করোনাকালের ভাবনা 

করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ মানবজাতির জন্য অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ তার বিচার-বিবেচনা করার ক্ষমতা আমার নেই। এটা করতে পারেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী, জীবাণুবিশেষজ্ঞ, ওষুধ গবেষক, পরিবেশবাদী কর্মী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং দার্শনিকরা। খেটেখাওয়া মানুষ তথা শ্রমিকদের চিন্তা  করার বিষয় নয়। বরং তাদের জন্য এই মহামারিতে বেঁচেবর্তে থাকার একটি কঠিনতম লড়াইয়ের নাম করোনা। এই নির্মম সত্যকে জয় করা কতখানি সম্ভব হবে বা হচ্ছে তাও আমাদের কাছে এখন সুস্পষ্ট। করোনা নামক এই মহাসত্যটি নানাদিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়াকে কুপোকাৎ করে দেখিয়ে দিয়েছে তাদের অভ্যন্তরীণ সভ্যতা ও উন্নত সমাজব্যবস্থা কতখানি নড়বড়ে, কতখানি মিথ। নয়া অর্থনৈতিক শক্তি চীন কতখানি নির্মম হতে পারে!মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় কঠোরতাও কত ভঙ্গুর! মোদ্দাকথা, যোগ-বিয়োগ করার পর করোনা যে একটি বহুমাত্রিক শিক্ষা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। 

করোনা নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে, রাজনীতি হচ্ছে, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে এবং তাৎক্ষণিক সাহিত্যও রচিত হচ্ছে কম বেশি। সত্য-মিথ্যা সংবাদে অসংখ্য পত্রপত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়া সয়লাব হয়ে যাচ্ছে যা বিরক্তিকর। কুসংস্কারে নিমজ্জিত মানুষেরা কীভাবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে তা দেখার মতো। এই উদ্ভূত ভাইরাসজনিত অসুখটি পৃথিবীর মানুষকে অসুস্থ, ভীত, সন্ত্রস্ত এবং অস্থির মানসিক রোগী করে ফেলেছে। তার অপ্রতিরোধ্য অভিযান শ্রেণি বিভাজন মানছে না, বাস্তববাদী ও অদৃষ্টবাদী সব মানুষকেই ধরাশায়ী করে দিচ্ছে। 

অন্যদিকে, জরুরি অবস্থা জারি এবং শহর-লোকালয়কে লক ডাউন করে দিয়ে তথা এক ধরনের সান্ধ্যআইন বলবৎ করার কারণে বিবিধ দূষণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ধরিত্রী ও তার পশুপাখি, কীট, উদ্ভিদ, ফুলবৃক্ষ, জলাধার নতুন প্রাণ পেয়ে সবুজ, সুন্দর, সতেজ এবং স্বর্গীয় মনলোভারূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। কী জানি কেন, এই দৃশ্য থেকে মনে হচ্ছে, অতিরিক্ত উলম্ফন ভালো নয়, আমূল পরিবর্তনের হেতু হয়ে দাঁড়ায়—এই চিরসত্যটির জয় হয়েছে। এই শিক্ষাটাই মনে হয় মানুষ ভুলে যায়, ভুলে থাকে এবং ভুলে ছিল। 

না, এরপরেও মানুষের শিক্ষা হয় না, হয়নি অতীতেও। শত বছর পর পর এরকম মহামারি দুর্যোগ, মানুষসৃষ্ট অথবা প্রকৃতিসৃষ্ট পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে মার মার রূপে, লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই দুর্যোগের শিকার হয়েছে। তবে যত বড় দুর্যোগ বা মহামারিই হোক না কেন, যত দুর্র্ধর্ষ ঝড়বৃষ্টিই হোক না কেন, একসময় তাকেও থামতে হয়। প্রকৃতিই পরিত্রাণ বাতলিয়ে দেয়, না হয় বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক বা গবেষক উদ্ধারের পন্থা খুঁজে বের করেন। তারাই ত্রাণকর্তা। তারাই অবতার হিসেবে ধরায় আবির্ভূত হন। কিন্তু কোনো ধর্মীয় গুরু, পুরোহিত কিছুই করতে পারেন না। কেন পারেন না, এটা সচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ মাত্রই জানেন। করোনা-জীবাণুর সঙ্গে গোমূত্র জড়িয়ে ফেলা যে কত বড় ভণ্ডামি তা ভারতের ধর্মান্ধরা প্রমাণ করে ছেড়েছে। 

এই ধরনের দুর্যোগ বা মহামারিতে দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে সাধারণত সুযোগসন্ধানী এবং দায়দায়িত্বহীন হয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং গোঁড়া ধার্মিকরা। নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে অত্যন্ত সচেতন হয়ে ওঠে তারা। তার নজির বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু কলকারখানার মালিক শ্রমিকদেরকে মানুষজ্ঞান করার ক্ষমতা রাখে না, দু-তিন মাস সবেতন ছুটি দিতেই পারে, যেহেতু দীর্ঘকাল তাদেরকে ভূতের বেগারের মতো খাটিয়ে, নিমিত্ত সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে কোটিপতি হয়েছে, শূন্য থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, অন্ততপক্ষে মুনাফার অর্ধেক তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া স্বাভাবিক মানবধর্মের পরিচায়ক। কিন্তু তা তারা বেমালুম ভুলে আছে বা সেই সদিচ্ছা তাদের নেই। কোনো ধনী লোকও এগিয়ে আসছে না হতদরিদ্র  শ্রমজীবী মানুষকে রক্ষার্থে। সরকারের কথা বলে লাভ নেই, এই ক্ষেত্রে ধনী রাষ্ট্র আর দরিদ্র রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের চরিত্র একই রকম। জাপানে শুরু হয়েছে কর্মচারী ছাঁটাই ন্যায়-অন্যায়ভাবে। প্রচুর বিদেশি শ্রমিকও বেকার হয়ে পড়বে এবারের করোনাজনিত অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। তাদেরকে দেখার দায়িত্ব মানবিক কারণে রাজনীতিকদের কিন্তু কেউ এগিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। অতীতেও দেখা যায়নি। অথচ বিদেশি শ্রমিকরা যে জাপানিদের সমপরিমাণ পারিশ্রমিক পাচ্ছে বা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তাও নয়। অথচ গত শতাব্দীর ৮০-৯০ এর দশকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করেছে একচেটিয়া মোটরগাড়ি রপ্তানী করে বর্ণবৈষম্যবাদী অ্যাপার্টহেইট এর সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় জাপান। যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের ধনী হওয়ার পেছনে এটাও অন্যতম প্রধান একটি কারণ। 

একটি রাষ্ট্রের ধনী বলতে তারাই যারা রাজনীতিবিদ এবং পুঁজিপতি তথা ব্যবসায়ী। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করে ধনী হয় আর পুঁজিপতিরা শ্রমিকের প্রাপ্য পারিশ্রমিক তথা অর্থ আত্মসাৎ করে ধনী হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুঁজিপতিরাই রাজনীতিককে ক্রয় করে, তাদেরকে ধনী এবং পোষ্য করে থাকে এটা হাজার বছরের ইতিহাস। 

ব্যবসা-বাণিজ্য তথা পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এইসব থিওরি বা মতবাদ কাদের সৃষ্টি? ইহুদি পুঁজিপতিদের। এটা সম্যক শক্তিশালী ইহুদিদের একটি রাজনৈতিক মিশন বা খেলা বৈ কিছু নয়। মার্কসবাদ ও লেলিনবাদ তথা কমিউনিজম এইসব মতবাদ ইহুদিরাই টাকার বিনিময়ে গবেষণা করিয়েছে যাদেরকে দিয়ে তারাও সম্প্রদায়গত ইহুদি। কী কারণে? বিশাল সাম্রাজ্য সোভিয়েত রাশিয়ার অধিবাসী বিপুল ইহুদিকে সম্রাট  জারের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কার্ল মার্কস আর লেলিনকে কাজে লাগিয়েছে। ফলে প্রয়োগত কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে। মুক্তি মেলেনি, শান্তিও আসেনি। 

অনেক পেছনে যদি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে দেখতে পাই, মধ্যযুগেই দাস-ব্যবসা তুঙ্গে উঠেছিল ইহুদি বণিকদের মাধ্যমতো ৫০০ বছর হয়ে গেছে। আফ্রিকা থেকে বহু মানুষকে দাস করে নিয়ে গিয়ে কলকারখানা, ক্ষেতেখামার, নির্মাণ প্রকল্পে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করেছে অনেক বছর ধরে। স্বপ্নের আমেরিকা গড়েছে তারাই কিন্তু তারা তাদের প্রাপ্য অর্থ ও মর্যাদা কতখানি পেয়েছে আমরা সবাই তা জানি। একচেটিয়া ধনী থেকে ধনী হয়েছে ইহুদিরা এবং তাদের সহযোগী প্রভাবশালী খ্রিস্টানরাও। করোনা মহামারিতেও কৃষ্ণাঙ্গরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিটং পোস্ট প্রভৃতির মাধ্যমে জানা যাচ্ছে।

বহু প্রাচীনকাল থেকেই ইহুদিদের নিজস্ব কোনো বাসভূমি না থাকার কারণে ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন গোত্রের ইহুদিকে একটি রাষ্ট্রে জড়ো করার লক্ষ্য আমেরিকায় স্থায়ী প্রভাবশালী ধনী জায়োনিস্ট ইহুদিদের ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘঠিত হওয়ার মূল কারণই হচ্ছে নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং ভাগ্যবিপর্যস্ত ইহুদিদেরকে রক্ষা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইহুদিদেরই সৃষ্ট। যুদ্ধের পেছনে গভীরতর ষড়যন্ত্রে মেতেছিল কমিউনিজমে বিশ্বাসী জায়োনিস্ট ইহুদিরা, ভয়ঙ্কর ‘ভেনোনা প্রজেক্ট’ই অকাট্য প্রমাণ। এই যুদ্ধের পর বিশ্বের অর্থনীতি, অস্ত্রব্যবসা ও ডলারের নিয়ন্ত্রক তারাই হয়েছে। তাদের একটি রাষ্ট্রও হয়েছে।আজও তাদেরই হাতে বিশ্বঅর্থনীতি এবং বিশ্বশান্তি। আবার জ্ঞান-বিজ্ঞান-উদ্ভাবন-গবেষণা-সৃজনশীলতায় ইহুদিদের অবদান বিপুল এবং অনস্বীকার্য। পৃথিবীর অধিকাংশ যুগান্তকারী বিজ্ঞানীই ইহুদি বংশোদ্ভূত। পৃথিবীকে ক্রমাগত বদলে দিয়েছে এই সম্প্রদায়ের মেধাবী, প্রতিভাসম্পন্ন অগ্রসর মানুষরাই। 

আণবিক, পারমাণবিক বা জীবাণু গবেষণায় ইহুদিরা বরাবরই এগিয়ে। টেক্সাসের ম্যানহাটন অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্বকালে অ্যাটম বোমার উদ্ভাবন ও  তৈরির পেছনে যারা ছিলেন তারা প্রায় সবাই ছিলেন ইহুদি। মূল উদ্যোক্তা আমেরিকায় পলাতক পোলিশ ইহুদি পদার্থবিদ ড.ওপ্পেন হাইমার। অ্যাটম  বোমা তৈরির জন্য প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টকে প্ররোচিত করেছিলেন ইহুদি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। কম্পিউটার উদ্ভাবন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত প্রধান উদ্ভাবকরাও ইহুদি ছিলেন বলে জানা যায়। কে জানে বা কে বলবে করোনা নামক জীবাণু গবেষণায় ইহুদিদের হাত নেই বা ভূমিকা নেই? থাকতেও পারে। কী কারণে আজ সেটা জানা না থাকলেও অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে এই রহস্য একদিন উদঘাটন হবে। যদি ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সত্য কোনোদিন চাপা থাকবে না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহার মার্কিনী সেনাদের ওপরও ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছিল যতখানি মনে পড়ে। 

আবার এই করোনা মহামারি থেকে উদ্ধারকল্পে ইহুদি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাই যে এগিয়ে আছেন তাতেও কোনো ভুল নেই, এটা আশাব্যঞ্জক। যদিওবা করোনার প্রতিষেধক বা ভেকসিন এবং ওষুধ উদ্ভাবন নিয়ে ব্যবসা হবে, রাজনীতিও চলবে। তবুও মনে করি, পৃথিবীর মানুষের মধ্যে শান্তি ও আনন্দ ফিরে আসুক। প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুন্দর ও সতেজ রাখলে পৃথিবীটা ভালো থাকে, সুস্থ থাকে—এই চাক্ষুস অভিজ্ঞতাটা  যেন আমরা ভুলে না যাই। এটাও করোনাক্রান্তিকালের একটি মূল্যবান বাস্তব শিক্ষা। যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মের জায়গায় ধর্ম থাক, আমরা বাস্তবধর্মের চর্চা করি আর সেটা হল, কর্ম। কর্ম মানেই শান্তি ও অগ্রগতি। 

টোকিও, জাপান

menu
menu