চাঁদের হাটে কেনা ফুল

(বেহুলাবাংলা থেকে প্রকাশিত অভ্র আরিফ-এর কাব্য চাঁদের হাটে কেনা ফুল। তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রূপকণা সংগ্রহ করে চিন্তার রঙ মেখে পংক্তির বিন্যাসে জীবনের কথা বলেন। হৃদয়ে সুর লহরি বয়ে যায়। ঘুংঘুর-এর পাঠকদের জন্য তাঁর ৫টি কবিতা।) 

ভুল

ইন্টারভ্যু বোর্ডে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো,
“পৃথিবীর রাজধানীর নাম কী?”
আমি মনে করতে পারলাম না।
তারপর জিজ্ঞেস করলো, “ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান কোথায় জানেন?”
আমি এটাও ভুলে গেলাম। অথচ আমার ভুলে যাওয়ার কথা না,
অথচ আমরা রাত জেগে এসব মুখস্থ করি।

ফিরতিপথে ট্রেনের সিটে মাথা হেলিয়ে মনে হলো,
পৃথিবীর রাজধানীতো আমার হৃদয়
ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান আমার মস্তিষ্ক
নিজেকে ধিক্কার দিলাম। কী আশ্চর্য!
জীবনের দেনা শোধে মানুষ অনায়াসেই হৃদয় আর মস্তিষ্কের কথা ভুলে যায়!

সারাটা যাত্রাপথে আসন্ন ভুলের মাশুল ভাবতে ভাবতে 
ত্রিশটা স্টেশন পার হয়ে আমি গন্তব্যে নেমে যাই।
কিন্তু একী! এ রুক্ষ, ধূসর, ঊষর গন্তব্যস্থল কখনো আমার নয়,
আমার দেশ— পাহাড়, সমুদ্র ও সবুজের দেশ।
বুঝলাম, ভুল টিকেটের যাত্রী হয়ে ভুল গন্তব্যে পৌঁছে গেছি
ততক্ষণে আঁধার ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামে প্রায়…।

ভুল স্টেশনের যাত্রীদের কেউ আর কোনোদিন ফেরত নেয় না।
আমার সমুদ্র আর সবুজ পাহাড়ের জন্য আমি নিঃশব্দে কাঁদলাম।

অতঃপর, নিয়তিকে মেনে নিয়ে এবং কিছু করার না পেয়ে,
রুক্ষ-ধূসর ঊষর জমিতে হৃদয় ও মস্তিষ্কের ব্যবহার করে 
আমি পাহাড়, সবুজ ও সমুদ্রের আবাদ শুরু করলাম।

বিষাদ মানে  হাওয়া 

বিষাদের হাজার রকম চিত্রায়ণ করা যায়
শিক্ষক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী সবাই
ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিষাদের চিত্র আঁকবে।
রাজনীতিবিদ হলে অন্য কথা
সে আঁকাআঁকির বদলে তুলি ও ক্যানভাসটাই পকেটে পুরে নেবে।

উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বিষাদের চিত্র ভিন্নতর
আবার নিম্নবিত্ত হলে অন্য কথা।
সে আপনার কাছে বিষাদের মানে জানতে চাইবে
জানতে চাইবে, আগুন ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমোতে যাওয়াকে
বিষাদ বলে কিনা?

আমি চুপ। আমি এসবের কিছুই না।
আমার ক্যানভাস তাই শূন্য।
জলের ভিতর থাকা মাছের যেমন তেষ্টা পায় না
বিষাদমণ্ডলে ডুবে বিষাদের চিত্রায়ণ হয় না।
বিষাদ মানে হাওয়া, হাওয়া আঁকা যায় না।

চাঁদের হাটে কেনা ফুল

ব্ল্যাকআউটের তামসিক রাতে
যখন পৃথিবীর সব কৃত্রিম আলো নিভে গিয়েছিল
তখন পুবাকাশে রুপোর থালার মতোন
একটা মস্ত বড় চাঁদ ওঠে।

আর আমি শহরের চৌরাস্তার মোড়ে বেহুদা দাঁড়িয়ে আছি।
ঠিক তখনি রুপালি শামিয়ানা টানানো একটা ঘোড়ার গাড়ি
টগবগিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়,
আর আমি তাতে উঠে বসি নির্দ্বিধায়
যেন আমি জানতাম সে আসবে,
যেন আমি তার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম।

শহরের এক প্রান্তে এরকম রুপালি রাতে একটা হাট বসে
দুধ জোছনা মেশানো হাওয়া খেতে খেতে 
আমি সেই হাটে পৌঁছে যাই।
সেখানে র‌্যাঁবো, রিল্কে থেকে শুরু করে জীবনানন্দ, আল মাহমুদরা
বাজার সদাই শেষে আড্ডাবাজিতে মশগুল
এক কোণে লালন বসিয়েছে তাঁর গানের আসর।

আমি দ্রুত একগুচ্ছ রজনীগন্ধা কিনে ফিরে আসি।
সকালে অফিস। চাঁদের হাটে রাত জাগা কি আমার পোষায়?

তারপর—ফুলগুলো মাথার কাছে রেখে আমি ঘুমিয়ে যাই
কিন্তু হায়! সকালে উঠে দেখি আমার স্ত্রী
শাক ভেবে ফুলগুলোকে চুলায় চাপিয়ে দিয়েছে!

চলে যাওয়া ভালো

বরং চলে যাওয়াই প্রভূত কল্যাণকর।

এ অকল্যাণের দেশে কিশোরীর হাতে নেই আর ফুল,
পারাবতগুলো উড়ে গেছে নরকের উত্তাপ গায়ে নিয়ে
একলা কিশোর অভিমানে ফিরে গেছে মাঠ থেকে।

আমার এইভাবে চলে যাওয়া ভালো।

কেননা সম্পর্কের জমিন থেকে মাটি খাবলে
তারা এখন ব্যক্তিগত টবে নয়নতারা ফুটায়,
সকালের ফুল সন্ধ্যায় ঝরে যায়।
মানবিকতার মুমূর্ষু নদীর তীরে অপুষ্ট প্রেমের চাষাবাদ

আমার সকল নদী মরে যায়।

নির্দয় নিধনের এ শহরে এখন কুকুরও রূপ পাল্টায়
অকৃতজ্ঞতার রুমাল পকেটে পুরে তারা মানুষ হয়ে যায়।

বিরুদ্ধ স্বদেশ

গতরাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হয়েছিলো
বৃষ্টির ঘ্রাণের সাথে গন্ধরাজের সুবাস ছিলো
আজও আমি গন্ধরাজ ভালোবাসি।
অথচ আপনি কি জানেন আমার নাক নেই?
সুগন্ধী ফুলকে ভালোবাসার দায়ে ওরা আমার নাক কেটে নিয়েছে।

পরশু রাতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো ডাহুকের ডাকে
বহু বছর পর এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির এ দেশে পুনরায় ডাহুকের ডাকে
আমার বুকের জমিন আর্দ্র হয়ে উঠেছিল।
অথচ জানেন, মধুরতর সুর ও ডাক শুনতে ভালোবাসি বলে
ওরা আমাকে বধির করে দিয়েছে। 

তারও আগের দিন, আমি রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে উঠেছিলাম
ফাগুন বনে আগুন দেখে ভেবেছিলাম— 
সুরের কোন ঔদ্ধত্য নেই, পদ্মা সেতুর এই দেশে 
সুন্দরতম ফাগুন কারও না কারও অর্জন হবে হয়তো; সুর তো সাধাই যায়।
অথচ সুরে সুরে সুর মেলানোর কারণে
ওরা আমাকে নির্বাক করে দিয়েছে।


 • অভ্র আরিফ, কবি, ঢাকা 

menu
menu