্শন ও চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা দেয়া হয়। এখান থেকেই ওর পিতা হেকিমি তীব্ব-এ নবীর ওপর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। পিতার মুখে সে এই মাদ্রাসার কথা গল্পের মতো শুনেছে। তার বড় সাধ ছিল সোলেমনকে তিনি এই মাদ্রাসায় পড়াবেন। সে বড় হয়ে একজন হেকিম হবে। অসুস্থ মানুষকে শেফা দিয়ে সারিয়ে তুলবে। ওর পিতা বলতেন, অসুস্থ মানুষের সেবা করাই হলো মানুষের সবচাইতে বড় ইবাদত। আর হেকিম-কবিরাজগণ অসুস্থ মানুষের বিপদের বন্ধু। কিন্তু ওর পিতার সে সাধ পূরণ হয় নি। সান্দিকান মাদ্রাসা দূরে থাক মংডু মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ওকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। ওক্কাডা কিছুতেই একটি রোহিঙ্গা কিশোরকেও এলাকার বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয় নি। এমনকি, ওকে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করাতে বেগ পেতে হয়েছিল। ওর মা মগ নারী না হলে প্রাইমারি স্কুলেও ওকে তখন ভর্তি করাতে পারত না। প্রাথমিক শিক্ষার পর ওর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলে অগত্যা ওর পিতা ছেলেকে বনজঙ্গলের গাছপালা চেনাতে লাগলেন। শিশু সোলেমন নিজেও পিতার সঙ্গে লতাপাতা তুলে আনতে যেত। ওদের বাড়িতেই শেফা দাওয়াখানা ছিল। পিতা হেকিম আব্দুল মোতালেব পাহাড়-জঙ্গল থেকে ভেষজ সংগ্রহ করে মানুষের চিকিৎসার জন্য দাওয়ায় প্রস্তুত করে দিতেন। পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে হামান দিস্তায় লতাপাতা পিষে দিত। ছাঁকনি দিয়ে ছেকে দিত। বোতলে ভরে দিত। কোনো কোনো অসুস্থ লোককে সে দাওয়ায় খাইয়েও দিত। তিতা দাওয়াই খেতে না চাইলে সে বলত, তিতা দাওয়াই খেলে তাড়াতাড়ি অসুখ সেরে যায়। কেউ দাওয়াই মুখে নিতে না চাইলে এমন কথা সে ওর পিতাকে বলতে শুনত। ওর কথা শুনে কেউ কেউ মজা পেত আর হাসত। কেউ কেউ ওকে ছোটো হেকিম বলেও ডাকত। ওর পিতা হেকিম আব্দুল মোতালেবকে অনেকেই নগদ অর্থ দিতে পারত না। কেউ কেউ সারা বছরের চিকিৎসার বদলে মৌসুমে ধান কেটে বাড়িতে এসে ধান দিয়ে যেত। ওর পিতা কেবল রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাই করত না। মগরাও তার কাছে দাওয়ায় নিতে আসত। বলত, আল্লাহ তা’আলা অসুস্থ মানুষের সেবা করতে বলেছেন, কোনো বিশেষ ধর্মের লোক বা নাস্তিকের চিকিৎসা করতে মানা করেন নি। বাবা নাড়ি পরীক্ষা করে অসুখ নির্ণয় করে দিলে মগ আর রাখাইনদের অনেকেই আবার নিজেদের মতো করে লতাপাতা তুলে নিয়ে আসত। ওর পিতা সেগুলো ঠিক আছে কি না দেখে দিত। কোনো কোনো লতাপাতা ওর পিতার নির্দেশ করা ভেষজের সঙ্গে মিলত না। তখন ওর পিতা তাদের কাছে সেই সব ভেষজের গুণাগুণ সম্পর্কে জেনে নিত। ওর পিতা বলত, সৃষ্টিকর্তা যেখানে মানুষ পয়দা করেন সেখানে তার অসুখ বিসুখ সারানোর উপায়ও রাখেন। আর প্রত্যেক সমাজের মানুষকে সেগুলো চিনিয়েও দেন।
সোলেমন মসজিদ সম্পর্কে বিশেষ কোনো উৎসাহ প্রকাশ করল না। সে বরং জানতে চাইল, আর কী কী দেখার আছে এই শহরে?
বৌদ্ধ মন্দির, ওয়ার সেমিট্রি, সমুদ্রবন্দর, সমুদ্রসৈকত আর চৈনিক ও বার্মিজ পণ্যের মার্কেট? পর্যটকরা সচরাচর এসব জায়গায় যেতে আগ্রহ দেখায়।
—তুমি এসব জায়গা চেন?
—খুব চিনি। কতবার গিয়েছি।
—তুমি কি সব সময় এই শহরেই গাড়ি চালাও?
—এখন এ শহরেই চালাই। তবে আরাকানের বেশিরভাগ এলাকাই চিনি। কখনো কখনো অনেক দূরে, এমনকি রথে দং আর বুথিদং পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে গিয়েছি। আর দু’বছর ইউএনএইচসিআর-এর গাড়িও চালিয়েছি। সেটা ১৯৯৫ আর ৯৬ সালে।
সোলেমনের মনে পড়ছে, ১৯৯৪ সালে এদেশের ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধি বাংলাদেশের ক্যাম্প দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু তারা শরণার্থীদের সঙ্গে কোনো কথা বলে নি। ইউএনএইচসিআর-এর সঙ্গে কক্সবাজারে মিটিং হয়েছিল। সে মিটিং-এ মাঠপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। ফলে সে কিংবা রুবিনা কেউ জানতে পারে নি কী কথা হয়েছিল। কেবল প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রস্তুতি নিতে হবে এমন সিদ্ধান্তই ওদের জানানো হয়েছিল। তার পর মায়ানমারের মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আর নাসাকার অন্যান্য কর্মকর্তাও বাংলাদেশের নয়াপাড়া আর দমদমিয়া ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তারাও শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে চান নি। শরণার্থীরা তাদের উপস্থিতিতে মুখে কালো কাপড় বেঁধে কালো পতাকা প্রদর্শন করেছিল। তারা তখনও তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্য দাবী জানিয়েছিল। তারপরই অবশ্য পরিবার তালিকা মায়ানমারে প্রেরণ শুরু হয়েছিল আর কিছুদিনের মধ্যেই শরণার্থী প্রত্যাবাসন শুরু হয়েছিল। সোলেমন বুঝতে পেরেছিল, বাংলাদেশের তখনকার সরকারকে চীন কূটনৈতিক সাপোর্ট দেবার কারণে মায়ানমার কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে সরকার বদল হলে অবশিষ্ট শরণার্থী ফিরিয়ে আনতে মায়ানমার আর রাজি হলো না।
—তুমি তাহলে আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়িও চালিয়েছো।
—হ্যাঁ, সাহেব চালিয়েছি।
—কত বছর যাবত তুমি গাড়ি চালাও?
—কম করে হলেও পনের বছর। তার বেশিও হতে পারে। আমার বাপও ট্যাক্সিই চালাত। বাপই আমার ড্রাইভিং-এর ওস্তাদ ছিল। তার নিকটই আমি গাড়ি চালানো শিখেছি। আর এই গাড়িটাও বাপ চালাত।
—তোমার মা-বাবা কী তোমার সঙ্গেই থাকে?
—আমার বাপ মারা গেছে। মা বেঁচে আছে। একটা ছোটো বোন আছে। বোনটার বিয়ে হয়েছিল। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, ওর স্বামীও মারা গেছে। মগের হাতে অকালে প্রাণটা দিতে হলো ওকে। একটি ছেলে সন্তান নিয়ে বোনটা আমার কাছেই আছে।
—মহদং-এর পরিবারের ছবিটা সোলেমন কল্পনা করতে পারছে। মহদং-এর মুখে মা আর বোনের কথা শুনতে শুনতে সে একটা বাড়ি, একটা উঠোন একটা কিশোরীর মুখ দেখতে পাচ্ছে।
—সোলেমন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল, তুমি বলতে চাও, মারমেইড হোটেলটা থাকার জন্য বেশ ভালো হবে?
একসময় এটিই ছিল আকিয়াব বন্দরের সবচাইতে অভিজাত হোটেল। লোকে বলে, শতবছর আগেও আরব আর ইউরোপের বণিকরা বাণিজ্যতরী ভিড়িয়ে এই হোটেলেই উঠত। এখন আরো অনেক হোটেল হয়েছে। সেগুলোতে সুবিধাদিও অনেক বেশি। তবে সে সবের খরচও বেশি। কিন্তু যারা পুরোনো ঐতিহ্য পছন্দ করে আর কম খরচে নিরিবিলি থাকতে চায়, তারা মারমেইডকেই বেছে নেয়। তুমি এদেশে নতুন এসেছ। কেন বেশি খরচ করবে? তুমি নিশ্চয় অনেক খরচ করতে চাও না।
মহদং-এর পরামর্শ সোলেমনের পছন্দ হলো। সে বুঝতে পারছে, আকিয়াব শহর সম্পর্কে মহদং বেশ জানে।
সোলেমন মহদং-এর মতামতকে সমর্থন করল, আমি ঐতিহ্য পছন্দ করি। আর খরচও কম করতে চাই। বেশি খরচ যারা করে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না।
সহসা মহদং মুখ ফিরিয়ে সোলেমনের মুখের দিকে তাকাল। ওর চোখ দেখে সোলেমন আন্দাজ করে সোলেমনের কথায় সে খামোশ হয়েছে। আর এর কারণ ওর কথায় প্রকাশও পেল।
—তুমি মুসলিম!
—হ্যাঁ। কী করে বুঝলে?
মহদং উত্তর না দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। তার মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটে উঠেছে। সোলেমন এতক্ষণে আরো বেশি ভাবতে পারছে, মহদং মুসলিমই হবে। সে যাই হোক, সোলেমন ভাবে, নিজের নিরাপত্তার জন্য ওকে অবশ্যই সব সময় সচেতন থাকতে হবে। এরই মধ্যে একটা ভুল সে করে ফেলেছে। আর যেন ভুল না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেই হবে। সে যে ওর মুসলিম পরিচয় প্রকাশ করেছে ফেলেছে এটা যদি মহদং-এর মাধ্যমে কোনোভাবে কর্তৃপক্ষের কাঠে প্রকাশ পেয়ে যায়? সোলেমন ভাবে, একজন মুসলিম হিসেবে এরকম দুর্বল চিন্তা করা হারাম। মুসলমান সবসময় নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেবে, এটা ঈমানের অঙ্গ। তাই সে নিজের ভাবনাকে সামলে নেয়।
নির্জন পথ। দু’পাশে উঁচু নিচু টিলা। এখানো ওখানে কিছু পুরোনো বাড়িঘর আছে। গাছপালা নারকেল, সুপারি ছাড়াও কাঁঠাল আর কমলাজাতীয় ফলের চোখে পড়ছে। কোথাও কোথাও টিলার মাথা ছেঁটে নতুন বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। বসতির সংযোগ রাস্তাও বেশ চওড়া। সোলেমন আন্দাজ করে, খুব বেশিদিন আগে এসব নির্মিত হয়নি। দেখতে দেখতে যেতে সোলেমন একসময় খেয়াল করে, মহদং যেন গাড়ির আয়নায় ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর গাড়ির গতিও যেন কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। তারপর আরো খেয়াল করে, মহদং এখন প্রফুল্লচিত্তে গাড়ি চালাচ্ছে।
—মহদং বলল, আমিও মুসলিম।
মহদং একজন মুসলিম একথা জানার পরও সোলেমন ওর ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কথা বলা সমীচীন মনে করল না। গাড়ি চলছে আর সোলেমন চুপচাপ বসে চারপাশ দেখছে। পথের পাশে গাছপালা ওর নজর কাড়ছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে মহদং সোলেমনের দিকে ফিরে বলল, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।
—বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা আসছে কেন?
মহদং গলা নিচু করে অনেকটা গোপন কথা বলার মতো করে বলল, তোমাকে মনে রাখতে হবে, তুমি একজন মুসলমান। আর তুমি মগের মুল্লুকে এসেছ। এদেশে কোনো মুসলিম, সে এদেশের হোক আর বিদেশি হোক সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। তাই তোমাকে তোমার ধর্মীয় পরিচয় যথাসম্ভব গোপন রাখতে হবে। তুমি ফেরাই, এটাই তোমার বড় পরিচয়, তুমি যে একজন মুসলিম সেটা কখখনো প্রকাশ করবে না। আমার কথাটা মনে রেখ।
সোলেমনের মনের আকাশে কালো মেঘের মতো অতীত ভেসে উঠছে। নিকট অতীতের ছাড়িয়ে সুদূর অতীতও ওর মনে ছায়া ফেরছে। সে যেন এখনও ওদের আঙিনায় দাঁড়ানো নাসাকার সদস্যদের দেখতে পাচ্ছে। ঘর থেকে ধানচাল বের করে দিচ্ছে মানুষ। নেকড়ের কবল থেকে হরিণছানার মতো ঝোপঝাড়ের ভেতর লুকিয়ে থেকে যুবতী মেয়েরা বাঁচার চেষ্টা করছে দেখতে পাচ্ছে। তারপর গ্রাম কি জ্বলতে দেখতে পাচ্ছে। স্মৃতির আগুন ওকে পুড়িয়ে দেবার আগে মহদং ওকে পুনর্বার সতর্ক করতে মুখ খুলল।
—তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।
মুসলিম হওয়াতে এখানে কী ধরনের অসুবিধা হতে পারে? সে বিষয়ে সোলেমন কোনো আগ্রহ দেখাল না। কিন্তু মহদং নিজে থেকেই এ বিষয়ে আরো কিছু বলার জন্য উসখুশ করতে থাকে। বারবার অকারণে গাড়ির আয়নায় সোলেমনের চোখে চোখ রাখছে দেখে সে মহদং-এর মনোভাব বুঝতে পারছে। যেন সে একজন ভিনদেশি মুসলিমকে সাবধান না করে পারবেই না।
মুসলমানরা এখানে কী বিপদের মধ্যে আছে তুমি তো সেটা জানো না। বিদেশি হলেও মুসলিম হওয়ার কারণে কোনো কোনো হোটেলে তুমি থাকতে পারবে না, তোমাকে রুম দেবে না।
—সেটা হয়তো হারাম-হালালের কারণে।
—সেটা আসল কারণ নয়। এদেশের বৌদ্ধরা মুসলিম দেখতে পারে না। বলতে পারো সহ্য করতে পারে না, শত্রু মনে করে।
মহদং-এর মনের ভেতর কী আছে সোলেমন যেন এতক্ষণে আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু সে ওর সঙ্গে এদেশের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায় না। সে বরং খাবার নিয়েই কথা বলে, তুমি জান কি, মারমেইড হোটেলে হালাল খাবার পরিবেশন করে কি না?
মহদং বলল, তোমাকে বলেছি, মারমেইড পুরোনো ঐতিহ্যবাহী হোটেল। ওখানে কোনো সমস্যা হবে না। সে আরো বলল, একসময় এর মালিকও মুসলিমই ছিল। আসল মালিকের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা এই হোটেল বেচে দিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে।
সিগন্যালে লালবাতি দেখে গাড়ি থামিয়ে মহদং চুপ করে গেল। সোলেমনের মনে হচ্ছে, মহদং যাত্রীর বোধগম্যতার কথা বিবেচনা না করেই বক বক করে যাচ্ছে। কিন্তু সে বিষয়বস্তু থেকে কিংবা পূর্বের প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছে না। সর্বশেষ বাক্যের সঙ্গেও সংযোগ রক্ষা করেই সে কথা বলছে। সে যে বেশিক্ষণ অর্ধ বার্মিজ আর ভুল ইংরেজিতেও চালাতে পারছিল না সেটা যেমন সোলেমন ভুলে গিয়েছিল তেমনি সেও হয়তো ভুলে গিয়ে থাকবে।
সোলেমন দেখে, এখান থেকে চারটা পথ চার দিকে চলে গেছে। কোনটা কোথায় গেছে সেটা বার্মিজ ভাষায় লেখা আছে। সোলেমন সে লেখা পড়তে পারছে। একটা চিহ্ন সাগর সৈকতের দিক নির্দেশ করছে। আরেকটা নতুন বসতির দিক। অন্যটা কালাদন এলাকার পুরোনো বসতি। আর পেছনে ফেলে এসেছে সিটোয়ে এয়ারপোর্ট।
সবুজ বাতি জ্বললে মহদং ডান দিকে মোড় নিয়ে চলতে চলতে আবার কথা শুরু করল। সে কথা বলছিল বার্মিজ আর ইংরেজি মিশেল দিয়ে। মহদং জানাচ্ছে, তাদের ইউরোপে পাড়ি না দিয়ে উপায়ও ছিল না। বেঘোরে প্রাণটাও যেতে পারত। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াতে প্রাণটা অন্তত রক্ষা করতে পারল। আর পয়সাওয়ালাদের এই একটা সুবিধা তো আছেই। বিপদ দেখলে অর্থকড়ি নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে। আবার কেউ আগেবাগেই টাকাপয়সা পাচার করেও রাখে। দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তো কেউ বাধা দেয় না। আর তাড়াতে পারলেই তো ওদেরও সুবিধা। যত পার কৌশলে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দাও। আর ফিরে আসতে চাইলে বাধা দাও। একবার চলে গেলে আর কেউ কখনও ফিরে আসতে পারে না। এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া মানে চিরতরে চলে যাওয়া।
মহদং ওর বকবক শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সোলেমনের মনে হলো, ওর কথা এবার ফুরিয়ে এসেছে। ট্যাক্সিটা তখন কালাদন নদীর তীর ধরে চলছে। ডানপাশে প্রশস্ত সুনীল নদী নীরবে বয়ে চলেছে, আর বামপাশে ছড়ানো ছিটানো ইতিহাসের চিহ্ন নিয়ে শহর কালের সাক্ষ্য বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে নতুন উঁচু ভবন ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা রূপে মাথাচারা দিয়ে উঠছে।
সুন্দর রাস্তা। দু’পাশে সবুজের সমারোহ। সোলেমনের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। সে পথের আইল্যান্ডে স্থাপিত বার্মিজ ভাষার পথের বিবরণ লেখা পড়তে পারছে দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে। সে ভাবছে, এতবছর পরও তাহলে এই বর্ণমালা ভুলে যাই নি! নিরিবিলি একটা এলাকা। পথের দুপাশে ছোটো ছোটো টিলার উপর বেশ পুরোনো ধাঁচের বাড়িঘর। কিন্তু নির্মাণশৈলিতেও ভিন্নতা লক্ষণীয়। সে আন্দাজ করতে পারছে অনেক আগে থেকেই এখানে অভিজাত লোকেরা বসত করে। ট্যাক্সিটা চমৎকার পথ বেয়ে একটা টিলার উপরে হোটেল মারমেইড-এর গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়াল। সে নেমে তাকিয়ে নীল আকাশ আর আকাশে সফেদ পায়রা উড়তে দেখতে পেল।
ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে সোলেমন মহদংকে আরো একশ কিয়েট বকশিস দিল। ভাড়া আর মাত্র একশ কিয়েট বকশিস পেয়েই ড্রাইভার খুশি হলো। সে হাসিমুখে সোলেমনের লাগেজ হোটেলের রিসেপশনের কাছে নিয়ে রাখল।
অভ্যর্থনা ডেস্কের পেছনের দেয়ালজুড়ে একটা ম্যুরোল। ঝঞ্ঝাকবলিত একটা প্রাচীন বাণিজ্যতরী। বিশাল ঢেউ পরোয়া না করে পিঠে দুজন ভিনদেশি লোককে তুলে নিয়ে ডাঙার দিকে সাঁতরে উজানের দিকে যাচ্ছে একটা মারমেইড। আর অনতিদূরে পাহাড়ের পাদদেশে প্রকৃতির কোলে নারকেল-সুপারির ছায়ায় একটা ঐতিহ্যবাহী বার্মিজ বসতি। ম্যুরোলটার নিচে কাঠখোদাই করে বার্মিজ চিত্রলিপি? দ্য রয়েল মারমেইড : ইস্টার্ন অ্যারোস্ট্রকেসি।
সোলেমন ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সচরাচর কোনো অতিথির আগমনে যেমন সৌজন্য প্রকাশ করে তেমনি হাসিমুখে অভ্যর্থনাকারী তাকে স্বাগত জানাল।
—গুড আফটারনুন।
—গুড আফটারনুন। আমি একটা কক্ষ চাই। জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়, এমন একটা কক্ষ হলে ভালো হয়। আছে কি তেমন একটা?
অভ্যর্থনা-কর্মচারী সোলেমনের কথার সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে অতিথি অবস্থানের তথ্যবই খুলে পরীক্ষা করতে করতে ওকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। লোকটা যখন সোলেমনকে আবারও পর্যবেক্ষণ করছে তখন সে হোটেলের অভ্যন্তরীণ সজ্জা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছে যেন বিশাল একটা পুরোনো জাহাজের পাটাতনে সে দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু খিলানগুলো জাহাজের মাস্তুলের মতো। আর পুরোনোকালের লণ্ঠন বাতির মতো মাস্তুলের মোটা রশির সঙ্গে ঝাড়বাতি ঝুলে আছে। ছাদের কাছে দেয়ালের সঙ্গে মোটা কাছির সঙ্গে অনেকগুলো বয়া লটকানো আছে। একটা পুরোনো নোঙরও পাটাতনের উপর রাখা আছে প্রত্ন নির্দশনের মতো করে। হোটেলটা যে ঐতিহ্যবাহী এসব দেখে আন্দাজ করা যায়। (চলবে)