প্রবাসে স্বদেশ ভাবনা

এখনকার এই উন্নত যুগে মানুষের আয়ু অনেকাংশেই বেড়ে গেছে, বেড়ে চলেছে। স্বল্পায়ু বাঙালি এখন ৭০-৮০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আয়ু আরও দীর্ঘায়িত হতো, যদি খাদ্য ও পানীয়তে ভেজাল না থাকত। জাপানে থাকি বলে এইদেশে খাবার সবকিছুই তরতাজা ও সতেজ পাওয়া যায়। তাই নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু দেশে ফিরে গেলে পরে সর্বত্র ভেজাল খাদ্য ও পানীয় দেখে মানসিকভাবে বেসামাল হয়ে পড়ি। এই পরিস্থিতি কী অমানবিক বিশেষ করে বয়স্ক নাগরিকদের ক্ষেত্রে তা ব্যাখ্যা করা দুঃসাধ্য! 

আমিও ২০২০-এ এসে ৬১র ঘরে পা রেখেছি। বয়স হলে পরে মানুষের বাছ-বিচার থাকে না, যা-তা খেতে মন চায়, দিকবিদিক ছোটোছুটি করতে মন চায়। সবকিছুই আপন মনে হয়, সহজলভ্য মনে হয়, অহেতুক স্মৃতিকাতরতায় ভোগে। যে অতীতে সে আদৌ কখনো ছিল না, মনে হয় সেই অতীতে সে-ই ছিল সবচে সরব! ওই তো ওখানে যেন তার তরুণাত্মা দৌড়াদৌড়ি করছে! মানসচক্ষে নিজের অতীতের দুষ্টু কিশোরটা লুকোচুরি খেলায় মত্ত! এই অনুভূতিটা হয় কোনো কোনো স্মৃতিকথা পড়তে গেলে, কবে তুলে রাখা পেপার-কাটিং দেখে, পুরোনো ছবি পেলে, কেউ স্মৃতিচারণ করলে, পুরোনো চলচ্চিত্র দেখলে। আর এটা হওয়াই স্বাভাবিক। এটা সনাতন ধারা। 

আর ফেলে আসা দূর-নিকট অতীতে যেখানে সে নিজে ছিলই, সেটা যখন ভাবে বা মনে পড়ে সেইসব স্মৃতি তখন তো হয়ে যায় সোনায় সোহাগা। তার রূপরসগন্ধই আলাদা! আমার ক্ষেত্রেও ইদানীং তাই ঘটতে শুরু করেছে। ৩৬ বছরের প্রবাসজীবনে কতকিছু যে সংগ্রহ করেছিলাম শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র-রাজনীতি-ইতিহাস সম্পর্কিত তা দেখে নিজেই আশ্চর্য হই! আর এগুলো ছিল বলেই আমার বইগুলো লেখার ক্ষেত্রে অশেষ কাজে লেগেছে। তথ্যবহুল মোটা-মোটা গ্রন্থাদি, সাময়িকীর বিশেষ মেদবহুল সংখ্যাগুলোতে মূল্যবান নানা তথ্য থাকেই, কিন্তু পরিত্যক্ত মেদহীন পত্রপত্রিকা, ক্ষুদ্র ম্যাগাজিন, স্মরণিকা, চিঠিপত্র, চিরকুট, মেমো, ডায়েরিতেও যে অনেক অমূল্য তথ্য, উৎস, উপাত্ত—বিস্মৃত ইতিহাসের সূত্র থাকে সেটাও স্বীকার্য। 

অবসরজীবনে প্রবেশ করলেও আরও কিছুদিন কর্মরত থাকতে হবে শারীরিক সচলতার জন্য। জাপানিরা বলেন, ষাটের পর কাজ করা ভালো। কলকারখানায় একটু ভারী কাজ বা ভবন-উদ্যান-রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করা স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম। ডাক্তারও তাই বলেন। আর আমি তো সেই ১৯৮৬ সাল থেকেই ছাপাখানায় কাজ করে এসেছি। ৫০ এর পর কাজ করেছি খাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানায়। এই বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কাজ করেছি মোটর গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে। একটু ভারী কাজই ছিল। ফলে পরিশ্রম হয়েছে যথেষ্ট। ১০-১১টা ঘণ্টা কাজ। কাজের মধ্যে থাকলে বাজে চিন্তা, দুশ্চিন্তা কিছুই মনে আসে না। জাপানে কাজের সময় ফাঁকি দেবার কোনো সুযোগ নেই। ফলে আমার আর জিমে যেতে হয়নি আজ পর্যন্ত। জাপানে জিমে মাসিক ১০ হাজার ইয়েন মূল্য দিয়ে ব্যায়াম করা যায়। এত বছর পর্যন্ত আমার কাজের মধ্যেই সম্পূর্ণ ব্যায়াম হয়ে গেছে। কাজে থাকলে দিন খুব দ্রুত চলে যায়। দেখতে না দেখতেই সপ্তাহের ৫টি দিন কী করে যে চলে যেত টেরই পেতাম না! এভাবে ৩৫ বছর অতিক্রম করে এলাম। আর যে কবছর বাঁচি খুব যে বেশি কিছু লিখতে পারব তা মনে হয় না। গুরুত্বপূর্ণ জরুরি কয়েকটি বই না লিখলে নয়। তাই সংগৃহীত মুদ্রিত দলিলপত্রগুলোকে গুছিয়ে ফাইলবন্দি করার কাজটি করছি কিছুদিন ধরে। তখনই বেরিয়ে পড়ল দূর-নিকট অতীতের বহু ঘটনা, কর্মকীর্তি আর অসাধারণ সব মানুষের প্রতিকৃতি, প্রতিচ্ছবি আর তথ্যাদি! সেগুলো হয়তো অন্যের কাছে মূল্যবান নাও হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সামান্য পুরোনো, বিস্মৃত ছবিও অমূল্য সম্পদ। প্রবীণ, সমবয়সীদের কাছেও যে খুব মূল্যবান কিছু বলে প্রতিভাত হবে তাও নাও হতে পারে, তরুণ প্রজন্ম তো ভিন্ন ব্যাপার। তথাপি তরুণদের মাঝেও যদি ইতিহাসচেতা কেউ কেউ থাকে, তাহলে তাদের আগ্রহের কারণ হতে পারে। 

আসলে, ইতিহাস এমনটি বিষয় যাকে হেলাফেলা-অবজ্ঞা-অস্বীকার করা যায় না। শিক্ষা জগতের সব বিষয়ের পিতা হচ্ছে ইতিহাস। আমি দেখেছি জাপানি শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্বেচ্ছাসেবী, রাজনীতিবিদ, অভিনয়শিল্পী, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক, বিচারপতি, আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা, অফিসকর্মী, ক্রীড়াবিদ এবং কলকারখানার শ্রমিক সবাই ইতিহাসের ভক্ত। স্বদেশের, বহির্বিশ্বের ইতিহাস জানার জন্য তাদের আগ্রহের শেষ নেই! প্রচুর ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস, গবেষণামূলক গ্রন্থ এবং জীবনী জাপানে সারা বছর ধরেই প্রকাশিত হয়। ইতিহাস জানা মানে নিজের অবস্থানকে সম্যক জানা ও বোঝা। তা না হলে ভিন্ন জাতির সঙ্গে নিজেদের ভালোমন্দের তুলনা করা যায় না আবার ভাববিনিময়ও সম্ভব হয় না। মানবজাতির জন্য আন্তর্জাতীয় ভাববিনিময় খুবই জরুরি বিষয় আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তির জন্য। তাই জাপানে ইতিহাস ও সংস্কৃতিবিষয়ক গ্রন্থাদির প্রকাশ যেমন বেশি, তেমনি বিক্রয় তালিকার শীর্ষেও অবস্থান করে। এটা উন্নত ও সভ্য জাতির লক্ষণ। জাপানিরা বিশ্বের যেকোনো জাতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে সদাই আগ্রহী। তাই বৈশ্বিক ইতিহাসের গ্রন্থাদি জাপানি ভাষায় অনুবাদও হয়ে থাকে প্রচুর পরিমাণে। জাপান হচ্ছে বিশ্বইতিহাসের জাদুঘর। 

একসময় বাঙালির মধ্যেও ইতিহাসবিষয়ক বই পড়ার রেওয়াজ ছিল। অনেক বিখ্যাত বাঙালি ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। আমাদের বাবা-মা, তাদের সমসাময়িক মানুষদের ইতিহাসবিষয়ক বইপড়া ও চলচ্চিত্র দেখার স্মৃতি আমার কম নয়। সেটা অবশ্যই আমার কৈশোরকালের কথা। স্বাধীনতার পর সব উলট-পালট হয়ে গেল! আমাদের ভালো চিন্তা, অগ্রসর মনোভাব, সুঅভ্যাস, সুআচরণ, আধ্যাত্মিক সাধনা, সম্প্রীতি, নীতিজ্ঞান, সৃজনশীলতা, সহিষ্ণুতা—সব দ্রুতই হারিয়ে যেতে শুরু করল  নোংরা—বস্তিমুখী নিয়ন্ত্রণহীন রাজনীতির কারণে। বাঙালি জাতীয়তাবোধ থেকে  নয় মাসব্যাপী যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধটা বাঙালি করল—তার চেতনাটা নিস্তেজ হয়ে  ছিটকে পড়ে গেল অবাধ স্বজনপ্রীতি, দুর্বল শাসন, অদূরদর্শী পদক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে! এসব ঘটেছে ১৯৭২ থেকে বঙ্গবন্ধুহত্যাকাণ্ড পর্যন্ত। তখনকার পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনগুলোই এর বড় সাক্ষী। আমি তখন কিশোর—সবই ঘটেছে আমার চোখের সামনে, দেখার মধ্যে ও জানার  মধ্যে। বাবা ছিল কুমিল্লা সদর পুলিশ অফিসের জিআরও (জেনারেল রেকর্ডিং অফিসার), সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে বিমর্ষ মনে আমাদেরকে বলত, “প্রতিদিন রাজনৈতিক দলাদলি, হাঙ্গামা, মারামারি, খুনাখুনি; অর্থআত্মসাৎ, রিলিফ চুরি, মজুতদারী, দুর্নীতির কারণে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে মানুষ, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, অনেকে ওপরের কর্তা বা নেতাদের তদবির, ধমকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। কী বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা!” সদ্য স্বাধীন পুরো বাংলাদেশটিই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। তিনি বিচলিত, বিভ্রান্ত, অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। কেউ কারো কথা শুনত না! তিনি নিজেই বিরক্ত হয়ে বক্তৃতায় বলতেন, “চোরায় নাহি শুনে ধর্মের কাহিনি!” চোর আর চাটার দল তাঁর নামে বরাদ্দকৃত রিলিফের কম্বলটা পর্যন্ত আত্মসাৎ করে দিয়েছে! কী দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা তাঁর! তাঁর দুরবস্থার জন্য বাবা খুব দুঃখ প্রকাশ করত। বলত, “আহারে, মানুষটা বড়বেশি অসহায় পড়েছেন!” শাসন কঠোর করেও লাভ হল না, পরিবর্তন সূচিত হল না। 

স্বাধীনতা পেলে যে বাঙালি এরকম বিশৃঙ্খল, উশৃঙ্খল, উন্মাদ, বেপরোয়া হয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেননি! তাঁর দল তো বটেই জনগণের মধ্য থেকেও তাঁকে কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল না! সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! এমন হবে জানলে তিনি কোনোদিন স্বাধীনতা চাইতেন না আমার আজও বিশ্বাস। তাঁর প্রাণপ্রিয় বাঙালিকে বিশ্বাস করে, তাদের ওপর নির্ভর করে বঙ্গবন্ধু কী পেলেন? মৃত্যুর মতো কঠিন উপহার, নির্দয়, নির্মম প্রতিদান। না পেরে শেষ চেষ্টা ‘বাকশাল’ গঠন করলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে ‘বাকশাল’কে কেন্দ্র করে গভীর ষড়যন্ত্র হল, সামরিক সংঘাত সৃষ্টি করা হল। আমূল পাল্টে ফেলা হল দেশের ভাবমূর্তিকে! একটি পিছিয়েপড়া পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার আলোকে টেনে আনার জন্য লাগাতার অমানুষিক পরিশ্রম, প্রচেষ্টা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, লড়াই আর ভালোবাসা বঙ্গবন্ধু বিনিয়োগ করেছিলেন—তার নজির দ্বিতীয়টি নেই এই বিশ্বে!  তাঁর শাসনামলের সাড়ে তিনটি বছর তাঁকে একটি দিন স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি তাঁরই দলের লোকেরা; তাঁর সকল শান্তি হরণ করেছে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীরা। সেসব তো দৃশ্যত দেখা ঘটনা আমার জীবনে। এখনো জ্বলজ্বল করছে সেইসব দুঃসহ স্মৃতি। 

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর লাগাতার সামরিক স্বৈরতন্ত্র চলল এরশাদের পতন পর্যন্ত। সমরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের নামে পুনরায় সামরিক ইন্ধনপ্রসূত বেসামরিক স্বৈরাচারের নবদিগন্ত উন্মেচিত হল। পূর্ববর্তী শাসনামলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি স্বজনপ্রীতি, মুজতদারী, কালোবাজারি, দুর্নীতির মহাসাগরে নিমজ্জিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। মারামারি, খুনাখুনি, সাম্প্রদায়িক হামলা, দখলদারি, হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণের মহারাজত্বে বাংলাদেশের সভ্যতা কলুষিত হলো। বাঙালির সহজিয়া সংস্কৃতি, সাধনা, সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতা সব উধাও হয়ে গেল। মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো বিস্মৃত, ভুল ইতিহাস রচিত হতে লাগল, স্বাধীনতার মহান নেতা বঙ্গবন্ধুসহ কারাগারে নিহত জাতীয় চারনেতার নাম নিষিদ্ধ হয়ে গেল। নজিরবিহীন এরকম ইতিহাস বিকৃতি বিশ্ব দেখেনি কোনোদিন! স্বাধীনতাবিরোধীরা সমাজে ও রাষ্ট্রে পুনর্বহাল হলো। এমনকি ক্ষমতায় পর্যন্ত অধিষ্ঠিত হল! কয়েক প্রজন্ম জানল না, কেন পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙালি যুদ্ধ করেছিল? কেন স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল? কে বা কারা নেতৃত্ব দিল মহান মুক্তিযুদ্ধে জানার তারা সুযোগ পেল না। জাতি ও প্রতিষ্ঠাসমূহ পরিষ্কার দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একভাগ স্বাধীনতার পক্ষে, আরেক ভাগ স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিল। উন্নতির নামে লাগামহীন প্রকল্প গৃহীত হলো, হলো অর্থচুরি-আত্মসাতের মহোৎসব! বিদেশি সাহায্যের হরিলুট কাকে বলে আমাদের প্রজন্ম দেখল। 

নব্বই এর মাঝামাঝি স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দুঃসাহসী কিছু পদক্ষেপ নিল। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুহত্যাকাণ্ডের বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করল। উন্নয়নের নানা প্রকল্প গৃহীত হল। কিন্তু যে বাঙালি সে বাঙালিই রয়ে গেল। নীতি, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, জাতিসেবা, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন, প্রজন্মের স্বাধীনতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন আর হল না! উন্নয়নের নামে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েই চলেছে। প্রতিরোধ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও রোধ করা সম্ভবপর হচ্ছে না। বছর দু-তিন আগে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা অনুজপ্রতিম বন্ধু জাপানে এলে পরে, নিভৃতে হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, “দাদা, দেশ উন্নত হচ্ছে সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না! এটাই আমাদের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। আমরা সচেতন, সুনাগরিকদের বিশ্বাস এবং আস্থা হারাতে বসেছি। প্রধান মন্ত্রী চেষ্টার ত্রুটি করছেন না, কঠোর হচ্ছেন, কিন্তু একা তিনি কতখানি করবেন? দেশটা তো আমাদের সকলের। আমরা চলে গেলে পরে তো আমাদের বংশধর, নাতি-নাতনিরা থাকবে, তাদের জন্য আমরা কী রেখে যাচ্ছি, কী রকম বাসস্থান, কী রকম দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ রেখে যাচ্ছি—এটা কি আমাদের চিন্তা  করা উচিত নয়? জরুরি নয়? কিন্তু কারা এসব করছে আপনি তা ভালো করেই জানেন। তারা আমাদেরই লোক, আমাদের আত্মীয়।” 

আমি উত্তরে বললাম, “পঁচাত্তরের গন্ধ পাচ্ছি। ওরকম না হলে অপ্রতিরোধ্য একটি রক্তাক্ত উলট-পালটের শঙ্কা স্বস্তি দিচ্ছে না।” আমার উত্তর শুনে তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, “নানাভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিবতকর অবস্থার মধ্যে ফেলা হচ্ছে। যার যা ইচ্ছে সে তাই করছে। চাঁদাবাজি তো আছেই! ধর্ষণ বেড়ে গিয়ে কী এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলেছে সরকারকে তা সুস্থ মাথায় চিন্তা করা কঠিন। বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের ইমেজকে কী বিচ্ছিরিভাবে কলুষিত করছে, তা আপনি প্রবাসী হিসেবেও জানেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়াবাড়ি সীমা লঙ্ঘন করেছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা আওয়ামী লীগের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে দলটির মানমর্যাদাকে, ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করছে।” 

তার কথা শুনে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। সম্প্রতি মহান মুক্তিযুদ্ধের সংশোধিত নামের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা ও রাজকারদের নামের অদলবদল যে কলঙ্ক সৃষ্টি করেছে তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সুযোগ আর নেই। ইতিহাসে সেটা স্থায়ী কলঙ্ক হিসেবে থেকে যাবে। আমার মনে হয় না, বিশ্বের আর কোনো দেশে সে দেশের মহান স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি, বীরযোদ্ধাদের নিয়ে এমন কেলেঙ্কারি হয়েছে বা হচ্ছে! এতে করে জাতি হিসেবে বাঙালির মানদণ্ড কোনখানে দাঁড়িয়ে আছে সহজেই অনুমেয়। এত বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরও তার মানমর্যাদা সম্পর্কে যে জাতি সচেতন হয়নি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সে জাতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ বলাই বাহুল্য। উন্নয়ন দিয়ে কি জাতির নৈতিক অবনতি, চারিত্রিক অবক্ষয়ের চেহারা ঢাকা দেয়া যাবে? 

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে জাপানের খ্যাতিমান লেখক, গবেষক, আন্তর্জাতিক পতাকা গবেষক ও রেডক্রসের প্রাক্তন প্রধান ফুকিউরা তাদামাসা ২০১০ সালে আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সব পরাশক্তি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কোনো অংশেই কম হয়নি! অথচ আজ সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা আর তার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের অমার্জনীয় আচরণ, আন্দোলন এবং হীনমন্যতা আমাদেরকে যুক্তি, মুক্তবুদ্ধি এবং বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে মধ্যযুগের দিকে ঠেলে দিতে তৎপর। অনেক বিদেশি নাগরিকও আমাদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে। সেসব ইতিহাস আজও রচিত হয়নি পূর্ণাঙ্গভাবে। সরকার স্বাধীনতাকে সমর্থন করার জন্য বিদেশিদের সম্মানিত করলেও অনেকেই বাদ পড়ে গেছেন, ইহলোকত্যাগ করেছেন। যেমন জাপানের স্বনামধন্য রবীন্দ্রগবেষক, বঙ্গবন্ধুর ভক্ত-দোভাষী প্রয়াত অধ্যাপক কাজুও আজুমা, গবেষক ফুকিউরা তাদামাসা, অধ্যাপক ড. পেমা গিয়ালপো, কিয়োতো মোমোয়ামা লায়ন ক্লাবের গর্ভনর প্রয়াত তাসুগি কিসোও, সাংবাদিক প্রয়াত তানাকা তোশিহিসা এমনি আরও অনেক। এখন আমার জানামতে জীবিত আছেন ফুকিউরা ও ড. পেমা গিয়ালপো এই দুজন মাত্র। বাকি সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন। 

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গে। অগণিত মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন, শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন, চাঁদা তুলেছেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উৎসাহ-প্রেরণা জুগিয়েছেন, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরও সেইসব ইতিহাস বেরিয়ে আসছে ক্রমাগত। এতে বোঝা যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি কত গভীর এবং ব্যাপক ছিল। তেমনি একজন বাঙালির কথা এখানে তুলে ধরে এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই।  

একজন হরিসাধন দাশগুপ্ত 

পুরোনো মুদ্রিত দলিলপত্র বাছাই করতে গিয়ে প্রথমেই নজরে এলো ৯০-এর মাঝামাঝি কলকাতার সানন্দা ম্যাগাজিনের দু-তিনটি সংরক্ষিত পাতা। ম্যাগাজিনের ‘ধ্রুপদী’ বিভাগে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন, “শেষ সাক্ষাৎকার হরিসাধন দাশগুপ্ত”তে জানতে পেলাম মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জড়িত হওয়ার বিষয়টি। প্রয়াত হরিসাধন দাশগুপ্ত (১৯২৩-৯৬) ছিলেন প্রখ্যাত তথ্যচিত্রকার, কাহিনিচিত্রকার, হলিউড-ফেরত চলচ্চিত্রযোদ্ধা ও বোদ্ধা। তাঁর পরিচালিত কমললতা, একই অঙ্গে এত রূপ ইত্যাদি কাহিনিচিত্র অবিস্মরণীয়। টাটা স্টিল কোম্পানির তথ্যচিত্রও তিনি নির্মাণ করেছিলেন। জানা যায় ১০০টি গুপুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র তিনি নির্মাণ করেছিলেন জীবদ্দশায়। তার মধ্যে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তথ্যচিত্র অনবদ্য একটি কাজ। অত্যন্ত গুণী ও প্রভাবশালী এই মানুষটি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সিনেমাটোগ্রাফি’র ওপর স্মাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। তারপর হলিউডে গিয়েছেন আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণ কৌশল শিক্ষালাভ করার জন্য। সেখানে বিখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আরভিং পিচেলের কাছে শিক্ষানবিশি করেন। এবং সেখানেই পরিচিত হন বিশ্বনন্দিত ফরাসি চিত্রপরিচালক জ্যঁ রেনোয়ারের সঙ্গে। গত শতকের ষাটের দিকে রেনোয়ার ভারতে আসেন তাঁর দি রিভার চলচ্চিত্রের কাজ করার জন্য, হরিসাধন তাঁর প্রধান সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

ভারতের স্বাধীনতার পর ইতালির বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও নয়া-বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রের জনক রবের্তো রোসেলিনি প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর আমন্ত্রণে ভারতে আসেন ভারতের জনজীবনের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য ১৯৫৭ সালে। হরিসাধন তাঁর সহযোগী হয়েছিলেন। পরে রবের্তোর সঙ্গে যেকোনো কারণেই হোক তাঁর স্ত্রী সোনালি দাশগুপ্ত এক পুত্র সন্তানসহ ইতালি চলে যান। এই ঘটনা নিয়ে নানা গুঞ্জন, রটনা, আলোচনা, সমালোচনা বহু বছর চলচ্চিত্র জগৎকে মাতিয়ে রেখেছিল। সে যাই হোক, এটা তাঁর ব্যক্তিগত পারিবারিক ব্যাপার। 

হরিসাধন দাশগুপ্ত যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন তা কি আমরা জানি? বাংলাদেশে কখনো কি কারো স্মৃতিচারণে, কারো লেখায় সেই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে? আমার জানা নেই। আরিফ হায়দার কর্তৃক সানন্দার জন্য গৃহীত সেই সাক্ষাতকারের এক জায়গায় হরিসাধন বলছেন, “বাংলাদেশের দু’জন মানুষ এই কলকাতায় এসে আমার খুব কাছের হয়ে উঠেছিল। একজন জহির রায়হান, অন্যজন আলমগীর কবির। বিশেষ করে জহির। ওরা এসেছিল ১৯৭১ সালে। তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমাদের বাড়িটা ছিল সেই সময়ের জন্য বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলনের অফিস। জহির ছিল সেই অ্যাসোসিয়েশন-এর সেক্রেটারি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য ছিলেন প্রেসিডেন্ট। ঠিক সেই সময় সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে মেতে উঠলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, যুদ্ধের ছবি তুলব বলে। জহিরও কিন্তু এখানে এসেছিল ছবির কাজ করবার জন্যই। আমি জহিরকে দেখে আশাবাদী হলাম, যেমন হয়েছিলাম আমেরিকা থেকে ফিরে সত্যজিৎ রায়কে দেখে—ঠিক তেমনই হলাম জহিরকে দেখে। জহির  রায়হানের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেল, আমরা বাংলাদেশের, এই যুদ্ধকালীন সময়কে ডিসকভার করব। শুরু হল কাজ। জহির প্রথম কাজ শুরু করল স্টপ জেনোসাইড । একটা অসাধারণ ডকুমেন্টারি। এই ছবিতে ছিল ওর আইডিয়া আর আমার রিসোর্স। ঠিক সেই সময় জহিরের মতো, এস. সুখদেব সিং (আমারই ছাত্র) কলকাতায় এলো মুক্তিযুদ্ধের ওপরে কাজ করবে বলে। আবার এরই মধ্যে জ্যঁ রেনোয়ার ছেলে জ্যাক রেনোয়া তার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে বাংলাদেশের ওপর ছবি করতে এসেছিল। তারাও আমার এখানেই প্রথম যোগাযোগ করে। কিন্তু পরে এরা ছবি না করে ইটালি ফিরে যায়। শেষ পর্যন্ত জহিরকে আমার ক্যামেরাটি দিই ছবি শেষ করার জন্য। ব্যস, এই তো হলো বাংলাদেশ পর্ব।” 

অথচ এই ইতিহাসটি যে আরও ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা ভুলেই গেছি। ১৯৯৬ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত বেঁচেছিলেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। বাংলাদেশ তাঁকে কি কখনো আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কিংবা স্বাধীনতার পুরস্কারে ভূষিত করেছিল? আমার জানা নেই। এই সাক্ষাতকারেই জানা যায় তিনি ছিলেন ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান। শৈশবেই দেশভাগের সময় ভারতে চলে যান পরিবারের সঙ্গে। যদিও একবার জন্মস্থানে ফিরতে প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। 

জন্মস্থানে ফেরার ভাগ্য নিয়ে সবাই জন্মায় না, আমিও তাঁদেরই একজন হয়তোবা।


 প্রবীর বিকাশ সরকার, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক  এবং সম্পাদক, জাপান

menu
menu