কবিতার তটরেখা

কবিতা বিষয়ে কিছু লিখতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটা সব চাইতে বড় হয়ে ওঠে, তা হলো, কী বিষয়ে লিখব? ওই প্রশ্নটাই ঘুরেফিরে আসতে থাকে, কারণ, কবিতা যে সত্যি সত্যি কী—তা আজও জানা হয়নি। মনে হয়, কবিতা যাঁরা লেখেন, তাঁরা কেউই জানেন না। 

তবু লিখি।

কেন লিখি? কেউ যদি এ প্রশ্ন করেন, তবে আবার স্বীকার করতেই হবে—তাও সঠিকভাবে জানি না। মনে হয়, যার যেমন প্রকৃতি সে তাই করে। কিন্তু কেন যে প্রকৃতির বশে কবিতা লেখে, কেউ বা ছবি আঁকে, কেউ গবেষণা করে বিজ্ঞান নিয়ে—তাও দুর্বোধ্য। আসলে যে যেমন, সে তেমন—বোধ্য শুধু এটুকুই।

তাই আমি কবিতা লিখি।

আমি জানি, কবিতা যাঁরা পড়েন তাঁরাও জানেন না, কবিতা কী। তবু তাঁরা পড়েন। কেন পড়েন? এর উত্তরে সবাই বলবেন, কবিতা পড়তে ভাল লাগে, তাই পড়েন। আর আমিও ঠিক একইভাবে বলব, কবিতা লিখতে ভাল লাগে—তাই লিখি। যদিও জানি, শুধু ভালো লাগা নয়; কবিতা লেখার আরও একটা কারণ আছে, আর তা হলো আনন্দ।

আনন্দ কী?

আমি জানি না। শুধু মাঝে মাঝে তার দেখা পাই ‘আর তখনই তাকে চিনি—ঠিক যেভাবে চিনি কবিতাকে। মাঝে মাঝে কবিতার দেখা পেলে দেখি সে যেন এক নতুন দেশ, নতুন দ্বীপ, নতুন জগৎ—যা আমারই মধ্যে ছিল,  অথচ দেখতে পাইনি এতকাল! অথবা আমিই ছিলাম তার মধ্যে—কে জানে? আসলে মনে হয় কবিতার মধ্যে আমি আর আমার মধ্যেই কবিতা—এ দুটো একই কথা। যেমন এই বিশ্ব চৈতন্যময়—এ কথা সত্য আবার চৈতন্য যে বিশ্বময়, এও তো সমানভাবে সত্য। অর্থাৎ বিশ্ব যেমন চৈতন্যে আধৃত, চৈতন্যও তেমনি বিশ্বে আধৃত! অতএব তারা এক, অভিন্ন সত্তা। তেমনি কবির চেতনা আর কবিতাও এক এবং অভিন্ন।

এ এমন এক অনুভবের বিষয়, যেখানে পৌঁছোতে গেলে অনেক পথ পেরোতে হয়। সে এক দীর্ঘ অভিযাত্রার কথা। কলম্বাসের সমুদ্র যাত্রার মতো। শুধু জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় কবিতার উদ্দেশে। তাঁকে খুঁজে পাব কিনা ঠিক নেই। কলম্বাসও কি জানতেন, তাঁর গন্তব্যের শেষ কোথায়? আসল কথাটা হলো ওই বেরিয়ে পড়া। বাকিটা ভাগ্যের হাতে, ঈশ্বরের হাতে। শুধু বিশ্বাস রাখা চাই। অভিযাত্রার শেষে সেই অজানা দেশ আছে, সেই অজানা দেশ—যার নাম ‘কবিতা’, সে আছে। আছেই… একদিন ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার দেখা পাওয়া যাবেই—এই বিশ্বাস।

কথা হলো, কবিতা আছে। সত্যি আছে, কারণ তা প্রকৃতই অস্তিত্বশীল। পাহাড়, পাথর, গাছপালা, নদী, আকাশ বাতাস, মানুষ, পশুপাখির মতো, বিশ্বের যেকোনো সদবস্তুর মতোই সে আছে এবং কবি তাকে সৃষ্টি করেন না, আবিষ্কার করেন মাত্র। আবিষ্কার—উদ্ভাবন নয়। জর্জ স্টিফেনসনের রেল ইঞ্জিনের মতো নয়, এডিসনের গ্রামোফোন আবিষ্কারের মতো নয়। উদ্ভাবন নয়। আবিষ্কার। আছে তাকেই খুঁজে পাওয়া। ভাস্কো-দা-গামার ভারত-পথ আবিষ্কার নয়, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো। কলম্বাস তো ভারতের পথই খুঁজতে চেয়েছিলেন! কিন্তু তিনি যেখানে পৌঁছোলেন, তা সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা অদৃষ্টপূর্ব এক আশ্চর্য ভূখণ্ড—যার নাম কবিতা।

লক্ষ্য করুন, ভাস্কো-ডা-গামা তার গন্তব্যে পৌঁছেছিলেন; কিন্তু কলম্বাস গন্তব্যে না পৌঁছেও অনেক মহত্বর আবিষ্কার করেছিলেন! আমারও অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত কবিযাত্রায যে অভিজ্ঞতা, তাতে বারবার এই গন্তব্যচ্যূত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাকে এভাবেই বিহ্বল করেছে; আসলে, এখন তো গন্তব্যে না পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়েই আমি আমার ভাব সমুদ্রে পাড়ি দিতে ভালোবাসি। কোনো বিশেষ কথা বলার জন্য, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে, কোনো বক্তব্যকে প্রকাশ করার জন্য কলম ধরি না। কারণ, আমার কথা হলো, কবিতা কোনো বক্তব্য নয়, কোনো কথা নয়, তার কোনো উদ্দেশ্যে নেই, উদ্দেশ নেই : তাই তার খোঁজে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াই এক মাত্র পথ। তা কি, কেমন, এই বিপুল ভাব সমুদ্রের বিস্তারে কোথায় তার অবস্থান, তা আগে থেকে জানার উপায় যেহেতু নেই, তাই কবিতা লেখার কোনো সুনির্দিষ্ট পথও নেই। শুধু ওই বেরিয়ে পড়া, আর ব্যাকুল অনুসন্ধান—কবির শুধু এইটুকুই সম্বল, আর কিছুই নয়। তারপর অকূল সাগরে দুচোখ মেলে দিয়ে ভেসে বেড়ানো—কখন দৃষ্টির সীমানায় ফুটে ওঠে কোনো অজানা দেশের, কোনো রহস্য দ্বীপের দূর তটরেখা। সেখানে কোন আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, কোন্ অদেখা দৃশ্য, গভীর অরণ্যসঙ্কুল পর্বতগুহার গভীরে কোন্ বিস্ময়কর স্থপত্য অথবা জঙ্গলাকীর্ণ কোনো প্রাচীন মন্দিরের অভ্যন্তরে কোন্ অভাবনীয় ভাস্কর্য অপেক্ষা করে আছে, কবি তার কিছুই জানে না। কত মূর্তি, কত বিচিত্র কারুকার্য উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁরই চৈতন্যের গাত্রে, লোকচক্ষুর অন্তরালে যুগ যুগ ধরে অনাবিষ্কৃত সে অতুল ঐশ্বর্যের সংবাদ কে রাখে। কবি একে সৃষ্টি করেননি; এ আছে, বিশ্বের যাবতীয় সদ্বস্তুর মতো! সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। যখন এই পৃথিবী, এমনকি এই জগৎও সৃষ্টি হয়নি, তখনো ছিল, আছে, চিরকাল থাকবে। এই সৃষ্টি চৈতন্যের মতোই আদি অন্তহীন। ঈশ্বরই প্রকাশিত হয়ে রয়েছেন এমনি নানান রুপে—কবি মুগ্ধ চোখে তাকে দেখেন, অভিভূত ধ্যানস্থ হয়ে তারই অরূপকে লিপিবদ্ধ করেন ভাষার রেখায়। এই লিপিই কবিতা! কবি শুধু তার লিপিকার মাত্র, স্রষ্টা নন। স্রষ্টা ঈশ্বর।

সুতরাং, যা চিরন্তন, যা সত্য তার আর রূপান্তর নেই। রূপান্তর ঘটালে তার বিকৃতি হয়, তার সৌন্দর্যের হানি হয়। সেতো শুধু ওই সৌন্দর্যেরই প্রকাশ মাত্র। সে জ্ঞান নয়। সে বির্বাক। সে কর্মী নয়, সে কিছুই করে না। সে সমাজ সংস্কারণ নয়। সে সুন্দর, তাই মানুষের আনন্দের কারণ। মানুষের আনন্দই তো সমাজের একমাত্র কল্যাণ। সে কাজে কবিতাকে চালিত না করলেও, সে সমাজের কল্যাণই সাধন করান। কিন্তু সে পথে তাকে পরিচালিত করার যেকোনো চেষ্টা, তা সে ধর্ম, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, বিপ্লব—যে উদ্দশ্যেই হোক, তা কবিতাকে আমাদের বাসনার ভারবাহী জন্তুতেই পরিণত করবে। তার দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য পরিতার্থ হবে কিনা, তা গৌণ, কিন্তু তাতে কবিতার উদ্দেশ্য আনন্দ যে অধরাই থেকে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ, আমরা যেহেতু আনন্দের অধিকারী নই, আনন্দের পথ আমাদের কাছে অচেনা। তাই আমরা যারা পথ চিনি না, তারা কবিতাকে পথ চেনাবো কীভাবে? আমরা যারা নিরন্তন বিষাদে ডুবে আছি, তারা কবিতাকে পথ প্রদর্শন করব কী উপায়ে।

আমার অভিযাত্রার অভিজ্ঞতায় আমি বারবার দেখেছি, একবার ভেসে পড়লে, সেই আমাকে পথ দেখায়। প্রতিদিনের এই ভালো-মন্দ, হিসাব-নিকাশ, যুক্তি-তর্কের মধ্যে যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখনই লক্ষ্য করি চেতনার প্রান্তসীমায় একটা অস্পষ্ট, ঝাপসা তটরেখা ফুটে উঠছে কবিতার প্রথম পংক্তির মতো। কোথা থেকে এলো, কেমন ভাবে এলো—ঠিক বোঝা যায় না। কখনো মনে হয় যেন চেতনার গভীর সমুদ্রতলদেশ থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে একটা দ্বীপ আর তার দীর্ঘ তটরেখা। বাকিটা তখনো অতলে!

তার সবটা কখনোই ভেসে ওঠে না আর যতটা অতলে, চোখের আড়ালে যতটা, তাই হলো কবিতার অব্যক্ত স্বরূপ, তার পরা অবস্থা।

ভর্তৃহরি তাঁর বাক্যপদীয় গ্রন্থে বাক্-এর চারটি দশা বা বাক্যের প্রকাশের চারটি স্তরের কথা বলেছেন। আদিতে পরা অবস্থায় সে অব্যক্ত, ব্রহ্ম স্বরূপ। ব্রহ্ম থেকেই সবের উৎপত্তি। বাক্, তথা কবিতারও তাই। কবিতা তার অব্যক্ত অবস্থায় ব্রহ্মস্থ। পরা বা অব্যক্ত অবস্থা থেকে সে ক্রমে ব্যক্ত হয়। পরা থেকে পশ্যন্তি অবস্থায় সে জগৎরূপে প্রকাশিত হয়। জগৎই সমস্ত ভাবের উৎস। এই ভাবই হলো বাক্, অর্থাৎ কবিতার—প্রকৃত পক্ষে শিল্পেরই মধ্যমা অবস্থা। চতুর্থ বা অন্তিম অবস্থায় সে হয় পূর্ণ রূপে প্রকাশিত—যাকে আমরা কবিতা বা শিল্প বলে চিনি। কবিতার এই অবস্থাই তার বৈখরী দশা। এটুকই শুধু ভাসমান, এটুকুই শুধু দৃশ্য, প্রকাশিত।

বাকিটা, যা অতলে তা জানা যায় না। গভীর, দুর্বিগাহ সে রহস্য চিরকাল অজ্ঞাতই থেকে যায়, কারণ সেখানে দৃষ্টি যায় না, ভাষা যায় না, মন ও যেতে পারে না!


বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় কবি, কথাসাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৪৫-এ কলকাতায়। কিন্তু মনে মনে আজীবন বসবাস বীরভূম জেলার বীরভূম গ্রামে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ এ (ছাড়া যার দশদিক) এ পর্যন্ত তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্থ এবং প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

menu
menu