অক্ষরের ভিতরে আমাদের জীবন

‘অক্ষরবন্দি জীবন’ পড়ে মনে হলো প্রায় একটা আবিষ্কার করলাম। আমাদের ধূসর-ঊষর সাহিত্যের দেশে এরকম একটা আশ্চর্য ক্ষুদ্রাকার হীরকখণ্ড ভিড়ের ভিতরে খুঁজে পাব আগে জানতাম না। একেবারে জানতাম না বললে মিথ্যা বলা হবে। অনেকদিন থেকে শুনে আসছি কবি ও চিকিৎসক মোশতাক আহমদ বই পড়ার স্মৃতি নিয়ে একটি বই লিখছেন। এটা তিনি কয়েকটি পর্ব বিভিন্ন ওয়েবে ম্যাগাজিনে প্রকাশ করে জানানও দিয়েছেন। প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়। নেটপাড়ায় এ বই নিয়ে অনেক সুনাম ও দুর্নাম দেখতে পেয়েছি। এরিমধ্যে ‘অক্ষরবন্দি জীবন’ নিয়ে অনেক আলোচনাও শুনেছি, উল্লেখও দেখেছি নানা সময়ে—এই সেদিন খুব সম্ভবত কবি ও সম্পাদক অমিত চৌধুরীর স্মৃতিচারণায় সপ্রশংসভাবেই। বইটি যতই পড়ছি ততই নষ্টালজিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছি সে শৈশবের বেলায়, যখন আমি জীবনে প্রথম ‘আউট বই’ পড়েছিলাম। আমার শৈশবে তথা আমাদের গ্রামীণ এলাকায় একাডেমির বইয়ের বাইরের বইকে বলা হতো ‘আউট বই’। ক্লাসের পড়া ফেলে এই ‘আউট বই’ পড়ার কারণে সেজ মামার কাছে কি মারটাই না খেয়েছিলাম। তবে সে সময়ে ‘আউট বই’ বলে যে বইটির জন্য মাইর খেয়েছিলাম ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা।’ বইটির নাম দেখে মামা হয়ত আমাকে ইঁচড়ে পাকা ভাবছিলেন। ওই সময় বইটিতে কী বুঝানো হয়েছে তা বুঝতে না পারলে পড়ে মজা পেয়েছি বেশ। মামা অবশ্য এ ধরনের বই না পড়ার অনুরোধ জানিয়ে ‘ঈশপের গল্প’ নামে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। ‘অক্ষরবন্দি জীবন’ পড়ে জানতে পারলাম সেটি মোশতাকেরও শৈশবের পাঠ্য ছিলো।

‘অক্ষরবন্দি জীবন’ বইয়ের লেখক মোশতাক আহমদ একাধারে কবি, গদ্যকার ও অনুবাদক। দশক বিচারে আশির দশকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। আশির দশকে প্রকাশ করেন ‘সড়ক নম্বর দুঃখ / বাড়ি নম্বর কষ্ট’ নামক কবিতার বই। এরপর থেকে মেডিকেল পেশার পাশাপাশি থেমে নেই তার লেখালেখি। ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছেন ৬ খানা কবিতার বই, ‘তিন ভুবনের যাত্রী’ নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, লিখেছেন ছোটগল্প—‘স্বপ্ন মায়া কিংবা মতিভ্রমের গল্প’ তার প্রকাশিত গল্প গ্রন্থ। অনুবাদও করেছেন বিদেশি অনেক কবিতা। ‘অনুদিত মহাদেশ’ নামে একটি অনুবাদ কবিতাগ্রন্থ ই-বুক করেছেন। ‘অক্ষরবন্দি জীবন’ মোশতাক আহমদের বই পড়ার স্মৃতি নিয়ে একটি অসাধারণ বই। বইটিতে শিরোক্তি-তে

গল্পকার শাহাদুজ্জামান লিখেছেন, ‘বইপত্রের ভেতর আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে। তাতে যেটা হয়েছে যে অক্ষরের ভেতর দিয়ে পৃথিবীকে দেখা, জীবনকে দেখার একটা পাঠ আমার শুরু হয়ে গেছে শৈশব এবং কৈশারেই। অক্ষরের ভেতর দিয়ে জীবনকে দেখলে তাকে মায়াবী দেখায়। লেখালেখি তো মূলত এই অক্ষরের ভেতর দিয়েই দ্বিতীয় এক জীবন রচনা করা’।

সত্যি বইয়ের ভেতর আমাদের শৈশব-কৈশোর এবং বর্তমানে যৌবনকাল কাটছে। অক্ষরের ভিতরে আমাদের জীবন শুরু হয় শৈশব কালে; এই অক্ষরের ভিতর দিয়ে আমরা বড় হই এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করি। একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি পড়ি অনেক বই। প্রত্যেক মানুষই এ কাজটি করেন। তবে যারা বই পড়তে বেশি ভালোবাসেন এবং বইয়ের ভিতরে নিজের সুখ ও সমৃদ্ধি খুঁজেন তারাই বেশি পড়েন। যারা লেখালেখি করেন তাদের তো বই না পড়লে হয় না। বই পড়ে জ্ঞানার্জন করা-ই মোক্ষম। আর এই বই পড়ার স্মৃতি নিয়ে বই করাও তো আরো মহৎ কাজ। বই পড়ার স্মৃতি নিয়ে যিনি বই লিখেন তার মাধ্যমে অনেক বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায় এবং যারা পড়ছেন তারাও বইটি পড়ার আগ্রহ থেকেই থাকে। বই পড়ার স্মৃতি নিয়ে একক তেমন একটা রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। হয়তো এটাই আমার সীমাবদ্ধতা ও অক্ষতা। কবি মোশতাক আহমদ এ যাবৎ পড়া বই নিয়ে একটি আস্ত বই লিখেছেন তার জন্য সাধুবাদ। মোশতাক ‘অক্ষরবন্দি জীবন’-এ ২৬টি প্রবন্ধ একত্র করেছেন। এ ২৬টি প্রবন্ধের মধ্যে আমার নজর কেড়েছে ‘বইয়ের গন্ধ’, ‘সে এক স্বপ্নের জগৎ, সে এক মায়ার জগৎ’, বই ধার দিও না’, ‘কবিতার ঘর ও বাহির’, ‘মননশীল পুরষ্কার’, ‘জল দেখে ভয় লাগে’, ‘একটি কবিতার স্মৃতি’, ‘ কক্সবাজারের উপহার’, গানের শহর, কবিতার শহর’ এবং বিকল্প আত্মজা : আমার প্রথম বই’ নামক প্রবন্ধগুলো। প্রত্যেক লেখকের ‘বইয়ের গন্ধ’ থাকে; মোশতাকের সেই গন্ধ ছিলো। আমারও তাই। এ শিরোনামের প্রবন্ধে কবি মোশতাক অনেক পড়ার স্মৃতি উল্লেখ করেছেন যে বইগুলো বিকাশকালীন সময়ে অবশ্য পড়া দরকার। এখানে কবি পড়েছেন, আশুতোষ-নিমাই-ফাল্গুনির চিতা বহ্নিমান কিংবা প্রিয় বান্ধবী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কাব্য সঞ্চয়ন’, পল্লীকবি জসিম উদদীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ড. হাসান জামানের ‘চার খলিফার জীবনী কিংবা রুশ দেশের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’।

‘বই ধার দিও না’ শিরোনামের লেখাটি দেখে মনে করেছিলাম বই ধার দেওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে হয়তো আলোচনা করেছেন। মনে করছিলাম মোশতাক হয়তো বই ধার দিয়ে সে বই আর ফেরত পাননি বলে খেদোক্তি করে লেখাটি লিখেছেন কিন্তু পড়ে জানতাম পারলাম ‘বই ধার দিও না’ একটি বই। লেখক, বুদ্ধদেব বসু। লেখাটি পড়ে জানতে পারলাম মোশতাক আহমদ জীবনে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার নিয়ে বই পড়ার স্মৃতিচারণ করেছেন। ধার নিয়ে পড়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনিও বেশ কয়েকটি বই ধার নিয়ে নিজের মনে করে রেখে দিয়েছেন। যা প্রায়ই লেখকের বেলায়ও হয়ে থাকে।

লেখাটি আরো জানতে পারলাম আমার কাছ থেকে ভুমেন্দ্রে গুহের ‘আলেখ্য : জীবনানন্দ’ বইটি ধার নিয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এ লেখায় বিভিন্ন সময় ধার নিয়ে যে সব বই পড়ার কথা বলেছেন তার মধ্যে ‘বাঙালির হাসির গল্প, নেংটি ইঁদুরের গল্প, মাহমুদুল হকের প্রতিদিন একটি রুমাল, সুকান্ত বিচিত্রা, তলস্তয়ের পুনরুজ্জীবন, মরুতীর্থ হিংলাজ, টিন ড্রাম, আন্না কারেনিনা, তালাশ, রফিক আজাদের কবিতাসংগ্রহ, এম সেজায়ারের দেশে ফেরার খাতা, ঘুমের দরজা ঠেলে, দোজখনামা।

‘কবিতার ঘর ও বাহির’ নাম্নী শিরোনামের লেখাটির পরিচায়ক কবিকে লিখতে হলে ছন্দ আয়ত্ত করা দরকার এবং এই ঘরানার বই পড়া আবশ্যক। পুর্ণেন্দু পত্রীর ‘কবিতার ঘর ও বাহির’ বইয়ের নামে এ শিরোনাম রাখা হয়েছে। এ লেখায় তিনি কবিতা এবং কবি হতে যে সব পড়ার কথা বলেছেন তার মধ্যে ‘নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ ও ‘কবিতা কী ও কেন’, সুভাষ মুখার্জীর ‘কবিতার বোঝাপড়া’, শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা। কবিতার ঘর ও বাহির বই পড়ে আমরা জানতে পারি বিশ্বকবিতার দিকপাল আর ব্যতিক্রমী প্রতিভাদের জীবনের অ্যানেকডটস। এ লেখাটি লিখে মোশতাক আহমদ আমাদেরকে অনেক জরুরি বিষয় জানান দিয়েছেন।

‘কবির সাথে পরিচয়ের দিনগুলো’ শিরোনামের মাধ্যমে জানতে পারি স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমানের সাথে মোশতাক আহমদের পরিচয় পর্ব। এ পর্বে মোশতাক শামসুর রাহমানের ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, বিধ্বস্ত নীলিমা, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’ দুঃসময়ের মুখোমুখি, ‘নিজ বাসভূমে, নিয়ত মন্তাজ, কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি পড়ার স্মৃতি উল্লেখ করেছেন।

‘একটি কবিতার স্মৃতি’ শিরোনামের লেখাটা কবি ও মূল্যায়ন সম্পাদকে নিয়ে লেখা। ২০১০ সালে অমিত চৌধুরীর ষাট বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত অমিত চৌধুরী কর্মকৃতি মূল্যায়ন স্মারকে প্রকাশিত হয়েছে। এ লেখায় মোশতাক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন সময়ের একটি স্মুতি তুলে ধরতে গিয়ে কবি অমিত চৌধুরীর ‘চোখ রেখেছি তোমার চোখে’ কবিতাটি নব্বইয়ের উত্তাল সময়ে তাঁর ক্যাম্পাসে জনপ্রিয় হয়েছিল বলে মোশতাক উল্লেখ করেছেন।
‘কক্সবাজারের উপহার’ শিরোনামের লেখাটি তিনি চাকুরিসূত্রে কক্সবাজারে থাকাকালীন কক্সবাজারে কবি সাহিত্যিকদের সাথে আড্ডা, সেমিনার, পুরষ্কার প্রদান এবং কক্সবাজারের কবি লেখকদের বই উপহার দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন কক্সবাজারের কবি লেখকদের প্রকাশিত বইয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা ।

আলোচনা করেছেন খোকন কায়সারের গল্প, অমিত চৌধুরীর মূল্যায়ন ও ‘ ধোঁকাবাজ ধোঁকারাজ’, কবি মানিক বৈরাগীর ‘গহীনে দ্রোহ নীল’, শুভ্রতার কলঙ্ক মুখস্থ করেছি’, সিরাজুল হক সিরাজের ‘রূপচাঁদা কঙ্কাল’ ‘বোঁয়াড়ি’, ‘ঘিলাফুল’, খালেদ মাহবুব মোর্শেদের ‘সম্পন্ন সাম্পান’, মহাপ্লাবনের পলি’, ‘আয়না জোড়া অন্ধকার’, আসিফ নূরের ‘শরবিদ্ধ শরের শহর’, ভাগ্যধন বড়ুয়ার ‘অপর পৃষ্ঠার বৃত্তান্ত’, আলী প্রয়াসের ‘নুড়িপাথরের ঘ্রাণ, জলপাহাড়ের ভূগোল, স্বরূপ সুপান্থের ‘জলকামানের বই’সহ অসংখ্য বইয়ের। আলোচনা করেছেন নিলয় রফিক ও মনির ইউসুফ এবং অকাল প্রয়াত মাসউদ শাফির কবিতা ও যাপিত জীবনের। শুধু তাই নয়, মোশতাক আহমদ এই লেখকের প্রসঙ্গও আলোচনা করেছেন। আমার প্রকাশিত বই ‘ভাষা আন্দােলনে কক্সবাজার’ ও ‘রাজাকারনামা’ বইয়ের কথাও উল্লেখ করেছেন। চাকুরি সূত্রে থাকাকালীন আমাদের কক্সবাজারের লেখকদের সাথে সময় দিয়ে এবং কবিতা ও লেখার আলোচনা করে আমাদের ধন্য করেছেন তিনি।

কবি মোশতাক আহমদের বই পড়ার স্মৃতি নিয়ে লিখিত ‘অক্ষরবন্দি জীবন’ বইটির মাধ্যমে আমাদের জানান দিয়েছেন বই পড়ার স্মৃতি নিয়ে লেখাটা কত মজার এবং মধুর স্মৃতির। এই বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। বইটি সবার কাছে সমাদৃত হোক এ প্রত্যাশায়।


• কক্সবাজার

menu
menu