অঞ্জলি
অঞ্জলি
তৃপ্তি আমার চোখে লেগে আছে,
ঘামের শিশির নাকে।
চাহিয়াছিলাম কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিয়া
তুষ্ট করিবো তাকে।
মাথা নাড়াইয়া মেয়েটি কহিল—
ওটা রেখে দাও, আজ
জীবন আমার পূর্ণ হয়েছে,
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বরাজ।
আমি বলিলাম, ঠিকাছে, তুমি
স্বরাজ বললে কেন?
মনে হয় তুমি শিক্ষিতা মেয়ে,
সুভাষ বসুকে চেনো।
মেয়েটি বলিল, ভুলে গেছ বুঝি,
কলেজের দিনগুলি?
তুমি ছিলে আমাদের প্রিয় নেতা,
আমি মিছিলের 'অঞ্জলি'।
অঞ্জলি? তুমিই অঞ্জলি তবে?
হুম, বেশ মনে আছে।
কেমন করিয়া ভুলিব এ-নাম?
আমি তো তোমার প্রণয়পত্রের
উত্তরও দিয়েছিলাম।
উত্তর দিয়েছিলে? দিয়েছিলে?
সত্যিই তুমি উত্তর দিয়েছিলে?
হ্যাঁ। দিয়েছিলাম, এবং সম্বোধনে
তোমাকে লিখেওছিলাম—প্রিয়ে।
হায় ঈশ্বর, কী দুর্ভাগ্য আমার!
আমি পাইনি সে চিঠি, বিপ্লব,
আমি পাইনি তোমার চিঠি।
কার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলে গো,
মনে আছে তার নাম?
কী যে বলো মনে থাকবে না কেন?
মনে আছে, খুব মনে আছে প্রিয়ে!
সাদা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে
আমার দীপান্তর হয়েছিল বলে,
সেই চিঠি আমি পাঠিয়েছিলাম
আমার বন্ধু দীপকের হাত দিয়ে।
দীপক? দীপক? স্প্লেনেডের মিছিলে, পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলো যে?
সেই দীপক?
হায় ভগবান! আমাকে লেখা
তোমার পত্রটি ওর কাছে ছিলো?
ছিলো, অঞ্জলি, নিশ্চয়ই ছিলো।
মনে হয় তার ডিসক্লেইমড মরদেহ
পুলিশ পুড়িয়ে দিলে দীপকের সাথে-সাথে ভস্ম হয়ে গেছে
ঐ প্রেমপত্রখানি।
এতোদিন পর, আজ এই অভদ্র পল্লীতে, বিপ্লব, তুমি কেন এলে বিগতযৌবনা এই অঞ্জলির ঘরে? একি শুধু দৈবদুর্বিপাকে?
না, অঞ্জলি, না। দুর্বিপাকে নয়।
আন্দামান থেকে ফিরে আসার পর, খণ্ডিত ভারতবর্ষে
আমি তোমাকে খুঁজেছি বিস্তর।
পাগল যেমন পাবে না জেনেও খুঁজে ফেরে পরশ পাথর।
কত ঘাটে ভিড়েছে আমার নাও,
তোমাকে আমি পাইনি কোথাও।
কলকাতা, ঢাকা, বোম্বাই ঘুরে
অবশেষে এসেছি দিল্লিতে—।
একদিন যে-নগরী জয় করবো বলে নেতাজীর শিষ্য হয়ে লড়াই করেছি—
আজ সেই নগরীতে
আমি খু্ঁজিতেছি আমার ঈশ্বরী।
পরম আদরে বিপ্লবের উদগত চোখের অশ্রু শাড়ির আঁচলে মুছে দিয়ে,
অঞ্জলি বললো—
নারীচিত্ত জয় করা রাজ্যজয়ের চেয়ে কম বড় কথা নয়,
তুমিও তা মানো নিশ্চয়।
দেশ আজ আছে, কাল নেই।
মানবমানবীর প্রগাঢ় প্রণয় সত্য।
এই শিক্ষা দিতে আজ আমাদের
প্রেমের বিজয়রথ থেমেছে দিল্লিতে।
আচ্ছা বিপ্লব, আমার যৌবনের প্রাণপ্রিয় নেতা, বলো তুমি আজ
কেন আমার কুটিরে এলে?
তোমার হারানো অঞ্জলিকে
তুমি কি চিনতে পেরেছিলে?
বিপ্লব বললো, না, তোমাকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি।
তবে তোমাকে কিছুটা
অঞ্জলির মতো মনে হয়েছিলো।
এখন বুঝলাম, অঞ্জলির মতো নও, প্রিয়ে, তুমিই অঞ্জলি।
চলো, তুমি আমার সঙ্গে চলো
তোমায় হৃদ-মাঝারে রাখবো,
আর ছেড়ে যাবো না।
ছেড়ে গেলে তোমায় আমি
আর তো পাবো না।
বিপ্লবের সুরে সুর মিলিয়ে
তখন অঞ্জলি গাইলো,
আমরা কলকাতায় ঘর বাঁধবো,
আর দিল্লি থাকবো না।
নির্মলেন্দু গুণ, কবি, বাংলাদেশ