দুটি কবিতা ।। মঈনুস সুলতান

দামেক্স থেকে বৈরুতের পথে

বেরিয়ে পড়তে হয় যে—
জলদি করো—বাতিল হওয়া কারেন্সির মতো 
পেছনে পড়ে থাকুক তিন প্রজন্মের সাজানো সংসার—
আবর্জনার ঝুড়িতে কলার খোসার মতো পড়ে থাকুক শতেক রতন,
স্বদেশ ছেড়ে ভিনদেশে যাওয়া নতুন কিছু নয়
                      শরণার্থী হওয়ার প্রথাটি—বুঝলে হে—সনাতন।

অত বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই—হামেশা তো শুনছো বোমার সাইরেন
হাতে তুলে নাও ওউদ—তোমার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র অ্যারাবিকা,
জখমের ব্যথা নিয়ে ভেবো না অতো—
বাজার থেকে কিনে নেয়া যাবে রেশমী সড়কের সওদা… অহিফেন, 
পুড়ুক প্রতিবেশীর ঘরদোর—পুড়তে পুড়তে নীরবে নিভে যাবে অগ্নিশিখা।

বারবার পেছন ফিরে তাকিয়ো না তো—
বৈরুতের শেষ বাসটি ছাড়তে নেই বিশেষ দেরি,
উমাইয়া খলিফার স্মৃতিময় মসজিদটি থাকবে আগের মতন—
যাচ্ছো যে নগরে—ওখানে ট্যাভার্ন এন্তার—কিনে নেয়া যাবে শেরী,
ধ্বংন হলেও পালমিরার স্থাপত্যকলা স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে দামেস্ক
                              বেঁচে থাকবে রেশমী সড়কের সম্মোহন।

বেশ তো ঘুমিয়ে নিলে—
এবার চোখ খুলো—তাকাও চলমান বাসের জানালায়
বেকা ভ্যালিতে রেশম চাষীরা ফলিয়েছে থোকা থোকা তুঁত—
তোমার সহকর্মী সুহৃদরা মেতেছে গৃহযুদ্ধে—
গেরিলারা ক্রল করছে পরিখায়,
সামান্য দূরের পেনিনসুলায়—জোড়া পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে বৈরুত।

ঘনিয়ে আসছে সাঁঝ—উপত্যকার কুটিররাজিতে জ্বলে ওঠছে পিলসুজ
যাইনি কখনো—তবে অনুমান করি ওই গ্রামে বাস করা কৌম হচ্ছে দ্রুজ,
শুনেছি চাইলে এখানে দত্তক নেয়া যায় বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত অলিভ বৃক্ষ—
ভয় পাওয়ার কিছু নেই— হাত ধরো ফের বোমায় বিষ্ফোরিত হলো অন্তরীক্ষ।

কিশতির পালে

খুব কিছু চাই না হে—

অপরাহ্ণ পড়ে এলে গোমতি-চিত্রার পাড়ে বসে নিরিবিলি
দেখতে চাই স্রোতজলে অস্তরাগের ঝিলিমিলি,
প্রলোভন যৎসামান্য—
পান করতে চাই চন্দ্রমল্লিকার নিখাদ নির্যাস,
শূন্যতার সংক্রমণে না হয় জখমিত হোক বাহুপাশ;

জলের কিনারে বসে থাকবো নিশ্চুপ 
কাশফুলের শুভ্রতা নন্দিত পরিসরের খুব কাছাকাছি,
তবে চলে যাবো বহুদূরে—
নীরবতায় বাজবে কনসার্ট রহস্যরঙিন ছন্দসুরে;

আরো একটি অতৃপ্ত বাসনা—
প্রাঙ্গনে শত বছর ধরে অপঠিত পুঁথির মতো 
পড়ে আছে যে হাজামজা দিঘি,
তার ঘটলায় বসে নীরবে হতে চাই পরবাসী—
আর জানতে চাই—
কী বেদনায় জ্বলেপুড়ে ফুটো হয়—জনান্তিকে বাজে যে বাঁশী;

বিরাট কিছু নয় হে চাহিদা
অতিক্রম করে শত জনমের দ্বিধা,
জানতে চাই—নৈঃশব্দের সবুজ জমিনে 
কীভাবে ফুটে ওঠে সংগীতের সহজিয়া শস্য—
না বলা কথার প্রেক্ষাপটে থাকে যে রঙ্গনদীপ্ত রহস্য;

চাই না হে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু
ফাঁকি দিয়ে পাকচক্রে ছায়াবাজ যে গোয়েন্দা নিয়েছে পিছু,
একবার যদি যেতে পারি অন্তরালে—
তৈরি হয়নি কিশতির গলুই—নির্মাণ হয়নি হে নীল-দাড়া
তারপরও আলাভোলা বাতাস এসে লাগে যে পালে…।


মঈনুস সুলতান কবি, গল্পকার ও ভ্রামণিক। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে কবিতা ও গল্প লিখছেন। হালফিললিখেছেন কিছু ভ্রমণ-ভিত্তিক আলেখ্য। প্রাচীন মুদ্রা, সূচীশিল্প, পান্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো দিনের মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে। তিনি আমেরিকায় বসবাস করেন।

menu
menu