সিমুর্গ, নিশাপুর ও ত্রিশটি পাখির গল্প

এক গাদা বই বুকে নিয়ে শুয়ে আছি ইজি চেয়ারে। পড়ন্ত বিকেল। আঙ্গিনায় গাছের ফাঁক গলে শিশুর মতো রোদ খেলছে। জল ঝরছে পুলে। পাতা নড়ছে বাইরে। লম্বা লম্বা তাল জাতীয় পাম গাছগুলো দোলে দোলে হাঁটছে। ওরা কোথায় যেন যাচ্ছে। কিন্তু তা নিয়ে আমার কোনো কৌতুহল নেই।
আমি তন্দ্রার বালিশে মাথা এলিয়ে আছি। 
দেখছি, এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতী দ্বিতল প্রাসাদের জানালা খুলে-রাতের অন্ধকারে উন্মুক্ত করে দিয়েছে ঘন কালো চুল। দীর্ঘ সেই চুল বাগানে নেমে এসেছে। তাঁর চোখের কালো ঝালর অতিক্রম করে যে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে, সে স্বল্প আলোয় তাঁরই চুল ও কামনার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে এক অসামান্য রূপের যুবক, ‘জ্বাল’।   
সে অভিসারে এসেছে রাজকন্যা রুদাবেহর কাছে। শাহেনশাহ যদি জানতে পায় গর্দান যাবে দু’জনেরই। কিন্তু প্রেম গর্দানের চেয়েও বেশি মূল্যবান। প্রেমের সা¤্রাজ্য যেকোনো শাহেনশার সা¤্রাজ্যের চেয়েও বড়। প্রেমের শক্তির কোনো সীমা পরিসীমা নেই। রুদাবেহর প্রেমিক জ্বালের পিতা-মাতা নেই, পারস্যের মিথিকাল পাখি সিমুর্গ তাকে লালন পালন করেছে। হৃদ্ধ করেছে তাকে সাহসে ও প্রজ্ঞায়। 

সিমুর্গ

সিমুর্গ হচ্ছে পারস্যের সাসানিয়ান রয়্যাল সিম্বল। একটি বিশাল পাখি যে হাতি বা তিমি নিয়ে উড়ে যেতে পারে। কখনো দেখতে সে ময়ূরের মতো, কখনো তাঁর মাথাটি কুকুরের এবং পায়ে সিংহের নখর। কখনো কখনো কুকুরের বদলে মানুষের মুখ। কিন্তু খুবই দয়ালু প্রকৃতির এবং সে একটি নারী পাখি। স্তন্যপায়ী, বাচ্চারা তার দুধ পান করে। দ্তঁ আছে। সে সাপের শত্রু। যেখানে জল প্রচুর সে বাস করে সেখানে। তাঁর পালক পিতল-রঙের। পারস্যের মিথ অনুসারে এই পাখি এতই বয়স্ক যে, সে পৃথিবীর তিনবার ধ্বংস দেখেছে। বয়সের কারণে সে সব যুগ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে। সে জল ও মাটিকে পবিত্র করে উর্বরতা দান করে। সে আকাশ ও মাটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। 
পার্সিয়ান সাহিত্যে সে ঈশ্বরের মেটাফোর।
পার্সিয়ান শব্দ “সি মুর্গ ”(ংর গঁৎম) এর আভিধানিক অর্থ ত্রিশটি পাখি। 
(ংর-ত্রিশ , গঁৎম- পাখি)।

নিশাপুর 

খোরাসানের নিশাপুর শহর। ওমর খৈয়ামের নামের সঙ্গে জড়িত এর নাম। তৃতীয় শতাব্দীতে স¤্রাট শাপুর-১ এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন সাসানিয়ান সাত্রাপির রাজধানী হিসাবে। কালে কালে এই শহর বড় হয়। তাহিরি, সেলজুক এবং সামানিদ রাজবংশের সময়ও রাজধানী ছিল। ১০০০ সালের দিকে পৃথিবীর ১০টি বড় শহরের একটিতে পরিণত হয় এই নিশাপুর। প্রসিদ্ধ সিল্ক রোড গিয়েছিল এই শহরের ওপর দিয়ে। ১২২১ সালের কথা। 
চেঙ্গিস খানের মেয়ে জামাই নিহত হয় এখানে। শোকের চেয়েও প্রতিশোধের আকাক্সক্ষায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে নারী। পিতার কাছে দাবি করে নিশাপুর শহরের প্রতিটি মানুষের ছিন্ন মস্তক। মরু হাওয়ার মতো ছুটে আসে মঙ্গল বাহিনী। ১০ দিন ১০ রাত চলে হত্যাযজ্ঞ। ধর্ম গ্রন্থে বর্ণিত কেয়ামত। মানুষ, মানুষ নয়, পশু। মানুষ মানুষকে হত্যা করে পিঁপড়ের মতো। মানুষ যাদের জন্ম মানুষের ঘরে নয়। কর্তিত মস্তক জড়ো করে করে ওরা এক বিশাল পিরামিড তৈরি করে। একজন নারীর রক্তের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য। একজন নাগরিকও রেহাই পায় না। এই নাগরিকদের মধ্যে ছিলেন ৭৪-৭৫ বছর বয়স্ক পারস্যের সুফি কবি ফরিদউদ্দিন আত্তার । 
১১৪৫ সালে নিশাপুরে তার জন্ম, চেঙ্গিস খানেরও জন্মের ১৭ বছর আগে। এই ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে নিশাপুর শহর হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে দীর্ঘদিনের জন্য। তাঁর রূপ বৈভব ও ঐশ্বর্যের কথা ভুলে যায় মানুষ। 
মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি যে দু’জন কবির দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন তারা হলেন আত্তার এবং সানাই। “অঃঃধৎ রং ঃযব ংড়ঁষ ধহফ ঝধহধর রঃং ঃড়ি বুবং, ও পধসব ধভঃবৎ ঝধহধর ধহফ অঃঃধৎ”-রুমি বলেন। 
“অঃঃধৎ যধং ৎড়ধসবফ ঃযৎড়ঁময ঃযব ংবাবহ পরঃরবং ড়ভ ষড়াব যিরষব বি যধাব নধৎবষু ঃঁৎহবফ ফড়হি ঃযব ভরৎংঃ ংঃৎববঃ ”.
আত্তারকে রুমি কতখানি গভীরভাবে বুঝেছেন তার প্রমাণ মিলে এই বক্তব্যে। 
আত্তার অনেক বই লিখেছেন। তাঁর গধহṭরয়-ঁṭ-Ṭধুৎ বা ‘পাখিদের সম্মেলন’ নামে কাহিনি কাব্যটি সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি সুফি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই বলে গণ্য হয়। 


পাখিদের সম্মেলন

পৃথিবী ব্যাপী অন্যায়, অবিচার, শোষণ বিদ্রোহ, পরিবেশ দুষণ ও অশান্তির কারণ নিয়ে আলোচনা করতে সব পাখিরা একত্রিত হয়। হুপো ছিল তাদের মধ্যে সবচাইতে জ্ঞানী। সে বলে, ‘এ সবের মূল কারণ হলো, আমাদের, পাখিদের কোনো রাজা নেই।’ কেউ কেউ বলে, ‘আমরা অনেক রাজা দেখেছি, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি কোনোদিন, কী দরকার আমাদের আরও একজন রাজার?’
হুপো বলে, ‘এই রাজা সত্যিকারের প্রাজ্ঞ। সে আমাদের ততই কাছে, যতদূরে আমরা তাঁর থেকে। তার নাম সিমুর্গ। কাফ পর্বতের চূড়ায় তার বাস, চল আমরা সবাই তার সন্ধানে যাই ।’
পাখিরা অনুধাবন করে এ বড় কঠিন পথ, কেউ কেউ সন্দেহে দোদুল্যমান হয়, কেউ হয় ভীত।
হাঁস বলে, ‘আমি ছোট্ট এই ডোবার জলেই সুখী! জলই হচ্ছে সব সুখের আঁধার’
হুপো বলে, ‘আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেখানে জলের অভাব নেই।’
বাজপাখি বলে, ‘আমার একজন প্রভু আছে।’
‘তুমি প্রভুর আদেশ পালন করতে পছন্দ করো? আমরা প্রভুর সন্ধানেই যাচ্ছি, চল আমাদের সাথে।’
পেঁচা বলে, ‘আমি সময়ের ভগ্নস্তূপে চকচকে মণি খোঁজি। একই স্থানে থাকবে কেন ? মণি সন্ধানের নতুন স্থান খুঁজতে চল আমাদের সাথে,’
বুলবুলি বলে, ‘আমি ভালোবাসার জন্য বাঁচি, গোলাপ আর আমি এক সত্তা। আমি কি করে আমার গোলাপকে ছেড়ে যাই?’
‘তুমি কি জানো না গোলাপে কাঁটা আছে?’
কাকাতুয়া বলে, ‘আমার খাঁচাই ভালো, এখানে খুব নিরাপদ। ওরা আমাকে প্রতিদিন খেতে দেয়, দেয় পানের জল।’
‘এবং তোমাকে আদেশ করে তুমি কি বলবে এবং কিভাবে চিন্তা করবে।’
ময়ূর বলে, ‘আমি সম্পূর্ণ স্বকীয়, আমি অন্য কারও মতো নই। চেয়ে দেখ আমার কী রং, কী রূপ ও বৈভব!’
‘এই রূপ নিয়ে একা পড়ে থাকবে কেন? চলো, সবাইকে দেখাবে তোমার রূপ।’
অবশেষে পাখিরা যাত্রা শুরু করে।
নানা রঙের, নানা আকৃতির উড়ন্ত পাখিরা, পৃথিবীর প্রতিটি স্থান, প্রতিটি কোণ ভরে ফেলে।
‘আসো, সাহসী পাখিরা, বাতাসে ভাসো, ডানা ঝাপটাও, তোল হৈ হৈ রৈ রৈ কোলাহলের অনুরণন।’
‘প্রেম ভালোবাসে বাঁধা বিস্তর, আমরা প্রেমের সঠিক পথে চলছি।’
‘স্ফটিকের বালুকণার অন্তহীন এই মরুভূমি, অবিরাম পর্বতমালা যেন মালা গাঁথার সুতা। শান্ত ও সহজে ওড়ো, হাওয়া অনুকূল, আমাদের যেতে হবে দীর্ঘ পথ’
পাখিরা ওড়ে আর ভাবে, আর ভাবে : ‘কিন্তু সে যদি না থাকে সেখানে?’
‘আর কতদূর যেতে হবে আমাদের?’
‘আচ্ছা সিমুর্গ দেখতে কেমন?’
‘জানতে ইচ্ছে করে, সে কি আমাদের খেতে দেবে? দেবে পানীয়?’
সাতটি গ্রহ যেন ফোঁটা ফোঁটা দাগ, সাতটি মহাসাগর যেন বৃষ্টি কণা। (ঞযব ংবাবহ ঢ়ষধহবঃং ধৎব ভৎবপশষবংৃঞযব ংবাবহ ড়পবধহং ধৎব ফৎড়ঢ়ং ড়ভ ৎধরহৃ) পাখিদের পার হতে হবে সাত সাতটি উপত্যকা :

১. উপত্যকা অভীষ্ট লক্ষ্যেও (াধষষবু ড়ভ য়ঁবংঃ) 
(চঅঞওঊঘঈঊ-ঢ়বধপবভঁষ, ধঁংঢ়রপরড়ঁং, ঃৎঁঃযভঁষ, রহঃবহংব, বহফঁৎরহম, হঁসনরহম, পধষসরহম, বঃবৎহধষ) হল শান্তি ও মঙ্গলের স্থান। সত্যনিষ্ঠা, তীব্রতা ও ঐকান্তিকতার, স্থায়ী ও বিলুপ্ত অনুভূতির, স্থৈর্য্য ও চিরন্তনতার। যা কিছু মূল্যবান তোমাদের কাছে তার থেকে মুক্ত হতে হবে। সব ফেলে যেতে হবে পিছনে : সমস্ত আকাক্সক্ষা, বন্ধন, বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও ডগমা।
‘ছুঁড়ে ফেলে দাও তোমাদের সংস্কার, দর্প ও ক্ষমতা, আর সেইসব কিছু , যা না হলে মূল্যহীন মনে হয় জীবন।’(ঔবঃঃরংড়হ ুড়ঁৎ ড়নংবংংরড়হং, ুড়ঁৎ ঢ়ড়বিৎ ধহফ বাবৎুঃযরহম ুড়ঁ যড়ষফ ফবধৎ.)
রাত্রি ঘনিয়ে আসে, পাখিরা বিরতি নেয় ।
সংস্কারাচ্ছন্ন পাখি ঝাঁঝরি দিয়ে মাটি চালুনি দিতে দিতে বলে, “আমি পথ খুঁজছি, আমাকে খুঁজতে হবে সর্বত্র।”
হুপো বলে, ‘যখন শূন্য মনে হয় সব, হৃৎপি-ের দুয়ার খুলে দিও হাওয়া খেলে যেতে।’ (ডযবহ ুড়ঁ ভববষ বসঢ়ঃু, ুড়ঁ যধাব ঃড় ড়ঢ়বহ ঁঢ় ুড়ঁৎ যবধৎঃ ধহফ ষবঃ ঃযব রিহফ ংবিবঢ় ঃযৎড়ঁময রঃ.)


২. উপত্যকা ভালোবাসার (াধষষবু ড়ভ ষড়াব ):
(ঐবৎব নঁৎহরহম ভরৎব রং ষড়াব ধহফ নঁৎহরহম ষড়াব রং ভরৎব)
এখানে জ্বলন্ত আগুন হচ্ছে-প্রণয়। আর প্রণয়ের তীব্রতা-আগুন। ভালোবাসার চিতা জ্বলে অনুক্ষণ, চিরন্তন দাবদাহে।
কিছু পাখি পালিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় রাতের নিকষ যবনিকায়।
অপ্রতিভ পাখি বলে, ‘ভালোবাসায় আমার ভয় হয়।’
হুপো বলে, “না ভালোবাসা তোমাকে টেনে তুলতে পারে পৃথিবীর শীর্ষে অথবা টেনে নামাতে পারে নিরুদ্ধ নরকে। ( খড়াব পধহ ষরভঃ ুড়ঁ ঃড় ঃযব ঃড়ঢ় ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ ড়ৎ ঢ়ঁষষ ুড়ঁ ঃড় ঃযব নড়ঃঃড়স ড়ভ যবষষ)
প্রাচীন গোর খোদককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘তুমি কি ভালোবাসাকে সমাধীস্থ করতে পারো?’
সে বলেছিল, ‘আমি বহু লাশ মাটি চাপা দিয়েছি জীবনভর কিন্তু একটি বারও খুড়িনি আকাক্সক্ষার কবর।’


৩.উপত্যকা বোধ ও বোঝাপড়ার (াধষষবু ড়ভ রিংফড়স) : এই উপত্যকা অতিক্রম করার বিভিন্ন পথ, বিভিন্ন পাখি বেছে নেয় নিজের নিজের ভিন্ন পথ এবং অমান্য করার ভিন্ন ভিন্ন আইন। কেউ কারও মতো নয়, সবাই যার যার মতো। এখানে পাখিরা বুঝতে পারে তাদের সারা জীবনে অর্জিত জ্ঞান সম্পূর্ণ মূল্যহীন, তাদের বোধ স্ব-বিরোধী ও দ্বৈত চিন্তায় ভরপুর।
যদি সময়কে থামিয়ে দেয়া হয়, তবে কিন্তু শুরুও থাকে না, শেষও থাকে না, থাকে শুধু অন্তহীন উড়াল। (ডরঃয ঃরসব ংঁংঢ়বহফবফ, ঃযবৎব রং হড় নবমরহহরহম ড়ৎ বহফ , ড়হষু বহফষবংং ভষরমযঃ).  
পাখিরা চিৎকার করে প্রশ্ন করে, ‘আমরা কোথায়? বোধের এই উপত্যকায় আমাদের যে কোনই বোধ নেই ।’
হুপো বলে, ‘মনোযোগ চাই, অখ- মনোযোগ এখানে। আমরা একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে যাচ্ছি। কেউ জানে না আরও কত সময় আমাদের যেতে হবে এবং আরও কতদূর! তোমরা কি সেই পাখির গল্প শুনেছো যে পথ হারিয়েছিল এবং কেউ তার সন্ধান করে নাই? কেউ না। সে পাথরে পরিণত হয়েছিল... এবং তার চোখ থেকে ঝরেছিল ছোট ছোট নুড়ির অশ্রু কণা।’


৪. উপত্যকা বন্ধন মুক্তির (াধষষবু ড়ভ ফবঃধপযসবহঃ) 
(ওঃ রং যবৎব ঃযধঃ ধষষ পঁৎরড়ংরঃু ধহফ ফবংরৎব বীঢ়রৎব) বন্ধন মুক্তির উপত্যকায় সব কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা ও আকাক্সক্ষা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পাখিরা কোনো কিছু রাখার বা কোনো কিছু জানার ইচ্ছালুপ্ত হয়ে অনুভব করে যে তারা আদি অন্তহীন এই বিশ্বসংসারের অংশ। এই জগত তাদের পরিচিত বস্তুজগতের বাইরে। নতুন এই জগতে নক্ষত্ররাও ধূলিকণার সমান, একটা হাতিকে একটি পিঁপড়ার থেকে তফাত করা যায় না।
পাখিরা এখানে উড়ে আসতেই অনস্তিত্বের গর্ভ থেকে অকস্মাৎ এক হিং¯্র টর্নেডো ছুটে আসে গর্জন করতে করতে এবং সমস্ত মহাদেশ ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। যদি সমস্ত মহাকাশ তার সমস্ত নক্ষত্রদের নিয়ে বিস্ফোরিত হয় এই উপত্যকায়, তাও গণ্য হবেন একটি পাতার কম্পনের মতো।
এখানে একটি নগণ্য মাছও একটি বিশাল তিমির চেয়ে শক্তিশালী এবং কেউ জানে না কী এর কারণ।  
গ্রহাচার্য খেচর সমস্ত গ্রহ ও নক্ষত্রপুঞ্জের পথ নির্ণয় করে এঁকে রাখে বালুর টেবিলে কিন্তু ধুলিঝড় এসে সব মুছে দিয়ে যায়। মনে হয় অটুট আমাদের এই পৃথিবী, অথচ বাস্তবে শুধুই ধুলি কণা!
হুপো চিৎকার করে বলে, ‘পাখিরা, ভুলেও কেউ এখানে থামার চিন্তা করো না।’

৫. উপত্যকা ঐক্যের (াধষষবু ড়ভ ঁহরঃু): 
(অষষ যিড় বহঃবৎ যবৎব ধৎব নড়ঁহফ ধঃ ঃযব হবপশ নু ড়হব ৎড়ঢ়ব)
ঐক্যের উপত্যকায় প্রবেশ করে যারা তাদের সবার ঘাড়ে একই রজ্জু বাঁধা। এখানে এসে তারা বুঝতে পারে যে ঐক্য ও অনৈক্য আসলে একই জিনিস। তারা শূন্যের মধ্যে এক একটি সত্তা এবং এখানে কাল বা মহাকাল বলে কিছু নেই। ঈশ্বর ঐক্য, অনৈক্য, মহাকাল ইত্যাদির উর্ধ্বে। 
তোমার হয়তো মনে হবে তুমি এখানে অনেককে দেখতে পাচ্ছ কিন্তু বাস্তবে হয়তো সামান্যই কয়জন অথবা একজনও নেই। 
এই উপত্যকায় এসে নিঃশেষিত পরিশ্রান্ত পাখিরা ঘুমে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। একটি বাদুড় উড়ে আসে এ সময়। প্রশ্ন করে, “সূর্যের কী কোনো খবর আছে তোমাদের কাছে? আমি তো সারা জীবন অন্ধকারে উড়েছি। আমি সূর্যকে খুঁজে পাই না। সূর্যের অস্তিত্ব কি আদৌ আছে?”

একটি ছোট পাখির চোখে ঘুম নেই ।
হুপো বলে, “ছোট পাখি, তুমি কেন ঘুমাওনি এখনো, আমাদের সবারই বিশ্রাম দরকার।”
ছোট পাখি, “আমি কখনই আমার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি না। হয়তো একদিন আমি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, অন্যদিন সব কেমন অনিশ্চিত ও ধূসর। একদিন আমি হতাশায় ডুবে থাকি, অন্যদিন আশায় উড়ি অতি উঁচুতে। আমি আসলেই ভীষণ দুর্বল ভঙ্গুর... ও অযোগ্য ও ঊন।”
হুপো বলে, “আমাদের প্রত্যেকেরই মন আশা নিরাশায় দোলে। শুধু উড্ডয়নে হৃদয় বিশুদ্ধ হয়”

৬. উপত্যকা বিস্ময় ও বিহ্বলতার (াধষষবু ড়ভ ধসধুবসবহঃ): 
(চষধপব ড়ভ পড়হংঃধহঃ ঢ়ধরহ ধহফ নবরিষফবৎসবহঃ)
যখন পাখিরা ষষ্ঠ ভ্যালিতে উড়ে আসে হঠাৎ পাখার নিচে সব কিছু অদৃশ্য হয়ে যায়। তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, অস্থিরতা ঘিরে আসে। তারা হতভম্ব ... বিস্মিত বিহ্বলিত ...
অসম্ভব বেদনা ও হতাশা গ্রাস করে তাদের। অনুভব করে যে তারা কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু বোঝে না। এমন কি তারা নিজেদের সম্পর্কেও সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
অবিরল বেদনা ও বিভ্রান্তির উপত্যকা এই...
‘তুমি ভুলেও চোখ খুলে তাকিও না এখানে, নিও না শ্বাস-নিশ্বাস, এখানে ব্যথা ও বেদনারা সুতীক্ষè খঞ্জন হয়ে বিদ্ধ করে।’
দুঃখ পাখি  বলে ওঠে, ‘আমরা খুব বেশি দূরে চলে এসেছি। ভয় হচ্ছে যে, আমরা আর কোনোদিন ফিরে যেতে পারবো না।’
হুপো বলে, ‘পেছনে ফেরা? জীবন তো একটি বৃত্তের মধ্যে। ফিনিক্স পাখির কথা ধরো। সে এক হাজার বছরেরও বেশি নিঃসঙ্গ বাঁচে, অনেক অনেক জ্ঞান অর্জন করে। যখন তার চলে যাবার সময় আসে সে পাতা জড়ো করে চারপাশে, তারপরে পাখা ঝাপটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তার ছাই থেকে জন্ম হয় নতুন ফিনিক্সের। আমরা সামনের দিকে যাচ্ছি পাখি, পিছনে নয়।’ 

৭. উপত্যকা মৃত্যুর (াধষষবু ড়ভ ধহহরযরষধঃরড়হ): 
(ঐবৎব ুড়ঁ ংবব হড়ঃযরহম, ভববষ হড়ঃযরহম ধহফ ঃযবৎব রং হড়ঃযরহম)
তারপরে তারা মৃত্যু উপত্যকায় এসে উপস্থিত হয়। এখানে বঞ্চনা, ভ্রান্তিপ্রবণতা, নির্বুদ্ধিতা, বধিরতা ও মৃতু্যু। এখানে কিছুই দেখা যায় না, কিছুই অনুভূত  হয় না। এখানে অনস্তিত্বের সীমাহীন শূন্যগর্ভ। হৃৎপি- এখানে স্থির ও অচঞ্চল, এবং বোধাতীত বহু রহস্যের আঁধার এই স্থান।
শত শত, সহ¯্র,অযুত ও নিযুত পাখি উড়াল দিয়েছিল অনির্দিষ্টের পথে। ভরে দিয়েছিল পৃথিবীর প্রতিটি পথ, প্রতিটি কোণ, কিন্তু সবাই সফল হয় নাই, পৌঁছে নাই সবাই। কেউ কেউ বেদনা ও ভয়ে আত্মবিশ্বাস লুপ্ত হয়ে অলক্ষিতে পালিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে। অন্যেরা পথ চলেছে অবিরত কিন্তু অভিভূত হয়ে হারিয়েছে পথ ও বিবেচনাবোধ। অনেকে মরেছে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায়, সূর্যতাপে, মহাসাগরের অসীমতা ও একঘেয়েমির ব্যাপ্তিতে। কিছু ছিন্নভিন্ন হয়েছে হিং¯্র পশুদের থাবায়। আর কিছু পথের ভয়াল অভিজ্ঞতায় হয়েছে বোধিলুপ্ত উন্মাদ।
অবশেষে ছিন্ন পালক ক্লান্ত ও আশাহীন কিছু পাখি অতিক্রম করে এসেছে সপ্ত উপত্যকার সীমানা।
পাখিরা প্রশ্ন করে, ‘জীবিত, না মৃত আমরা?’
‘কোথায় সেই রাজা, যার কাছে উত্তর আছে সকল প্রশ্নের?’
‘আমরা এতদূর, এত দীর্ঘপথ পার হয়ে এসেছি, কই সে? কোথায় দেখা পাবো তার?’
‘আমরা? আমরাই কি অতিক্রম করে এসেছি এই সব উপত্যকা!’
হুপো, ‘উপত্যকা? কিসের? সে তো শুধু মায়া, মোহ ও বিভ্রম পাখিরা! শুধুই স্বপ্ন, আমরা এখনো কিছুই অতিক্রম করি নাই। আমরা সবে আমাদের যাত্রার শুরু করতে যাচ্ছি।’
কিছু পাখি থ ! তারা বিশ্বাসই করতে পারে না। কিছু পাখি সঙ্গে সঙ্গে আশা হারিয়ে মৃত ঝরে পড়ে আকাশের কোল থেকে। আর কিছু উড়তে থাকে...
উড়ছে ...
উড়ছে...
উড়ছে...
তারপরে দূরে, বহু দূরে, দেখা দেয় কাফ পর্বত। মাত্র ত্রিশটি পাখির ছোট্ট একটি দল! 
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, নিজেদের মাঝখানে অবরুদ্ধ, যারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে আর কোনো চেষ্টা না করার, 
যাদের আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই উড়ার...
‘কাফ পর্বত! আমরা আমাদের রাজা সিমুর্গের সন্ধানে এসেছি। দুয়ার খোল, যেতে দাও।’
পর্বত, ‘ঘরে ফিরে যাও পাখিরা, ফিরে যাও, তোমরা ধুলা ও আর ছাই ছাড়া কিছুই নও।’
পাখিরা, ‘দয়া করো, একটু দয়া!’
হুপো, ‘ক্ষমা করো, পাখিরা, আমি আমার নিজের মোহ ও ইগো দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম! আমি হয়তো তোমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারিনি।’
পাখিদের মধ্যে গুঞ্জন, অবিশ্বাস ও বিহ্বলতার বিপন্নতা!
তারা এখন কী করবে জানে না। 
পর্বত বলে ওঠে, ‘তোমরা এখনো ফিরে যাওনি? আচ্ছা আসো!’
মায়াবী পর্দা খুলে যায়, পাখিরা প্রবেশ করে একজন একজন করে।
তারা দেখতে পায় নীল জলের স্বচ্ছ হ্রদ এবং সেই হ্রদে সূর্যের রশ্মিতে ত্রিশটি উড়ন্ত পাখির প্রতিবিম্ব।
তারা বিস্মিত হয় এবং তখনই দেখতে পায় রাজা সিমুর্গকে!
এবং রাজা সিমুর্গ আসলে তারাই । 
ত্রিশটি পাখি!
যারা অভীপ্সার অনুসন্ধানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, নিজেদের অতিক্রম করে, ভয়, পাপ, পঙ্কিলতা, লোভ, রিপু, ইগোর পরিখা পার হয়ে, পরিণত হয়েছে বিশুদ্ধতম সত্তায়। 
এবং তারা পৌঁছেছে তাদের রাজার কাছে। 
সেই রাজার উপস্থিতির বিশালত্বের মহা মহাসমুদ্রে তারা বুঝতে পারে যে রাজা আসলে তারাই।
তাদের প্রত্যকে, এবং সবাই সমষ্টিতে।
তাদের সত্তাই হলো সিমুর্গ,
সিমুর্গের অন্তর্নিহিত সত্তা তারাই।
( অহফ ঃযবু ংবব ঃযবু ধৎব ঝরসড়ৎময ঃযব শরহমৃ. ধহফ ঃযধঃ ঝরসড়ৎময ঃযব শরহম রং বধপয ড়ভ ঃযবস ধহফ ধষষ ড়ভ ঃযবস)

বিহ্বলতার জগত থেকে চেতনে ফিরি, গান বাজছে : ‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে নইলে মোরা রাজার সনে মিলবো কি সত্যে...’

এই লেখাটির জন্য আমি নীচের তিনটি বই ব্যবহার করেছি। কিছু বাক্য সরাসরি ভাষান্তর করেছি 
ঞযব পড়হভবৎবহপব ড়ভ ঃযব নরৎফং - চবঃবৎ ঝরং
ঞযব পড়হভবৎবহপব ড়ভ ঃযব নরৎফং-অষবীরং ণড়ৎশ খড়সনধৎফ 
ঞযব পড়হভবৎবহপব ড়ভ ঃযব নরৎফং-ঊফধিৎফ ঋরঃুমবৎধষফ 
উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি নিশাপুর শহর ও কবি আত্তার সম্পর্কে
 

menu
menu