কবি জসীমউদ্দীন প্রসঙ্গে

 কৈশোরকাল থেকে যৌবনের প্রারম্ভকাল পর্যন্ত কবি জসীম উদ্দীন ছিলেন আমার চেতনার মধ্যে একমাত্র কবি। তাঁর কবিতা পাঠ করে আমি এত মুগ্ধ হই যে, তাঁর কবিতা ছাড়া অন্য কারো কবিতার খোঁজখবর রাখতাম না। অর্থাৎ জসীম উদ্দীন ছিলেন আমার কাছে একমাত্র প্রধান কবি। এই ধারণার মূলে ছিল বেশ কয়েকটি কারণ। প্রধান কারণ ছিল গ্রাম প্রকৃতি। আমি জন্ম থেকেই এই গ্রাম প্রকৃতির রূপ ঐশ্বর্য নিবিড়ভাবে দেখে আসছি। গ্রামের নদী, বিল-হাওড়-বাওড়, বন-জঙ্গল, পথঘাট, মাঠ প্রান্তর, কৃষি ভূমি, বাঁশবন, আ¤্রকানন, গোচারণ ভূমি, চাষী-গৃহস্থের জীবন-যাপন, একান্নবর্তী পরিবার, রাখালদের গরু চরাণো, কৃষকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, ফসল উৎপাদন, ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য একান্তভাবে খুঁজে পেয়েছিলাম জসীম উদ্দীনের কবিতার মধ্যে। এই কারণেই তিনি ছিলেন আমার কাছে একমাত্র প্রিয় কবি।

বালকবেলা, আমার মনেও একদিন ভাবোচ্ছ্বাস জেগে ওঠে, আমিও তো জসীম উদ্দীনের মত পদ রচনা করতে পারি। শুরু হলো জসীম উদ্দীনের কবিতা অনুসরণ করে পদ রচনা। নিজের মনেই লিখতে থাকি। কবিতা হচ্ছে কী হচ্ছে না, এটা নিয়ে কখনো ভাবিনি। আমি যে লিখি এই বিষয়টি আমার বিদ্যালয়ের  সহপাঠি বন্ধুরা জেনে গেল। একদিন আমার এক সহপাঠি আমার বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে বললেন, স্যার হোসেন কবিতা লিখতে পারে। স্যার আমার দিকে তাকালেন, ব্যাঙ্গ করে বললেন, তাই নাকি ? তাহলে তো দেখি কী লিখেছো? কবিতা লিখেছো না গবিতা লিখেছো ?

আমার এক সহপাঠি বন্ধু আমার কাছ থেকে কবিতাটি নিয়ে স্যারকে পাঠ করে শোনালো- ‘গভর্নর এসেছে যশোর/ গাড়ি-ঘোড়া-রিকশা চলেছে মটর/ দলে দলে লোকজন / শুনতে চলেছে ভাষণ।’
স্যার বললেন, নাহ্, এটা তোমার লেখা নয়। বলো, কোন বই থেকে টুকে এনেছো। নকল, নকল। এসব বাদ দিয়ে লেখাপড়া করো। এতে তোমার লেখাপড়া গোল্লায় যাবে।
আমি তখন ৫ম শ্রেণির ছাত্র। যেদিন এই পদ্যটি রচনা করেছিলাম, সেদিন যশোরে নুরুল আমিন সাহেব একটি জনসভায় প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। তিনি তখন ছিলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দলে দলে লোকজন দুপুর থেকে ময়দানের দিকে যাচ্ছিল। শ্রেণিকক্ষে বসেই পদ্যটি রচনা করি। ভেবেছিলাম শিক্ষক মহোদয় পদ্যটির পাঠ শুনে প্রশংসা করবেন। ঘটনা ঘটলো তার উল্টো। তিনি ব্যঙ্গ করলেন এবং নকল করেছি বলে উপহাস করলেন।

স্যারের বক্তব্য শুনে মাথাটা নিচু হয়ে এলো। এ রকমভাবে তিনি যে, আমাকে আক্রমণ করবেন, কখনো কল্পনা করিনি। হতভম্ব হয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এই ঘটনার পর থেকে আমার মাথায় একটা গো চেপে বসলো। সংকল্প করলাম, আমি কবিতা লিখবই।
আবার শুরু করলাম নতুন উদ্যমে কবিতা লেখার কাজ। জসীম উদ্দীনের কবিতাগ্রন্থ খুঁজতে লাগলাম। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্য পুস্তকে তাঁর কবিতা পাওয়া যেত। নানা রকম বিষয়ের উপর কবিতা। রাখালী, পল্লী জননী, হাসু, কবর। যত পড়ি ততই বিস্মিত হই। কবি জসীম উদ্দীনই হয়ে উঠলেন আমার ধ্যান জ্ঞান। কবিকে দুচোখে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। কোথায় তিনি থাকেন, ব্যক্তিগতভাবে কী কাজ করেন তিনি। এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করি, কেউ কিছু তথ্য দিতে পারেন না।

অষ্টম শ্রেণিতে উঠলাম। আমার পাঠ্য বইয়ে জসীম উদ্দীনের একটা কবিতা ছিল। আমাদের বাংলার শিক্ষক ছিলেন কওছার আলী। তিনি কয়েক মাস হলো, আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নতুন যোগদান করেছেন। বয়সে তিনি নবীন। অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিক্ষকসূলভ ভাব-গাম্ভীর্য থাকলেও ছাত্রদের প্রতি তিনি ছিলেন সদয় সহানুভূতিশীল। হঠাৎ করে তিনি একদিন জসীম উদ্দীনের কবিতা পড়াতে পড়াতে জসীম উদ্দীনের সম্পর্কে কিছু ধারণা দিলেন। বললেন, তোমরা কী জসীম উদ্দীনের কোনো কাব্যগ্রন্থ পড়েছো ? আমরা সকলেই বললাম, না স্যার। আমরা কেউ তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থ পড়িনি। আবার প্রশ্ন করলেন তিনি, জসীম উদ্দীনের একটি বিখ্যাত কবিতার নাম কবর পড়েছো কী ?

কেউ কোনো জবাব দিল না। শুধুমাত্র আমিই বললাম, স্যার আমি পড়েছি। কওছার স্যার আমার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, বলো তো প্রথম লাইনটি কী ? আমি পাঠ করে শোনালাম। ‘এইখানে তোর দাদীর কবর, ডালিম গাছের তলে, / তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’
কওছার আলী সাহেব মন্তব্য করলেন, আমার কাছে জসীম উদ্দীনের সাহেবের বেশ কয়টি কাব্যগ্রন্থ আছে। তুমি যদি পড়তে চাও তো দেব। তিনি আরও বললেন, পল্লীবাংলাকে যদি নিবিড়ভাবে জানতে চাও-তবে জসীম উদ্দীনের কাব্যগ্রন্থ অবশ্যই পড়তে হবে।

অতিসত্ত্বর কওছার আলী সাহেব আমার প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠলেন। আমি তাঁর শিক্ষকসূলভ আচরণে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একদিন স্যারকে বললাম, স্যার জসীম উদ্দীন এর কাব্যগ্রন্থ পড়তে চাই। তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমার বাড়িতে এসো, যেকোনো রোববারে আসতে পারো। রোববার ছিল বিদ্যালয়ের সাপ্তাহিক ছুটি। তখন জষ্টি মাস। আমি এক রোববারে দুপুরবেলা স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গ্রামের নাম বামন আলী। ঝিকরগাছা বাজার থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে। এটা একটা অজপাড়া গাঁ। যাতায়াতের জন্যে কোনো যানবাহন নেই। এই গ্রামে যারা তৎকালে বাস করতো, তারা পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতো। স্যার প্রতিদিন আসা যাওয়া করতেন বাইসাইকেলে।

আমি জষ্টি মাসের প্রখর রৌদ্রের মধ্য দিয়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। এর আগে কখনো এই গ্রামে আসিনি। কোথাও আম কাঁঠালের বন। বুনো ঝোপ-ঝাড়। পথের দু’ধারে মাঠ। চাষারা কাজ করছে। রৌদ্রপোড়া বাতাস। আগুনের হল্কা বয়ে যাচ্ছে। কখনো বাতাসে ধূলো উড়ে আসছে। আমি সেই প্রখর রৌদ্র ও ধূলোর মধ্য দিয়ে বামন আলী গ্রামে এসে পৌঁছালাম। মাথার ওপরের গনগনে সূর্যটা পশ্চিমে কিছুটা হেলে পড়েছে।
গ্রামটি বিশেষ বড় নয়। এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করে স্যারের বাড়ির বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। মাটির দেয়াল। খড়ের ছাউনি। সাধারণ চাষী গৃহস্থের বাড়ি। হাঁস-মুরগি, ছাগল উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে স্যারের পারিবারিক অবস্থা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। বাড়ির প্রাঙ্গণে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। 
আমি বললাম, স্যার কি বাড়িতে আছেন ? তিনি কোনো জবাব দিলেন না। আমার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে ঘরের উঁচু বারান্দায় উঠে ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, মাস্টার দেখ, একটা ছেলে তোমাকে খোঁজ করছে। স্যার ঘর থেকে বেরিয়ে উঁচু বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে হাসলেন। বললেন, এসো, আমার ঘরে এসে বসো। বইটা পেলে, আমি এখনি যে পথে এসেছি, সেই পথে চলে যেতে চাই।

-    বসবে না ?
-    না স্যার।
-    একটু কিছু খাও।
-    না স্যার।
স্যার আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা বই। স্যার আমার হাতে তুলে দিলেন বইটা।
-    এটা ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ এটা পড়া শেষ হয়ে গেলে আর একটা বই দেব তোমাকে- ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’। তারপরে পাবে রাখালী।
বইটি হাতে পেয়ে আমার মনে হলো- আমি একটা স্বর্ণখ- হাতে পেয়েছি। আমার শরীরের মধ্যে একটা নতুন শিহরণ বয়ে গেল। আমি স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রচ- রৌদ্রের মধ্যে পথের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে হাতের বইটির দিকে তাকাই, মলাট দেখি, প্রচ্ছদ দেখি, বইটির শিরোনাম দেখি-নতুন একটা উপলব্ধিতে আমার মন-প্রাণ ভরে যায়। জসীম উদ্দীন নামটা আমার অন্তরের গভীরে বারবার আলোড়িত হতে থাকে। আমি পথ চলি, আর বইটা নেড়ে চেড়ে দেখি। বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি দেখি। অবন ঠাকুরের আঁকা ছবিটা দেখে মুগ্ধ হই।

বিকেলবেলা বাড়িতে এসে ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ পড়তে থাকি। চুম্বকের মত দু’চোখ আকর্ষণ করে বইয়ের একটা পৃষ্ঠা। বিকাল থেকে সন্ধ্যা দিনের আলো নিভে যায়। ঘরের মধ্যে হ্যারিকেনের আলোয় আবার পড়তে থাকি। পাঠ্য পুস্তকের কথা ভুলে যাই। নক্সী কাঁথার মাঠ আমার জীবন্ত বলে মনে হতে থাকে। সারারাত জেগে বইটা পড়ে শেষ করি-মনের মধ্যে আরেক রকমের উপলব্ধি সঞ্চারিত হয়। জানতে ইচ্ছে করে- কোথায় সে নক্সী কাঁথার মাঠ ?

এই কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে আমার মনের জগৎ বদলে যেতে থাকে। সব সময় সাজু আর রূপাইয়ের চিন্তায় নিমগ্ন থাকি। ইচ্ছে করে নক্সী কাঁথার মত আমিও একটা কাব্যগ্রন্থ রচনা করি। কিন্তু তা কি সম্ভব ?
মন-প্রাণ দিয়ে লিখার চেষ্টা করি। প্রতিদিন লিখি আর কাটাকুটি করি। খাতার পাতা কালো অক্ষরে ভরে ওঠে। কিন্তু নক্সী কাঁথার মত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে না। অগত্যা ব্যর্থ হই। বালকের পক্ষে এই কাজটি করা দুরুহ হয়ে ওঠে। স্যার বললেন, কেমন লেগেছে বইটা ? আমি বলি, বইটা পড়ে আমার চোখে এখনো ঘোর লেগে রয়েছে। স্যার হেসে ওঠেন, তাই ? আমি মাথা নাড়ায়। স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। স্যার বলেন, জসীম উদ্দীনকে বলা হয় পল্লীকবি। পল্লীকে নিয়েই তিনি কবিতা লেখেন। আমি প্রশ্ন করি, স্যার নক্সী কাঁথার মাঠ কোথায় ? উনি জবাব দেন, এই নামে কোনো মাঠ আছে কিনা জানি না। হয়ত থাকতেও পারে। জসীম উদ্দীনের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। সেখানে আমি কখনো যাইনি। 

-    স্যার, আপনি কবিকে কখনো দেখেছেন ?
-    না, কবিকে কখনো দেখিনি।
-    তিনি কী করেন ?
-    শুনেছি তিনি সরকারের তথ্য বিভাগের একজন হায়ার অফিসার। ঢাকায় থাকেন।

নক্সী কাঁথার মাঠ পাঠ করে আমার মনে হতে লাগলো, এই গ্রন্থের প্রতি চরণ কবি কল্পনা করে রচনা করেননি। চোখে যা দেখেছেন, সেটিই লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। পড়তে পড়তে কয়েকটি চরণ আমার মুখস্থ হয়ে উঠলো। আমি আমার গ্রামের প্রকৃতি মাঠঘাট, খেত-খামার, গাছ গাছালি এই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় হুবহু খুঁজে পেয়ে যাই-
 

   ‘এই এক গাঁ ওই এক গাঁ দীঘল মাঠ
    ধান কাউনের লিখনলিপি কে করেছে পাঠ।’

একটা গাছ আর একটা গাছের দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে, তার রূপকল্প এই গ্রন্থের মধ্যে সেদিন খুঁজে পেয়েছিলাম। মানুষ, গৃহপালিত পশু, ঘরবাড়ি, জীবন-যাপন, হিংসা-বিদ্বেষ এমন কোন বস্তু নেই যে এই গ্রন্থের মধ্যে কবি প্রকাশ করেননি।

বেশ কয়েকদিন কবির এই কাব্যগ্রন্থটি হাতে করে নিয়ে হাটে বাজারে বিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। বিদ্যালয়ের বন্ধু-বান্ধবদের দেখিয়ে গর্ব অনুভব করেছি। আমি যে এই গ্রন্থটি পাঠ করেছি এটাই ছিল আমার গর্ব।

 দিন দশেক পর একদিন বিকেল বেলা স্যারের বাড়িতে গিয়ে বইটি ফেরত দিলাম। স্যার ছিলেন জসীম উদ্দীনের ভক্ত। তিনি তাঁর ঘরের মধ্যে ঢুকে জসীম উদ্দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যগ্রন্থটি এনে আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, আমি আমার সংগৃহীত এই বইগুলো কাউকে কখনো পড়তে দেইনি। শুধুমাত্র তোমাকেই দিলাম।

‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যগ্রন্থটি বারবার নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলাম। মনে হলো, আর একটি স্বর্ণখ- আমি হাতে পেয়েছি। বইয়ের ভেতরের কালো কালো অক্ষর থেকে একটা মন-মাতানো সোদা গন্ধ বাতাসে ভেসে আসতে লাগলো। আমি স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, এই বইটাও তোমার ভালো লাগবে।

পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। পথের দু’ধারে মাঠ, গাছপালা আমার চোখে অপরূপ হয়ে ধরা পড়তে লাগলো। আমি মনে মনে এই মাঠ, এই গাছপালা, এই বিকেল, এই গ্রাম ও দূর দিগন্তের আকাশ নিয়ে ভাবতে ভাবতে পথ অতিক্রম করতে লাগলাম। জসীম উদ্দীনকে স্বচোখে দেখার জন্যে মন উতলা হয়ে উঠলো। কবির কাল্পনিক প্রতিকৃতি আমার মানস চোখে ভেসে উঠতে লাগলো। এই কবি, যিনি পল্লী প্রকৃতির রূপকার। তাঁকে নিয়ে নানা রকম চিন্তা আমার মগজে ঘুরপাক খেতে লাগলো। 

প্রকৃতপক্ষে জসীম উদ্দীনকে আমি খুঁজে পেয়েছি বাংলার শস্য-শ্যামল প্রকৃতির মধ্যে। নক্সী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যগ্রন্থ দুটি বহুকাল আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি যখনই শূন্য খা খা মাঠের দিকে তাকাতাম, তখনই মনে হয়েছে এই তো সেই জসীম উদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ। এই মাঠেই তো বিছানো রয়েছে পল্লীবাংলার হাতের কারুকাজ করা, রূপকথার মালা গাঁথা, বহুকালের সুঁইবিদ্ধ আঁকাবাঁকা জীবন-যাপনের কাহিনি। এই কথা ভাবতে ভাবতে বহু দিবস, বহু রজনী আমার পার হয়ে গেছে।

আবার যখনই কোনো নদীর তীরে কোনো ভাঙাঘাট দেখেছি, তখনই আমার মনে হয়েছে, এটাই বুঝি জসীম উদ্দীনের সেই সোজন বাদিয়ার ঘাট। এখানে তো বহুকাল আগে সোজন এসে তার নৌকার বহর নিয়ে অবস্থান করেছিলো। নদীর ভেতর থেকে উঠে আসা বাতাস মনে হয়েছে সোজনের দীর্ঘশ্বাস। এই বিষয়টি নিয়ে যখন ভাবি, তখনই আমার মনে হয়েছে পল্লীবাংলার রূপকার নক্সী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট-এর কবি জসীম উদ্দীন রূপাই-সাজু ও সোজন-দুলির মত আরেকটি কিংবদন্তীর মানুষ রূপে বাংলার মাটিতে একাকার হয়ে রয়েছেন। 

menu
menu