গুচ্ছ কবিতা ।। হালিম আবদুল্লাহ
আবু হুরায়রার পাঠ
আমাদের কিছু পাঠ নিভৃত থাক সুলতানা
এইসব ধ্বনি ও বর্ণবিহীন পাঠ সকলের জন্য নয়।
বাজার হাট, সংসার করা অধীনস্থ গড় মানুষ
ভণ্ড রাজনীতিক
মসজিদ মন্দিরে ভীড় জমানো কামুক নর ও নারী
শিক্ষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী
সন্ন্যাসী, সুফি, দরবেশ
কেউ আমাদের এই অধ্যয়ন রীতি বুঝবে না।
তাদের পাঠ সফিনায়
সিনায় সিনায় আমাদের নিগূঢ় পাঠ
তাদের বর্ণমালা জড় ও নির্দিষ্ট
স্পর্শই আমাদের প্রাণময় বর্ণমালা।
আমাদের কিছু পাঠ নিভৃত থাক সুলতানা
মদিনার আবু হুরায়রার মতো আমাদেরও খাদ্যনালী হারাবার ভয় থাকুক।
ইফতার
কোনো এক রোজার সকালে তোমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হবো
ধরো সেই এক সুবেহ সাদিকের কাল
আকাশের কালো রেখা থেকে সাদা রেখার উদ্ভব হয়েছে এবং আমাদের জন্য পানাহার হারাম হয়ে গেছে।
আমরা জড়াজড়ি হাঁটছি কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করছি না
আমরা একদেহ হয়ে গেছি।
মায়ানদীর পাড়ে এসে আমাদের যাত্রা থামুক
আমরা মুখোমুখী বসে থাকি
আমাদের পায়ের নিচে উজ্জ্বল মেঘের নদী
আমাদের মাথার উপরে লক্ষ পাখির কলরব
বাতাসে ফুলের গন্ধ
আর সূর্যের নিয়মে পার হওয়া আমাদের নির্বাক সময়।
তারপর সব আলো নিভে গেলে
সব শব্দ শব্দের পাখা মেলে মহাশূন্যে উড়ে গেলে
আমরা পরস্পরকে ইফতারে খাব এবং নাই হয়ে যাব।
সুলতানার নৌকা
উঁচুতে তোমার বাড়ি প্রিয় সুলতানা
ঘাটে বান্ধা চতুরঙ্গের নাও।
খানা খাদ্য মজুদ রাখা লতা পাতা দিয়া
জল বর্ষায় জিকির কর আনন্দ ভূগোলে
ঢেউ লাগা বাতাসে জুড়াও শরীরের হিয়া
নাচ আর নাচাও যত বিরিক্ষের পাতা।
না ডুবলে গেরস্তালি
বানের মতোন সুখ কে আর কবে পায়।
ঘাটের নাওয়ে খাটাও পিরিতের পাল
আকাশে উজ্জ্বল কালো শ্রাবণের দিন
ফেলে দিয়ে অঙ্গের সামাজিক রীতি
নিলাজ রয়েছ জলে নিলাজ বরণ।
হালিম বলে, সুলতানার নৌকায় ভেসেছি
আমার কি আছে আর প্লাবনের ভর!
সীমালঙ্ঘনকারী
পা রাখতে পারছি না
জায়গা বড় কম
আমি আজন্ম সীমালঙ্ঘনকারী
নিজেকে মানচিত্রে আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই
তাই বরাদ্দকৃত ঐশী শাস্তিই আমার নিয়তি।
ধর্ম ও রাষ্ট্রের পাঠশালায় আমি আনুগত্যের পাঠ নিই না
মন্ত্রে আমার সম্পূর্ণ অরুচি
সমাজ ও সংসারের সুখে আমি অভ্যস্ত হই না
পুনরাবৃত্তি আমি ঘৃণা করি
সীমায় আমি থাকতে পারি না
আমি চিরকাল অসীমের যাত্রী।
আমি কবি ও প্রেমিক
তাই ঐশী অভিশপ্ত ও সীমলঙ্ঘনকারী।
নিষিদ্ধ নগর
ডান হাতে জলপাই আর বাম হাতে ডুমুর নিয়ে তুমি আমার নগরে এসেছিলে
তারপর এ জনপদে হত্যা ও বিশৃঙ্খলা চির নিষিদ্ধ হয়েছে
সুলতানা, এখন আমার আগ্রাসন থেকে সকলে নিরাপদ
আমার হন্তারক প্রবণতা তোমার এক চুম্বনে কর্পূরের মতো উড়ে গেছে।
সাতখানা নাগিনি আমার শিথান পাহারা দেয়
পাঁচখানা চিতা থাবা মেলে আমার পৈথানে বসে থাকে
ডানে চার জোড়া কামট
বামে পাশে নয় বর্ণের দুর্দান্ত কুমির
আমরা শত্রুতাহীন পরস্পরের প্রেমে নিমজ্জিত হই
সুলতানা, তোমার ডুমুর ও জলপাই ভক্ষণের পর আমার আর শত্রু বলে কেউ নেই।
আমার এ নগরে কোনো কারাগার ও চিড়িয়াখানা নেই
এখানে হিংসা ও ভালোবাসার গলাগলি ভাব
আমার এ নগরে জন্ম ও মৃত্যু নেই
এখানে সব ধরনের স্খলন হারাম
আমার এ নগরে কোনো তাড়াহুড়া নেই
এখানে যাত্রা ও গন্তব্য এক বিন্দুতে মিশে যায়
আমার এই নগরে কোনো লড়াই নেই কারণ এখানে কেউ লিঙ্গভেদ করে না।
ডান হাতে জলপাই আর বাম হাতে ডুমুর নিয়ে
তুমি আমার নগরে এসেছিলে
সুলতানা, সেই থেকে আমার সঙ্গে আমার আর কোনো শত্রুতা নেই।
লখিন্দর কাল
অবরুদ্ধ আকাশ মাটি অবরুদ্ধ জল
অবরুদ্ধ কণ্ঠ সবার
অবরুদ্ধ নগর গঞ্জ গ্রামে কোটি লোকের সংসার
নদী অবরুদ্ধ
বাতাস অবরুদ্ধ হয়ে খাবি খায় যাপনের কাল
দেহের শিথানে বসে দুর্দান্ত জাদুকর অবরুদ্ধ করে রাখে জাগরণের ভোর।
এমন যুথবদ্ধ ঘুম কখনো দেখিনি আর
এমন বানোয়াট সত্য কখনো শুনিনি আর
এমন নপুংসক সময় কখনো লেখেনি ইতিহাস
মুক্তির স্লোগানে এমন বন্দি দশা এ লোকালয় কভু প্রত্যক্ষ করেনি
এমন নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের খেলা এ প্রান্তরে কোনোদিন খেলেনি কেউ।
যেন এ হস্তমৈথুনের কাল
পথে পথে মাথা নিচু করে হাঁটে ক্লান্ত যুবক ও যুবতি।
এখানে বিশুদ্ধ কেউ নেই
যশপ্রার্থী কবি, কণ্ঠ বেচা গায়ক আর সুবিধাপন্থী বুদ্ধিজীবীর দূষিত নিশ্বাসে ভারি হয়ে আছে সকাল ও রাত
মৃতজীবন রাজপথে জটলা পাকায়
যেন এ মৃত্যুপুরি শ্মশান গোরস্থান
কেউ জীবিত ও বিশুদ্ধ নই
মধ্যবিত্ত সুখ কিনি দাসত্বের দামে।
এ বুঝি লখিন্দর কাল
ঘুমকাতর বেহুলা পাহারা দেয় অরক্ষিত সোনার বাসর।
হালিম আবদুল্লাহ, কবি ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ